Saturday, April 20, 2024
Homeবাণী-কথাসংসার - হুমায়ূন আহমেদ

সংসার – হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ

একজন মানুষ এক জীবনে কতবার ‘সংসার’ করে? বেশির ভাগ মানুষের জন্য একবার। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি মানুষের জন্য দুবার। প্রথম সংসার জ্বলেপুড়ে যাওয়ার কারণে দ্বিতীয়বার। আমি, মনে হয়, কথা গুছিয়ে বলতে পারছি না। এখানে ‘সংসার’ মানে বিয়ে করে ঘর বাঁধা বোঝাচ্ছি না। হাঁড়িকুড়ি, বিছানা-বালিশ নিয়ে দিনযাপন বোঝাচ্ছি।

আমার মা অতি অল্প বয়সে বাবার সঙ্গে সংসার করতে এসেছিলেন। বাবার মৃত্যুতে মায়ের সংসার লন্ডভন্ড হয়ে গেল। তিনি তাঁর বড় ছেলের সঙ্গে ঢাকায় এলেন। নিউমার্কেট থেকে হাঁড়িকুড়ি কিনে নতুন সংসার শুরু করলেন। আমি বাবাশূন্য মায়ের নতুন সংসারে যুক্ত হলাম।

পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় গেলাম। গুলতেকিনকে নিয়ে শুরু হলো তৃতীয় সংসার। হাঁড়িপাতিল কেনা, বিছানা-বালিশ কেনা।

ঢাকায় ফিরে এসেই সেই সংসারও ভাঙল। উত্তরার এক বাসায় শুরু হলো আমার একার চতুর্থ সংসার।
বছর তিনেক পর শাওন আমার সঙ্গে যুক্ত হলো। ‘দখিন হাওয়া’য় আমার পঞ্চম সংসার।
ক্যানসার বাধিয়ে আমেরিকায় এসে শুরু হলো ষষ্ঠ সংসার।

সম্ভবত, সপ্তম সংসার হবে আমার শেষ সংসার। সেখানে কি আমি একা থাকব, নাকি সুখ-দুঃখের সব সাথিই থাকবে?
দার্শনিক কথাবার্তা থাক, ষষ্ঠ সংসার নিয়ে বলি।

বাড়ি ভাড়া করা হলো, হাঁড়ি-পাতিল কেনা হলো; টিভি কেনা, বিছানা-বালিশ—সে এক হইচই।

তিন রুমের একটি আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বাড়িটা নিশ্চয় সুন্দর। কারণ, কথাবার্তার একপর্যায়ে বাড়িতে রোগী দেখতে আসা প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘বাড়িটা কার?’

আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ‘যেহেতু ভাড়া নিয়েছি, আপাতত আমার।’

বাড়িটায় তিনটা শোবার ঘর। জানালার পাশে প্রকাণ্ড মেপলগাছ। মেপলগাছের পাতায় ফল-এর (Fall) রং ধরতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে তাকালে চোখ ঘরে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট বাড়িতে ‘এটিক’ নামের একটা ছাদঘর থাকে। এই ঘরটা হয় সবচেয়ে সুন্দর। অনেকখানি সময় আমি এটিতে একা কাটাই। লেখালেখি করি না। ছবি আঁকি। জলরং ছবি। ছবি মোটেই ভালো হচ্ছে না। রঙে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। শুধু অন্যদিন-এর মাজহার বলছে, ‘অসাধারণ!

আপনার আঁকা ছবি বিক্রি করে আমরা চিকিৎসার খরচ তুলে ফেলতে পারব, ইনশাল্লাহ।’
চিকিৎসার খরচ নিয়ে আমি এই মুহূর্তে ভাবছি না। নিজেকে ব্যস্ত কীভাবে রাখা যায়, ভাবছি তা নিয়ে।

প্রচুর বই জোগাড় করেছি (অর্থাৎ, কিনেছি)। বাড়ির পাশেই একটা পাবলিক লাইব্রেরি, তার মেম্বার হয়েছি। মেম্বার হতে গিয়ে গোপন আনন্দও পেলাম। বিদেশি লেখকদের বইয়ের তাকে দেখি আমার অনেক বই। বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, ‘বাংলা ভাষার এই বই তোমরা কীভাবে পেয়েছ?’ লাইব্রেরিয়ান বলল, ‘আমাদের বই দেয় লাইব্রেরি অব কংগ্রেস।’

আমি বললাম, ‘বাংলা ভাষার এই লেখক আমার প্রিয় লেখকদের একজন।’ লাইব্রেরিয়ান বলল, ‘হাউ নাইস! তুমি তার একটা বই ইস্যু করে নিয়ে যাও। সাত দিন রাখতে পারবে।’

আমি হিমুর একটা বই ইস্যু করে নিয়ে এলাম।

দেশে যখন ছিলাম, নিয়মিত সাপ্তাহিক টাইম পড়তাম। এখন পয়সা দিয়ে চারটি পত্রিকার গ্রাহক হয়েছি—

Time
Science
Scientific American
National Geographic

অন্য সময় হলে শাওন মাসে মাসে এতগুলো টাকা খরচ করতে দিত না। তার এখন হিসাবের টাকা। গুনে গুনে খরচ করতে হচ্ছে। সে ঠিক করেছে, আমার কোনো কিছুতেই বাধা দেবে না। বিশাল বাড়িতে আমাদের সঙ্গে মাজহার ছাড়া কেউ নেই। কাজেই জলি ও তার স্বামীকে নাইওর নিয়ে এসেছি। রান্নার দায়িত্ব জলি নিয়ে নিয়েছে। সে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে, ‘হুমায়ূন ভাই, আজ কী খাবেন?’ আমি চেষ্টা করি এমন কোনো খাবারের নাম করতে, যা জোগাড় করা অসম্ভব। কিন্তু অবাক কাণ্ড, খাবারের টেবিলে তা পাচ্ছি। উদাহরণ—

কচুর লতি দিয়ে কাঁঠালবিচি
গরুর ভুঁড়ি
মাছ দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল
ডাঁটা দিয়ে ট্যাংরা মাছ।

মাজহার দায়িত্ব নিয়েছে আমাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর। অদ্ভুত, উদ্ভট ও অখাদ্য সব ফল ও ফলের রস আমাকে নিয়মিত খেতে হচ্ছে। অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের ফল খেয়ে আমি এখন বুঝেছি—জগতে ফলের রাজা আম। ফলের রানি আম। ফলের রাজপুত্র-রাজকন্যা আম।

দেশে আমি ‘গর্তজীবী’ ছিলাম। আমেরিকায় এসে গর্ত থেকে বের হয়েছি। যতটা পারি, পৃথিবী দেখে যাই। কিছুই তো বলা যাচ্ছে না।
গর্ত থেকে বের হয়ে আমি কিছুটা সময় আমার বাড়ির পেছনের ব্যাক ইয়ার্ডে (Back Yard) কাটাই।

আমেরিকানরা এই জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। উইকএন্ডে বারবিকিউ করে, আড্ডা দেয়, বিয়ার খেয়ে উল্লাস করে। বাকি দিনগুলোতে জায়গাটা পড়ে থাকে অনাথের মতো। আমি চেষ্টা করি প্রতিদিন সন্ধ্যার কিছুটা সময় এখানে কাটাতে।

এক সন্ধ্যায় পুত্র নিষাদকে নিয়ে বসেছি। হঠাৎ পুত্র আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘বাবা, দেখো, বাংলাদেশের চাঁদটা এখানে চলে এসেছে। আকাশে কত বড় চাঁদ!’ তাকিয়ে দেখি, মেপলগাছের ফাঁকে নিউইয়র্ক নগরে সম্পূর্ণ বেমানান এক চাঁদ নির্লজ্জের মতো উঠে বসে আছে। তার তো থাকার কথা বাঁশবাগানে মাথায়।

আমি পুত্রকে বললাম, ‘বাংলাদেশের চাঁদ এখানে কীভাবে চলে এসেছে?’ সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমরা যখন প্লেনে করে এসেছি, তখন প্লেনের পেছনে পেছনে চলে এসেছে। চাঁদটা তোমাকে খুব ভালোবাসে তো, এই জন্য এসেছে।’

শিশুরা না বুঝে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমার পুত্রের কথা সত্যি। বাংলাদেশের দুঃখী চাঁদ শুধু আমাকে ভালোবেসেই কংক্রিটের নিউইয়র্ক নগরে চলে এসেছে।

আমি আমার লেখকজীবনে একটিমাত্র উপন্যাসই আমেরিকায় বসে লিখেছিলাম—সবাই গেছে বনে। নামটা ধার করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান থেকে—‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’।

আচ্ছা, পাঠক কি জানেন, এই গানটি কোনো আনন্দগীতি, না দুঃখগীতি? রবীন্দ্রনাথের অতি আদরের পুত্র শমির মৃত্যুর পরদিন রাতে আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছিল। রবীন্দ্রনাথ একা টানাবারান্দায় বসে প্রবল জোছনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লিখলেন—

‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না গো যাব না যে
রইনু পড়ে ঘরের মাঝে—
এই নিরালায় রব আপন কোণে।…
আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে
কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে…’

হুমায়ূন আহমেদ, নিউইয়র্ক
তারিখ: ৩০-১০-২০১১

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments