Friday, March 29, 2024
Homeবাণী-কথাসমুদ্র দর্শন - হুমায়ূন আহমেদ

সমুদ্র দর্শন – হুমায়ূন আহমেদ

তেত্রিশ বছর আগের কথা।

ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুলের নাম চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল। ক্লাস টিচারের নাম মুখলেসুর রহমান, যদিও সবাই তাকে চেনে দেড় ব্যাটারী নামে। দেড় ব্যাটারী নামকরণের উৎস জানি না। সম্ভবত শারীরিক উচ্চতার সঙ্গে এই নাম সম্পর্কিত। স্যার হলেন বেঁটেখাট মানুষ, ভারিক্কি গড়ন, মিলিটারীর প্যারেডের ভঙ্গিতে হাঁটেন। তাঁর শারীরিক কোন সমস্যা আছে, খানিকক্ষণ পরপর মাথা দুলিয়ে বিচিত্র এক ঋকি দেন। আমরা হাসতে গিয়েও হাসি না। হাসি গিলে ফেলি, কারণ দেড়-ব্যাটারী স্যারের ধমক স্কুল-বিখ্যাত। তার ধমকে প্রতি বছরই নিচের ক্লাসের ভীতু টাইপের কিছু ছাত্র প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। স্যার নিজেই এদের স্কুলের বারান্দায় নিয়ে গোসল করিয়ে দেন। বিরক্ত গলায় বলেন, এত ভয় পাস কেন রে গাধা? আমি তো শুধু ধমকই দেই। কখনো কি মারি? আমার হাতে কখনো বেত দেখেছিস?

মজার ব্যাপার হচ্ছে স্যারের মারও স্কুল-বিখ্যাত। কি-চড়, কানে মলা, পেনসিলের ডলা, ডাস্টারের বাড়ি–শাস্তির প্রতিটি শাখাতেই তাঁর যথেষ্ট সুনাম আছে, তবে বেত না। স্যারের হাতে বেত আমরা আসলেই দেখিনি।

তেত্রিশ বছর আগে শারীরিক শাস্তি শিক্ষাব্যবস্থার অংগ হিসেবে ধরা হত। বছরের শুরুতে স্কুলের জন্যে চক ডাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে নানান ধরনের বেত কেনা হত। স্যাররা ক্লাসে ঢুকতেন ডাস্টার এবং বেত নিয়ে। পড়া শুরু করার আগে শরীর গরম করে। নেয়ার কায়দায় শাস্তি চলত। বাবা-মা’রা এতে কিছু মনে করতেন না। বরং খুশি হতেন, ছেলে ঠিক জায়গায় আছে। শরীরের যেসব জায়গায় বেতের দাগ পড়বে সেইসব জায়গা বেহেশতে যাবে, এমন কথাও শোনা যেত।

দেড় ব্যাটারী স্যার প্রচলিত প্রথার ব্যতিক্রম ছিলেন না, তবে একটি বিষয়ে অন্য স্যারদের সঙ্গে তার ঘোরতর অমিল ছিল। ছাত্রকে শাস্তি দেয়ার পর তার মন খারাপ হত। তীব্র অনুশোচনায় কাতর হতেন। প্রায়ই এমন হয়েছে যে শাস্তি প্রদানের পর তার রাগ পড়ে গেছে। ছাত্র ব্যথায় কাঁদছে, তিনিও অনুশোচনায় কাঁদছেন। বড়ই মজার দৃশ্য। এর মধ্যেই নানান কাণ্ড ঘটে যেত।

অস্বস্তির সঙ্গে বলছি–ছাত্র পড়ানো ছাড়া অন্য সব কাজ তিনি খুব চমৎকার পারতেন। সম্ভবত এই কারণে তাকে জটিল কোন ক্লাস দেয়া হত না। তিনি ড্রয়িং ক্লাস নিতেন, লাইব্রেরী ক্লাস নিতেন। ড্রীল করাতেন, অন্য স্যারদের অনুপস্থিতিতে হঠাৎ যদি তাকে অংক বা ভূগোল ক্লাসে আসতে হত–তিনি খুব বিমর্ষ বোধ করতেন। অংক ক্লাসে তিনি আমাদের নামতা ধরতেন। “বল দেখি তিন সাতে কত? না পারলে আজ কিন্তু কিয়ামত। অংক কিছু না, আসল জিনিস নামতা।” ভূগোল ক্লাসে ঢুকতেন একটা গ্লোব নিয়ে। করুণ চোখে গ্লোবটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তিনি সময় পার করে দিতেন।

আমরা এই স্যারকে নানাবিধ কারণে খুব পছন্দ করতাম। প্রথম কারণ, তিনি ক্লাসে কিছু পড়াতেন না এবং পড়া ধরতেন না। বাড়ির কাজ দিতেন, তবে দেখতেন না। দ্বিতীয় কারণ, তিনি আমাদের প্রত্যেকের নামে দু লাইন থেকে চার লাইনের ছড়া বলতেন। উদাহরণ দিয়ে বলি–আমার নাম হুমায়ুন। আমাকে দেখলেই বলতেন,

হুমায়ুন
তোমার নেই কোন গুণ।

আমাদের ক্লাসের ছাত্র হামিদ রেজা খানকে দেখলেই বলতেন–

হামিদ রেজা খান
রাখবে দেশের মান।

আমাদের স্কুলের দপ্তরী রাসমোহন। তাকে দেখলেও বলতেন–

রাসমোহন
তুমি আছ কেমন?

স্যারকে পছন্দ করার তৃতীয় কারণ হল–তিনি ছিলেন আমাদের সংগীত শিক্ষক। আমরা সব ছাত্র তাঁর লেখা এবং তার সুর দেয়া গান সমবেতভাবে গাইতাম, স্যার বিমলানন্দ উপভোগ করতেন। এইসব সংগীতের সবই গণসংগীত। একটা ছিল ছাদ পিটানো গান। আমরা বেঞ্চিতে দু’হাতে ছাদ পিটাবার মত করে থাবা দিতে দিতে গাইতাম–

ঘড়িতে দশটা বাজে
পাঁচটা কেন বাজে না বাবুজী।

বেঞ্চিতে হাত দিয়ে পরপর তিনবার শব্দ–ধপ, ধপ, ধপ]।

ঘড়িতে ১১টা বাজে।
পাঁচটা কেন বাজে না বাবুজী।

[ ধপ, ধপ, ধপ ]

ঘড়িতে ১২টা বাজে
পাঁচটা কেন বাজে না বাবুজী।

[ ধপ, ধপ, ধপ ]

এইভাবে ঘড়িতে পঁচটা বাজলে গান শেষ হত।

স্যারের নিয়ম ছিল ক্লাসে একজন অপরাধ করলে সবার শাস্তি পেতে হত। গণসংঙ্গিতের মতই গণশাস্তি। সে শাস্তিও খুব মজার। সবাইকে বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়াতে বলা হত। আমরা উঠে দাঁড়াতাম। স্যার বলতেন ওয়ান-টু-থ্রী …

আমরা এক সঙ্গে গানের সুরে বলতাম,

“অপরাধ করেছি।”

স্যার বলতেন থ্রী-টু-ওয়ান। আমরা বলতাম,

“ক্ষমা চাই।”

স্যার বলতেন–যা, ক্ষমা করলাম।

এমন একজন বিচিত্র মানুষকে পছন্দ না করার কোন কারণ নেই। সবচে বড় কথা হল–তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক যিনি বলতেন–পড়াশোনাটা কোন বড় ব্যাপার না রে গাধা। ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়াটা কিছু না। যে কেউ নিয়মমত পড়লে ফার্স্ট সেকেন্ড হবে। বড় ব্যাপার হল …।

বড় ব্যাপার কি তা স্যার বলতেন না। চিন্তিত মুখে আমাদের দিকে তাকাতেন। নিজের মাথা চুলকাতেন, ভুরু কুঁচকাতেন। সম্ভবত কোটি বড় ব্যাপার তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট ছিল না।

সেবার আমাদের ক্লাসের সবাই ফাঁইন্যাল পরীক্ষায় পাস করে সেভেনে উঠেছি। শুধু ফেল করেছে জামাল-কামাল দুই ভাই। দু’জনেই মহাবিচ্ছু। একবার পকেটে করে গুই সাপ নিয়ে এসেছিল। আমরা সবাই ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলাম–জামাল কামাল দুই ভাই পুরোনো ক্লাসে পড়ে রইল এবং চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তাদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে কাঁদতে লাগলেন মুখলেস স্যার। স্যারের কান্নায় দ্রবীভূত হয়েই আমাদের হেড স্যার জামাল কামালকে প্রমোশন দিয়ে দিলেন। আনন্দে সবচে বেশি লাফালাফি করতে লাগলেন আমাদের স্যার। সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হল স্যারের ঘোষণায়। স্যার আমাদের ডেকে বললেন–তিনি আমাদের রেজাল্টে অত্যন্ত খুশি। সেন্ট পারসেন্ট পাস, এরকম কখনো হয় না। কাজেই উপহারস্বরূপ তিনি আমাদের সমুদ্র দেখিয়ে আনবেন। কক্সবাজার নিয়ে যাবেন, দু’ টাকা করে চাদা।

কক্সবাজার কোন হাতের কাছের ব্যাপার নয়, একশ মাইল দূরের পথ। দু’ টাকায় এত দূর যাওয়া, এক রাত থেকে ফিরে আসা কি করে সম্ভব আমি জানি না–স্যার যখন বলেছিলেন কোন একটা ব্যবস্থা হবেই। আমরা চাঁদার টাকা জোগাড় করবার জন্য। প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে লাগলাম। আমাদের সময় বাবা-মা’র কাছ থেকে টাকা বের করা কঠিন ব্যাপার ছিল।

একদিন সত্যি সত্যি পঁয়ত্রিশ জন ছেলেকে নিয়ে স্যার কক্সবাজার রওনা হলেন। মুড়ির টিন জাতীয় বাস। সেই বাস দুলতে দুলতে চলেছে। কিছু দূর গিয়ে অনেকক্ষণ থেমে থাকে। যাত্রী জোগাড় করে আবার হেলতে দুলতে চলে। আজকাল তিন ঘণ্টায় কক্সবাজার পৌঁছা যায়। তখন সময়ের কোন হিসাব ছিল না। আমরা সকাল ন’টায় রওনা হয়ে রাত দশটায় পৌঁছলাম। স্যার আমাদের সমুদ্রে নিয়ে গেলেন না–এক স্কুল ঘরে নিয়ে তুললেন। মেঝেতে চাটাই পেতে দেয়া আছে। চাটাইয়ের উপর খড় বিছানো। সেই খড়ের উপর চাঁদর। আমরা খিচুড়ি খেয়ে ঘুমুতে গেলাম। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব আমাদের জন্যে খিচুড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। স্যার বলে দিলেন খুব ভোরে উঠতে হবে। ভোরে আমাদের সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবেন, তবে কেউ সমুদ্রে নামতে পারবে না। কেউ যদি সমুদ্রে নামে–মেরে তক্তা বানিয়ে দেবেন। এতগুলি ছেলের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। তিনি একা মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভোরবেলায় সমুদ্র দেখতে গেলাম। সমুদ্র দেখে হকচকিয়ে গেলাম। আকাশের মত বিশাল কিন্তু নিঃস্তব্ধ নয়–প্রাণময়। এমন বিশাল এবং প্রায় জীবন্ত কিছু যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা ছেলেমানুষী কল্পনায় এর আগে কখনো আসেনি। সমুদ্রের তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। সে সারাক্ষণ ডাকে, আয় আয়–কাছে আয়। সেই আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা সম্ভব হল না। স্যারের কঠিন নিষেধ ভুলে গিয়ে জুতা পায়ে ছুটে গেলাম–প্রায় হাঁটু পানিতে। স্যার এসে ঘাড় ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু হল মার। কঠিন মার। সমগ্র স্কুল জীবনে আমি প্রচুর শাস্তি পেয়েছি–এমন কঠিন শাস্তি কখনো পাইনি। শারীরিক দুঃখের চেয়েও গভীর অপমানবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করল। স্যার বললেন, এইখানে বসে থাকবি। সমুদ্রের দিকে তাকাবি না–উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে বোস। এখান থেকে এক পা নড়লে টান দিয়ে মাথা ছিঁড়ে ফেলব।

আমি সমুদ্রের কাছে এসে, সমুদ্রের উল্টোদিকে মুখ হয়ে বসে রইলাম, আমার বন্ধুরা মহানন্দে সমুদ্র দেখতে লাগল। দুপুর দশটায় বাসে করে চিটাগাং রওনা হব। সবাই বাসে উঠেছি। বাস ছাড়ার আগে আগে স্যার গিয়ে বাস ড্রাইভারের কানে কানে কি বললেন। তারপর এলেন আমার কাছে। আগের মতই হুংকার দিয়ে বললেন, নাম বাস থেকে। নাম বলছি।

আমি নামলাম। মনে হল শাস্তিপর্ব শেষ হয়নি। স্যার আমাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, খোল জুতা। জুতা খুলোম। স্যার আমার হাত ধরে হঠাৎ অসম্ভব কোমল গলায় বললেন–চল যাই সমুদ্রে। একবার ভাবলাম অভিমান দেখিয়ে বলি–‘না’। কিন্তু ইচ্ছা করল না। স্যারের হাত ধরে সমুদ্রে নামলাম। তিনি বললেন–ব্যাটা আমার উপর রাগ করিস না। একদল ছেলেকে নিয়ে এসেছি। এদের কেউ সমুদ্রে ভেসে গেলে সমস্যা না? তোকে শাস্তি দেয়া অন্যায় হয়েছে। ভুল হয়েছে। আমি মানুষ। আমি তো ভুল করবই। আমি কি ফেরেশতা যে আমার ভুল হবে না? তোর যতক্ষণ ইচ্ছা সমুদ্রে হাঁটাহাঁটি কর। আর আমার উপর রাগ খুব বেশি হলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দে। দেখি তোর কেমন শক্তি।

আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখি, স্যার তাঁর পুরোনো অভ্যাসমত কঁদতে শুরু করেছেন।

আমরা টাকা-পয়সা খরচ করে দূরের সমুদ্র দেখতে যাই, অথচ আমাদের আশেপাশের মানুষরাই বুকে সমুদ্র ধারণ করে ঘুরে বেড়ান। সেই সমুদ্র আমাদের চোখে পড়ে না।

.

পঁচিশ বছর পর স্যারের সঙ্গে আবার দেখা। তিনি আজিমপুর কবরস্থানের পাশের রাস্তা দিয়ে হনহন করে যাচ্ছেন। আগের মতই আছেন, শুধু আকাশের শাদা মেঘ ভর করেছে তার মাথার চুলে। তিনিই প্রথম আমাকে দেখলেন–চেঁচিয়ে ডাকলেন, হুমায়ূন না? হুমায়ূন, তোর নেই কো কোন গুণ। আরে গাধা, তুই কেমন আছিস?

সমুদ্র দেখলে সমুদ্রের জল স্পর্শ করতে হয়। আমি কদমবুছি করবার জন্যে নিচু হলাম। স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। লক্ষ্য করলাম বয়সজনিত কারণে স্যারের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে আমাদের শাস্তি দিয়ে কাঁদতেন। এখন কাঁদছেন কোন শাস্তি না দিয়েই।

আমি বললাম, কেমন আছেন স্যার?

স্যার চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভাল আছি রে ব্যাটা। ভাল আছি। প্রেসিডেন্ট মেডেল পেয়েছি, বুঝলি? বেস্ট টিচার হিসেবে প্রেসিডেন্ট মেডেল। কি হাস্যকর কথা। আমি নাকি বেস্ট টিচার! হা হা হা। তিনি হাসছেন। কিন্তু তার চোখ ভেজা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments