Saturday, April 20, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পশিবেনবাবুর ইস্কুল - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শিবেনবাবুর ইস্কুল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শিবেনবাবুর ইস্কুল - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

সকালে বেড়াতে বেরিয়ে মহেন্দ্রবাবু একটা ভাঙা পরিত্যক্ত ইস্কুলবাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। স্কুলবাড়ি দেখলেই চেনা যায়। লম্বামতো বাড়ি, সার সার ঘর, মাঝখানে একটা উঠানমতো। তিনি ত্রিশ বছর নানা ইস্কুলে পড়িয়েছেন। এই সবে রিটায়ার করে হরিপুরে খুড়শ্বশুরের বাড়িতে কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে এসেছেন।

একটা লোক সামনের মাঠে খোঁটা পুঁতছিল। তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, বাপু হে, এটা যেন স্কুলবাড়ি বলে মনে হচ্ছে, তা এর এরকম ভগ্নদশা কেন?

ভগ্নদশা ছাড়া উপায় কী বলুন! শিবেন রায় ইস্কুল খুলেছিলেন, কিন্তু মোটে ছাত্তরই হয় না, তাই উঠে গেছে।

বল কী? তা ছাত্র হয় না কেন?

অ্যাজ্ঞে এ হল গরিবের গাঁ, ছেলেপুলেদেরও পেটভাতের জোগাড় করতে কাজে লেগে পড়তে হয়, পড়বার ফুরসত কোথায় বলুন?

তাহলে তো বড়োই মুশকিল, এক কাজ করলে হয় না? যদি বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে ক্লাস করা হয় তাহলে?

লোকটা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, তার জো নেই কর্তা, কেরোসিনের যা দাম হয়েছে তা কহতব্য নয়, শুধু দামই নয়, মাথা খুঁড়লেও তেল পাওয়া যায় না এখানে। তাই সন্ধ্যে হতে না হতেই গোটা গাঁ ঘুমে একেবারে ঢলাঢ়ল, সন্ধ্যের পর এ গাঁয়ে আলোর ব্যবস্থাই নেই, অন্ধকারে কি লেখাপড়া হয়?

মহেন্দ্রবাবু শিক্ষাব্রতী মানুষ, শিক্ষা জিনিসটা মানুষের জীবনে কত প্রয়োজন তা তিনি ভালোই জানেন, তাই বললেন, কিন্তু বাপু হে, শিক্ষারও তো একটা দাম আছে।

লোকটা একগাল হেসে বলে, তা আর নেই! শিক্ষা বড় উপকারী জিনিস মশাই, দু-চারটে ইংরিজি বুকনি ঝাড়লেই আমি দেখেছি গা বেশ গরম হয়ে ওঠে। শীতকালেও ঘামের ভাব হয়। তারপর ধরুন ইতিহাস, দু-পাতা পড়লেই এমন চমৎকার ঘুম এসে যায় যে, এক ঘুমে রাত কাবার, অঙ্ক কষতে বসলে খিদে চাগাড় দেবেই কী দেবে, একথালা পান্ত খেয়ে আঁক কষতে বসেই খিদের চোটে উঠে পড়তে হয়েছে।

মহেন্দ্রবাবু একটু হতাশ হলেন বটে, কিন্তু ধৈর্য হারালেন না, বললেন তা বাপু, ইস্কুলটা চালু করার একটা ব্যবস্থা করা যায় না?

লোকটা কাঁচুমাচু মুখে বলে, শিবেনবাবু পটোল তুলেছেন। তার ছেলেমেয়েরা ব্যাবসাবাণিজ্য নিয়ে ভারি ব্যস্ত। ইস্কুলের পিছনে কে টাকা ঢালবে বলুন? ছাত্তরও নেই।

তাই তো! বড়ো সমস্যায় পড়া গেল দেখছি।

মহেন্দ্রবাবুর খুড়শ্বশুর পাঁচকড়ি সমাদ্দার বললেন, শিবেনবাবুর ইস্কুলের কথা বলছ নাকি বাবাজি? ও তো এখন সাপখোপের আড্ডা, শিবেনবাবু ভালো ভেবে ইস্কুল তৈরি করলেন বটে, কিন্তু চালাতে পারলেন কই? আর এ গাঁয়ের লোকের লেখাপড়া শেখার গরজও নেই, শুনছি শিবেন্দুবাবুর ছেলেরা ইস্কুলবাড়িতে গুদামঘর বানাবে।

মহেন্দ্রবাবু শিক্ষাব্রতী মানুষ, দমলেন না, পরদিনই গিয়ে শিবেনবাবুর বড়ো ছেলে গোবিন্দর সঙ্গে দেখা করে বললেন, স্কুলটা আবার চালু করলে ভালো হয়।

গোবিন্দ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ট্যাঁকের কড়ি আর কতকাল গচ্চা দিতে হবে বলুন তো? বাবা তো কম টাকা ঢালেননি, আজ অবধি ক-টা মাধ্যমিক টপকেছে তা জানেন? পঞ্চাশ জনও নয়, আর তা না-হবেই বা কেন? যা ভূতের উৎপাত!

মহেন্দ্রবাবু অবাক হয়ে বলে, ভূতের উৎপাত? সে আবার কী?

তবে আর বলছি কী? দিনেদুপুরে খাতা পেনসিল টেনে নিয়ে যায়, চেয়ার-টেবিল উলটে দেয়, ব্ল্যাকবোর্ড মুছে দেয়, পরীক্ষার সময় ক্যানেস্তারার শব্দ করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে, সবাই জেরবার হওয়ার জোগাড়।

মহেন্দ্রবাবু হেসে বললেন, ভূত একটা কুসংস্কার বই তো নয়, নিশ্চয়ই কোনো দুষ্টু লোক আড়াল থেকে এসব করাচ্ছে।

গোবিন্দ বলল, তা পটল ঘোষ দুষ্টু নয়, এ কথা কেউ বলেছে কি? হাড়েবজ্জাত মানুষ ছিল মশাই, গাঁয়ে কোনো ভালো কাজ হতে গেলেই বাগড়া দিত, নতুন রাস্তা হয়েছে, পটল দলবল নিয়ে রাতে এসে রাস্তা খুঁড়ে রেখে যেত। জলাশয় হচ্ছে, পটল গিয়ে রাতারাতি তাতে ঢেলে রেখে আসত, গাছের চারা লাগালে উপড়ে ফেলতে লহমাও সময় লাগত না তার। পটলের আমলে এ গাঁয়ে একটাও স্কুল হয়নি, হলেই মামলা ঠুকে, মিথ্যে নালিশ করে কাজ আটকে দিত।

তা সেই পটলবাবু কোথায় থাকেন?

তা কে জানে মশাই, তবে কয়েক বছর হল সে মারা গেছে, ভেবেছিলাম এবার গাঁ জুড়োবে, তা কোথায় কি, ভূত হয়ে এখন আমাদের ইস্কুলটার পিছনে লেগেছে, আমাদেরই কপাল খারাপ, ওই জায়গাটাই পটলের ভিটে ছিল কিনা, বাবা জমিটা কিনে নিয়েছিলেন।

ব্যর্থমনোরথ হয়ে মহেন্দ্রবাবু ফিরে এলেন, সব শুনে পাঁচকড়ি বললেন বাবাজীবন, গোবিন্দ কিন্তু মিথ্যে কথা বলেননি, এ ওই পটলের ভূতই বটে, তুমি বিশ্বাস করবে না বলে বলিনি, কিন্তু ঘটনা খুব সত্যি ।

মহেন্দ্রবাবু জেদি লোক, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেন বটে, কিন্তু মটকা মেরে রইলেন, বাড়ির সবাই ঘুমোলে চুপি চুপি উঠে, খিড়কি খুলে বেরিয়ে পড়লেন, তারপর সোজা এসে পোড়ো ইস্কুলবাড়িটায় ঢুকে পড়লেন।

ভূতের মোকাবিলা কখনও করেননি বলে মহেন্দ্রবাবু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না এমতাবস্থায় কী করা উচিত। তবে তাঁর অসম্ভব সাহস, বুদ্ধিও বড়ো কম নয়।

সামনে যে ক্লাসঘরটা দেখলেন সেটাতেই ঢুকে পড়লেন মহেন্দ্রবাবু, ঘুটঘুট্টি অন্ধকার, ইঁদুরের কিচমিচ শোনা যাচ্ছে, ঝিঁঝি ডাকছে, চামচিকে উড়ে বেড়াচ্ছে, মহেন্দ্রবাবু মাথায়, মুখে, হাতে মাকড়সার জাল টের পাচ্ছেন, চারদিকে বিচ্ছিরি গন্ধ।

মহেন্দ্রবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে খুব গম্ভীরভাবে ডাকলেন, পটলবাবু—

কেউ জবাব দিল না।

পটলবাবু, শুনতে পাচ্ছেন? কোনো শব্দ নেই?

পটলবাবু, আমি হলাম মহেন্দ্র মাস্টার, বহু গাধা ঠেঙিয়ে মানুষ করে দিয়েছি, বুঝলেন?

অন্ধকারে হঠাৎ সামনে একটা সাদামতো কী যেন দেখা গেল, না কোনো মূর্তিটুর্তি নয়, খানিকটা কুয়াশার মতো ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎ একটা খ্যাঁকানো গলায় কে যেন বলে উঠল, কে র‍্যা? কার এত বুকের পাটা যে রাতবিরেতে ডাকাডাকি করছিস?

বললুম তো, মহেন্দ্র মাস্টার, গাধা পিটিয়ে মানুষ বানাই,

তা মরতে এখানে কেন? আর জায়গা নেই?

এই জায়গাই আমার পছন্দ। আজ থেকে রোজ নিশুত রাতে এসে আমি আপনাকে লেখাপড়া শেখাব।

অ্যাঁ! লেখাপড়া! আমাকে!

যে আজ্ঞে, আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনার ভিতরে এক অবিদ্যার বাস, তাকে তাড়াতে হলে বিদ্যের দরকার। আপনি তৈরি থাকুন, কাল থেকেই আমি আপনাকে পড়ানো শুরু করব। প্রথম মুগ্ধবোধ, তারপর বর্ণপরিচয়, তারপর ব্যাকরণ, কথামালা, হিতোপদেশ।

শেখালেই হল! যদি না শিখি!

সহজে শিখবেন না যে আমি জানি, কিন্তু আমি তো ছাড়বার পাত্র নই।

দেখো মাস্টার, মানে মানে সরে পড়ো, নইলে এমন সব কান্ড করব যে পালানোর পথ পাবে না।

দেখুন না চেষ্টা করে, কত ডাকাত ছেলেকে জল করে এসেছি, আপনি তো কিছুই নন।

আচ্ছা টেঁটিয়া তো!

যে আজ্ঞে।

ও তোমার কম্ম নয় হে। যখন ইস্কুলে পড়তুম তখন কত মাস্টার কত চেষ্টা করেছে। আমাকে শেখাতে পারেনি। তুমি কোথা থেকে উদয় হলে হে বাপু?

উদয় যখন হয়েই পড়েছি তখন আর সহজে অস্ত যাচ্ছি না, বুঝলেন পটলবাবু?

পটলবাবুর ভূত একটু চুপ করে থেকে বলল, তার মানে তুমি সহজে ঢিট হওয়ার লোক নও।

আজ্ঞে না।

দূর বাপু, আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে হবেটা কী? তার চেয়ে যাদের পড়ালে কাজ হয় তাদেরই পড়াও না।

কিন্তু আপনার জন্য যে ইস্কুলটাও উঠে গেছে?

ঠিক আছে বাপু, স্কুল হোক, আমি বরং তখন পাশের গাঁয়ে হাওয়া খেতে যাব।

ঠিক তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার মতো বদখত লোকের পাল্লায় পড়লে কি আর কিছু করার থাকে?

মহেন্দ্রবাবু হাসলেন। পাঁচ দিনের মধ্যে শিবেনবাবুর স্কুল চালু হয়ে গেল। স্কুলের হেডমাস্টার হলেন মহেন্দ্রবাবু।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments