Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাপিসিমা - বাণী বসু

পিসিমা – বাণী বসু

পিসিমা - বাণী বসু

ব্রাহ্মণ ভোজন গতকাল হয়ে গেছে। এলাহি লোকজন। আজ নিয়মভঙ্গ। নয় নয়। করেও আড়াইশোর কাছে লোক হয়ে গেল। বাড়ি-বর্গে নিজেদের গুষ্টিই তো। পঞ্চাশের ওপরে। তার ওপর এতগুলি কুটুম। পাড়ার লোকও আছে।

অনীশ বলল, ওদের মাছ-ভাত না খাওয়ালে বাবার তো মান থাকতই না, আমাদেরও না। করেছে অনেক।

দীপিকা বা দীপু বলল, একশোবার। বাবা অদড় হয়ে পড়েছিল। তোমরা ছেলেরা তো কোনকালে ভেগে গেছ। পাড়ার এইসব কেষ্টা, বিষ্ণু, গনু, ভোঁদড়— এরা না থাকলে বাবার ডাক্তার বদ্যিটুকুও সময়ে অসময়ে হত কি-না সন্দেহ। পিসিমা মেয়েমানুষ বই তো নয়।

কথার মাঝখানটা অনীশের খট করে লেগেছিল। দীপুটা চিরকালের অপ্রিয়বাদিনী। সে তো স্বীকারই করছে সে করেনি। তার করার অবস্থা ছিল না। কর্মস্থল যদি কারুর হোসিয়ারপুর পাঞ্জাব হয় তা হলে বাবার দেখাশোনার জন্য শ্রীরামপুর ঋষি বঙ্কিম সরণি ঘড়ি-ঘড়ি দৌড়ে আসা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। বরঞ্চ যারা অপেক্ষাকৃত কাছেপিঠে থাকে তাদেরই উচিত ছিল নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা করে নেওয়া এ ব্যাপারে। দীপিকার টিপ্পনীর উত্তর অবশ্য দিল অনীশের বউ, দীপিকার বউদি। কুমিল্লার মেয়ে, তার কথার বাঁধুনিই আলাদা। বলল, তা দিদি, তোমার বড়দা তো সংসারের সবার সুসারের কথা ভেবে ভেবে কোনকালেই গেছেন, কিন্তু মেয়েরাও তো আজকাল সম্পত্তির ভাগ পাচ্ছে। দেখাশোনার বেলা বুঝি শুধুই ছেলে!

দীপিকা মুখ শুকনো করে জবাব দিল, তোমার যদি আমার ছেলের মতো একটি গুণধর থাকত! তা হলেই একমাত্র বুঝতে বউদি আসানসোল থেকে শ্রীরামপুর য ঘন্টারই রাস্তা হোক, ঘন-ঘন বাপেরবাড়ি আসার ভাগ্যি আমার নয় কেন।

অতীশের বউ শুক্লা আমুদে মানুষ, ঝগড়াঝাঁটি, মনকষাকষি পছন্দ করে না। সে হেসে উঠে বলল, এসে অবধি দেখছি দিদি তুমি সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরার মতো বুবুলরামকে ধরেছ। কেন? কী করেছে সে!

কী আর করবে ভাই! কিছুই করেনি। শুধু প্রতিদিনকার রুটিনটা ওর রক্তাক্ষরে লেখা। আজ ভুরুর ওপর ট্যাংরা মাছের কাঁটা। কাল কুঁচকিতে ডিউস বল, পরশু হাত বঁটির ওপর পড়ে দে-গঙ্গা নে-গঙ্গা। এদিকে পাড়া থেকে ওদিকে স্কুল থেকে নালিশের পর নালিশ। যাই হোক না প্রতি বছর ফার্স্ট হয়ে ক্লাসে উঠছে, তাই অত শয়তানির পরও স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়নি।–পুত্রগর্বে এই সময়ে দীপুর মুখ চকচক করতে থাকে।

এত দুষ্টু বুবুলরাম? কই দেখলে তো মনে হয় না!

কথাটা অন্য খাতে বওয়াতে পেরে দীপু বেশ খুশি হয়ে গিয়েছিল। সে তো দাদার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়নি। মাঝে মাঝে একটু কুটুস-কামড় দিতে তার ভালো লাগে। সে বলল, দুষ্টু মানে? বলছি না শয়তান! শয়তান! তার ওপরে বালির বস্তায় ঘুষি মারছে দু-বেলা, আমাকে উবু করে বসিয়ে মাথার ওপর দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে যাবে, না কি ক্যারাটে শেখা হচ্ছে। ক্লাবটি তো হয়েছে সোনায় সোহাগা।

দীপুর বোন অনীতা বা অনু দিদির পুত্রগর্বে গর্বিত বোধ করছিল। সাধারণত বোনে বোনে এসব ব্যাপারে একটা সহমর্মিতা থাকে। সে বলে উঠল, মেজবউদি, তুমি শোনোনি, বুবুল অল বেঙ্গল যোগকুমার হয়েছে গত বছর। যোগাসনে চ্যাম্পিয়ন। কী শক্ত শক্ত আসন করে তোমার দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সার্কাসের প্লাসটিক বডিকে হার মানায়।

শুক্লা চোখ কপালে তুলে বলে, বলো কি অনু, ওইটুকু ছেলের এত গুণ। বুঝতে পারিনি তো! আমরা জানতুম লেখাপড়াতেই ভালো।

মহিলাদের আড্ডা যথারীতি ছেলেদের গুণগানে পৌঁছেছে দেখে অনীশ এই সময়ে বিরক্ত হয়ে ঘর ত্যাগ করছিল। অতীশ এসে বলল, দাদা, তুমি এখানে করছ কি? বাবার বস দাসসাহেব অফিসের আরও কয়েকজনকে নিয়ে এসে সেই কখন থেকে বসে আছেন। দাসসাহেবকে মনে আছে তো!

দাসসাহেবকে মনে থাকবে না, কী যে তুমি বলো রন্টু! উনি তো আমাকে গাইড করেছেন অল্প বয়সে। ওঁর কথাতেই তো আমি কমপিটিটিভ পরীক্ষার দিকে যাই। ডাকবে তো আমাকে!

লম্বা কোঁচাটা সামলাতে সামলাতে ন্যাড়া মাথায় সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী চেহারার দুই ভাই অবিলম্বে শশব্যস্ত বেরিয়ে গেল।

ছোটো বোন ঈশিতা বা ইতুর সঙ্গে দালানেই ঠোকাঠুকি হয়ে গেল দাদাদের। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই দোতলার বড়ো হলঘর, নিমন্ত্রিতরা সেখানেই বসেছেন। ইতু তাঁদেরই আপ্যায়ন করছিল। দাদাদের সঙ্গে দেখা হতে হাত মুখ নেড়ে বলল, এই যে গৌর-নিতাই ওরফে জগাই-মাধাই, কোথায় যাওয়া হচ্ছে দু-জনের হন্তদন্ত হয়ে! ফার্স্ট ব্যাচ বসাতে হবে সে খেয়াল আছে!

অতীশ বলল, তুই তো এক্সপার্ট, যা না, দীপু অনু বউদি এদেরও ডেকে নিয়ে যা, শুক্লাটাকে ডাকিস না। উলটোপালটা করবে।

উলটোপালটা করবে, না নিজের বউকে আড়াল করছ বাওয়া!, ইতু ভঙ্গি করল।

যা, যা, ইয়ার্কি মারিস না। নিয়ে গিয়েই একবার মজাটা দ্যাখ না—মাসিকে কেমন মামি বলে, কাকাকে দাদা, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপালে মজাটা নিজেই টের পাবি।

অতীশ আর দাঁড়াল না, দাদা এগিয়ে গেছে, সেও কোঁচাটা হাতে তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। দাসসাহেবরা অনেকক্ষণ বসে আছেন। বাড়ির বড় ছেলে অনীশ যখন ফার্স্ট ক্লাস অনার্স নিয়ে বি এসসি পাস করল তখন এই দাসসাহেবই তাঁর রাশভারি গাড়ি চড়ে এক বাক্স কেক নিয়ে থিয়েটার রোড থেকে শ্রীরামপুর এই সারাটা পথ উজিয়ে এসেছিলেন। গমগমে গলায় পুরনো বাড়ির অলিগলি ভরে দিয়ে বলেছিলেন, দেখবেন রাখহরিবাবু, ছেলেকে যেন আবার এম এসসি-তে ভরতি করবেন না। কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসান।

সে কী? অত ভালো রেজাল্ট করল ছেলেটা, পড়াব না!

কেন? কেরানিগিরি করতে! না দুশো পঁচাত্তর টাকার মাস্টারি করতে! অনীশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের পরীক্ষায় বসবে এই আমার হুকুম। এম এসসি-টি ভুলে যাও। বাঙালির ছেলে অল ইন্ডিয়া কমপিটিশনে ক্রমশ পেছিয়ে পড়ছে রাখহরিবাবু। মাদ্রাজি, ইউ পি, এমনকি বেহার থেকে পর্যন্ত সব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যাচ্ছে, আর এই বইয়ের পোকা বঙ্গসন্তান সব ফ্যারাডে আর এডিসনের ভূত মাথায় পুরে দিন আনছে দিন খাচ্ছে।

অনীশ যে সময়ে আই পি এস হয়েছিল সেসময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সত্যিই এ লাইনে চিন্তা করত না। মধ্যবিত্ত বাবা তো নয়ই। অশীতিপর দাসসাহেবকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করতে করতে অনীশের সেই কথাই মনে হচ্ছিল।

থাক, থাক, দীর্ঘায়ু হও বাবা। দাঁত পড়ে, চুল খুইয়ে এককালের সাহেব মানুষটি এখন খুব ঘরোয়া বাঙালি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ঝুলন্ত মুখগহ্বরে সব সময়েই যেন কী চিবোচ্ছেন। হাতে লাঠি। ধবধবে ধুতিপাঞ্জাবির ভেতরে কোনো মানুষের শরীর আছে কি না সন্দেহ হয়।

তোমাদের পিতৃদেব সেন্ট পার্সেন্ট সৎ মানুষ, সৎ নাগরিক ছিলেন বাবা। কর্তব্যপরায়ণ, স্বার্থশূন্য, পরহিতৈষী। স্ত্রী বিয়োগের পরও তাঁকে দশ-দশটা বছর এভাবে বেঁচে থাকতে হল কেন জানি না। সবই মঙ্গলময়ের ইচ্ছা।

অনীশের শ্বশুরমশাই উপস্থিত ছিলেন, বললেন, আমার বেয়ান রত্নগর্ভা ছিলেন রাধামোহনবাবু। ছেলে মেয়ে কটি সবই তো তাঁর দয়ায় সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি যেখানে যেমন রেখেছেন, সেখানেই থাকতে বাধ্য তো সব। যথা নিযুক্তোহস্মি, তথা করোমি। তবে দেখাশোনা সব বাবাজিরা পালা করেই করত। তার ওপরে সবার মাথায় ছিলেন আমার আরেক বেয়ান। এদের পিসিমা। দাদাকে দু হাতে আগলে রেখেছিলেন, এদের গর্ভধারিণীর অভাব জানতে দেননি। যাওয়া-আসা একরকম নিত্যই করতুম কি না! পানটি হেঁচা, সময়ে ফলের রস, চা, শরবৎ, বেলের মোরববা, ইসবগুল। একেবারে তেরেকেটে ধা, তালে বাঁধা, তাল কাটার কোনো উপায় নেই।

তাই নাকি! তাই নাকি! দাসসাহেবের সচল মুখ আরও সচল হয়ে উঠল।

তা হলে তো রাখহরিবাবুর অশেষ পুণ্য। আমি তো একটি মাত্র কন্যার কানাডায় বিয়ে দিয়ে মনে মনে দিন গুনি দাদা, গৃহিণীর তিরোধান যেন সইতে না হয়। জপের মালার মতো জপি দিনরাত। আহা, উইডোয়ারের দুঃখে শেয়াল কুকুরও কাঁদে, জানেন তো দাদা! তা সেই পুণ্যবতী ভগ্নীটি আমার কই! তাঁকে দর্শন করে চক্ষু সার্থক করি একবার।

দাসসাহেবের সামান্য ভীমরতি হয়েছে সেটা অনীশ অতীশ দু ভাই-ই বেশ বুঝতে পারছিল। কিন্তু নখদন্তহীন এই ব্যাঘ্রই একদিন দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং এ বাড়ির গার্জেন এঞ্জেল ছিলেন স্মরণ করে অনীশ বলল, রন্টু, পিসিমাকে একবার আনো।

শ্রাদ্ধের দিন এসেছিলেন দাসসাহেব, তাঁর পুরোনো মরিস মাইনরে চেপে। কিন্তু সেদিন এরা ভাইয়েরা সবাই কাজে ব্যস্ত ছিল। ষোড়শোপচার শ্রাদ্ধ। একেবারে শাস্ত্রবিধিসম্মত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পুরোহিত। তিনি কোনো কাজে একবিন্দু আপস সইবেন না। কাজে কাজেই সেদিন এত কথাবার্তা আপ্যায়নের সুযোগ ছিল না। কীর্তন শুনে, প্যালা দিয়ে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কাছে মিনিট দশেক বসে লিমকা আর রাজভোেগ খেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ আর সবাইয়ের মতো।

অতীশ পিসিমাকে দোতলার মেয়েদের ঘর থেকে সিঁড়ি নামিয়ে বড়ো দালান পেরিয়ে আনতে আনতে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছিল। এর চেয়ে যদি দাদাসাহেব তার বউ শুক্লাকে আনতে বলতেন কাজটা আরও সহজ এবং মনোজ্ঞ হত। শুক্লা সপ্রতিভ, পরিহাসপটু, সুশ্রী, সুশ্রী কেন রীতিমত সুন্দরীই। আজ বারো দিন পর নখ-টখ পালিশ করে চুলে শ্যাম্পু দিয়ে, সিঁদুর টিপ পরে, নতুন গোল্ডেন সিল্ক টাঙ্গাইল পরে দেখাচ্ছে দারুণ! টকটক করে আসত, টুকটুক করে কথা বলত। কিন্তু এই পিসিমাকে নিয়ে যেতে তার দম বেরিয়ে যাচ্ছে। একেই তো তিয়াত্তরের ওপর বয়স হয়েছে। মাথাটি সাদা কালো কদম ফুল। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো এক পেল্লাই সাইজের মাড় খড়খড়ে থান পরিয়েছে ভাইঝি আর ভাইপো বউয়েরা মিলে, পায়ে বাত, দাদাটি গত হবার পরই পিসিমা যেন হঠাৎ করে আশি পেরিয়ে পড়েছেন। জড়ভরত পুঁটলির মতো। চোখ চলে না, পা চলে না। অতীশ বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার কি কুশ পা না কি গো, পিসিমা! এত ফ্যাশনের কাপড়ই বা তোমাকে পরাল কে! এ যে কুইন এলিজাবেথের গাউনের মতো চারদিক থেকে ফুলে রয়েছে! যাচ্চলে!

পিসিমার দাঁতগুলি এই বয়সেও গুটিকয় কষের দাঁত ছাড়া, মোটামুটি আছে। বললেন, আমি কি আর পারি ধন? মানিক আমার! এখন তোমরাই আমার হাত পা, তোমরা আমার চোখ, যদি নিয়ে যেতে পার তো গেলুম। নয়তো এখেনেই বসলুম।

অতীশ বলল, ভালো জ্বালা। থামা দিলে কেন? দাসসাহেব তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন যে!

শেষ ব্যাচ সুষ্ঠু বাড়ির ভাইবোন বউজামাই লোকজনকে নিয়ে। পিসিমা তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছেন দেখে অনীশের বউ প্রতিমা জোর দিয়ে বলল, তা হয় না পিসিমা, আপনি এবার গিয়ে একটু শুয়ে পড়ুন।

পিসিমা বললেন, তুই মা পূর্ববঙ্গের মেয়ে হয়ে দুপুরে শোয়ার কথা মুখে আনিস কী করে? আমার শুতে লাগবে না।

খেলেনও না তো কিছু!

বাঃ, দু-দুটো পুরুষ্টু কলা, হাতাভর চিড়ে ভিজে, সন্দেশ! ভেসে যায় রে, ভেসে যায়। তিয়াত্তর পার হয়ে চুয়াত্তরে পড়লুম—একবেলা দুটোখানি যা হোক হলেই এ শরীর চলতে থাকে ঠিক। এখন তো আর শরীরের জোরে চলি না ধন, মনের জোরে চলি।

ছোটো একটি মোড়া টেনে, গুটিসুটি বসলেন পিসিমা একধারে।

শোলপোড়া একটু একটু মুখে দাও মা, শুক্লা, মেজবউমা, ফেলে দিসনি। ভাতের মধ্যে করে একটু গিলে নে মা, দশহরার দিন যেমন কলা গেলো।

অনীশ বলল, এ সব পুরনো আচারবিচার আর নেই পিসিমা, যেটুকু আছে উঠিয়ে দাও।

শুক্লা অতীশকে বলল, দশহরার দিনে কলা গেলা কি গো!

ওসব কলা গেলা ফেলা কি আমি জানি?—অতীশ বলল।

দীপিকা উলটো দিকে বসেছিল, বলল, কেন, তোর মনে নেই মেজদা, দশহরার। দিনে কলার মধ্যে উচ্ছে পুরে মা আমাদের গিলিয়ে খাওয়াত। খুব নাকি ভালো প্রতিষেধক! সত্যিই আমাদের কিন্তু রোগাভোগগুলো কম হত। হপ্তায় দু দিন চিরেতা, দু দিন কালমেঘ। সেসব দিন গেছে! হাত পা ছোড়াছুড়ি, কান্নাকাটি, বাববাঃ!

তিনটে নাগাদ মোটের ওপর খালি হয়ে গেল বাড়ি। আত্মীয়কুটুমরা সব একে একে বিদায় নিলেন। রবিবার বলেই নিমন্ত্রিতরা সবাই এসেছিলেন। অনেক দিন পর সবার সঙ্গে দেখা, খবরাখবর নিতেই সময় চলে যায়। বৃদ্ধেরা সব একে একে যাচ্ছেন। একে একে নিভিছে দেউটি। সে কথা বলাবলি করতে করতে চলে গেলেন সব। ছেলেপিলেরা কেউ এখনও ডেকোরেটরের চেয়ার নিয়ে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে, কেউ ঘুমে ঢুলে পড়েছে।

অনু এসে বলল, তোর ছেলেকে আমি সামলাতে পারলুম না রে দিদি। হেরে গেলুম। বুবুল একাই থ্রি ফোর্থ চেয়ার তুলে দিল। ডেকোরেটরের লোকগুলো বেকার বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে আর দাঁত বার করে হাসছে। চেয়ার সারা হয়েছে এবার টেবিল তুলছে। মানে সেই লম্বামতো কাঠগুলো আর কি!

দীপু পান চিবোতে অলস গলায় বলল, কেন, দাদা, মেজদা কী করছে?

দাদা মেজদা কি এ তল্লাটে আছে না কি? দাদা তো শ্বশুরকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে গেল। মেজদাও…..

শুক্লা বলল, এই মেজদি আমি আছি কিন্তু এখানে। বেফাঁস কিছু বলে ফেলল না বাবা।

অনু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। ইতু হাসছে। বলল, আমরা তিন বোনে যা বলি মুখের সামনেই বলি, আড়ালে বলি না মেজবউদি।

শুক্লা হেসে বলল, আমরা কিন্তু বুবুলরামকে নিয়ে আরম্ভ করেছিলুম।

দীপু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে চেয়ার-টেবিল তুলছে তো! ঠিক আছে। তুলতে দাও। যে ভবিষ্যতে যা হবে তার মহড়া আগে থেকেই শুরু হয়ে যাওয়া ভালো।

অনু বলল, তোর ছেলে কি ডেকোরেটর হবে। না কেটারার হবে রে?

দীপু বলল, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হবে ভাই। ওর দ্বারায় আর কিছু হবে না।

শুক্লা বলল, বাপ রে, ক্লাসে প্রতিবার ফার্স্ট হয়ে ওঠা ছেলেকে নিয়ে তুমি এত। ভাবছ?

দীপু বলল, ক্লাস ফোর স্টাফের মধ্যে আই কিউ কম আছে বলে মনে করো নাকি? একেক জন আছে ঠিকমতো গাইড্যান্স দিলে অনেক এঞ্জিনিয়ার ডাক্তারের ভাত মারতে পারত। আসলে প্রবৃত্তি, বউদি প্রবৃত্তি। এঁটো পাত তুলতে যার প্রবৃত্তি সে ভবিষ্যতে এঁটো পাতই তুলবে। কেন, এতগুলো ছেলেমেয়ে তো রয়েছে, দাদারাই না হয় বড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু তোমার কিষণ অনু শাম্পি-মাম্পি কেউ আর শূন্য চেয়ার, এঁটো টেবিল তুলছে, এঁটো পাত তুলছে?

ইতু বলল, আমার ছেলের অ্যাকটিভিটি বাদ দিলি কেন দিদি? দ্যাখ ও কিসের রিহার্সাল দিচ্ছে।

ইতুর ছেলের বয়স সাড়ে সাত মাস। সে এখন সবে ঘুম ভেঙে উঠে বড়োকর্ম করে মুখটা ভেলে ছিল। ইতু হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল, দ্যাখ তোর ফর্মুলা অনুসারে আমার ছেলেটা সারাজীবন এই-ই করবে।

দীপু হাত বাড়িয়ে বোনের পিঠে একটা কিল বসাল। শুক্লার হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে, বলল, বাববাঃ। ইতুটা পারেও। দেখি, তোমাদের দাদারা আর দিদিভাই কোথায় গেল।

ইতু চেঁচিয়ে বলল, দাদার সঙ্গে রা আর দিদিভাইটা বাদ দে মেজবউদি। তুই কাকে খুঁজতে যাচ্ছিস আমরা সবাই জানি।

সকলে হাসতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুক্লা সত্যিই চারজনকে ধরে নিয়ে এল। অনুর বর আজ আসতেই পারেনি, দীপুর বর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেখে আসানসোল ফিরে গেছে। একমাত্র ইতুর বর, বাড়ির ছোটো জামাই, জামাইদের মধ্যে উপস্থিত ছিল।

অতীশ এসে কোঁচা গুটিয়ে সবার মাঝখানে জমিয়ে বসে বলল, বলো এবার তোমরা কে কী বলবে। অনেকক্ষণ ধরে আমাকে খোঁজাখুঁজি হচ্ছে শুনছি।

দীপু বলল, খুঁজছিল আসলে শুক্লা, কিন্তু তুই যখন এসেই গেছিস তখন ধর আমরাও তোকে খুঁজছিলুম। কদিন পর ভাইবোনেরা মিললুম বল তো! কথায় বলে রাজায় রাজায় দেখা হয়, বোনে বোনে হয় না। আমাদের শুধু বোনে বোনে নয়, ভাইবোনেও দেখা হয় না রে!

অনীশ বলল, তা বাচ্চাগুলো সব কে কোথায়? দীপুর ছেলেটা তো দেখলুম ইসমাইলের সঙ্গে জোর তর্ক জুড়েছে। ইসমাইল বলছে ওদের গ্রামে নাকি কে এক খুনখুনে বুড়ো আছে, দুশো তিয়াত্তর বছর বয়স। দীপুর ছেলে বলছে তা হতেই পারে না, গিনেস বুকে নাকি ও কোন রাশিয়ান না চীনে বুড়োর নাম দেখেছে।

অনু বলল, সত্যি! বুড়ো হওয়ার কী কষ্ট, না? বাবার কত হয়েছিল গো!

দীপু বলল, তিরাশি। কানে শোনেন না, চোখে দেখেন না, দাঁত নেই যে পছন্দের জিনিস খাবেন।

অনীশ বলল, কেন, বাবার তো বাঁধানো দাঁত ছিল।

প্রতিমা বলল, থাকলে কি হবে, বাবা তো সেটা নিয়মিত ব্যবহারই করলেন না, একটু লাগত, প্রথম দিকে যেমন লাগে। আমার বাবার তো ষাটের কোঠা থেকেই পুরো বাঁধানো। এঁর মাথায় কে ঢুকিয়েছিল ক্যানসার হতে পারে। ব্যাস।

ইতু বলল, চোখের ছানি কাটানো নিয়ে তো সেই সত্তর বছর থেকে বলা হচ্ছে। তখন মা-ও বেঁচে, আমারও বিয়ে হয়নি। খালি এক কথা কটা দিনই বা আর বাঁচব, এই চোখেই আমার চলে যাবে।

অতীশ বলল, সেই সত্তর তিরাশিতে গড়াল। আজকাল এসব অপারেশন কিছু না, দুঘন্টা পরে ছেড়ে দেয়। আমার একবারটি অনুমতি দিলেই নেত্রালয়ে ব্যবস্থা করে দিতুম। করতে তো দিলেন না।

দীপু বলল, শয্যাশায়ী হয়ে পড়েননি, বেডসোর হয়ে যায়নি, সে শুধু পিসিমার জন্যে। দুই ভাইবোনে টুকটুক করতে করতে দুবেলা ছাদে উঠতেন, গাছের পরিচর্যা করতেন। বাবা সোজা-সমর্থই গেছেন। নিরামিষ ছাড়া খেতে ভালোবাসতেন না ইদানীং।

ইতু বলল, আমরা এলে কিন্তু পিসিমার মাছ-মাংস আনানো চাই।

অনু বলল, ইতু, তোর পিসিমার হাতের আলুর তরকারি মনে আছে। আর নটে শাকের চচ্চড়ি?

ইতু বলল, থাকবে না আবার! মজাটা শোন না! আমি তো আগে শাক-টাক খেতুম না! আলুও খুব একটা পছন্দ করতুম না। ওদিকে ভাগলপুরে ওদের বাড়িতে বিহারি বামুন রাঁধে। সে কি জঘন্য ধারণা করতে পারবি না। শুধু অড়র ডাল আর বেগুন-চোখা বলে ওদের নিজস্ব একটা রান্না ভালো করত। আমাদের এদিকের রান্না কিছু পারে না। আমার শাশুড়ি তো আবার অ্যাডভোকেট। এসব দিকে হুঁশ খেয়াল নেই। আমি তিন মাস পরে বাড়ি এসে পিসিমার হেঁশেলে উঁকি দিয়েছি! পিসিমা বলল, যা খেতে বসগে যা, দিচ্ছি। আমি বললুম, যা যা বেঁধেছ একটু একটু দিয়ো পিসিমা। পিসিমা বলল, নটেশাকের চচ্চড়ি তুই খাবি? আমি বললুম, জরুর। ওরে দিদি রে, বউদি রে, সে কি রান্নারে, মুখ ছেড়ে গেল একেবারে। বিকেলবেলা পিসিমা নরম সাদা সাদা পরোটা করে দিল আর আলুর তরকারি। দম নয়, তরকারি। তার কী স্বাদ!

অনু বলল, আমার শ্বশুরবাড়িতে তো ফি বছর একঝুড়ি করে খাজা যায়। আমাদের আশেপাশে তো জ্ঞাতি ভাশুর-দেওররা থাকে, তাদের ভাগ দিই। এমন হয়েছে পুজোর ষষ্ঠীর দিন থেকে ওরা সব বলতে থাকবে বউদি, বউদি, অনীতা, অনীতা এবার পিসিমা খাজা পাঠাবেন তো! এমনি হ্যাংলা!

অতীশ বলল, এ আর বেশি কথা কি! দুর্গাপুরে যখন আমার প্রথম পোস্টিং হয়, পিসিমাকে নিয়ে গিয়েছিলুম। শি সুন বিকেম আ পপুলার ফিগার। ছাত্ররা, কলিগ-রা সব আমাকে যত না চেনে, পিসিমাকে চেনে তার চেয়ে অনেক বেশি। আরে আমার পরিচয়ই হয়ে গেল পিসিমার ভাইপো, ওই খাজা গজা, মালপো, আচার আরও কী কী সব তোদের আছে! বেগতিক দেখে একদিন বললুম, পিসিমা তোমাকে আনলুম আমার খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে দূর করবার জন্য, এদিকে তুমি সারা দুর্গাপুরের খাওয়াদাওয়ার ভার নিয়ে বসে আছ? এরকম রান্না রাঁধলে তো আমাকে পথে বসতে হবে। পিসিমা হেসে বলল, কেন? কেউ খেতে চাইছে? পি আর সেন ছিল একেন্নম্বরের পেটুক, বুঝলি! ও-ই ধরেছিল। পিসিমা আমাকে অভয় দিয়ে বললে, দাঁড়া আমি দেখছি কী করা যায়। সেদিন বিকেলে পি আর সেন এসেছে, পিসিমা এক প্লেট রসবড়া দিয়ে বললে, পিনাকী, ক-দিন ধরেই বাবা খুব একটা সাধ জাগছে তোমাকে নিয়ে। পি আর সেন বলল, বলুন পিসিমা, এ ভাইপো আপনার হুকুম তামিল করতে সব সময়ে হুজুরে হাজির। বলুন, ক-বার বাজার যেতে হবে? পিসিমা বলল, তা একটু যেতে হবে বাবা। তোমার বাড়িতে আমার হাতে একদিন সবাইকে খাওয়াবে এই আমার সাধ বাবা। পি আর সেন পড়েছে এদিকে ফাঁপরে। কিন্তু এত ভালোবাসত পিসিমাকে সঙ্গে সঙ্গে পিসিমাকে কোলে তুলে নিয়ে ধেই ধেই নাচ। আমাকে এতটুকু খাটতে পর্যন্ত হয়নি। ক্যামপাসসুদ্ধ কলিগ-কে খাইয়েছিল পিসিমার হাতে। ধন্য ধন্য রব চারদিকে।

দীপু বলল, পিসিমা তো তা হলে বুদ্ধিও ধরে খুব। আই কিউ টেস্ট করলে নিশ্চয় অ্যাবভ অ্যাভারেজ হবে।

অনীশ বলল, তা তো হতেই পারে। মারই তো দেখেছি কী ভীষণ স্মৃতিশক্তি, যে-কোনো ঘটনার সাল তারিখ অবিকল বলে দিতে পারত। কবে ইতু কী মজার কথা বলেছিল, রন্টু কোথা থেকে এশিয়াটিক কলেরা নিয়ে এল, আমার বন্ধুরা আড্ডা মারতে মারতে মাকে কবে কি বলেছিল, সব মা মুখস্ত বলে দিত। সাংঘাতিক মেধা। আমাদের দেশের অনেক বয়স্ক লোকের মধ্যেই এটা পাবি। অরিজিন্যাল ব্রেন পাওয়ারটা যাবে কোথায় বল? তা পিসিমা এখন কোথায়?

একটু শুতে পাঠিয়েছি জোর করে, অনু ইতু বলল।

অনীশ বলল, একটা খুব জরুরি কথা আছে, এখনই সেটা সেরে নেওয়া ভালো। জামাইরাও সব থাকলে ভালো হত। যাক সে, নেই যখন আমাদের নিজেদের মধ্যেই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।

অনীশের গম্ভীর গলা শুনে অনু ঘাবড়ে গিয়েছিল, বলল, অত সিরিয়াস কেন রে দাদা, একটু হাসিমুখে যা বলবি বল না বাবা! তোর রকম দেখে আমার বুক ধড়ফড় করছে!

অনীশ গলা খাটো করে বলল, এই এত বড়ো বাড়িখানাতে পিসিমা এখন একেবারে একা হয়ে গেল, এটা কেউ খেয়াল করেছ? একদম একলা। তিয়াত্তর বছরের একজন বৃদ্ধাকে এইভাবে রাখা ঠিক কি না তোমরা বলো!

দীপু বলল, তাই তো! তা হলে! একটা বিশ্বাসী লোক পর্যন্ত নেই।

অতীশ বলল, বিশ্বাসী লোকের কথা ছাড়ো। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী কোনো লোকের হাতেই এত বড়ো বাড়ি এবং একজন বৃদ্ধাকে ছেড়ে রাখা যায় না। একমাত্র উপায় আমাদের কেউ সঙ্গে থাকা। অনু, তুই পারবি!

অনু বা অনীতা বালিগঞ্জ প্লেসে থাকে। স্বামীর নিজস্ব অডিটার্স ফার্ম। সেটা গড়িয়ার দিকে। বাড়িতে শ্বশুরশাশুড়িও আছেন। অনীতা বলল, আমি আসা-যাওয়া করতে পারি। কিন্তু এসে থাকা ইমপসিবল। আমার শ্বশুরেরও চুয়াত্তর হল। শাশুড়ির ঊনসত্তর। তাঁদেরও তো আমাকে চব্বিশ ঘন্টাই দেখতে হয়। শাম্পি মাম্পি মর্ডানে পড়ে। কত কষ্ট করে, কত কাঠ খড়-পুড়িয়ে ওদের ভর্তি করা!

অনীশ বলল, অনুই একমাত্র কলকাতায় থাকে। তারই যখন এসে থাকবার প্রশ্ন উঠছে না, তখন অন্যদের তো কথাই নেই। তা হলে উপায় পিসিমাকেই নিয়ে যাওয়া। আমার দ্যাখ অনিশ্চিত অবস্থা। তিন বছর হয়ে এল, যে-কোনো জায়গার যে-কোনো মুহূর্তে বদলি হয়ে যেতে পারি। যেখানেই যাই, বড়ো কোয়াটার্স পাব। সবই ঠিক। কিন্তু আমাকে সবসময়ে ডেঞ্জার জোন-এ থাকতে হয়, যেতে হয়। রাইকেই আমি হস্টেলে রাখি। প্রতিমাকেও অন্যত্র রাখলে ভালো হয়, তার ওপর পিসিমার মতো একজন পরনির্ভরশীল বৃদ্ধাকে নিয়ে গেলে আমার কিংবা প্রতিমার এক হপ্তার মধ্যে দুশ্চিন্তায় স্ট্রোক হয়ে যাবে। রন্টু তুই কি বলিস!

অতীশ বলল, তুমি তো জানোই দাদা, মাস তিনেকের মধ্যে আমার জার্মানি যাবার কথা। কিষণকে বোর্ডিং-এ রেখে, শুক্লাকেও নিয়ে যাব ভেবেছি। স্ত্রী অ্যালাউড। এরকম সুযোগ ওর জীবনে দু-বার আসবে না। পিসিমাকে নিয়ে গেলে তো সেটা সম্ভব নয়! দীপু তুই তো পারিস? অনু ইতু দু-জনেরই শ্বশুরশাশুড়ি রয়েছেন, অন্যান্য আত্মীয় পরিজনও রয়েছে। তাদের মাঝখানে পিসিমাকে নিয়ে যাওয়াটা তো ঠিক যুক্তিযুক্ত হবে না!

দীপু আমতা আমতা করে বলল, ও নেই। ওর মত না নিয়ে তো আমি কিছু বলতে পারি না। তা ছাড়া ও সাংঘাতিক রাগি মানুষ। এটা আমি লুকোছাপা করি না। তোমাদেরই জামাই, তোমরাই দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছ। যেকালে তোমাদের জামাইয়ের পান থেকে চুন খসলে রইরই কাণ্ড হয়, সেকালে তার অনুমতি না নিয়ে পিসিমাকে তার সংসারে নিয়ে যাবার সাহস আমার নেই। তা ছাড়া আমি জানি, অনুমতি সে দেবে না, বাড়িতে থার্ড পার্সন তার একদমই পছন্দ নয়।

অনীশ হতাশ হয়ে বলল, তা হলে?

অতীশ বলল, তা হলে একটাই উপায় বাকি রইল। অনেক ভালো ভালো বৃদ্ধাবাসে হয়েছে আজকাল। তারই একটাতে দেখেশুনে নিয়ে দাও।

অনীশ বলল, বাড়ি? বা

ড়ি বিক্রি করে আমরা পাঁচজনে ভাগ করে নেব, শ্রীরামপুরে তো আর কেউ থাকতে আসছে না। আমি দুর্গাপুরেই জমি কিনেছি। বাড়িটা তা হলে আরম্ভ করে দিতে পারি, এ-বাড়ি বিক্রির টাকাটা পেলে।

অনীশ চিন্তিত মুখে বলল, বাড়ি তো সত্যিই আমারও দরকার। আমি হয়তো শেষ পর্যন্ত দিল্লিতেই সেটল করব। টাকাটা পেলে আমারও সুবিধে হয়। তবে পাঁচ ভাগ করে আর শেষ পর্যন্ত কী বা থাকবে?

দীপু অনু নীরবে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। দীপু বলল, ভাগ ছেড়ে দেওয়ার কথা যদি বলো, তা হলে তোমাদের জামাইদের উপস্থিতি দরকার।

অতীশ বলল, বাজে বকিসনি। বাড়ির ভাগ থাকলে তোদেরই থাকবে। জামাইদের তো আর ভাগ নয়। যা বলবার তোরা অনায়াসেই বলতে পারিস।

ইতু বলল, শ্বশুরবাড়ির হাত তোলা হয়ে থাকি। পাঁচ ভূতের বাড়ি। ওর পর্যন্ত রোজগারের পাইপয়সা শ্বশুরের হাতে তুলে দিতে হয়। হাতে নিজস্ব টাকা না থাকার কী কষ্ট সে আমিই জানি।

অনু বলল, যা বলেছিস। আমারও সেই এক কথা। চাবি শাশুড়ির কাছে, কর্তৃত্ব তাঁর, খাটুনি আমার। কখনো যদি হাতখরচ কিছু দিল তো তার ডেবিট-ক্রেডিট দাখিল করো, জার্নাল মেনটেন করো। বাব্বাঃ।

দীপু বলল, দেখো বড়দা-মেজদা ভদ্রেশ্বরের বাড়ি ওদের পৈতৃক। সাত ভাইয়ের ভাগ। বুঝতেই পারছ কী অবস্থা। তিন ভাই বাইরে থাকে। বাকি চার ভাই ভদ্রাসন কামড়ে পড়ে আছে। এদিকে এলেও তো বরাবর আমি বাবার কাছে উঠি। শ্বশুরবাড়ির ভাগ পেয়ে তাতে জমি কিনে বাড়ি তুলতে হলে আমাকে এক জন্ম ঘুরে আসতে হবে। এ বাড়ির ভাগের টাকাটা পাই তো আসানসোলে হোক, ভদ্রেশ্বরে হোক, যেখানে তোক একটা মাথা গোঁজার আস্তানা করার কথা ভাবতে পারি।

অনীশ বলল, ঠিক আছে। ঠিক আছে। তবে ওই কথাই রইল। সবাই বৃদ্ধাবাসের খোঁজ করতে থাকো, আমি আর দিন সাতেক আছি, এরই মধ্যে যা হয় ব্যবস্থা করতে হবে।

এই সময়ে দরজায় শব্দ হল। পিসিমার কদমফুল মাথাটি দেখা গেল, তিনি দরজাটা হাট করে খুলে দিয়ে বললেন, দীনু আয় বাবা, এখানে আমার চাঁদের হাট বসেছে। বড়ো বউমা ধন আমার, দীনুর ট্রে থেকে চা-গুলো সব ঢেলে ঢেলে তুলে তুলে দাও তো মা!

প্রতিমা, ইতু দুজনেই উঠে পড়ল। প্রতিমা চা ঢালছে, আর ইতু কাপগুলো এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে। দিতে দিতে ইতু বলল, এ কী পিসিমা, মাছভাজা, পাপড়ভাজা এসব কী কাণ্ড? পানতুয়া! দুপুরের অত খাওয়ার পর!

পিসিমা বললেন, তুই থাম তো মুখপুড়ি। লুচির ফোসকা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তুই মড়ার দড়া হয়ে থাকবি তো থাক। দুপুরে গাঁই গোত্তর সব খাইয়ে তোরা কতটুকু দাঁতে কেটেছিস যেন আমি দেখিনি! ঠাকুরকে সব মাছ কালিয়া দিতে দিইনি। এখন সব খা, গরম গরম ভালো করে খা। মন্টু খবর্দার না বলবি না, মেজবউমা, তুমি রন্টু ধনকে জোর করে খাইয়ে দাও তো, তুমি বললে কেমন না খায় দেখি। …দীপু মানিক, ছেলের দৌরাত্মে দুপুরে কিছু খাওনি মা আমি দেখেছি।

অনু বলল, আমায় ধন মানিক কিছু বললে না পিসিমা, খেতেও বললে না। আমি খাব না যাও। পেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, না?

পিসিমা একমুখ হেসে বললেন, তোকে যে আমি কোলে বসিয়ে খাইয়ে দেব মা। তোর যে আলাদা খাতির! শিবঠাকুরের তো লক্ষ্মী সরস্বতী আছেই, কিন্তু তাঁর একদম নিজের নিজস্ব কন্যেটি যে মা মনসা, তার জায়গা যে ঠাকুরের একবারে কোলে-কাঁখে!

সত্যিই, অনু হবার সময়ে তার মা যায়-যায় হয়েছিলেন। অনেক দিন খাওয়ানোদাওয়ানো তো দূরের কথা, একটু কোলে করাও তাঁর বারণ ছিল। অনুকে পিসিমাই একরকম বড়ো করেছেন।

শুক্লা বলল, পিসিমা বসুন না, এই যে মোড়াটাতে বসুন।

তা বসব বইকি, পিসিমা বললেন, এমন জমজমে আনন্দমেলা বসেছে, দেখব? দুটো চোখ যখন ভগবান এখনও রেখেছেন তখন দেখে সাধ পুন্ন করি।

অতীশ বলল, বাবার শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গ উপলক্ষ্যে এই জমায়েত। একে তুমি আনন্দমেলা বলছ পিসিমা?

বলব না তো কি! দাদা নিজেও ওপর থেকে দেখে দেখে ঠিক এই কথাই বলছে যে রে, বউদির সঙ্গে হাসতে হাসতে বলছে। আমরা না মলে যে তোরা একত্তর হস না বাবা। সে বেশ গেছে। ভগবান করুন আমিও যেন এমনি যেতে পারি। তখনও তোরা এমনি মেলা বসাবি, আমোদ আহ্লাদ করবি। খুনসুটি করবি…..।

পিসিমা আঁচলের খুঁট নিয়ে চোখের জল মুছলেন।

দিন তিনেক পরে খোঁজখবর করে অতীশ এসে অনীশকে বলল, দাদা একটা ভীষণ মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

কেন রে?

বৃদ্ধাবাস ইজ অল রাইট। কিন্তু ভালোগুলো সবই বেশ মোটা টাকা চায়। কয়েকটা তো আবার প্রথমেই হোক টাকা জমা রাখতে বলছে।

তুই মিশনারিদেরগুলো খোঁজ করেছিলি?

করেছি, কিন্তু পিসিমার স্ট্রিকট ব্রাহ্মিনিজম তো জানিসই। মিশনারি প্রতিষ্ঠানে রাখলে শেষে অন্নজল না ত্যাগ করে।

ভাবালে। অনীশ চিন্তিত মুখে বলল, দেখি আমার সোর্সগুলো ট্যাপ করে দেখি।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনুর বর রঞ্জিত খবর আনল একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের। পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি হিন্দুই। তবে সব জাতের বৃদ্ধ বৃদ্ধাই তারা রাখে, একেবারে বিনা পয়সায়। জায়গাটা শেয়ালদা লাইনে, একদিন অনীশ অতীশ, রঞ্জিতকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এল। ভালোই মনে হচ্ছে। বহু বড়ো বড়ো লোকের গোপন ডোনেশন আছে, ওরা কিছু নেয় না। নেহাত পীড়াপীড়ি করলে হয়তো ভোনেশন কিছু নিতে পারে। পিসিমার কাছে তারপর ভাঙা হল কথাটা।

দীপু বলল, পিসিমা, তুমি এখন কি করবে?

কীসের কী রে?

না মানে কোথায় থাকবে? কীভাবে? সে কথা কিছু ভেবেছ?

ছেলেমেয়েরা সবাই উপস্থিত। পিসিমা অবাক চোখে চেয়ে বললেন, একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ-পাঁচটা ছেলেমেয়ে আমার। তিয়াত্তর বছর বয়সে আমার ভাবনা আমি ভাবব?।

ছেলেমেয়ে সকলেই চুপ করে রয়েছে। অতীশই শেষে বলল, ঠিক আছে। তোমার ভাবনা আমরা ভাবব তো? ভাবতে দিচ্ছ তা হলে! শোনো তবে, তোমার জন্যে শ্যামনগরে একটা খুব ভালো প্রতিষ্ঠান দেখা হয়েছে। সেখানেই তুমি থাকবে। ওরাই তোমার দেখাশোনা করবে। আমরা যে যখন পারি মাঝমধ্যেই যাব, দেখে আসব। হিন্দুদের জায়গা পুরোপুরি, কেরেস্তান-টান, ম্লেচ্ছ-টেচ্ছ ব্যাপার নয়, তুমি নিজের মতো থাকতে পারবে।

পিসিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। বিস্ময়ে তাঁর মাথা থেকে ঘোমটা খসে পড়েছে। হাবলা মুখে তিনি বললেন, পতিষ্ঠান? পতিষ্ঠান আমার কী করবে রন্টু? এ বাড়িতে, এই ড্যাস গল-এ আমি থাকতে পাব না? বাড়িটার নাম গ্রেস ডেল। পিসিমা বরাবর উলটোপালটা বলে এসেছেন। ওই উলটোপালটা নামটাই তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়।

অপ্রস্তুত মুখে অতীশ বলল, থাকতে পাবে না কেন? কিন্তু এখানে কে তোমার দেখাশোনা করবে? সেটাই তো হচ্ছে মুশকিল। বয়সটা তো তোমার বাড়ছে? না কমছে! এত বড়ো বাড়ি দেখাশোনা পরিচ্ছন্ন রাখা চাট্টিখানি কথা না কি? সেরকম বিশ্বাসী লোকই বা কই?

কেন রন্টু, দীনু রইল। তোরা মাস গেলে দুশো একশো যে যা পারিস দিতিস, বাবা থাকতে যেমন দিচ্ছিলি! আমার ভেসে যেত। তোরা এদিকে এলে সব আমার কাছে আসবি। খাবি, থাকবি।

তারপর তোমার অসুখবিসুখ করলে?

আমার কিচ্ছু হবে না ধন। ভগবানের আশীর্বাদে আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাব। দীনুও রইল।

দীনুকে আমরা অতটা বিশ্বাস বা নির্ভর করতে পারছি না পিসিমা। ফসল কাটার সময় হলেই তো ও দেশে চলে যাবে, দু মাস তিন মাস বেপাত্তা। শেষকালে দেখবে এ বাড়ি জবরদখল হয়ে যাবে। ওই দীনুই সাহায্য করবে তাদের।

তা হলে?

তা হলে যা বললুম, খুব সুন্দর জায়গায় থাকবে তুমি, আমি জার্মানি থেকে ফিরে তোমায় নিয়ে যাব যখন, দাদার সুবিধে হলে দাদাও নিয়ে যাবে। আপাতত তো এ ছাড়া অন্য উপায় দেখছি না।

পিসিমা কিছু বললেন না। অনীশ-অতীশের কাজ ছিল। বেরিয়ে গেল। বাইরে বাড়ির দালাল। ওদিকে মিউনিসিপ্যালিটিতে যেতে হবে, মিউটেশনের জন্য কী কী করা দরকার…। সবই তো এই ক-দিনের মধ্যে! প্রতিমা রাইকে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছে। তার মেয়ের মাথায় ঈষৎ সোনালি চুল, টকটকে রঙ, সুন্দরী না হলেও জৌলুস-অলা চেহারা। সে মিরান্দা হাউজে পড়ে। শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে এসে সেই ছোট্ট এতটুকু রাইকে এত বড়ো, এত সুন্দর দেখে পাড়ার অনেকেই মুগ্ধ। তাদেরই অনুরোধে এই সামাজিক নিয়মরক্ষা। শুক্লা কিছুক্ষণ বসেছিল, হঠাৎ মনে হল কিষণকে অনেকক্ষণ দেখেনি, কে জানে বুবুল দুরন্ত ছেলে তার সঙ্গে মিলে কি বদবুদ্ধি করছে! সে কিষণ কিষণটা কোথায় গেল বলতে বলতে উঠে গেল। দীপু বসে বসে নখ খুঁটছিল, তিন বোনে সামান্য আগে পরে পিসিমার ঘর থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে গেল। পিসিমা ছোটো মোড়ার ওপর বসেই রইলেন, বসেই রইলেন। তাঁর মুখের ওপর দিয়েই সন্ধে গড়াল, রাত হল। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পিসিমার দশটি বছর বয়স বেড়ে গেল।

সইসাবুদ শেষ হলে দীপিকা বলল, আচ্ছা মাতাজি, আপনাদের ভিজিটিং-ডে এবং আওয়ারগুলো আমাদের একটু বলে দেবেন, নোট করে নিই।

মাতাজি মুখ তুলে বললেন, দেখুন, আপনারা একটু ভুল করছেন। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের তিনকুলে কেউ নেই দেখাশোনা করার বা আর্থিক দায়িত্ব বহন করার। কাজেই আমাদের ওসব ভিজিটিং আওয়ার-টাওয়ারও নেই।

অনীতা হাঁ করে বলল, ভিজিটিং আওয়ার নেই!

না, আপন বলতে যাদের কেউ নেই, তাদেরই একমাত্র এখানে রাখা হয়।

অনীতা সামলে নিয়ে বলল, তা অবশ্য সত্যি দিদি, পিসিমার তো যাকে বলে আপন, তেমন কেউ নেই। ছেলে না, মেয়ে না। নাত-নাতনি কেউ না।

দীপু বলল, আমরা তো যাকে বলে নিষ্পর। পরস্য পর। পিসিমা তো আবার বাবার সতাত বোন, জানিস তো!

ইতু বলল, মা বেঁচে থাকতে আমরা কেউ জানতেই পারিনি কথাটা।

অনু বলল, মায়ের বাহাদুরি আছে, হাজার হোক পরের বাড়ির মেয়ে তো!

দীপু বলল, বাবারও বাহাদুরি।

এইখানেই এ কাহিনি শেষ হয়ে যেত। হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু হল না। একদিন গভীর রাত্তিরে ঘুমাতে ঘুমোতে দীপু হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। শব্দে জেগে উঠেছে অসমঞ্জ, তার রাগি স্বামী। ওদিকে দামাল ছেলেও। অসমঞ্জু বললে, আরে মাঝরাত্তিরে এরকম মড়াকান্না জুড়লে কেন? হয়েছেটা কী?

দীপু বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদছে আর বলছে, পিসিমাকে তুমি আমার কাছে রাখতে দেবে কি না বলো, আগে বলো। আমি সারাটা জীবন তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকব। অন হবার পর আমি খেতম না পিসিমা খাইয়ে না দিলে, পিসিমার বুকে হাত রেখে মা মনে করে ঘুমোতুম। সেই পিসিমাকে…..। উ! ওগো, পিসিমা না থাকলে আমি মরে যেতুম। পুঁয়ে পাওয়া হয়ে গিয়েছিলুম। তুমি আমার পেতেই না। অন্য কোনো রা কুসি এসে তোমার এ সংসার সাজাত!

অসমঞ্জ বললে, মাঝরাত্তিরে তুমি এ কী আরম্ভ করলে? পিসিমাকে তুমি তোমার কাছে এনে রাখতে চাও এ কথা তো আগে বলোনি!

বলব কি? তোমার যা মেজাজ, তোমাকে আমি হিটলারের চেয়েও ভয় পাই।

তা হলে আর আমায় বলা কেন। পিসিমা এলে তো চমৎকার হয়, রান্নাবান্নায় তো তিনি একাই একশো। যাও যাও নিয়ে এসো গে, রোজ রোজ আর আমায় নুন কম, মিষ্টি বেশি, আধসেদ্ধ খেতে হবে না। এই জন্যে এত কান্না!

যদি তোমার মা কিছু বলেন?

বলবেন তো ভদ্রেশ্বরে। এখানে তো সে কথা আমাদের কানে আসছে না। আর বলবেন আমার মা বলবেন, সে আমি বুঝব। ওহ তোমরা মেয়েরা না একেন্নম্বরের কুচুটে।

কুচুটে নয় গো কুচুটে নয়, ভিতু। ভিতু।

আচ্ছা তাই তো তাই। এখন ঘুমোও দিকি!

স্টেশনেই অনুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দীপুর। এখন ওদের পাঁচজনের কাছেই শ্রীরামপুরের বাড়ির চাবি ভেতরের কোল্যাপসিবল গেটের। বাইরে দরজার চাবি দীনুর কাছে। যতদিন না বাড়ি বিক্রিবাট্টা হয়, সে-ই কেয়ারটেকার।

অনু অবাক হয়ে বলল, দিদি তুই?

দীপু বলল, অনু তুই?

অনুর চোখ ছলছল করছে। বলল, কাল রাতে স্বপ্ন দেখছি একটা খুব রোগা না-খেতে পাওয়া বেড়ালছানা, তাকে শাম্পি পাঁচিলের ওপাশে ফেলে দিচ্ছে, হঠাৎ বেড়ালটা মিউ মিউ করে ডেকে উঠল করুণ স্বরে। তার পরেই দেখলুম সেটা বেড়াল নয়, পিসিমা। দিদিরে, আমি পিসিমাকে বৃদ্ধাবাসে ফেলে রেখে থাকতে পারব না। ভগবান তা হলে কখনো আমাকে মাপ করবেন না। মায়ের সূতিকার সময়ে পিসিমাই তো আমায় বাঁচিয়েছে। পিসিমাই আমার আসল মা। অনু কেঁদে ফেলল।

দুই বোনে এক রিকশায় মনের কথা বলাবলি করতে করতে বাড়ি চলল। দীপু বলল—তোর অসমঞ্জদাকে আমি সত্যি বলছি অনু এত দিন শুধু ভয়ই করে এসেছি। মারাত্মক ভয়। মোজা রিপু নেই, ছুড়ে ফেলে দিল, ডালে নুন নেই, ছুড়ে ফেলে দিল, বুবুলের স্কুল থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল, আসতে দেরি হয়েছে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল। বাপরে! সেই লোক! আজ এই প্রথম ওকে শ্রদ্ধা করলুম, ভালোও বাসলুম বলতে পারিস।

অনু বলল, অনেক ভেবে ঠিক করলুম, যতদিন না বাড়ি বিক্রি হয় আমি এসে থাকব। দ্যাখ, এতদিন আমি শাশুড়ির ছেলেকে দেখেছি, কিছুদিন উনি আমার মেয়েদের দেখুন। শাম্পি-মাম্পি শুক্রবার রাতে এ বাড়ি চলে আসবে, রবিবার আবার বাবার সঙ্গে চলে যাবে। ওদেরও একটু আত্মনির্ভরশীল হওয়া ভালো, এইট তো হল। তারপর বাড়ি বিক্রি হলে, আমার ভাগটা দিয়ে আমি পিসিমাকে আমাদের বাড়ির খুব কাছে, একটা মাদ্রাজি পরিবারে পেয়িংগেস্ট রাখব। পেয়িংগেস্ট মানে-মেজানিন ঘর, একট রান্নাঘর, বাথরুম ওরা দেয়, পিসিমা নিজের রান্না নিজেই করে নেবে। পিসিমার সুন্দর কুলিয়ে যাবে। আমি তো সব সময়ে দেখাশোনা করতে পারবই।

শ্রীরামপুরের বাড়ির দরজা খুলে দিল অতীশ স্বয়ং। খুলেই অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার রে? তোরা জয়া-বিজয়া কোত্থেকে?

মেজদা তুই?

আরে, আর বলিসনি, দুর্গাপুরে পৌঁছে থেকে শুক্লা গুম হয়ে আছে। কাল মহা কান্নাকাটি জুড়ে দিল। বলে, আমি জার্মানি যাবো না। ভাগ্যে থাকলে আমার হবে। না থাকলে না-ই হল, আমি অমন ফরেন-হ্যাংলা নই। তুমি ঘুরে এসো। পিসিমা আর কিষণকে নিয়ে আমি থাকব এখানে। তার পরে আবার আরেক কাণ্ড।

কি কাণ্ড?

আয়, ভেতরে আয়, দেখাচ্ছি।

ভেতরে যেতে যেতে অনীশ চেঁচিয়ে বলল, দীনু ভালো করে কাঁচা তেজপাতা ভিজিয়ে চা কর। একটা তরকারি কিছু চড়িয়ে দে। দিদিরা দুজন এসেছে।

দীনু এসে বলল, টাকা দিন কিছু, বাজার আনি। কেরোসিনেরও ভাঁড়ে মা ভবানী। সে-ও কিনতে হবে।

দুম করে লোডশেডিং হয়ে গেল। উঠোনে শ্যাওলা, তুলসী গাছটা বিরাট ঝাড় হয়ে উঠেছে, তাকে আর ঠাকুর-দেবতা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে উড়নচণ্ডী রাক্ষুসি।

অতীশ বলল, সাবধানে বাথরুমে যাস দীপু, উঠোনটা একেবারে… আমি তো পড়ে গিয়ে যা কেলো…উঃ।

দীনু বলল, পিসিমা থাকলে এসব কিছু ভাবতে হত না, দাদা। অন্নপুন্নোর ভাণ্ডার। বাড়িতে লক্ষ্মী অষ্টপহর জ্বল জ্বল করছেন। শ্যাওলা উঠোন, আঁধার-বাড়ি এ আমি আমার জন্মে কখনও দেখিনিকো।

অতীশ ধমক দিয়ে বলল, যা যা তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর। বেশি আর লেকচার দিসনি। তোর আবার জন্ম। এ বাড়িতে কদিন আছিস? পাঁচ বছর না সাত বছর?

দীনু বলল, যাঁহা পাঁচ তাঁহাই সাত, ধরুন না গিয়ে দাদাবাবু।

আলো এলে একটা টেলিগ্রাম, আর একটা কিউ এম এস লেখা অন্তর্দেশীয় পত্র অতীশ দু বোনের হাতে তুলে দিল।

টেলিগ্রামটা অনীশের। অতীশের দুর্গাপুরের ঠিাকানায় করা।

অ্যাম ট্রানসফার্ড টু ডেলহি। সেন্ড পিসিমা শার্প বাই দা নেক্সট রাজধানী। অ্যাওয়েটিং ইনফর্মেশন—দাদা।

ইতুর চিঠিটাও দুর্গাপুরের ঠিকানায়। লিখেছে অতীশ-শুক্লাকে।

প্রিয়, মেজদা-মেজবউদি,

পিসিমাকে বৃদ্ধাবাসে পাঠবার প্রস্তাবটা আমাদের গোড়ার থেকেই ভালো লাগেনি। কিন্তু আমি একে সবার ছোটো, তার পরে শ্বশুরবাড়িতে পরিজনও অনেক। তোমাদের জামাই একে মুখচোরা, তায় সেও বাড়িতে সবার ছোটো। আমার পক্ষে পিসিমার কোনো ব্যবস্থা করা নিতান্তই অসম্ভব। কিন্তু যখন থেকে শুনেছি পিসিমাকে এমন জায়গায় রাখা হয়েছে যেখানে দেখতে যাবার পর্যন্ত অনুমতি দেয় না, তখন থেকেই আমার প্রাণ কাঁদছে। এখানে এসে তোমাদের জামাইয়ের সঙ্গে অনেক আলোচনার পর একটা লিগ্যাল পয়েন্ট আবিষ্কার করলুম। পিসিমা বাবার সৎ-বোন হলেও, একই বাবার সন্তান। এবং শ্রীরামপুরের—গ্রেস ডেল বাড়ি বাবা একটু-আধটু বাড়ালেও ঠাকুর্দারই করা। সেই হিসেবে কিন্তু বাড়ির অর্ধভাগ পিসিমার প্রাপ্য হয়। বাকি অধভাগকে পাঁচ ভাগ করে আমরা পাঁচ ভাইবোন নিতে পারি। সেক্ষেত্রে পিসিমাকে আমরা যতটা অসহায় মনে করছি ততটা তিনি নন। বাড়ি বেচে হয় তোমরা পিসিমাকে তাঁর প্রাপ্য টাকায় একটা যথার্থ ভালো প্রতিষ্ঠানে রাখো, যেখানে তাঁকে আমরা দেখতে যেতে পারব, এবং প্রয়োজন হলে নিজেদের কাছে এনে রাখতে পারব। আর তা যদি না হয়, পিসিমা অবলা বলে তাঁকে যদি তোমরা বঞ্চিতই কর, তা হলে আমার ভাগটা আমি দিয়ে দিচ্ছি, তা দিয়েও পিসিমার অনুরূপ ব্যবস্থা হতে পারে। সাত কাঠার কাছে ভদ্রাসন আমাদের। পাঁচ ভাগের এক ভাগ তো লাখখানেক টাকা হবেই! ভালোবাসা জেনো।

ইতি
তোমাদের ইতু

চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে দীপু বলল, সত্যিই তো, মেজদা আজকালকার আইনে পিসিমারও তো একটা ভাগ থাকার কথা। এটা তো আমাদের কারো মনে হয়নি। তোর হয়েছিল?

অতীশ বলল, অনেস্টলি বলছি দীপু হয়নি।

বহু রাত পর্যন্ত তিনজনে পরামর্শ হল। মাঝে দীনু দোকান থেকে অখাদ্য রুটি তড়কা এনে দিল। কেরোসিন পাওয়া যায়নি। চারজনের রান্নায় দীনুর খুব একটা উৎসাহও দেখা গেল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল অবিলম্বে পিসিমাকে আশা নিকেতন থেকে নিয়ে আসা। শ্রীরামপুরের বাড়ি বিক্রির চেষ্টা আপাতত বন্ধ থাক। পিসিমা যতদিন আছেন বাড়ি ভোগ করুন, দীনু থাকবে, দরকার হলে আর একটি লোকও রাখা হবে, ঠিকে। অনু দেখাশোনা করবে। শনি-রবিবার এসে থাকবে। পরে পিসিমার মৃত্যু হলে যা হয় ব্যবস্থা করা হবে।

পরদিন সকালে তিন ভাইবোন নতুন ব্যবস্থার কথা জানিয়ে অনীশ এবং ইতুকে টেলিগ্রাম করে শেয়ালদা চলল।

ট্রেন চলেছে। তিন ভাই বোন অধৈর্য হয়ে স্টেশনের নাম পড়ছে।

অতীশ বলল, দ্যাখ। সত্যিই আমাদের অ্যাকচুয়ালি মা-বাবা আর পিসিমাতে কোনো তফাত নেই। মা-বাবা কোনোদিন করেননি।

দীপু বলল, একটু লেটে বুঝলি মেজদা। পিসিমার মধ্যে আমরা বাবার রক্ত আর মায়ের স্নেহ পেয়েছিলুম।

অনু বলল, মা কীভাবে দিদিমণি বলে ডাকত, সে ডাকটা তোর মনে আছে? বালবিধবা বলে বাবা-মা যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে পিসিমাকে আগলে রাখত।

দীপু বলল, আমি আগেরবার বাবাকে বলতে শুনেছি–রুচি তুই আমার আগে যাস। পিসিমা বলছে, অমন কতাও বোলো না দাদা, তুমি আগে যাও, পরে আমি আসছি। আমি গেলে তোমায় দেখবে কে?_আমি গেলেই বা তোকে দেখবে কে শুনি? বাবা বলল। পিসিমা বলল, আমার কথা ছেড়ে দাও। একটু, এই এতটুকুটি হলেও মেয়েমানুষের ভেসে যায়…

আশা-নিকেতনে এখন যিনি তত্ত্বাধানে আছেন, সেই মাতাজি আগের জন নন। হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না। সেই একই রকম সাদা কাপড়, কানের পাশ দিয়ে ঘোমটা দিয়ে পরা। সব কথা মন দিয়ে শুনে বললেন, দেখুন, আপনারা খুব ভুল, খুব অন্যায় করেছেন। আমাদের এখানে আত্মীয়-পরিজনহীন মানুষ ছাড়া নেওয়া হয় না। সমাজের নিয়ম হল পরস্পর পরস্পরকে দেখা। যাঁর দেখবার লোক আছে তিনি কেন দাতব্য-প্রতিষ্ঠানে আসবেন। তাঁর দেখাশোনা যেমন করেই হোক, তার নিকটজনদের নৈতিক দায়িত্ব। কেন আপনারা রেখেছিলেন ওঁকে? বিপদটা কি জানেন? সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। শুধু বৃদ্ধ বৃদ্ধা নয়, সর্ব অর্থে অনাথ যারা তাদেরই ব্যবস্থা এখানে করা হয়, আমাদের সাধ্যমত। প্রত্যেককে কিছুটা শ্রমও দিতে হয়। আবাসিকদের আমরা দীর্ঘ দিন এক জায়গায় রাখি না। কয়েক মাস অন্তর অন্তর স্থান বদল করাই। এই আমাদের নিয়ম। এবং তাঁদের কোনো ঠিকানা নিই না। নাম নিই না। একটা নম্বরের পাশে, তাঁদের এখানে নতুন নামকরণ হয়। পুরোনো পরিচয় মুছে ফেলে তাঁরা যাতে নতুন জীবন লাভ করতে পারেন, তারই চেষ্টা করি। তবে আমার যতদূর মনে পড়ছে, সম্প্রতি এখান থেকে ওরকম স্থানবদল হয়নি। আপনাদের দেওয়া এই রুচিশীলা ভট্টাচার্য, নাম আমরা ভেতরে গিয়ে বলতে পারব না। আমাদের নাম আলো, সলিল, বহ্নি, বরুণ, পবন, আগুন—এইসব। কে যে এঁদের মধ্যে রুচিদেবী তা জানি না, জানাতেও পারি না।

অনুকে কাঁদতে দেখে, মাতাজি বললেন, ঠিক আছে, আপনাদের জন্য আমি একটা কাজ করছি। এ ঘরে আপনারা বসুন, ঘরটা আমি অন্ধকার করে দিচ্ছি। ওদিকের চৌকো জানলাটা দেখছেন, ওর পেছনে দালান। ওই দালান দিয়ে আমি মহিলা আবাসিকদের পাস করাব। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এইভাবে আপনারা গুনবেন। ঠিকজনকে চিনে নেবেন, তারপরে আমি ওঁকে আনিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি।

বাইরের জানলাগুলো বন্ধ করে দিলেন মাতাজি। ভেতরের জানলাটা খুলে দিয়ে চলে গেলেন।

একটু পরে জানলার ওপাশে আইডেনটিটি প্যারেড শুরু হল। প্রথম জন, মাথার চুল কদম ছাঁট, সাদা কালো, মুখ ঈষৎ কুঁচকোনো, না কালো না ফর্সা। দ্বিতীয় জন—মাথার চুল ঘাড় অবধি সাদা-কালো, কুঁচকানো মুখ, না কালো, না ফর্সা। তৃতীয় জন মাথার চুল কদমছাঁট সাদা, কুচকোনো মুখ, না ফর্সা, না কালো। এইভাবে তেরোজন হয়ে গেল, শোভাযাত্রা থামল। একটু পরে মাতাজি ঘরে ঢুকে বললেন, দেখছেন? বলুন কোনুজন?

দীপু বলল, কে আবার! প্রথম জন!

অতীশ বলল, যাঃ, তৃতীয় জন। চুলগুলো একেবারে পেকে গেছে বলে বুঝতে পারিসনি।

অনু বলল, আমি শিওর পঞ্চম জন।

মাতাজি বললেন, সে কি? আপনাদের আপনজন, পিসিমা বলছেন, চিনতে পারছেন না? আচ্ছা আমি এই তিনজনকেই আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করে আসছি তিনি রুচিশীলা দেবী কিনা। যদিও, আবার বলছি—এটা আমাদের নিয়ম নয়।

পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে মাতাজি বললেন, ওঁদের কারুর নামই রুচিশীলা নয়। প্রথমজনের নাম জানকিবাই-উনি বিহারি। তৃতীয় জন ফতিমা বেগম বুঝতেই পারছেন বাঙালি মুসলমান। আর পঞ্চম জনের নাম শুদু বুঢ়িয়া, ও একটি ভিখারি-বস্তিতে থাকত, কখনও নামকরণ হয়নি, হয়ে থাকলেও ভুলে গেছে, ওকে আমরা ধরিত্রী বলে ডাকি। আপনারা এক কাজ করুন, আপনাদের পিসিমার একটা সাম্প্রতিক ফটো, তাঁর চেহারার সঠিক বর্ণনা, আর কিছু আইডেনটিফাইং মার্ক দিন। তারপর দেখছি কী করা যায়।

তখন অতীশ, দীপু ও অনু নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা করে দেখল—গত দশ বছরে কোথাও, কোনো উপলক্ষ্যে পিসিমার কোনো ফটো তোলা হয়নি। এবং তাদের পিসিমা খুব রোগাও না, কালোও না, ফর্সাও না, চুল পুরো পাকা না, আবার পুরো কাঁচাও না, দাঁত যে সব গোটা তাও না, আবার সব যে পড়ে গেছে তা-ও নয়, তিনি খুব বুড়োও নন, আবার কম বুড়োও নন, আসলে তাঁর কোনও পরিচয়চিহ্ন নেই। তিনি আসলে শুধুই একজন পিসিমা। অগণ্য পিসিমার মধ্যে একজন। কারো মা নয়, বাবা নয় শুধুমাত্র পিসিমা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments