Tuesday, April 16, 2024
Homeরম্য গল্পমজার গল্পরাত দু’টার সময় টেলিফোন - হুমায়ূন আহমেদ

রাত দু’টার সময় টেলিফোন – হুমায়ূন আহমেদ

রাত দু’টার সময় কাঁচা ঘুম থেকে উঠে টেলিফোন ধরলাম। রং নাম্বার, বলাই বাহুল্য। আমি এমন কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি না যার কাছে রাত দুটা তিনটার সময় টেলিফোন আসবে।

আমি হেঁড়ে গলায় বললাম, কে?

ওপাশ থেকে আমার ভাগ্নি সুমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মামা, তুমি এত বিশ্রী করে কে বললে কেন?

বিশ্রী করে বলেছি?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে তুমি খুব বিরক্ত।

রাত দু’টার সময় ঘুম থেকে উঠে টেলিফোন ধরলে সাধু-সন্ন্যাসীরাও খানিকটা বিরক্ত হন।

এত রাতে টেলিফোন করায় তুমি কি রাগ করেছ?

না, রাগ করিনি। খুবই আনন্দ হচ্ছে। ব্যাপারটি কী?

আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছি মামা। ভাবলাম, মরার আগে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলি। এই পৃথিবীতে আমি কাউকে পছন্দ করি না। তোমাকে খানিকটা করি।

টেলিফোনে ফুসফুস জাতীয় শব্দ হতে লাগল। সম্ভবত কান্নার শব্দ। আমি খানিকটা চিন্তিত বোধ করলাম। এ যুগের সুপার সেনসেটিভ মেয়ে। তার ওপর বয়স সতেরো। কিছুই বলা যায় না। কথাবার্তা বলে ক্রাইসিস কাটিয়ে দিতে হবে।

কীভাবে সুইসাইড করবি কিছু ঠিক করেছিস?

হ্যাঁ।

কীভাবে? এটম খাব মামা।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এটম খাবি মানে? এটম বোমার কথা বলছিস? এটম বোমা কি খাওয়া যায়? স্মল সাইজ বের করেছে?

এটম না মামা, র‍্যাটম। ইঁদুর-মারা বিষ।

ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে মরবি। এটা একটা লজ্জার ব্যাপার না? তুই তো ইঁদুর না। তুই হচ্ছিস মানুষ। তোর উচিত মানুষ-মরা বিষ খাওয়া। ইঁদুররা সুইসাইড করতে চাইলে র‍্যাটম ব্যবহার করবে। তুই কেন করবি? তোর মান-অপমানবোধ নেই? ইঁদুররা যখন জানবে তুই র‍্যাটম খেয়েছিস তখন অপমানে ওরা হাসাহাসি করবে না।

সুমি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, মামা, তুমি কি ঠাট্টা করছ?

আরে না। ঠাট্টা করব কেন?

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ঠাট্টা করছ। আমি কিন্তু মোটেই ঠাট্টা করছি না, আমার সামনে দু’প্যাকেট র‍্যাটম।

তোর সামনে দু’প্যাকেট র‍্যাটম?

হ্যাঁ। র‍্যাটম পানিতে গুলে খাব।

এমনি এমনি খেতে পারবি না। প্রথমে চিনির শরবত বানাবি। লেবু চিবে রস দিয়ে দিস–তার সঙ্গে র‍্যাটম মিলাবি। নয়তো খেতে পারবি না।

থ্যাংকস ফর দি সাজেশন মামা

আরও একটা কথা, ভালো করে দেখ তো ও প্যাকেটের গায়ে এক্সপায়ারি ডেট আছে কিনা। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খাবি। কাজের কাজ কিছুই হবে না। মাঝখানে সিরিয়াস ধরনের ডাইরিয়া হবে। ওরস্যালাইন খেতে হবে গ্যালন গ্যালন।

মামা তুমি ঠাট্টা করছ! তুমি বুঝতে পারছ না যে আমি কী পরিমাণ সিরিয়াস। এই মুহূর্তে আমি কী করছি জানো? শেষ চিঠি লিখলাম।

কী লিখলি শেষ চিঠিতে?

খুব সাধারণ একটি চিঠি, যাতে আমার মৃত্যুর পর পুলিশ বাবা-মাকে যন্ত্রণা না করে। লিখেছি–আমার মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী। আচ্ছা মামা, দায়ী বানান কী? দীর্ঘ। ই-কার নাহ্রস্ব ই-কার?

জানি না। একটা লিখলেই হলো। তুই মরে যাচ্ছিস এটাই বড় কথা, বানান নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।

কী যে তুমি বলো মামা। সবাই মাথা ঘামাবে। পত্রিকায় এই চিঠি ছাপা হবে। কত লোক পড়বে। তোমরাও নিশ্চয়ই আমার শেষ চিঠি যত্ন করে রাখবে। সেখানে একটা ভুল বানান থাকা কি ঠিক হবে?

মোটেই ঠিক হবে না, তুই বরং দায়ী শব্দটা বাদ দিয়ে লেখ–আমার মৃত্যুর জন্যে আমিই responsible.

জগাখিচুড়ি করব?

তাতে কোনো অসুবিধা নেই–তুই ক্যাপিট্যাল লেটারে লিখে লিখে দে। এতেও এক ধরনের অ্যাফেক্ট হবে। লিখে দে–

আমার মৃত্যুর জন্যে আমিই RESPONSIBLE.

তোমার আইডিয়া আমার কাছে খারাপ লাগছে না মামা। ভালোই লাগছে। চিঠির শেষে কি মৃত্যুবিষয়ক কোনো কবিতা দিয়ে দেব।

দিতে পারিস। যদিও খুবই ওল্ড স্টাইল। তবু ব্যবহার করা যায়। পুরনো সব ফ্যাশনই তো ফিরে আসছে।

ওল্ড ফ্যাশন হলে দিতে চাই না মামা। তোমার মাথায় কি আর কোনো আইডিয়া আছে? মডার্ন আইডিয়া?

আছে। আরেকটা কাগজে বড় বড় করে লেখ Bদায়।

সুমি রেগে গেল। থমথমে গলায় বলল, কী যে তুমি বলো মামা! এইসব তো ক্লাস ফোর ফাইভের ছেলে মেয়েরা লেখে। চিঠির শেষে লেখে–এবার তাহলে ৮০ Bদায়। আমি কি ক্লাস ফোরের মেয়ে?

আমি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললাম, এইখানেই তো তুই একটা ভুল করলি সুমি। তোর মতো ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে, তোর মতো ম্যাচিউরড মেয়ে, তোর মতো লজিক্যাল একটা মেয়ে যখন বাচ্চা মেয়েদের মতো লিখবে Bদায়। তখন আমরা চিন্তায় পড়ে যাব। অন্য একটা অর্থ বের করার চেষ্টা করব।

কী অর্থ?

একেকজন একেক রকম অর্থ করবে। কেউ বলবে, মৃত্যুর আগে আগে এই মেয়েটি শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিল।

মামা, তোমার এই আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়েছে।

থ্যাংকস।

আর কোনো আইডিয়া আছে?

চিঠির মধ্যে কোনোরকম রহস্য রাখতে চাস?

তার মানে?

যাতে চিঠি পড়ে লোকজন কনফিউজড হয়। একদল বলে, আত্মহত্যা, আরেকদল বলে, না, মার্ডার।

এতে লাভ কী?

ভালো পাবলিসিটি পাবি। রোজ তোর ছবি দিয়ে পত্রিকার নিউজ যাবে–সোমার মৃত্যু রহস্য ঘনীভূত। সোমার মৃত্যু: নতুন মোড়। পত্রিকার দশ দিনের খোরাক। তোর সুন্দর সুন্দর সিঙ্গেল ছবি আছে? ব্লক অ্যান্ড হোয়াইট?

রিসেন্ট ছবি তো কালার।

না থাকলে কী আর করা। কালার ছবিই দিতে হবে। নাকি কয়েকটা দিন অপেক্ষা করবি? ইতোমধ্যে আমরা একজন ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে নানা ভঙ্গিমায় বেশ কিছু ছবি তুলে রাখি…।

সুমি রাগী গলায় বলল, তোমার কৌশল আমি বুঝে গেছি মামা। তুমি সুইসাইড ব্যাপারটা ডিলে করাতে চাচ্ছ। তুমি ভাবছ, ফটোগ্রাফারের কথায় আমি আত্মহত্যার সময় পিছিয়ে দেব।

আমি মোটেই সেরকম কিছু ভাবছি না। কারও স্বাধীন ইচ্ছায় আমি বাধা দিই না। তাহলে তুমি বাধা দিচ্ছ না।

শেষ চিঠিটা লিখে ফেলব।

অবশ্যই লিখে ফেলবি।

পৃথিবী ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে মামা।

একটু কষ্ট তো হবেই। এই কষ্ট স্বীকার করে নিতেই হবে। তুই দেরি না করে শেষ চিঠি লিখে ফেল।

সুমি বলল, লাল কালি দিয়ে লিখব মামা।

কালো কালি দিয়ে লেখার চেয়ে রক্ত দিয়ে লিখতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো।

রক্ত? রক্ত পাব কোথায়?

ব্রেড দিয়ে হাত চিরে বের কর।

পাগল হয়েছ? আমি ব্লেড দিয়ে হাত চিরে রক্ত বের করব?

তাহলে এক কাজ কর–ঘরে প্রচুর মশা আছে না?

আছে।

ওদের কাছে হাত বাড়িয়ে দে। রক্ত খেয়ে ওরা ফুলে যখন ঢোল হবে তখন ওদের ধরে ধরে একটা পিরিচে জমা কর। গোটা ত্রিশেক রক্ত-খাওয়া মশা জোগাড় হওয়ার পর মশা টিপে টিপে রক্ত বের কর।

মামা, তুমি ব্রিলিয়ান্ট।

থ্যাংকস।

তাহলে রাখি মামা? মশাদের রক্ত খাওয়ানো শুরু করি।

বিদায়। লেখা হওয়ার পর টেলিফোন করিস, কেমন?

আচ্ছা।

আমি নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম। Bদায় লেখার মতো যথেষ্ট রক্ত যোগাড় করা সহজ কর্ম না। তাছাড়া কথাবার্তা বলে সুমিকে যথেষ্ট পরিমাণে কনফিউজও করা হয়েছে। আত্মহত্যার ইচ্ছার তিলমাত্র এখন তার মধ্যে নেই। থাকা উচিত নয়।

পরদিন ঘুম ভাঙল হৈচৈ-এর শব্দে। দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার জোগাড়। দরজা খুলে দেখি, সুমির মা–আমার কনিষ্ঠ ভগ্নি রণরঙ্গিনী মূর্তিতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। অবস্থা নিশ্চয় সঙ্গিন। যে-কোনো সঙ্গিন অবস্থা ডিফিউজ করতে হলে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসতে হয়। আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলাম।

আমার বোন দীর্ঘদিনের উপবাসী সুন্দরবনের মহিলা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো গর্জন করে উঠে বলল, দাদা ভাই, তুমি তুমি তুমি…

আমি বললাম, হ্যাঁ আমি আমি আমি। ব্যাপার কী?

তুমি সুমিকে সুইসাইড করার বুদ্ধি দিয়েছ?

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, পাগল হয়ে গেলি নাকি? আমি জীবনবাদী মানুষ। আমি…

এসো তুমি আমার সঙ্গে, এসো।

কোথায়?

পিজি হাসপাতালে।

আরে মুশকিল! লুঙ্গি পরে যাব নাকি?

হ্যাঁ, তুমি লুঙ্গি পরেই যাবে। আমার মেয়ে মরতে বসেছিল তোমার জন্যে।

র‍্যাটম খেয়েছে শেষ পর্যন্ত?

হ্যাঁ। খেয়েছে। র‍্যাটম দিয়ে চিনি দিয়ে লেবু চিরে তার রস দিয়ে শরবত বানিয়ে তার থেকে এক চুমুক খেয়েছে।

কিছু হয়নি তো?

কিছু হলে তোমাকে আমি আস্ত রাখতাম?

কী যন্ত্রণা! আমি কী করলাম?

চলো আমার সঙ্গে হাসপাতালে, তারপর শুনবে তুমি কী করেছ। ছিঃ দাদা ভাই, ছিঃ!

গেলাম হাসপাতালে। আমাদের যেখানে যত আত্মীয়স্বজন আছে সব চলে এসেছে। বেশিরভাগই রোগীর কিছু হয়নি দেখে খানিকটা মনমরা। আমাকে দেখে সুমি হাসিমুখে বলল, মামা!

আমি বললাম, কিরে?

তোমার কথামতো সবকিছু করেছি মামা। আগে শরবত বানিয়ে নিয়েছি। শুধু রক্ত দিয়ে বিদায় লিখতে পারিনি। রেড মার্কার দিয়ে লিখেছি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments