প্রহারেণ ধনঞ্জয় – জসীম উদ্দীন

'প্রহারেণ ধনঞ্জয়' জসীম উদ্দীন

এক কুলীন ব্রাহ্মণ ছিল খুবই গরীব। কোনোরকমে দিন চলে যায়। কোন এক বর্ষাকালে সাত মেয়ের সাত জামাই এসে বসে আছে তার বাড়িতে। বেচারি শ্বশুর আজ বিক্রি করে বউ-এর গয়না, কাল বিক্রি করে পিতলের কলসী। যা মূল্য পায় তাই দিয়ে জামাইদেরকে খাওয়ায়। আষাঢ় মাসের ঘন বর্ষার দিন। দুধে-মাছে খেয়ে জামাইরা আর ফেরার নামও করে না। পাড়ার একজন লোক, গরীব ব্রাহ্মণের অবস্থা দেখে বড়ই দুঃখিত হল। সে এসে শ্বশুরকে বলল, “আপনার জামাইরা যে আজ দশ-বারো দিন ধরে বসে বসে খাচ্ছে, তাদের বাড়ি চলে যেতে বলেন না কেন?”

শ্বশুর বলল, “তাহা যদি করি তবে জামাইরা রেগে মেগে বাড়ি গিয়ে আমার মেয়েদের কষ্ট দিবে। সেই জন্যই তো তাদেরকে এতটুকু অযত্ন করতে সাহস পাই না।”

তখন সেই লোকটি শ্বশুরের কানে কানে একটি উপদেশ দিয়ে গেল। পরদিন জামাইদের খাওয়ার সময় পাতে ঘি পড়ল না। তাহা দেখে হরি নামের জামাই রেগে একেবারে অস্থির। সে ভাতের থালা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠল, “কি-আজ আমাদের থালায় ঘি পড়ল না, ঘি না খাইয়ে শ্বশুর আমাদেরকে অপমান করলেন। এমন শ্বশুরবাড়ি কে থাকে?” এই বলে সে গাট্টি-বোচকা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি হতে চলে গেল।

পরদিন জামাইদের খাওয়ার সময় পাতে মাংস পড়ল না। মাধব নামের জামাই ভাতের থালা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

“কি!-শ্বশুরবাড়ি এসেছি বলে অপমানিত হব? কাল খাওয়ার সময় ঘি দিল না, আজ আবার মাংস দিল না। এমন শ্বশুরবাড়ি নাই থাকিলাম।” এই বলে সে ছাতি লাঠি বগলে করে বাড়ি চলে গেল।

পরদিন খাওয়ার সময় মাছ দেওয়া হল না। সেদিন রেগে মধু নামের জামাই চলে গেল। তার পরদিন খাওয়ার সময় মিষ্টান্ন দেওয়া হল না। উহাতে অপমান বোধ করে যাদব নামের জামাই চলে গেল। অপর দিন পাতে ব্যঞ্জন পড়ল না। অক্ষয় নামের জামাই রেগে আগুন হয়ে চলে গেল। বাকী দুই জামাই শ্যাম আর ধনঞ্জয় তবু পড়ে রইল। বাড়িতে গেলে ভাতও তো জুটবে না। না দিয়েছে তরকারি, না দিয়েছে ঘি। এখানে নুন দিয়েও তো পেট ভরে ভাত খাওয়া যাবে!

পরদিন যখন খাওয়ার সময় লবণ দেওয়া হল না, বিনা লবণে ভাত খেতে খেতে থুথু করে শ্যাম নামের জামাই চাদর গলায় দিয়ে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু ধনঞ্জয় আর যায় না। শ্বশুর না দিয়েছে লবণ, পেট ভরে ভাত তো দিবে! বাড়িতে গিয়ে ভাতও তো জুটবে না। আর শ্বশুর বাড়িতে টিনের ঘর, ঝড়-বৃষ্টিতে জল পড়ে না। বাড়িতে খড়ের ঘর! ছাউনি খসে পড়েছে। এতটুকু বৃষ্টি পড়লেই মেঝেয় হাঁটুখানেক জল। শ্বশুর বাড়িতে আরাম করে তো রাতে ঘুমান যায়।

পরদিন সেই লোকটি এসে জিজ্ঞাসা করল, “আমার পরামর্শ মতো কাজ করে ফল পেয়েছ তো?”

শ্বশুর বলল, “আপনার পরামর্শমতো কাজ করায় সকল জামাই-ই একে একে চলে গিয়েছে। কিন্তু ধনঞ্জয় নামের জামাই কিছুতেই যায় না।”

লোকটি তখন পরামর্শ দিল, “উহাকে লাঠিপেটা করে তাড়াও।”

কতদিন আর জামাইকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ান যায়! পরদিন শ্বশুর একটি লাঠি দিয়ে মারিয়া ধনঞ্জয়কে তাড়িয়ে দিল। সেই হতে শ্লোক তৈরি হল।

হরি বিনা হরির্যাতি মাংসেন মাধব, মৎস্য বিনা মধুর্যাতি মিষ্টান্ন বিনা যাদব। ব্যঞ্জন বিনা তড়িৎ যাতি ক্রোধদ্দীপ্ত অক্ষয়, লবণ বিনা শ্যাম যাতি প্রহারেণ ধনঞ্জয়।

You May Also Like

About the Author: Anuprerona

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.