Saturday, April 20, 2024
Homeকিশোর গল্পশাহপরীর দ্বীপের দুর্গ - তানজিনা হোসেন

শাহপরীর দ্বীপের দুর্গ – তানজিনা হোসেন

শাহপরীর দ্বীপের দুর্গ - তানজিনা হোসেন

মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে টেকনাফের দিকে শাঁই শাঁই করে ছুটে চলছিল আমাদের বাইক। আমাদের মানে বাইকটা অয়নের, সে-ই চালাচ্ছিল, আমি বসেছিলাম পেছনে। দুই বন্ধু তিন দিনের ছুটিতে এসেছি কক্সবাজারে বেড়াতে। সমুদ্র আমাদের বড় প্রিয়। একটুখানি সুযোগ পেলেই ছুটে আসি বেলাভূমিতে। সাগরের পাড় ধরে বাইক চালাই, কখনো থেমে সূর্যাস্ত দেখি, হাওয়া খাই, পা ভেজাই সাগরের জলে। কক্সবাজারের ব্যস্ত বিচগুলোর চেয়ে দূরদূরান্তের নির্জন বিচগুলো আমাদের বেশি টানে। এখন তাই ছুটছি টেকনাফের জিরো পয়েন্টের কাছে সাবরাং বিচের দিকে। এ সময় ওদিকটা বেশ ফাঁকা থাকে, আর জনমানবহীন। শীতের শেষ সন্ধ্যায় প্রাণভরে সূর্যাস্ত অবলোকন করা যাবে, বালুর ওপর পা ছড়িয়ে বসে চুপচাপ দেখা যাবে ডিমের কুসুমের মতো দেখতে সূর্যটা কী করে টুপ করে সমুদ্রে ডুবে যায়। লাল কাঁকড়াগুলো মানুষের পদধ্বনি টের পেয়ে তখন এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে ঢুকে পড়বে গর্তে, গোলাপি সৈকতটা তাদের আনাগোনার কারণে আরও লাল হয়ে উঠবে।

আমাদের একটা ট্রাভেল গ্রুপ আছে। মাঝেমধ্যেই দল বেঁধে এদিক–ওদিক যাওয়া হয়। গ্রুপের ফেসবুক পেজ আর ওয়েবসাইটে ছবি আর ভ্রমণকাহিনি আপলোড করার নিয়ম। আজকে সূর্যাস্তের একটা অসাধারণ ছবি তুলতে হবে। অনেক দিন গ্রুপে কিছু দেওয়া হয় না।

সাবরাং পৌঁছাতে পৌঁছাতে শেষ বিকেল। আজকের সৈকতটা একটু বেশিই নির্জন মনে হচ্ছে। অন্য সময় এখানে দু–চারজন ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে ঘুরতে দেখেছি। আমাদের মতো অ্যাডভেঞ্চার–প্রিয় দলছুট দু-একজন পর্যটকও থাকে মাঝেমধ্যে। এ অঞ্চলটা এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। আরও দূরে জিরো পয়েন্টের কাছে পথের ধারে গড়ে উঠেছে দু–একটা রেস্তোরাঁ। কিন্তু এখানটায় কেবলই ধু ধু বালু আর সফেদ সমুদ্র। রাস্তার ধারে বাইক দাঁড় করিয়ে আমরা জুতা খুলে বালু পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে এলাম। বসে পড়লাম আধভেজা সৈকতে। সৈকতের চরাচরে আর কেউ নেই। বাতাস বইছে। পশ্চিমে হেলে পড়া কমলা সূর্য। দারুণ লাগছে। আমাদের সামনেই সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকল। ফিকে অন্ধকার আকাশে ঝিকমিক করে উঠল সহস্র তারা।

চল এবার উঠি, বলল অয়ন।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে জিনস থেকে বালু ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম, চল।

ঠিক তখনই ওপাশ থেকে ভোজবাজির মতো যেন আবছা অন্ধকার ফুঁড়ে উঠল এক কিশোর। পরনে হাঁটু অবধি প্যান্ট আর টি-শার্ট, খালি পা। ভগ্ন স্বাস্থ্য। পায়ে কাদা লেগে আছে। এই ছেলে এতক্ষণ কোথায় ছিল? আশ্চর্য!

আপনারা কি টেকনাফের দিকে যাইবেন? ছেলেটা ভাঙা গলায় বলল। সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর, বয়স ১৪–১৫ হবে। এই নির্জন সৈকতে একা একা ছেলেটা কী করছে? পকেটমার নয় তো?

দুই পা পিছিয়ে এসে বললাম, না। আমরা কক্সবাজার ফিরব।

ওহ্‌! হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ছেলেটি, টেকনাফের দিকে গেলে কইতাম আমারে একটু নামায়ে দিতে সামনে। বন্ধুদের সাথে আসছিলাম, হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চইলা গেছিলাম, অহন দেখি আমি একলা। বন্ধুরা মনে হয় আমারে ফালায়া চইলা গেছে।

সেকি! এই নির্জন জায়গায় ছেলেটা একা পড়ে আছে? বন্ধুরাই–বা তাকে ফেলে চলে গেল কেন? এই পথে বড় বড় মালবাহী ট্রাক আর বিজিবির গাড়ি ছাড়া এ সময় কোনো গাড়ি যায় না। রিকশা, সিএনজি তো নয়ই। এই ছেলে এখন বাড়ি ফিরবে কী করে? তবে বাইকে ওঠানোর আগে ছেলেটাকে একটু বাজিয়ে দেখা দরকার। এই দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ রোডে নাকি রাতবিরাতে বিস্তর মাদকের চালান হয়। মোড়ে মোড়ে আছে চেকপোস্ট। মাদক চোরাচালানে এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জড়িত। এ সে রকম কেউ নয় তো? পরে দেখা গেল লিফট দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছি।

আমরা ছেলেটার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম বালুর ওপর।

কী নাম তোমার?

স্যার, সুমন।

পড়াশোনা করো নাকি?

না স্যার, গরিব মানুষ। মাদ্রাসায় দিছিল বাপে, জন্ডিস হয়া মইরা গেছে। আমার পড়াও গেছে বন্ধ হইয়া। অহন ট্যুরিস্টগো লগে লগে ঘুরি। অজানা–অচেনা জায়গা চিনায়া লয়া যাই। অনেক ট্যুরিস্ট আছে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে। এই এলাকা তো আমার মুখস্থ। ছুডো থিকা বড় হইছি।

তোমার কথাবার্তা তো এই এলাকার মানুষের মতো না।

আমি চাটগাঁইয়া না, স্যার। রোহিঙ্গাও না। আমগো বাড়ি টাঙ্গাইল। বাপ এইখানে জোগালির কাজ করত। বড় বড় রাস্তাঘাট হইতাছে, হেই কামে আইছিল কন্ট্রাকটরের লগে। পরে এইখানেই রইয়া গেছে।

মা আছে?

আছে স্যার। টেকনাফের পল্লী বিদ্যুৎ অপিস আছে না? ওই যে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার পার হইয়া আরেট্টু সামনে, হাসপাতালের একটু আগে। ওই অপিসের ঝাড়ুদারনি। আইজ বাড়িত গেলে খবর আছে। মায় পিটাইব। সন্ধ্যা হয়া গেছে। অহনতরি ফিরতে পারি নাই।

এতক্ষণ কথা বলে ছেলেটাকে বেশ নিরীহই মনে হচ্ছে। একটু মায়াও লাগছে এখন। বাবা নেই, এ বয়সে রোজগারে নামতে হয়েছে। ট্যুরিস্টদের সঙ্গে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় একা একা। অয়ন তার কথার রেশ ধরে বলল, তুমি অজানা–অচেনা জায়গায় ট্যুরিস্টদের ঘোরাও মানে কী? এদিকে কি ও রকম ইন্টারেস্টিং জায়গা আছে?

সুমন উৎসাহিত হয়ে উঠল, আছে না স্যার! কত সুন্দর সুন্দর জায়গা যে আছে আশপাশে। লুকানো ঝরনা আছে পাহাড়ের কোনাকাঞ্চিতে। কেউ চিনে না। পুরানা রাজবাড়ি আছে। মাথাভাঙার দিকে নতুন কইরা একটা পুরান ভাঙা মসজিদ পাওয়া গেছে। শাহপরীর দ্বীপের দিকে একটা আশ্চর্য দুর্গও পাইছি। তিনজন ট্যুরিস্টরে এই পর্যন্ত দেখাইছি। দেইখা তো হেরা পাগল হয়া গেছে!

সুমন গলা নামিয়ে বলল, জায়গাটা আশ্চর্য স্যার। ভাঙা ইটের দুর্গ। জায়গায় জায়গায় ইট খইসা পড়ছে। সামনের দিকে একটা সিংহমূর্তিওয়ালা গেট আছে। কিন্তুক সেইটা বড় কথা না। দুর্গে জানি কী একটা আছে! গেলে টের পাওয়া যায়।

মানে?

দেখা যায় না কিছু। খালি টের পাওয়া যায়। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে। নিশ্বাসের শব্দ। আচমকা ভিতরে আলো জ্বইলা উঠে। কারা জানি হাসে ফিকফিক কইরা।

শুনে আমরা হেসে উঠলাম। আমরা দুই বন্ধু সারা দেশে অনেক পরিত্যক্ত রাজবাড়ি, প্রাসাদ, মন্দির ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রায় সব কটির নামেই নানা কল্পিত কেচ্ছাকাহিনি প্রচলিত আছে। কিন্তু নিজেরা ঘুরতে গিয়ে কখনো অতিপ্রাকৃত বা অশরীরী কিছুর দেখা এখনো পাইনি। পেলে তো ভালোই হতো। এখন সুমনের কথা শুনে আমাদের অ্যাডভেঞ্চার–প্রিয় মন জেগে উঠল। এবার তাহলে ট্রাভেল গ্রুপের পেজে দারুণ কিছু শেয়ার করা যাবে।

অয়ন বলল, নিয়ে যাবে আমাদের সেখানে? দেখি কী এমন আছে, যা টের পাওয়া যায় কিন্তু চোখে দেখা যায় না?

অহন যাইবেন? সন্ধ্যা বেলা? ডরাইবেন না তো? সুমনের চোখ চকচক করে উঠল দুষ্টুমিতে।

তুমি না ডরালেই হলো! আমরাও হাসলাম ওর কথা শুনে।

আমি ডরাই না স্যার, সুমন কান পর্যন্ত হাসি হাসে এবার। ডর–ভয় আমারে ছাইড়া গেছে কুন দিন। একলা একলা পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রের ধারে ঘুইরা বেড়াই। কেউ আমার লগে থাকে না। তাইলে আর দেরি ক্যান স্যার? লন যাই।

বাইকে সুমনকে মাঝখানে রেখে আমি পেছনে বসলাম। একটা–দুটো পুলিশের জিপ কি প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে অনেকক্ষণ পরপর হাইওয়ে দিয়ে। নয়তো গোটা রাস্তা নির্জন, জনশূন্য। সাগরের ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। দূর থেকে ধবধবে সাদা ফেনাকে মনে হচ্ছে বিচ্ছুরিত আলো। আমাদের ডানে সমুদ্র, বাঁয়ে উঁচু পাহাড়। স্টার্ট দেওয়ার আগে অয়ন বলল, তুমি চিনবা তো ঠিকমতো, সুমন? না ঘুরাইবা খালি খালি? হুদাই বাইকের তেল খরচ করাইবা?

স্যার, চিনুম তো নিশ্চয়। আপনাগো জিপিএস নাই? জিপিএসও ফিট করতে পারেন। শাহপরীর দ্বীপের রাখাইন দুর্গ। সাবরাং ইউনিয়ন। দিলেই আইসা পড়ব।

আমি ফোনে গুগল ম্যাপ অন করলাম। বাহ্‌! এই তো দেখা যাচ্ছে। দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। সময় দেখাচ্ছে ২৩ মিনিট। অয়ন বাইক স্টার্ট দিল। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন। আমরা রওনা দিলাম সুমনকে নিয়ে।

উড়ছে সুমনের। আমাদের দুজনের মাথায় অবশ্য হেলমেট। দুরন্ত বাতাস কেটে কেটে ছুটে চলেছে আমাদের বাইক। ভারী ভালো লাগছে। মেরিন ড্রাইভ রোড পার হয়ে দেশের একেবারে শেষ প্রান্তে শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছানোর পর সুমন চেঁচিয়ে বলল, বামে যাইতে হইব স্যার।

আমাদের গুগল ম্যাপও তা–ই দেখাচ্ছে। অয়ন বাঁয়ে টার্ন নিল। পাথুরে জংলি মাটির রাস্তা। দুধারে বড় বড় গাছ। হিজল, কেতকী, ঝাউ। আজ বাতাসটা একটু জোরালো, তাই গাছগুলো এদিক–ওদিক হেলেদুলে পড়ছে। বাতাসে পাতা ওড়ার সরসর শব্দ। কোথায় যেন শেয়াল ডাকছে। একটু পর আকাশে চাঁদ উঠলে নিকষ অন্ধকার একটু একটু করে কেটে যেতে থাকল। সঙ্গে তারাদের মিষ্টি আলো তো আছেই। এমন অদ্ভুত যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। ছেলেটা আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে না তো? হয়তো তার গ্যাং রয়েছে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে, পিস্তল বা ছুরি হাতে। কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে ডেরায়। ভেবে নিজেরই হাসি পেল আমার। আমাদের মতো মানুষকে কিডন্যাপ করেই–বা কী হবে? ফুটো পয়সাও মিলবে না। আমরা মফস্বলের ছেলে। হোস্টেলে থেকে পড়ি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। নিজেদের ঘোরাঘুরির বাতিকের খরচ মেটাতে টিউশনি করতে হয়, বাড়ি থেকে পড়ার খরচ ছাড়া কিছুই দেয় না। আমাদের কিডন্যাপ করে কোনো লাভ নেই।

আইসা পড়ছি স্যার।

সুমনের কথায় অয়ন ব্রেক কষল জোরে। জংলি পথটা এক জায়গায় এসে আগাছা আর ঝোপের কাছে শেষ হয়ে গেছে। সামনে আর পথ নেই। এখন?

একটু হাঁটতে হইব অখন।

আমরা বাইক থেকে নামলাম। পঞ্চমীর চাঁদ আর নক্ষত্রের আলোয় বনজঙ্গল সরিয়ে সরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সুমন বলল, শীত কাল তো, সাপখোপ নাই। বেবাকটি গর্তে। নাইলে সর্বনাশ হইত।

সাপের কথায় কেমন গা শিরশির করে উঠল। বাতাসটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে এখন। জোয়ার চলছে বোধ হয়। সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠছে, তা দূর থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে। কতক্ষণ এভাবে বনের মধ্য দিয়ে হেঁটেছি মনে নেই, হঠাৎই যেন বনটা ফাঁকা হয়ে গেল। সামনে সবুজ একটি মাঠ ক্রমেই বেলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। অদূরে অজগরের মতো গর্জন করছে বঙ্গোপসাগর। বড় বড় ঢেউয়ের মাথায় মুক্তোর দানার মতো সাদা ফেনা সজোরে আছড়ে পড়ছে তীরে। সাগরটা যেন ফোঁস ফোঁস করছে অব্যক্ত ক্রোধে। চাঁদের আলোয় ক্রমে স্পষ্ট হলো চোখের সামনে—এই উন্মত্ত সমুদ্র আর আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন দুর্গ। দুর্গের সম্মুখভাগে ভাঙা সিংহমূর্তি, সুমন যেমনটা বলেছিল। বাঁ দিকের সিংহটার মাথা নেই। দুটি সিংহের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেলে দুর্গের দরজা। অন্ধকারে দরজার রং বোঝা যায় না। ভাঙা দালানটার এখানে-ওখানে অন্ধকার খাঁজে বেড়ে উঠেছে আগাছা। আশ্চর্য! এমন একটা পুরাকীর্তি এখানে জঙ্গলের মধ্যে সমুদ্রের ধারে অযত্নে, অবহেলায় পড়ে আছে?

অয়ন ওর ফোন বের করে নাইট মোডে ছবি তুলতে চেষ্টা করল। ফ্লাশ জ্বলে উঠল কয়েকবার। কিন্তু স্পষ্ট ছবি উঠল না দেখে অয়ন বিরক্তি প্রকাশ করল একটু। আমি অস্ফুটে বললাম, এ রকম একটি জায়গায় অত আগে এই দুর্গ কে বানাল? আজব না ব্যাপারটা? এদিকটাতে তো এখনো মানুষের অত বসবাস নেই। আগে কারা থাকত এখানে?

সুমন বলল, গত মাসে চিটাগাং ইউনিভার্সিটির একজন মাস্টাররে নিয়া আসছিলাম স্যার। উনি কইছেন, চৌদ্দ শ কত সালে নাকি আরাকান থিকা রাখাইন রাজা চন্দ্র-সূর্য তার সৈন্যসামন্ত নিয়া কক্সবাজারে আইসা রাজত্ব পাতছিলেন। এইটা হেই সুমকার কোনো দুর্গ হইব। অনেক ফটো উঠায়া নিছিলেন উনি। কইছেন আবার আইবেন।

সুমনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই লক্ষ করছিলাম, দূরে উত্তাল সমুদ্রে বিন্দুর মতো কয়েক ফোঁটা আলো দেখা যাচ্ছে। এই বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে এই নির্জন সমুদ্রে কি মাছ ধরতে নেমেছে জেলেরা? শাহপরীর দ্বীপে আমরা আগেও একবার এসেছিলাম। উঠেছিলাম পর্যটনের নেটং মোটেলে। সে বছর তিনেক আগের কথা। এই এলাকার মানুষ মূলত মাছ শুঁটকি করে বিক্রি করে। বেশ কয়েকটি ছোট দ্বীপ আছে আশপাশে। সব কটিতেই শুঁটকি ঝোলে। চাইলে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু তখন তো কেউ ঘুণাক্ষরেও এ রকম একটা দুর্গের কথা উচ্চারণ করেনি।

নৌকাগুলা এই দিকেই আসতেছে, অয়ন বলল আস্তে আস্তে। ওর কণ্ঠে এখন দ্বিধা। ডাকাত বা দস্যু নয় তো? সুমন কি সত্যি আমাদের বিপদে ফেলল? একটা এলোমেলো হাওয়া এসে দুর্গের ভেতর নানা রকম শব্দের সৃষ্টি করতে লাগল। মনে হলো যেন কোথায় একটা গান বাজছে। না, গান কোথায়, এ তো ঢোলের শব্দ। আশ্চর্য, এত ভেতরে কি মানুষের বসত আছে? কিন্তু সুমন কোথায় গেল?

আশপাশে তাকিয়ে সুমনকে কোথাও দেখতে না পেয়ে এবার আমরা নিশ্চিত হলাম যে ছেলেটা দস্যুদের হাতে আমাদের তুলে দিয়ে নির্ঘাত পালিয়েছে। কী বোকামিই না করেছি আমরা। আমাদের কি এখন পালিয়ে যাওয়া উচিত? পেছনে ঘন জঙ্গল। সেই কত দূরে বাইক রেখে এসেছি। ঘুরে দৌড়ে পালাতে গেলে যদি এরা পেছন থেকে গুলি ছোড়ে? আমরা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। নৌকার মশালগুলো আরও নিকটবর্তী হলো। একে একে তীরে ভিড়ল সাত-আটটি নৌকা। উত্তাল সমুদ্রের পাগলাটে ঢেউয়ের মধ্যেই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল লোকগুলো। পরনে রঙিন লুঙ্গি আর পিরান, মাথায় পাগড়ি বাঁধা। হাতে মশাল। কারও কারও হাতে তলোয়ার। সর্বনাশ!

দুর্গের কাছাকাছি এসে দলটা হঠাৎ থেমে গেল। একেবারে সামনের সুঠামদেহী লোকটি, যার কোমরে একটি ঝলমলে বেল্ট আর মাথায় মুকুট, সে তলোয়ার উঁচিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কী কী যেন বলতে শুরু করল। বাকিরা তার কথায় মশাল আর তলোয়ার উঁচিয়ে হইহই করে সমর্থন জানাতে থাকল। আশ্চর্য ব্যাপার, আমাদের মতো জলজ্যান্ত দুজন মানুষ যেন তাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ লক্ষই করছে না আমাদের। আমরা দুজন অবশ্য একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি নিজেদের।

মশালের আলোয় দুর্গটা এবার বেশ ভালো করে দেখা যাচ্ছে। যতটা প্রাচীন আর ভাঙা মনে হচ্ছিল অন্ধকারে, এখন তা আর মনে হচ্ছে না। বরং অবাক ব্যাপার যে মনে হচ্ছে এখনো যেন কারা এই দুর্গের ভেতর থাকে। একটা কেমন কোলাহল ভেসে আসছে ভেতর থেকে। মেয়েদের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। কী আশ্চর্য, এখানে মেয়েরা এল কোথা থেকে? একটা ভয়ানক ডাকাত দল বোধ হয় ডেরা বেঁধেছে নির্জন এই দুর্গে! বা হতে পারে আন্তর্জাতিক চোরাচালান দলের কোনো একটি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই নির্জন জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছে। এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারলে কক্সবাজারের এসপি সাহেবকে সব খুলে বলতে হবে। ওনার সঙ্গে ভালোই পরিচয় আছে আমাদের।

নৌকার লোকগুলো এবার ‘ওয়েমো, ওয়েমো’ বলে চিৎকার করে মিছিল করতে শুরু করেছে। মুকুট পরা লোকটিকে ঘিরে স্লোগান দিচ্ছে তারা। বারবার ওই একই শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে—ওয়েমো, ওয়েমো, ওয়েমো। মিছিল করতে করতে তারা দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়ল। আর আশ্চর্য, দুর্গের ভেতর থেকে শোনা যেতে থাকল নারী-পুরুষের সম্মিলিত হাসি আর গানের আওয়াজ। শেষ লোকটি ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত আমরা দুজন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে ছিলাম। এবার হঠাৎ সম্মোহন ভাঙতে আর দেরি না করে পেছন ফিরে ছুটতে থাকলাম। জংলি সেই মেঠো পথ দিয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকলাম আমরা। আগাছা আর কাঁটার আঘাতে হাত-পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে থাকল। কয়েকবার হোঁচট খেলাম নুড়িপাথরে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল অনেকগুলো বাদুড়। খুব কাছেই তারস্বরে ডেকে উঠল একটা তক্ষক। প্রবল বাতাসের কারণে ছুটতেও কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে কতক্ষণ ছুটেছি জানি না, একসময় জঙ্গলের বাইরে দাঁড় করানো বাইকটা চোখে পড়ল আমাদের। অয়ন দৌড়ে গিয়ে বাইকে স্টার্ট দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এতক্ষণে এই প্রথম কথাটা বলল, শিগগির আয়, চন্দন।

আমিও ছুটে গিয়ে পেছনে চেপে বসলাম। অয়ন ভয়ংকর জোরে বাইক ঘুরিয়ে সোজা চালিয়ে দিল টেকনাফের দিকে। এতক্ষণে সমুদ্র আরও উত্তাল হয়ে উঠেছে। এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে তার গর্জন। ভয়ংকর বাতাসে দুধারে গাছগুলো যেন নুয়ে পড়ছে মাটিতে। ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি এসে পড়ছে নাকে–মুখে। আজ কি কোনো বিপৎসংকেত ছিল? কই, কিছু তো মনে পড়ছে না! আমরা তো আবহাওয়ার সংবাদ দেখেই বেরিয়েছি।

অ-য়-ন!

পেছন ফিরে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম আমি। আমাদের পেছনে ধেয়ে আসছে একটি ঘূর্ণিঝড়! কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে ওটা। এমনটা কেবল হলিউডের মুভিতেই দেখেছি। অয়ন স্পিড বাড়িয়ে দিল অনেক। প্রাণপণে চেষ্টা করল ঘূর্ণিঝড়ের বলয়ের বাইরে যেতে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়টা ক্রমেই আমাদের গ্রাস করে ফেলতে চাইল। টেনে ধরতে থাকল পেছন থেকে চুম্বকের মতো। শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা আর হলো না। বাইকসমেত আমরা হারিয়ে গেলাম সেই ঘূর্ণির ভেতর। চারপাশে ভয়ংকর ঘূর্ণনরত বাতাস আর বালু, উড়তে থাকা কাঠের টুকরা, শুকনা পাতা আর পানির চূর্ণ—কী আশ্চর্য, এরপর দেখি চতুর্দিকে উড়ছে রঙিন মাছ, লাল কাঁকড়া, ছোট ছোট কচ্ছপ, এমনকি একটা অক্টোপাসও। তার কিছুক্ষণ পর দেখি, আমাদের চারপাশে ঘুরন্ত অবস্থায় মশাল উঁচিয়ে নাচছে কিছু মানুষ আর বারবার চেঁচিয়ে বলছে ওয়েমো, ওয়েমো, ওয়েমো। অদ্ভুত পোশাক আর গয়না পরা কিছু মেয়ে হাতে কী একটা বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। কী আশ্চর্য, ঘূর্ণিঝড় এদেরও গ্রাস করে নিয়েছে নাকি? তারপর আমাদের আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমরা শুয়ে আছি একটি সবুজ মাঠে, চারদিকে বাঁশের বেড়ায় শুঁটকি ঝুলছে। সমস্ত এলাকায় উৎকট গন্ধ। আকাশে ঝকঝকে রোদ। চোখ মেলতেই কয়েকজন জেলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। একজন ছুটে গিয়ে নিয়ে এল পানির বোতল। দূরে আমাদের বাইকটা নিয়ে খেলা করছে কিছু ছোট ছেলে। সেদিকে তাকিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হলাম, যাক, বাইকটা তাহলে ঝড়ে ভেঙে যায়নি।

ঝড়! শুনে ভীষণ অবাক হলো যেন জেলেরা। ঝড় আবার কোথায়? গেল এক বছর সমুদ্র একেবারে মাছের মতো ঠান্ডা। সেই আইলার পরে আর কোনো বড় ঝড় হয়নি এদিকে। আর গত রাতেই তো তারা মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে গেছিল নৌকা নিয়ে, সমুদ্র কোনো যন্ত্রণা করেনি। ছিল একেবারে শান্ত, লক্ষ্মী হয়ে।

কিন্তু একটা ঘূর্ণিঝড়, ওই রাখাইন দুর্গের কাছে, জঙ্গলটার কাছে, উত্তেজিত হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমরা।

দুর্গ? এ ওর দিকে চোখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল জেলেরা। এবার পেছন থেকে পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় আর চশমা পরা একজন বলে উঠল, ওহ্‌ বুঝছি। আপনারাও তার খপ্পরে পড়ছিলেন। রাতবিরাতে কেন যে এই দিকে ঘোরেন। ওই খানে কোনো দুর্গ নাই। লোকে বলে কোনো এক সময় ছিল। ইতিহাসে আছে সতেরো শ চুরাশি সালে বার্মার রাজা আরাকান রাজ্যের ২০ হাজার রাখাইনকে হত্যা করে রাজ্য দখল করে নিয়েছিল। সে সময় এপারের একজন বিপ্লবী রাখাইন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আরাকান গেছিলেন। অনুসারীদের নিয়ে প্রবল পরাক্রমে এক যুদ্ধ করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়ে তিনি বীরের বেশে আবার ফিরে এসেছিলেন সতেরো শ একানব্বই সালে। ইতিহাসবিদেরা বলেন, হয়তো এখানেই ছিল তার দুর্গ। বীর রাখাইন নেতার নাম ওয়েমো। এই নামেই রাখাইনরা তাকে স্মরণ করে। কিন্তু সেই দুর্গ আমাদের বাপ-দাদারাও চোখে দেখেনি। ১৯৬৩ সালের ভয়ংকর সাইক্লোনে দুর্গটুর্গ কই ভেসে গেছে, কেউ জানে না।

সেকি! অয়ন বিমূঢ় ভঙ্গিতে বলে, আমরা যে স্পষ্ট দেখলাম দুর্গটা! দুদিকে সিংহদ্বার! এমনকি দুর্গটা জীবিত, মানে মানুষ বসবাস করে। আপনারা মনে হয় ভুল করছেন। এমনকি গুগল ম্যাপও তো দেখাল আমাদের।

শার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটি, পরে শুনেছি তিনি এখানকার পর্যটন অফিসের কর্মকর্তা, হেসে আমাদের বললেন, কই, দেখান দেখি।

আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে গুগল ম্যাপ অন করলাম। রাখাইন দুর্গ, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং ইউনিয়ন দিয়ে সার্চ দিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, এবার আমার মোবাইল বেইমানি করল। গুগল ম্যাপ এই ডেসটিনেশন ক্রমাগত আননোন দেখিয়ে যেতে থাকল। এই এলাকায় এ রকম দুর্গটুর্গ কিছু নেই। তাহলে? গুগল ম্যাপকেও বুঝি ভূতে ধরেছিল গতকাল? তা কি হয়?

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, চলেন, নেটং মোটেলে একটু বিশ্রাম নেন আগে। তারপর টেকনাফ হয়ে কক্সবাজার ফিরে যাবেন। এমনটা এই প্রথম নয়। এর আগেও কয়েকজনের সঙ্গে হয়েছে। গত মাসেই ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক—

পাশ থেকে একজন জেলে বলে উঠল, ইবেরে হয়দে রাইক্ষুষ। রাতিয়ে অইলি ডাহি লইয়ায়, তারপরদি পানিত চুবই মারে। হুয়াল ভালা দে বাঁচি গেইনগুঁই। আল্লাহ রহম করো।

হঠাৎ সুমনের কথা মনে পড়ল আমাদের। সে–ই তো ডেকে নিয়ে গেল আমাদের প্রাচীন দুর্গ দেখাতে। কোথায় গেল ছেলেটা?

এবারও ঘটনা শুনে একটা নিশ্বাস ফেললেন নেটংয়ের কর্মকর্তাটি।

ছেলেটা তাহলে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে এই দিকে। পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ক্লিনারের ছেলেটার কথা বলতেছেন তো? যার বাপ হাইওয়ের জোগালি মিস্তিরি ছিল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর কথাই বলছি। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়স। নাম সুমন।

বছর তিনেক আগে ছেলেটা সাবরাং সৈকত থেকে সমুদ্রে ভেসে গেছে। বন্ধুদের সাথে খেলতেছিল। খেলতে খেলতে মনে হয় একটু গভীরে চলে গেছিল। ভাটি চলছিল তখন, সমুদ্র টেনে নিয়ে গেল। তার লাশ আর পাওয়া যায় নাই। তার পর থেকে ছেলেটা এদিক-ওদিক পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। সাবরাংয়ে একা একা ঘুরতে গিয়ে নাকি অনেক ট্যুরিস্টই তাকে দেখেছে। কিন্তু তার পাগলপ্রায় মা প্রায়ই ছেলেকে দেখবে বলে রাত্তির গভীর হলে সাবরাং সৈকতে গিয়ে বসে থাকে। শয়তানটা মাকে কখনো দেখা দেয় না, এমন বদমাশ। তার যত শয়তানি ট্যুরিস্টদের সাথে।

আমরা দুজন হাঁ করে তার দিকে চেয়ে রইলাম। লোকটা আবার তাড়া দিল, কই, এইবার ওঠেন। চা-নাশতা খাইয়া রওনা দেন। রোদ চড়চড় করতেছে। কী একটা জ্বালা হইল এই সুমনরে নিয়া, কদিন পরপর ট্যুরিস্টদের এমন ঘোল খাওয়ায়! তা কী আর করবেন, দুঃখী ছেলে একটা। মাফ করে দেন ওরে। চলেন চলেন এবার।

আমরা শাহপরীর দ্বীপ, গন্ধওলা সাদা সাদা শুঁটকির পর্দা, রহস্যময় রাখাইন দুর্গ আর সৈকতে-পাহাড়ে একা একা ঘুরে বেড়ানো এক সাহসী দুঃখী কিশোরকে পেছনে ফেলে বাইকে চড়লাম আবার, অনিন্দ্যসুন্দর মেরিন ড্রাইভ রোড হয়ে ফিরে চললাম কক্সবাজারের দিকে। যেতে যেতে ভাবছিলাম, আমাদের ট্রাভেল গ্রুপে অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা শেয়ার করাটা বোকামি হবে কি না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments