Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাশিরিষ - বাণী বসু

শিরিষ – বাণী বসু

পিসিমা - বাণী বসু

আমার, তোমার, সবার দেশের মতনই সে এক দেশ ছিল। দেশে নগর ছিল, গ্রাম ছিল, গঞ্জ ছিল, বাজার-হাট-মেলা-মোচ্ছব সবই ছিল। কিন্তু কোনও কিছুরই যেন কোনও ছিরি ছিল না। কেউ গাইলে মনে হত সারাক্ষণই কেন অমন কাক ডাকে গো! কেউ নাচলে মনে হত যেন মামদো-গোভূতে নেত্য করছে। তাল ছটকে যায়, সুর হড়কে যায়, লয় পিছলে যায়। অন্নের স্বাদ খড়ির মতন। আনাজপাতি ভুসকো, জলের মাছ জলেই মরে, দেশ ভরা শুধু ধোঁয়া কালি আঁধার আর আওয়াজ।

কেউ জানে না সেই মামদো-গোভূতের গাঁক গাঁক আওয়াজের দেশে শিরিষ কোথা থেকে এলো। এ চত্বরের সবচে’ বুড়ো মানুষ, যার নাম নবীনমাধব, সে নাম এখন কেউ জানে না, সবাই ডাকে সাণ্ডেলখুড়ো, সেই খুড়ো যে চোখে দেখে না, কানে শোনে না, কি শীত কি গ্রীষ্ম বাঁদুরে টুপি চড়িয়ে যে খালি কে যায়, কোথায় যায়, বলে সারাবেলা খামোখা হাঁকড়ে হাঁকড়ে ওঠে, সেই নবীনমাধবও না। কেউ যদি একবার জিজ্ঞেস করে—‘শিরিষ ঠাকরুণ কোত্থেকে এলো গো?’ অমনি সে কানের পেছনে হাত দিয়ে সাত বার কোশ্চেন করে শোনে, তারপর ভুরু কুঁচকে সরু চেরা বাঁশের মতো গলায় বলে ওঠে—‘কি জানি বাপু, কেমন করে কখন ঘটে গেল ঘটনাটি।’

রাস্তার মোড়ে ঘেরা মাঠ, মাঠের ঈশান কোণে ঈশানী এক মহীরুহ বৃক্ষ। তার আগাপাশতলা খালি পাখির বাসা আর পাখির বাসা। সন্ধের ঝোঁকে গাছ ঘিরে কলকলানি ক্রমেই এমন জোরালো হয়ে ওঠে যে মনে হয় পাহাড়ি নদী বইছে, পাগলাঝোরা হয়ে এখুনি পাথর টপকে টপকে নামবে। এই গাছটিতে কখন পাতা ঝরে, কখন পাতা গজায়, কখন কোন পাখি বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়, আবার উড়ে যায়, কেউ কি কখনও নজর করে দেখেছে? কেউ দেখেনি। অথচ বৃক্ষ ক্রমেই আরও বলবান, আরও বীর্যবান, আরও আশ্রয়শীল, আরও ছায়াময় হয়ে উঠছে। কেউ জানে না তার ইতিহাসও।

মাঠের কোণের গোলাপি বাড়িটা কবে শিরিষের পিতৃপুরুষ কিনেছিলেন, কবে শিরিষ অন্য কোথাও জন্মালো, কবে, কেমন করে বড় হল, কেন এখানে সোমত্ত বিধবা (?) চলে এলো, কবে তার বিষাদ যোগ, সাংখ্যযোগ শেষ হয়ে কর্মযোগ শুরু হল, অতশত ইতিবৃত্ত কে-ই বা মনে রেখেছে। নবীনমাধব বলে—‘আমায় শুধিও না বাপু, বলে নিজের জ্বালাতেই মলাম!’ বুড়ো যেন সংসারের ভারি ভুরি বড় গিন্নির মতো পেটের মধ্যে অনেক কথা রাখে ঢাকে।

শিরিষের ঘরসংসারের বাইরের দিকে একটি দারোয়ান, একটি কোচোয়ান। একটি মালি, আর ভেতরদিকে একটি দাস, একটি দাসী, এবং একটি একমাত্তর কন্যে। এরাই বাড়ির বারমহলে, অন্দরমহলে হাত পা ছড়িয়ে বসবাস করে। অতবড় বিঘের ওপর বাড়ি বাগান! তার দেখ-দেখালি, গোছ-গাছালি সব এরাই রয়ে বসে করে। ছোট্ট টুকটুকে মেয়েটি সাবেক কালের টমটম গাড়ির বাইরে বড় একটা পা দেয় না, টকাটক আসে, টকাটক যায়, এক ঝলকে লোকে শুধু দেখতে পায় ঠাকরুণের কন্যেটি যেন ভরা গ্রীষ্মের চম্পক, কিংবা গন্ধরাজ, সূর্যের সবটুকু সৌরভ শুষে নিয়ে তৈরি হয়েছে। অন্দরের বাগানে সে আপনমনে খেলে বেড়ায়, নেচে বেড়ায়, গেয়ে বেড়ায়, সব একা-একা। নয়তো তার মায়ের সঙ্গে। কিন্তু তার মা শিরিষ ক্রমেই অন্দরমহল থেকে বারমহল, বারমহল থেকে দেউড়ি, বারান্দা থেকে বাগান, বাগান থেকে বড় রাস্তা, দোকান, বাজার, ব্যাঙ্ক ইস্কুল, কলেজ, কেলাব, খেলাধুলো, যোগব্যায়াম, সাঁতার…।

জিনিসটার শুরু হয় এইভাবে। পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা চাঁদা চাইতে এসেছিল। সরস্বতীপুজো করবে। দারোয়ান রামখেলাওন তাদের হাঁকিয়ে দেয়। তার বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত। পাড়া বেপাড়া যেখানে যোতো সোরোসতী মাঈ আসছে সোবাই কি তার মাকে পুছে পুছে আসছে! পুছে পুছে যদি না আসলো তো ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিঁয়াসে। বাচ্চা তো নয়, চুহা এক-একটা। বিল্লি ভি আছে। লেকিন মিলে মিশে আছে, তাইতে কেস বহোৎ খতরনাক হয়ে যাচ্ছে। এই রকম রামখেলাওনি বিশ্লেষণের মাঝমধ্যিখানে একটি চুহাসম বাচ্চা ভেতর বাড়ির দিকে দৌড়ে গিয়ে ‘মাসিমা, মাসিমা, আসতে দিচ্ছে না’ বলে সরু গলায় চেঁচাতে থাকে। শিরিষ তখন সেই মুহূর্তটা নিরানন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে মধুতে আটকানো মক্ষীর মতো নিশ্চল ছিল। বাচ্চার মিঠে গলার তীক্ষ্ণ ডাক একেবারে তার বুকের মধ্যে গিয়ে পৌঁছলো, তার মনে হল সে নিজেই বুঝি কাকে কিছুতেই আসতে দিচ্ছে না। সেই কেউ তার দোরের বাইরে ধর্না দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার মিষ্টি সরু গলা অনেক আকিঞ্চনে তার কাছে প্রার্থী। সে তার দোতলার পুরনো মার্বেলের ঘর থেকে এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। হঠাৎই যেন তার মরা নদীর সোঁতায় জোয়ার এসেছে। উঠোনের এক দিকে লম্বা চওড়া ইয়া গোঁপ, ইয়া গুল রামখেলাওন, অন্যদিকে অস্বাভাবিক সাদা, ক্ষীণা এক উদাসিনী নারী। মাঝখানে পড়ে বাচ্চাটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেঁচাতে ভুলে গেছে।

শিরিষ বলল—‘চাঁদা নিয়ে কি করবি থোকন?’

বাচ্চাটি ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলে বলল—‘খাবো।’

—‘কী খাবি?’ শিরিষের মুখে সামান্য হাসি।

—‘লুচি আলুর দম’—বাচ্চাটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল।

আরও ছেলে-মেয়ের দল তখন অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। আস্তে আস্তে প্রকাশ পেলো পাড়ার বড়রা সরস্বতীপুজো করে ঠিকই, কিন্তু সকালের খিচুড়ি-লাবড়া-ভোগ পর্যন্ত বাচ্চাদের অধিকার। সন্ধেবেলায় যে লুচি, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, পায়েস দিয়ে রাজসিক ভোগ হয় সে ভোগের কণামাত্র বাচ্চাদের কাছে পৌঁছয় না। তাই তারা এ বছর প্রতিজ্ঞা করেছে টুলুর বাড়ি কাঠের সরস্বতী আছে, তাই দিয়ে মিন্টুর বাড়ির বাইরের ঘরে পুজো করবে, গণেশের বাবা অবসর সময়ে পুজো-আচ্চা করে থাকেন, তিনিই পুজো সেরে দেবেন এবং চাঁদা তুলে সবাই লুচি আলুর দম খাবে, খাবেই।

—‘কতজন আছিস তোরা?’ শিরিষ নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।

—‘সতেরজন।’

—‘আমার বাড়ি সরস্বতী পুজো হয়, সন্ধেবেলা তোদের নেমন্তন্ন। প্রসাদ খাবি।’

রামখেলাওনের মুখ ক্রমশই হাঁ হয়ে যাচ্ছিল।

সরসোতী পুজো? পুজো-উজো এ কোঠিতে সে কোন দিন দেখেনি।

কিন্তু ছেলের দল এলো। প্রথমে সসঙ্কোচে, একটি দুটি করে। তারপর বেশ সপ্রতিভভাবে দলে দলে। বড় হলঘরে আসন পেতে সব্বাইকে খাওয়ালো শিরিষ। বালভোজন। সাদা সাদা লুচি, লালচে-হলুদ ফুলকপি, সাদা সবুজ আলু-মটরশুঁটি, টুকটুকে লাল চাটনি, হালকা বাদামি পায়েস। কমলাভোগ, যে যটা পারে।

বা রে বা! সরস্বতী ঠাকুর কোথায়? পুজো হবে না? কাঁসর ঘণ্টা বাজবে না? ছেলের দল হই-হই করছে। তখন ঘরে ঢুকল সত্যিকারের বাল-সরস্বতী শিরিষের মেয়ে প্রসর্পিতা। সাদা সিল্কের শাড়িতে নীল পদ্ম-পাড়। হাতে তানপুরো। সে সবাইকে নিয়ে গাইবে, নাচবে। সরস্বতীর গান, লক্ষ্মীর গান, দুর্গার গান, আসলে যে যেখানে সব যশো দেহি, দ্বিষো জহি আছে সব্বাইকার গান।

এইভাবে দিন যায়। একদিকে প্রসর্পিতা গান গায়, অন্যদিকে বাগানের ফুলগুলি সব আহ্লাদ নিয়ে ফুটে ওঠে, গাছ আলো করে। প্রসর্পিতা হাসে। পাখিগুলির মধ্যে কূজনের প্রতিযোগিতা পড়ে যায়, প্রসর্পিতা নাচে তার সঙ্গে সঙ্গত করে বৈশাখ-আশ্বিনের ঝড়, আষাঢ়-ফাগুনের বিষ্টি, সহনর্তকীর ভূমিকায় নেমে পড়ে ফুলো ফুলো ব্যালের পোশাক-পরা সাদা মেঘের দল। শিরিষ প্রথমে ছোট ছেলেদের, তারপর মেয়েদের, তারপর বড় ছেলেদের, তারপর গিন্নিদের মজলিশে যায়। মজলিশের চেহারা পাল্টে যেতে থাকে। কবে যে পাল্টে গেল, কেউ বুঝতেই পারে না। খুব আশ্চর্যের বিষয়, কিন্তু একদম নির্জলা সত্যি কথা যে শিরিষদের পাড়ায় কোনও বাড়িতে দেওয়াল-লিখন নেই। মিছিল যায় না। যে যার সময়মতো কাজে কম্মে যায়, বাড়ি ফিরে আসে। ছেলেমেয়ের দল প্রাণভরে খেলাধুলো করে আঁধার নামলে যে যার মতো বাড়ি যায়। আজান, গ্রন্থসাহেব আর গীতার আয়োজন যারা লাউডস্পিকারে করেছিল তারা আজকাল বড্ড ব্যস্ত। ওই যে মৌলভিসাহেব দাঁড়ি আঁচড়িয়ে, চোখে সুর্মা, কাকে কাকে যেন আজকাল আরবি পড়াচ্ছেন। বলবন্ত সিং-এর দলের এমন রমরমা সূর্য-উনুনের ব্যবসা যে তারা আর কিচ্ছুটির সময় করতে পারে না। গীতা-ভাস্কর নীলমণি পণ্ডিত বাড়িতে টোল খুলেছেন। বহু জায়গা থেকে কথ্য সংস্কৃত শিখতে তাঁর কাছে লোক আসছে। সেই যে একবার নীলু পণ্ডিত সপ্তমী পুজোর শেষাশেষি বৃষ্টি আসতে দেখে বলে ফেলেছিলেন:

বৃষ্টি পততি পট পট পট

মনঃ করোতি ছট ফট ফট

ছত্রং ধরয় চট পট পট

তাত মণ্টু ডোন্ট সে নট।

সেই থেকে ছেলেদের বায়না হল নীলু পণ্ডিতকে এই সহজ সংস্কৃত শেখাতেই হবে। শিরিষের বাড়ির ঠাকুরদালানে তার ব্যবস্থা হল। শিরিষ এখন ছড়িয়ে গেছে সবখানে, সবখানে, সবখানে। সে আর সাদা একখানা খড়ির পুতুলের মতো নেই। কড়ির মতন সাদা কবেকার শঙ্খিনীমালার মুখ তার নেই। শঙ্খমালা এখন কাঞ্চনমালা হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা-ছাপ ফেলে শিরিষ এ কাজে সে কাজে নানা কাজে ঘুরে বেড়ায়। অঞ্চলটি আনন্দে গৌরবে সাফল্যে থই থই করে। তার ছটপরবের ঢোল কাঁসি, তার রঙ্গোলিবিহুর নাচ, তার বৈশাখীর আমোদ, তার লক্ষ্মীর পাঁচালি আর ভাদুর গানের মৃদু মধুর সুর গ্রাম-গঞ্জের আবহাওয়াতে গাবগুবাগুবের মতো বাজতেই থাকে, বাজতেই থাকে।

এইসব করতে করতে শিরিষের হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে মধুর মতো গাঢ়, সেই বিষাদসিন্ধুর পরিধি ক্রমেই ছোট হতে থাকে। এক-এক দিন নিশিরাতে ঘুম ভাঙলে শিরিষ ছাতে উঠে যায়। নারকোল গাছের পেছনে একটি বাঁকা চাঁদ ঝুলে থাকে, কালচে আকাশে ফুটফুট করছে তারা। সেদিকে তার সাদা মুখের দ্যুতি তুলে ধরে শিরিষ কোন গোপন গহন অতীতের উদ্দেশে বলে ওঠে—‘তুমি কোথায় আছো হে বঞ্চক, যেখানে যে স্বর্গের ময়ূরসিংহাসনেই থাকো তুমি আর আমার মনের নাগাল পাবে না। তুমি থাকো কঠিন মণিমাণিক্যময় প্রতারক স্বর্গে, আমি এই কঠিন পৃথিবী সবুজে ভরিয়ে ফেলব। সবুজ আরও সবুজ। সবুজের অগ্রভাগে স্বর্ণাভা লাগবে, সুবাস দুলবে বাতাসে, আমি যেখানে যেখানে যাবো, সেইখানে সেইখানে তোমার সোনা মরকতকে লজ্জা দিয়ে পৃথিবীর আপন হৃদয়ের সোনিমা শ্যামলিমা আমার পেছনে পেছনে যাবেই যাবে। বলে শিরিষ হাসতে থাকে। সে কোনও সশব্দ টংকারঅলা চ্যালেঞ্জের হাসি নয়। দিকদিগন্ত শান্তি ও সুষমায় ভরিয়ে তোলা সে এক অদ্ভুত অরোরা বোরিয়ালিস।

শিরিষ যখন তার মধ্যরাত্রির উদগীথ সেরে এইভাবে নেমে আসে তখন শোবার ঘরে তার হৃদয়ের কাছে চন্দ্রকান্তমণির মেয়েটি ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে। তার কোমল কপালে আলতো পরশ রাখে শিরিষ।

—‘তুমি কী স্বপন দেখছো জাদু? তুমি কি আমার মতো ভুবনময় পঙ্কসরোবরে কমল ফোটাবার কাজটি নেবে? তোমাকে আমি শিখিয়ে দিয়ে যাবো ফুল ফোটাবার মন্ত্র। পাখি-হরিণ-কীটপতঙ্গ বশীভূত করার অখণ্ড বাঁশিটি আমি অনেক সাধনায় খুঁজে পেয়েছি, তোমার হাতে তুলে দিয়ে যাবো।

পাশ ফেরে প্রসর্পিতা। তারপরেই তার চোখের পাতার ভেতরে মণিদুটি কাঁপতে থাকে, মেয়ে ঘুমের ঘোরে ফুঁপিয়ে ওঠে। শিরিষ সন্তর্পণে মেয়ের অফোটা পদ্মের মতো বুকের ওপর থেকে হাত দুটি সরিয়ে রাখে। বুকের ওপর হাত রেখে শুলে পাথর-দত্যি পিষে মারে। —‘মা আমার ঘুমাও, শিয়রে জাগিয়ে রাখলাম ঘিয়ের বাতি, আমার নিঝুম দুটি চোখ, শীতল দুটি হাত রইল তোমার শিথানে। সুখে নিদ্রা যাও মা।’

মেয়ে শিরিষের সুখ, মেয়ে শিরিষের শান্তি, মেয়ে তার আনন্দ আহ্লাদ, বিস্ময়, রোমাঞ্চ, মেয়ের ভেতর দিয়েই শিরিষ তার ভুবনখানি দেখে। প্রসর্পিতা যদি বলে—‘মা আমি কেন এমন একা?’ শিরিষ বলে—‘আমার ঊর্ধ্ব এবং অধঃ, আকাশ এবং ভূমি, একবার মাত্র একবারই যে ঐকতানে বেজেছিল মা, এমন ঘটনা তো আর দ্বিতীয়বার ঘটে না!’ প্রসর্পিতা যদি বলে, ‘মা, আমার পিতা কে?’ শিরিষ বলে—‘তোমার পিতা পুরুষ, বীজ রোপণ ভিন্ন যার আর অন্য ভূমিকা নেই।’ প্রসর্পিতা তখন বলে—‘মাগো তুমিই কি আমার সব?’ মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শিরিষ বলে ওঠে—‘আমি তোমার সব কি না জানি না মাগো, কিন্তু তুমি আমার সর্বস্ব।’ সত্যি-সত্যি, মেয়ে হাসছে বলেই তার কোলের কাছে ভিড় করে আসা যাবতীয় শিশু বালক বালিকার হাসি শিরিষের বুকে দোলা দেয়। মেয়ে গায় বলেই, সে তার বাগান, বাগান পেরিয়ে পর-প্রতিবেশীর বাড়ির চুড়োয় দোয়েলের শিস শুনতে পায়, ফিঙের দোল দেখতে পায়, বেনে-বউ গটগটিয়ে হেঁটে গেলে ঝিলিক ঝিলিক হাসে। আর গভীর রাতে পাপিহা তীব্র করুণ স্বরে পিউ কঁহা পিউ কঁহা বলে ডেকে উঠলে কিশোরী মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে মধ্যযৌবনের দ্রুতচ্ছন্দ চঞ্চল হিন্দোলটি সে প্রাণপণে কল্যাণ ঠাটে এনে বাজাতে থাকে।

ওরা কেউ জানে না এই মৌজা, এই গ্রাম, এই গঞ্জ, এই উপনগর, মহানগর সব স-ব আসলে শিরিষরাই গড়েছে। কারণ গড়ে অনেকে মিলে, কিন্তু মন্ত্রটি কানে দেয় একজন-দুজন। থাকতে পারে রাজ্য, প্রয়োজনের খেয়ালে গড়ে ওঠা, কিন্তু তার বিচিত্র বেসুরে যে সঙ্গতি আনে সেই প্রকৃত রাজ্যপাল। ওরা এ-ও জানে না বন্ধ্যা নিষ্ফলা কপিশ ভূমির এই যে তীব্র সবুজ স্বপন এর পেছনে আছে একটি মানুষের বিষাদের পারে পৌঁছনো গভীর মন্দ্রিত আনন্দ। ওরা এও জানে না এই আনন্দের পেছনে আছে রক্তমাংস নাক চোখ মুখের প্রাণভরা, তৃষাহরা, নয়নের মণি, বুকের কলজে এক কন্যে। শিরিষ নিজেও জানে কি? সে যে এক দিক থেকে আরেক দিক পর্যন্ত একটা সাদা ফুরফুরে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়ায়, তার পাখায় এমন বেগ, শরীরে এমন লঘিমা কে দিল, কেমন করে দিল, অতশত বিশ্লেষণে কি তার মন যায়? সে শুধু জানে অনেক মিথ্যের ঝকমকানি তাকে এক সময়ে অন্ধকারের গহনে নিয়ে গিয়েছিল, সেই অন্ধকার সে একা একা পার হয়েছে, এখন তার চোখে মুক্তার লাবণ্যচ্ছটা। তাই সে প্রজাপতি, তার উড়ন্ত পায়ের আঙুলগুলি পরাগের রেণুতে রেণুতে রঞ্জিত হয়ে থাকে, আর সেই রঞ্জন আদিগন্ত ছড়িয়ে গিয়ে অফলা আমগাছটির শীর্ষ শাখাটি পর্যন্ত বউলে বউলে ঝমঝম করতে থাকে। আর, সবাই অতশত জানে না বলেই মানুষের ঠোঁটে ঠোঁটে নামগুলি হাটে হাটে বাটে বাটে ফেরে, যেন তারা প্রশ্বাস নিচ্ছে। নিশ্বাস ফেলছে।

সেদিন বসন্তকালের সন্ধেবেলা। মধুমাধবী সারঙের শেষ মূৰ্ছনার মতো গোধূলিবেলা মিলিয়ে গেল। আকাশ থেকে সাঁঝের কুয়াশা গাছগাছালির অলিতে গলিতে ঝুপঝাপ করে নেমে পড়ছে। শিরিষের বাড়িতে জগদ্দল কটা দু-ঠেঙে গাড়ি এসে থামল। কী তাদের চক্কর! কী-ই বা তাদের গর্জন! গাড়ির থেকে নেমে এলো এক, দো, তিন, চার, পাঁচ, ছে, রামখেলাওন গুনেছিল, মুশকো মুশকো লোক। শান্তিমণি দেখেছিল তাদের হাতে ইস্টিলের বালা, কানে রুপোর মাকড়ি, গলায় সোনার চেন, জামার খোলা বুকের ভেতর দিয়ে দলা দলা রোম দেখলে গা শিউরোয়। রামখেলাওন কবে ছেলেমানুষ আর ভিখারি তাড়াবার দারোয়ানগিরি করত, তাও সে কবেই ভুলে মেরে দিয়েছে। খইনি ডলতে ডলতে তার হাতের তালু ঝুলে পড়ল। ঘড় ঘড় করে গেট খুলে ছ জোড়া বুট সোজা অন্দরবাড়ির দিকে চলে গেল। গট গট গট গট গট গট…।

—শীর্ষা দেবী আছেন? শীর্ষা দেবী?

—আপনারা কে? এখানে শীর্ষা দেবী বলে কেউ থাকেন না।

—তাহলে শিশির দেবী, শিশিরকণা, শিশিরবালা, কিংবা শিশির মালা…

শিরিষ চুপ করে রইল।

—চট্টরাজদাকে চেনেন? মোহিতবরণ চট্টরাজ?

কে না চেনে? শিরিষ চুপ করে রইল।

—মোহিদ্দা আপনাকে জানিয়েছেন এবার থেকে আপনি আমাদের নেত্রী। অভয়বিন্দু দাঁকে নেক্স্‌ট্‌ নির্বাচনে কাত করতে হবে।

শিরিষ গম্ভীর গলায় বলল—আমি এসব বুঝি না।

—বুঝে নেবেন। মোহিদ্দা বুঝিয়ে দেবেন।

—আমি এসব দলাদলি করি না।

—মোহিদ্দা করবেন, আপনি শুধু দাঁড়াবেন।

—আমি এসব ঘেন্না করি।

—আপনি ঘেন্না করলে কি হয়, মোহিদ্দা এসব ভালোবাসেন। অট্টহাস্য করে উঠল পাতালবাসী যুবকের দল।

—‘নির্বাচন আমাদের রুজি, নির্বাচন আমাদের পুঁজি, নির্বাচনকে যে গাল দেয় আমরা তার কপালে স্টেনগান গুঁজি…।

দু পেয়ে জগদ্দলগুলো রাস্তা কাঁপিয়ে চলে গেল। নবীনমাধব তক সমস্ত মানুষ ক্রমে ক্রমে এসে ভেঙে পড়ল শিরিষের ভেতরবাড়ির আঙনে। কাঁচা-পাকা নানান গলায় শোনা গেল—‘শিরিষমা, শিরিষদিদি, শিরিষ বোন। না করো না মা, না করো না! মোহিতবরণ আর অভয়বিন্দু ও দুজনেই কাঁচাখেকো দেবতা। এ ছাড়লে ও ধরবে, ও ছাড়লে এ ধরবে। আর নিস্তার নেই।’ যারা আরও অভিজ্ঞ, আরও বয়স্ক তারা ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়লে—‘কথাটা যত সহজ সোজা শোনাচ্ছে ততটা কখনো নয়, উঁহু, এর ভেতরে কিছু গুহ্য কথা আছে, কিছু ভয়ঙ্কর কথা।’

সবাই চলে গেলে তখনও সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে রয়েছে শিরিষ। চোয়াল দুটি কঠিন, কপালের মধ্যিখানে নীলশিরা দপদপ করছে। চুল যেন রুক্ষ ধূসরবর্ণ।

ঝড়ের আগের সময়ের মতো থমথমে দিন যায়। এক দুই তিন করে সাত দিন। শিরিষ আস্তে আস্তে আবার কাজকর্ম করছে। রামখেলাওন গেট খুলছে, গেট বন্ধ করছে। সাত দিনের দিন বাড়ি ফিরে শিরিষ দেখল, রামখেলাওন কপাল চাপড়াচ্ছে। শান্তিমণি কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেছে। মোহিতবরণের বিশাল ল্যান্ডরোভার এসে প্রসর্পিতাকে গেটের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেছে। শিরিষ ছুটল চট্টরাজের বাড়ি। গেটের পরে গেট, তারপরে গেট, তারপরে আরও গেট, সব তালাবন্ধ। লোকে বলল চট্টরাজদা হনিমুনে গেছেন। কোথায় কেউ জানে না। শিরিষ ছুটল থানায়, ভারপ্রাপ্ত অফিসার দেখালেন আঠার বছরের মেয়ে স্বেচ্ছায় মোহিতবরণের সঙ্গে চলে গেছে, তলায় স্বাক্ষর। শিরিষ সরোষে বলল ‘এ সই জাল।’ অফিসার বললেন—‘স্ত্রীলোক বড় গোলমাল করে, সামনে থেকে নিয়ে যাও।’ শিরিষ ছুটল অঞ্চলপ্রধানের বাড়ি, তিনি বললেন—‘এ তো তোমার সৌভাগ্য মা। মেয়ে রাজরাণী হয়ে গেল।’ শিরিষ গেল রাজ্যপ্রধানের বাড়ি। অনেক দিনের অনেক ধরনার পর তিনি যখন দেখা দিলেন, বললেন—‘এতো বড় রাজ্য, তাতে এতো প্রদেশ, এতো মহকুমা, এতো জেলা, এতো তার কর্মযজ্ঞ, কোন পাড়াতে কোন মায়ের কোন মেয়ে উচ্ছন্নে গেল সে-ও কি তবে আমায় ব্যক্তিগতভাবে দেখতে হবে?’

মাঠের কোণের গোলাপি বাড়িটির পলেস্তারা খসে গেছে। ভাঙা গেটের ধারে টুলে বসে রামখেলাওন আর ‘রাম ভজো’ গান ধরে না। বাগানটি বিছুটিতে আক্রান্ত। কেউ জানে না শিরিষ কোথায়। মাঠে ছোট ছেলেমেয়েরা আর বল খেলে না, বড়রা খেলে। সন্ধে হলেই ফিসফাস, হি হি হি, হো হো হো, হিং টিং ছট। সকাল হলে রজনীগন্ধার বাসি মালা, আর খালি বোতল, চাঁটের ঠোঙা আর কাগজের পেলেট, আরও হাজারো অকথ্য নোংরা ঝাঁটাতে ঝাঁটাতে মালি খুশিমনে পকেটের পয়সা বাজায়। যখন-তখনই হাতে সাইকেলের চেন নিয়ে দু ঠেঙে গাড়িতে টহল দিয়ে বেড়ায় রাক্ষুসে যুবকের দল, যাকে হাতের কাছে পায় মেরে উচ্ছন্ন করে দেয়, রাতের আঁধারে ফ্যামিলিকে ফ্যামিলি কাদের চপারে শেষ হয়ে যায়, কেউ জানে না, খালি রক্তগঙ্গায় চুবে হু-হু করে কাঁপতে থাকে। হাটে বাজারে দোকানে রাস্তার মোড়ে বোমা ফাটে, টুকরো টুকরো হয়ে যায় বেসাতি, দোকানঘর, কেনা-বেচা-করতে আসা মানুষজনের দল। নবীনমাধবের আজকাল পক্ষাঘাত। মেয়ে বউগুলি চোখ গোল গোল করে কেচ্ছা শোনে, কার বাড়ির ছেলে…কোন বাড়ির মেয়ে!

সে বছর বিষ্টি হল না। মাটি জ্বলে গেল, ধানগুলি সব খড়। দিগন্ত পর্যন্ত খাঁ খাঁ খোয়াইয়ের মতো লালচে মাটির দিকে তাকিয়ে রমজান মিঞা আর সুরিন্দর সিং, দুলাল হাজরা আর গোবিন্দ মাঝি হাহাকার করে কপাল চাপড়ালো। কুয়োর জল শুকিয়ে গেছে। শ্যালোয় শুধু চাগাড় মারাই সার। খালতলায় একটুখানি কাদাঘোলা। মাঠের ঈশান কোণের গাছটি এতদিন দাঁড়িয়েছিল, কেউ দেখেনি ঘুণপোকায় তার ভেতর ফোঁপরা হয়ে গেছে। সেই ফোঁপরা গাছটি হঠাৎ একদিন দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল। আর তারপর আরম্ভ হল বিষ্টি, বিষ্টি, বিষ্টি। এক দিন দু দিন তিন দিন, তারপর দিনের পর দিন। গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মাঝঘুমের মধ্যে একদিন চকিত হয়ে উঠে বসল মানুষগুলি, অন্ধকারে ভালো ঠাহর হয় না, তবু বোঝা যায় লক্ষ ফণা তুলে ছুটে আসছে হড়পা বান। গরু, বলদ, রাখাল, বাগাল ভাসিয়ে, মাটি খড়ের ঘর দুয়োর ফাঁসিয়ে, পাকা বাড়ির ভিত নাড়িয়ে অবশেষে ডাঙায় জলে একাকার করে সেই সর্বনেশে বন্যা সব ডুবিয়ে দিয়ে চলে গেল। থই থই করে দুলতে লাগল জল শুধু জল আর জল। এ মেরু থেকে ও মেরু পর্যন্ত। কৈলাস থেকে আরারত। সেই প্রলয়পয়োধিজলে একটি নূহর নৌকাও রইল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments