Friday, April 26, 2024
Homeবাণী-কথাশেষের সে বিচার - ডাঃ অরুণকুমার দত্ত

শেষের সে বিচার – ডাঃ অরুণকুমার দত্ত

dui banglar dampotto koloher shato kahini

পুলকেশ পেছনের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ঠিক সামনের সমারাল বাড়ির চারতলার এক ফ্ল্যাটের গরাদবিহীন বাথরুমের জানলার ভেতর দিয়ে-সরীসৃপের মত একটা কালো লোক ঢুকে গেল। চারদিকে তখন রাত্রে অন্ধকার নামছে। পুলকেশ কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার, বেহালার এই অঞ্চলের নাম যদু কলোনী। চারপাশে এলোমেলো বহুতল অট্টালিকাগুলো দ্রুত গজিয়ে উঠছে। যার ফলে, বেহালার লোকসংখ্যাই খালি বেড়ে যায় নি; স্থানীয় জিওগ্রাফিও বদলে গেছে।

রাত বেশি না হলেও, সামনের চারতলা বাড়ির ফ্ল্যাটগুলোর বেশিরভাগ বাসিন্দারাই অনুপস্থিত ছিল। কিছু দূরে নাম করা আর্টিষ্টদের নিয়ে এক জলসা চলছিল। সেই জলসার আকর্ষণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের সেখানে আটকে রেখেছিল। সামনের ফ্ল্যাটের চারতলার শোবার ঘরে নীল আলো জ্বলছিল। সেই লোকটাকে সে ঘরে ঢুকতে দেখে পুলকেশ, পকেট থেকে বাইনাকুলার বার করে চোখ রাখলেন।

এমন সময় ফ্ল্যাটের দরজা খুলে কারা যেন ঘরে ঢুকল। কালো লোকটার চাঞ্চল্য দেখে, অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার পুলকেশ রকার, সে কথা অনুমান করলেন, পুলকেশ মনে মনে হেসে স্বগতোক্তি কলেন,—বটুক সাপুই…..এবার আর পুলিশের জাল কেটে তুমি পালাতে পারবে না। অনেকবার তুমি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পাতা ফাদে পা না দিয়ে পালিয়ে গেছ। তোমার বিরুদ্ধে বেশ কিছু চুরি, ছিনতাই, ডাকারি কেস ঝুলছে।

এমন সময় সেই ঘরে অল্পবয়সী এক দম্পতি প্রবেশ করল। আগন্তুকদের দেখে, সুচতুর ক্ষিপ্রতায় টুক—মেঝেতে পড়ে থাকা একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে পাশের ঘরে ঢুকে গেল। বেডরুমের নিয়নলাইট জ্বলে ওঠাতে, পুলকেশ সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন, এমন সময় পুলকেরে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল, নীচে থেকে তাঁর সহকারী অফিসার ফোন করে খবর জানতে চাইছেন। ফ্ল্যাটের ভেতরকার সংলাপ, পুলকেশ শুনতে পাচ্ছিলেন না। এ পর্যন্ত তিনি যা কিছু দেখেছেন সব কথা ফোনে জানিয়ে দিলেন।

“বেশ দেরি হয়ে গেল স্বপন, বিয়ের নেনতন্ন বাড়িতে, আজ আর আমাদের গরম খাওয়া জুটবে না।” বউটি ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়েই সর্বপ্রথম কথা বলল।

“তোমার জন্যেই তো এত দেরি হয়ে গেল প্রতিভা। তখন থেকে বলছি, জলসা ছেড়ে বাড়ি চল। কানে কোন কথা যাচ্ছে না। খালি বলেছ এই গানটা শুনেই চলে যাব।”

স্বামীর কথা শুনে কটাক্ষ করে প্রতিভা উত্তর দেয়। “তোমার তো রস্ক বলে কিছু নেই। গানের গাও জান না। স্বরলিপির কিছুই বোঝ না। খালি ভোজ খাবার লোভ।”

বটুক ওরফে বটা কান খাড়া করে শুনতে থাকে। সে আগে থেকে পাকা খবর পেয়েছে। অল্পদিনের বিয়ে করা দম্পতির এখনো ছেলেপুলে হয়নি। আজ ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে তারা অনেক গয়না বার করেছে। এও জেনেছে, মত পালটিয়ে খাঁটি গয়নাগুলো আলমারির লকারে রেখে মেকি গয়না পরে বউটি উত্তর কলকাতায় নেমতন্ন বাড়ি যাবে। ঠিক এ সময় প্রতিভা পাশের অন্ধকার ঘরে ঢুকতে গিয়ে, কম্বলে মোড়া শায়িত বটার গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়।

ঝঙ্কার তুলে প্রতিভা চেঁচিয়ে ওঠে, “কি জ্বালা ….এঘরে আবার কে কম্বলটা জড় করে রাখল?” বেডরুম থেকে স্বপন আর্তনাদ করে ওঠে। “ওঃ হো! ডানপায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা গাটের পায়ায় লেগে জখম হয়ে গেল। কি বিতিকিচ্ছিরি খাটের পায়া?” স্বপন কাতরাতে থাকে।

—”নাচতে না জানলে উঠোনের দোষ! প্রতিভা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ভ্রুভঙ্গী করে সে বলে চলে। “জান….এই পালঙ্ক এক নম্বর সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি। বউবাজারের সেরা দোকানে গিয়ে অর্ডার দিয়ে মা করিয়ে এনেছেন।”

ততক্ষণে স্বপনের ব্যথা হ্রাস পেয়েছে। গলার স্বর নামিয়ে স্বপন মন্তব্য ছেড়ে। “এক নম্বর সেগুন। তাই তার এতগুণ? দশ নম্বর হলে আমার পায়ের কি হাল হত জানি না?”

স্বপনের এই পরিহাস, কিন্তু প্রতিভার পায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। জগমুক্ত শরের মত প্রতিভার গলা দিয়ে তীক্ষ্ণ খোঁচা দেওয়া ম্য বেরিয়ে আসে, “দ্যাখ….আমার বাপ-মার দেওয়া জিনিসপত্র দিয়েই তো এই ফ্ল্যাটটা সাজানো পোছানো হয়েছে। এই খাট বিছানা, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সোফা সেট—মায় টিভি, ফ্রিজ পর্যন্ত আমার বাপের বাড়ির দিক থেকে এসেছে, তোমার নিজের বলতে কি আছে?”

স্ত্রীর কথা শুনে ব্যারোমিটারের পারার মত—স্বপনের মেজাজ চড়তে থাকে। ব্যঙ্গ করে স্বপন বলে ওঠে, “হ্যাঁ….এই টেলিফোন, মেজের কার্পেট, লাইট, ফ্যান মায় ফ্ল্যাটের বিশাল ভাড়া পর্যন্ত, তোমার বাপের বাড়ির দিক থেকে এসেছে?”

“তুমি আর কথা বলনা। তোমরা মুরোদ আমার জানা আছে। বিয়ের পর লোকে কনা জায়গায় ঘোরে। আর তুমি হানিমুন করতে, পুরী পর্যন্ত যেতে পারলে না। দীঘার একটা হলিডে হোমে গিয়ে নম নম করে মধুচন্দ্রিকার পালা শেষ করলে।”

স্ত্রী শ্লেষাত্মক কথাগুলো, স্বপনের গায়ে দারুণভাবে বিধছিল। তিক্তকণ্ঠে স্বপন বলে, “তখন নতুন চাকরি তাই। এখন কতটাকা ভাড়া দিয়ে এই মডার্ন খোলামেলা ফ্ল্যাটে বাস করছ সেকথা ভেবে দেখেছ?”

প্রতিভা একথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে, “হ্যাঁ মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। বিয়ের পরে একটা গয়নাও তো আমায় কিনে দিতে পারনি। পুরুষ মানুষ বলে ভাব—মেয়েদের সব সময় পায়ের নীচে নাবিয়ে রাখবে? সে যুগ পাল্টে গেছে মেয়েরা এখন পুরুষের সঙ্গে তাল দিয়ে পাইলটিং পর্যন্ত করছে।”

পাশের ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বটুক স্বগতোক্তি করে, “ধুত্তোর ছাই! এদের দাম্পত্যের কলহের জন্যে আমার রাতটা মাটি হয়ে যাবে দেখছি।”

অবিকল বেড়ালের অনুকরণে বটা ম্যাও ডেকে ওঠে।—”আবার সেই বেড়ালটা এসে ঘরে ঢুকেছে।” প্রতিভার গলা বিরক্তিতে ভরা।

হঠাৎ স্বপন কঁকিয়ে ওঠে, “উফ মশাটা তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে কান ফুটো করে দিল? এই চারতলায়ও মশা উঠে এসেছে। কলকাতা কখনও ম্যালেরিয়া মুক্ত হবে না।”

“কি করে হবে? পাশে পুকুর, রাস্তায় খোলা নর্দমা। একটু বৃষ্টি বাদলা হলেই রাস্তায় জল জমে যায়। দাঁড়াও যাবার আগে একবার ঘরটায় ধুনো দিয়ে যাই। ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়াতে হয়।” কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে প্রতিভা, রান্নাঘরে গিয়ে ধুনুচিতে নারকেলের ছোবড়াধুনো দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ধুনুচিটা খাটের পাশে রেখে ফ্যান চালিয়ে দেয়। তারপর দুজনে বেশবাস বদলে সাজসজ্জা করতে থাকে।

ঘরের ভেতর কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নামে। পাশের ঘরে আধশোয়া হয়ে বটা দরজার ফাঁক দিয়ে বেডরুমে উঁকি মারে, এদের দাম্পত্য কলহ তাহলে এখনকার মত ঠাণ্ডা হয়েছে। অভিজ্ঞ বটা জানে, কিভাবে হাওয়া বদলে পরিবেশ নিজের পক্ষে আনা যায়। সঠিক পরিবেশ না এলে, তাদের কাজ করতে অসুবিধা হয়।

“তোমার হয়ে গেছে, প্রতিভা! স্বপন জিজ্ঞেস করে। লক্ষ্মীটি আর এক মিনিট অপেক্ষা কর।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পাতার ওপরে মাস্কারা লাগাতে লাগাতে প্রতিভা বলে, আধুনিক প্রসাধনে কিভাবে নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করা যায়; বিউটি পার্লারে গিয়ে সেই আর্ট প্রতিভা শিখে এসেছে।

ঠিক এসময় আবার ঘরের কোণ থেকে ম্যাও শব্দ ভেসে আসে, ম্যাও শব্দ শুনে স্বপন চমকে ওঠে। উঁকি মেরে দ্যাখে—আরে এ যে সত্যিকারের বেড়াল। “আবার সেই হাড় হাভাতে বেড়ালটা ঘরের মধ্যে ঢুকেছে?” কুদ্ধকণ্ঠে কথাগুলো বলে, পায়ের চটি খুলে স্বপন-বেড়ালটাকে তাক করে ছুঁড়ে মারে। আত্মরক্ষার জন্যে কুঁই ও শব্দ করে ভয়ার্ত বেড়াল খাটের নীচে সেঁধোতে যায় খাটের এক ধারে। ধুনুচিতে রাখা ধুনো জ্বলছিল, বেড়ালের ধাক্কায় ধুনুচি উল্টে যায়। জ্বলন্ত ছোবড়ার টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। একটা টুকরো ঝুলে থাকা বেড কভারে ছিটকে গিয়ে লাগে। পরক্ষণেই বেডকভারটা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।

গরমের দিন হওয়ায়, শুধু চারতলার ছাদ নয়, ঘরটাও গরম হয়েছিল, ফ্যানের হাওয়ার লেলিহান আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় না। আগুন! আগুন! বাঁচাও! বাঁচাও! বলে প্রতিভা আর স্বপন দুজনেই আর্তচিৎকার করে ওঠে, দরজা দিয়ে পালানোর পথ ছিল না। সেখানে আগুন জ্বলছল, পাশের ঘরে উঠে বসা বটাও ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গেছিল। চুরি করতে এসে একি বিপদ! বাথরুমের গরাদবিহীন জানলা দিয়ে, সরীসৃপের মত রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে নীচের মাটিতে পা রাখা তার কছে কোন ব্যাপার নয় কিন্তু এই নবদম্পতির কি হাল হবে? বটা দ্রুত চিন্তা করতে থাকে।

ওদিকে চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে খেতে পুলকেশ সবকিছু লক্ষ করছিলেন। আগুন দেখে পুলকেশও কম বিচলিত হন নি। আগুন দেখে মোবাইল ফোনে ভাষ্যকারের মত তিনি, ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছিলেন। বাড়ির নীচে লোক জড় হয়ে গেছিল। জনতার ভয়ার্ত চিৎকার শিশুর ক্রন্দন সব কিছু মিলে এক বিশৃঙ্খল ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।

দরজা বন্ধ থাকায় দমকলের লোকেরা এসে ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ সবাইকে তাক করে কম্বল মুড়ি দিয়ে রটা ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। তারপর আগুনের শিখা উপেক্ষা করে, প্রথমে প্রতিভা, পরে স্বপনকে কম্বলে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বের করে নিয়ে আসে, চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে পুলিশ অফিসার পুলকেশ সরকার সবকিছু লক্ষ্য করে, রীতিমত বেকুব বনে যান। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালান, দাগী আসামী বটুক সাপুইয়ের ভিন্নতর চেহারা পুলকেশের মগজে ঝড় তোলে।

দমকল ও সহৃদয় লোকেদের চেষ্টায় ও যত্নে নীচে নামিয়ে প্রতিভাও স্বপনকে সুস্থ করে তোলা হয়। তাদের আঘাত সে রকম গুরুতর ছিল না। বটুক সাপুই কি ভাবে তাদের ঘরে এল, তার হদিশ স্বামী-স্ত্রী করতে পারছিল না। তবে বটা না। থাকলে, তারা যে নির্ঘাৎ পুড়ে মারা যেত সে ব্যাপারে তাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

পুলিশের লোকেরা এসে, অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বটুক সাঁপুইকে কাছের নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। তার দেহের অনেক জায়গায় পুড়ে গেছিল। তাহলেও ডাক্তার। আশ্বাস দিয়ে জানালেন, গায়ে মুখে পোড়া দাগ নিয়ে লোকটি এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। কেবিনে ঢুকে বটার বিছানার পাশে একান্তে পুলকেশ জিজ্ঞেস করলেন,—”বটা …তুমি আগুন দেখে পালিয়ে গেলে না কেন? নিজের জীবন বিপন্ন করে, ঘরে ঢুকে তুমি ওদের বাঁচাতে গেলে কেন?”

ক্লান্ত দৃষ্টিতে পুলকেশের দিকে বটা উত্তর দেয়। “সরকার সাহেব আপনি এত কথা জানলেন কি করে?”

“–দ্যাখ বটা…তোমাকে ধরতে আজ দলবল নিয়ে আমি জাল বিছিয়ে ছিলাম। পেছনের বাড়ির চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে, আমি তোমার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলাম, অবাক হয়ে আমি দেখলাম, আগুন লেগেছে দেখে ভয় পেয়ে তুমি পালিয়ে গেলে না। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, সুখি গৃহকোণে বাসা বাধা দম্পতিকে বাঁচাবার জন্যে, তুমি অসাধ্য সাধন করলে। বটা তুমি এত মহৎ! না না …পুলিশ তোমায় গ্রেপ্তারের কথা ভাবছে না। বরঞ্চ তুমি যাতে সরকারি পুরস্কার পাও আমরা সে চেষ্টা করব।”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments