Tuesday, May 7, 2024
Homeকিশোর গল্পছোটদের গল্পপুটু - ইবরাহীম খাঁ

পুটু – ইবরাহীম খাঁ

তখন আমি ছোট। মা-বাবার সঙ্গে বাড়িতে থাকি। রোজ পুতুলের বিয়ে দিই, দিনে তিনবার গিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে মার কাছে নালিশ করি আর ভাত দিতে একটু দেরি হলে কেঁদে দুই চোখ ফোলাই। তা ছাড়া গাঁয়ের পাঠশালায় যাই, হফতায় একটা করে স্লেট ভাঙি আর মাসে একটা করে বই ছিঁড়ি।

বাড়িতে গাই ছিল, বকরি ছিল, মুরগি ছিল। মা গাই ভালোবাসতেন। বলতেন—ওরা দুধ দেয় অনেক, অথচ সামান্য খড় খেলে তুষ্ট থাকে আর ওদের গোবরে পালানের ভালো সার হয়। বাবা ভালোবাসতেন বকরি আর মুরগি। এ দুটোই মার চোখের বিষ ছিল। তিনি বলতেন, বকরি; ওহ্! ভীষণ! ওরা বিষের পাতা পেলে তাও খায়; পালান তো ওদের জ্বালায় রাখাই দায়। মুরগি আর এক আপদ: ঘর নষ্ট করে, মটর-পালংশাক খেয়ে সাবাড় করে, মরিচ, কপি, টমেটো পর্যন্তও ওদের জ্বালায় রাখার জো নাই।

সেবার বাড়িতে একটা বকরির চারটি বাচ্চা হলো। শেষ বাচ্চাটি হলো নেহায়েত দুর্বল। বাকি তিনটি সবল বাচ্চার ধাক্কায় দুর্বল বাচ্চাটা তার মায়ের কাছে ভিড়তেই পারত না।

দুই দিন পর দেখা গেল, দুধের অভাবে দুর্বল বাচ্চাটি যায় যায়। বাবা বাচ্চাটি ধরে এনে মায়ের কোলে ফেলে দিলেন। বললেন—ও মরবার পথে; যদি পারো ওকে বাঁচাও।

মা প্রথমে বিষম বিরক্তির সঙ্গে ভ্রুকুটি করলেন। বললেন, আমার ঘাড়ে এ জঞ্জাল কেন?

পরক্ষণেই বাচ্চাটির দিকে চেয়ে আমাকে বললেন: একটু দুধ বাটিতে ঢেলে নিয়ে আয় তো মা, দেখি আপদটাকে খাওয়ান যায় কিনা।

আমি বাটিতে দুধ নিয়ে এলাম। মা নিজ আঙুল দুধে ভিজিয়ে ভিজিয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়াতে লাগলেন। বাচ্চাটা মার আঙুল চুক চুক শব্দে চুষে খেতে লাগল।

এমনিভাবে দুই-তিন দিন গেল। এখন খিদে পেলেই বাচ্চাটি মার কাছে এসে হাজির হয়।

মা বাচ্চাটির নাম রাখলেন পুটু। পুটু পুটু ডাক দিলেই পুটু মার কাছে লাফিয়ে আসে।

মা পুটুর জন্য একটি দুধ খাওয়ানো বোতলের ব্যবস্থা করে ফেললেন। পুটু এখন থেকে দিনে চারবার করে বোতলের দুধ খেতে লাগল।

পুটুর চেহারা ফিরে গেল। তার গায়ের কালো লোম চিকচিক করতে লাগল।

ইতিমধ্যে রান্নাঘরে পুটুর উপদ্রব শুরু হয়ে গেল। সে মার পাছে পাছে গিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে, মার কাপড়ের আঁচল কামড়িয়ে ধরে টানে এবং সুবিধা পেলে গিয়ে কোলে ওঠে। এর ওপর কখনো পানির কলসটা উল্টিয়ে দেয়, কখনো মটরশাক নিয়ে টানাটানি করে, কখনো-বা আমাকে দেখে যেমন লাফালাফি শুরু করে তাতে নুনের হাঁড়ি যে কাত হয়ে পড়ে, মসলার বাসন যে উপুড় হয়ে যায়, সেদিকে তার খেয়াল থাকে না।

মা এক-একবার রাগ করে আমাকে বলেন—তুই পুটুকে কোলে নিয়ে নিয়ে ওর মেজাজটাই খারাপ করে দিলি। আমি বলি: আর দুধ খাইয়ে খাইয়ে ওটাকে অসুরের মতো করে তুলল কে?

মা তাড়াতাড়ি পুটুর দিকে থুতু ফেলার চেষ্টা করে বলেন: ষাট, ষাট, তোরা ওর ওপর নজর লাগাসনে।

পুটু দুধ ছেড়ে ঘাস ধরল। তবু দিনে দুইবার মার কাছে তাকে আসতেই হবে, আর মার হাতে দুটো শাকের পাতা, নাহয় একটু ভাতের ফেন তাকে খেতেই হবে।

আর আমার কাছে পুটুর দিনে দুই-একবার আসা চাই-ই। আমার গায় তার গা ঘষার জন্য আর হাতে দুটো কানমলা খাওয়ার লোভে।

এমনি করে দিন যায়, হফতা আসে; হফতা যায়, মাস আসে। পুটু রোজ রোজ মোটা হয়ে ওঠে।

মাকে শুনিয়ে একদিন বাবা বললেন, ‘ঈদ তো প্রায় এসে গেল; পুটুও বেশ মোটাসোটা হয়ে উঠল; এবার ওরই কাবাব দিয়ে কয়েকজন মানুষ খাওয়ান যাক, কী বলো?’

‘আমি ওসব কিচ্ছু জানি না’—গম্ভীরভাবে মা এই মন্তব্য করে বাবার সামনে থেকে সরে গেলেন।

বাবা এরপর আর কোনো জবাব দিলেন না। পুটু কাছেই ছিল: আমি দৌড়িয়ে গিয়ে পুটুকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলাম। পুটু এ আদর বুঝল: বিলাইর বাচ্চার মতো চুপ করে কোলের মধ্যে লুকিয়ে রইল।

কয়েক দিন যায়। বাবা আবার মাকে বললেন—দেখো, পুটুকে খাইয়ে খাইয়ে তাড়াতাড়ি আরও মোটা করো। ঈদের তো আর বেশি দেরি নাই।

মা ঝংকার দিয়ে বললেন: তুমি কি ভেবেছ যে কয়েক দিনের মধ্যে পুটু একটা ছোটখাটো হাতি হয়ে যাবে? তওবা! তওবা! যেন দুনিয়ায় পুটু ছাড়া আর খাসি বকরি নাই।

বাবা কাজের মানুষ; সব সময় নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে ডুবে থাকেন। তিনি মার কথার দিকে বিশেষ নজর না নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

পুটুকে বাবা দুই-চারবার আদর করেছিলেন: এখন থেকে সে বাবার পাছেও ঘোরাফেরা শুরু করল।

বাবা পুটুর জন্য তাজা ঘাস, ভিজানো ছোলা আর কলাইয়ের ভুসির ব্যবস্থা করলেন।

দেখে মায়ের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বাবার ওপর আমারও মন খারাপ হয়ে উঠল। ঈদের মাত্র দুই দিন বাকি। বাবা মাকে বললেন—আচ্ছা, কেবল পুটুর কাবাবেই চলবে, না আরও কিছুর জোগাড় করতে হবে?

মা করুণ নয়নে বাবার দিকে চাইলেন: বললেন: আমি তো ভেবে রেখেছি, দুটো খাসি মোরগ আছে, এবারকার মতো ওই দিয়েই চালিয়ে দেওয়া যাবে।

বাবা সংক্ষেপে বললেন: কিন্তু বকরির কাবাবের কথা আত্মীয়মহলে জানাজানি হয় গেছে যে?

মা এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না; গম্ভীর মুখে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাবাও এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না।

ঈদের দিন সকালে বাবা খাসি মোরগ দুটি নিজে জবেহ করে দিলেন। বললেন—এই দুটো বানাও; বকরি আমি জবেহ করি না। মুনশির কাছে নিতে হবে।

এই বলে বাবা মুনশির বাড়ির দিকে চললেন। পুটু তার পাছে পাছে চলল।

ঘণ্টাখানেক পর বাবা একটা খাল ছাড়ানো বকরি এনে রান্নাঘরে দিলেন, বললেন: ঠিকঠাক করে নাও, আমি নিজে ওটাকে আস্ত কাবাব করব।

দেখে আমি কেঁদে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

ঈদের নামাজ হয়ে গেছে। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এসে দস্তরখানা সামনে নিয়ে বসেছেন। মাকে নানা বললেন—তুমিও সাথে বসো মা, নইলে আমাদের ঈদের খানার আনন্দ পূর্ণ হবে না।

খেতে বসলেন নানা, চাচা, বাবা আর মা। আমিও নানার কাছে বসলাম।

চাকর খাসি মোরগের কোরমা আর রুটি নিয়ে এল। তারপর এল আস্ত বকরির কাবাব। বাবা ছুরি হাতে নিয়ে কাবাব কেটে কেটে বাসনে দিতে লাগলেন।

বাবা নানার বাসনে একটা রান দিলেন আর চাচার বাসনে দিলেন আরেকটা রান। আমার বাসনে দিলেন সিনার এক বড় টুকরা।

এরপর বাবা গেলেন মার বাসনের পানে। মার বাসনে কাবাব দেওয়ার উপক্রম করতেই মা চিৎকার বললেন, ‘আমি তোমার ও কাবাব চাই না—চাই না।’ তারপর তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

নানা ও চাচা অবাক হয়ে মার দিকে চাইলেন। আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। এই সুযোগে বাবা চুপ করে বেরিয়ে গেলেন।

মা চোখের পানি মুছতে মুছতে কাঁদো কাঁদো সুরে বলতে লাগলেন: এটা আমার পুটুর কাবাব। আমি ওকে নিজের হাতে খাইয়েছি, ও আমার পাছে পাছে ঘুরত, আঁচল কামড়িয়ে ধরত। আমি বুঝি না, ওকে জবেহ না করে চলল না কেন?

ঠিক এই সময় বাবা ঘরে ঢুকলেন। তাঁর কোলে পুটু: তিনি পুটুর পিঠে আস্তে হাত বোলাচ্ছেন আর বলছেন: আর লাফালাফি করিস না, পুটু। এই বেলায় দুইবার খেয়েছিস, আর কত খেতে চাস?

আমি লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে পুটুকে কোলে নিলাম। মা অবাক হয়ে বাবার দিকে চেয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন: অ্যাঁ! এ কী? কোথা থেকে…

বাবা যেন মায়ের ওপর একটা টেক্কা মেরে দিয়েছেন এমনভাবে বললেন, ‘দেখলাম, তুমি পুটুকে জবেহ না করেই ছাড়বে না, কাজেই আমি পুটুকে লুকিয়ে রেখে অন্য বকরি নিয়ে জবেহ করেছি।’

নানা হেসে মার দিকে চেয়ে বললেন: পাগলি বেটি, বরাবরই না জেনে কেঁদে খুন হয়।

পুটু বুড়ো হয়ে মরেছিল, ওর গলায় কেউ ছুরি তুলতে সাহস পায় নাই।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments