Thursday, April 18, 2024
Homeবাণী-কথাস্বর্ণলতা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

স্বর্ণলতা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

স্বর্ণলতা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ডাক্তারের বলার ইচ্ছে ছিল, মহিলাটি আপনার কে হন, কিন্তু চারদিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাতে-তাকাতে মুখে বললেন, দেখুন অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন।

সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন দুজনে, সেকেলে ধরনের চওড়া কাঠের সিঁড়ি, প্রতি পদক্ষেপে বেশ শব্দ হচ্ছিল। বাড়িটা বেশ বড়ই, কিন্তু ঘরগুলো সব ফাঁকা, লোকজন নেই বলেই মনে হয়। কথা। বলতে-বলতে ভালো করে তাকালেন ছেলেটির দিকে বয়েস তেইশ-চব্বিশ, জোয়ান ঘোড়ার মতো স্বাস্থ্য, গায়ের রংটা ঝরনার জলের মতো পরিষ্কার। থুতনির ঠিক নীচে অনেক কালের। একটা পুরোনো কাটা দাগ—হাসলে ছেলেটিকে ভারী সুন্দর দেখায়।

প্রিয়ব্রত একটু গম্ভীর চোখে তাকাল। কোনও ভয়ের কারণ আছে কি না স্পষ্ট করে বলুন। ডাক্তারবাবু।

ডাক্তার হাসলেন। ইয়ংম্যান, এরকম বিচলিত হয়ে পড়ছেন কেন?

ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন নীচে, প্রিয়ব্রত বলল, আপনি হয়তো হাসবেন শুনলে, অ্যাক্সিডেন্ট সম্বন্ধে আমাদের বংশে একটা কুসংস্কার আছে। আমাদের বাড়ির প্রায় সকলেই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

হঠাৎ ডাক্তার প্রায় অবান্তরভাবে জিগ্যেস করলেন, ভদ্রমহিলা আপনার কে হন?

বউদি, আমার মা-ও বলতে পারেন। আমার বয়েস যখন নবছর তখন আমার মা মারা যান, তখন থেকেই বউদি আমাকে মানুষ করেছেন।

আপনার দাদা কি…

হ্যাঁ, আমার দাদা বেঁচে নেই। আপনার মনে আছে কি উনশশো ছেচল্লিশ সালে মাদ্রাজে সেই যে ব্রিজ ভেঙে একটা ট্রেনের দুটো কম্পার্টমেন্ট নদীতে পড়ে যায়? সাড়ে ছশো লোক মরেছিল— দাদা ছিল তার মধ্যে। মাত্র কয়েক বছর আগে দাদার বিয়ে হয়েছিল। আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়। গরম ফ্যান গেলে ভরতি ফ্যান একটা গামলায় করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, এক ফোঁটা পড়েছিল মাটিতে, তার ওপর পা পড়ে পিছলে পড়লেন। গরম ফ্যান গায়ে উলটে পড়ল। সারা গায়ে শেষে এমন ঘা হয়েছিল যে মা শুতে বসতে পারতেন না। যন্ত্রণা দেখে শেষে আমরা। মায়ের মৃত্যুই কামনা করতুম।

প্রিয়ব্রত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, ডাক্তার বললেন, থাক-থাক। এ-বাড়িতে আপনারা কতদিন এসেছেন?

বছর দুয়েক। আমরা বহুদিন থেকে বাংলাদেশ ছাড়া। আমরা প্রায় মাদ্রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা ওখানে চাকরি করতেন। আমাদের জন্ম মাদ্রাজে লেখাপড়াও শিখেছি ওখানে। এ-বাড়িতে শুধু আমি, বউদি আর এক বুড়ি পিসিমা। বাবা মারা গেছেন গত এপ্রিলে, আশ্চর্য মৃত্যু। বাবা বুড়ো হলেও বেশ সুস্থ সমর্থ মানুষ। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেলেন, সঙ্গে-সঙ্গে হার্টফেল। ডাক্তারবাবু, বউদি কি…

না, কোনও ভয় নেই, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। দুর্ঘটনাটা কী করে হল বলুন তো?

প্রিয়ব্রত মুখ নীচু করে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটু লাজুক ধরনের হেসে বলল, ব্যাপারটা শুনলে হয়তো আপনি হাসবেন। দুর্ঘটনার জন্য আমিই দায়ী। বউদি আমাকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছেন, বউদি আমার মায়ের মতো, বন্ধুর মতো। বউদির সঙ্গে মাঝে-মাঝে খুব ঠাট্টা-ইয়ার্কি করি। আজ অফিস থেকে ফিরেছি বিকেলে, বউদি তখন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলেন। আমি ভয় দেখাবার জন্য গলাটা গম্ভীর করে ডাকলুম, স্বর্ণ! স্বর্ণ! বউদি চমকে ফিরে আমাকে দেখতে পেলেন, তারপর কী জানি কেন—অজ্ঞান হওয়ার মতো ঢলে পড়ে গেলেন। আমি ছুটে এসে ধরবার আগে ছ-সাতটা সিঁড়ি গড়িয়ে এসেছেন।

ডাক্তারবাবু মুখ লুকিয়ে হাসলেন। খুব ভয় দেখিয়েছেন যা হোক। কোনওদিন কি ফিটের অসুখ ছিল?

না, কোনওদিন না। প্রিয়ব্রত বলল।

থাক গে, এমন কিছু নয়। কোনও ফ্র্যাকচার হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। অয়েন্টমেন্ট যেটা লিখে দিয়েছি ভালো কার লাগান আর ট্যাবলেটগুলো রোজ দুটো করে খাওয়াবেন। নড়াচড়া বন্ধ। পরশুদিন আমাকে খবর দেবেন।

স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে আছেন। অন্তত তাই মনে হয়। শাড়ির পায়ের দিকটা অনেকখানি ভিজে—প্রথমে ডাক্তারকে না পেয়ে প্রিয়ব্রত অনেকটা বরফ এনে চাপিয়ে দিয়েছিল।

স্বর্ণলতাকে দেখলে বয়েস বুঝতে পারা যায় না, মনে হয় ভরাস্বাস্থ্য যুবতী, জ্যৈষ্ঠ মাসের বিকেলের মতো উজ্জ্বল হলুদ গায়ের রঙ। শুধু সাদা শাড়ি আর সিঁদুরহীন সিঁথির জন্য একটা নির্জন গাম্ভীর্য এসেছে।

প্রিয়ব্রতর বাবা স্বর্ণলতাকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। ছেলে মারা যাওয়ার বছর দেড়েক পর তিনি বলেছিলেন, ইচ্ছা করলে স্বর্ণলতা আবার বিয়ে করতে পারে। ওইটুকু মেয়ে, অমন রূপ, কেন শুকনো হয়ে পড়ে থাকবে! স্বর্ণলতা খুব সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, আপনার ছেলে ছাড়া যদি আর কারুর সঙ্গে আমার বিয়ে হত, তবে সেই স্বামীর মৃত্যুর পর হয়তো আবার বিয়ের কথা ভাবতুম। কিন্তু শুব্রতকে যে একবার দেখেছে সে আর অন্য কারুর কথা ভাবতে। পারে না। প্রিয়ব্রতর দাদাকে ভালোবেসে বাড়ির সকলের অমতে বিয়ে করেছিলেন স্বর্ণলতা। এ নিয়ে মাদ্রাজের বাঙালিপাড়ায় বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।

প্রিয়ব্রত আস্তে দরজা খুলে দাঁড়াল। তার মুখে লজ্জা আর ক্ষোভের ছায়া দুলছে। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চলে যাচ্ছিল, স্বর্ণলতা ডাকলেন, টুনু শোন।

তোমার যন্ত্রণা কমেছে?

না, তুই আমার পাশে এসে বোস। স্বর্ণলতা অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন প্রিয়ব্রতর দিকে। তারপর একটু হেসে স্নান গলায় বললেন, তুই এমন চমকে দিয়েছিলি…

বাঃ, তুমি এরকম করবে কী করে জানব!

স্বর্ণলতা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখের কোণ দুটো চিকচিক করে উঠল। বললেন, তুই কবে বড় হয়ে উঠেছিস লক্ষ্যই করিনি, টুনু। অনেক বড় হয়ে গেছিস।

কি কান্ডই বাধালে তুমি, ডাক্তারকে ব্যাপারটা বলতে আমার এত লজ্জা করছিল! যে শুনবে সে আমাকেই দোষ দেবে। আমার সবচেয়ে অবাক লাগছে একটা ব্যাপার। হঠাৎ পিছন থেকে ডাকলে চমকে কেউ পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তোমাকে দেখলুম আমার ডাক শুনে হাসি-হাসি মুখে ফিরে তাকিয়ে আমার দিকে ঝাপসা চোখে পুরো একমিনিট তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ দেখি। তুমি গড়িয়ে পড়ছ! আমাকে দেখতে পাওয়ার পরও কি হল তোমার?

না, তোকে দেখতে পাইনি। আমি ভূত দেখেছিলাম। স্বর্ণলতার কণ্ঠস্বর শূন্য ঘরে প্রতিধ্বনির মতো শোনাল।

ও, আমার চেহারা বুঝি ভূতের মতো হচ্ছে আজকাল? লঘুভাবে প্রিয়ব্রত বলল।

হ্যাঁ, হচ্ছেই তো! স্বর্ণলতা একটু হেসে বললেন, দেখ টুনু, তোকে রোজ দেখছি তাই বুঝতে পারিনি এতদিন তুই আর সেই দশ বছরের ছেলেটি নেই! তুই রেগে এককেবারে হুবহু তোর দাদার মতো দেখতে হয়েছিস। তুই যেভাবে ডেকেছিলি, রেগে গেলে তোর দাদাও ঠিক ওইরকমভাবে ডাকত। শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম, তাই আমার মনে হল, তবে কি শুভো বারো বছর পর আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে? তারপরই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল, মাথাটা ঘুরে গেল।

অস্বস্তির ভাবটা কাটাবার জন্য প্রিয়ব্রত বলল, এইবার বুঝি কান্নাকাটি শুরু করবে!

যা, যা, স্বর্ণলতা হেসে উঠলেন, তোকে আর ফঞ্চুড়ি করতে হবে না। ডাক্তার কী বলল, পা-টা ভেঙেছে নাকি? দেখতে-দেখতে বাঁ-পায়ের গোড়ালিটায় যে ভীষণ ব্যথা হয়ে উঠল রে!

শোনো, এখন সাতদিন তুমি চুপ করে শুয়ে থাকবে বিছানায়। নড়াচড়া একেবারে বারণ। তোমার জন্য একটা নার্স ঠিক করতে হবে কদিনের রজন্য।

নার্স? নার্স কী হবে?

তোমার কাজগুলো দেখাশুনো…

চুপ কর। তুই আছিস কী করতে। না, না, ওসব নার্সটার্স বাড়িতে ঢোকাবি না বলে দিলাম। অর্জুনকে বল চা দিতে।

রাত্রি দশটা। প্রিয়ব্রত স্বর্ণলতার বাঁ-পায়ের গোড়ালিতে আস্তে-আস্তে মলম মালিস করে দিচ্ছে। নরম সুন্দর পায়ের পাতা স্বর্ণলতার, তাঁকে চিঠিতে শ্রীচরণকমলেষু কথাটা সার্থকভাবেই লেখা যায়। প্রত্যেকটি আঙুল সুললিত, নখের ভিতর দিয়ে রক্তের আভা ফুটে বেরুচ্ছ, কোথাও একছিটে ময়লা নেই। মায়ের কথা মনে পড়ছে প্রিয়ব্রতর। মায়ের চেহারা ভালো করে মনে পড়ে না, কোনওদিন মায়ের পায়ে এমনভাবে হাত বুলিয়ে দেয়নি।

স্বর্ণলতা এক দৃষ্টিতে দেখছেন প্রিয়ব্রতকে। তাঁর সারা শরীর শিরশির করছে। ঘাড়ের পাশ দিয়ে দেখলে কে বলবে, ও শুভব্রত নয়! একদিন সামান্য সর্দিজ্বর হয়েছিল তাঁর, শুভব্রত খাটের পাশে হাঁটুমুড়ে ঠিক এমনিভাবে বসেছিল, মনে হয় যেন এই সেদিন। তবে শুব্রত টুনুর মতো শান্ত ছিল না, সে ছিল জলপ্রপাতের মতো তীব্র আবেগপ্রবণ। দুজনে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটত, শুভর ব্যবহারের জন্য সমস্ত শহরের লোক তাকিয়ে থাকত ওদের দিকে। মনে হয় যেন এই সেদিন, কিন্তু কতদিন অনেক দিন।

স্বর্ণলতা ডাকলেন, টুনু শোন। থাক, তোকে আর সেবা করতে হবে না। এদিকে এসে বস। প্রিয়ব্রত তোয়ালেতে হাত মুছতে-মুছতে উঠে এসে চেয়ারে বসল। এখন একটু ভালো লাগছে?

হ্যাঁ। কিন্তু সারা শরীরটায় ক্রমে-ক্রমে ব্যথা হয়ে আসছে। কতদিন শুয়ে থাকতে হবে কে জানে!

হয় থাকলেই, বেশ শুয়ে-শুয়ে গল্পের বই পড়বে। আমি কয়েকদিনের ছুটে নিচ্ছি। গল্প করব দুজনে সারাদিন।

স্বর্ণলতা কোনও কথা বললেন না। আজ অনেকদিন বাদে কেমন যেন বারেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন।

প্রিয়ব্রত উঠে গিয়ে দেয়ালের একটা কাত হয়ে থাকা ছবিকে সোজা করে দিল। দাদার চেহারা। আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। আচ্ছা বউদি, দাদার সঙ্গে তোমার কী করে আলাপ হয়েছিল প্রথমে?

স্বর্ণলতা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন ওর দিকে। ও কী বুঝতে পেরেছে যে আজ সারাদিন আমি ওর দাদার কথাই ভাবছি। না, সরল মুখ প্রিয়ব্রত। নরম গলায় জিগ্যেস করলেন, তুই খুব ভয়। পেয়েছিলি, না? যদি আমি মরে যেতাম! এবার তোর একটা বিয়ে দিতে হবে টুনু। আমি আর থাকতে পারি না, বড় একা-একা লাগে রে।

দাদার মৃত্যুর খবর শুনে বউদি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, প্রিয়ব্রতর আজও মনে আছে। সেদিন ওরা মীনাক্ষীদেবীর মন্দির দেখতে যাবে ঠিক করেছিল। টিফিন কেরিয়ারে খাবার-দাবার ভরে রেডি। হয়েছিল। বাবা এলেন স্টেশন থেকে। বাগানের দরজা দিয়ে ঢুকতে-ঢুকতে একবার সারা বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। দোতলায় দাদার ঘরের দিকে একবার তাকালেন। তারপর নীচু হয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে বাগানের দরজাটা বন্ধ করে ভিতরে এলেন, খুব আস্তে বললেন, আজ বেড়াতে যাওয়া হবে না। স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিনটা। বউদির ছিল সবচেয়ে বেশী উৎসাহ বেড়াতে যাওয়ার জন্যে। একটা ফুল-ফুল ছাপ দেওয়া সিল্কের শাড়ি পরেছিলেন বউদি। ছুটতে ছুটতে এসে জিগ্যেস করলেন, কেন কী হয়েছে বাবা, রামস্বামীর সঙ্গে বুঝি দাবা খেলতে বসবেন? আজকে একটা দিন…

বাবা সোজা চোখ তুলে তাকালেন বউদির দিকে। একটুও না কেঁপে বললেন, শুভ মারা গেছে, শুভো বেঁচে নেই। এইমাত্র খবর পেলাম স্টেশনে, আমাদের শুভো মারা গেছে। স্বর্ণ, শুনতে পাচ্ছো, শুভো বেঁচে নেই। শুভ শুভ…

কী ভাবছিস টুনু, স্বর্ণলতা ওকে একা ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে বললেন, অনেক রাত হল, এবার শুতে যা।

টুনু, টুনু!

কে যেন ডাকছে, একবার মনে হল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে কণ্ঠস্বরের মতো অস্পষ্ট, নরম।

টুনু, টুনু!

কার ডাক কোথা থেকে আসছে প্রিয়ব্রত মধ্যরাত্রে ঘুম থেকে উঠে কিছুই বুঝতে পারছিল না। পাশের ঘর থেকে পিসিমা বললেন, ও টুনু ওঠ, তোর বউদি তোকে ডাকছে দেখ। পিসিমার। বাতের অসুখ, নিজে উঠতে পারেন না। প্রিয়ব্রত হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখদুটো একবার মুছে বাইরে এল, বারান্দা পেরিয়ে বউদির ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল। স্বর্ণলতা ঘরে নেই। ডানদিকে বাথরুমের দরজাটা ফাঁক করে খোলা, সেখান থেকে একটা গোঙানির শব্দ আসছে। স্বর্ণলতা হাঁটু দুমড়ে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। প্রিয়ব্রত আজ পর্যন্ত বউদিকে কোনওদিনও কাঁদতে দেখেনি। যখন দাদা মারা যান তখনও বউদি একেবারে ভেঙে পড়েননি। যেন দাদার ওপর অভিমানেই একটা ছুরির মতো অনমনীয়, তীক্ষ্ণহয়েছিলেন। সেই স্বর্ণলতা আজ তার হাতের তালুতে মুখ রেখে কাঁদছেন। টুনু আমার কী হল, তোর পিসির মতো আমিও কি একেবারে অথর্ব হয়ে গেলুম! হাঁটুতে একদম জোর পাচ্ছি না, দাঁড়াতে পারলুম না এসে! আঃ লাগে রে লাগে, আঃ আস্তে…প্রিয়ব্রত স্বর্ণলতাকে দুই বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে তুলে নিয়েছে, থুতনি দিয়ে দরজা ফাঁক করে তাঁকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল।

কে তোমায় সর্দারি করে একা আসতে বলেছে! আমি কালই নার্স আনব।

স্বর্ণলতা বড়-বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁর বেশবাস বিস্রস্ত। প্রিয়ব্রত তাঁর শায়ার দড়িটা টেনে বেঁধে দিল। কাপড়টা মোটামুটি একটু গুছিয়ে দিল ঠিক করে। তুমি ঘুমোও, বউদি, আমি তোমার পাশে বসে আছি। কিছু ভয় নেই, ডাক্তার খুব জোর দিয়ে বলছে। আর তুমি যদি এরকম কর, তবে যে আমার ভীষণ লজ্জা করে আমার ছেলেমানুষির জন্যই তো এরকম হল।

না, তুই না, তোর কোনও দোষ নেই, এর জন্য দায়ী অন্য একজন।

প্রিয়ব্রত স্বর্ণলতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আঙুলগুলো কপালের উপর দিয়ে ঘুরে কানের পাশ দিয়ে যখন নামছে, তখন চোখের জলে তার আঙুল ভিজে যাচ্ছে। স্বর্ণলতা একটুক্ষণ বাদে প্রিয়ব্রতর হাতখানা মুঠো করে ধরে রইলেন। একটু সামলে নিয়ে বললেন, এবার তোর একটা বিয়ে দিতে হবে, টুনু। বেশ ছোট্টখাট্টো একটা বউ আনব, দুই সখীতে মিলেমিশে থাকব। তোর হাতটা ঠিক তোর দাদার মতো—সেইরকম লম্বা-লম্বা পরিষ্কার আঙুল, তালুর উলটো পিঠে কালো রোম ঠিক এইরকম…

ওদের পরিবারে দুর্ঘটনা সম্পর্কে কুসংস্কার ছিল—আশ্চর্য, স্বর্ণলতাও সহজে সারল না। পায়ে কোনও ফ্র্যাকচার হয়নি, প্লাস্টার করতে হল না, কিন্তু হাঁটু আর গোড়ালিতে ব্যথা হয়ে রইল। স্বর্ণলতা একেবারে শয্যাশায়ী হয়েই রইলেন। তাছাড়া তার তলপেটেও ভীষণ ব্যথা হতে লাগল, মাঝে-মাঝে পেটের মধ্যে মুচড়ে উঠে তাঁর সমস্ত আত্মাটাকেই যেন সেখানে বন্দি করতে চায়। ডাক্তার আসতে লাগলেন রোজ। প্রিয়ব্রত ভীষণ বিপদে পড়ল। কলকাতায় তাদের আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। স্বর্ণলতা কিছুতেই নার্স রাখতে রাজি হলেন না, সমস্ত দেখাশুনো তাকে একাই করতে হয়। সে চাকরি করে একটা বিলেতি ফার্মে। তাকে লম্বা ছুটি নিতে হল!

মাঝে-মাঝে শুধু চেতলার সদানন্দ কাকার বাড়ি থেকে সকলে আসে। সদানন্দবাবু রিটায়ার্ড হেডমাস্টার, প্রিয়ব্রতর বাবার বাল্যবন্ধু। প্রায় বছর কুড়ি বাদে একদিন কলকাতায় একটা সিনেমা হলে দেখা হতেই দুই বন্ধু পরস্পরকে চিনতে পেরেছিলেন।

সদানন্দবাবু বললেন, শোনো টুনু, বউদিকে দার্জিলিঙ কিংবা পুরী এরকম কোনও জায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। কলকাতা ওর বোধহয় ঠিক সুট করছে না। গতবারেও তো দেখলুম, সর্দিজ্বরে খুব ভুগল। আর তা ছাড়া ওর দেখাশুনো করবার জন্য একজন নার্সটার্স রাখো—তুমি বড় হয়েছ পুরুষ-মানুষ, তুমি কি আর সবরকম করতে পারবে! না হয় স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে কিছুদিন.। প্রিয়ব্রত খুব অস্বস্তি বোধ করল, সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না, কাকাবাবু। বউদি যদি আমার কোনও কথা শোনেন।

সদানন্দবাবু স্বর্ণলতাকেও বলেছিলেন একথা। স্বর্ণলতা অত্যন্ত কঠিন চরিত্রের মেয়ে। হেসে। বললেন, না কাকাবাবু, নার্সটার্স আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না। আর হাসপাতালে গেলে আমি মরেই যাব। তার চেয়ে, মরি যদি টুনুর হাতেই মরব! বলে, এমন চমকপ্রদভাবে হেসে উঠলেন, যে সকলকেই হাসতে হল।

সদানন্দবাবুর মেজো মেয়ে নীলিমা বলল, টুনুদা, আপনি তো এখন বাড়িতেই থাকবেন। আমি দুপুরের দিকে কেমিস্ট্রি আর বায়োলজিটা দেখে নিতে আসব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন আসবি না? সদানন্দবাবু হুড়োহুড়ি করে বললেন, তোর পড়াশুনোও হবে। আর ওদের একা-একা লাগবে না।

অথচ ওদের তো কখনও একা লাগে না, কখনও সময় বিরক্তিকর রকম অচল লাগে না। বউদি যে ওর বন্ধু একথা প্রিয়ব্রত কাউকে বোঝাতে পারবে না। সারাক্ষণ দুজনে বসে গল্প করে! মধুর স্মৃতির গল্প। কখনও-কখনও দাবা খেলে দুজনে। স্বর্ণলতাকে দাবায় হারানো খুব শক্ত, তবু দু একবার যদি প্রিয়ব্রত তাঁকে মাত করে দেয়, স্বর্ণলতা হাত দিয়ে সমস্ত গুটি এলোমেলো করে হেসে উঠে বলেন, দাবায় আমাকে হারাতে পারবি; কিন্তু ব্যাডমিন্টনে কিছুতেই পারবি না। ওখানে থাকতে তোর দাদা আর আমি মিক্সড ডবলস-এর চ্যাম্পিয়ান ছিলুম, একবার খেলতে গিয়েছিলুম ওয়ালটেয়ারে, সেটা নভেম্বর মাসে…তখন ওয়ালটেয়ারের গল্প হয়।

সন্ধেবেলা একটা কালো রঙের মলম স্বর্ণলতার হাঁটুতে প্রিয়ব্রত মালিশ করে দেয়। ধবধবে ফরসা পা স্বর্ণলতার, তার ওপর কালো সাপের মতো রেখা পড়ে। প্রিয়ব্রত হাটতা যতবার ওঠায়, ততবার স্বর্ণলতার গা শিরশির করে। যন্ত্রণায় নয়, ভালো লাগায় নয়, অন্যরকম লাগে। একটু বাদে বলে ওঠেন এক-একদিন, আর না, শুভো আর পারি না। প্রিয়ব্রত তাড়াতাড়ি হাত তুলে নিয়ে বলে, আমি শুভ নয়, প্রিয়ব্রত। আজকাল তোমার বারেবারে ভুল হচ্ছে।

নীলিমা প্রত্যেকদিন দুপুরবেলা আসে। নীলিমা মেয়েটি যেমন কলেজের মেয়েরা হয়, ছিমছাম চেহারা, সপ্রতিভ কথাবার্তা। কথা বলতে-বলতে আঁচল দিয়ে বাঁ হাতটা জড়ায় আবার খুলে ফেলে। পড়ার মধ্যে বলে ওঠে, কেন ছাই মরতে সায়ান্স নিয়েছিলাম। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি মোটেই ভালো লাগে না। তার চেয়ে এই কবিতাটা একটু বুঝিয়ে দিন।

মাঝে-মাঝে স্বর্ণলতা ডেকে পাঠান প্রিয়ব্রতকে। হয়তো বলেন, ঘুম আসে না দুপুরবেলা কিছুতেই। মাথার কাছের জানালাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে যা তো। কোনওবার হয়তো, সেই বইটা কোথায় রেখেছিস, যেটা সকালবেলা পড়ছিলাম। তারপর হেসে বলেন, দেখিস বেশি পড়িয়ে যেন মেয়েটাকে আবার দিগগজ করিয়ে দিসনি।

প্রিয়ব্রত একদিন নীলিমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল। শীতের ক্ষীণ বিকেল, তখনই আলো নিভে আসছে। নীলিমা মেয়েটি বড় ছটফটে, রাস্তায় যেতে-যেতে অনর্গল কথা বলে, লোকে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে ফিরে-ফিরে তাকায়। প্রিয়ব্রত স্বভাবত শান্ত, গম্ভীর পা ফেলে, কৌতুকের সঙ্গে নীলিমার কথা শুনতে-শুনতে হেঁটে চলে।

দুপুরটা আজকাল ভীষণ অসহ্য মনে হয় স্বর্ণলতার। প্রিয়ব্রত কাল থেকে অফিসে যাচ্ছে। আয়নায় নিজের মুখ দেখছিলেন, কেমন যেন কর্কশ হয়ে গিয়েছে তাঁর চেহারা। স্বাস্থ্য যে খুব খারাপ হয়েছে তা নয়, চোখ থেকে দৃষ্টির চিনতাই কেমন যেন কমে গেছে। নিজেকে এমন অসহায়, নির্জন এর আগে আর কখনও মনে হয়নি। জানলা দিয়ে রোদ আসে ঠিক তাঁর শিয়রে, একটু পরেই রোদটা বিরক্তিকর লাগে, কিন্তু জানালাটা উঠে বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না। একটা হলুদ রঙের পতঙ্গ বোঁ-বোঁ শব্দ করে সারা ঘরে ঘুরতে থাকে। সেই একঘেয়ে শব্দটা একটু বাদেই ক্লান্ত করে দেয়। পাশের বাড়ির ছোট ছেলেটি একটি পয়সা হারিয়ে সারা দুপুর ধরে একঘেয়ে। ভাবে কাঁদছে—স্বর্ণলতা বহুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কান্না শুনলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, যে-জীবন রোদ্দুরে, পতঙ্গের ডানায়, এই পাশের বাড়িটির শিশুর চিৎকারে—একে তিনি কিছুতেই স্পর্শ। করতে পারছেন না। অথচ এসব শুধু তাঁর অসুখের জন্যই নয়, একথা স্বর্ণলতা জানেন। এ অসুখ সারবেই কিছুদিনের মধ্যে—স্বর্ণলতা শরীর দিয়ে বুঝতে পারছেন। কিন্তু তবু তাঁর মনে হয়, সকলে মিলে তাঁকে যেন আস্তে-আস্তে নির্বাসন দিচ্ছে, দুঃসহ একাকিত্বের অন্ধকারে। এই জুলাইতে তাঁর বয়েস হল বত্রিশ, এখনও সামনে দীর্ঘ জীবন, অথচ তাঁর সমস্ত স্বপ্ন সম্পদ পড়ে রইল গোদাবরীর অন্য পারে যেখানে শুভো ডুবে মরেছে। স্বর্ণলতা একা ঘরে আপন মনে কাতরে ওঠেন, আমি তো বারণ করেছিলাম শুভভাকে, আমি যেতে বারণ করেছিলাম।

এই সময় তাঁর তলপেট ব্যথা করে। অসহ্য অবর্ণনীয় ব্যথা। ভূমিকম্পে ধরিত্রী যেমন যন্ত্রণায়। অভিভূত হয়, স্বর্ণলতাও সেইরকম ব্যথায় মুষড়ে পড়েন। বালিশের তলা থেকে ট্যাবলেটটা বের করে পর্যন্ত খাবার সামর্থ্য থাকে না। চোখ জ্বালা করে জল আসে।

অফিস থেকে ফেরবার পথে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে এসেছে প্রিয়ব্রত। বলল বউদি, ডাক্তারবাবু বললেন, এখন থেকে রোজ তোমাকে একটু-একটু হাঁটা অভ্যেস করতে হবে। এবার তুমি শিগগিরই সেরে উঠবে। স্বর্ণলতা মেয়ের মতো খুশি হয়ে উঠলেন। বললেন, চল আজ থেকেই অভ্যেস করি। এরকমভাবে শুয়ে থাকলে আমি এমনিতেই মরে যাব।

চল, একটু বারান্দায় বেড়িয়ে আসি। তোমার কাপড়টা ঠিক করে নাও।

বারান্দায় নয়, ছাদে। তুই একটু ধরলে আমি ঠিক উঠতে পারব! প্রিয়ব্রতকে ধরে-ধরে স্বর্ণলতা ছাদে উঠলেন। শীতের পরিষ্কার নীল আকাশের দিকে পুরো চোখ মেলে তাকালেন। বহুদিন পরে অনেকখানি আকাশের নীচে দাঁড়ালেন, বহুদিন পর অনেক বাতাসের মধ্যে। অনেকদিন। স্বর্ণলতাকে এমন চঞ্চল দেখা যায়নি। প্রিয়ব্রত একহাতে স্বর্ণলতাকে বেষ্টন করে রইল, স্বর্ণলতা একহাতে প্রিয়ব্রতর কাঁধে হাত দিয়ে রইলেন, তারপর খুব আস্তে-আস্তে দুজনে সমানভাবে পা ফেলে ছাদের এদিক-ওদিক করতে লাগলেন।

জানিস টুনু, আজ তোর দাদাকে স্বপ্ন দেখলাম।

প্রিয়ব্রত এই প্রসঙ্গটি সবচেয়ে বেশি ভয় করে। সেজন্য কথা ফেরাবার জন্য বলল, অফিস থেকে অনেককে দিল্লি বোম্বাই ম্যাড্রাস পাঠাচ্ছে। তোমার যদি ইচ্ছা করে, তবে আবার আমরা ম্যাড্রাস চলে যাই।

স্বর্ণলতা বললেন, না, ও পোড়ার দেশে আর না। হ্যাঁ রে, ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয় রে? স্বপ্ন দেখলাম তোর দাদা বেঁচে আছে।

চলো, নীচে যাই, তোমার ঠান্ডা লাগবে।

শোন, দেখলুম গোদাবরীর জলে তোর দাদা সাঁতার দিয়ে ভাসছে। কীরকম ভালো সাঁতারু ছিল জানিস না তো। ও জলে ডুবে মরবে, একথা আমার বিশ্বাস হয় না।

কথা বলতে-বলতে উত্তেজনায় স্বর্ণলতা দাঁড়িয়ে পড়েছেন। চাঁদের আলো অন্ধকারকে একটা স্নিগ্ধ জ্যোতি দিয়েছে। প্রিয়ব্রত অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। স্বর্ণলতা দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে সামনাসামনি তাকিয়ে আচ্ছন্ন গলায় বললেন, কী রকম অদ্ভুত স্বপ্ন! আমি নদীর একধারে। দাঁড়িয়ে আছি, ট্রেন ভেঙে-ভেঙে কম্পার্টমেন্টগুলো জলে পড়ছে…শব্দ…চিৎকার…কান্না…তার মধ্যে শুভকে দেখলাম ডুব সাঁতার দিয়ে বেরিয়ে আসছে। নদীর অন্য পারে চলে যাচ্ছে বাঁচবার জন্য—সে যত এগুচ্ছেনদীর পাড় তত ভেঙে-ভেঙে সরে যাচ্ছে। স্বর্ণলতা আর্তনাদ করে। উঠলেন, অথচ আমি যেদিকে ছিলাম, সেদিকের মাটি শক্ত ছিল, ও কেন সেদিকে এল না!

হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞানের মতো প্রিয়ব্রতর কাঁধে মুখ গুঁজে দিলেন স্বর্ণলতা। নিজের নরম, দুর্বল পায়ের ওপর ভরসা না করে শরীরের সমস্ত ভার প্রিয়ব্রতর শরীরে এলিয়ে দিলেন। প্রিয়ব্রত। তাঁকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার কেমন যেন একটা ভয় করতে লাগল, বউদিকে তার এমন রহস্যময় আর কখনও মনে হয়নি।

বউদি, চলো, নীচে যাই। তোমার কি পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে?

পায়ে না রে, তলপেটের কাছটায় ভীষণ ব্যথা। একটু দেরি কর, একটু। প্রিয়ব্রত হঠাৎ অনুভব করল, বউদির তলপেট তার শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। অল্প-অল্প কেঁপে উঠছে সে বুঝতে। পারছে। শুধু তলপেট নয়, স্বর্ণলতার দুই স্তন, তাঁর সমস্ত শরীর তার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে। একথা জীবনে সেই প্রথম অনুভব করল। হঠাৎ তার শরীরে অসহ্য উত্তাপ এল কোথা থেকে। কানের লতি, চোখের পাশ দুটো জ্বলতে লাগল। ইচ্ছে হল স্বর্ণলতাকে আরও জোরে শরীরের সঙ্গে চেপে ধরতে, তাঁর মুখটা তুলে তাঁর তেরো বছরের শুকনো ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠে চেপে ধরতে। একথা তার আগে কখনও মনে হয়নি। ছেলেবেলা মা মারা যাওয়ার পর, বহুদিন সে বউদির সঙ্গে একসঙ্গে শুয়েছে, ঘুমের ঘোরে ভয় পেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে। কোনওদিন শরীরে উত্তাপ লাগেনি। তখন বউদির মাতৃস্মৃতি লেগেছিল।

আজ একটা ভয়ংকর বাসনা তাকে ছুঁয়েছে, তার নিজের হাত অক্টোপাশের বাহুর মতো বউদিকে পিশে ফেলতে চাইতে। সে তৎক্ষণাৎ বলল, চলো, নীচে যাই বউদি, এক্ষুনি।

না, একটু পরে। সত্যি করে বল, সেদিন সিঁড়ির নীচে কে দাঁড়িয়ে ছিল? তুই না শুভব্রত?

আমি।

কে নীলিমাকে পড়ায়?

আমি।

কিন্তু তুই যখন নীলিমার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে হো-হো করে হেসে উঠিস—আমি ঠিক চিনতে–পারি—শুভব্রত ওর বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলে ঠিক এইরকম ভাবে হাসত। আমি কি সব ভুলে যাব? না, না—

প্রিয়ব্রত একটু উষ্ণ স্বরে বলল, কী উলটোপালটা কথা বলছ তুমি, আজ এতদিন পর…। চলো, নীচে চলো।

না, এখন না, আর একটু পর…স্বর্ণলতা প্রিয়ব্রতকে আর একটু দৃঢ়ভাবে ধরে রইলেন। প্রিয়ব্রতর তখন আঙুলের ডগাগুলো পর্যন্ত জ্বালা করতে শুরু করেছে, কপালে ভুরুর ঠিক ওপরে মনে হচ্ছে কে যেন একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে ঘষছে। সে অসহিষ্ণু গলায় বলল, আর না, চলো নীচে, বউদি…

না, অমি নীচে যাব না, আর নীচে গেলে আমি পাতালে নেমে যাব।

কী পাগলের মতো কথা বলছ, চলো। প্রিয়ব্রত প্রায় জোর করে তাঁকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে এল। স্বর্ণলতা ছটফট করে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য চেষ্টা করলেন, কান্না-ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি এখন যাব না, আমি আর কতকাল, না, যাব না, কত ভুলব আমি, না, না…

অর্জুন চাকরটা সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। পিসিমা ঘর থেকে ডাক ছেড়ে বললেন, আবার কী হল রে, আবার কেউ পড়ল না কি টুনু, স্বর্ণ, কী হল, ও টুনু, প্রিয়ব্রত স্বর্ণলতাকে এনে খাটে শুইয়ে দিয়ে যা। স্বর্ণলতা বালিশে মুখ গুঁজে রইলেন। শব্দহীন চাপা কান্নায় তাঁর শরীর কেঁপে উঠতে লাগল। প্রিয়ব্রত পরিশ্রান্ত হয়ে হাঁপাতে লাগল। একটু বাদে মুখ তুলে স্বর্ণলতা বললেন, টুনু তুই এখন এ ঘর থেকে একটু যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।

প্রিয়ব্রত তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

শুভব্রত, তুমি, শেষে তুমি…

প্রিয়ব্রত, তখন নীলিমাকে চুম্বন করছিল। প্রথমে নীলিমা দু-একবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, পরে সে ঘনঘন তার বুকে মাথা ঘষছে। সে এসেছে সকালবেলায় তার টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট জানাতে। প্রিয়ব্রত নীচের ঘরে খবরের কাগজের দিকে মুখ করে বসেছিল।

নীলিমা চোখের ফাঁক দিয়ে একবার দরজার দিকে চেয়ে বলল, ওরকম উস্কোখুস্কো চেহারা কেন আপনার? রাত্তিরে ঘুম হয়নি বুঝি?

প্রিয়ব্রত ওর হাতটা টেনে এনে মুঠোয় চেপে ধরল।

ও কী! হাত ছাড়ুন, হাত ভেঙে যাবে যে! নীলিমা অর্ধেকটা ঠোঁট উলটে নকল ভয়ে হেসে পিছিয়ে এল।

নীলিমা তোমার হাতখানা ধরতে দাও! প্রিয়ব্রতর কণ্ঠস্বর ভূতে পাওয়া মানুষের মতো।

না, সকালবেলায় একী ছেলেমানুষি!

প্রিয়ব্রত তৎক্ষণাৎ চেয়ার থেকে উঠে তরুণ সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। নীলিমা ভয় পেয়ে ঘরের সেই কোণে পিছিয়ে গেল দরজার বাইরে থেকে যে-দিকটা দেখা যায় না। প্রিয়ব্রত একটিও কথা না বলে তাকে চুম্বন করতে লাগল। দু-হাতে তাকে মাটি থেকে একটু উঁচুতে তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

শুভব্রত, তুমি, শেষে তুমিও ঠকাতে চাও আমাকে।

প্রিয়ব্রত মুখ ফিরিয়ে দেখল স্বর্ণলতা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছেন। প্রিয়ব্রত নীলিমাকে মুক্ত না করেই ঈষৎ বিরক্তি-মিশ্রিত ঝাঁঝাল গলায় বলল, তুমি কেন নীচে নেমে এসেছ বউদি?

দেবী প্রতিমার মতো রূপ ছিল স্বর্ণলতার। আজ দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, এক হারিয়ে যাওয়া। নিঃস্ব মানুষের মতো। শরীরের সোনার রঙ ম্লান হয়ে এসেছে, চোখের নীচে ঘন কালির রেখা, দৃষ্টি কেমন যেন অস্বাভাবিক।

আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি, শুভব্রত। কেন তবু লুকিয়ে আছো?

প্রিয়ব্রত নীলিমাকে ছেড়ে ওঁর দিকে এগিয়ে এল। বলল, বউদি, আমি টুনু। আমাকে চিনতে পারছ না?

না, না, আমি ঠিক চিনেছি। আমি জানতুম তুমি মরতে পারো না। কিন্তু কেন তুমি এখনও আমায় ভয় দেখাচ্ছ? শেষে কি ওই মেয়েটার মায়ায় ভুললে! ও তোমার সব রক্ত শুষে নেবে বেরিয়ে যা তুই, বেরিয়ে যা এখুনি। কেন তুই আসিস এখানে, না—

প্রিয়ব্রত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নীলিমা ফিসফিস করে বলল, পাগল হয়ে গেছে। একদম পাগল হয়ে গেছে।

আমি তোমার জন্য তেরো বছর ধরে প্রতীক্ষা করে বসে আছি, আর তুমি ভুললে এই মেয়েটার মায়ায়!

স্বর্ণলতা আর দাঁড়াতে পারলেন না। তাঁর পায়ে জোর কমে আসতে লাগল। প্রাণপণে দরজাটা চেপে আস্তে-আস্তে তিনি বসে পড়তে লাগলেন। প্রিয়ব্রত এসে তাঁর হাত ধরল। বলল, বউদি, আমি টুনু, প্রিয়ব্রত। আমি কিছুতেই শুভব্রত হতে পারি না। ভালো করে আমার দিকে চেয়ে দেখ। চেষ্টা করেও আমি শুভব্রত হতে পারব না।

স্বর্ণলতা আর উত্তর দিতে পারলেন না। গলার কাছে অনেকখানি বাষ্প জমে গেল, চোখ এল ঝাপসা হয়ে। নীলিমাও কাছে এসে তাঁকে ছুঁয়ে বলল, বউদি চলুন, ওপরের ঘরে চলুন। স্বর্ণলতার ডান হাতের মনিবন্ধে পাশাপাশিনীলিমা আর প্রিয়ব্রতর হাত! প্রিয়ব্রতর হাতটাকে যেমন শুভব্রতের হাত বলে চিনতে পারলেন—তেমনি হঠাৎ নীলিমার হাত দেখেও তেরো বছর আগেকার স্বর্ণলতার হাতের মতোই মনে হল। সেইরকম, উজ্জ্বল, মসৃণ, লঘু চামড়া প্রতিটি রোমকূপের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে চঞ্চল আনন্দের প্রবাহ আঁকা আছে।

আর তাঁর নিজের ত্বক—অভিজ্ঞ, মন্থর, গোধূলির আলোর মতো করুণ, প্রতীক্ষায় ক্লান্ত। একবার দুজনের মুখের দিকে তাকালেন, দুটি উজ্জ্বল তরুণ মুখ। তাঁর মনে হল, ওরা দুজনে তাঁর থেকে অনেক দূরে আছে। অনেক দূরে, এক নদীর অন্য পারে। তিনি কিছুতেই ওদের ছুঁতে পারবেন না, শুধু তার দীর্ঘশ্বাস ওদের ঘিরে থাকবে।

ওরা দুজনে আর একবার একসঙ্গে ডাকল, বউদি, বউদি।

স্বর্ণলতা কোনও উত্তর দিলেন না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments