Thursday, May 2, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পঅমানুষিক - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

অমানুষিক – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভয় সমগ্র - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

যাঁদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া অভ্যাস তাঁরা নিশ্চয় ঘটনাটা পড়েছেন। আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের কথা। হত্যা কাহিনিটা ফলাও করে সংবাদপত্র ছাপিয়েছিল, কিন্তু হৈমন্তী ঘোষালের কবিত্বটার কথায় বিশেষ জোর দেয়নি।

সমস্ত ঘটনাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার জানা, কারণ সেই সময়ে হৈমন্তী ঘোষালের সহকারী হিসেবে আমি কাজ করেছিলাম।

এদেশে হৈমন্তীর আগে নারী-গোয়েন্দা কেউ ছিল বলে জানি না, পরে আর কেউ হয়েছে কি না তাও বলতে পারব না। এমএসসি পাশ করে ফোরেনসিক মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করছি এক অভিজ্ঞ বিজ্ঞানের অধ্যাপকের কাছে, হৈমন্তীর হঠাৎ চোখে পড়ে গেলাম।

কী একটা ব্যাপারে হৈমন্তী অধ্যাপকের কাছে আনাগোনা করছিল, সেই সূত্রেই আলাপ হয়ে গেল। হৈমন্তী আমাকে সোজাসুজি জানাল তার সহকারী হিসাবে কাজ করার জন্য। হৈমন্তী ঘোষাল যে শখের গোয়েন্দা সে-পরিচয় তখনই পেলাম।

যাক, আসল ঘটনাটা বলি।

রায়বাহাদুর তেজেশ সরকার। অভ্র ব্যাবসার একচ্ছত্র মালিক। থাকেন গিরিডিতে। বিপত্নীক, একটি ছেলে পড়ার ব্যাপারে গ্লাসগো, একটি মেয়ে শ্বশুরবাড়ি মিরাটে।

তেজশ সরকার থাকতেন ভৃত্যদের হেফাজতে। বিশেষ করে বৃদ্ধ রামকমলই দেখাশোনা করত। খুব পুরোনো লোক। ছেলেবেলায় তেজেশবাবুর খেলার সাথি ছিল।

এক শনিবারের ভোরে। বিছানায় শুয়ে আধ ঘুম জাগরণ অবস্থা, ফোন বেজে উঠল।

‘কে নিরুপম? আমি হৈমন্তী। এখনই চলে এসো।’

‘কী ব্যাপার?’ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।

‘আজই আমরা গিরিডি রওনা হব। তুমি তৈরি হয়ে এসো।’

তখনও সকালের কাগজটা পড়া হয়নি। তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে রওনা হয়ে পড়লাম।

হৈমন্তীও তৈরি হয়ে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছিল।

আবার উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন করলাম, ‘কী, হল কী?’

‘ট্রেনে বলব।’

ট্রেনে উঠে হৈমন্তী হাতের কাগজটা আমার সামনে প্রসারিত করে দিল। বড়ো বড়ো অক্ষরের লেখা— রায়বাহাদুর তেজেশচন্দ্র সরকার নিহত।

তারপর ছোটো ছোটো অক্ষরে বিবরণ ‘কে বা কাহারা রায়বাহাদুরকে হত্যা করিয়া গিয়াছে। প্রতি রাত্রের মতোই এক কাপ দুধ পান করিয়া শয়ন করেন। পরদিন অনেক দরজা ঠেলাঠেলির পর তাঁহার ঘুম না ভাঙাইতে পারিয়া বৃদ্ধ ভৃত্য লোক ডাকিয়া দরজা ভাঙিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া প্রভুকে মৃত অবস্থায় দেখিতে পায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা, সমস্ত দরজা জানলা ভিতর হইতে অর্গল বন্ধ ছিল। কাজেই দুর্বৃত্তরা কীভাবে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল, তাহা কিছু জানা যাইতেছে না। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরিত হইয়াছে।’

তারপর তেজেশবাবুর জনহিতকর কাজের তালিকা, তাঁর বিশাল হৃদয়ের পরিচয় প্রভৃতির ফিরিস্তি।

‘তোমার কী মনে হয় নিরুপম?’

‘আত্মহত্যা নয়তো?’

‘সে রকম কোনো স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া এ বয়সে লোকে আত্মহত্যা করেও না।’

‘তবে, আপনার কী মনে হয়?’

হৈমন্তী হাসল, ‘আমার কিছুই মনে হয় না। সরেজমিনে তদারক না করলে কিছুই বলতে পারব না। আমি ফোনে পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের সবরকম সুযোগ দেবেন। দেখা যাক।’

হোটেলে জিনিসপত্র রেখেই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। তেজেশবাবুর দরজায় পুলিশ মোতায়েন ছিল। আমাদের দেখে সেলাম করে পথ ছেড়ে দিল। সম্ভবত পুলিশ সুপার আমাদের কথা তাকে বলে থাকবেন।

দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। তেজেশবাবুর শয়নকক্ষ। দোতলায়। এককোণে আধুনিক ডিজাইনের একটি খাট। মাথার কাছে টিপয়ের ওপর টেলিফোন। পাশে একটি ছোটো টেবিল, নীচের থাকে কতকগুলো বই। ওপরে সম্ভবত দুধের কাপটা ছিল। ঘরে আর কোনো আসবাব নেই। দেয়ালে মাত্র একটা ছবি। বুদ্ধের। তিব্বতী ঢং-এ আঁকা। সেই ছবির সামনে মেঝের ওপর একটা কার্পেটের আসন পাতা।

রামকমলকে ডেকে পাঠানো হল। চোখ মুছতে মুছতে বেচারি এসে হাজির।

রাত্রে তেজেশবাবু দুধ ছাড়া কিছু খান না। শুধু এক কাপ ঠান্ডা দুধ। খুব ঠান্ডা। প্রত্যেক রাতেই দুধ চাপা দিয়ে রেখে রামকমল চলে যায়। দুধ ঠান্ডা হলে তেজেশবাবু পান করেন।

‘এখানে আসন কেন?’ হৈমন্তী প্রশ্ন করল।

‘বাবু প্রত্যেদিন বসে জপ করেন। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে।’

‘এ ছবিটা কোথা থেকে এল?’

‘অনেক আগে বাবু গ্যাংটক থেকে কিনে এসেছিলেন।’

হৈমন্তী আর কিছু বলল না। ঘুরে ঘুরে সমস্ত জানলা দরজা মেঝে তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগল। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। হাতের অথবা পায়ের।

‘এমনও তো হতে পারে, কেউ আগে থেকে খাটের তলায় লুকিয়েছিল।’

দোরগোড়ায় দাঁড়ানো পুলিশটা আলোকপাত করার চেষ্টা করল।

হৈমন্তী হাসল, ‘কাজ শেষ করে লোকটা তাহলে পালাল কোথা দিয়ে? দরজা ভেঙে এ ঘরে ঢুকতে হয়েছিল, শুনলাম। দরজা এখনও ভাঙাই রয়েছে।’

অপ্রস্তুত পুলিশটি সরে গেল সেখান থেকে।

একটু পরেই অনেকগুলো বুটের শব্দ শোনা গেল। দারোগা আর এক সহকর্মী এসে হাজির হল।

‘এই যে হৈমন্তীবাবু, কিছু পেলেন খুঁজে?’

হৈমন্তী কোনো উত্তর দিল না। একটা আতশ কাচ হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে কী দেখতে লাগল।

দারোগা বলতে লাগল, ‘পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসেছে, পোটাসিয়াম সায়নাইডে মৃত্যু। দুধে মেশানো ছিল। বুঝতে পারছেন, এ রামকমলের কীর্তি। তাকে গ্রেপ্তার করার অর্ডার দিয়েছি।’

এবারেও হৈমন্তী কিছু বলল না। এদিক-ওদিক চেয়ে একবার দেখল। রামকমল নেই। পুলিশ তখন তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে অ্যারেস্ট করেছে।

‘আর কী দেখবেন?’ দারোগা তাড়া দিল।

হৈমন্তী কয়েক পা পিছিয়ে এসে একটা ভেন্টিলেটারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওটা খোলা ছিল?’

দারোগা টিটকিরি দিয়ে হেসে উঠল, ‘একেই বলে স্ত্রী বুদ্ধি! এ ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে বড়োজোর একটা বেড়ালবাচ্ছা গলে আসতে পারে, মানুষের কথা বাদ দিন।’

‘আমাকে একটা কাঠের মই জোগাড় করে দিতে পারেন?’ হৈমন্তী দারোগার কথায় কর্ণপাত করল না।

‘কী করবেন? ভেন্টিলেটার দিয়ে ঢোকা যায় কি না পরখ করবেন?’ দারোগার হাসি আকর্ণ বিস্তৃত।

হৈমন্তী দৃঢ়কণ্ঠে আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘দেখ তো নিরুপম, কাঠের একটা মই জোগাড় করতে পারো কিনা?’

আমাকে আর যেতে হল না। বাইরে থেকে একটা পুলিশই মই নিয়ে এল। কিছুদিন আগেই বাড়িতে রং দেওয়া হয়েছিল, মিস্ত্রিদের মই বাইরে পড়েছিল।

মই আনতেই হৈমন্তী তর তর করে মই বেয়ে উঠে পড়ল। ভেন্টিলেটারের কাছে ঝুঁকে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে কী দেখল, তারপর সাবধানে নেমে এল।

‘কি, পেলেন কিছু খুঁজে?’ দারোগা জিজ্ঞাসা করল।

‘না, মিস্টার রয়, নতুন কিছু পেলাম না,’ হৈমন্তী ঘাড় নাড়ল; ‘রামকমলই বোধ হয় অপরাধী।’

হোটেলে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে হৈমন্তী আবার বের হল। সঙ্গে যথারীতি আমি।

এবার লক্ষ্য তেজেশবাবুর অভ্রের কারখানা।

কারখানা বন্ধ ছিল। আমরা ম্যানেজারের কামরায় ঢুকলাম।

সেই দুর্ঘটনার দিন সকাল থেকে তেজেশবাবুর সঙ্গে কারা দেখা করেছিল, তার একটা তালিকা জোগাড় হল। বেশিরভাগ লোকই অফিসের। কাগজপত্র সই করাতে এসেছিল। ব্যাবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে তেজেশবাবুর সঙ্গে কারও মনোমালিন্য আছে, এমন খবর পাওয়া গেল না।

আমরা দুজনে বেরিয়ে এলাম। হৈমন্তী খুব চিন্তিত। সারা পথ আমার সঙ্গে একটি কথাও বলল না।

‘চলো, একবার স্টেশনের এলাকাটা ঘুরে আসি।’

হৈমন্তীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিস্মিত হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কোনো উত্তর না-দিয়ে তার অনুসরণ করলাম।

স্টেশন ফাঁকা। এখন বোধ হয় আপ-ডাউন কোনো ট্রেনেরই আসার সম্ভাবনা নেই।

হৈমন্তী সোজা স্টেশনমাস্টারের ঘরে ঢুকে গেল। আমি পিছন পিছন।

স্টেশনমাস্টার টেবিলের ওপর দুটি পা তুলে দিবানিদ্রার আয়োজন করছিল, হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটি তরুণীকে দেখে বিব্রত হয়ে পা নামিয়ে নিল।

‘নমস্কার!’ হৈমন্তী সামনের টুলটা টেনে নিয়ে বসল।

‘কী বলুন?’ স্টেশনমাস্টার গলাটা প্রসারিত করল।

‘আচ্ছা, এখানে দেখার কী আছে বলুন তো? আপনি এখানে কত দিন আছেন?’

হৈমন্তীর কণ্ঠে কিশোরীর চাপল্য।

‘তা বছর পাঁচেক হয়ে গেল। এখানে তো লোকে উশ্রী জলপ্রপাত দেখতেই আসে। দেখেছেন সেটা?’

‘কবে!’ হৈমন্তী ঠোঁট ওলটাল, তারপর একটু থেমে বলল, ‘আচ্ছা, সেদিন পথের ধারে চমৎকার মেটে রং-এর খরগোশ দেখলাম। কাউকে বললে খরগোশ ধরে দেয় না?’

‘তা দেবে না কেন? সাঁওতালদের বলুন না, তারা ফাঁদ পেতে ধরে দেবে।’

‘আর পাখি, পাখি কেউ বিক্রি করে না? আমি অনেকগুলো কিনতে চাই।’

‘পাখি।’ ঠোঁট কামড়ে স্টেশনমাস্টার ভাবতে শুরু করল, তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এইভাবে বলল, ‘আরে, ভালো কথা, আপনি রূপচাঁদের দোকানে সোজা চলে যান না। পাখি, জানোয়ার যা দরকার তাই পাবেন।’

‘রূপচাঁদের দোকান।’ হৈমন্তী উত্তেজনা দমন করে বলল, ‘ঠিকানাটা দয়া করে বলে দেবেন?’

‘ঠিকানা আর কী! সোজা ওই রাস্তাটা ধরে চলে যান। ছোট্ট টিলা দেখছেন একটা, ওরই কোলে একটা সাইনবোর্ড দেখবেন। রূপচাঁদ অ্যান্ড কোং। কিন্তু খুব সাবধান, বেটা একেবারে গলাকাটা। যা দাম বলবে ঠিক তার অর্ধেক বলবেন, বুঝলেন?’

হৈমন্তী বুঝল।

দুজনে বেরিয়ে এসে প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়ালাম।

হৈমন্তীই বলল, ‘নিরুপম, চলো আগে এক কাপ চা খেয়ে নিই, তারপর রূপচাঁদ কোম্পানিতে যাব।’

একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘কোথায় এসেছেন খুনের কিনারা করতে, আর তা না-করে কোথায় রংবেরঙের পাখি পাওয়া যায়, তারই খোঁজে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন!’

হৈমন্তী মুখ টিপে হাসল। বলল, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে শেখো নিরুপম। বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর।’

আর কোনো কথা বললাম না। হাঁটতে হাঁটতে রূপচাঁদের দোকানে গিয়ে পৌঁছোলাম।

একতলা বাড়ি। পিছন দিকে বাগানের মধ্যে বিরাট টিনের চালা। তারই নীচে অজস্র খাঁচায় পাখি আর জন্তুর মেলা। পথে আসতে আসতেই পাখির কাকলি কানে আসছিল।

রূপচাঁদের দেখা মিলল। খর্বকায়, কৃশতনু। মনে হয় মানুষটা যেন অনেক ঝড়ঝাপটা পার হয়ে এসেছে।

হৈমন্তী এগিয়ে গেল।

‘কলকাতা থেকে আসছি। পাখির খুব শখ। প্রতি সপ্তাহে নিউ মার্কেট ঘুরে ঘুরে পাখি কিনি। আপনার কাছে নতুন রকমের পাখি কিছু আছে?’

রূপচাঁদ অপাঙ্গে আমাদের দুজনের আপাদমস্তক একবার জরিপ করল। তারপর বলল, ‘আসুন।’

খরগোশ গিনিপিগ আর হরেক রকমের পাখি।

হৈমন্তী এধার থেকে ওধারে দ্রুত চোখ বোলাতে লাগল। মনে হল সে যা আশা করেছিল, তা যেন পায়নি। চোখের দৃষ্টিতে হতাশায় আভা।

আমি বললাম, ‘এসব কাদের বিক্রি করেন?’

‘দেশ বিদেশ থেকে অর্ডার আসে। অনেক জায়গার চিড়িয়াখানাতেও যায়। তা ছাড়া অনেক বিজ্ঞানের কলেজে গিনিপিগ, খরগোশ এসবও দিতে হয়।’

হৈমন্তী আরও এগিয়ে গেছল। খাঁচায় সারের মাঝখানের সরু পথ দিয়ে। একেবারে কোণের দিকে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমরাও তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

একটা বড়ো খাঁচায় একটা ছোটো আকারের বানর। খাঁচার মাঝখানের রডটা ধরে ডিগবাজি খাচ্ছে।

‘বা, ভারি চমৎকার তো! এটা কত দাম?’ হৈমন্তী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

রূপচাঁদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘না, ওটা বিক্রি করতে পারব না। ওটা একটা সার্কাস কোম্পানিকে দেবার কথা হয়ে গেছে। তারা অগ্রিম টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছে। সেইজন্যই ওটাকে কিছু খেলা শিখিয়েছি।’

হৈমন্তী একবার রূপচাঁদের দিকে চেয়ে দেখল, তারপর সরে এল খাঁচার কাছ থেকে।

একটা বাচ্ছা হরিণ দর করে আগাম কিছু টাকা রূপচাঁদকে দিয়ে এল। বলে এল, পরের দিন সকালে লোক পাঠিয়ে হরিণটা নিয়ে যাবে।

রূপচাঁদ প্রাপ্তির একটা রসিদ লিখে দিল। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত হৈমন্তী খুব ব্যস্ত হয়ে রইল।

আমি হোটেলে শুয়ে রইলাম একটা মাসিক পত্রিকা নিয়ে। হৈমন্তীর সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে বারণ করল। হেসে বলল, ‘এখন নয়, পরে। এখন সঙ্গে থাকলে সাসপেন্সটা নষ্ট হয়ে যাবে। নিরুপায়। নারীচরিত্রের হদিস দেবতারাও পান না, তাও নারী গোয়েন্দা-চরিত্র!’

রাত কাটল। পরের দিন সকালে হৈমন্তীকে হরিণটা আনার কথা মনে করিয়ে দিলাম।

হৈমন্তী হেসে বলল, ‘আনব কার কাছ থেকে? রূপচাঁদবাবু হাজতে।’

চমকে উঠলাম, ‘সেকী?’

‘ধীরে, রজনী ধীরে। সময়ে সবই জানতে পারবে।’

হৈমন্তী বেরিয়ে গেল, আমাকে সঙ্গে না নিয়েই।

সমস্ত দিন হৈমন্তী বাইরেই রইল। হোটেলে ফিরল না। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খাওয়াদাওয়া সেরে শয্যায় গা এলিয়ে দিলাম।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, ঘুম ভাঙল হৈমন্তীর চিৎকারে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

‘কী ব্যাপার?’

‘চলো সার্কাস দেখে আসি।’

আমি হতভম্ব। বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম, ‘কী ব্যাপার আপনার বলুন তো? খুনের কিনারা করতে এসেছেন, না ফুর্তি করতে এসেছেন। আসামি ধরা চুলোয় গেল, কেবল কোথায় হরিণ বিক্রি হচ্ছে, কোথায় সার্কাস হচ্ছে, এই করে বেড়াচ্ছেন!’

হৈমন্তী হাসল। ‘শখের গোয়েন্দা হবার ওই এক মস্ত সুবিধা নিরুপম, কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। আসামি না ধরতে পারলে চাকরি যাবার ভয় নেই। নাও, যাবে তো চলো।’

অগত্যা উঠতে হল।

বাইরে একটা টাঙ্গা অপেক্ষা করছিল। তাতে উঠে বসলাম।

টাঙ্গা যে বাড়ির সামনে থাকল, উঁকি দিয়ে দেখেই আমি অবাক।

‘একী, এ যে রায়বাহাদুরের বাড়ি!’

‘সার্কাসের তাঁবু এখানেই পড়েছে। আর একটি কথাও নয় নিরুপম। চুপচাপ বাড়ির পিছন দিকে চলে এসো।’

আস্তে আস্তে পা ফেলে বাড়ির পিছন দিকে গেলাম, তারপর খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। সিঁড়ি দিয়ে একেবারে দোতলায়।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বাইরে কোথাও বাতি নেই। হৈমন্তী টর্চের আলোয় পথ দেখিয়ে চলল।

কিছুটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

টর্চের আলোতে দেখলাম দারোগাবাবু আর তার একজন সহকর্মী দাঁড়িয়ে। দারোগাবাবু নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল।

নিঃশব্দ পায়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

দরজায় সার সার তিনটি ছিদ্র। হৈমন্তীর নির্দেশে এক একজন এক একটি ছিদ্রে চোখ রাখলাম।

রায়বাহাদুর তেজেশ সরকারের শয়নকক্ষ। অনুজ্জ্বল আলো, কিন্তু দেখতে কোনো অসুবিধা হল না।

শয্যা প্রস্তুত। এদিকে টেবিলের ওপর ডিশ-ঢাকা কাপ। অন্যদিকে আসনের ওপর ছবির দিকে মুখ করে কে একজন উপবিষ্ট। এ কোণ থেকে তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

বুঝতে পারলাম। ঠিক হত্যার রাতের দৃশ্য সাজানো হয়েছে। আসামিকে ধরার জন্য এ পদ্ধতিও অন্য দেশে একাধিকবার অনুসৃত হয়েছে।

এও বোধ হয় তাই।

খুট করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠলাম, তারপর উত্তেজনায়, বিস্ময়ে যেন বাকরোধ হয়ে গেল।

দেয়ালের পাইপ বেয়ে তরতর করে বানরের একটা বাচ্ছা নেমে এল। আস্তে আস্তে এসে ডিশটা তুলে কাপে কী-একটা ফেলে দিয়ে আবার পাইপ বেয়ে নক্ষত্রগতিতে ভেন্টিলেটারের মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘আশ্চর্য!’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দারোগাবাবু প্রথম কথা বলল।

ভিতরের দরজা খুলে হৈমন্তী বাইরে এল। পিছনের আসন থেকে উঠে একটি পুলিশ কর্মচারীও বাইরে এসে দাঁড়াল।

দারোগাবাবুর দিকে চেয়ে হৈমন্তী বলল, ‘কি স্যার, বিশ্বাস হল?’

দারোগাবাবু হাতজোড় করে বলল, ‘অবলা কেন মা এত বলে!’

‘এবার অবশ্য বিষ নয়, অ্যানাসিনের বড়ি বানরটির হাতে দিয়েছিলাম। একই স্টিমুলাস, কাজেই তার রেসপন্স একই হয়েছিল।’

‘কিন্তু রূপচাঁদকে এর সঙ্গে জড়াবেন কী করে?’

‘রূপচাঁদের সই করা স্বীকারোক্তি আমার কাছে আছে। যাবার আগে আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি অনুগ্রহ করে বৃদ্ধ রামকমলবাবুকে আজই ছেড়ে দেবেন। বেচারি বড়ো কান্নাকাটি করছে।’

দারোগাবাবু মাথা নীচু করেই ঘাড় নাড়ল।

আসল কথা হল ফেরার সময়। ট্রেনে। ‘তা হলে সার্কাসটা তোমার খারাপ লাগেনি নিরুপম?’ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করল।

‘না, তা লাগেনি, কিন্তু গোড়া থেকে আমাকে একটু খুলে বলুন।’

হৈমন্তী চায়ের কাপটা সরিয়ে রেখে বলতে আরম্ভ করল।

‘প্রথমেই দুটো জিনিস আমার মনে হয়েছিল। এক, যে-ই রায়বাহাদুরকে হত্যা করে থাকুক, টাকা পয়সার জন্য যে করেনি— সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, কোনো টাকা পয়সা চুরি যায়নি, যদিও বালিশের তলায় তাঁর মানিব্যাগ থাকত। রায়বাহাদুরের মৃত্যুতে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি অন্য কেউ পাবে, এমন সম্ভাবনাও ছিল না, কারণ তিনি নিঃসন্তান নন। তাঁর উইলে তাঁর পুত্র-কন্যার জন্য যথারীতি সংস্থান করা আছে।

দুই, যেভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তাতে বোঝা যায় কোনো মানুষের পক্ষে বন্ধ ঘরে বাইরে থেকে ঢোকা সম্ভব নয়।

তোমার মনে থাকতে পারে, মই আনিয়ে আমি ভেন্টিলেটারের চারপাশ দেখেছিলাম।’

আমি ঘাড় নাড়লাম।

‘একটা হাতের বা পায়ের দাগ ছিল। মানুষের নয়, অন্য জন্তুর। আমার প্রথম ধারণা হয়েছিল কুকুরের। কেউ যেন ভেন্টিলেটার দিয়ে ঢুকেই নতুন দেওয়া রঙে পা পিছলে গিয়েছিল। সেই পায়ের ছাপ আমি মনে মনে তুলে নিই, তারপর হোটেলে ফিরে জন্তুজানোয়ারদের হাত পায়ের ছাপের যে বই আমার আছে, তা দেখে বুঝতে পারি, ছাপটা কুকুরের পায়ের নয়, বানরের। বুঝতে পারলাম বানরটি যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষিত। তারপর কী করে রূপচাঁদের সন্ধান পাই তা তোমার অজানা নয়। সেখানে বানরের নখে তখনও রং লেগেছিল।’

হৈমন্তী একটু থামল। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে আবার বলতে লাগল, রূপচাঁদকে নিয়েই আমাকে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। কিছুটা মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে হয়েছে’।

‘মিথ্যার আশ্রয়?’

‘তাই বই কী!’

‘তাই বই কী।’ সোজাসুজি রূপচাঁদকে বললাম, ‘ছি, রূপচাঁদ, সবই বেশ কায়দামাফিক করে এসেছিলে, কিন্তু বিষটা আর একটু জোরালো দিতে হয়। দুধটা খাওয়ার পরও রায়বাহাদুর একটা কাগজ টেনে তোমার নামটা লেখবার যথেষ্ট সময় পেলেন কী করে? মানুষের মতন কাজ কি আর বানরে পারে? তাকে যতই ট্রেনিং দাও।’

রূপচাঁদ দুটো ঠোঁট টিপে রইল।

আমি বলতে লাগলাম, ”তোমার অনুতপ্ত হওয়া উচিত রূপচাঁদ। একজন নিরীহ, ধার্মিক ভদ্রলোককে তুমি এভাবে শেষ করলে। অমায়িক, দেশপূজ্য লোক, জীবনে কখনো কোনো অন্যায় করেননি—”

”আঃ থামুন, থামুন আপনি! জীবনে কখনো কোনো অন্যায় করেনি। মহাধার্মিক লোক! আমার সর্বনাশ কে করেছে? কে আমাকে আহত করে আমার যথাসর্বস্ব—”

রূপচাঁদ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

তারপরের কথাগুলো জানতে আর অসুবিধা হয়নি নিরুপম। অনেক বছর আগে দুই বন্ধু তেজেশ আর রূপচাঁদ, তখন তার নাম ছিল সুবিনয়, গ্যাংটক বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে গুম্ফার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান তাঁরা পেয়েছিলেন। দুজনে সে স্বর্ণমুদ্রা সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তারপর একই পান্থনিবাসে পাশাপাশি দুজনে যখন শুয়ে, তখন তেজেশবাবুর মনে লোভের সাপটা ফণা মেলে দাঁড়িয়ে উঠেছিল। অর্ধেকের চেয়ে সম্পূর্ণটা যে অনেক বেশি এমন একটা চিন্তা বার বার তার মস্তিষ্ককোষ আলোড়িত করেছিল।

তাই রাতের অন্ধকারে আস্তে আস্তে উঠে লোহা বাঁধানো বাঁশের লাঠিটা নিয়ে সুবিনয়ের মাথায় সবেগে আঘাত করে তার বুকের মধ্যে লুকানো স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে সেই রাতেই তেজেশবাবু দার্জিলিং চলে এসেছিলেন। তার পরের দিন কলকাতা। সেখান থেকে পশ্চিমের নানা দেশ।

তারপর কোথাও কোনো আলোড়ন না-দেখে গিরিডিতে এসে অভ্রের ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। তেজেশবাবু নিশ্চিন্তে ছিলেন যে কোনো ভয় নেই। মৃত ব্যক্তি তার অংশ চাইতে আসে না। তা ছাড়া এ অর্থের মালিকানা প্রমাণ করাও সহজসাধ্য নয়।

কিন্তু বছর দুয়েক আগে বেড়াতে বেড়াতে রূপচাঁদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তেজেশবাবু চিনতে পারেননি, কিন্তু রূপচাঁদ পেরেছিল।

রূপচাঁদ সত্যিই যে লোকটাকে চিনতে পেরেছিল, তাকে নিশ্চিহ্ন করে তার প্রমাণও সে দিয়েছে।’

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments