Friday, October 10, 2025
Homeথ্রিলার গল্পঅন্ধকারের রাজপুত্র - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

অন্ধকারের রাজপুত্র – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

ফিস, অস্ট্রিয়া।

স্যামনন পাহাড়ের ওপাড় থেকে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটার সঙ্গে আলোর আঙুলগুলো ভেসে উঠল। রোজ এই দৃশ্য দেখে ফাদার ফ্রান্সিসের মনে হয় পাহাড়ের মাথায় ভর দিয়ে যেন উঠে আসছেন অর্কদেব!

চার্চের থেকে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে ঘণ্টাটা দেখলেন ফাদার। ঘণ্টার ওপরের ক্যানোপিটার মাথার ক্রসে কমলা আভা এসে ঠেকেছে। ফাদার জানেন এবার বেরিয়ে পড়তে হবে ওঁকে।

সকালবেলা না হাঁটলে গোটা দিনটায় ‘কী যেন হল না’ মনে হয় ফাদারের। সারাদিন অরফ্যানেজের বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কোথা দিয়ে যে সময় বেরিয়ে যায়! এই প্রাতঃভ্রমণটুকুই যা নিজের।

ভাল করে টুপিটায় কান ঢেকে, মাফলার জড়িয়ে চার্চের কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ফাদার।

পিচের নির্জন রাস্তা। দু’দিকে তুলোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বরফ। বড় বড় গাছগুলোর পাতায় অজানা ফিসফিস লেগেই আছে যেন! এই সময়টায় ফাদারের মনে হয় এটাই কি পৃথিবীর নির্জনতম জায়গা!

রাস্তাটা আলতো করে উঠে গেছে সামনে। টাইরোলিন ইন উপত্যকার গ্রাম এই ফিস। ফলে গোটা অঞ্চলটাই চড়াই উতরাই-এ ভরা। হাঁটতে গিয়ে ফাদারের একটু হাঁপ ধরে বটে, কিন্তু ভালও লাগে খুব।

সামনের বড় বড় কয়েকটা পাইন গাছের গোড়া থেকে রাস্তাটা বেঁকে গেছে ডানদিকে। ফাদার ছোট ছোট পায়ে সেই বাঁকের কাছে পৌঁছে থমকে গেলেন! এ কী!

একটা জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে পথটা জুড়ে। কিন্তু গাড়ির ভেতরে কেউ নেই! ফাঁকা!

ফাদার এদিক ওদিক তাকালেন। আচ্ছা মুশকিল! কে এত সকালে এমন করে পথটা আটকে রেখেছে?

হ্যালো? কেউ আছেন? ফাদার চিৎকার করে ডাকলেন।

শব্দটা গাছে, পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে গেল দূরে!

ফাদার এদিক ওদিকে তাকালেন। আশ্চর্য!

“টিউব, টিউব।”

কোথায় যেন পর পর শব্দ হল দুটো! বড্ড চেনা শব্দ, কোথায় যেন… তবে এর বেশি কিছু ভাবতে পারলেন না ফাদার। আচমকা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন কাঁধে। মনে হল কেউ গলন্ত লোহা ঢেলে দিয়েছে শরীরে। প্রচণ্ড ধাক্কায় রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ে গেলেন ফাদার।

ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। দুটো কাঁধ অসাড়। নড়তে পারছেন না। তাও বৃদ্ধ শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ওই অবস্থাতেও ঘাড় ঘোরাবার চেষ্টা করলেন উনি!

“প্লিজ, নড়বেন না,” শান্ত গলায় বলে উঠল একজন, “কষ্ট দেবেন না নিজেকে। আর বলে দেবেন, আপনাকে দিয়ে শুরু। এরপর ওর শহরের পালা।”

ঠান্ডা হাওয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হল ফাদারের। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল চোখে। শুধু জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে লোকটির পেছন ঘুরে চলে যাওয়াটা দেখলেন। দেখলেন সকালের হাওয়ায় লোকটার বড় কোঁকড়া চুলগুলো উড়ছে।

দু’মাস আগে। লন্ডন।

টেনশনে গোপীর ভেতরটা থমথম করছে। চারিদিকে এত মানুষ, আলো আর হুল্লোড়! তাও ও ভাল করে মন দিতে পারছে না কোনও কিছুতে! কেবলই ঘড়ি দেখছে, আর ভাবছে, এখনও কোনও খবর আসছে না কেন!

গোপীকৃষ্ণ মুরলিরাজন স্টোনটেক কর্প-এর সাউথ-ইস্ট এশিয়ার রিজিওনাল হেড। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে এই জায়গায় পৌঁছতে যা যা দরকার সব আছে ওর। অ্যামেরিকান নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে এম টেক, ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি, সাহস আর ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা করতে পারার মতো উপস্থিত বুদ্ধি!

গোপী মনে করে ভাগ্য বলে কিছু হয় না। যে যা করে সেটাই তার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেয়। তাই তো মাত্র বারো বছরের চাকরিতে ও এতটা ওপরে উঠে এসেছে।

তবে এটা তো সবে শুরু। আজ যদি ঠিকঠাক খবরটা আসে তাহলে সামনে আরও নানান অপরচুনিটি অপেক্ষা করে আছে।

গোপী হাতের গ্লাসটা রেখে দূরে তাকাল। জিউস-এর সিইও মিস্টার পেন দু’জন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। মনে মনে হাসল গোপী। ও জানে পেনের মনের ভেতরেও ঝড় চলছে। জানে, ওর মতো, পেনও অপেক্ষা করছে একটা ফোন কলের।

“হাই গোপী, ফিলিং বাটারফ্লাইজ!” পাশে এসে জিজ্ঞেস করল জন।

জন স্নো, এই কোম্পানিতে গোপীর কমপিটিটর। স্টোনটেক কর্পের মিডল ইস্ট এশিয়া আর অ্যাফ্রিকার কম্বাইন্ড রিজিয়ান হেড। পঞ্চাশের মতো বয়স। মোটা। থলথলে। দেখলে মনে হয় গোলাপি শুয়োরকে কেউ কোট-প্যান্ট পরিয়ে দিয়েছে। আজকের এই বড় সেলিব্রেশনটা ওর সাফল্যের জন্যই।

গোপী জানে, আজকের সাফল্যের পরে জন একটু এগিয়ে গেল ওর চেয়ে।

স্টোনটেক কর্প পৃথিবীর এক নামকরা কনস্ট্রাকশন জায়েন্ট। তার সঙ্গে আরও নানান ব্যবসা আছে ওদের। যার মধ্যে একটা হল আন্ডার সি মাইনিং। সমুদ্রের তলা খুঁড়ে হিরে বের করে ওরা। আর সেই কাজ করতে গিয়েই মাস দেড়েক আগে, ১৭১৫ সালে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া একটা স্প্যানিশ জাহাজকে খুঁজে পেয়েছে ওদের টিম। যার থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাওয়া গেছে! আজ সেই সব জিনিসই সাজিয়ে একটা অনুষ্ঠান করছে স্টোনটেক। এতে সারা পৃথিবীতে প্রেস্টিজ আর ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়বে ওদের।

গোটা ঘটনাটার চার্জে ছিল জন। তাই আজ গোটা ক্ষীরটা একা ভোগ করছে ও।

সমুদ্রের তলা থেকে বেশ কয়েকটা লোহার ট্রাঙ্ক উদ্ধার করা হয়েছে। তার ভেতরে সোনা, রুপোর ইট থেকে শুরু করে দামি পাথর, মোম-কাপড়ে জড়ানো নথি, আরও নানান জিনিস পাওয়া গেছে!

সেগুলোকেও সব পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে চারিদিকে। তবে এসবের মধ্যে এমন কিছু জিনিস আছে যা শুধু দামিই নয় ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাজা পঞ্চম ফিলিপের আদেশ খোদাই করা বেশ কিছু তামার প্লেট। হিরে বসানো হাড়ের তরোয়াল। আর রানির জন্য নিয়ে যাওয়া সাতটা সোনার গোলাপ ফুল। প্রতিটা ফুলের পাপড়িগুলো জুড়ে বসানো রয়েছে ছোট ছোট ‘পিজিয়ন ব্লাড’ রঙের চুনি! আর মাঝখানে একটা বড় ডায়মন্ড! দূর থেকে দেখলে যাকে মনে হয় ঝলমলে গোলাপ ফুল। নাম স্প্যানিশ রোজ!

গোপী তাকাল জনের দিকে, “না, বাটারফ্লাইজ কেন হবে? আমি কনফিডেন্ট।”

জন হাসল, “দেখ কী হয়। বড় সাহেব তো আজকের ইভেন্ট নিয়ে খুব খুশি। ওই জিউস গ্রুপের সিইও-কে দেখছ? কেমন মুখ কালো করে ঘুরছে! ব্যাটাদের আজ খুব বিট করেছি আমি।”

গোপী হাসল, “এই করে কিন্তু কোম্পানির শেয়ার প্রাইস বাড়বে না। মনে রেখ সেটা বাড়বে একমাত্র বড় মাপের কাজ পেলে। ফলে, এই সব ইভেন্ট-এর কী দাম আছে বলো!”

জন বুঝল কথাটা। বলল, “কাজ? তুমি আনতে পারছ? আচ্ছা, সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিয়ানে কি তেমন ভাল কাজ বেরচ্ছে না? মানে এমন ঠান্ডা রেসপন্স কেন?”

মনে মনে রাগটাকে গিলল গোপী! ওর রিজিয়নে ঠান্ডা রেসপন্স! শালা, মিডল ইস্ট-এর মতো সোনার জায়গা পেয়েছে জন বরাত জোরে। যুদ্ধের পর কনস্ট্রাকশনের সুনামি লেগে গেছে। ওর রিজিয়নে কাজ করতে হলে বুঝত। তারওপর আবার রিসেশন হিট করেছে! তাতেও যা পারফর্ম্যান্স দেখাচ্ছে, ম্যানেজমেন্ট বেশ খুশি! আর আজ যদি গুড নিউজটা আসে তবে তো কথাই নেই! বোর্ড অব ডাইরেক্টরস-এ ওর জায়গাটা পাকা। জন তাকিয়ে দেখবে তখন।

গোপী বাহামাসে প্রপার্টি দেখে রেখেছে। সঙ্গে ফোর সিটার একটা প্লেন! জন তো জানে না এল ডোরাডো কাকে বলে!

পকেটে ফোনটা একবার রিং হতেই দ্রুত ধরল গোপী। এর মধ্যেই মনে হল ওর ভেতরে দু হাজার বুনো ঘোড়া ছুটে গেল যেন। তবু মনটা শক্ত করল ও। ভাবল আজ এসপার নয় ওসপার!

ফোনটা কানে ধরে গোপী দেখল জিউসের সিইও-ও ফোন ধরে রয়েছে। এক সঙ্গেই কি এল খবরটা? গোপী জানে স্টোনটেক আর জিউস এই কাজটায় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী!

দেড় মিনিটের কল। তাতেই জীবন এতটা পালটে গেল! গোপী ফোনটা রেখে তাকাল পাশে দাঁড়ানো জনের দিকে। এবার সত্যিই প্রজাপতি বুঝতে পারছে পেটে!

জন জিজ্ঞেস করল, “কী খবর? কে পেল কাজটা?”

গোপী হাসল, “বাহামাসে গেছ কখনও?”

জনের উত্তরের জন্য দাঁড়াল না গোপী। নানান লোকের ভিড় সরিয়ে দৌড়ে গেল ওদের চেয়ারম্যান, পিটার ক্রেগের দিকে। বুড়োকে বলতে হবে সাউথ ইস্ট এশিয়ার বিগেস্ট ব্রিজটার টেন্ডারে স্টোনকর্প লোয়েস্ট হয়েছে। বলতে হবে এবার ওয়ার্ক অর্ডারটা পাওয়া জাস্ট সময়ের অপেক্ষা!

জিউসের সিইও-র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাসি পেল গোপীর। ভদ্রলোকের মুখ চোখ লাল হয়ে আছে রাগে। স্বাভাবিক! কাজটা তো পায়নি! একশো পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন ডলারের কাজ! চাট্টিখানি কথা তো নয়!

গোপী যেতে যেতে শুনল সিইও ভদ্রলোক বলছেন, “কীভাবে হল এটা? কীভাবে হল? মিনিমাম ওয়ান সেভেন্টি কোট হয়! সেখানে ওয়ান থার্টিফাইভ! ডাকো আমার এস্টিমেটারকে। রিভিউ দ্য ডিজাইন অ্যান্ড কস্টিং। এত কম টাকায় কাজটা ওরা নিল কী করে? আমি ছাড়ব না, কিছুতেই ছাড়ব না।”

গোপী জানে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম শহরের বুকে গঙ্গা নদীর ওপর তৈরি হওয়া নতুন কেবল-ষ্টেয়েড ব্রিজটার বরাত এখন স্টোনটেকের হাতের মুঠোয়! জানে, জিউসের আর কিচ্ছু করার নেই এই ব্যাপারে!

ফিস, অস্ট্রিয়া।

আন্ট এম্মালিনার পাগ-টার চারটে ছানা হয়েছে। গতকাল রাতে ফোন করে আন্টি যখন বলছিল মায়ের মুখে স্পষ্ট খুশি দেখেছিল ইয়েনস। রাত বলে মা চুপ করে ছিল। কিন্তু আজ সাত সকালে ওকে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে মা। কী? না, আন্টির বাড়িতে গিয়ে চারটে পাগের ছবি তুলে আনতে হবে। সঙ্গে করে আবার আন্টির জন্য কয়েকটা কুকি আর ব্রাউনি দিয়ে দিয়েছে!

বিরক্ত লাগে ইয়েনসের। ও কি পোস্টম্যান নাকি? কাল শেষ রাত অবধি বায়ার্ন মিউনিখ আর বার্সেলোনার একটা ম্যাচের রিপিট টেলিকাস্ট দেখেছিল! কোথায় আজ ঘুমোবে একটু! না, কুকুরের ছবি তুলতে যেতে হবে!

ইয়েনস খাবারের বাক্সটা সাইকেলের সামনের বাস্কেটে রেখে বেরিয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি সারতে হবে কাজটা। এসে তো আবার স্কুলেও যেতে হবে!

উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে সাইকেল ছুটিয়ে দিল ইয়েনস।

সূর্য উঠছে সবে। কনকনে হাওয়ার থেকে বাঁচতে কান ঢাকা টুপির সঙ্গে ইয়ার প্লাগটাও পরে নিয়েছে ইয়েনস।

ওদের বাড়ি থেকে আন্ট এম্মালিনার বাড়ি বেশ কিছুটা দূরে। ইয়েনস ভাবল চার্চের সামনের রাস্তা দিয়ে শর্টকাট করে নিলেই তো হয়।

পিচের রাস্তা থেকে বাঁদিকের পাথুরে রাস্তায় নেমে গেল ইয়েনস। তারপর জোড়ে প্যাডল করতে লাগল।

ওই দেখা যাচ্ছে চার্চের বেল টাওয়ার। দেখা যাচ্ছে তার মাথার ওপরের ক্রসটা। বড় ঘণ্টাটা আর একটু পরেই বাজবে। ইয়েনস জানে ফাদার ফ্রান্সিস মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে রোজ ঘণ্টাটা বাজান।

পাথুরে রাস্তা থেকে আবার চার্চের সামনের পিচ রাস্তায় উঠল ইয়েনস। ওই তো বড় বড় পাইন গাছগুলো। ওরা বলে পাইন বান্ডল। ওটা পার করলেই আন্টির বাড়ি।

ইয়েনস পাইন গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু, পার করতে পারল না। সাইকেলটাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল মাঝ রাস্তায়। আর দেখল, পথের পাশে একজন মানুষ পড়ে রয়েছেন মুখ থুবড়ে।

ছ্যাঁত করে উঠল ইয়েনসের বুকটা। সকালের নরম আলোয় ও তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে লোকটাকে। হাওয়ায় অল্প অল্প কাঁপছে তাঁর মাথার চুলগুলো। এমন প্ল্যাটিনাম-ব্লন্ড চুল ওর খুব চেনা!

সাইকেলটাকে ফেলে দৌড়ে গেল ইয়েনস। ফাদার ফ্রান্সিস পড়ে আছেন! চোখ বন্ধ। কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। তবে একটু যেন ঘন হয়ে এসেছে তার রঙ।

ইয়েনস নাকের কাছে হাত নিল ফাদারের। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকল, “ফাদার, ফাদার ফ্রান্সিস।”

আচমকা একটু নড়লেন ফাদার। ইয়েনস দেখল ঠোঁটদুটো নড়ছে তাঁর। কিছু কি বলতে চান উনি?

ইয়েনস ফাদারের মুখের কাছে কানটা নিয়ে গেল। কিছু বলছেন মানুষটা। কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না ও। ভাল করে শুনবে বলে ইয়েনস আরও ঝুঁকল। এবার শুনতে পেল ও। শুনল ফাদার জড়িয়ে, অস্ফুটে বলছেন, “অ্যাডাম, অদম্য…”

এখন। কলকাতা।

সপ্তাহের তিনটে দিন খুব ভাল কাটে লি’র। মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি- এই দিনগুলোয় ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ময়দানে খেলতে আসে ওরা।

আজ মঙ্গলবার। সবে খেলা শেষ হয়েছে এখন। জার্সিটা খুলে মাঠে বসেছে লি আর ওর বন্ধুরা। পিকনিক গার্ডেন থেকে ভোর ভোর বাস ধরে ওরা চলে আসে ময়দানে। তারপর শুরু করে খেলা। ফুটবল।

তখনও রোদ নরম থাকে। ওরা সাত জনের দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়ে ম্যাচ খেলে।

লি-এর বন্ধুরা সবাই বাঙালি। আর ওর শরীরের চৈনিক রক্ত থাকলেও কলকাতায় তৃতীয় পুরুষ কাটছে ওদের। লি-র বাংলা দারুণ, ইলিশ মাছ যে-কোনও বাঙালির চেয়ে ভাল বেছে খায়। ওর মায়ের মতো ডাঁটা চচ্চড়ি খুব কম লোকে রান্না করতে পারে!

লি-দের রেস্তোরাঁ আছে ট্যাংরায়। কলেজের ফাঁকে সেখানে বাবা আর দাদাদের সাহায্য করে ও। তাই সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়।

শুধু সপ্তাহের এই তিনটে দিন সকালে বাজার যাওয়ার কাজ থাকে না। ও সোজা চলে আসে শহিদ মিনারের পায়ের কাছে। ঘণ্টাখানেক ফুটবল পেটায়। তারপর পেতলের কলসিতে চা বিক্রি করতে আসা লোকটার থেকে চা খায়। সঙ্গে কেক। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় পৌনে ন’টা বেজে যায়!

আজ লি-র মনটা ভাল আছে। দু’ গোলে জিতেছে ওরা। লি দিয়েছে একটা গোল। জার্সি খুলে চা খেতে খেতে সবাই সেই আলোচনাটাই করছে।

লি চায়ে চুমুক দিয়ে তাকাল। আজ দিনটা মেঘলা। হাওয়াও দিচ্ছে বেশ! গোল্লা পাকানো কিছু মেঘ জড়ামড়ি করে গড়াচ্ছে আকাশে। একটু দূরে ময়দানের একটা ক্লাবের টেন্টের পাশে ছোট্ট স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে। নাম ‘স্কাইড্যান্স স্টেডিয়াম’। লোহার স্ট্রাকচারে জিনিসটাকে কাকের বাসার মতো লাগলেও লি জানে, দারুণ হবে স্টেডিয়ামটা। লি-র ভাল লাগছে। যে যাই বলুক, কলকাতার মতো শহর হয় না!

“এই ধর, ধর।”

লি মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কথা বলতে বলতে ওর এক বন্ধু ফুটবলটা আচমকা একটু জোরে শট মেরে দিয়েছে। বলটা গড়াতে গড়াতে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল।

লি হাতের ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে উঠে গেল বলটা আনতে। একটা লোক আসছিল মাঠ দিয়ে হেঁটে। লি দেখল লোকটা পা দিয়ে থামাল বলটা।

লোকটা লম্বা, গমের মতো গায়ের রঙ। মাথায় বড়, কোঁকড়া চুল। আর সবচেয়ে অদ্ভুত চোখ দুটো। গাঢ় সবুজ রঙের! লোকটার মুখ চোখ যেন ছুরি দিয়ে কেটে তৈরি করা! ভারতীয় যে নয় বুঝতেই পারল লি। আজকাল কলকাতায় বিদেশি লোকে ভরে গেছে!

ও হেসে তাকাল লোকটার দিকে। লোকটা বলটার তলায় টোকা মেরে তুলে নিল শূন্যে। দু’পায়ে জাগল করল কিছুটা। মাথায় তুলে ব্যালান্স করল একটু। তারপর আবার পায়ে নামিয়ে পাস করে দিল লি-কে।

লি হেসে বলল, “ইউ আর ভেরি গুড।”

লোকটা হাসল। তারপর যেন কিছুটা নিজের মনেই বলল, “দ্য বেস্ট ইজ় ইয়েট টু কাম।”

লি মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “আই উইশ ইট ইজ ট্রু।”

লোকটা হাসল, বলল, “বি কেয়ারফুল অ্যাবাউট হোয়াট ইউ উইশ ফর।”

লোকটা চলে গেল বড় রাস্তার দিকে। কী বলল লোকটা? এমন বলল কেন? লি অবাক হল খুব!

বলটা নিয়ে বন্ধুদের কাছে ফিরে এল লি। একজনকে বলটা দিয়ে বসতে গেল মাটিতে। কিন্তু ঠিক তখনই একটা আলোর ঝলকানি দেখল চোখের কোণ দিয়ে। আর শুনল বিকট এক শব্দ। ওর পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল যেন। প্রচণ্ড গরম এক হাওয়ার ঝাপটা পেছন থেকে এসে লি-কে আছড়ে ফেলল দূরে।

কানে তালা লেগে গেছে লি-র। চোখের সামনে পৃথিবীটা ঘুরছে বনবন করে। সারা গায়ে ব্যথা। মাথা তুলতে পারছে না যেন! আচমকা কী হল এটা?

শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে কোনও মতে উঠে বসল লি। বন্ধুরাও ওর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। দু’একজনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।

লি ধীরে ধীরে দাঁড়াল এবার। পা টলছে ওর। কষ্ট হচ্ছে মাথায়। তবু পেছন ঘুরল। দেখল আশেপাশে বেশ কিছু মানুষ পড়ে আছে। বাকিরা পাগলের মতো দৌড়চ্ছে। লি মাথা তুলে থমকে গেল। দেখল, কালো ধোঁয়া স্তম্ভের মতো উঠে যাচ্ছে আকাশের ওই গোল্লা পাকানো মেঘগুলোর দিকে।

লি ভুলে গেল ওর যন্ত্রণার কথা। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। দেখল, আধপোড়া কেক-এর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বোমায় অর্ধেক উড়ে যাওয়া ‘স্কাইড্যান্স স্টেডিয়াম’!

কনফারেন্স রুমে ঢুকতে ঢুকতেই চিফ সেক্রেটারি সঞ্জয় মিত্রর দিকে চোখ গেল জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ, ক্রাইম পল্লব কান্তি ঘোষের। তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন কমিশনার অফ পুলিশ সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ এবং অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি (হোম) বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘরের ভেতরে আরও অনেক চেনা মুখ দেখতে পেলেন পল্লববাবু।

ঘরের কোণে মাথার থেকে টুপিটা খুলে রাখলেন পল্লববাবু তারপর কমিশনারকে বললেন, “স্যার, ম্যাডাম এসে গেছেন।”

সুরজিৎবাবু কিছু বলার আগেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। সিএম দ্রুত ঘরে ঢুকে এলেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন মন্ত্রী রয়েছেন।

“গুড মর্নিং ম্যাডাম,” সমবেত গুঞ্জন উঠল ঘরে।

সিএম ছোট্ট করে মাথা নাড়লেন উত্তরে। তারপর চশমাটা খুলে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা হল কী করে? এমন সাংঘাতিক কাণ্ডটা ঘটল কী করে?”

সুরজিৎবাবু সামনের লম্বা টেবিলে রাখা একটা পেপার ওয়েটের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করলেন একটু। তারপর বললেন, “আমরা দেখার চেষ্টা করছি ম্যাডাম। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না!”

“আপনাদের কোনও টিপ অফ ছিল না? কোনও খবর পাননি?” সিএম একটা চেয়ার টেনে বসলেন।

“ম্যাডাম, খবর তো নানারকম থাকেই। কিন্তু এটার কোনওরকম টিপ অফ ছিল না।” এবার কথা বললেন চিফ সেক্রেটারি।

সিএম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করলেন। চোখ বন্ধ করে ভাবলেন একটু। তারপর শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে-জড়াতে সেক্রেটারি অফ সিভিল ডিফেন্স পৃথ্বীদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কোনও ফোন পেয়েছেন কি এখনও পর্যন্ত? কে করতে পারে বলে মনে হয় আপনাদের? কেউ কোনও ডিমান্ড করেছে?”

“এখনও নয় ম্যাডাম।”

“সেকি!” সিএম অবাক হলেন, “আধঘণ্টা হয়ে গেছে আর কেউ এখনও রেসপনসিবিলিটি নেয়নি?”

“অন দ্য কন্ট্রারি,” পল্লববাবু বললেন, “প্রায় সব জঙ্গি গোষ্ঠীই বলেছে এটা তারা করেনি। বলেছে এমনভাবে স্পোর্টসের কিছু ধ্বংস করাটা তাদের মোডাস অপারেন্ডির বাইরে।”

সিএম সুরজিৎবাবুকে বললেন, “শহরের সব ইম্পর্ট্যান্ট জায়গাকে ইমিডিয়েটলি কর্ডন করুন। যতটা পারেন ফোর্স ডিপ্লয় করুন। কিন্তু দেখবেন সাধারণ মানুষের যেন হ্যারাসমেন্ট না নয়!”

“শিওর ম্যাডাম। আমি অলরেডি অ্যাকশন নিয়েছি,” সুরজিৎবাবু ঠোঁট কামড়ে মাথা ঝাঁকালেন।

সিএম এবার তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে, “আপনি সেন্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন? ওরা কী বলছে?”

সঞ্জয়বাবু বললেন, “হোম, ডিফেন্স দুটো মিনিস্ট্রির সঙ্গেই কথা হয়েছে ম্যাডাম। আর ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল প্লাস পিএমও-র প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির সঙ্গেও কথা হয়েছে।”

“ওরা কি কাউকে পাঠাবে?” সিএম জিজ্ঞেস করলেন।

“পাঠাবে ম্যাডাম। তবে আমরাও পুরো চেষ্টা করছি। ফরেনসিক থেকে লোকজন চলে গেছে স্টেডিয়ামের কাছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।”

“কোনও লিড পাওয়া গেছে কি?”

সুরজিৎবাবু মাথা নাড়লেন, “না ম্যাডাম, নট ইয়েট। তবে আমরা চেষ্টা করছি। সমস্ত রকম ট্রান্সপোর্ট টারমিনাসে খবর নেওয়া হচ্ছে। শহরের ঢোকার সমস্ত টোলগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হচ্ছে। লাস্ট সেভেন ডেজ়-এ কোনও অ্যালার্মিং কেউ শহরে ঢোকেনি। সেনসিটিভ জায়গাগুলোয় অপারেট করা আমাদের কনট্যাক্টরাও কিছু বলতে পারছে না। সম্পূর্ণ অচেনা কেউ এটা করেছে বলে আমাদের ধারণা।”

সিএম পাশে বসা একজন মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলোকে নিজে ফোন করো। বলো, ওরা যেন আমাদের হেলপ করে। মাস হিস্টিরিয়া যাতে না ছড়ায় সেটা যেন দেখে।”

“হ্যাঁ দিদি।”

সিএম এবার ঘুরলেন সঞ্জয়বাবুর দিকে, “ন্যাশানাল সিকিওরিটি গার্ড কি আসছে?”

সঞ্জয়বাবু মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম। তবে পিএমও থেকে বলা হয়েছে আমাদের যা লাগবে সেটা আমরা যেন বলি। আর ডিফেন্স মিনিস্টার নিজেই আসছেন।”

“কিন্তু কে লোকটা, কোথায় আছে সে, কী করছে, কী চায়, কিছুই জানা যাচ্ছে না! আমি জানি আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম খুবই এফিশিয়েন্ট, কিন্তু কিছু জানতে না পারলে তো সবটাই অন্ধকারে হাতড়ানো হবে। সব্বাই মিলে খুঁজলেও কিছু পাওয়া যাবে না!” বাসুদেববাবু কতকটা যেন নিজের মনেই বললেন কথাগুলো!

“খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা বুঝলেন বাসুদেববাবু, খড়ের গাদায় সূঁচ!” সিএম ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করলেন একটু, বললেন, “এক বা একাধিক কেউ ঘুরছে এই শহরে। যে বা যারা কী চায় এখনও বলেনি। আমরা জানি না এমন ঘটনা আর ঘটতে পারে কী না! জানি না, ঘটলে কোথায় ঘটবে! অন্ধকার বুঝলেন, সবাই অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি আমরা। এখন আমাদের এমন কাউকে চাই যে অন্ধকারে দেখতে পায়! অন্ধকারে স্বচ্ছন্দ! আমাদের এমন কাউকে চাই যে অন্ধকারটা চেনে!’

সাদা-কালো ছবিটা আবছা হয়ে গেছে, তবু তার দিকে তাকালে আজও সামান্য সময়ের জন্য মনটা অন্যরকম হয়ে যায় অদম্যর।

ছবিটা ওর পাঁচ বছর বয়সে তোলা। জানলা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। আলো এসে পড়ছে ওর মুখে। হাসি মুখ। ছবিটা তুলেছিল বাবা।

কাজের সূত্রে বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই ঘুরত বাবা। ওর খুব কম দেখা হত বাবার সঙ্গে। এখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকত অদম্য।

বাবা মারা যায় বারো বছর বয়সে। তাও সুদূর সোমালিয়ায়। মা তো ছিল না ছোট থেকেই। বাবা মারা যাওয়ার পর ওকে আর সেই আত্মীয়টি রাখতে চায়নি। মুখে না বললেও তাদের অত্যাচারে সেটা বুঝতে পারত অদম্য। তাই একদিন আর সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছিল বাড়ি থেকে। ভেবেছিল, কেউ যখন নেই, ও-ই বা আর বাঁচবে কেন!

এখনও মনে আছে অদম্যর। অন্ধকার এক স্টেশনে রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়েছিল ও। অপেক্ষা করছিল কখন আসবে ট্রেন। কখন ও ঝাঁপিয়ে পড়বে তার সামনে!

তারপর দেখেছিল সেই উজ্জ্বল হলুদ আলো। দেখেছিল অন্ধকার চিরে এগিয়ে আসছে লোহার দানব। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল অদম্য। তারপর শরীর টান করেছিল লাফাবে বলে।

কিন্তু পারেনি। ঠিক সময়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওকে টেনে এনেছিল একটা হাত। মৃত্যুর মুখ থেকে সেদিন ওকে ফিরিয়ে এনেছিলেন ফাদার ফ্রান্সিস!

লম্বা মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল ছোট্ট ছেলেটা। ফাদার মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন ওর। আর ভাঙা বাংলায় বলছিলেন, “কাঁদতে নেই, কক্ষনো কাঁদতে নেই। জানি কষ্ট হয়। যন্ত্রণা হয়। তবু পালাতে নেই! জানবি মাটির অনেক অনেক তলায় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাপে, তাপে, অন্ধকারেই তো জন্ম নেয় হীরক খণ্ড। জীবনে হতাশ হতে নেই, ভেঙে পড়তে নেই! তুই অন্ধকারে আছিস তো কী হয়েছে? একদিন তুই আলোয় ফিরবি। আলোয় ঝলমল করবি! মনে-মনে জানবি তুই এক রাজপুত্র, অন্ধকারের রাজপুত্র!

সেই থেকে ফাদার ফ্রান্সিসই অদম্যর সব।

পরে ওর কথা শুনে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন ফাদার। নিয়ে এসেছিলেন ওর জিনিসপত্র। সঙ্গে এই ছবিটাও।

অদম্যর কাছে ওর নিজের বাবার কোনও ছবি নেই। বাবার তুলে দেওয়া ওর এই ছবিটাই আছে কেবল। এটাই দেখে ও। বাবা বলতে এর বেশি কিছু মনে করতে পারে না ঠিক। বরং চোখ বন্ধ করলে ফাদারের মুখটাই দেখতে পায়। নিজের বাবা হিসেবে এই লোকটার মুখটাই ফিরে ফিরে আসে ওর মনে!

এখনও ফাদারের মুখটা মনে পড়ল ওর। গলটুর-এর আরৎহউস হসপিটালে শুয়ে থাকা ফাদারের মুখটা যেন স্পষ্ট দেখতে পেল ও। রোগা, এক মুখ সাদা দাড়ি গোঁফ।

ফাদারের গুলি লাগার খবর পেয়ে ফিস-এ পৌঁছতে ওর ঘণ্টাচারেক সময় লেগেছিল। ছোট্ট ইয়েনস খুব বুদ্ধি করে ফাদারকে ভর্তি করিয়েছিল হসপিটালে। তারপর খবর দিয়েছিল সবাইকে।

অদম্য ফাদারের কেবিনে ঢুকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “কে সে? কেমন দেখতে তাকে তুমি আমায় একবার বলো।”

ফাদার সময় নিয়েছিলেন একটু, তারপর ধীর গলায় বলেছিলেন, “কেন? ওকে মারবি? তার চেয়েও কঠিন কাজ সামনে অপেক্ষা করে আছে তোর। মানুষকে মারার কাজ নয় অ্যাডাম, বাঁচানোর কাজ!”

ব্যাগটা বিছানা থেকে তুলে নিল অদম্য। আজ খুব ভোরে শিয়ালদা স্টেশনে এসে নেমেছে ও। ঘুম প্রায় হয়নি। তবু বহু বিনিদ্র রাত্রি কাটাবার অভিজ্ঞতা আছে ওর। তাই এতে ওর অসুবিধে হয় না। বরং সকালে এই লজের ঘরটার ছোট্ট রঙিন টিভিতে অর্ধেক ভাঙা স্টেডিয়ামটা দেখে বুঝতে পেরেছে ফাদার ভুল বলেননি ওকে। বুঝতে পেরেছে একটু দেরি করে ফেললেও লোকটা ঢুকছে এই শহরে।

তবে ছাড়বে না অদম্য। ফাদারকে যে গুলি করেছে তাকে ছাড়বে না। সে জানে না কোথায় হাত দিয়েছে! দরকার হলে শহরের প্রত্যেকটা লোককে ধরে ধরে ও দেখবে। প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথর ঘেঁটে দেখবে। দরকার হলে নরকের অন্ধকার থেকে তাকে টেনে বের করে আনবে।

ঘর থেকে বেরোবার আগে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল ও। চোয়াল শক্ত করে মনে মনে বলল, ‘পারতে হবে, তোমাকে পারতেই হবে। মনে রেখ, তুমি কার জন্য বেঁচে আছ আজ! মনে রেখ তুমি কার জন্য আজ অদম্য সেন!

সকাল থেকেই আজ মেজাজ খারাপ হয়ে আছে লখার। বোনটার বিয়ে নিয়ে বাবা এমন ঝামেলা করছে যে বলার নয়। আরে বাবা, লাভলি নিজে পছন্দ করেছে একটা ছেলেকে। তাতে বাবার আপত্তি! কেন মেয়ে অব্রাহ্মণের ছেলেকে বিয়ে করবে!

আরে ভাই, তুমি কি পারবে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে? হেঁপো রুগি একটা! মা’কে পরের বাড়ি রান্না করতে হয় আর লখাকে সকাল থেকে রাত অবধি টানতে হয় অন্যের অটো। মাস গেলে তাতে যা হয় কোনও মতে সংসারটা চলে। এই অবস্থায় কি আর লাভলির বিয়ে দেওয়া সহজ হবে!

বাবা মাইরি বোঝেই না! অত ব্রাহ্মণ-টাহ্মণ চলে নাকি আজকাল! মেয়েটা নিজে একজনকে পছন্দ করেছে। ছেলেটাও ভাল, সেক্টর ফাইভের একটা বড় অফিসে পিওনের কাজ করে। রোজগার ভাল। কিন্তু ওই, কায়েতের ছেলে!

আজ সকালে বাবার সঙ্গে খুব লেগেছিল লখার। ও বলেছিল, “লক্ষণ মুখোপাধ্যায় থেকে যখন লখা হয়ে অন্যের অটো টানি আর খিস্তি খাই, তখন লাভলি কায়েতের ছেলেকে বিয়ে করলে ক্ষতি কী! আর যার মুরোদ নেই তার অত বাছ-বিচার কীসের!”

বাবার মুরোদ নেই কথাটা লখা বলেছে শুনে মা আজ একটা থাপ্পড় মেরেছে ওকে। লখাও তাই সকালে না খেয়ে বেরিয়ে এসেছে!

সেই থেকে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে ওর! আসলে বাবার ওপর রাগ করলেও মনে মনে ওর নিজের ওপরই বিরক্তি লাগছে! ওই কথাটা বাবাকে না বললেও পারত!

অন্য দিন সকালের এই সময়টা একটু ভিড় থাকে। কিন্তু আজ লোকজন একটু কম। সকাল থেকেই গোটা শহরটা থমথম করছে। কারা যেন বোমা মেরে অর্ধেক উড়িয়ে দিয়েছে ময়দানে তৈরি হওয়া একটা স্টেডিয়াম। সব চ্যানেলগুলো তাই নিয়ে পড়েছে। চারিদিকে পুলিশ আর আধা সামরিক বাহিনী গিজগিজ করছে।

অন্য দিন এ সময়টা চারজন সওয়ারি হওয়া কোনও ব্যাপারই না। কিন্তু আজ তিন জন হয়েছে সবে। ওর পাশে প্যাসেঞ্জার বসার সিটটা খালি এখনও।

লখা বিজন সেতু থেকে রাসবিহারী অবধি ট্রিপ খাটে। আট টাকা ভাড়া। সকাল সকাল খুচরোর চাপ খুব। কালো ফিতেওয়ালা ব্যাগটা অটোর হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে ও পেছনে বসা তিনজনকে বলল, “খুচরো দেবেন।”

একজন বলল, “সকালে কোথায় পাব এত খুচরো! তোমরা দিতে পার না?”

লখা মাথা ঘুরিয়ে বলল, “না পারি না দাদু। যেমন এই বয়সে আপনি অনেক কিছু পারেন না, তেমন আমিও সকালে ওটা দিতে পারি না!”

“মানে? কী বললে?” বছর পঞ্চান্নর লোকটি রেগে গেল।

কিন্তু লখা কিছু বলার আগেই ওর পাশের সিটে এসে বসল লম্বা মতো একটা মানুষ। মাজা গায়ের রঙ। কোঁকড়া বড় চুল। পেটানো চেহারা।

লোকটা ভীষণ ভদ্র গলায় বলল, “প্লিজ় হারি।”

লোকটার গলায় কী ছিল লখা বুঝল না, কিন্তু অমন পান্না সবুজ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ও আর কথা বাড়াল না। খুচরোর কথা না তুলে চালিয়ে দিল গাড়ি!

আজকাল কলকাতায় প্রচুর বিদেশি দেখা যায়। লখার গাড়িতেই রোজ দু’একজন করে ওঠে। কিন্তু এ লোকটা সেই সব বিদেশিদের মতো নয়! লখা আড়চোখে তাকাল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে শক্তিশালী লোক। এমন করে বসেছে যে লখাকে প্রায় বাইরের দিকে ঝুলে চালাতে হচ্ছে গাড়ি!

গড়িয়াহাটের মোড়ের কাছে গিয়ে থমকে গেল গাড়ি। মোড়ের মাথায় এমনিতেই জ্যাম হয় খুব তারওপর আবার আজ পুলিশ দিয়েছে! লখা স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির বাইরে বেরোল। সামনেই একটা মিনি। লখা গাড়ির ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গেল একটু। এবার দেখা যাচ্ছে মোড়টা। খুব জ্যাম। ধুর, আজ দিনটাই…

মনে মনে কথাটা শেষ করতে পারল না লখা। আচমকা বিজন সেতুর দিকে থেকে বিকট শব্দ হল একটা! পায়ের তলায় সবকিছু যেন ঢেউ লেগে কেঁপে গেল নিমেষে! লখা বসে পড়ল ভয়ে। কী এটা? একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে এবার পেছনের দিকে তাকাল ও। দেখল মানুষজন দৌড়ে আসছে ওই দিক থেকে। প্রাণভয়ে চিৎকার করছে! বেশ কিছু গাড়ি উলটে আছে, ছড়িয়ে আছে। মোড়ের কাছের ফুট ব্রিজটার একটা হোর্ডিং খুলে ঝুলছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনও দৈত্য যেন হাত দিয়ে ঘেঁটে দিয়েছে শহরটাকে!

লখা দ্রুত চলে এল ওর অটোর কাছে। পেছনের তিনটে লোক অটো থেকে বেরিয়ে অসহায়ের মতো তাকাচ্ছে! চোখে-মুখে আতঙ্ক! কী করবে বুঝতে পারছে না! তবে সামনের সিটটা খালি।

লখা তাকাল এদিক ওদিক। সেই সবুজ চোখের লোকটা কোথায় গেল?

জিনি জুতোটা পরতে পরতে মায়ের দিকে তাকাল। মা খাবার টেবিল পরিষ্কার করছে। মুখটা ভাতের হাড়ির মতো করে রেখেছে এখনও! আশ্চর্য মহিলা বটে! কাল থেকে রেগে আছে তো আছেই! ক্লান্ত হয় না একটুও!

জুতোটা পরে ও পাশের বেসিনে গিয়ে হাতটা ধুয়ে নিল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আসছি মা।”

মা মুখ তুলে তাকাল এবার। গম্ভীর গলায় বলল, “বলে গেলি না তো ওদের কী বলব!”

“কী বলবে? কী বলার আছে? কাল রাতে তো বলে দিলাম!”

“ওটাই তোর শেষ কথা?” মা চোয়াল শক্ত করল!

হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল জিনির। পুরোনো দিনের উত্তম কুমারের ছবিগুলোতে কমল মিত্র এমন গলাতেই আলটিমেটাম দিতেন না!

ও বলল, “প্রথম বা শেষ নয় মা, ওটাই আমার একমাত্র কথা! আমি এখন বিয়ে করব না। প্লিজ, তুমি, বাবা আর দাদা মিলে এই বর-হান্টিংটা বন্ধ করো! এক বছরও হয়নি খবর কাগজে ঢুকেছি, কোথায় নিজের পায়ের তলায় জমি শক্ত করব, না বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিলে!”

মা বলল, “কাগজ না ব্যাঙ! নিজেই তো বলিস তেমন সুবিধে হচ্ছে না! বস তোকে খুব একটা আমল দেয় না! তবে?”

“দেয় না বলেই তো আমায় আরও বেশি করে কাজ করতে হবে। দেখো মা, আজ তো আমার অফ ছিল। কিন্তু আমি কি ছুটিটা নিলাম? কলকাতায় সকাল থেকে যে দক্ষ যজ্ঞ শুরু হয়েছে সেটা আমার কাছে বিরাট অপরচুনিটি। এক্সক্লুসিভ কিছু জোগাড় করতে পারলে…”

“সেই তো! চারিদিকে বোমাবাজি চলছে আর তুই চললি ধিঙ্গিপনা করতে!” মা বসে পড়ল একটা চেয়ার টেনে, “কেন এমন করছিস? ছেলেটা বিদেশে থাকে। তোকে পছন্দ হয়েছে ওদের। কত ভাল থাকবি বলতো!”

“মা” জিনি বিরক্ত হল, “তোমার ভাল থাকার কনসেপ্ট আর আমার ভাল থাকার কনসেপ্ট তো এক নাও হতে পারে! কেন ইনসিস্ট করছ! আমায় যে-কোনও মূল্যে এই প্রোফেশনে নাম করতে হবে!”

“যে-কোনও মূল্যে মানে?” মা ভুরু কুঁচকে তাকাল।

জিনি এবার তাকাল মায়ের দিকে। তারপর কেটে কেটে বলল, “যে-কোনও মূল্যে মানে, যে-কো-ন-ও মূ-ল্যে। এক্সক্লুসিভ নিউজ়ের জন্য আমি যে-কোনও কিছু করতে প্রস্তুত। বুঝেছ?”

রাস্তায় বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল জিনি। মেঘ করে আছে। ও মনে মনে ভগবানকে ডাকল। একবার, আজ একবার আমার হাতে নতুন কিছু ধরিয়ে দাও ভগবান। আমায় একটা চান্স দাও।

অফিসে ওর বসকে একটু আগে ফোন করে আজ কাজ করতে চায় বলেছিল জিনি। হেড আপত্তি করেননি। তবে মুচকি হেসে বলেছিলেন, “তুই করতে চাইছিস কর। কিন্তু কী করবি? তোকে কিন্তু কোনও ফোটোগ্রাফার দিতে পারব না। একা…”

“আমি একাই পারব মোহনদা।” জিনি বলেছিল, “আমার ক্যামেরাটা নিয়ে নিচ্ছি। তেমন ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে আমি তুলে নেব।”

ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধ বদলে পাড়ার মোড় থেকে ডানদিকে বাঁক নিল জিনি। এইটবি থেকে বিজন সেতু যেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু আজ ভোগান্তি হবে। গড়িয়াহাট থেকে বিজন সেতু অবধি প্রচুর পুলিশ, মিলিটারি জমেছে। সঙ্গে দমকল আর প্যারামেডিকসের লোকজন। হবেই। সেতুর পাশের একটা সদ্য তৈরি হওয়া মাল্টিস্টোরিড প্রায় উড়ে গিয়েছে। নতুন বিল্ডিং, নাম ‘ধরিত্রী অ্যাপার্টমেন্ট।’ তবে লোকজন আসেনি এখনও। তা হলেও ব্লাস্টের চোটে আশপাশের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশ। ফ্ল্যাটের দারোয়ান, ফুটপাথের মানুষজন, দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু গাড়ি পুরো দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে। গোটাদশেক মানুষ মারা গিয়েছে।

সকাল থেকে কলকাতায় যা হচ্ছে, ভারতবর্ষে এমন কোনও দিন কোথাও হয়নি!

মনে মনে নিজেকে স্টেডি করল জিনি। খারাপ শোনালেও প্রফেশনাল দুনিয়ায় একেই বলে সুযোগ! এর সদ্ব্যবহার যদি ও করতে না পারে তবে আর কোনও দিন কিছু করতে পারবে না!

“এক্সকিউজ় মি। ক্যান আই হ্যাভ আ মোমেন্ট প্লিজ।”

সুন্দর ভরাট গলার স্বরে থমকে দাঁড়াল জিনি। দেখল একজন লোক। লম্বা, বড় কোঁকড়া চুল। সবুজ রঙের চোখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

“বলুন,” জিনি অবাক হল বিদেশিকে দেখে।

লোকটা নিজের পকেট থেকে একটা আই কার্ড বের করে দেখাল জিনিকে। বলল, “আমি ইন্টারপোল থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।”

এর দশ মিনিট পরে লোকটা কথা শেষ করে জিনির চলে যাওয়াটা দেখল। তারপর হাসল নিজের মনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে পাশের একটা সরু গলিতে ঢুকে গেল। দ্রুত হাতে খুলে ফেলল মাথার কোঁকড়া চুল। তারপর সাবধানে খুলে নিল সবুজ দুটো কনট্যাক্ট লেন্সও। এরপর দুটো জিনিসকেই প্যাকেটে মুড়ে সাইড ব্যাগে ভরে নিল। পরে কাজে লাগবে।

এবার নিজের নিখুঁতভাবে কামানো মাথায় একবার হাত বোলাল লোকটা। তারপর শান্ত পায়ে হেঁটে মিশে গেল যাদবপুরের হিজিবিজি ভিড়ের ভেতর!

ইস্তানবুল। মাসখানেক আগে।

এই মেইহানেটা ছোট্ট কিন্তু বেশ সুন্দর। এর এক কোণে মেজেই নিয়ে বসে রয়েছে অদম্য। বসফরাসের দিক থেকে এখন সুন্দর হাওয়া আসছে একটা। সূর্য ডুবছে দূরে। প্রাচীন চার্চ, মসজিদ আর রাজপ্রাসাদের সঙ্গে এখনকার আধুনিক মাল্টিস্টোরেডের মিশ্রণে একটা অদ্ভুত সিটিস্কেপ তৈরি হয়েছে! আধুনিকতার মাঝেও কোথাও যেন সেই কনস্তানতিনোপোল, বাইজানটাইন সাম্রাজ্য আর ওট্টোমান দুনিয়াটা রয়ে গেছে শহরের শিরায়।

এখানকার ছোট্ট ট্যাভার্নগুলোকে মেইহানে বলে। আগেকার দিনে পৃথিবীর এই সব সমুদ্র-সংলগ্ন অঞ্চলে মেইহানেগুলো গড়ে উঠেছিল। এখানে নানারকম পানীয়ের সঙ্গে মেজেই পাওয়া যায়। মেজেই হল বিভিন্নরকম খাবারের একটা কালেকশন।

অদম্য সেটা নিয়ে বসে থাকলেও এখনও কিছুই প্রায় মুখে তোলেনি। সামনের লোকটাকে দেখছে ও। সাধারণত কোনও কাজ ও নেয় ইমেল-এর সাহায্যে। মুখোমুখি দেখা করে না। কিন্তু এবার ওকে খুব জোরের সঙ্গে দেখা করতে আসতে বলা হয়েছে।

তবে দেখা করতে এলেও নিজের প্রকৃত চেহারা নিয়ে আসেনি ও। এখন কেউ ওকে দেখলে বলবেই না ও ভারতীয়। বলবে ও নিশ্চয় উত্তর আফ্রিকার লোক!

সামনের লোকটা ইউরোপিয়ান। কথা শুনে মনে হচ্ছে স্কটিশ। লম্বা ফরসা। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর উত্তরের অপেক্ষা করছে।

কিন্তু অদম্য কথা বলতে পারছে না। কী বলবে ও? কীসের জন্য একটা শহরকে ও বোমা মেরে তছনছ করে দেবে? কেন দেবে? লোকটা বলছে, কলকাতাকে এমন করে নাড়াতে হবে যাতে সারা পৃথিবীর লোকে সেখানে যেতে ভয় পায়। যাতে ওখানকার সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়! কিন্তু কেন করবে ও এটা? কারণটা কী? একটা নিরীহ শহরকে কীসের জন্য তছনছ করবে ও?

লোকটা কিছুতেই কারণটা বলছে না। শুধু টাকার কথা বলে যাচ্ছে। বলে যাচ্ছে কত মিলিয়ান ইউরো এটার থেকে পেতে পারে ও! লোকটা কি ভেবেছে অদম্য টাকার দাস?

সামনের প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে দিল অদম্য। তারপর বলল,“সরি, আমি এটা পারব না।”

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকাল অদম্যর দিকে, বলল, “কেন জানতে পারি?”

“এথিক্স। কারণ না জেনে আমি এমন করে নিরীহ মানুষ মারতে পারব না। আমি আর যাই হই টেররিস্ট নই।”

“টেররিস্ট!” লোকটা হাসল, “আমরা সবাই কোনও না কোনও ভাবে টেররিস্ট। ভয় দেখানো বা টেরর সৃষ্টি করার ওপরই ক্ষমতা টিকে আছে। কেউ সাধ করে কারও কথা শোনে না। সবাই ভেতরে ভেতরে কোনও একটা ভয়ের থেকেই অন্যের কাছে নতজানু হয়ে থাকে।”

অদম্য হাসল, “সরি মিস্টার। আপনার সঙ্গে ফিলজফিকাল ডিবেট করতে আসেনি। আমি কাজটা করব না। বাই।”

লোকটা নাক টেনে হাসল একটু। তারপর শান্ত গলায় বলল, “অ্যাজ ইউ উইশ। তবে মনে রাখবেন মানুষ নিজেকে আইসোলেট করতে চাইলেও কিন্তু সব সময় তা পারে না।”

অদম্য টেবিলে খাবারের দামটা রেখে উঠে দাঁড়াল, বললাম তো, “আমি একদম ডিবেট পছন্দ করি না।”

লোকটা তাকিয়ে দেখল অদম্য বেরিয়ে গেল মেইহানে থেকে। তারপর নিজের মনে হেসে পেছনে ফিরে তাকাল।

একটি মেয়ে বসেছিল কয়েকটা টেবল দূরে। লোকটাকে দেখে মেয়েটা হাসল অল্প করে। তারপর পাশে রাখা ব্যাগটা খুলে একটা ল্যাপটপ বের করল। ব্যাগের সামনে লাগানো ছোট্ট স্পাই-ক্যামটার সঙ্গে ব্লুটুথ-এ কানেক্ট করল ল্যাপটপটা। কয়েকটা বাটন টিপতেই ধীরে ধীরে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফুটে উঠল ছদ্মবেশী অদম্যর সদ্য তোলা ছবি।

ছবিটা সিলেক্ট করে একটা প্রোগ্রাম রান করাল মেয়েটা। আর ছবিটা সাধারণ থেকে বদলে গেল থার্মাল ইমেজে। তারপর সেই ইমেজের আউটলাইন ধরে ছদ্মবেশের তলার আসল অদম্যর মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠল ক্রমশ। মেয়েটা নতুন একটা ফাইলে অদম্যর আসল মুখের ছবিটা সেভ করে রাখল। তারপর আবার লোকটির দিকে তাকিয়ে নড করল। লোকটা নিজের ফোনের ব্লুটুথ অন করল।

দশ মিনিট পরে দেখা গেল ইস্তানবুলের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটা কালো সেডান। তার পেছনের সিটে বসে লোকটা ফোনে অদম্যর আসল ছবিটা দেখল আবার। তারপর ইমেলের সঙ্গে অ্যাটাচ করে পাঠিয়ে দিল ইটালির ছোট্ট একটা শহরে। সঙ্গে লিখে দিল, “এনগেজ হিম। অ্যান্ড ফাইন্ড হিজ অ্যাকিলিসেস হিল!- অ্যাজ পার ‘হিজ’ অর্ডার।”

১০

এখন। কলকাতা।

সিএম এতক্ষণ ফোনে কথা বলছিলেন। এবার মোবাইলটা রেখে পুলিশ কমিশনারকে জিজ্ঞেস করলেন, “হোয়াটস হ্যাপেনিং?”

সুরজিৎবাবু চোখ পিটপিট করে বললেন, “ম্যাডাম শহরের সমস্ত ইম্পর্ট্যান্ট ভেনু আমরা গার্ড করার চেষ্টা করছি। কেউ সেখান দিয়ে গলতে পারবে না। ধরিত্রী অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রেও তাই ম্যাডাম। ব্লাস্টটা নিশ্চয়ই আজকের প্ল্যান্ট করা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে হয়নি। আমার মনে হয় বেশ কিছুদিন আগে এটা প্ল্যান্ট করা হয়েছে। খুব শক্তিশালী আইইডি ব্যবহার করা হয়েছে।”

চশমা খুলে এবার বাসুদেববাবুর দিকে তাকালেন সিএম, “কিচ্ছু জানা যাচ্ছে না? গত কয়েকদিনে কারা শহরে ঢুকছে বা কারা পোটেনশিয়াল থ্রেট তার কি কোনও লিস্ট পেলেন না?”

বাসুদেববাবু বললেন, “তেমন অ্যালার্মিং কেউ ঢোকেনি ম্যাডাম। ভয়ঙ্কর কোনও মানুষ ঢুকলে আমরা সোর্স মারফত জানতে পারতাম। বা তেমন হলে ইন্টারপোল বা বিদেশি নানান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো আমাদের খবর দেয়। এবার তেমনও কিছু ছিল না।”

সিএম হাতের পেনটা নিয়ে সামনের পেপারে ডুড্‌ল করতে লাগলেন। বাসুদেববাবু দেখেই বুঝলেন উনি চিন্তা করছেন কিছু।

“ম্যাডাম, চা।” একটা ছেলে এসে ট্রে-তে করে চা নামিয়ে রাখল সিএম-এর পাশে।

সিএম এবার চিফ সেক্রেটারির দিকে তাকালেন, “অ্যান্টনিজির সঙ্গে একটু আগে কথা হল আমার। উনি আসছেন। পিএম ভীষণ চিন্তিত। এমন ন্যাশনাল ক্রাইসিস আগে তো হয়নি! সেন্টার থেকে যা করার করছে। কিন্তু আমার একজনের কথা মনে হচ্ছে। আপনি তার ব্যাপারে পিএমও-র সঙ্গে কথা বলুন আবার। এই ক্রাইসিসে বেস্ট ইন দ্য বিজনেসকেই আমি চাই। তার জন্য যা করতে হয় করুন।”

১১

আদিল কী বলবে বুঝতে না পেরে হাসল শুধু।

বালিগঞ্জ প্লেসের এই বাড়িটা খুব সুন্দর। পুরোনো বাংলো প্যাটার্নের। গোটা কলকাতা জুড়ে সুন্দর পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙে যে ধরনের প্রোমোটারি উত্পাত শুরু হয়েছে তার থেকে এটা একটা ওয়েলকাম ব্রেক!

দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার ভেতরে একটা লন আছে। তাতে কত যে ফুলের গাছ! শাহিনের খুব ফুল পছন্দ। অবশ্য শুধু ফুলই নয়, ওর পেন্টিং, ড্রাইভিং, ট্র্যাভেলিং থেকে শুরু করে আরও কত কী যে পছন্দ!

খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে এসেছে আদিল। বাবা ছিলেন স্কুলমাস্টার। বরাবর একটা মিতব্যয়ী পরিবেশে ও মানুষ। ছোটবেলার এই আত্মসংযমটাই হয়তো ওকে মার্কোস-এর মতো একটা জায়গায় পৌঁছতে সাহায্য করেছে। ডিটারমিনেশন, ডেডিকেশন আর লয়ালটি শিখিয়েছে।

মার্কোস বা মেরিন কমান্ডো ফোর্স হল ভারতীয় নৌবাহিনীর এলিট স্পেশাল অপারেশন ইউনিট। তবে নৌবাহিনীর অংশ হলেও সমস্তরকম জায়গায় এরা কাজ করে। অ্যান্টিটেররিজম-এ এদের সমতুল্য পৃথিবীতে খুব কম ইউনিটই আছে। কাশ্মীর উপত্যকায় এরা বিশেষভাবে সফল। সন্ত্রাসবাদীরা যথেষ্ট সমঝে চলে এদের। আড়ালে “দাড়িওয়ালা ফৌজ” বলে ডাকে। তার কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছদ্মবেশে মিশে থাকতে পারে এই মার্কোসরা।

প্রতি একশোজন অ্যাপ্লিকেন্টের মধ্যে মাত্র দশজন এই ইউনিটের জন্য সিলেক্টেড হয়। আদিল এখনও ভাবে ওর ট্রেনিং পর্বের কথা। এক এক সময় মনে হত যেন মরেই যাবে। বিশেষ করে ট্রেনিঙের শেষের দিকে ওই ডেথ ক্রলটা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়! থাই অবধি কাদায় পঁচিশ কেজি ওজনের স্যুট পরে আটশো মিটার পেরোনো! তারপর সেখান থেকে উঠে আড়াই কিলোমিটারের সেই দুঃসাধ্য দৌড় যাতে পৃথিবীর প্রায় সমস্তরকম বাধা বিপত্তি পেরোতে হয়!

আদিল জানে ওইরকম রগড়ানি না খেলে হয়তো এমন একটা জীবন পাওয়া যায় না। মার্কোসদের একজনই কুড়ি জনের সমান। তাই এই এক থেকে কুড়িটা মানুষ হয়ে ওঠার পথটা তো কঠিন হবেই!

শাহিনদের বাড়ির লোকজন জানে না যে ও মার্কোস। আসলে এটা জানানোও যায় না। শাহিনদের বাড়ির লোকেরা জানে আদিল ইন্ডিয়ান নেভিতে আছে। সেখানে ডেস্ক জব করে।

এখনই বিয়ে করার ইচ্ছে নেই আদিলের। কিন্তু মা এমন করছে যে বাধ্য হয়েছে শাহিনদের এখানে আসতে।

শাহিনের বাবা আর আদিলের বাবা ছোটবেলার বন্ধু। যদিও শাহিনের বাবা খুবই বড় বিজনেসম্যান। কিন্তু নিজের ছোটবেলার বন্ধুকে ভোলেননি উনি। আদিলকে ছোট থেকেই পছন্দ করতেন ভদ্রলোক। তাই এখন নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতেও আগ্রহী।

বহু বছর পর শাহিনকে দেখল ও। আগে শাহিন সুন্দরী তো ছিলই। কিন্তু এখন যেন ইয়ুমথাং ভ্যালির বসন্তকাল চলছে! এত সুন্দর লাগছে শাহিনকে যে ঠিকমতো তাকাতেই পারছে না আদিল।

ওরা বসে আছে শাহিনের ঘরের লাগোয়া বড় ব্যালকনিতে। পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছে আদিল। কী নির্জন চারিদিক! বোঝাই যাচ্ছে না এত ব্যস্ত শহরের মধ্যে বসে রয়েছে ও!

শাহিন বলল, “কী মেঘ করে আছে আজ, না! ইস, কী ডিপ্রেসিভ! ঠিক তোমার মুখটার মতো।”

আদিল বাইরের লনটার দিকে তাকাল। বলল, “দু’ দুটো ব্লাস্ট! কত লোক মারা গেল! শহরটা হাই অ্যালার্ট-এ আছে। সেখানে আমি ছুটি কাটাচ্ছি!”

“তো?” শাহিন এগিয়ে এসে বসল আদিলের পাশে, “একটা ম্যানিয়াক ঢুকে পড়েছে শহরে। পুলিশ, মিলিটারি সবাই তো নেমে পড়েছে! সেখানে তুমি একা কী করবে?”

আদিল কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলে যে ঢুকেছে সে একাই অপারেট করছে বলে মনে হয় ওর। তাই এত ঢাক ঢোল বাজিয়ে তাকে ধরা যাবে না। এই শয়তানটাকে ওয়ান টু ওয়ান কমব্যাটে ধরতে হবে। বেশি লোক দিয়ে ঘিরতে গেলে ও কোণঠাসা হয়ে গিয়ে আরও বড় কোনও সর্বনাশ ঘটাতে পারে!

শাহিন আদিলের শার্টটা ধরে টানল, “কী তখন থেকে ফোঁস ফোঁস করছ? জানো তো মেয়েরা চিরকাল আর্মির লোকজন পছন্দ করে। উই হ্যাভ সামথিং ফর ইউনিফর্মস। তোমার একটা ফুল ইউনিফর্ম-এর ছবি আমায় দেবে?”

আদিল তাকাল শাহিনের দিকে, “টিভিতে বলছে দুটো ব্লাস্ট হয়েছে। সব ক’টা নোন টেররিস্ট আউটফিট এটাকে কনডেম করেছে। বলেছে তারা এমনটা করেনি। তবে কি কোনও নতুন কেউ গজাল? কী চায় সে? ডিমান্ডটা কী?”

“আচ্ছা লোক তো!” শাহিন চোখ পাকাল, “আমি সামনে বসে আছি আর তুমি কার কথা ভাবছ? মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খালি অন্য কথায় পালিয়ে যায়! ভিতু একটা। আমায় নিয়ে আজ বিকেলে ড্রাইভে যেতে হবে তোমাকে।”

“মানে?” আদিল অবাক হল, “এই অবস্থায়?”

“তুমি তো পারবে। তোমার তো আই কার্ড আছে। চলো না। খুব থ্রিলিং হবে। একটা সাইকোপ্যাথ শহরে ঘুরছে আর আমরা রিস্ক নিয়েও প্রেম করছি! দারুণ, না? আমায় কিন্তু অনেক ফুল কিনে দিতে হবে!”

আদিল কী বলবে ভেবে পেল না।

শাহিন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। আদিলের মোবাইলটা মৌমাছির মতো গুঞ্জন করে উঠল এবার।

পকেট থেকে ফোনটা বের করে নম্বরটা দেখল আদিল। ওরে বাবা! বেস থেকে রিং করছে! ও দ্রুত রিসিভ করল কলটা!

ঠিক চার মিনিটের মাথায় ফোনটা কেটে উঠে দাঁড়াল আদিল।

শাহিনও উঠে দাঁড়াল ওর সঙ্গে। জিজ্ঞেস করল, “এখনই ড্রাইভে যাবে?”

আদিল তাকাল শাহিনের দিকে। বড় বড় চোখ। তুলি দিয়ে আঁকা ঠোঁট। নাকের পাশে ছোট্ট একটা তিল। খুব আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

আদিল জানে সব আশা পূরণ হয় না। করা যায় না। ও বলল, “সরি শাহিন। আমায় এখুনি যেতে হবে। কল অফ ডিউটি। বস ডেকেছেন।”

“মানে? আর আমাদের ড্রাইভ?”

“হবে পরে। আই প্রমিস। নাউ প্লিজ়… আই হ্যাভ টু লিভ।”

শাহিনকে আর কথা বলতে না দিয়ে আদিল প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

শাহিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল আদিলের যাওয়ার দিকে। তারপর নিজের মনে বলল, “করে তো ডেস্ক জব। সেখানেও এত ইম্পর্ট্যান্ট কাজ! আশ্চর্য!”

১২

গড়িয়াহাট মোড়ের থেকে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোনও গাড়ি বিজন সেতুর দিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না! ফার্ন রোডের মোড় থেকে পুলিশ আর আধা সামরিক বাহিনী থিকথিক করছে।

এটা যে হবে, অদম্য জানত। এবিপি আনন্দের অফিসটা ওই বাড়িটার কাছেই। ওই অফিসেরও ক্ষতি হয়েছে কিছুটা। তাও ওই চ্যানেলেই এক্সক্লুসিভ ফুটেজ যাচ্ছে ব্লাস্টের। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন খুবলে নিয়েছে বাড়িটাকে।

এমন একটা ব্লাস্টের পর পুলিশকে আরও সতর্ক থাকতে হয়। কারণ বড় একটা ব্লাস্টের পাশাপাশি ছোট একটা বা দুটো ব্লাস্ট করানোটাই টেররিস্টদের স্ট্র্যাটিজি! তবে সেই সময়টা কেটে গেছে।

অদম্য এগিয়ে গেল সামনে। নীল রঙের চাকা লাগানো কিছু লোহার ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা ব্লক করা হয়েছে। এমনিতেই মোড়ের দু’দিকে মাটির নীচের সোয়ারেজের যে বড় ড্রেন রয়েছে সেগুলোকে পরিষ্কার করার কাজের জন্য রাস্তা আটকে আছে। বটল-নেক হয়ে আছে গোটা অঞ্চলটা। তারওপর গাড়ির মেলা আর পুলিশ মিলে পুরো জায়গাটায় যেন গিঁট লাগিয়ে দিয়েছে।

অদম্য ব্যাগের থেকে ক্যামেরাটা বের করল। গলায় ঝুলিয়ে নিল প্রেস কার্ড। অ্যামেরিকান নামী একটা নিউজ পেপারের স্পেশাল করেসপনডেন্ট হিসেবে কার্ডটা তৈরি করা।

“এক্সকিউজ় মি,” অদম্য এগিয়ে গেল সামনের দিকে। পুলিশের অল্পবয়সি একজন এসআই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বুকে নাম লেখা, প্রান্তর ব্যানার্জি।

“বলুন,” প্রান্তর তাকালেন ওর দিকে।

“আমি নিউ ইয়র্ক থেকে আসছি। আমার নাম নিলয় বাসু। স্পেশাল করেসপনডেন্ট। ব্লাস্ট সাইটের দিকে কিছু স্ন্যাপ নেওয়ার ছিল।”

প্রান্তর অবাক হয়ে তাকালেন, “বাঙালি! নিউ ইয়র্ক থেকে! তাও জার্নালিস্ট!”

অদম্য হাসল, “আমরা পৃথিবীর সমস্ত প্রফেশনেই পারকোলেট করে গেছি। একদিন দেখবেন কোনও বাঙালি ইন্টারন্যাশানাল আউট ল এসে পড়েছে এখানে!”

প্রান্তর হাসলেন সামান্য। তারপর বললেন, “যান। তবে বেশি দূর বোধহয় যেতে পারবেন না। ফার্ন রোডের মুখ থেকে সব বন্ধ। ফরেনসিকের লোকজন কাজ করছে।”

অদম্য জিজ্ঞেস করল, “আপনি নিশ্চয়ই স্পট দেখছেন। কী এক্সপ্লোসিভ ইউজ করা হয়েছিল?”

প্রান্তর বললেন, “সি-ফোর বলেই তো মনে হচ্ছে। না হলে এমন ডেভাস্টেশন হয় না! পাশের একটা বাড়িতে গিয়ে আছড়ে পড়েছে দুটো গাড়ি।”

অদম্য জিজ্ঞেস করল, “কেউ কি কোনও রেসপন্সিবিলিটি নিয়েছে? কোনও লিঙ্ক পাওয়া গেছে?”

“দেখুন মিস্টার বাসু, আমি কিছু ডাইভালজ করতে পারব না। সরি। লালবাজারে চলে যান। ওখানে আপডেট দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া, সিটি হাই এলার্ট-এ আছে। কিছু বলা সেফও নয়।”

অদম্য আর কথা বাড়াল না। ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। ভিড়ের মাঝে বেশ কিছু প্রেসের লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ব্লাস্টের সাইট দেখে পাওয়া যাবে না কিছু। আর ডি এক্স যে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা তো নিশ্চিত। ও ভেবেছিল যদি কিছু পেয়ে যায়! কিন্তু কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না! তবে কি লালবাজারে যাবে?

এখন সেপ্টেম্বরের শুরু। আর মাসখানেক পরে পুজো। এমন সময় বাছল শয়তানটা?

ঠোঁট কামড়ে সামনের বিভ্রান্ত ভিড়টাকে দেখল ও। এই কাজটাই ওকে করার কথা বলেছিল না সেই স্কটিশ লোকটা! আর ও এই কাজটা অস্বীকার করায় ফাদারকে গুলি খেতে হয়েছে!

ভেতরে রাগটা পাকিয়ে উঠল আবার। মনে পড়ে গেল আরৎহউস হসপিটালে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটির মুখ।

ফাদার একজন এক্স আর্মি। ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছেন। হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটে দারুণ পারদর্শী। তাই ওর মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই পেছন থেকে লুকিয়ে গুলি করা হয়েছে ফাদারকে!

অদম্যর আবছা কাজগুলোকে সমর্থন করেন না ফাদার। কিন্তু এবার বলেছেন এই শহরে আসতে। বলেছেন, এই শহরটাকে বাঁচাতে।

শহরটাকে বাঁচাতে আর পারল কই ও! কত লোক মারা গেল এইটুকু সময়ের মধ্যে! আরও কত যে মারা যাবে! যদি একবার কোনও উপায়ে ও শয়তানটার হদিশ পায়! শহরের হিসেবের সঙ্গে ফাদারের হিসেবটাও বুঝে নেবে।

“হাই,” মেয়েলি গলার স্বরে চমকে তাকাল অদম্য।

জিনস আর টি-শার্ট পরা একটা মেয়ে। কাঁধে ব্যাগ। হাতে ছোট্ট একটা ক্যামেরা। অদম্য দেখল ওর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা হাসছে।

“ইয়েস?” অদম্য সতর্ক হল। এখানে কোনও রকম ছদ্মবেশ ছাড়াই ঘুরছে ও। কিন্তু এই মেয়েটা আননোন কোয়ানটিটি। হঠাৎ ওর সঙ্গে কথা বলছে কেন?

“আমি জিনি, ক্যান ইউ হেলপ মি?” মেয়েটা হেসে তাকাল ওর দিকে।

“কী ধরনের?”

“আমি এখনও ট্রেনি হিসেবে কাজ করছি। এটাই আমার প্রথম মেজর কেস। তাও দেখুন না, কোনওরকম অ্যাসিস্ট্যান্স দেয়নি আমার বস। এই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা যায়!”

“আপনার কি ছবি লাগবে?”

“নট এগজ়্যাক্টলি। আমি কয়েকটা শট নিয়েছি। আসলে আমার অন্য একটা দরকার আছে।”

“কী সেটা?” অদম্য খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল।

“সরি ফর ডিস্টার্বিং, কিন্তু আমি আপনার প্রেস আইডি-টা দেখেছি। আপনি তো বিশাল জায়গা থেকে এসেছেন! লালবাজারে ব্রিফিং চলছে সময়ে সময়ে। আমি একা গেলে পাত্তা পাব না। প্লিজ, আমায় আপনার সঙ্গে ট্যাগ করে নেবেন?”

আজ সকাল থেকে মেঘ করে আছে বলেই বোধহয় একটা প্রেশার কুকারের মতো গরম বাড়ছে শহরে! অদম্য পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছল মুখটা।

এখানে যে কিছু হবে না সেটা বুঝতেই পারছে অদম্য। কিন্তু লোকটাকে ট্রেস করতে হলে কোথাও থেকে তো শুরু করতে হবে! আর সেটার আদর্শ জায়গা হল লালবাজার। কারণ শয়তানটা যদি কোনওরকম যোগাযোগ করে, তো সেখানেই করবে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনও লাভ হবে না। আর শুধু তাই নয় মেয়েটা সঙ্গে থাকলে কেউ চট করে ওকে সন্দেহও করবে না।

অদম্য হাসল, “ঠিক আছে। চলুন তবে। কিন্তু একটা কথা বলি। আমি এখানে একটা ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম। এমন হবে, তা তো আর জানতাম না। কিন্তু যেই ঘটনাটা ঘটল অমনি অফিস থেকে আমায় কল করল টু কভার দ্য ইন্সিডেন্স। তাই আমার কিন্তু তেমন জানাশোনা নেই।”

“ডোন্ট ওরি,” জিনি হাসল, “চলুন তো। বাই দ্য ওয়ে আমায় আপনি বলবেন না প্লিজ।”

আবার মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল অদম্য। আড়চোখে দেখল জিনি ওর পেছনেই আসছে। হাতে ধরা মোবাইল।

জিনি ফোনের অ্যালবামটা খুলে একটা ফোল্ডার ক্লিক করল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দশটা ছবি। অদম্যর। ন’টা নানারকম মেকআপ-এ আর একটা মেকআপ ছাড়া।

জিনি চোয়াল শক্ত করল। ইন্টারপোলের লোকটা সকালে এই ছবিগুলো দিয়ে গেছে ও-কে। বলেছে, “যদি সাংবাদিকতায় নাম করতে চাও। এই লোকটাকে নজর কোরো। ব্যাটা ব্লাস্ট সাইটে ঘোরাঘুরি করবে আমি জানি। জাস্ট লোকেট করে ওর সঙ্গে জুড়ে যেয়ো। আর কাউকে জানতে দেবে না কিন্তু ও কে। শুধু মনে রেখো কাজটা কমপ্লিট করতে পারলে তোমার লাইফ বদলে যাবে। ছোটখাটো পেপারের অফিসে বা কলকাতায় নয়, সারা পৃথিবীতে ফেমাস হয়ে যাবে তুমি! শুধু ওর সঙ্গে থেকে ওর মুভমেন্টটা নজরে রেখো। আমি ঠিক সময়ে তোমায় ফোন করব। রাখো এই মোবাইলটা।”

লোকটা ওকে একটা ছোট্ট শস্তার মোবাইল দিয়েছিল।

“কিন্তু ও যদি না আসে!” জিনি জিজ্ঞেস করেছিল।

লোকটা হেসে বলেছিল, “আমি ওর প্যাটার্ন জানি। হি ইজ় প্রেডিক্টবল! আর সেটাই ওর দুর্বলতা!”

“কী করেছে লোকটা?” জিনি জিজ্ঞেস করেছিল।

“সব জানতে পারবে। শুধু জেনো এই ব্লাস্টগুলোয় ওর হাত আছে।”

জিনি ওই বড় কোঁকড়া চুলের লোকটার চোখে যেন সবুজ রঙের আগুন দেখতে পেয়েছিল! ছবিগুলো ব্লুটুথে নিজের ফোনে নিয়ে নিয়েছিল জিনি। বলেছিল, “আই উইল ট্রাই। কিন্তু আপনি আমাকেই বাছলেন কেন?”

লোকটা হেসে বলেছিল, “আমরা রিসার্চ ছাড়া কাজ করি না। তুমি পরিশ্রমী, সাহসী। ডিটারমিনেশন আছে তোমার। নামকরা কাউকে আমরা ট্যাপ করতেই পারতাম। কিন্তু ইউ আর মোর হাংরি আই গেস! ঠিক না?”

অদম্যর সামান্য পেছনে হাঁটতে লাগল জিনি। বাইরে না দেখালেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। এই লোকটাই তবে ব্লাস্টের সঙ্গে যুক্ত! একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে হাঁটছে ও! দেখলে তো বোঝাই যাচ্ছে না! রোগা পাতলা, সামান্য বেঁটে মানুষটাকে দেখলে খুবই নিরীহ মনে হয়! বয়সও তো কম। বড়জোর ছাব্বিশ-সাতাশ! এ এমন করতে পারে!

জিনি দ্রুত ভেবে নিল ওর কাজ। ইন্টারপোলের এজেন্টটিকে সবরকম কোঅপারেট করবে ও। এটাই হবে ওর জীবনের স্টেপিং-স্টোন। ছায়ার মতো জিনি লেগে থাকবে লোকটার সঙ্গে। এই ব্যাটাকে সহজে ছাড়বে না ও। কলকাতার সবচেয়ে বড় স্কুপটা হাতছাড়া করবে না কিছুতেই!

১৩

ফোনটা রিং হওয়ামাত্র সুরজিৎবাবু ইশারায় কলটাকে স্পিকারে ট্রান্সফার করতে বললেন।

বড় কাঠের টেবিলটার মাঝখানে রাখা আছে চ্যাপটা প্লেটের মতো স্পিকারটা। লালবাজারের এই কনফারেন্স রুমটা আপৎকালীনভাবে কন্ট্রোল রুমে পরিণত করা হয়েছে। একপাশে সিএম-এর সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রী আর অন্যপাশে সেক্রেটারিরা বসে রয়েছেন। একটু আগেই খবর এসেছে যে দমদম এয়ারপোর্টে নেমে গেছেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, আর অন্য ফ্লাইটে আসছেন র-এর দু’জন অফিসার।

আদিল এই ঘরে ঢুকেই মোটামুটি বুঝে নিয়েছে পরিস্থিতি। সব্বাই খুব টেনস্‌ড হয়ে আছেন। অজানা একজন মানুষ মেরে চলেছে কিন্তু তার কোনও ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না! আসলে এমন পরিস্থিতিগুলোতে পুলিশের সোর্স বা ইন্টেলিজেন্সের থেকে খবর পাওয়া যায়! কিন্তু এখানে তা হয়নি। এই মুহূর্তটির আগে পর্যন্ত কোনও ফোন আসেনি।

শাহিনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আদিল সোজা চলে এসেছে লালবাজারে। সিএম-এর স্পেশ্যাল রেকমেন্ডেশনে ওকে আসতে বলা হয়েছে। গত বছর কলকাতার বুকে যে সাংঘাতিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা আটকাতে আদিলের সাহসের কথা সিএম ভোলেননি।

তাই আদিল এই ঘরে ঢোকামাত্র উনি বলেছিলেন, “হিয়ার ইউ আর। আদিল, আমরা আবার তোমার সাহায্য চাই। তুমি পল্লববাবুর থেকে ব্রিফটা নিয়ে নাও। তোমাকে এই শয়তানটাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”

পল্লববাবু খুব সংক্ষেপে গুছিয়ে আদিলকে বলে দিয়েছেন গোটা পরিস্থিতি। আদিল জানে কোনও লিড-এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া ওর আপাতত করার নেই কিছু।

“মর্নিং,” মার্জিত গলার স্বর শোনা গেল স্পিকারে।

উচ্চারণ শুনে আদিল ঠিক বুঝতে পারল না কোন দেশের মানুষ। তবে যতদূর মনে হল নিজের অ্যাকসেন্ট লুকোবার চেষ্টা করছে লোকটা।

“কে বলছ?” সুরজিৎবাবু ঝুঁকে পড়লেন মাউথপিসের ওপর।

“সেটা নিশ্চয়ই বলব। তবে তার আগে বলুন, কেমন দেখলেন আমার কাজ?”

“কেন করছ এসব কাজ? কে তুমি?” সুরজিৎবাবু ঠোঁট কামড়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি একজন আর্টিস্ট। কেমন চোখের সামনে দিয়ে দুটো মাস্টারপিস তৈরি করে দিলাম! আপনারা বেরসিক দেখছি। বেঙ্গলিরা তো শুনেছি আর্টিস্টের জাত। তারা একটুও অ্যাপ্রিশিয়েট করবে না?”

“বাজে কথা রাখো, কী চাও?” সুরজিৎবাবু এবার কড়া হলেন।

লোকটা হাসল একটু, বলল, “আমার দুটো জিনিস দরকার। জাস্ট টু। আর সেটা না পেলে আমি কী করতে পারি তা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝেছেন? ইচ্ছে করলে আরও বড় কিছু করতে পারতাম। কিন্তু আপনাদের ডিসিশন নিতে যাতে সুবিধে হয় তাই আমি দুটো ইভেন্ট ঘটালাম। মানে এ দুটোকে ক্যাটালিস্ট বলতে পারেন। টু স্পিড আপ ইওর ডিসিশনস।”

সুরজিৎবাবু চোখ দিয়ে কম্পিউটারে বসে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করলেন। আদিল বুঝল কলটা ট্রেস করার কথা জিজ্ঞেস করছেন সিপি। লোকটি ইঙ্গিতে বলল যে, ও চেষ্টা করছে।

“প্রথম ডিমান্ড হল স্টোনটেক কর্প বেঙ্গালুরুতে ওদের যে ট্রেজার ডিসপ্লে করছে সেখান থেকে স্প্যানিশ রোজের ছোট্ট বান্ডেলটা আমার চাই।”

“কী?” সুরজিৎবাবু সিএম-এর দিকে তাকালেন।

দেখলেন সিএম-ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।

“শুনতে পেলেন না? সহজ একটা কাজ। সোনার তৈরি গোলাপের ওপর ছোট্ট ছোট্ট ‘পিজিয়ন ব্লাড’ রঙের রুবি আর মাঝখানে বড় হিরে বসানো। ওই কিং ফিলিপ দ্য ফিফথ-এর আমলের জিনিসটা আমার চাই। সিম্পল!”

এবার সিএম বললেন, “এই জন্য তুমি মানুষ মারছ? শহরের জিনিসপত্র ধ্বংস করছ? এই কারণে? তুমি কি পাগল?”

লোকটি হাসল, “হবে হয়তো। আসলে সব আর্টিস্টরাই তো কিছুটা তাই। যাইহোক, বুঝতেই তো পারছেন কাজটা কত্ত সোজা। সাতটা সোনার ওপর চুনি বসানো গোলাপ! মানুষের জীবনের কাছে তার কী এমন দাম বলুন? ওটা স্টোনটেকের থেকে নিয়ে আমায় দিয়ে দিন। ব্যাস, আপনাদের সিটি পারশিয়ালি বেঁচে যাবে।”

“পারশিয়ালি? মানে?” সিএম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“পারশিয়ালি ম্যাডাম। জাস্ট পারশিয়ালি। কারণ এটা তো আমার প্রথম ডিম্যান্ড। সেকেন্ডটা তো এখনও বলিইনি।”

“কী সেটা?” সুরজিৎবাবু কল ট্রেস করতে থাকা পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে আবার ইঙ্গিত করলেন।

লোকটি ফোনের ওপার থেকে বলল, “ধীরে। সবে তো সকাল এখন। এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? জেনে রাখুন আমরা দু’জন আছি। আমাদের নিজেদের মধ্যে একটু ডিসকাস করে নিতে দিন। আমি আবার দু’ ঘণ্টা পরে ফোন করব।”

“দেখো,” সুরজিৎবাবু আরও কিছুটা সময় নেওয়ার চেষ্টা করলেন, “তোমরা দু’জনেই থাকো বা দুশোজন, এমন কাজ করে কলকাতা থেকে যে পালাতে পারবে সেটা ভাবার কিন্তু কোনও কারণ নেই।”

“থ্যাঙ্কস ফর ইওর কনসার্ন। আমি আবার ফোন করব। বাই দ্য ওয়ে,” লোকটি এবার হাসল, “গুড লাক উইথ ইওর ট্র্যাকিং।”

কট করে কেটে গেল লাইনটা। সুরজিৎবাবু আগ্রহ নিয়ে তাকালেন সামনে কম্পিউটার প্যানেলে বসা অফিসারটির দিকে, “দেখলেন কোথা থেকে কলটা করেছে? ট্রেস হল?”

আদিল দেখল অফিসারটি বিব্রতভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “স্যার টাওয়ার লোকেশন দেখাচ্ছে রোমানিয়া!”

“কী?” ঘরের সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন।

অফিসারটি বললেন, “আসলে স্যার কানেকশনটা মাস্ক করা। তাই এমন দেখাচ্ছে। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে লোকটা ফোনটার অজস্র মিরারড লোকেশন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখেছে।”

আবার ফোনটা বাজল। আদিল অবাক হল খুব। দু’ঘণ্টা তো হয়নি! তবে?

“ইয়েস?” সুরজিৎবাবু কলটা রিসিভ করলেন।

“পেলেন আমার লোকেশন? এসব করে সময় নষ্ট করবেন না। আমার এইসব ভাঙচুর করতে ভাল লাগে না।”

“কেন এসব করছ তুমি? কী চাও আসলে? কে তুমি?” সুরজিৎবাবু প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।

“আমি?” লোকটা নাক টানল সামান্য। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ধরে নিন আমি লুসিয়াস ডোমিটিয়াস আহেনোবারবাস।”

“কী?”

“বড় হয়ে গেল না নামটা?” লোকটা হাসল এবার, “ছোট্ট একটা নামও আছে। পৃথিবীর সব্বাই চেনে সেটা। আপনারাও চেনেন। আমার নাম নিরো।”

১৪

এখন। বেঙ্গালুরু।

দেওয়ালে ঝোলানো এলইডি টিভিটার দিকে চোখ রেখেই ফোনটা রিসিভ করল গোপী। কলকাতায় যা হচ্ছে তাতে টিভির থেকে চোখ সরাতে পারছে না ও!

“হ্যালো।”

“স্যার, কলকাতা থেকে ফোন। চিফ সেক্রেটারি অব ওয়েস্টবেঙ্গল ফোনে আছেন।”

“কে?” গোপী একটু অবাক হল। যেন বুঝতেও কিছুটা সময় লাগল ওর।

“চিফ সেক্রেটারি স্যার। মিস্টার সানজায় মিটরা।”

“পুট হিম থ্রু।”

গোপী টেবিল থেকে রিমোটটা তুলে মিউট করে দিল টিভি। তারপর কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়াল কাচের জানলার কাছে।

ছ’তলার ওপর থেকে সকালের কানিংহাম রোডটা বেশ নিরিবিলি লাগছে। এই শহরটা খুব ভাল লাগে গোপীর। একটা অদ্ভুত রিদম আছে। সঙ্গে খুব র‍্যাশানাল।

“মিস্টার মুরলিরাজন?” সঞ্জয়বাবুর গলাটা চিনতে পারল গোপী।

“ইয়েস স্যার,” গোপী উত্তর দিল।

“আপনি জানেন তো কী হচ্ছে?” সঞ্জয়বাবু খুব মাথা ঠান্ডা মানুষ। গলাটাও তেমনই শোনাল।

“আয়্যাম এক্সট্রিমলি সরি স্যার,” গোপী বলল, “আয়্যাম শক্‌ড। কলকাতার মানুষদের জন্য আমি চিন্তিতও।”

সঞ্জয়বাবু সময় নিলেন একটু তারপর বললেন, “বাট দ্য প্রবলেম হ্যাজ় কাম টু ইওর ডোর টুউ।”

“মিনিং হোয়াট?” গোপী এসে বসল নিজের চেয়ারে, “আমাদের প্রবলেম? মানে?”

“ওই রুবি স্টাডেড রোজেস মিস্টার মুরলিরাজন। স্প্যানিশ রোজেস।”

“মানে?” গোপী উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“মানে, আমাদের অচেনা শত্রুটি সেগুলো চায়।”

মিনিটপাঁচেক পরে সঞ্জয়বাবুর ফোনটা রেখে গোপী চুপ করে বসে রইল একটু সময়। তারপর দ্রুত হাতে ফোন করল একটা। আর কয়েক হাজার মাইল দূরে, ইউরোপের এক ভোরের শহরে বেজে উঠল আর একটা ফোন।

বিছানার পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরলেন স্টোনটেক কর্পের চেয়ারম্যান পিটার ক্রেগ।

১৫

মাস দেড়েক আগে। ব্রাসেলস। সকাল দশটা কুড়ি।

অ্যান রোজ এ সময়টায় একটা কালো কফি এনে দেয় পিটারকে। কিন্তু সেটা লন্ডনে। বেলজিয়ামের এই শহরে আর কী করে ও পাবে অ্যানকে?

মেয়েটা বছর দুয়েক হল ওর সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু দু’ বছরেই এতটা নিজের মতো করে খেয়াল রাখে পিটারের যে অবাক লাগে ওর! মেয়েরা কি এমন একটা নারচারিং ইনস্টিংকট নিয়েই জন্মায়?

নিজের মুখটা একবার দেখে নিল পিটার। ছেষট্টি বছর বয়স হলে কী হবে, ও এখনও তেমন রিঙ্কলস আসতে দেয়নি। বিজ্ঞান বয়সের ছাপকেও আটকে দিচ্ছে!

বেজ রঙের কোটের সঙ্গে নীল টাইটা ভাল মানিয়েছে। ও মনে মনে বলল, “আমি পিটার ক্রেগ, চেয়ারম্যান, স্টোনটেক কর্প। আজ আমার দিন। বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের সামনে আজ আমায় সুন্দর আর কনফিডেন্ট দেখাতেই হবে।”

মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে ওর। এত বড় একটা কাজ এনে দিল ও তাতেও বোর্ডের মেম্বারদের মন ভরে না! শেয়ারের দাম গত দু সপ্তাহে সেভেন্টি পাইভ পারসেন্ট বেড়েছে। কোম্পানির হিস্ট্রিতে এটা রেকর্ড! এর কি কোনও দাম নেই! কাজটা পাওয়ার পর থেকেই বোর্ড মেম্বাররা টিকটিক শুরু করেছে। ফালতু সব লোকজন!

লন্ডন থেকে আসার আগে অ্যান সব ব্রিফ করে দিয়েছে ওকে। প্রেজেন্টেশনও রেডি করিয়ে দিয়েছে। এবার থাম্ব ড্রাইভাটা শুধু কম্পিউটারে লাগিয়ে গোটা বিজনেস গ্রাফের রাইজটা দেখাতে হবে।

পিটার হাসল মনে মনে। ওর মনে পড়ে গেল জিউস-এর সিইও-র মুখটা। কলকাতার কাজটা হারাবার পর দেখে মনে হচ্ছিল বেচারাকে আইটিইউ-তে ভর্তি করতে হবে।

তবে সতর্ক থাকতে হবে খুব। পিটার জানে জিউস গ্রুপ এত সহজে হার মানবে না। ওরা কলকাঠি নাড়িয়ে কলকাতার কাজটা পণ্ড করতে চাইবে। ও শুনেছে প্রজেক্টের ভায়াবিলিটি নিয়ে নাকি ওরা প্রশ্ন করছে! আজ বোর্ড অব ডাইরেক্টরস-এর মিটিঙে এটা নিয়েও কথা বলতে হবে ওকে। বলতে হবে কাজটা শুধু পেলেই হবে না, সেটা সম্পূর্ণ করাটাও তো শিখতে হবে! কারণ আজ প্রজেক্টের ভায়াবিলিটি নিয়ে কথা বলছে ওরা। কিন্তু কাজটা বানচাল করতে কাল যে অন্য কিছু করবে না তার কি কোনও গ্যারান্টি আছে!

১৬

এখন। কলকাতা।

ভিড়ের সামনে এগিয়ে যেতে যেতে অদম্য একবার পেছনে ফিরে দেখল। জিনি ওর সঙ্গেই আছে। লালবাজারের এই করিডরটায় পুলিশ আর সাংবাদিকদের ভিড় উপছে পড়েছে।

একটু ধাক্কাধাক্কিও হচ্ছে। কলকাতা যে পৃথিবীর একদম আকর্ষণ বিন্দু হয়ে গেছে এই মুহূর্তে!

বারান্দার এক প্রান্তে একটা উঁচু ডেস্ক রাখা আছে। তার ওপর রাখা আছে এক গোছা মাইক্রোফোন। অদম্য যতটা পারল তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

যে শয়তানটা এ সব করে যাচ্ছে তার হদিশ ও জানে না। কেউই জানে না। এই শহরে কোথাও যদি তার হদিশ পাওয়া যায়, সেটা যাবে ওই কন্ট্রোল রুমের ভেতর থেকে। কিন্তু ওকে তো আর ওর ভেতরে ঢুকতে দেবে না!

অদম্য সামনে তাকাল। সবুজ হাফ হাতা পাঞ্জাবি পরে যিনি এগিয়ে আসছেন তাকে ও চেনে। শ্রীপার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিল্পমন্ত্রী।

এমন একটা বিপদে সবাই যে কন্ট্রোলরুমে গিয়ে জড়ো হবেন সেটাই স্বাভাবিক!

পার্থবাবু এসে দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। মুখটা বিষণ্ণ, চিন্তিতও।

সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্লিজ আপনারা একটু চুপ করুন। আমি একটা স্টেটমেন্ট পড়ব শুধু। এখনই কোনও প্রশ্ন করবেন না। কারণ বলার মতো কিছু ডেভলপমেন্ট হয়নি এখনও।”

“স্যার, জানা গেল কে এমনটা করছে? তার ডিমান্ড কী? লোকজন কি রাস্তায় বেরোতে পারে সেফলি? দিদি কি টিভিতে কিছু বলবেন?” পেছন থেকে প্রশ্ন এল।

“প্লিজ” পার্থবাবু হাত তুললেন, “আপনাদের এটুকুই বলছি, আমাদের সম্পূর্ণ স্ট্রেংথ আমরা ডিপ্লয় করেছি। শহরের সমস্ত কিছু আমরা নজরে রাখছি। এর বেশি কিছু বলা যাবে না। কারণ আমাদের সার্চ প্রসেসটা তা হলে কমপ্রোমাইজড হয়ে যেতে পারে! ফর আওয়ার সিটি অ্যান্ড কান্ট্রি’জ় সেক, আপনারা ব্যাপারটা বুঝুন।”

অদম্য দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। স্বাভাবিক। এর বাইরে আর কী-ই বা বলতে পারেন পার্থবাবু। সকাল থেকে যা হচ্ছে তা তো আর এই একটু সময়ের মধ্যে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়।

এই ধরনের ক্রিমিনালদের মোডাস অপারেন্ডি জানে অদম্য। জানে এরা সামনে আসে না। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করে। একটা কোনও ফ্যাকশনের লোক হলে তাকে ট্রেস করা সম্ভব। কিন্তু একা কেউ অপারেট করলে এই এত্ত বড় শহরে তাকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

পার্থবাবু তাঁর স্টেটমেন্টটা পড়লেন। মানুষজনকে প্যানিক না করতে বললেন। বললেন, সরকার সমস্ত চেষ্টা করছে। অনুরোধ করলেন কেউ গুজব রটাবেন না বা গুজবে কান দেবেন না। সব শেষে বললেন যে স্পেশাল হেলপ লাইন খোলা হয়েছে। কেউ যদি কোনও সন্দেহজনক কিছু দেখেন যেন সঙ্গে সঙ্গে হেলপ লাইনের নম্বরে ফোন করেন।

নম্বরগুলো বলে পার্থবাবু টিভি চ্যানেল থেকে যারা এসেছেন, তাদের অনুরোধ করলেন এগুলো যেন এক্ষুনি প্রচার করে দেওয়া হয়।

কথা শেষ করে পার্থবাবু আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন দূরের কন্ট্রোল রুমের দিকে।

পেছন পেছন বেশ কিছু সাংবাদিক এগিয়ে গেলেন। প্রশ্নও করলেন কিন্তু একটা জায়গার পর পুলিশ তাঁদের আটকে দিল।

অদম্যও এগিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন করতে নয়!

বাকি সাংবাদিকরা ফিরে এলেও অদম্য দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আচমকা নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা পেন কুড়িয়ে নিয়ে সামনে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটিকে বলল, “পার্থবাবুর পকেট থেকে পেনটা পড়ে গেছে। একটু দিয়ে দেবেন কাইন্ডলি।”

পুলিশ অফিসারটি সামান্য হেসে পেনটা নিলেন। তারপর পেছনে দাঁড়ানো রোগা অল্পবয়সি একটা ছেলেকে ডেকে বললেন, “গোপাল এটা ওই ঘরে স্যারকে গিয়ে দিয়ে আয় তো। পড়ে গেছে ওঁর পকেট থেকে।”

গোপাল ঘরে ঢুকে দেখল পার্থবাবু সিএম-এর সঙ্গে কথা বলছেন কিছু। ও ইতঃস্তত করল। মাঝখানে কি কথা বলা ঠিক হবে?

ও তাকাল এদিক ওদিক।

ফিরহাদ হাকিম বসেছিলেন সামনেই। জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলবে ভাই?”

গোপাল পার্থবাবুকে দেখিয়ে বলল, “স্যারের পেনটা পড়ে গিয়েছিল। তাই…”

ফিরহাদ সাহেব পেনটা নিয়ে বললেন, “আমি দিয়ে দেব।”

তারপর ঘরের মাঝখানের যে টেবিলটা ঘিরে বসেছিলেন সবাই তাতে রেখে দিলেন পেনটা।

লালবাজারের গেটের বাইরে এসে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াল অদম্য। জিনি, টিভি থেকে আসা আর এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছে। ছেলেটা হেসে হেসেই কথা বলছে জিনির সঙ্গে। বুঝতে পারছে দু’জনে দু’জনকে চেনে ভাল।

অদম্য কানের ভেতর ছোট্ট মটর দানার মতো ইয়ারপিসটা গুঁজে নিল ভাল করে। শুনল তাতে সিএম-এর গলা।

সিএম জিজ্ঞেস করছেন, “মিস্টার মুরলিরাজন কি কিছু বললেন?”

সঞ্জয়বাবু উত্তর দিলেন, “ম্যাডাম উনি অলরেডি ফ্লাইটে আছেন।”

অদম্য চোয়াল শক্ত করল। পেনের ভেতরের মাইক্রোফোনটা খুব জোরালো। টোকিও থেকে কিনেছিল গত বছর। আজ কাজে দিল।

কিন্তু মুরলিরাজনটা কে?

জিনিকে দেখল অদম্য। এখনও কথা বলে চলেছে। ও ভাবল, মেয়েটাকে কি সঙ্গে রাখবে, নাকি কাটিয়ে দেবে? পরে কি ওর কোনও কাজে লাগতে পারে মেয়েটা?

১৭

আদিল দেখল গোপীকে। লম্বা, অ্যাথলেটিক বিল্ড। গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার। চোখে মুখে প্রবল কনফিডেন্স। তাও টেনশনটা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট।

গোপী ঘরে ঢোকামাত্র সবার চোখ চলে গেছে ওর দিকে। এবার বাসুদেববাবু এগিয়ে গেলেন। তারপর নিজের ও বাকি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

সিএম-এর পাশের চেয়ারে হাতের ব্রিফকেসটা রেখে গোপী সবাইকে নমস্কার করল।

“আর কোনও ফোন এসেছে?” গোপী সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল।

“না,” সুরজিৎবাবু চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়লেন, “বলল দু’ ঘণ্টা পরে কল করবে কিন্তু সাড়ে তিন ঘণ্টা কেটে গেল!”

“তার মানে আর কোনও ডিমান্ড আসেনি!” গোপী তাকাল সবার দিকে।

সঞ্জয়বাবু বললেন, “আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনি ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছেন!”

“হ্যাঁ, আমি আমাদের চেয়ারম্যান মিস্টার পিটার ক্রেগকে ফোন করলাম লন্ডনে। উনি সব শুনে বললেন দ্রুত চলে যেতে। তাই চার্টার্ড ফ্লাইটে এসেছি। আসলে আমি তো বুঝতেই পারছি না এসব কী হচ্ছে! তাও ওই স্প্যানিশ রোজের জন্য!”

“কী বলি বলুন তো! পৃথিবীতে তো সাইকোপ্যাথের কোনও অভাব নেই!”

সুরজিৎবাবু আরও কিছু বলার আগেই ফোন এল একটা। দু-একটা কথা বলেই ফোনটা রেখে সিপি বললেন, “অ্যান্টনিজি এসে গেছেন,” তারপর গোপীর দিকে তাকালেন, “ইনি আসার পর আলোচনাটা হোক।”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এ কে অ্যান্টনি ঘরে ঢুকলেন।

সামান্য প্লেজেন্টারিজের পর অ্যান্টনিজি জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম, কে নেগোশিয়েট করছেন?”

সিএম সুরজিৎবাবুকে দেখিয়ে বললেন, “উনি কথা বলছেন। তবে পরের ফোনটা আসেনি এখনও। উই আর ওয়েটিং। আসলে গোটা অবস্থাটাই খুব প্যাঁচালো! তার সঙ্গে আবার ফোনটার লোকেশনও ডিটেক্ট করা যাচ্ছে না।”

অ্যান্টনিজি বললেন, “‘র’-এর অফিসাররা আসছেন। ওরাও দিল্লিতে কথা বলেছে। কিন্তু খুব অ্যালার্মিং কোনও টেররিস্টের দেশে ঢোকার খবর পাওয়া যায়নি। তা, ডিমান্ড রেখেছে কিছু?”

সুরজিৎবাবু ঠোঁট কামড়ে শুনছিলেন। এবার বললেন, “আপাতত একটা স্যার। স্প্যানিশ রোজ়।”

“হোয়াট?” অ্যান্টনিজি অবাক হলেন।

এবার কথা বলল গোপী। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “স্যার আমাদের স্টোনটেক আন্ডার সি মাইনিং-এ পাইওনিয়ার কোম্পানি। অ্যাফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে সেই এরকমই একটা কাজের সময় আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ১৭১৫-তে ডুবে যাওয়া কয়েকটা স্প্যানিশ জাহাজ। রাজা পঞ্চম ফিলিপের ফ্লিট ছিল ওটা। সেখানে অনেক কিছু আমরা পেয়েছি। সেগুলো সারা পৃথিবীতে শো-কেস করছি ঘুরে ঘুরে। মাস দুয়েক আগে লন্ডনে ছিল প্রথম ইভেন্ট। তারপর দুবাইতে হয়েছে। এবার বেঙ্গালুরুতে হচ্ছে।”

“কিন্তু রোজ়ের ব্যাপারটা কী?”

“রোজ়গুলো হল, রানির জন্য নিয়ে যাওয়া সাতটা সোনার গোলাপ ফুল। যার পাপড়িগুলো জুড়ে বসানো রয়েছে ছোট ছোট ‘পিজিয়ন ব্লাড’ রঙের চুনি! আর মাঝখানে একটা বড় ডায়মন্ড! দূর থেকে দেখলে যাকে মনে হয় ঝলমলে গোলাপ ফুল। আর প্রতিটা পাপড়ির তলায় পঞ্চম ফিলিপের এমব্লেম খোদাই করা।”

“আচ্ছা! কত কস্ট হবে?” অ্যান্টনিজি অবাক হলেন।

সিএম বললেন, “দাম তো ভালই হবে মিস্টার অ্যান্টনি। অ্যান্টিক পিস বলে কথা! তারওপর আবার মিসিং পিস অব হিস্ট্রি!”

“এগজ়্যাক্টলি ম্যাডাম,” গোপী গলার টাইটা আলগা করল, “এক একটা রোজ় প্রায় হাফ মিলিয়ান ডলার হবে! মানে অন্তত ইনশিওরেন্স কোম্পানি তো তাই বলেছে।”

“তার মানে থ্রি পয়েন্ট ফাইভ মিলিয়ন!” সিএম মাথা নাড়লেন, “এর জন্য এত বড় অ্যাটাক!”

সঞ্জয়বাবু অ্যান্টনিজিকে বললেন, “এগুলোই ওই টেররিস্টটি মানে নিরো, চেয়েছে।”

“বাট উই কান্ট নেগোশিয়েট উইথ আ টেররিস্ট, না?”

“নেগোশিয়েট নয় মিস্টার অ্যান্টনি। কিন্তু অবস্থাটাও তো দেখবেন! কলকাতায় যা হল, তা নাইন ইলেভেনের চেয়ে কি কম? তবে,” সিএম তাকালেন গোপীর দিকে, “জিনিসটা স্টোনটেক-এর। ওঁরা কী করবেন, সেটা ওঁরাই জানেন। আমরা আমাদের প্লাইটটা ওঁদের সামনে রেখেছি মাত্র!”

গোপী বলল, “ম্যাডাম আমাদের আপনারা ব্রিজের কাজটা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের চেয়ারম্যান আমায় বলেছেন সবরকমের কোঅপারেট করতে। তাই…”

গোপী কথা শেষ না করে পাশের চেয়ারে রাখা ব্যাগটা টেবলে তুলল। তারপর তাকাল সবার দিকে।

আদিল দেখল সবাই গোপীর ব্যাগটাকেই দেখছে।

ব্যাগ খুলে গোপী একটা কালো ভেলভেটের থলে বের করল। তারপর আর একটা নীল চৌকো ভেলভেটের রুমাল পাতল টেবলে। এবার থলির জিনিসগুলো উপুড় করে দিল রুমালটার ওপর।

পায়চারি থামিয়ে এগিয়ে এলেন সিএম। নিমেষের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেল ঘরটা। সবার চোখের সামনে ঝলমল করে উঠল রাজা পঞ্চম ফিলিপের উপহার। ক্যারামের ঘুঁটির ব্যাসের সাতটা অসাধারণ গোলাপ! স্প্যানিশ রোজ়। কলকাতার আংশিক মুক্তিপণ!

১৮

লালবাজারের উলটো ফুটপাথে গিটারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল অদম্য। সব কথা স্পষ্ট শুনেছে ও। এমন কী এটাও শুনেছে যে ক্যারামের ঘুঁটির ব্যাসের গোলাপগুলোর দাম নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অ্যান্টনিজি।

কিন্তু ওইটুকুই। এতে তো কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না! কোথায় নিরো?

নিরো! নামটা খুব অদ্ভুত বেছেছে! কুখ্যাত রোমান সম্রাট! যে করেই হোক একে ধরতে হবে। ফাদারকে করা গুলির হিসেব নিতে হবে!

“চা খাবেন?” জিনি একটা প্লাস্টিকের ছোট্ট কাপ নিয়ে এল, “কী ব্যাপার বলুন তো! সকালে পর পর দুটো ব্লাস্ট হল! তারপর সব চুপচাপ! কোথায় ঘাপটি মারল লোকটা? আপনি জানেন?”

“আমি?” অদম্য চট করে তাকাল জিনির দিকে। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল, “জানলে কি এখানে দাঁড়িয়ে সরকারের নেক্সট স্টেটমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতাম! ওই ছেলেটা কে?”

জিনি বলল, “এবিপি আনন্দতে আছে। মনোজ। আমার পুরনো বন্ধু। আমরা দু’জনেই যাদবপুর। আপনি কোথা থেকে পাশ করেছেন? নিশ্চয়ই বিদেশি কোনও ইউনিভার্সিটি থেকে?”

অদম্য উত্তর না দিয়ে হাসল। বলল, “দাও চা-টা খাই।”

জিনি ভাল করে দেখল অদম্যকে। নেহাতই মামুলি চেহারা! এ খতরনাক লোক! সবুজ চোখের সেই ইন্টারপোল এজেন্ট তো তাই বলল। কিন্তু কেন একে তবে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছে না! নিজেই বা উপস্থিত হচ্ছে না কেন! কে জানে এদের পদ্ধতি কী!

অবশ্য এজেন্ট লোকটা বলেছিল এই নিলয় বাসু নামে ছদ্ম-সাংবাদিকটি হল দড়ি। এর গতিবিধি নজরে রাখলে সেটা মাস্টার-মাইন্ডের কাছে পৌঁছে দেবে ওদের।

এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে যে ও পড়বে কোনওদিন ভাবতেই পারেনি জিনি। এজেন্টটি ওকে একটা শস্তার মোবাইল দিয়েছে। বলেছে টার্গেটকে খুঁজে পেলে যেন একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেয়!

গড়িয়াহাট থেকে লালবাজারে আসার পথেই সেটা করেছে জিনি। এবার ওকে অপেক্ষা করতে হবে! ইন্টারপোলের ওই সবুজ চোখের মানুষটা থেকে কী খবর আসবে সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ওকে!

ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে, ও জানে! কিন্তু এই রিস্ক না নিলে নিউজটা করবে কী করে? এমন একজন টেররিস্টের সঙ্গে সময় কাটানো, ইন্টারপোলের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা, আর শেষমেশ সেই টেররিস্টসহ কলকাতায় গণ্ডগোলের মূল পাণ্ডাকে ধরা! কেরিয়ারটা কোন পিকে যে উঠবে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর!

জিনি দূরে চায়ের দোকানে দাঁড়ানো অদম্যকে দেখল। তারপর জিনসের পকেট থেকে লোকটার দেওয়া মোবাইলটা বের করল। কখন আসবে ফোন! কখন ও ব্রেক করবে জীবনের সবচেয়ে বড় নিউজটা!

১৯

সিএম আদিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার কি কোনও আইডিয়া আছে, কীভাবে আমরা এই নিরোকে রিচ করতে পারি!”

আদিল উত্তরটা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বেজে উঠল ফোনটা। ঘরের সবাই এক সঙ্গে চুপ করে গেল। সুরজিৎবাবু সবার দিকে তাকিয়ে নিলেন একবার, তারপর রিসিভ করলেন কলটা!

“সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল,” নিরোর গলা শান্ত।

“তুমি এমন করছ কেন?” সুরজিৎবাবু কিছু বলার আগেই অ্যান্টনিজি প্রশ্নটা করলেন।

“আই গেস আপনি ইন্ডিয়ার ডিফেন্স মিনিস্টার! রাইট?” নিরো হাসল।

অবাক লাগল আদিলের। গলা শুনে বুঝে গেল নিরো!

নিরো বলল, “আমি তো বলেছি আমার কী চাই। ওই স্প্যানিশ গোলাপ। আর…”

“আর কী?” সিএম কঠিন গলায় বললেন, “তুমি কী ভেবেছ, এমন করে হুমকি দিয়ে, ধমকে যা ইচ্ছে তাই করবে! তোমার খামখেয়ালের জন্য জানো কত লোকের মৃত্যু হয়েছে? এখনও সময় আছে, ধরা দাও। আমি কথা দিচ্ছি, যতটা সম্ভব আমরা লিনিয়েন্ট থাকব।”

“প্লিজ়, আমার জন্য আপনাদের এতটা চিন্তিত হতে হবে না!” নিরোর গলাটা শক্ত হল, “আমার সেকেন্ড প্রস্তাবটা এবার দেওয়ার সময় হয়েছে। আশা করি গোপী মুরলিরাজনও এসে গেছেন।”

“ইয়েস,” গোপী কঠিন গলায় বলল, “তোমার রোজ়ও নিয়ে এসেছি আমি। নাও হ্যাভ দ্যাট অ্যান্ড গেট দ্য হেল আউট অফ হিয়ার।”

“কুল ইট মাই ডিয়ার। এত রাগ দেখাতে নেই! রাগ আয়নার মতো, একজন দেখালে সামনের জনেরও একই রিঅ্যাকশন হয়! মনে আছে তো আমার নাম কী? নিরো। ভুলে গেছেন, সে কেমন সম্রাট ছিল! যার নিজের মা’কে মারতে হাত কাঁপেনি, তার কি অন্যকে মারতে হাত কাঁপবে?”

“কী চাও?” সিএম কথা বাড়াতে দিল না নিরোকে।

“সিম্পল একটা জিনিস ম্যাম। একটা ওয়ার্ক অর্ডার ক্যানসেল করতে হবে।”

“মানে?”

নিরো সময় নিল একটু। তারপর বলল, “গঙ্গার ওপর যে নতুন ব্রিজটার ওয়ার্ক অর্ডার আপনারা স্টোনটেক কর্পকে দিয়েছেন, সেটা ক্যানসেল করতে হবে।”

“হোয়াট ননসেন্স!” সিএম বিরক্ত হয়ে হাতের পেনটা সজোরে রাখলেন টেবিলে, “এর মানে? ক্যানসেল করতে হবে মানে? এর জন্য তুমি মানুষ মারছ? একটা সিটিকে হসটেজ করছ?”

“ননসেন্স নয় ম্যাম। আমি ননসেন্স ক্রিয়েট করি না। প্লিজ চুজ ইওর ওয়ার্ড ওয়াইজলি।”

“উই আর,” এবার আচমকা আদিল কথা বলে উঠল, “আমরা ঠিকই বলছি। আমি এমন কারও সঙ্গে ডিল করতে চাই না যে কাওয়ার্ড!”

“কাওয়ার্ড!” নিরো থমকাল একটু, “আমি? নিরো?”

“নয়তো কী?” আদিল ঠান্ডা গলায় বলল, “নিরীহ মানুষকে মারো তুমি! আড়ালে থেকে আঘাত করো! জানো অ্যাপার্টমেন্টের বিস্ফোরণে আটজন শিশু মারা গেছে! তুমি যা চাও, তার জন্য এত নীচে নামতে হবে? যে বাচ্চাদের মারে সে শুধু ভিতুই নয়, জানোয়ারও।”

নিরো চুপ করে রইল একটু। তারপর বলল, “কী চান আপনারা? আমায় ঠেকাতে চান্স চান! পারবেন না।”

“যে লুকিয়ে থাকে কাপুরুষের মতো তার থেকে কী চাইব?”

“কলকাতার দুটো পয়েন্ট এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। সামনে কোথায় কী করব, আপনারা জানেন না। তাও এভাবে কথা বলছেন! আমি প্রফেশনাল। এসব নাটক ভাল লাগে না। আকাশ থেকে মারতে মারতে নামছি।” ঠান্ডা গলায় রাগকে আটকাল কোনও মতে, “আই উইল শো ইউ দ্য হেল। এবার নরক দর্শন করতে হবে আপনাদের। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেইখানেই এবার নরক তৈরি করব। আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, পারলে আমায় খুঁজে বের করুন, আটকান।”

“কিন্তু,” সঞ্জয়বাবু বললেন, “আপনার সেকেন্ড ডিমান্ডটা…”

“সেটা ফুলফিল না করতে পারলে এমন ঘটনা ঘটবে যে, সারা পৃথিবী আজ থেকে হাজার বছর পরেও মনে রাখবে এই দিনটা। আর আমি যে ফাঁকা কথা বলছি না, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”

আর কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইনটা কেটে দিল নিরো।

ঘরের ভেতরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল একদম!

সামান্য পরে অ্যান্টনিজিই প্রথম কথা বললেন, “আদিল, এটা কী হল? প্রোটোকল ভেঙে এভাবে কথা বলার মানে? আর কেন ওকে এমন অ্যাগ্রাভেট করলে! এর কনসিকোয়েন্স কী হতে পারে ভেবেছ?”

আদিল মাথা নামিয়ে বলল, “সরি স্যার। আসলে ওকে যদি না খোঁচাতাম ও বেরোত না। কী করতে পারে তার কোনও ধারণাই পেতাম না। যে যত বড় ক্রিমিনালই হোক, অসাবধানতা আর অহংকার কখনও কখনও তার পতন ঢেকে আনতে পারে।”

“মানে?” সিএম অবাক হলেন।

“ম্যাডাম,” আদিল বলল, “একটু আগে সিপি স্যারের সঙ্গে কথা বলে আমি জেনেছি যে বিশাল বড় আরডিএক্স বা সেমটেক্স-এর কন্সাইনমেন্ট শহরে ঢুকেছে এমন কোনও খবর পুলিশের কাছে নেই! অলরেডি দুটো বড় ব্লাস্ট হয়েছে। থার্ড এমন কোনও ব্লাস্ট করার মতো ফায়ার পাওয়ার ওর কাছে আছে কিনা আমরা জানি না। থাকলে, সেটা যদি আমরা আটকে দিতে পারি তবে আমি শিওর তারপরে ওর করার মতো আর কিছু থাকবে না।”

“কিন্তু থার্ড ব্লাস্ট হলে কোথায় হবে সেটা জানব কী করে?” পার্থবাবু চশমাটা ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন।

আদিল সেই উত্তর না দিয়ে তাকাল কম্পিউটারে বসা অফিসারটির দিকে। বলল, “আপনি নিশ্চয়ই রেকর্ড করেছেন সব কনভার্সেশন?”

অফিসারটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

আদিল বলল, “একবার লাউড করে, যথা সম্ভব নয়েজ স্টেবল করে চালান।”

অফিসারটি সাউন্ড ফাইলটা বের করে সেটা অন করলেন। নিরোর কথা শোনা যাচ্ছে।

আদিল এগিয়ে গেল প্যানেলের দিকে। তারপর ট্র্যাকার বলে হাত রেখে সামনে পিছনে করে নিরোর কথার অংশগুলো শুনল বেশ কয়েকবার।

“কিছু পেলে?” সিএম-ও উঠে এসে দাঁড়িয়েছেন আদিলের পাশে।

আদিল বলল, “ম্যাডাম ভাল করে শুনুন। ওর কথার পিছনে কী শুনতে পাচ্ছেন?”

“ওর কথার পেছনে?” সিএম স্পিকারের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, “রাস্তার শব্দ… গাড়ি, আর…”

“আর গান ম্যাডাম,” আদিল এবার তাকাল সুরজিৎবাবুর দিকে, “স্যার, প্লিজ় খবর নিন মেট্রো স্টেশনগুলোর পাশে কোথায় কোথায় মিটিং বা সেরকম কিছু হচ্ছে!”

সুরজিৎবাবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলেন ঘরের আর একদিকে।

অ্যান্টনিজি বললেন, “বাট, মেট্রো স্টেশনই কেন?”

আদিল বলল, “স্যার, ‘আকাশ থেকে মারতে মারতে নামছি। স্কাই ডান্স, ধরিত্রী অ্যাপার্টমেন্ট, এরপর…’ এই অবধি বলে থেমেছিল ও। কারণ বেঁফাস কিছু বলতে গিয়েছিল। কিন্তু কী সেটা? আকাশ মানে স্টেডিয়াম, তার নীচে মাটি, মানে মাল্টিস্টোরেড। আর তার নীচে?”

“মেট্রো,” সিএম ঠোঁট কামড়ে তাকালেন সুরজিৎবাবুর দিকে, “পেলেন কিছু?”

সুরজিৎবাবু বললেন, “ইয়েস ম্যাডাম। যতীন দাস পার্ক মেট্রোর পাশের যতীন দাস শিশু উদ্যানেই একটা ছোট্ট সভা হচ্ছে।”

“এই অবস্থায়?” সিএম উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।

“ম্যাডাম, ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প। পারমিশন ছিল। তাই…”

আদিল বলল, “স্যার আমায় ওখানে যেতে হবে।”

সুরজিৎবাবু বললেন, “বম্ব ডিজপোজ়াল স্কোয়াডও যাবে। আর আমি ওখানে অ্যালার্ট করে দিচ্ছি পুলিশকে। আশপাশটা এভাকুয়েট করাতে বলছি দ্রুত।”

অ্যান্টনিজি বললেন, “কী করে লোকটা এমন করে জাল ছড়াল?”

কেউ উত্তর দিলেন না। কিন্তু আদিল জানে একা এবং এফিশিয়েন্ট কোনও টেররিস্ট যদি জনবহুল শহরে গেরিলা অপারেশন করতে চায়, তাকে আটকানো কঠিন! আর নিরো তো বলছে ওরা দু’জন আছে! ফলে কাজটা আরও সহজ ওদের কাছে।

পার্থবাবু বললেন, “আদিল, যদি আপনার অনুমান ভুল হয়?”

আদিল নিজের পিস্তলটা দেখে নিয়ে বলল, “স্যার, চান্স তো নিতেই হবে। আর ভাবুন যদি ঠিক হয়! তবে নিরোকে আমরা এটা বোঝাতে পারব যে ও নিজেকে যতটা আনবিটেন ভাবছে ততটা ও নয়। বোঝাতে পারব আমরা যখন বোমাটা ডিফিউজ় করতে পেরেছি, তখন ও নিজেও সেফ নয়।”

২০

দোকানটা ছোট। জিনিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে এসে ঢুকেছিল অদম্য। একটা গেমস পার্লার এটা। অদম্য ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করেছিল বাথরুমটা কোথায়! কাউন্টারে বসে থাকা লোকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল একটু। তারপর দেখিয়ে দিয়েছিল।

বাথরুমে ঢুকে অদম্য বুঝতে পেরেছিল এখানে হবে না। কারণ পেছনের কোনও দরজা নেই! ও কানে লাগানো ছোট্ট ইয়ার পিসটা দিয়ে শুনতে পাচ্ছিল লালবাজারের কন্ট্রোল রুমের ভেতরে কী কথা হচ্ছে!

বুঝতে পারছিল আদিল একা পারবে না। ওকে যেতে হবে। আর শুধু গেলেই হবে না ব্যাপারটা আটকাতে আদিলকে সাহায্য করতে হবে! কিন্তু কীভাবে? জিনিকে তো আগে কাটাতে হবে।

তবে কিছু করার আগে আবার চিন্তা করেছিল অদম্য। পরে যদি জিনিকে কাজে লাগে! এই ছোট্ট দোকানটায় ঢোকার আগে জিনির ব্যাগের ভেতর একটা জিপিএস ট্র্যাকার ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে অদম্য। পরে জিনিকে খুঁজে পেতে কাজে লাগবে এটা।

বাথরুমটায় ঢুকে অবস্থাটা বুঝে নিয়েছিল ও। বাথরুমে কোনও পেছনের দরজা নেই! তবে একটা জানলা আছে। পুরোনো দিনের বাড়ি বলেই হয়তো কাঠের শিকওলা জানলা।

দ্রুত ভেবে নিয়েছিল অদম্য। হাতের ক্যামেরাটার তলার ছোট্ট বোতামটায় চাপ দিয়েছিল একবার। পিং শব্দে খুলে গিয়েছিল একটা খোপ। তার ভেতর থেকে একটা ফোল্ডেড টাইটেনিয়াম ব্লেড বের করেছিল ও।

জাস্ট আটচল্লিশ সেকেন্ড লেগেছিল দুটো কাঠের শিক কাটতে।

জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়েই একটা ছোট্ট গলি। তার ভেতর দিয়ে দ্রুত দৌড়ে গিয়েছিল ও। একটু দেরি হলেই জিনি হয়তো খুঁজতে শুরু করবে। সেটার আগেই এ তল্লাট থেকে সরতে হবে ওকে। না হলে যতীন দাস পার্ক স্টেশনে যাওয়া নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন শুনতে হবে ওকে!

দোকানটার সামনে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট। সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে জিনি।

অদম্য দোকানের পেছনের গলি দিয়ে বেরিয়ে দৌড়ে মার্কেন্টাইল বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে উঠেছিল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। আর সেখানেই ও পেয়ে গিয়েছিল ওর উপায়!

কলকাতার মোড়ে মোড়ে আজ পুলিশের চেক পোস্ট। সেখান দিয়ে দ্রুত যাওয়া মুশকিল। অদম্য ভাবছিল তবে উপায় কী!

ফুটপাথের পাশেই একটা অ্যাম্বুলেন্সকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল ও। ড্রাইভার বা অন্য কাউকে আশেপাশে দেখতে পায়নি! আর অপেক্ষা করেনি অদম্য। দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল সটান। স্টিয়ারিঙের নীচের একটা প্যানেল খুলে দুটো তার ঘষে গাড়ি স্টার্ট করতে ও সময় নিয়েছিল এক মিনিট। তারপর মাথার ব্লিঙ্কার চালু করে এগিয়ে গিয়েছিল ধর্মতলার দিকে।

আশুতোষ কলেজের সামনে অ্যাম্বুলেন্সটা রেখে অদম্য ব্যাগ থেকে বের করল জিনিসটা। ছোট্ট লাঠির সামনে এলইডি প্যানেল লাগানো একটা যন্ত্র। এটা আরডিএক্স ডিটেকটিং ডিভাইস!

আরডিএক্স এক ধরনের প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। টেররিস্টদের প্রিয় হাতিয়ার। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে একে ধরা যায় না। আগে সোয়াব-পরীক্ষা করে বোঝা যেত আরডিএক্স-এর উপস্থিতি। কিন্তু সেটা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির দু’জন বিজ্ঞানী মিলে পলিমার ফ্লুরোসেন্স টাইপ এই ডিটেক্টরটা বানিয়েছেন। এতে সামান্যতম আরডিএক্স-এর উপস্থিতিও ধরা যায়। উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট পলিমারটি আরডিএক্স-এর কাছাকাছি নিয়ে গেলে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।

অদম্য জানে আর একরকম ডিটেক্টর নিয়েও পরীক্ষা চলছে। সেটা ফ্লুরোসেন্ট টার্ন-অন টাইপ ডিভাইস। কিন্তু ও অল্প সময়ের মধ্যে এটাই জোগাড় করতে পেরেছে নেপাল থেকে। তারপর যোগবাণী বর্ডার হয়ে পুর্ণিয়ায় পৌঁছে ট্রেনে করে শিয়ালদাতে এসেছে ও।

এবার দ্রুত পেছনের সিটে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে দমকল কর্মীর পোশাক বের করে পরে নিল অদম্য। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে।

ঘড়ি বলছে কুড়ি মিনিট সময় পেরিয়েছে। আদিল কি পৌঁছে গেছে!

হাজরা মোড়ের কাছে বেশ ভিড়! পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে মেট্রো স্টেশনের মুখটা! তবু বহু মানুষ একটু দূরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে!

অদম্য মাথা নাড়ল! পুলিশ যতই তাদের সুরক্ষিত রাখতে চান বাঙালির বিনি পয়সায় সার্কাস দেখার অভ্যেস গেল না!

ভিড়ের মাঝে সবার মাথা ছাড়িয়ে আদিলকে দেখতে পেল অদম্য। গত বছর দেখা মুখটা ও ভোলে কী করে! সারা জীবনে সত্যিকারের মানুষ খুব কম দেখা যায়। তাই একবার তেমন কাউকে দেখলে অদম্য ভোলে না সহজে!

সামনেই যতীন দাস পার্ক। মেট্রো স্টেশন ও শিশু উদ্যান পাশাপাশি! রেলিং ঘেরা উদ্যানে প্যান্ডেল বাঁধা। কিন্তু এখন আর কোনও লোক নেই! অদম্য ভাবল, আদিল যা অনুমান করেছে সেটা যদি না মেলে, তবে!

বম্ব স্কোয়াডের লোকজনকে দেখল অদম্য। ওদের সঙ্গে কি এইরকম ডিটেক্টর আছে? জানে না ও! অল্প সময়ে মেট্রো স্টেশনের থেকে আরডিএক্স খোঁজা সহজ কাজ নয়! কী করে করবে আদিল?

অদম্য একটু এগিয়ে বুঝল ওর পক্ষে স্টেশনে ঢোকা সহজ নয়। সিকিউরিটি খুব কড়া। তাহলে উপায়?

ও পুলিশ আর আধা সামরিক বাহিনীর ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কেউ বিশেষ বাধা দিল না। এমন অবস্থায় দমকলের লোকজন তো থাকবেই!

সামনে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ। এর ওপারে যেতে দেবে না।

অদম্য চান্স নিল একটা। সামনে দড়ি ধরে কর্ডন তৈরি করে রাখা পুলিশটাকে বলল, “স্যার, ওইখানে, মানে দূরের ওই পুলিশ ভ্যান থেকে এই যন্ত্রটা দিল। বোম ডিটেক্টর।”

“অ্যাঁ?” পুলিশটি ঘাবড়াল একটু। মুখ ফিরিয়ে অদম্যকে দেখল। যেন বুঝতে চাইল কী বলতে চাইছে।

অদম্য আবার বলল, “ওই দূরে বোম স্কোয়াডের গাড়ি থেকে দিল স্যার। অন্যান্য যন্ত্র দিলেও এটা নাকি রয়ে গিয়েছিল। আপনি কি নেবেন না আমি ওদের…”

পুলিশটি পা উঁচু করে দূরে দেখার চেষ্টা করল। গোটা জায়গায় প্রায় দশ বারোটা পুলিশ আর বম্ব স্কোয়াডের গাড়িতে ভর্তি। পুলিশটি অদম্যর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে দেখল আর একবার। অদম্যও বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়ে রইল পুলিশটির দিকে।

“তবে স্যার ওদের ফেরত…” অদম্য পিছু ফিরতে গেল।

“দাও,” পুলিশটি খপ করে ছিনিয়ে নিল ডিভাইসটা, তারপর বলল, “আর তুমি পিছিয়ে যাও। আগুন লাগলে সামনে আসবে। এখন আমাদের দেখতে দাও ব্যাপারটা। যাও, বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না।”

অদম্য মাথা নেড়ে আবার ভিড় ঠেলে পিছিয়ে গেল। শুধু যেতে যেতে পেছনের দিকে তাকাল। দেখল পুলিশটি গিয়ে বম্ব স্কোয়াডের অফিসারের সামনে ধরল যন্ত্রটা। অফিসারটি সেটা হাতে নেওয়ার আগেই আদিল ছোঁ মেরে তুলে নিল।

আদিলের চোখে-মুখে উত্তেজনা! অদম্য হাসল একটু। ভাবল, যাক, ঠিক লোকের কাছে পৌঁছে গেছে জিনিস! এবার দেখা যাক এই শহরটার কপালে কী আছে!

২১

মেট্রোর হাঁ হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকাল আদিল। নিরোর কথা মতো আর মিনিটপাঁচেক সময় আছে। ও দেরি করল না! বম্ব স্কোয়াডের দু’জন ও স্টেশনের একজন কর্মীকে ইশারা করে দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। স্কোয়াডের দু’জন নিজেদের স্যুট পরে অনুসরণ করল আদিলকে। স্টেশনের কর্মীটি একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে নামল ওদের পেছন পেছন।

সকালের পরই মেট্রো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আদিল বুঝতে পারছে যে আরডিএক্সটা দু’একদিন আগেই স্টেশনের ভেতরে কোথাও প্ল্যান্ট করা হয়েছে। এখন টাইমারটা কী দিয়ে তৈরি সেটা দেখতে হবে!

আরডিএক্স সাংঘাতিক ধরনের বিস্ফোরক হলেও নিজে নিজে কাজ করতে পারে না। এটা ফাটাতে ডিটোনেটর লাগে। আর সেই ডিটোনেটরকে কাজ করাতে হলে লাগে ইলেকট্রিকাল চার্জ বা ব্যাটারি!

এখন যদি রিমোট কন্ট্রোল্ড বোমা হয় তবে একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে! সেটা হল, মাটির তলায় সব সময় যে রিমোট সিগন্যাল পৌঁছবে, তা নয়। অর্থাৎ বোমা যে ফাটবেই সেটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তাই এসব ক্ষেত্রে মানুষেরা নিজেরাই বিস্ফোরক বয়ে নিয়ে গিয়ে নাশকতা করে। যন্ত্রের উপর খুব একটা ভরসা করে না!

কিন্তু এক্ষেত্রে সেটাও সম্ভব নয়। কারণ মাটির তলায় এখন কেউ নেই। তাই নিশ্চয়ই টাইমার ও ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে! সেক্ষেত্রে ভয়টা বেশি! এক একটা সেকেন্ড এখানে দামি!

আদিল মাটির নীচে ঢোকার আগেই প্ল্যানটা সেরে রেখেছিল। এবার সিঁড়ি দিয়ে টিকিট ঘরের সামনে নেমেই ইশারা করল।

স্টেশনের কর্মীটি দ্রুত গিয়ে অফ করে দিল স্টেশনের মেন সুইচ। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে গেল সবটা। ওপর থেকে নেমে আসা সিঁড়ি পথ ধরে সামান্য আলো আসছে মাত্র! একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে!

আদিল সময় নষ্ট না করে ব্যাগটা খুলে সেখান থেকে থার্মাল গগলস বের করে পরল। তারপর হাতে নিল আরডিএক্স ডিটেক্টরটা। এটার ব্যবহার ভালই জানে।

সামনের অন্ধকারকে থার্মাল গগলসের ভেতর দিয়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। যা কিছুর উত্তাপ সামান্য বেশি তার রঙ আশেপাশের চেয়ে সামান্য উজ্জ্বল হলদেটে বা কমলা দেখায় এই গগলসের মধ্যে দিয়ে।

আদিল জানে ডিটোনেটারের ব্যাটারিটা এখনও চলছে। ফলে, সেখানে একটা হিট-সিগনেচার থাকবে। থার্মাল ইমেজের ফলে সেটা দেখতে পাওয়ার সুযোগ বেশি! তবে সমস্যাও আছে! স্টেশনে এত রকমের ইলেকট্রিকাল যন্ত্র চলে। ফলে সেগুলো উত্তপ্ত হয়ে থাকে। তাই হিটস্পটটা ঠিক মতো লোকেট করা সহজ হবে না!

আর মাত্র মিনিট তিনেক সময় আছে। আদিল হাতের ডিটেক্টরটা অন করে দ্রুত সামনের পিলার থেকে হিটস্পট ধরে ব্রাশ করতে শুরু করল।

যে সব আলোগুলো জ্বলছিল সেগুলো গরম হয়ে থাকার ফলে থার্মাল গগলসের ভেতর দিয়ে সেগুলোকে হলদেটে-কমলা দেখাচ্ছ! আদিল বুঝল বড্ড বেশি সময় লাগছে।

আচ্ছা, ও যদি এমন একটা নাশকতা করতে চাইত তবে কোথায় প্ল্যান্ট করত বোমাটা? টিকিট ঘরটা অপেক্ষাকৃত মাটির ওপরে। সেখানে বা তার সামনে বোমা ফাটালে কি ক্ষয় বেশি হবে? নাকি প্ল্যাটফর্মের মাঝখানের কোনও পিলার ওড়াতে পারলে ক্ষতি বেশি হবে?

গগলসের থার্মাল ইমেজিংটা পালটে ও নাইট ভিশন মোড অন করল। হাতের ডিটেক্টরের ফ্লুওরোসেন্ট প্যানেলটা হালকা গোলাপি আভায় জ্বলছে। যদিও সেটা গগলসের ভেতর দিয়ে সবুজ লাগছে। আদিল জানে আরডিএক্স-এর কাছে এলেই এই গোলাপি আভাটা আর থাকবে না। তার বদলে প্যানেলের তাপমাত্রা বাড়বে। যা থেকে একটা সিগন্যাল যাবে পাশের এলইডি ইন্ডিকেটরে। আর এই এলইডি সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠে জানিয়ে দেবে বিপদ সংকেত!

ঘড়ি দেখল আদিল! আধঘণ্টা হয়ে এল প্রায়! আচ্ছা, নিরো আধঘণ্টা কথাটা এমনি বলেনি তো!

আর ভাবল না আদিল। সামনের গেট পেরিয়ে নেমে গেল নীচে। যতটা সম্ভব দ্রুত ও পিলারগুলো ব্রাশ করতে লাগল।

আচমকা ওর হাতঘড়িটা নড়ে উঠল। আধঘণ্টা হওয়ার ঠিক তিরিশ সেকেন্ড আগে একটা টাইমার ঠিক করে রেখেছে আদিল। সেই সময়টা চলে এল তবে! আদিলের বুকটা কেঁপে উঠল।

জীবনে বহুবার মৃত্যুমুখে পড়েছে ও। তবে সব জায়গাতেই একটা পঞ্চাশ পঞ্চাশ চান্স ছিল! কিন্তু এখানে, এই মাটির তলায় সেটা নেই। ও একবার বম্ব স্কোয়াডের দু’জনকে দেখল। বোমাটা ডিটেক্ট করার পর ওরা ডিফিউজ করবে বলে এসেছিল। কিন্তু এবার তো মারা পড়বে।

ও কানে লাগানো ওয়্যারলেস ডিভাইসটায় বলল, “তোমরা ফিরে যাও। কুইক।”

ওরা ঘাবড়ে গেল, “কেন স্যার?”

“যাও। ডোন্ট আরগিউ। গো,” চিৎকার করল আদিল।

ওই দু’জন পিছিয়ে গেল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ওপরের দিকে।

আদিল জানে আর সময় নেই। ও শেষ চেষ্টা করল। এলোপাথাড়িভাবে ডিটেক্টরটা বোলাতে লাগল একের পর এক পিলারে। কিচ্ছু নেই! তবে? এখন উপায়?

ঘড়িটা নড়ে উঠল আবার। পাঁচ সেকেন্ড বাকি! সময় উপস্থিত! আদিল নড়ল না আর। ডিটেক্টরটা ফেলে দিল হাত থেকে। আর আশা নেই! ও চোখ বন্ধ করে নিল এবার। হঠাৎ বাবা মায়ের মুখটা ভেসে উঠল সামনে। দেখতে পেল শাহিন হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ভাবল, এই খেলায় তবে জিতে গেল নিরো!

মনে মনে গুনতে শুরু করল ও। তিন দুই, এক… আদিল ধীরে ধীরে নামিয়ে নিল মাথা।

টিঁট্টি টিঁট্টি টিঁট্টি টিঁট্টি।

আদিল পাথরের মতো স্থির হয়ে আছে। কিছু হল কি? না তো! বোমা ফাটল না তো! বোমা ফাটল না তো! ওটা কীসের আওয়াজ!

ও ঠোঁট চাটল। গলাটাও শুকিয়ে গেছে একদম। কানে লাগানো ওয়াকিতে বলল, “লাইট অন করতে বলুন। কুইক।”

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্বলে উঠল স্টেশনের আলোগুলো। গগলসটা খুলে ফেলল আদিল। এখনও আওয়াজটা হয়ে চলেছে। কীসের আওয়াজ এটা? সেল ফোন কি?

শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গেল আদিল। ডানদিকে একটা পিলার তার ওপর দিকে সিলিঙের থেকে ঝোলানো রয়েছে সিসিটিভি। আরে! পাশে ওটা কী?

এমনিতে তো হাত পাবে না।

আদিল পিছিয়ে গেল একটু। তারপর দৌড়ে এসে পিলারটায় ভর রেখে কিছুটা বেয়ে, কিছুটা লাফিয়ে উঠে ক্যামেরার কাছে থেকে সাদামতো জিনিসটা পেড়ে আনল মুহূর্তের মধ্যে।

সাদাটে রঙের সাবানের মতো জিনিসটা দেখল আদিল। কিন্তু কী অবাক! কোনও ডিটোনেটর নেই তো! বরং জিনিসটার গায়ে একটা সেল ফোন লাগানো। সেখান থেকেই রিং হচ্ছে!

ফোনটা খুলে নিল আদিল। আর তখনই বুঝল জিনিসটা আরডিএক্স নয়। নিরো ঠাট্টা করল! মিথ্যে বলল! কিন্তু কেন?

ফোনটার রিং থেমে গেছে। তবে স্ক্রিনে জ্বলে আছে আলো। আর সেখান থেকে হলুদ ন্যাড়া মাথাটা হাসছে। চওড়া এক হাসি! স্মাইলি! আদিল দেখল সেই স্মাইলি-র তলায় লাল দিয়ে লেখা, ‘ডিকয়।’

২২

ম্যানুয়েল মার্তিনেজ এমন অবস্থায় পড়েননি কোনওদিন। সারা বছর পৃথিবীর নানান দেশে ঘুরতে হয় ওঁকে। কিন্তু এমনভাবে কোনও শহরকে টেররিস্টের হাতে আটকে পড়তে দেখেননি উনি।

দক্ষিণ এশিয়ায় সৌজন্য সফরে বেরিয়েছেন ম্যানুয়েল। বামপন্থী ইউনাইটেড সোশিয়ালিস্ট পার্টি অব ভেনেজুয়েলার মুখপাত্র হয়ে এসেছেন এ শহরে। নানান দেশে ঘুরে বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক দর্শনের আদান-প্রদান করতেই তাঁকে পাঠানো হয়েছে।

গতকাল কলকাতায় পৌঁছেছেন ম্যানুয়েল। আজ সকালে এসেছেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। কিন্তু কলকাতার যা অবস্থা তাতে কোনও আলোচনাই হয়ে ওঠেনি।

পুরো পরিস্থিতির ওপর চোখ রেখে আর একদিন এখানে থাকবেন ম্যানুয়েল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ আছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু ম্যানুয়েলকে বলেছিলেন আরও কিছুক্ষণ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পার্টির দফতরে থেকে যেতে, কিন্তু ম্যানুয়েল রাজি হননি। হোটেলে ফিরে কাজ আছে ওঁর। সামনে চিন সফরের জন্য কিছু হোম ওয়ার্ক দরকার।

সূর্যবাবু বলেছিলেন একজনকে গাড়িতে সঙ্গে দিয়ে দেবেন, যাতে হোটেল অবধি যেতে কোনও অসুবিধে না হয়। কিন্তু ম্যানুয়েল রাজি হননি। এসব সিকিউরিটি একদম ভাল লাগে না ওঁর।

সকালে যে সাদা গাড়িটায় এখানে এসেছিলেন সেটার বদলে এখন কালো গাড়িতে ফিরতে হচ্ছে ম্যানুয়েলকে। আগের গাড়িটায় নাকি কীসব প্রবলেম দেখা দিয়েছে! এই ড্রাইভারটি নতুন। চুপচাপ চালাচ্ছে।

আজ কলকাতার রাস্তায় সাধারণ মানুষের চেয়ে পুলিশ আর মিলিটারি যেন বেশি!

ঘড়িতে সময় দেখে ম্যানুয়েলের ভুরুটা কুঁচকে গেল! কী ব্যাপার এখানে আসতে কুড়ি মিনিট লেগেছিল, আর এখন আধঘণ্টা হয়ে গেল তাও হোটেলে পৌঁছনো গেল না! ড্রাইভারটি কি পথ ভুল করল নাকি!

“হ্যালো,” ম্যানুয়েল ঝুঁকে পড়ে বললেন, “তুমি কি রাস্তা চেনো না?”

ড্রাইভারটি আচমকা গতি কমিয়ে দিল গাড়ির তারপর পিছনে ফিরে বলল, “চিনি স্যার।”

“তবে হোটেল পৌঁছতে এত সময় লাগছে কেন?”

ড্রাইভারটি কোনও উত্তর না দিয়ে গাড়িটা আচমকা থামিয়ে দিল ফুটপাথ ঘেঁষে। তারপর দরজা খুলে নেমে গেল গাড়ি থেকে!

“আরে! কী ব্যাপার?” ম্যানুয়েল অবাক হয়ে গেলেন, “হোটেলে আমায় তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে!”

ড্রাইভারটি কিন্তু ফিরেও তাকাল না। যেন শুনতে পায়নি এমন ভান করে চলে গেল।

“আরে!” ম্যানুয়েল দরজা খুলে নামতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না। তার আগেই ন্যাড়া মাথা একটা লোক এসে দ্রুত ড্রাইভারের দিকে দরজা খুলে বসে পড়ল সিটে।

“কে তুমি?” ম্যানুয়েল সামান্য ঘাবড়ে গেলেন, “কী ব্যাপার?”

লোকটা এবার পেছনে ফিরল, বলল, “সরি, রিস্কেজিউল করতে হচ্ছে আপনার প্রোগ্র্যাম। আপনি হোটেল নয়, আমার সঙ্গে যাবেন।”

ম্যানুয়েল আর কিছু বলার আগেই লোকটা ডান হাতটা তুলল। ছিক একটা শব্দ। ঠান্ডা জলের স্পর্শ যেন! জ্ঞান হারাবার ঠিক আগে ম্যানুয়েল দেখলেন লোকটার হাতে একটা ছোট্ট স্প্রে-গান!

২৩

যতীন দাস পার্ক মেট্রোর অফিসরুমে বসে ভিডিও ফুটেজটা আবার দেখল আদিল।

গতকাল রাতের দিকের ফুটেজ। ঝাঁকড়া চুলের একটা লোক ক্যামেরার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। তারপর দ্রুত ওপরের দিকে কিছু একটা ছোড়ার ভঙ্গি করল। এটাই দেখতে চাইছিল আদিল। এক ধরনের স্টিকিং মেটিরিয়াল দিয়ে ওই সাবান আর তাতে গাঁথা সেল ফোনটা আটকানো ছিল! এখন বুঝতে পারল ওটাকে ছুড়ে লাগানো হয়েছিল।

সেল ফোনটার ওই ‘ডিকয়’ মেসেজটা দেখার পরে আদিল সময় নষ্ট করেনি এক মুহূর্তও। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটার ব্যাটারি খুলে দেখেছে কত এমএএইচ-এর ব্যাটারি। এমএএইচ বা মিলি অ্যামপেয়ার আওয়ার একটা ব্যাটারির শক্তি নির্দেশ করে।

কত পারসেন্ট ব্যাটারি খরচ হয়েছে সেটা আদিল দেখে নিয়েছিল আগেই। এবার এমএএইচ-টা দেখে হিসেব করে বুঝেছিল ঠিক কতটা সময় আগে ব্যাটারিটা চার্জ দেওয়া হয়েছে। সেই সময় ধরে ও স্টেশনের সিসিটিভির ফুটেজ চেক করছিল এতক্ষণ। কারণ কোনও জায়গায় একদিনের জন্য কোনও ফোন রাখতে হলে তাকে তো পুরো চার্জ দিয়েই রাখতে হবে!

লোকটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঝাঁকড়া চুলটা বোঝা যাচ্ছে। আর ক্যামেরাটা ওপরে বসানো, তাই হাইটটাও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ক্যামেরা পজিশন আর লোকটার স্ক্রিনে ছবি দেখে সেটাও মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে আদিল। আর স্ক্রিনে তো সময় দেখাচ্ছেই!

ও পাশে দাঁড়ানো স্টেশন মাস্টারকে বলল, “এই রাত ন’টা নাগাদ কারা ছিল কাউন্টারে?”

স্টেশন মাস্টার কিছু বলার আগেই পাশে দাঁড়ানো রোগামতো একটা ছেলে বলল, “আমি ছিলাম স্যার। আরও দু’জন ছিল, কিন্তু এ লোকটা আমার কাছ থেকেই টোকেন নিয়েছিল।”

আদিল জিজ্ঞেস করল, “তুমি বলতে পারবে কেমন দেখতে ওকে? আমি তোমায় তাহলে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে। স্কেচ আঁকাতে হবে। পারবে?”

“পারব স্যার,” ছেলেটা মাথা নাড়ল, “লোকটার মাথায় বড় কোঁকড়া চুল। বেশ লম্বা। আর চোখ দুটো স্যার অদ্ভুত রকমের সবুজ!”

২৪

“নিউ মিলেনিয়াম ব্রিজ স্টোনটেক কর্পের কাছে একটা ড্রিম প্রজেক্ট! এখন সারা পৃথিবীতে যে রিসেশন হিট করেছে তাতে আমরাও অ্যাফেক্টেড। এই অবস্থায় এটা আমাদের কাছে একটা অপরচ্যুনিটি! একশো পঁয়ত্রিশ মিলিয়ান ডলার তো আর স্যার একটুখানি টাকা নয়!” গোপী সবার দিকে তাকাল।

পার্থবাবু বললেন, “কাজটা পাওয়ার পর নিশ্চয়ই আপনাদের শেয়ারও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে?”

গোপী এর মধ্যেও হাসল একটু, “হ্যাঁ স্যার। তা তো অনেকটাই হয়েছে। কাজটার ওপর আমাদের অনেক কিছু নির্ভর করছে। তা ছাড়া এত উঁচু ব্রিজ তো পৃথিবীতে খুব একটা নেই! তলা দিয়ে জাহাজ যাবে এর। কেবল স্টেয়ড ব্রিজ হলেও এটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ!”

“আপনার কি মনে হয় আপনারা যাতে কাজটা করতে না পারেন সেই জন্য কেউ ঝামেলা করছে?” অ্যান্টনিজি প্রশ্ন করলেন।

“স্যার,” গোপী বলল, “কাজটা জিউসও পেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা পেয়েছি। ওরা তো প্রজেক্টের ভায়াবিলিটি নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। আমার হাতে কোনও প্রুফ নেই… তাই আমি আর কী বলব!”

সিএম এবার সুরজিৎবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আদিল কি ছেলেটিকে নিয়ে আসছে? আর এই ‘ডিকয়’ ব্যাপারটার রহস্য বুঝতে পারছেন?”

সুরজিৎবাবু বললেন, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। সাধারণত এটা বোকা বানাবার ট্যাক্টিকস। আমাদের মনটা একদিকে পাঠিয়ে অন্য কাজ হাসিল করতে চাওয়ার চেষ্টা আর কী! কিন্তু এখনও তো কিছু…”

সুরজিৎবাবু কথা শেষ করার আগেই আবার ফোনটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠলেন সবাই।

“হ্যালো,” সুরজিৎবাবু কলটা রিসিভ করলেন দ্রুত, “এর মানে কী?”

“এর মানে আপনাদের নিয়ে আমি যেমন খুশি তেমনভাবে প্লে করতে পারি। আপনাদের দিয়ে যা খুশি করাতে পারি। আপনারা ভেবেছিলেন আমায় উত্তেজিত করে কথা বের করে নেবেন! কাওয়ার্ড-টাওয়ার্ড বললে আমি ইগো থেকে কিছু করে বসব! সরি, প্রোফেশনাল ফিল্ড-এ আমি ওই জিনিসটা ঘরে রেখে আসি। শুধু একটু অ্যাকটিং করলাম। জানতাম আপনারা ঠিক মাইকের আওয়াজ শুনে স্টেশনটা লোকেট করতে পারবেন। ব্যাস, মিশন অ্যাকমপ্লিশড। বাই দ্য ওয়ে, আমার ডিমান্ডটার কী হল?”

“মিশন মানে? কোন মিশন? আর দেখো,” সিএম উত্তেজিতভাবে চশমাটা খুলে ফেললেন, “এভাবে কিছু পাওয়া যায়? আর এটা সরকারি কাজ। বললেই কি ক্যানসেল করা যায় অর্ডার? নানান ক্লজ় থাকে। ওরা কাজটা করবেন, কিন্তু আমাদেরও কিছু লায়াবিলিটি আছে। প্লাস ব্রিজটা হওয়ার দরকার। স্টোনটেক-এর উদারতা যে ওরা স্প্যানিশ রোজ়গুলো দিতে রাজি হয়েছে। ওদের জিনিস ওরা না দিলেও তো আমরা কিছু করতে পারতাম না। তা ছাড়া টেররিস্টদের সঙ্গে…”

“নেগোশিয়েট করেন না তো!” নিরো হাসল, “ম্যানুয়েল মার্তিনেজকে চেনেন তো?”

“ম্যানুয়েল?” এবার বাসুদেববাবু কথা বললেন, “হ্যাঁ, উনি তো গতকাল এসেছেন। আমাদের সঙ্গেও দেখা করতে আসবেন। কেন?”

“বোধহয় পারবেন না দেখা করতে। মানে, আপনারা যদি এই অর্ডারটা ক্যানসেল না করেন…”

“মানে?”

“জানেন সম্রাট নিরো কী করতেন! ওঁর যাকে শাস্তি দেওয়ার থাকত, তার সারা গায়ে ভেড়ার চর্বি মাখাতেন প্রথমে। তারপর একটা ধাতব খুঁটির সঙ্গে বেঁধে জ্বালিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে রাতে বাগানে পার্টি দিতেন উনি আর সেখানে এইরকম বহু মানুষকে জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করতেন!” নিরো শক্ত গলায় বলল, “আমি আপনাদের আরও কিছু সময় দিচ্ছি। মনে রাখবেন আমি কিন্তু একা নই। আমরা দু’জন কাজ করছি একসঙ্গে। এরপরে যখন ফোন করব তখন পজিটিভ উত্তর দেবেন। না হলে দেখবেন ম্যানুয়েল মার্তিনেজ এমনভাবেই কলকাতার কোনও অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলছেন!”

২৫

মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করে কানে ধরল অদম্য। সারাদিন গেছে একবারও ফাদারের খবর নেওয়া হয়নি!

সেপ্টেম্বরের প্রথম এখন, শরৎকাল। কিন্তু সকাল থেকে সেই যে মেঘ করে আছে তো আছেই! ওর ফোনের মধ্যেই জিনির জিপিএস লোকেশন দেখা যাচ্ছে। ও লক্ষ রেখেছে জিনি লালবাজার অঞ্চলেই আছে!

অদম্য সবটাই শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে। কিন্তু জিনি বা অন্য সাংবাদিকরা তো আর তা পাচ্ছে না! তাই ওদের খবরের জন্য ওখানেই থাকতে হবে।

সেই সকাল থেকে এখন বিকেল হয়ে গেল তবু নিরোকে খুঁজে পাওয়া গেল না! লোকটার ফোন ভালভাবে মাস্ক করা রয়েছে। আর বুদ্ধিও আছে লোকটার। আদিলকে পর্যন্ত বোকা বানিয়ে ছেড়েছে! এমন ইমপ্রেশন দিয়েছে যেন ভুল করে বোমার লোকেশন বলে ফেলেছে! আসলে ওটা ডাইভারশান ছিল! সবার চোখ যখন মেট্রোর দিকে তখন ভেনেজুয়েলার ওই ডিপ্লোম্যাটটিকে কী অদ্ভুতভাবে তুলে নিয়ে গেল!

অদম্য ভাবল ভাগ্যিস স্পাই পেনটা ওর সঙ্গে ছিল!

“ইয়েস,” ওপার থেকে মেট্রনের গলা পেল অদম্য।

অল্প কথায় ফাদারের খোঁজ নিল ও। তারপর হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক আছেন ফাদার। তবে কষ্ট পাচ্ছেন। এই বয়সে শরীর এত ধকল নিতে পারে!

কিন্তু দুটো জিনিস নিয়ে ধন্দ যাচ্ছে না অদম্যর। ফাদারকে আহত করে কেন কলকাতার কথাটা বলল নিরো! আর নিরো বার বার বলছে ওরা দু’জন অপারেট করছে। সেই দ্বিতীয়জনটি কে?

ফোনটা কেটে জিপিএস লোকেটরটা আবার দেখল অদম্য। জিনিকে এবার দেখা দিতে হবে। মেয়েটাকে ওর দরকার। আর তার সঙ্গে কান রাখতে হবে লালবাজারের দিকে। নিরো এরপর কী করে এখন সেটাই দেখার!

২৬

অ্যান্টনিজি সিএম-এর দিকে তাকালেন, “ম্যাডাম, দিল্লি থেকে আরও এনফোর্সমেন্ট আনাতে হবে। যেভাবে হোক এই পাগল লোকটাকে খুঁজে বের করতেই হবে। একজন ডিপ্লোম্যাট এলেন বিদেশ থেকে, তাকে তুলে নিয়ে গেল! উনি কোনও সিকিউরিটি নেননি?”

উত্তরটা এবার দিলেন সুরজিৎবাবু, “না স্যার, বহুবার ওঁকে বলা হয়েছে। উনি নেননি। বলেছেন, কে কী করবে ওঁকে? প্লাস ওঁর নাকি ক্লসট্রোফোবিক লাগে সিকিউরিটি নিয়ে ঘুরতে!”

“আমাদের সঙ্গে সুর্যবাবুর কথা হয়েছে। নিরাপত্তার কথাটা ওঁকে বলেছি আমরা। তাই এখনও প্রেসকে জানাননি ব্যাপারটা। কিন্তু যত সময় যাবে নিউজ কনটেন করা টাফ হয়ে যাবে। আর নিরো যদি নিজে খবরটা ফ্ল্যাশ করে…” সিএম প্যাডে আঁকিবুকি কাটতে-কাটতে বললেন, “বাই দ্য ওয়ে গাড়িটা চালাচ্ছিল কে? সেই ড্রাইভারটি কোন এজেন্সির?”

“সকালে যে গাড়িটা ওঁকে আলিমুদ্দিনে পৌঁছে দিয়েছিল সেটাতে কী সব গোলমাল দেখা দেয়। তাই আর একটা গাড়ি পাঠানো হয় কার রেন্টাল থেকে। ড্রাইভারটিকে পাওয়া যাচ্ছে না!”

সিএম এবার তাকালেন গোপীর দিকে, “আপনি কি মনে করেন জিউস বা তেমন কেউ এই লোকটাকে পাঠিয়েছে?”

“আমার হাতে তো কোনও প্রুফ নেই ম্যাডাম! একশো পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন ডলার মানে আজকের বাজারে প্রায় এইট পয়েন্ট থ্রি বিলিয়ন রুপিজ! এর সঙ্গে শেয়ার বাজারের মুনাফা, ক্রেডেনশিয়াল আরও কত কী যে জড়িয়ে আছে! ফলে বুঝতেই পারছেন ইনসেন আমাউন্ট অফ মানি ইজ ইনভলভড। আর এই সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় এমন একটা কাজ মানে আরও নানা দেশে সিমিলার কাইন্ড অব ওয়ার্ক অপরচুনিটি। এই দেশেও আরও নানান ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল কাজ করার চান্স! তাই বলছি আপাত-দৃষ্টিতে এটা একটা অর্ডার, কিন্তু আসলে তা নয়। এটা গেট-ওয়ে অব বিলিয়নস অব ডলারস।” গোপী রুমাল বের করে মুখটা মুছল, “তবে আমি একটু আগে বাইরে গিয়ে মিস্টার ক্রেগের সঙ্গে কথা বলেছি।”

“অ্যান্ড?” সিএম চিন্তিত মুখে তাকালেন।

গোপী উত্তর দিতে গিয়েও পারল না। ফোনটা বেজে উঠল কর্কশভাবে।

সুরজিৎবাবু আবার রিসিভ করলেন কলটা।

নিরো বলল, “আশা করি আপনারা ঠিক করতে পেরেছেন।”

“দেখো, গুন্ডামিটা এবার মাত্রা ছাড়াচ্ছে! কী ভেবেছ তুমি? ফোন মাস্ক করে রাখলে আমরা তোমায় চিহ্নিত করতে পারব না! আমাদের বেস্ট টেকনিশিয়ানরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। তোমায় ধরতে পারা জাস্ট আ ম্যাটার অব টাইম। শহরে ঢুকে পড়েছ ঠিক আছে, কিন্তু বেরোতে পারবে না।” সুরজিৎবাবু কঠিন গলায় বললেন।

“প্লিজ, দুটো ড্যামেজ আর একটা গুগলি। আপনারা তো ক্রিকেট-লাভিং নেশান। এটাও বোঝেন না! আর কী কী ওড়ালে আপনারা বুঝবেন? আন্ডার রেনোভেশন রাইটার্স বিল্ডিং! সেটা কি এনাফ প্রুফ হবে? আমি আগেই বলেছি আমায় পরীক্ষা করবেন না। কিন্তু আই গেস আপনারা বোঝেননি। ঠিক আছে অর্ডার যদি না ক্যানসেল করেন তবে প্রথমে ম্যানুয়েল, তারপর রাইটার্স। তারপর না হয়…”

“আই অ্যাকসেপ্ট,” আচমকা কথা বলে উঠল গোপী। বলল, “আমি রাজি। গভর্নমেন্ট যদি অর্ডার ক্যানসেল করেন আমরা ড্যামেজ স্যুট করব না। আমরা মেনে নেব।”

“সে কী!” সিএম অবাক হলেন।

নিরো বলল, “মিস্টার মুরলিরাজন, আপনি ঠিক সিদ্ধান্ত নিলেন। এখনও প্রেস জানে না ম্যানুয়েলের কিডন্যাপিংটা। তবে আপনারা না মানলে সেটা এবার জানবে।”

“নিরো, আমার কথা শোনো,” গোপী সামনের মাইকের দিকে এগিয়ে বসল, “আমরা কাজ ছেড়ে দেব। স্প্যানিশ রোজ়ও দেব। কিন্তু শর্ত আছে একটা। মিস্টার মার্তিনেজকে ছেড়ে দিতে হবে। আমায় তুমি তার জায়গায় বন্দি করে রাখো। জানি একজন হস্টেজ না নিলে তুমি এখান থেকে বেরোতে পারবে না। তাই আমায় নাও। মিস্টার মার্তিনেজকে ছেড়ে দাও।”

“কী বলছেন আপনি?” অ্যান্টনিজি আর সিএম একসঙ্গে বলে উঠলেন।

“আমি মিস্টার ক্রেগের সঙ্গে কথা বলেছি।” গোপী বলল, “নিরো, বি আ ম্যান। অ্যাটলিস্ট ফর ওয়ান্স।”

নিরো চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে মিস্টার গোপী। আই অ্যাকসেপ্ট। তবে নো ট্রিকি বিজনেস। আপনি একা আসবেন। সম্পূর্ণ একা।”

“কোথায়? কখন?”

নিরো বলল, “শুনুন তবে, মন দিয়ে শুনুন।”

২৭

ইয়ার পিসটায় যা শুনল তাতে খুব একটা অবাক হল না অদম্য। সত্যি তো একটা এগজিট স্ট্র্যাটেজি না নিয়ে কি আর নিরো এসেছে শহরে? কিন্তু এমন একটা ভেনু বলছে সেখানে ও পৌঁছবে কী করে!

অদম্য আকাশের দিকে তাকাল। শেষ বিকেলের কলকাতা যেন মেঘের চাপে আরও মনমরা হয়ে আছে!

পাশেই একটা ইলেকট্রনিক্সের বড় দোকান। তার শো-উইন্ডোতে বোবা টিভিরা চলছে। কলকাতার ছবিই দেখাচ্ছে সেখানে। ভাঙা স্টেডিয়াম, উড়ে যাওয়া অ্যাপার্টমেন্ট! তলার স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। তাতে লেখা নিরাপত্তার কারণে আগামী বারো ঘণ্টা বিদ্যাসাগর সেতুতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে।

এর মধ্যে আরো দু’বার সরকারিভাবে কলকাতার পরিস্থিতি জানানো হয়েছে। অবশ্য তাতে অদম্য খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।

এখন ওর ভাবনা হচ্ছে লোকটাকে ধরবে কী করে! ফাদারকে গুলি করে, কলকাতাকে তছনছ করে একটা লোক চলে যাবে! সেটা ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে!

হাসপাতালে শুয়ে থাকা ফাদারের মুখটা মনে পড়ল ওর। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ফাদার জীবনে এই প্রথম কিছু করতে বললেন ওকে। সেটা করতে পারবে না? লোকটা হাতের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে!

ঠোঁট কামড়ে বোবা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকল অদম্য। একটু আগে ও জিনির সামনে এসেছে। ওকে দেখে জিনি তো প্রথমে খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, “এক ঘণ্টার জন্য কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন? দোকানে ঢুকে দেখলাম আপনি নেই!”

অদম্য হেসে বলেছিল, “বললাম না এখানে একটা পারসোনাল কাজের জন্য এসেছি। আচমকা একটু যেতে হয়েছিল। তোমার নাম্বার তো নেই যে জানাব।”

জিনি আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু একটু অদ্ভুতভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে!

“এক্সকিউজ় মি।”

জিনির ডাকে মুখ তুলল অদম্য। মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওর! জিনি একটা শস্তার সেল ফোন বাড়িয়ে ধরেছে অদম্যর দিকে।

“কী?”

“কল ফর ইউ!”

“আমার জন্য!” খুব অবাক হয়ে ফোনটা ধরল ও, “হ্যালো।”

“ফাদার কেমন আছেন?” নিরোর গলাটা শান্ত শোনাল খুব।

অদম্য যেন শক খেল, “ত-তুমি?”

“ফাদার নাকি এক্স আর্মি! মারলাম যখন কিছুই তো বুঝতে পারলেন না!” নিরো হাসল সামান্য।

অদম্যর মনে হল হাতের চাপে ফোনটা ভেঙে ফেলে।

“আমায় মারতে ইচ্ছে করছে, না?” হাসল নিরো, “সন্ধে সাতটায়, বিদ্যাসাগর সেতু। আয়াম টেকিং অফ। তোমায় ফেয়ার চান্স দিচ্ছি। কাম অ্যান্ড গেট মি।”

অদম্য ফোনটা কেটে চুপ করে রইল। ও যে আগেই এই জায়গাটার কথা ইয়ার পিসের মাধ্যমে শুনেছে, সেটা তো আর নিরো জানে না।

গোপী নিজে জায়গা বদল করতে চায় মিস্টার মার্তিনেজের সঙ্গে। সন্ধে সাতটার সময় বিদ্যাসাগর সেতুর মাঝখানে আসতে বলেছে গোপীকে। আর বলেছে একটা হেলিকপ্টার পাঠাতে। সেই সময় গোটা ব্রিজের আলো বন্ধ করে দিতে হবে। যদি একজনও পুলিশ বা মিলিটারি আশেপাশে বা নীচের নদীতে থাকে তবে মিস্টার মার্তিনেজকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে নিরো।

সিম্পল প্ল্যান! গোপীকে বন্দি করে নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে উড়ে বেরিয়ে যাবে নিরো!

ব্রিজে না থাকলেও দু’দিকে যে পুলিশ আর মিলিটারিরা গার্ড হিসেবে থাকবে সেটা তো স্বাভাবিক। তাই এটা নিয়েই ভাবছে অদম্য। নিরো ব্রিজে ঢুকবে কী করে! আর ওকেই বা ডাকছে কেন!

অদম্য জিনির দিকে তাকাল, তারপর দাঁত চেপে বলল, “তুমি জানো কে লোকটা? জানো কলকাতার সর্বনাশ এই লোকটাই করছে! আর আমায় তুমি ফলো করছ? ওর কথায়! তুমি এর সঙ্গে জড়িত?”

“না না,” জিনি ভয় পেয়ে গেল এবার, “ও বলল আপনি ইন্টারন্যাশানাল ক্রিমিনাল আর ও ইন্টারপোল থেকে… মানে আই থট আমার এটা লাইফ টাইম চান্স। এমন একটা স্টোরি… প্লিজ়, আমি কিছু জানি না। লোভে পড়ে…”

জিনি কথা শেষ করতে পারল না। ও বড় বড় চোখ করে তাকাল পাশের ইলেকট্রনিক্সের দোকানটার দিকে। শো-উইন্ডোর টিভিতে ভেসে উঠেছে একটা হাতে আঁকা ছবি। নিউজ চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে স্কেচটা। তলার স্ক্রলে লেখা ‘কলকাতার সম্ভাব্য আতঙ্কবাদী!’

জিনি ধরা গলা বলল, “এ-এই তো… এই তো সবুজ চোখের লোকটা…”

অদম্য ঠান্ডা চোখে তাকাল জিনির দিকে, “আমি তোমায় কেন মারব না সেটা বলতে পারো?”

“আমি…প্লিজ়…” জিনির চোখে জল এল এবার।

অদম্য জিনির নিজের ফোনটা নিল। তারপর ইমেজ ফাইল থেকে ডিলিট করে দিল ওর নিজের ছবিগুলো। ঠান্ডা গলায় বলল, “চোখের জল কোনও কমপেনসেশন নয়। ইউ হ্যাভ টু গো বিয়ন্ড টিয়ার্স! তোমায় একটা কাজ করতে হবে!”

২৮

অন্ধকারের মধ্যে বিরাট বড় এক ডাইনোসরের মতো লাগছে বিদ্যাসাগর সেতুটাকে। এক পকেটে স্প্যানিশ রোজ়ের থলি আর অন্য পকেটে ব্রিজের ক্যানসেল করা অর্ডার-এর চিঠি নিয়ে পায়ে পায়ে এগোতে লাগল গোপী।

ব্রিজটা মাটি ছেড়ে এবার জলের ওপর দিয়ে বেঁকে গেছে বাঁদিকে। বড় বড় দুটো এইচ-এর মতো পিলার দেখা যাচ্ছে। মেঘলা আকাশের লাল আভায় সবটাই কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল গোপী। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে হেলিকপ্টারের ব্লেডগুলো। পাইলটটি নিশ্চয়ই চলে গেছে এর মধ্যে।

ও ব্রিজের মাঝখানে আবছা মতো ছ’টা ছায়ামূর্তি দেখল। মানে কি শুধু মার্তিনেজ নয় আরও কয়েকজনকে তুলে নিয়েছে নিরো! স্নাইপাররা যাতে দূর থেকে ওকে চিনতে না পারে তাই কি এতজন!

“আমি এসেছি, প্লিজ় এবার মিস্টার মার্তিনেজকে ছেড়ে দাও।” গোপী চিৎকার করল।

“আর আমার শর্ত!”

“আছে আমার কাছে। প্লাস টিভিতেও ওটা অ্যানাউন্স করা হয়েছে।” গোপী পকেট থেকে থলি আর খাম বের করে দেখাল।

“ইউ গো।” ছায়া মূর্তিগুলোর থেকে একজনকে আচমকা ধাক্কা দিল নিরো।

“গ্রাসিয়াস, দিওস মে আইউদে।” বলে ম্যানুয়েল দৌড় লাগালো।

গোপীর পাশ দিয়ে পেছনে, কলকাতার দিকে চলে গেল ম্যানুয়েল।

“এবার তুমি।” নিরো বাঁহাতের ইশারা করল।

“বাকি লোকগুলো!”

“দে আর ডলস। অ্যাডাল্ট টয়েজ। এসো তাড়াতাড়ি, কুইক। আর একজনের জন্য ওয়েট করতে হবে।”

গোপী দেখল নিরো কথা শেষ করে হাতের পিস্তলটা তুলল ওর দিকে!

২৯

নিরোকে গোপীর দিকে ইশারা করতে দেখল অদম্য। ওর শরীরটা টানটান হয়ে উঠল।

জলের তলা দিয়ে সাঁতার কেটে এসে সেতুর পিলার সাপোর্টে উঠেছিল ও। তারপর পিলারের গা বেয়ে উঠে এসেছে রেলিঙের ধারে। এখান থেকে নিরো মিটার কুড়ি দূরে। পেছন থেকে গোপীকে দেখতে পাচ্ছে ও।

এতক্ষণ গুড়ি মেরে পুরো ঘটনাটা দেখেছে অদম্য। কিন্তু আর লুকিয়ে থাকলে চলবে না! গোপীকে নিরোর হাতে পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। কারণ তাহলে নিরো পালিয়ে যাবে সহজেই!

অদম্য ওর কাঁধে আটকানো ছোট্ট যন্ত্রটা হাত দিয়ে দেখে নিল একবার। চলছে। আর সময় নষ্ট নয়। ও দ্রুত রেলিং টপকে রাস্তায় নামল। পিস্তলটা বের করে এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে। আর ঠিক তখনই নিরোও তুলল পিস্তলটা। গোপী ওর দিকে যেতে গিয়েও থমকে গেল। ভাবল, ওকে দেখে পিস্তল তুলছে শয়তানটা! কিন্তু অদম্য জানে তা নয়। ও জানে গোপীর পেছনে ওকে আসতে দেখেছে নিরো!

নিরো হাসল, “হিয়ার ইউ আর!”

“হ্যাঁ,” চোয়াল শক্ত করে বলল অদম্য, “আমি।”

“জানো কী করে ফাদারকে গুলি করেছি? এইভাবে।” আচমকা গুলি চালাল নিরো। সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল থেকে ‘টিউব’ শব্দ হল একটা।

হাঁটু গেড়ে ছোট্ট ডিগবাজি খেল অদম্য। তারপর গড়িয়ে যেতে যেতে ও নিজেও পালটা ফায়ার করল।

গুলিটা গায়ে না লেগে লাগল নিরোর পিস্তলে। সেটা ছিটকে পড়ল দূরের অন্ধকারে। অদম্য আবার ফায়ার করতে গেল, তার আগেই নিরো নিজেই বুলেটের মতো এগিয়ে গেল গোপীর দিকে। নিমেষে একটা ছুরি বের করে চেপে ধরল গোপীর গলায়। হিসিহিসে স্বরে বলল, “পিস্তলটা ফ্যালো এবার। ফ্যালো।”

অদম্য চোয়াল শক্ত করল। ইস। তারপর পিস্তলটা ফেলে দিল মাটিতে।

“এবার পা দিয়ে ওটা ঠেলে সরিয়ে দে।”

অদম্য পা দিয়ে পিস্তলটা ঠেলে দিল দূরে। তবে চোখ সরাল না নিরোর থেকে। একটা সুযোগ দরকার ওর। মাত্র একটা সুযোগ!

নিরো গোপীকে ঠেলে সরিয়ে দিল একদিকে তারপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল অদম্যর ওপর। নিমেষে শরীরটাকে নিচু করে অদম্য হাত দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া নিরোর শরীরটাকে মাথার ওপর দিয়ে ঠেলে দিল। ডিগবাজি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ল নিরো। ধাতব শব্দ শুনে বোঝা গেল হাতের ছুরিটাও ছিটকে গেছে!

অদম্য উঠে দাঁড়াল। নিরোও দাঁড়াল ওর মুখোমুখি। কিন্তু এগোল না এক পা-ও। অদম্য বুঝল কারণটা। দেখল, ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোপী। আর ওর হাতে সোজা করে ধরা অদম্যর পিস্তলটা!

৩০

আচমকা গুলির শব্দে চমকে উঠেছিল। সবাই। আদিল নিজেই বুঝতে পারেনি কী হল! কলকাতার দিকটায় পুলিশ ও মিলিটারিদের গাড়ি আর ব্যারিকেডের মাঝে দাঁড়িয়েছিল ও। আশেপাশে প্রেসও এসে জমে গেছে!

একটা কথা ভাবছিল আদিল। ব্রিজের মাঝখানে নিরো গোপীর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’দিক সিল করে দিয়েছিল পুলিশ। বেশ কিছু গাড়ি ব্রিজের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটকে আছে ঠিকই, কিন্তু তার আরোহীদের আগেই গাড়ি ছেড়ে হেঁটে ব্রিজ থেকে নেমে যেতে বলা হয়েছে। তাহলে নিরো ব্রিজে উঠল কখন! ও কি তবে গোটা সময়টা গাড়ি নিয়ে ব্রিজেই চক্কর দিচ্ছিল!

মেট্রোর সেই কর্মীটির ডেসক্রিপশন অনুযায়ী স্কেচ আঁকিয়ে একটা ছবি টিভিতে প্রচার করা হয়েছে। তবে ফল হয়নি কিছু।

গোপী এমন একটা সাহসী সিদ্ধান্ত যে নিতে পারে ভাবতেই পারেনি আদিল। খুব সেলফলেস মানুষ!

তাই গুলির শব্দটা শুনে নিজেকে আটকাতে পারেনি! একটু আগে হাঁপাতে হাঁপাতে ম্যানুয়েল এসে পড়েছে। আটকে আছে গোপী! তবে কি নিরো ওর ডিমান্ড মতো জিনিসগুলো পেয়ে গুলি করল গোপীকে!

বারো সেকেন্ড-এ একশো মিটার টানতে পারে আদিল। তাই দ্রুত ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ও। কিন্তু কাছে গেল না।

সামনে ব্রিজটা বাঁদিকে বেঁকে গেছে। ও গুড়ি মেরে এগিয়ে গেল ওই দিকে। কালো পোশাক পরে রয়েছে আদিল। ওকে চট করে দেখা সহজ হবে না।

সামনে দুটো খালি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদিল গিয়ে একটার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। তারপর মাথা তুলে দেখল! তিনজন! মানে একজন তো গোপী। আর বাকি দু’জন! নিরো আর তার সঙ্গী? এর জন্যই কি নিরো বলছিল দু’জন আছে ওরা!

ও আবার দেখল মাথা তুলে। আরে, গোপীর হাতে পিস্তল গেল কী করে! উৎসাহিত হল আদিল। যাক এখন তো ওদের দিকেই ঘুরেছে খেলা। কন্ট্রোল তো গোপীর হাতে! তবে কি এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে?

“শুট হিম। দেরি করবেন না। করুন গুলি।”

একটা গলা পেল আদিল! কী ব্যাপার! আদিল উঁকি দিল।

যে লোকটা বলছে সে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল গোপীর পাশে।

গোপী তখনও বন্দুকটা ধরে আছে, “আপনি কে?”

“আপনার বন্ধু আমি। আপনি করুন গুলি নিরোকে,” লোকটা বলল আবার!

আদিল পিস্তলটা বের করল এবার। কী ঘটছে সামনে? এ লোকটা কে?

গোপী লোকটার দিকে তাকাল। তারপর আচমকা হাত বাড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরল লোকটার গলা।

লোকটা চেঁচিয়ে বলল, “আরে, কী করছেন! ওই দাঁড়িয়ে রয়েছে নিরো। শুট হিম।”

গোপী হাতের চাপ বাড়াল লোকটার গলায় তারপর কানের নীচে পিস্তলটা ঠেকিয়ে কেটে কেটে বলল, “আমি জানি ও নিরো। খুব ভাল করে জানি। কারণ ও তো আমার হয়েই কাজ করছে!”

এটা কী শুনছে! বুকটা কেঁপে উঠল আদিলের। গোপী! সত্যি গোপী! কিন্তু কেন?

গোপী নিরোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কাছে সব আছে। ডোন্ট ওরি। এটাকে শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়ব।”

“আপনি? নিজে এসব করেছেন?” লোকটা অবাক গলায় বলল।

আদিলের মনে হল গোপীর হাতে আটকা-পড়া লোকটা কেমন যেন ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে। ও কি সাহায্য করবে?

গোপী হাসল, “বিজনেস বোঝো কিছু? জানো কত টাকা অ্যাট স্টেক। কাজটা পাওয়া আমাদের দরকার ছিল। না হলে লোকের বিশ্বাস থাকত না আমাদের ওপর। কে একটা পিছিয়ে পড়া কোম্পানির শেয়ার কিনবে! এই রিসেশনের বাজারে কে ইনভেস্ট করবে তার টাকা আমাদের ওপর!”

“কিন্তু কাজ তো পেলেন। তবে?”

“কী প্রাইসে পেয়েছি জানো? টোটাল লস। এই কাজ করতে গেলে পুরো লালবাতি জ্বলবে। সব শেষ হবে। জিউস বুঝেছিল। তাই কথা তুলেছিল প্রাইস নিয়ে। কিন্তু পাবলিক কি এসব বোঝে? বোঝে না। তারা দেখেছে আমরা কাজ পেয়েছি। জানো কোথায় চড়েছে আমাদের শেয়ার! কিন্তু যদি এই কাজ করতে যাই তো ভরাডুবি হবে। ভরাডুবি মানে মিনিমাম পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিলিয়ান ডলার লস। আর নিজের থেকে কাজ ছাড়লে এখানে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাই উপায় কী?” গোপী হাসল, “নিরো এল তছনছ করল কলকাতা, গভর্নমেন্টকে বাধ্য করল অর্ডার ফিরিয়ে নিতে। কোম্পানির গুড উইল বজায় থাকল। আর সরকারের কাছেও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে রইলাম আমরা। প্লাস পরে যখন আবার এই ব্রিজের টেন্ডার হবে আমরাই প্রেফারেন্স পাব। তখন ঠিক প্রাইসে কাজটা নিয়ে বেরিয়ে যাব। বুঝলে?”

“এই জন্য এত লোককে মারলেন?”

“সারা পৃথিবী এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শুধু যুদ্ধের ধরনটা বদলে গেছে। যুদ্ধে ক্যাজুয়ালটি তো হবেই!” গোপী বলল, “আর তুমি হলে আমাদের আসল লোক। যখন বলা হল কাজটা কর। করলে না। আর তাই তোমায় ফাঁদে ফেলে আনা হল। নিরো কি শেষ করে দিতে পারত না ফাদারকে? কিন্তু যেখানে আহত করলেই তুমি রাগে অন্ধ হয়ে ছুটে আসবে…”

“শুধু আমি বারণ করেছি বলে!”

গোপী হাসল, “তাই কি হয়! আমরা চলে যাব আর কিছু রেখে যাব না। তোমায় মেরে ফেলে রেখে যাব এখানে। সঙ্গে থাকবে ঝাঁকড়া চুলের উইগ, সবুজ কন্ট্যাক্ট লেন্স আর নিরোর ব্যবহার করা ফোন। ‘র’ ঠিক ওটাকে ট্রেস করে নেবে। তারপর সারা পৃথিবী জানবে দু’জন ঢুকেছিল কলকাতায়। একজন আমায় বন্দি করে পালিয়েছে আর একজন মরে পড়ে আছে। তারপর তোমার অতীত খুঁজবে সবাই। কিন্তু এমন কিছুই পাবে না যা আমাদের সঙ্গে লিঙ্ক করতে পারে তোমায়। তার উপর শহর বাঁচাতে স্প্যানিশ রোজ় স্যাক্রিফাইস করলাম! অর্ডার ছাড়লাম! আমার ক্রেডেনশিয়াল নিয়ে কে প্রশ্ন করবে? তা ছাড়া আমি তো বন্দি। আমি কী করতে পারি বলো!”

আদিলের শরীর দিয়ে যেন আগুন বেরচ্ছে! এটা সারা পৃথিবী জানতে পারবে না! এখন বুঝতে পারছে কেন স্প্যানিশ রোজ়টা ডিমান্ড করা হয়েছিল!

ওর অসহায় লাগল। গোপী একবার হেলিকপ্টারে করে বেরিয়ে গেলে কী করবে আদিল! প্রমাণ নেই তো হাতে! গোপী যে ইমেজ তৈরি করেছে নিজের তাতে কে বিশ্বাস করবে আদিলকে!

লোকটা আবার বলল, “আপনি নিজে এত বড় একটা কাজ করলেন! আপনার কোম্পানি আপনাকে ছেড়ে দেবে?”

গোপী ধৈর্য হারাল এবার, “এত প্রশ্ন কেন, হ্যাঁ? ইন্টারভিউ চলছে? ঠিক আছে, মরার আগে শুনে নে তবে। আমি লেফটেন্যান্ট মাত্র। জাস্ট অ্যান ইনস্ট্রুমেন্ট। বুঝলি?”

লোকটা স্থির গলায় জিজ্ঞেস করল, “কার অর্ডার তবে এটা? এর মাস্টার মাইন্ড কে?”

৩১

দেড় মাস আগে। ব্রাসেলস। সকাল সোয়া এগারোটা।

কনফারেন্স রুম থেকে দরজাটা দড়াম করে খুলে বেরিয়ে এল পিটার। টাই-এর নট-টা আলগা করে হনহন করে হাঁটতে শুরু করল চওড়া করিডর দিয়ে। এত বড় সাহস? ওকে বের করে দেবে কোম্পানি থেকে? ফ্রড-এর চার্জে জেলে ভরবে! মুখে চুন কালি মাখাবে! প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে কী চলল এটা? ইনকুইজিশন?

ও কি জানে না ব্রিজের কাজটা আন্ডার কোট করে নিয়েছে? কিন্তু পাবলিক অত বোঝে নাকি! ওরা বলছে ঠিক খবর লিক হবে। আর তার পরে নাকি কোম্পানির রেপুটেশনের সঙ্গে শেয়ার বাজারে দামও এমন পড়বে যে স্টোনটেককে আর ব্যবসা করে খেতে হবে না!

একজন তো বলল সে নিজেই নাকি প্রেসের কাছে ফাঁস করে দেবে। এ ছাড়া স্টোনটেককে নাকি বাঁচানোর আর উপায় নেই!

পকেট থেকে চুরুটটা বের করে দাঁতে কামড়াল পিটার। ওরা কি আর জানে কী প্ল্যান আছে ওর! স্টোনটেককে অত সহজে পড়তে দেবে ও! পৃথিবীতে সব কিছুর একটা ব্যাক ডোর থাকে। এরা কী ভেবেছে ও কোনও ব্যাক ডোরের কথা না ভেবেই এই কাজটা নিয়েছে!

গোপী একমাত্র জানে ওর প্ল্যান। ছেলেটা কাজের।

একবার কনফারেন্স রুমের দিকে তাকাল পিটার। বাঞ্চ অব বাগার্স!

পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করল পিটার। চারটে রিং হওয়ার পরে ফোনটা ধরা হল ওদিক থেকে।

পিটার চুরুটটা হাতে নিয়ে দাঁত চেপে বলল, “টাইম হ্যাজ কাম গোপী। ইনিশিয়েট। আর মনে রেখো, ইমপ্যাক্ট শুড বি কলোসাল। বুঝলে!”

৩২

এখন। কলকাতা।

পকেট থেকে ছোট্ট একটা ট্রেসার বের করে তার বাটনটা পুশ করল নিরো। একটু দূরে, রাস্তায় ‘কুঁক’ করে শব্দ হল একটা। জ্বলে উঠল লাল আলো। ওর পিস্তল। নিরো এগিয়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিল সেটা। তারপর বলল, “গোপী। আপনি সরে যান। আমার কাজ আমায় করতে দিন। অনেক সময় নষ্ট…”

আদিল আড়াল থেকে দেখল যে নিরো শেষ করতে পারল না কথাটা। তার আগেই আচমকা লোকটা নিজের শরীরটাকে মোচড় দিয়ে ছিটকে সরে গেল ব্রিজের রেলিঙের দিকে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে বসে পড়ল গোপী। কিন্তু নিজেকে সামলেও নিল দ্রুত। টলতে টলতে উঠে ধরতে গেল লোকটাকে। আর নিরোও বন্দুক তুলল।

নিমেষের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিল আদিল। ওই লোকটা আর যেই হোক নিরোর বন্ধু নয়। আসলে নিরো যে দু’জনের কথা বলছিল, তার দ্বিতীয়জন হল এই গোপী!

ব্রিজের কেবলগুলোর ফাঁক দিয়ে লোকটা রেলিঙের কাছে চলে গেছে। গুলি করতে দু’এক সেকেন্ড বেশি সময় নিল নিরো। আর সেই সুযোগই ফায়ার করল আদিল।

নিরো স্থির হয়ে গেল একদম। তারপর ভেঙে পড়ল মাটিতে।

আদিল দ্রুত রিস্টে বাঁধা বাজারটা টিপল। ইলেকট্রনিক সংকেত ছিটকে গেল ব্রিজের দুই প্রান্তে। প্ল্যান মতো পুলিশ ও মিলিটারিরা এবার ঘিরে নেবে এই জায়গাটা।

“পুট দ্য গান ডাউন মিস্টার মুরলিরাজন,” আদিল ওর পিস্তলটা তাক করে বেরিয়ে এল আড়াল থেকে।

গোপী নিজের থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠে হাতের বন্দুকটা তুলল লোকটার দিকে। চিৎকার করে বলল, “এগোবেন না আদিল। আমি ওকে গুলি করব কিন্তু।”

আদিল বলল, “আর ভুল করবেন না। ফেলে দিন পিস্তল।”

লোকটা এই সুযোগে রেলিংটার ধারে চলে গেল আরও।

“স্টপ,” গোপী আর চিন্তা না করে ট্রিগারটা টানল।

কিন্তু ফায়ার হল না! শুধু কট করে শব্দ হল একটা। গোপী পাগলের মতো ট্রিগার টানতে লাগল, পিস্তল ঝাঁকাতে লাগল। কিন্তু গুলি বেরোচ্ছে না!

আদিল এই সুযোগটা নিল। দূর থেকে গোপীকে কাভার করেই লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, “তুমি নড়বে না একদম! হাত তোলো মাথার ওপর। তোলো হাত!”

লোকটা ধীরে ধীরে হাত তুলল। তারপর আচমকা শরীরটাকে কুঁকড়ে নিয়ে স্প্রিঙের মতো ছিটকে উঠল। নিমেষে রিভার্স সামারসল্ট খেয়ে টপকে গেল রেলিং। আদিল দৌড়ে গেল। কিন্তু তার আগেই আবছাভাবে জলে কিছু পড়ার শব্দ শোনা গেল নীচে!

দূর থেকে অনেকগুলো বুটের শব্দ আসছে। হইহই করে গাড়ি আসছে। ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে ব্রিজের আলোগুলো। এবার গোপীর দিকে তাকাল আদিল। দেখল মাটিতে বসে পড়েছে ও। খেলা যে শেষ বুঝতেই পারছে!

আদিল এগিয়ে গেল গোপীর দিকে, ওর হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে বলল, “বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি আছে পিস্তলটায়। এটা যার তার হাতেই চলবে। বৃথা গুলি করার চেষ্টা করলেন। আসলে প্রকৃত শয়তান বোধহয় এমন বন্ধুর পোশাকেই আসে!”

“শয়তান? আমি?” গোপী হাসল, “আমি অন্যকে বাঁচাবার জন্য স্যাক্রিফাইস করতে এসেছিলাম। দুটো টেররিস্ট এসেছিল আমায় মারতে। একজন পালিয়েছে আর অন্যজনকে আপনি গুলি করে মেরেছেন! ব্যাস। আমি জানি আপনি সবাইকে বলবেন আমি দোষী। আমি বলব আমি দোষী নই। আপনার কথার বিরুদ্ধে আমার কথা! কারণ আপনার কাছে কোনও প্রমাণ তো নেই! কতদিন আর আমায় প্রমাণ ছাড়া আটকে রাখবেন?”

আদিল আচমকা গোপীকে চড় মারল একটা। তারপর হিসহিসে গলায় বলল, “তুই ছাড়া পেলেও আমি কিন্তু তোকে ছাড়ব না।”

গোপী হাসল। প্রাণখোলা হাসি, “আপনার বীরত্বের জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি! কিন্তু আইন প্রমাণ চাইবে। কেমন?”

আদিল উত্তর না দিয়ে গোপীর কলার ধরে ঠেলে দিল এগিয়ে আসা পুলিশদের দিকে। বলল, “পুট দিস ম্যান আন্ডার অ্যারেস্ট।”

৩৩

জিনি ঘরে ঢুকতেই সিএম থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সবাই তাকালেন ওর দিকে। জিনি এঁদের এতদিন টিভিতেই দেখে এসেছে। তাই সামনে থেকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল।

সিএম বললেন, “আরে তুমি তো বাচ্চা মেয়ে! এমন কাণ্ড করলে কী করে!”

জিনি বলল, “আমি করিনি ম্যাম। ওই লোকটা… ওই লোকটাই সব করেছে!”

সত্যি জিনি কিছুই করেনি! সকাল থেকে আজ যা হল তাতে ওর কেরিয়ারের গ্রাফটাই পালটে গেল পুরো! এখন ও রীতিমতো একজন সেলিব্রিটি! ওর প্রচার করা লাইভ ফুটেজের ভিত্তিতেই গোপী আর পিটার ক্রেগের বিরুদ্ধে মামলা সাজানো হবে। নাশকতা, সন্ত্রাস, দেশদ্রোহিতা, খুন আরও নানান সব মামলা।

জিনি জানে এঁরা সবাই ওকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে তো ওই লোকটাই সব করল! লোকটা যখন ওকে বলেছিল, “তোমায় একটা কাজ করতে হবে!” ও তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল!

কিন্তু লোকটা একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছিল। বলেছিল, “আজ সন্ধেবেলা একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার লাইভ টেলিকাস্ট অ্যারেঞ্জ করতে পারবে? পারলে, অনেক কিছু পালটে যাবে।”

লোকটা যে মিথ্যে বলছে না, বুঝতে পেরেছিল জিনি।

চলে যাওয়ার আগে লোকটা জিনির ব্যাগের সামনের চেন থেকে ছোট্ট ব্যাটারির মতো জিনিস বের করে নিয়েছিল, বলেছিল, “জিপিএস ট্র্যাকারটা নিয়ে নিলাম।” তারপর একটা ছোট্ট ট্যাব দিয়েছিল জিনির হাতে, “এই ট্যাবে লাইভ ফিড পাবে। জাস্ট টেলিকাস্ট কোরো। মনে রেখো, তোমারও এই শহরের প্রতি দায়িত্ব আছে একটা!”

অবাক হয়ে লোকটার চলে যাওয়া দেখেছিল জিনি। নিলয় বাসু নাম নিয়ে আসা এই লোকটার আসল নাম কী?

জিনি নিজের বসকে ফোন করে আর সময় নষ্ট করেনি। হাজারটা কৈফিয়ত দিতে গিয়ে কাজটাই হবে না!

ও দূরে দাঁড়ানো মনোজকে ডেকেছিল সঙ্গে সঙ্গে। এবিপি আনন্দতে আছে মনোজ। লালবাজারে আজ ওর সঙ্গেই অনেকক্ষণ কথা বলেছে জিনি। বন্ধুরা থাকে কীসের জন্য!

আজ সারা দেশ দেখেছে বিদ্যাসাগর সেতুর ঘটনা। লোকটা নিজের কাঁধে একটা স্মার্ট ফোন লাগিয়ে গোটা ঘটনাটা নাইট ভিশন মোডে শুট করে লাইভ পাঠিয়েছে জিনির কাছে!

সাংবাদিক হিসেবে জিনির নাম এক ধাক্কায় পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে। তার সঙ্গে ডাক পড়েছে লালবাজারে।

জিনি আর কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকল আদিল।

সিএম এগিয়ে গেলেন নিজে। আদিলের হাত ধরে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ এগেন আদিল।”

আদিল মাথা ঝোঁকাল শুধু, বলল, “গোপী অন্য ঘরে আছে ম্যাডাম। ওর কাছে থেকে ক্যানসেল করা অর্ডারটা পেয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যভাবে স্প্যানিশ রোজ়ের থলিটা পাওয়া যায়নি!”

“মানে? ওটা তো গোপীর কাছেই ছিল!” অ্যান্টনিজি অবাক হলেন।

“সেই তো। ওকে সার্চ করেছি! আশেপাশে দেখেছি। কিচ্ছু নেই! জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে গেছে! গোপীও কিছু বলতে পারছে না। তবে সরি স্যার, গোপীর বিরুদ্ধে তেমন কোনও এভিডেন্স… মানে নিরো বেঁচে থাকলেও হত। কিন্তু…”

অ্যান্টনিজি হেসে জিনিকে দেখিয়ে বললেন, “কিন্তু দিস লিটল গার্ল হ্যাজ মেড দ্যাট পসিবল।”

জিনি হাসল, তারপর মৃদু গলায় বলল, “না স্যার, আমি নই। ওই লোকটা!”

সিএম জিজ্ঞেস করলেন, “দেখেছ তাকে?”

অ্যান্টনিজি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন দেখতে? কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা হল?”

সুরজিৎবাবু বললেন, “আমাদের ড্রাইভাররা গঙ্গায় খুঁজছে তাকে। নেভি তাদের মোটর বোট নিয়েও তল্লাশি করছে। কেমন দেখতে একটু মনে করো। আমাদের খুঁজে পেতে সুবিধে হবে। থিঙ্ক হার্ড।”

জিনি তাকাল সবার দিকে। তারপর বলল, “আমি তো দেখিনি। আমায় ফোনে কন্ট্যাক্ট করল।”

“ফোনে!” সঞ্জয়বাবু যেন এই প্রথম একটু আশ্চর্য হলেন!

“হ্যাঁ। তারপর একটা বাচ্চা ছেলে, ফুটপাথে থাকে আর কী, এসে এই ট্যাবটা দিল। সেই ছেলেটাও কে জানি না।”

“বাচ্চা ছেলে? ফোনে কথা? কিন্তু তোমাকেই কেন?”

জিনি বোকার মতো তাকাল সবার দিকে, “আমিও তো তাই ভাবছি স্যার। কী বলি বলুন তো!”

অ্যান্টনিজি বললেন, “ঠিক আছে। সার্চ চলুক। তবে একটাই আপশোস রয়ে গেল। পিটার ক্রেগকে ধরা গেল না। ব্রিটেনে আছে লোকটা। ওখান থেকে তো আর ওকে আনতে পারব না। প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই যে! আর গোপীর স্টেটমেন্ট ছাড়া ওর বিরুদ্ধে তেমন প্রমাণও তো নেই! ওই শয়তানটাকে যদি শাস্তি দেওয়া যেত!”

জিনি চুপ করে সরে এল এবার।

ঘরের কোণা থেকে আদিল এগিয়ে এল ওর দিকে। জিজ্ঞেস করল, “লোকটা বাঙালি, না?”

“আমি কী করে জানব?”

আদিল হাসল, “জানেন না! আচ্ছা, একটা ফোনেই সব বিশ্বাস করে নিলেন? আর রাস্তার একটা বাচ্চা এসে এমন সফিসটিকেটেড ডিভাইস দিয়ে গেল? স্ট্রেঞ্জ!”

জিনি কিছু না বলে তাকাল শুধু।

হাসল আদিল। ও জানে জিনি এর বেশি কিছু বলবে না। জানে, সন্ধেবেলা জিনি সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেছে। আর এখন দায়িত্ব পালন করছে মানুষের!

৩৪

পার্কসার্কাস ক্রসিঙে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বাইরে তাকাল আদিল। চারিদিকে রোজকার মতো ব্যস্ত শহর। কে বলবে এই গত পরশু একটা কাণ্ড ঘটে গেল!

পুজো আসছে সামনে। তাই বাঙালিকে ঘরে আটকে রাখবে সাধ্য কার! নিজের অজান্তেই হাসি পেয়ে গেল আদিলের।

“তুমি হাসছ! আমায় ফুল কিনে দিতে বললাম আর তাতে তুমি হাসছ!” পাশের থেকে রাগের গলায় বলে উঠল শাহিন!

ইশ। শাহিন কী বলছিল এতক্ষণ একদম শোনেনি!

সাতদিন ছুটি পেয়েছে আদিল। আর তাই শাহিনের আবদার মতো ওকে নিয়ে বেরোতে হয়েছে। কিন্তু থেকে থেকেই কেমন যেন আনমনা হয়ে যাচ্ছে আজ।

“কী হল? ফু-উ-ল!”

একটা লোক এসে আদিলের পাশের জানলায় ঠকঠক করছে। হাতে দু-তিন গোছা গোলাপ।

“এগুলো কবরখানার ফুল।”

“হোক। ফুল ফুলই। ফ্রেশ থাকলেই হল। কিনে দাও।” শাহিন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফোলাল।

আদিল কাচটা নামিয়ে এক গোছা গোলাপ কিনল।

সামনের সিগনাল খুলে গেছে এবার। পেছনের গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে খুব। আদিল আর দেরি করল না। এখান থেকে চার নম্বর ব্রিজ ধরে বাইপাসে উঠবে।

শাহিন ফুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। বলছেও কিছু। ওর হাসিখুশি মুখ দেখে ভাল লাগল আদিলের। এমন হাসিখুশি মুখের সমষ্টিই তো আমাদের দেশ!

“আরে! এটা কী!” শাহিন আচমকা চেঁচিয়ে উঠল।

একটু ঘাবড়ে গেল আদিল। কী ব্যাপার! ও পাশে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে ধক করে উঠল বুকটা। শাহিনের হাতে ওটা কী?

দ্রুত গাড়িটাকে রাস্তার বাঁদিকে দাঁড় করাল আদিল। শাহিনের হাত থেকে নিয়ে নিল জিনিসটা। সঙ্গে কীসের কাগজ এটা? একটা ছোট্ট নোট! লেখা:

‘আপনাদের সুখী জীবনের কামনায়… বাকি ছ’টা ফুল আমি নিলাম। অরফ্যানেজের বাচ্চাগুলোর সুবিধে হবে! ভাল থাকবেন। দেখা তো হবেই আবার। টিল দেন…’

আদিল চট করে দরজা খুলে বেরোল গাড়ির বাইরে। মানুষের সমুদ্রে কোথায় হারিয়ে গেল ফুলওয়ালা? কেমন দেখতে ছিল যেন? মাঝবয়সি। কাঁচা পাকা চুল। খুঁড়িয়ে হাঁটছিল কি? গেলটা কোথায়! আদিল এদিক ওদিক তাকাল। নাঃ, ভিড়ে মিশে গেছে! গোপী যখন ওকে গলা পেঁচিয়ে ধরেছিল তখনই কি তবে পকেট থেকে থলিটা… আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে এসে বসল, “কী মানুষ!”

শাহিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”

আদিল হাসল সামান্য। তারপর ধীর গলায় বলল, “এক সম্রাজ্ঞীর জন্য উপহার। সামান্য গোলাপ। রোজ়। স্প্যানিশ রোজ়!”

৩৫

একমাস পরে। লন্ডনে।

ঘরে ঢুকে ওভারকোটটা খুলে ফেলল পিটার। আজ একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। কিন্তু কী করবে! নেমন্তন্ন ছিল। লন্ডনের বেঙ্গলিরা বেশ কয়েকটা দুর্গাপুজো করে। তার একটায় যেতে হয়েছিল। সামাজিকতা রক্ষা করতে হয় তো!

আসলে গত মাসখানেক ধরে যা চলছে! বিজনেস দুনিয়ায় একদম শোরগোল পড়ে গেছে! আবার শেয়ার পড়ে গেছে স্টোনটেকের। পিটারের সমস্ত চেষ্টাই জলে গেল! গোপী যে এমন ঘেঁটে দেবে প্ল্যানটা বুঝতে পারেনি! ব্যাটা নিজে গিয়ে কাজ সেরে বেরিয়ে আসত। তা না, নিজেদের ট্রেল মোছার জন্য মাঝখানে আর একজনকে ফাঁসাতে গিয়েছিল! ইডিয়ট! কাউকে যদি আজকাল ভরসা করা যায়!

এখন গোপীকে সম্পূর্ণরকম অস্বীকার করেছে স্টোনটেক। বলেছে ওদের কোনও যোগাযোগই নেই গোপীর এই অপরাধের সঙ্গে। বরং আশ্বাস দিয়েছে তদন্তে সবরকমের সাহায্য করবে ভারত সরকারকে।

বাহামাসে প্রপার্টি! হাসি পেল পিটারের। রিভেরি অফ আ ফুল! তবে একটাই বাঁচোয়া, ওর টিকি কেউ ছুঁতে পারবে না!

পিটার বার কাউন্টারের ওপর ছোট্ট আলোটা জ্বালিয়ে একটু হুইস্কি নিল। টাই-এর নটটা আলগা করে বসল সোফায়। বড় ঘরের বাকিটা অন্ধকারে ডুবে আছে।

গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে রাখল সোফার হ্যান্ডরেস্টে। তারপর ফোনটা বের করল পিটার। সেই রাতে ব্রিজ থেকে যে লোকটা পালিয়েছে, সে খুব ডেঞ্জারাস। ওকে খুঁজে বের করে খতম করতে হবে! শত্রুর শেষ রাখতে নেই যে!

এই সব কাজে টমাস ওকে সাহায্য করতে পারে। এই স্কটিশ লোকটি খুব কাজের! ফোনটা কানে লাগাল ও। তারপর গ্লাসটা তুলতে গেল।

“নট এনি মোর।”

আচমকা গলার স্বরে ঘাবড়ে গেল পিটার। ফোনটা পড়ে গেল হাত থেকে। ভয়ার্ত চোখে সামনের অন্ধকারে তাকাল ও। একটা অবয়ব সেই অন্ধকারের থেকে বেরিয়ে এল ধীরে ধীরে। কালো কাপড়ে ঢাকা শরীর, মুখ। হাতে ওর দিকে তাক করা পিস্তল।

“কী চাও? কী…”

“ফাদার ফ্রান্সিস। নিরীহ সব মানুষ। এদের জীবনের কোনও দাম নেই, না?” লোকটার গলাটা ভীষণ ঠান্ডা শোনাল, “আছে পিটার। দাম আছে। তবে টাকা দিয়ে তা মাপা যায় না।”

অন্ধকার দিয়ে বানানো এই লোকটা কে? পিটার জিজ্ঞেস করল, “কী চাও তুমি? মানি? পাউন্ড? কত? এক মিলিয়ান? দু মিলিয়ান? প্লিজ়…”

“প্লিজ়!” লোকটা হাসল, “খারাপ মানুষ হওয়ার সমস্যাটা কী জানো? জানবে, তোমার চেয়েও খারাপ কেউ থাকতে পারে যে প্লিজ়-এর মানে বোঝে না।”

“কে তুমি? কে?” আতঙ্কের চোখে তাকাল পিটার।

বন্দুকটা পিটারের মাথার দিকে তুলল লোকটা। তারপর শান্ত গলায় বলল, “আমি সেন, অদম্য সেন।”

(সমস্ত ঘটনাই সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও গল্পের জন্য লেখা। যদি কোনও মিল থেকে যায় তা নেহাতই কাকতালীয়।)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments