Friday, May 17, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পদ্য ওভাল পর্ট্রেইট - এডগার অ্যালান পো

দ্য ওভাল পর্ট্রেইট – এডগার অ্যালান পো

অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র | Edgar Allan Poe Books

আমার খানসামার একান্ত ইচ্ছা একটা রাত আমি মুক্ত বাতাসের মধ্যে কাটিয়ে শরীর ও মনটাকে একটু চাঙা করে নেই। এরকম চিন্তা করে সে ধরতে গেলে জোর করেই সে আমাকে নিয়ে সে পল্লী ভবনটায় তোলে সেটা বহুদিন যাবই অ্যাপেলাইন পর্বতমালার ফাঁক ফোকড়ে অবস্থিত, বিষণ্ণতা আর জাঁকজমকের মিশ্রণে গড়ে ওঠা বহু বস্তির মধ্যে সবচেয়ে সেরা।

বাড়িটার পরিস্থিতি এক নজরে দেখে অনায়াসেই অনুমান করে নেওয়া যায় সে, দিন-কয়েক আগেই সেটা কয়েকের দিনের জন্য অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। কারণ, দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলে যা-কিছু চোখে পড়া সম্ভব, সে রকম তেমন কিছু নজরে পড়ল না।

বাড়িটার ভেতরে ঢুকে বাছাবাছি করে ছোট একটা ঘর আমরা বাস করার জন্য বেছে নিলাম। ঘরটায় খুবই সামান্য আসবাবপত্রও সাজানো রয়েছে দেখলাম। ভাবলাম, এতেই দিন কয়েক দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যাবে। অতএব আমরা তাতেই মাথা গুঁজলাম।

আমাদের মাথা গোঁজার ঘরটা বাড়িটার একান্তে–একেবারে এক কোণে অবস্থিত আর একটা বুরুজের তলায়।

ঘরের ভেতরে যে সরঞ্জাম আছে সেগুলোর সংখ্যা তেমন বেশি না হলেও দেখেশুনে খুবই মূল্যবান বলেই মনে হল। দেওয়ালে একটা সুদৃশ্য পর্দা ঝুলছে। তাতে যুদ্ধজয়ের হরেকরকম স্মারক সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও আছে অত্যাধুনিক অগণিত ছবি, বহুমূল্য সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো। সব মিলিয়ে বহুমূল্যই বটে।

ছবিগুলো কেবলমাত্র সামনের দেওয়ালেই নয়, ঘরটার কোণাগুলোতেও বেশ কয়েকটা খুবই নিপুণ-হাতে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এমনও হতে পারে, আমার অসুস্থতার প্রাথমিক প্রলাপের অবস্থার জন্যই সে ছবিগুলোর প্রতি আমার আকর্ষণ একটু বেশি মাত্রায়ই হয়। একের পর এক ছবি দেখে আমি ক্রমেই মুগ্ধ হয়ে উঠতে লাগলাম।

ঘরটার চারদিকে বার-কয়েক চোখের মণি দুটোকে বুলিয়ে নিয়ে ভাবে গদগদ হয়ে আমি খানসামা পেড্রোকে কাছে ডাকলাম।

পেড্রো ঘর গোছানো আর বিছানাপত্র গোছ করতে ব্যস্ত। আমার ডাক শুনে হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে এসে আদেশের অপেক্ষায় সামনে দাঁড়াল।

আমি তাকে হুকুম দিলাম–‘ওসব কাজ পড়ে হবে, আগে ঘরের খড়খড়িগুলো টেনে নামিয়ে দাও।

পেড্রো আমার এরকম জরুরি হুকুমের উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আমি তার গড়িমসির ব্যাপারে কোনো কথা না বলে বরং মুচকি হেসেই বললাম–‘আরে দেখতে পাচ্ছ না, বাইরে কেমন রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।

পেড্রো এবার জানালার দিকে এগিয়ে গেল। টানাটানি করে সব কয়টা জানালার খড়খড়ি নামিয়ে দিল।

আমি বললাম–এবার বিছানার কাছের লম্বা-লম্বা বাতিদানের সব কয়টা মোমবাতি জ্বেলে দাও। তারপর বিছানার ওপরের কুচি-দেওয়া ভেলভেটের মশারিটার দড়িগুলো খুলে ওটাকে ভাঁজ করে একপাশে রেখে দাও।

পেড্রো নিতান্ত অনুগতের মতো ব্যস্ত-হাতে মিনিট কয়েকের মধ্যেই আমার নির্দেশিত কাজগুলো এক করে সেরে ফেলল।

এমন প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক, এসব কাজ সেরে ফেলার জন্য আমি কেন খানসামা পেড্রোকে তাড়া দিলাম, তাই না? আসলে আমি ঘরটায় পা দিয়েই ছবিগুলোকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ি যে,নিদ্রাদেবীর হাতে যদি নিজেকে সঁপে দেওয়া সম্ভব না হয় তবে অন্তত ছবিগুলোকে দেখে, আর বিছানায় মাথার কাছে যে চটি বইটায় ছবিগুলোর পরিচয় ও বিবরণাদি লেখা রয়েছে তার ওপর চোখ বুলিয়েই যেন সারাটা রাত কাটিয়ে দিতে পারি। এ রকম ভেবে আমি অন্তত রাত কাটানোর ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম।

রাতে যৎসামান্য আহারাদি সেরে আমি বিছানা আশ্রয় করলাম।

আর খানসামা পেড্রো আহারাদির পর বাসনপত্র গোছগাছ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক কাজকর্ম মিটিয়ে শুয়ে পড়ল।

আমি বিছানা আশ্রয় করে বালিশের ওপর থেকে চটি বইটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। দীর্ঘ সময় একের পর এক পাতা উলটে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়তে লাগলাম।

কয়েক পাতা পড়ে বইটা ভাঁজ করে হাতে রেখে দেওয়ালে-টাঙানো ছবিগুলোর দিকে চোখ ফেরালাম। গভীর মনোযোগ আর শ্রদ্ধার সঙ্গে এক-এক করে সব কয়টা ছবিই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম।

সত্যি, সময় যে কীভাবে কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি। অস্বীকার করার উপায় নেই; আমি একাকীত্ব বোধ তো করলামই না বরং খুবই ভালোভাবে সময় কেটে যেতে লাগল।

এক সময় মাঝ-রাত হয়ে এলো।

বাতিদানটা আমার বিছানা থেকে সামান্য দূরে রয়েছে। খানসামা পেড্রোর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সে ঘুমে বিভোর। ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙিয়ে তাকে বিরক্ত করতে মন চাইল না। ফলে বাধ্য হয়েই বেশ কসরৎ করে হাত বাড়িয়ে সেটাকে টেনে এমন জায়গায় নিয়ে নিলাম যাতে মোমবাতির সবটুকু আলোই আমার বইটার ওপর পড়তে পারে। সেটা যেখানে রয়েছে সেখান থেকে সম্পূর্ণ আলো আমার হাতের বইটার পাতায় পৌঁছাতে পারে না। ফলে অসুবিধা তো একটু-আধটু হচ্ছিলই।

আরে ব্যস! বাতিদানিটা এগিয়ে নিয়ে আসার ফল যে এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে তা কিন্তু আমি ঘৃণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। সত্যি, একেবারেই অভাবনীয় ব্যাপার। খাটের একটা মশারি খাটাবার দণ্ডের ছায়ায় ঘরটার একটা কোণ এতক্ষণ আবছা অন্ধকারে ঢাকা ছিল। বাতিদানিটাকে স্থানান্তরিত করার ফলে অন্ধকার যে-কোণাটায় এবার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ল।

এতক্ষণ যে-ছবিটা আমার নজরের বাইরে ছিল এমন আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ায় সেটা স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়ে পড়ল। সেটা এক উদ্ভিন্ন যৌবনা এক রূপসির প্রতিকৃতি।

ছবিটার ওপর মুহূর্তের জন্য চোখের মণি দুটো বুলিয়ে নিয়েই যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। আর সর্বাঙ্গে কেমন যেন অবাঞ্ছিত শিহরণ খেলে গেল। ঘাড়ের কাছ থেকে একটা হিমেল স্রোত দ্রুত শিরদাঁড়া-বেয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এলো।

কেন যে আমার মধ্যে এমন অভাবনীয় ভাবান্তর ঘটে গেল তা আমি নিজেই নিশ্চিত করে বলতে পারব না। চোখ দুটো বন্ধ করে আমি তো মনে মনে আমার এমন আকস্মিক ভাবান্তরের কারণটাই খুঁজতে লাগলাম। আমি যাতে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা ভাবনায় লিপ্ত হবার অবসর পাই, নিঃসন্দেহ হতে পারি যে, আমার চোখ দুটো আমার সঙ্গে প্রতারণা করেনি। কারণ আরও আছে, ছবিটাকে যাতে আরও ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মতো বুকে সাহস সঞ্চয় করতে পারি, নিজের বিক্ষিপ্ত কল্পনাশক্তিকে একত্রিত আর সংযত ও শান্ত রাখার মতো মানসিকতা তৈরি করতে পারি। হ্যাঁ, এরকম উদ্দেশ্য নিয়েই আমি অতর্কিতে চোখ দুটো বন্ধ করে নিশ্চল-নিথরভাবে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে দিয়েও ছিলাম।

কয়েকমুহূর্ত পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার ধীরে ধীরে চোখ দুটো মেলোম। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের কোণে টাঙিয়ে রাখা ওই প্রতিকৃতিটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী ওই প্রতিকৃতিটাকে যে আমি খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি, অস্বীকার করার উপায় নেই, করতে চেষ্টাও করব না।

সত্যি কথা বলতে কি, ছবিটার ক্যানভাসের গায়ে মোমবাতির সাদা আলো প্রথম পতিত হওয়ামাত্র সে স্বপ্নজনিত অসাড়তা যা আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে অবশ,নিষ্ক্রীয় করে ফেলেছিল, তা নিঃশেষে উবে গেল। আচমকা একটা হোঁচট খেয়ে আমি যেন সম্পূর্ণ সংজ্ঞা ফিরে পেলাম,নিদ্রার ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠলাম। সংক্ষেপে বলতে গেলে, হারিয়ে যাওয়া আমাকে যেন আবার আমার মধ্যে ফিরে পেলাম।

আমি আগেই বলেছি, ঘরের কোণে টাঙানো প্রতিকৃতিটা এক উদ্ভিন্ন যৌবন রূপসির। পূর্ণাবয়ব নয়, দেহের কেবলমাত্র মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত। আর তা আঁকা হয়েছে ফল আর লতাপাতাসহ অঙ্কন-কৌশলে। আর একটু খোলসা করে বললে হয়তো আমার বক্তব্যটা অধিকতর সহজবোধ্য হতে পারে–মালি যে মস্তক অঙ্কন পদ্ধতি অবলম্বন করে ছবি আঁকেন এক্ষেত্রে সে পদ্ধতিই অনুকরণ করা হয়েছে।

প্রতিকৃতিটার বক্ষ, বাহু দুটো আর অত্যুজ্জ্বল ও দীর্ঘ কেশগুচ্ছের অগ্রভাগ প্রভৃতি অঙ্কন-শৈলীর নৈপুণ্যবশত বড়ই চমৎকারভাবে ফুল আর লতাপাতার ছায়াছায়া পরিবেশের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়েছে। আর তার ফ্রেমটা ডিম্বাকৃতি। তার চারদিকে মুরজাতির শিল্পকীর্তিতে সুদৃশ্য করে তোলা হয়েছে। শিল্পকলার কথা বিচার করলে স্বীকার করতেই হয়, ছবিটার চেয়ে ফ্রেমটা অধিকতর মন জয় করার ক্ষমতা রাখে। সত্যি সেটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আর চোখ ফেরানো দায়।

কিন্তু আমি যে অকস্মাৎ বিস্ময় বোধ করেছি তা কিন্তু মোটেই ছবিটার শিল্পনৈপুণ্য বা ফ্রেমটার মনলোভা কারুকার্য কোনোটারই কারণে নয়। এমনকি মুখটার সৌন্দর্যতা আমাকে এতখানি প্রভাবিত করতে পারেনি।

তবে? তবে কেন আমার মধ্যে এমন আকস্মিক ভাবান্তর ঘটেছিল, তাই না? আবার এমন কথাও তো বলা যাবে না, আমার কল্পনাই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠে প্রতিকৃতিটাকেই একটা প্রাণবন্ত মানুষ ভেবে ভুল করছি। না, এমন কথা বলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

আমি ওই বিশেষ প্রতিকৃতিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই অনেকক্ষণ, প্রায় একটা ঘণ্টা কাটিয়ে ছিলাম। তবে একই অবস্থায় নয়। কখন বিছানার ওপর বসে, কখনও আধ-শোয়া অবস্থায় আবার কখনও বা মেঝেতে দাঁড়িয়ে প্রতিকৃতিটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। শেষমেশ এক সময় প্রতিকৃতিটার দিকে অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকার ফলাফলের গোপন কারণটা বুঝতে পেরে আমার মনে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। আমি আনন্দে ডগমগ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আগেকার সে। বিস্ময়ানুভূতি এখন আমার মধ্য থেকে নিঃশেষে উবে গেছে।

প্র্তিকৃতিটার মধ্যে আত্মগোপনকারী প্রকৃতরহস্যটা কী তা যদি বলতে হয় তবে সংক্ষেপে যা বলা সম্ভব তা হচ্ছে, ছবিটার প্রাণময়তা। আর এ বিশেষ গুণটুকুই প্রথমে আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে। আবার আতঙ্কও কম সঞ্চার করেনি। সব মিলে আমাকে একেবারে কুপোকাৎ করে দেবার জোগাড় করেছিল।

ভীতির সঙ্গেই বাতিদানটাকে তুলে নিয়ে আবার আগের জায়গাতেই রেখে দিলাম। আমার চরম উত্তেজনার উৎসটাকে এভাবে নজরের আড়ালে রেখে দিয়ে আমি পুরোপুরি স্বস্তি লাভ করলাম। বালিশের ওপর থেকে চটি বইটাকে আবার তুলে নিলাম।

আমি মনকে নিয়োগ করলাম এসব ছবি আর তাদের অতীত-কাহিনী সমৃদ্ধ বইটার পাতায়।

সূচিপত্র দেখে ডিম্বাকৃতি প্রতিকৃতিটার সংখ্যা খুঁজে বের করলাম। পাতা উলটে নিচের এ অংশটায় প্রতিকৃতিটার সংখ্যা খুঁজে বের করলাম। পাতা উলটে নিচের এ

অংশটায় গভীর মনযোগের সঙ্গে চোখের মণি দুটোকে বুলাতে লাগলাম–

‘সে ছিল একজন যথার্থই রূপসি কুমারী কন্যা। তার রূপ-সৌন্দর্য যতটা ছিল সে তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি আনন্দময়ী ছিল।

এক অশুভক্ষণে এক চিত্রশিল্পীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছিল। তাকে মন-প্রাণ সঁপে ভালোবেসেছিল। শেষপর্যন্ত তাকে বিয়েও করেছিল। সে চিত্রশিল্পী ছিল বড় আবেগপ্রবণ, গম্ভীর আর পরিশ্রমীও বটে। আর সে ইতিমধ্যেই চিত্রশিল্পকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল। আর সে রূপসি তম্বী যুবতি? সে ছিল একেবারেই বিরল এক রূপের আকর–এক কুমারী।

সে রূপসি যুবতি যত না সুদর্শনা তার চেয়ে বেশি আনন্দে পরিপূর্ণা। তার মুখে কেবলই আলোকচ্ছটার মতো হাসির ঝিলিক সর্বক্ষণ লেগেই থাকে। আর? ছোট্ট হরিণ শিশুর মতোই সে চঞ্চলাও বটে। সবকিছুর প্রতিই তার আন্তরিক আকর্ষণ রয়েছে। ভালোবাসে–তবে কেবলমাত্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পকলাকে চরম বিতৃষ্ণার সঙ্গে দেখে, ঘৃণা করে। আর চিত্রশিল্পীর তুলি, রঙের পাত্র, রঙ আর অন্যান্য সরঞ্জামগুলোকে দু চোখ পেতে দেখতে পারে না, যারা তাকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করেছে প্রিয়-দর্শন সুখ আর আনন্দ থেকে।

তাই তো যেদিন চিত্রশিল্পী তার কাছে নিজের বাসনার কথা ব্যক্ত করল–রূপসি তষী তরুণী বধূটির প্রতিকৃতি রঙ আর তুলির মাধ্যমে ক্যানভাসের গায়ে ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী, সেদিন অন্তরের অন্তঃস্থলে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল, যারপরনাই মর্মাহত হল।

তা সত্ত্বেও সে তরুণী ছিল স্বভাবতই বিনম্ৰা বিনয়ী, বিশ্বস্ততার প্রতিমূর্তি। তাই তো সে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধীর-স্থিরভাবে চিত্রালয়ের অন্ধকার ঘরে বসে থেকেছে। যেখানে ইজেলের সঙ্গে সাঁটা ক্যানভাসের গায়ে, তার মাথার ওপর থেকে আলোকচ্ছটা ঠিকড়ে পড়ে।

এমন একটা মন না-চাওয়া পরিবেশে, নিজের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরোধী কাজের মধ্যে সে জোর করে নিজেকে লিপ্ত রেখেছে।

চিত্রশিল্পী কিন্তু তার নিজের কাজে মগ্ন আর আত্ম-প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সে কাজের মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখে আর থেকে থেকে বিভিন্ন বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করে নিজের কাজের বাহবা দেয়। ব্যস, এর বেশি কোনো কথা নয়।

সত্যি কথা বলতে কি, চিত্রশিল্পী যথার্থই এক বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ। তার কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে অসংযত প্রকৃতির, আবেগপ্রবণ আর রীতিমত মেজাজি মানুষ। নিজেকে নিয়ে, নিজের স্বপ্নের মধ্যেই সর্বদা আত্মমগ্ন থাকে।

চিত্রশিল্পী নিজের কাজ নিয়ে সর্বক্ষণ এমনই মজে থাকত যে, ভুলেও সে মুহূর্তের জন্য চোখ ফিরিয়ে দেখত না যে, সে নির্জন ঘরে সে ভৌতিক আলোর রেখাটা এসে পড়ে তার স্পর্শ লেগে নববধূর শরীর আর মন দুই শুকোতে শুকোতে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তার চোখ ও মন যে সম্পূর্ণরূপে ক্যানভাসের গায়েই আটকা পড়ে গেছে।

নববধূর শরীরের ক্রমোবনতি আর শুকিয়ে-যাওয়া মনের ব্যাপারটা সবার চোখেই ধরা পড়েছে, একমাত্র চিত্রশিল্পীর উদাসীন চোখ দুটো ছাড়া।

এত অবহেলা সহ্য করেও তরুণী নববধূ কোনোরকম প্রতিবাদ, এমনকি সামান্যতম অভিযোগ পর্যন্ত না করে মুখে হাসির ছোপ অব্যাহত রেখে একের পর এক দিন কাটাতে লাগল। এর কারণ রয়েছে যথেষ্টই। কারণ, সে তো নিজের চোখেই দেখত তার চিত্রশিল্পী স্বামী দেবতাটি তার নিজের কাজ, রক্ত-তুলি নিয়ে মেতে থেকেই পরম আনন্দ পায়। তার রূপসি তম্বী মনোরমা সহধর্মিনীর রূপ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

অথচ সে প্রেয়সীটি দিনে দিনে দেহ-মনের দিক থেকে শুকিয়ে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ছে।

অথচ এক তিল বাড়িয়ে না বললে, যারাই ইজেলের গায়ে সাঁটা প্রতিকৃতিটিকে দেখে, তারা শিল্পী আর শিল্পকর্মটির প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখে প্রশংসা শুরু করে দিচ্ছে।

সবাই আবেগে-উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে বলে এই প্রতিকৃতিটি যেমন চিত্রশিল্পীর শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় বহন করছে, ঠিক তেমনই প্রেয়সীর প্রতি তার গভীর প্রেম প্রীতির সাক্ষদানও করছে। সহধর্মিনীর প্রতি ভালোবাসা গভীর না হলে এমন একটা অনিন্দ্য সুন্দর চিত্র রঙ-তুলির মাধ্যমে কিছুতেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

কিন্তু শেষমেশ যখন চিত্রশিল্পীর সব প্রয়াস ও শ্রম পরিণতির দুয়ারে প্রায় পৌঁছে গেল, সে মুহূর্ত থেকে কাউকেই চিত্রালয়ের সে ঘরটায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো না। কেন? কারণ, কাজের নেশা চিত্রশিল্পীর মধ্যে চরমভাবে চেপে বসেছে। কাজ, কাজ করে সে প্রায় উন্মাদদশায় পৌঁছে গেছে।

কাজ! কাজ! আর কাজ! ক্যানভাসের গা থেকে চোখ সরাবার ফুরসৎ বা ইচ্ছা। কোনোটাই যে তার নেই। সর্বক্ষণ ক্যানভাসটার ওপরেই সে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। অন্য কারো দিকে তাকাবার কথা তো সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এমনকি স্ত্রীর মুখের দিকেও মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরায় না। এমনকি ক্যানভাসের ওপর সে যে রঙের প্রলেপ দিয়েছে তা-ও যে রূপসি তীর রক্ত-রাঙা গাল দুটো থেকে নেওয়া তা দেখতেও সে এ মুহূর্তে নিতান্ত অনাগ্রহী।

এভাবে রঙ, তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে যখন বেশ কয়েক সপ্তাহ গড়িয়ে গেল, শিল্পকর্মটা শেষ হতে আর সামান্যই অবশিষ্ট, কেবলমাত্র সুন্দর মুখটার ওপর মাত্র একটা তুলির টান, আর চোখের ওপর সামান্য একটু রঙ তুললেই কাজটা শেষ হয়ে যায়–ঠিক তখনই গরম তেলে পানির ছিটা পড়ার মতোই রূপসি তরুণী মনের দশা সইতে না পেরে ছ্যাৎ করে উঠল।

আর ঠিক তখনই…চিত্রশিল্পী ক্যানভাসটার গায়ে তুলিটা বুলিয়ে দিল। রঙের প্রলেপটা দিয়ে দিল। আর মুহূর্তের জন্য নিজের তুলির টানে ফুটিয়ে তোলা শিল্প কর্মটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।নিশ্চল নিথর পাথরের মূর্তির মতো সে দাঁড়িয়েই থাকল কয়েক মুহূর্ত ধরে।

কিন্তু তারপর। পরমুহূর্তে, পাথরের মূর্তির মতো অটল অনড়ভাবে দাঁড়িয়েনিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই তার সর্বাঙ্গ তির তির করে কাঁপতে লাগল। চকের মতোই ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেল তার মুখটা। পরমুহূর্তেই গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–এটাই, এটাই তো জীবন।

অকস্মাৎ যন্ত্রচালিতের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তার প্রেয়সীর দিকে তাকাল, তার প্রাণবায়ু তখন দেহ ছেড়ে গেছে, সে মৃত।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments