Thursday, April 18, 2024
Homeঅনুপ্রেরণাশিক্ষামূলক গল্পশিক্ষামূলক গল্প: রাজার অসুখ

শিক্ষামূলক গল্প: রাজার অসুখ

একবার এক রাজার ভীষণ অসুখ হল। তাবিজ-কবচ, ওঝা-বৈদ্য, ডাক্তার-কবিরাজ সব করা হয়েছে কিন্তু রোগ সারে না। সারাদিন চুপচাপ বসে থেকে সময় কাটে নিঃসন্তান রাজার।

একদিন কোতোয়াল এসে রাজাকে বলল- মহামান্য রাজা, লক্ষণ তো ভালো ঠেকছে না, আপনার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বোধ হয়। আপনি বরং চিকিৎসা-টিকিৎসা বাদ দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য একমনে ইবাদত-বন্দেগী করুন। বাকি দিনগুলো আরামে কাটুক।

রাজা বললেন, আচ্ছা।

মন্ত্রী এলেন রাজার ঘরে। কুর্ণিশ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, রাজামশাই! আপনার অসুস্থতার কথা শুনে রাজ্যটাও কেমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুখ চলে যাচ্ছে প্রজাদের মন থেকে। এখন রাজ্যটা শাসন করবে কে? প্রজারা বলছে এভাবে আর কতদিন? এর একটা বিহিত করলে হয় না রাজামশাই? এ ব্যাপারে আপনার সামান্য ইশারা পেলেই…

রাজা বললেন, আচ্ছা।

তারপর এলেন সেনাপতি। তিনি রাজাকে কুর্ণিশ না করেই বললেন, হে দুঃখিত রাজা, আপনি যদি অসুখে-বিসুখে ক্লান্ত হয়ে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন, তাহলে রাজ্যটা চলে কীভাবে? আপনার সুস্থতার জন্য সব চেষ্টাই তো করা হলো। আপনি সুস্থ হবেন এমন কোনো লক্ষণ দেখছি না। দিনে দিনে প্রজাদের মন ভেঙে যাচ্ছে। রাজ্যে যেকোনো সময় নানা অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যেতে পারে। পরে প্রজাদের সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আপনি জীবিত থেকেও মৃত। রাজ্যের কল্যাণে নতুন রাজার নাম ঘোষণা করা দরকার। আপনি সম্মতি দিলেই আমরা এগুতে পারি।

রাজা বললেন, আচ্ছা।

ঢোল-কাঁড়ায় বাড়ি পড়ল। তুড়ি-ভেরি, শঙ্খ-শিঙা বেজে উঠল। রাজবাড়িতে শুরু হয়ে গেল রাজাবদলের উৎসব। নতুন রাজার নাম ঘোষণা করা হবে। রাজদরবারে বইছে আনন্দের জোয়ার।

রাজামশাই জানালা ফাঁক করে দেখছেন ওসব। রাজা চিন্তিত মনে পায়চারি করছেন। তার আশেপাশে কেউ নেই। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা।

এরইমধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। প্রজারা রাজবাড়ির সামনে এসে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। তাদের কান্নায় রাজবাড়ির আনন্দে টান পড়ল। সবাই প্রচণ্ড বিরক্তবোধ করল। কোতোয়াল কয়েকজন সিপাই নিয়ে কান্নারত প্রজাদের সামনে গিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এই, কী চাস তোরা? কী হয়েছে তোদের? জানস না এখানে রাজা বদলের আনন্দ-আয়োজন চলছে?

প্রজারা বলল, না, না, না আমাদের প্রিয় রাজাকে কিছুতেই বদল করা চলবে না। বন্ধ করুন উৎসব। নতুন রাজা চাই না আমরা। আমাদের মহান রাজা যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তিনিই থাকবেন আমাদের রাজ্যের রাজা। আমাদের গায়ে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে এই মহান রাজাকে বদল করতে দেব না।

কোতোয়াল রাগে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে গিয়ে মন্ত্রী ও সেনাপতিকে প্রজাদের কথা বলল। তারা রাগে আগুন হয়ে কড়া নির্দেশ দিল কোতোয়ালকে। সে সিপাইদের নিয়ে কান্নারত প্রজাদের ধরে প্রচণ্ড মারধর করতে লাগল। তবুও প্রজারা তাদের দাবি ত্যাগ করল না। সেনাপতির নির্দেশে কোতোয়াল তাদের গাছের সাথে বেধে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করে ফেলল। প্রজারা বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইল।

রাজা জানালার ফাঁক দিয়ে সবই দেখছিলেন। আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি গর্জে উঠলেন এবং দ্রুত নিচে এসে ধমকের সুরে বললেন, কী হচ্ছে এসব, প্রজাদের গায়ের রক্ত ঝরিয়ে রাজা বদলের আনন্দ-আয়োজন চলছে বুঝি?

রাজার অগ্নিমূর্তি দেখে সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল এবং ছেড়ে দিল প্রজাদের।

রক্তাক্ত প্রজারা রাজাকে কুর্ণিশ করে বলল, হে মহান রাজা, আমরা আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আমরা আপনার ন্যায়শাসনের বদলে এই নিষ্ঠুর মানুষের দুঃশাসন চাই না। ওরা রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে। আমরা মনে-প্রাণে আপনার সুস্থতার জন্য দোয়া করছি। আপনি দয়া করে আমাদের ত্যাগ করবেন না রাজামশাই!

রাজা বললেন, আমি অসুস্থ নই। বহুদিনের পুরনো ও বিশ্বস্ত রাজকর্মচারিদের পরীক্ষা করার জন্য আমি অসুস্থতার ভান করেছি। আমি যাদের বিশ্বাস করে রাজ্য পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছি-এতদিনে তাদের মধ্যে ভয়ংকর লোভ জেগে উঠেছে। তাদের পরীক্ষা হয়ে গেল। সেই সাথে আমার প্রতি প্রজাদের বিশ্বাস ও ভালোবাসার পরীক্ষাটাও হয়ে গেল।

এই বলে রাজা লোভী রাজকর্মচারিদের বন্দী করে তাদের পরিবর্তে প্রজাদের নিয়োগ করলেন। কেউ মন্ত্রী, কেউ সেনাপতি, কেউবা কোতোয়াল-সিপাই পদে অধিষ্ঠিত হলো। রাজা বদলের আনন্দ-আয়োজন-অকৃতজ্ঞ কর্মচারি পরিবর্তনের উৎসবে পরিণত হলো।

বন্ধুরা, লোভের পরিণতির পর এবার আমরা অহংকার সম্পর্কে একটি গল্প শোনাব। এ গল্পটিও লিখেছে কথাসাহিত্যিক বিএম বরকতুল্লাহ। গল্পটির নাম ‘টুই-টুই আর পিক-পিক’। তাহলে গল্পটি শোনা যাক-

এক বনে টুই-টুই নামে একটি পাখি একাকি বাস করত। একদিন অন্য একটি পাখিকে দেখে সে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সে মনে মনে বলল, ‘পাখিটা মনে হয় আমার মতই একা। আমি যাই না কেন তার কাছে।’ সে পাখিটার কাছে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘ভাই পিক-পিক তোমার কি মন খারাপ, নাকি আমার মতো একা তুমি?’

চিন্তিত মুখে পিক-পিক পাখিটি বলল: ‘পথ হারিয়ে এই বনে এসে পড়েছি, এখানে কোনো পাখি দেখছি না, আমি খুবই একা। কিছুই ভালো লাগছে না আমার, বিরান ভূমির মতো লাগছে বনটা।’

হাসিমুখে টুই টুই বলল: ‘আমিও তো তোমার মতই একা! তোমাকে পেয়ে আমার মন ভালো হয়ে গেছে। আমরা দু’জনে মিলে মিশে খুব থাকতে পারব এই বনে। কী বলো পিক-পিক?’ ’মিলেমিশে থাকতে পারব মানে? তুমি এক জাতের পাখি আর আমি আরেক জাতের পাখি,’ বলল পিক-পিক। ‘দুই জাতের দুটি পাখি কি এক সাথে মিলেমিশে থাকতে পারে? এটাও কি সম্ভব?’

টুই-টুই বলল ’কেন সম্ভব নয়। হতে পারে আমরা দুই জন দুই জাতের পাখি,

পিক-পিক: তাতে কী,’

টুই-টুই: ‘এখানে আছে অনেক বিষাক্ত সাপ আর হিংস্র পশু। একা থাকা মানেই তো নিজেকে বিপদ আর কষ্টের মাঝে ঠেলে দেওয়া। আর মিলেমিশে থাকা মানে আনন্দে আর নিরাপদে থাকা। আমরা তো চমৎকার বন্ধু হতে পারি, কী বলো পিক-পিক?’

পিক-পিক: ‘বন্ধু!’ তুমি দেখতে আমার চেয়ে অনেক সুন্দর। তোমার গায়ের রং, পাখা, ঠোঁট, পা ও পুচ্ছ যেমন রঙ্গীন তেমন সুন্দর। দেখো, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার মতো কোন রং নেই আমার।’

টুই-টুই: ‘মিলেমিশে থাকার জন্য বাইরের রং কোনো বাধা নয়। মনের রংটাই হলো আসল। আমরা পাখি, ব্যস এটাই বড় কথা। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। তর্ক না করে চলো পেট ঠাণ্ডা করি আগে। তারপর অন্য কথা।’

পিক-পিক কোনো জবাব না করে টুই-টুই পাখির পিছু পিছু উড়ে চলে গেল খাবারের সন্ধানে।

টুই-টুই পাখির সাথে পিক-পিক পাখির খাতির হয়ে গেল। তারা সারাদিন এক সাথে থাকে আর গল্প করে। আনন্দে ছুটোছুটি করে। গাছের মগডালে খুব সুন্দর বাসা বানিয়েছে তারা। কিছুদিন পর ডিম পেড়েছে পিক-পিক। ডিম ফুটে ফুটফুটে দুটি বাচ্চা বেরিয়ে এলো। আনন্দের আর সীমা নেই। তাদের মনে হলো গোটা বনটাই একটা আনন্দভূমি।

কিছুদিন পরে অসংখ্য পাখি এসেছে বনে। পাখিদের দলে টুই-টুই আর পিক-পিক জাতের অনেক পাখিও রয়েছে। ওরা বাসা বেধেছে। সারাদিন বনে ঘুরে বেড়ায়, খাবার খায় আর সন্ধ্যা হলেই তারা ফিরে যায় নিজ নিজ বাসায়। পাখিদের কলরবে বন উতাল।

একদিন টুই-টুই পাখিকে তার জাতের পাখিরা বলে, ‘জাতপাত বলতে কিচ্ছু মানো না তুমি? পিক-পিকের মতো অসুন্দর ও অন্যজাতের একটা পাখির সঙ্গে কি তোমার বন্ধুত্ব হতে পারে? আমাদের রূপের সঙ্গে তাদের কোনো তুলনা হয়, ছিঃ টুই টুই ছিঃ।’

টুই-টুই: ‘এত ছিঃ ছিঃ করছ কেন? আমরা পাখি। এটাই তো বড় পরিচয়।আর আমাদের মিলেমিশে থাকার পেছনে সেই পরিচয়টাই বেছে নিয়েছি আমরা। আমাদের মনে কোনো দুঃখ নেই। দেখতেই পাচ্ছ আমরা কত ভালো আছি।’

অন্য পাখি: টুই-টুই আমাদের চেয়ে সুন্দর পাখি বলে তাদের বড় অহংকার। কদিন পরেই না তোমাকে ঘৃণাভরে তাড়িয়ে দিবে টুই-টুই। এটা কি আমাদের জন্য অপমানের বিষয় না?’

পিক পিক: ‘এই গভীর বনে ভয়ংকর বিপদে আমরা জাতপাত ভুলে নিজেদের শুধু পাখি ভেবেছি। আমাদের এখন কোনো কষ্ট নেই। দেখতেই পাচ্ছ, কত সুখে আছি আমরা।’

টুই-টুই আর পিক-পিকের মুখে এই কথা শুনে তাদের দলের পাখিদের খুব রাগ করার কথা। কিন্তু রাগ করল না কেউ। দলের এক বুড়ো পাখি আফসোস করে বলে, ‘আমরা ওই দুই জাতের দুটি পাখির মতো সুখী হতে পারি যদি না আমরা ‘জাত আর রং’ ভুলে নিজেদের শুধু পাখি ভাবতে পারি।’

বুড়ো পাখির কথায় সবাই খুশি হয়ে গেল। দুই জাতের পাখিরা আনন্দে হই হই করে টুই-টুই আর পিক-পিক পাখিকে বরণ করে নিল এবং সবাই সুর করে গেয়ে উঠল:

‘জাত-পাত মানি না, আমরা সবাই এক

জাত ভুলে টুই-পিক সুখে আছে দেখ…।’

বন্ধুরা, জাতপাত না করার বিষয়ে উপদেশমূলক গল্পটি শুনলে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো ইসলাম ধর্মেও জাতপাতের বৈষম্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের পর ঘোষণা করেনঃ
“হে কুরাইশগণ! রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তা’য়ালা জাহেলিয়াতের সব অহংকার ও বংশ গৌরব খতম করে দিয়েছেন। সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। আর আদমকে মাটি থেকে পয়দা করা হয়েছে।”

এ সম্পর্কে ইরানি কবি শেখ সাদী (র.) বলেছেন-
মাটিতে হয়েছে সৃষ্টি আদম তনয়
মাটিতেই মিশে যাবে জানিও নিশ্চয়।
গোর হতে মুর্দা যদি কর বাহির।
চিনা নাহি যায় ক’বো আমীর-ফকির।
দুনিয়াতে এসে কত রাজা মহারাজ
খালি হাতে চলে গেলা ফেলে তখত-তাজ।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments