Thursday, May 2, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পঅবাস্তব - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

অবাস্তব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভয় সমগ্র - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

আমি তখন বি. এ. পড়ি। পরীক্ষা সামনে। বাড়ি থেকে বের হওয়া প্রায় বন্ধ। সারাদিন বাড়িতে বসে পড়াশুনো করছি। মাঝে মাঝে শুধু বিশ্রামের জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছি।

গত দু-বছর থিয়েটার, সিনেমা, জলসায় যে সময় নষ্ট করেছি তার খেসারত।

বিকালে বসে বসে অর্থনীতির পাতা ওলটাচ্ছি, দুম করে পাখা বন্ধ হয়ে গেল। আলোর সুইচ টিপে দেখলাম আলোও বন্ধ।

আমাদের ছাত্রাবস্থায় ‘লোডশেডিং’-এর ব্যাপার অজানা ছিল। বারান্দায় বেরিয়ে এপাশে-ওপাশে খোঁজ করে জানলাম এ এলাকার সব বাড়ির এক অবস্থা। বাতিও জ্বলছে না। পাখাও চলছে না।

কোথাও একটা বড়ো রকমের গোলমাল হয়েছে।

গুমোট গরম। বাড়িতে থাকা দুষ্কর। হ্যারিকেন কিংবা মোমবাতি জ্বেলে হাতপাখা নেড়ে নেড়ে পড়বার চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু এত মেহনতের পর মগজে কিছু ঢুকবে, এমন আশা দুরাশা।

তাই সে চেষ্টা না-করে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লাম।

আমাদের পাড়ায় দেখলাম বেশিরভাগ লোক দাওয়ায় হাতপাখা চালাচ্ছে। গাড়ি ঘোড়ার জন্য পথ চলাই দুষ্কর।

রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

চৌরাস্তায় এসে দেখলাম, রাস্তার ওপরের বাড়িগুলোর আলো জ্বলছে পাখাও নিশ্চয় চলছে।

ভাবলাম একটা কাজ করি, একটু দূরে যে পার্ক আছে, সেখানে গিয়ে বসি। তারপর বাতি জ্বললে ফিরে আসব।

পার্কে গিয়ে বসলাম। দিব্যি ফুরফুরে বাতাস বইছে। কাছাকাছি ফুটপাতে কেউ ফুলের পশরা নিয়ে বসেছে। মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে।

পার্কে ঘাস দেখার জো নেই এমনই অবস্থা! অনেকেই শুয়ে পড়েছে। অনেকে আধশোয়া হয়ে রাগিনী ভাঁজছে। কেউ কেউ দল নিয়ে চক্রাকারে বসে গল্পগুজবে মত্ত।

উঠতে ইচ্ছা করল না।

পরীক্ষার দিন সাতেক বাকি। মোটামুটি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির কয়েকটা অধ্যায়ের ওপর চোখ বুলিয়ে নিতে হবে।

ওখানে বসে বসে অর্থনীতির সূত্রগুলো মনে মনে আওড়াতে লাগলাম।

আমি আলোর কাছেই বসেছিলাম। পার্কের মাঝে মাঝে দীপদণ্ড। কোথাও অন্ধকার নেই।

‘আরে অজয়, এখানে বসে আছিস। তোকে আমি চারদিক খুঁজে বেড়াচ্ছি।’

মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, আমার সহপাঠী প্রিয়নাথ।

প্রিয়নাথ খুব নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে। অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়েছে, মামার বাড়িতে মানুষ। সেখানে বেশ অনাদরে প্রতিপালিত। টিউশনির পর টিউশনি করে কলেজের খরচ চালিয়েছে।

ছাত্র হিসেবে প্রিয়নাথ যথেষ্ট মেধাবী। আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ।

প্রিয়নাথকে আমারও প্রয়োজন ছিল।

অনেকগুলো পাঠ্যবিষয়ে দুজনে মিলে আলোচনা করে পড়লে অনেক সুবিধা হয়। তাই বললাম, ‘আয় আয় বস। তোর সঙ্গে আমারও কিছু দরকার আছে।’

প্রিয়নাথ বসল। আমার মুখোমুখি।

তার চেহারা দেখে আমি চমকে উঠলাম।

উশকোখুশকো চুল, কোটরগত চোখ, শীর্ণ চোয়াল! পরনের সার্ট আর ধুতিও কর্দমাক্ত।

‘একী জামাকাপড়ে কাদা লাগল কী করে?’

প্রিয়নাথ কিছুক্ষণ উদাস দৃষ্টিতে আমার দিকে দেখল, তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, ‘অনেকটা জলা ভেঙে আসতে হয়েছে তাই।’

‘জলা? জলায় কেন? এখানে জলা পেলি কোথায়?’

‘শহরের বাইরে গিয়েছিলাম। একটা কাজ ছিল।’

‘কাজ? পরীক্ষার সময়?’

‘হ্যাঁ ভাই, উপায় ছিল না, কিন্তু গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম।’

‘কী বিপদ?’

কিছুক্ষণ প্রিয়নাথ চুপ করে রইল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘তারক মাস্টারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।’

‘তারক মাস্টার! তারক মাস্টার কে?’

‘তারক মাস্টার আমাদের স্কুলে অঙ্ক করাতেন।’

‘এতে আর বিপদ কী?’

‘বিপদ মানে, তারক মাস্টার মারা গেছেন আজ পাঁচ বছর।’

‘সেকী!’

‘হ্যাঁ তাই। আমি নিজে তাঁর মৃতদেহ পুড়িয়ে এসেছি।’

‘ঠিক দেখেছিস তো?’

‘ঠিক দেখেছি। পাশাপাশি দুজনে মাইল দুয়েক একসঙ্গে হেঁটে এলাম, তারক মাস্টারই তো আমাকে জলার মধ্যে দিয়ে নিয়ে এলেন। বললেন, কম সময় লাগবে।’

‘কী কথা হল?’

‘অনেক এলোমেলো কথা। আমি জিজ্ঞাসা করে ফেললাম এক সময়ে, ”স্যার আপনি তো মারা গেছেন। লোচনপুরের শ্মশানে—”

আমাকে কথা শেষ করতে না-দিয়ে তারক মাস্টার বীভৎসভাবে হেসে উঠলেন।

বললেন, ”আমি বেঁচে আছি তোকে কে বললে?”

তারপর তারক মাস্টার হারিয়ে গেলেন।’

‘হারিয়ে গেলেন?’

‘হ্যাঁ ভাই। কথা বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। অনেক ডাকলাম কোনো উত্তর নেই। তারপর আমি স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেনের ঘণ্টা পড়তে দেরি হল। বেঞ্চের উপর বসলাম।। হঠাৎ কাঁধে একটা স্পর্শ। ফিরে দেখি সুবীর। মনে আছে, আমাদের সঙ্গে আই এ পড়ত।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু সুবীর তো—’

বাধা দিয়ে প্রিয়নাথ বলল, ‘জানি সে টাইফয়েডে মারা গিয়েছিল।’

‘আমরা কলেজে শোক সভা করেছিলাম। সে এসে হাজির। মনে আছে, কলেজে সে বেশিরভাগ দিনই ক্রিম রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে আসত। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সুবীর আমাকে একটু ঠেলে বেঞ্চে বসল। পাশে।

তারপর বলল, ”কিরে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছিলি কেন? এখানে তোর কীসের কাজ?”

বললাম, ”আমার একটা জমির ব্যাপারে এসেছিলাম, কিন্তু তুই এখানে?”

সুবীর হাসল, ”আমার কথা ছেড়ে দে। কাজ নেই, কর্ম নেই, ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

যেখানে সুনিশ্চিত জানি লোকটা বেঁচে নেই। কলেজ পত্রিকায় তার সম্বন্ধে আমি লিখেওছি, সে রক্তমাংসের শরীরে একেবারে পাশে বসে। গায়ে গা লাগিয়ে। তার সঙ্গে কী কথা বলব!

ইচ্ছা করেই বললাম। সুবীর কী উত্তর দেয় জানবার জন্য।

”আর কলেজ যাস না কেন?”

মাথা নেড়ে বলল, ”উপায় নেই ভাই। বদ্ধঘরে আমার দম আটকে আসে। আমি একটু খোলামেলার পক্ষপাতী। তা ছাড়া কলেজে পড়ে কী হয় বল? রক্ত জল করে খেটে খুটে গ্রাজুয়েট না হয় হলাম তারপর? সেই তো দরখাস্ত হাতে নিয়ে দরজায় দরজায় মাথা ঠোকা। ভগবান জানেন ক-টা জুতো ছিঁড়লে তবে চাকরির সুরাহা হবে। আদৌ হবে কি না কে জানে!”

আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম সে মরার পরেও এভাবে দেখা দিল কী করে, ঠিক তখনই সুবীর উঠে দাঁড়াল।

বলল, ”তুই বস, আমি একটু ঘুরে আসি। এখনও ট্রেন আসার ঘণ্টা খানেক দেরি।”

সুবীর উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষে। দেখলাম, নেমে রেললাইনের পাশ দিয়ে ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের দিকে চলে গেল। আর তাকে দেখা গেল না।

বসে বসে সমস্ত ব্যাপারটা ভাবতে লাগলাম।

মনে হল, সবই আমার মনের কল্পনা। অবচেতন মনে হয়তো সুবীরের কথা চিন্তা করছিলাম। আমার কল্পনাই রূপ ধরে এসেছিল।

তারক মাস্টারের ব্যাপারটাও তাই।

গাঁয়ের পথ দিয়ে একলা হাঁটতে হাঁটতে স্বাভাবিকভাবেই তারক মাস্টারের কথা মনে এসেছিল। যখন এখানকার স্কুলে পড়তাম, তখন ঠিক এভাবে তারক মাস্টারের পাশাপাশি অনেক দিন গল্প করতে করতে হেঁটেছি।

সবকিছু মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম।

উঠে টিকিটঘরের কাছে গেলাম ঘর বন্ধ। ট্রেন আসবার আধ ঘণ্টা আগে খুলবে।

ভাবলাম, কাছের চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে আসি।

রীতিমতো তেষ্টা পেয়েছে।

অভ্যাসমতো দোকানে ঢোকবার আগে পকেটে হাত দিলাম।

সর্বনাশ পকেট খালি! অথচ আমার বেশ মনে আছে, বাড়ি থেকে বের হবার সময় মানিব্যাগ পকেটে নিয়েছিলাম।

নিশ্চয় রাস্তায় কোথায় পড়ে গেছে। সম্ভবত জলা পার হবার সময়। অবশ্য ব্যাগে বেশি টাকা ছিল না। বেশি টাকা পাবোই বা কোথায়? বোধ হয় টাকা পাঁচেক আর কিছু খুচরো ছিল।

চা না হয় না খেলাম, কিন্তু ট্রেনের টিকিট কিনব কী করে?

বিনা টিকিটে উঠলে চেকার যদি ধরে তাহলে জরিমানাও দিতে পারব না। সোজা হাজতে টেনে নিয়ে যাবে।

এখন উপায়!

এই নির্বান্ধব জায়গায় এমন কেউ নেই যে আমাকে পয়সা নিয়ে সাহায্য করবে? এখানে পড়ে থাকতেও পারব না।

চিন্তিত হয়ে পায়চারি আরম্ভ করলাম।

কিছু সময় কাটল। সিগন্যালের পাখা নীচু হল।

ট্রেনের অস্পষ্ট কাঠামো দেখা গেল।

এক জায়গায় দাঁড়ালাম।

সগর্জনে ট্রেন এসে থামল।

দারুণ ভিড়। পাদানিতে পর্যন্ত লোক ঝুলছে। ওদিকে কোথায় বুঝি মেলা চলছে। সেই মেলা ফেরত ভিড়।

ভাবলাম, ভালোই হল কোনোরকমে ঠেলাঠেলি করে যদি ট্রেনের মধ্যে একটু জায়গা করে নিতে পারি তাহলে টিকিট কাটতে হবে না।

এমন ভিড় ঠেলে চেকার আসবে এমন সম্ভাবনা কম।

গায়ের জোরে ঠেলেঠুলে উঠলাম। কিছু লোক গালাগাল দিল, কিছু লোক ঠেলে নামিয়ে দেবার চেষ্টাও করল। পারল না।

এককোণে গিয়ে দাঁড়ালাম।

একেই বলে অদৃষ্ট!

বোধ হয় গোটা দুয়েক স্টেশন পার হয়েছি, এমন সময়ে কাঁধে চাপ।

”টিকিটটা দেখাবেন।”

আড়চোখে দেখলাম, কালো কোট, সাদা প্যান্ট। হাতে টিকিট পাঞ্চ করার মেশিন।

”দেখি টিকিট।”

করিতকর্ম লোক। ভিড় ঠেলে ঠিক এসে দাঁড়িয়েছে।

আর দাঁড়িয়েছে একেবারে মোক্ষম জায়গায়।

নিরুপায়। ফিরতেই হল।

একনজর আমাকে দেখেই চেকার বলল, ”আরে কে দুলু না?”

দুলু আমার ডাক নাম, কিন্তু চেকার ও নাম জানল কী করে?

”কি রে, চিনতে পারছিস না?”

চেকার মাথা থেকে টুপিটা খুলে ফেলতেই চিনতে পারলাম।

মেসোমশাই। হরিপ্রসন্নবাবু। রেলে চাকরি করতেন জানতাম, কিন্তু ঠিক কী চাকরি জানা ছিল না।

বললাম, ”মেসোমশাই!”

প্রণাম করার চেষ্টা করেও পারলাম না। ভিড়ের জন্য সম্ভব হল না।

মেসো হাত তুলে বললেন, ”থাক, থাক। এদিকে কোথায় এসেছিলি?”

কোথায় এসেছিলাম বললাম।

সঙ্গে সঙ্গে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলাম। যাক, টিকিটের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মেসো যখন রয়েছেন, তখন হাওড়া পর্যন্ত নির্ঝঞ্ঝাট যাওয়া যাবে।

কথাটার পাশাপাশি আর একটা কথা মনে পড়ে গেল।

হরিপ্রসন্নবাবুর তো এভাবে থাকবার কথা নয়। বছর চারেক আগে মামার বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছিল। খবর এসেছিল, এই মেসো কলেরায় মারা গেছেন। গোরখপুর না কোথায় কাজ করতেন। শ্রাদ্ধের কার্ডও দেখেছিলাম। মামা কাজের দিন গিয়েছিলেন।

হরিপ্রসন্নবাবু লোকটি অমায়িক। যখনই মামার বাড়ি আসতেন আমাদের নিয়ে হইহই করতেন। জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, গঙ্গার ওপর নৌকায় বেড়ানো।

মামা বলতেন, ”ওঁর আর কী! প্রচুর কাঁচা পয়সা রোজগার। খরচ করতে পারে।”

কাঁচা পয়সা বলতে কী বোঝায় তখন জানতাম না।

কিন্তু এই কামরা ভরতি লোকের মধ্যে কী করে আমি জিজ্ঞাসা করি, মেসোমশাই, আপনি তো মারা গেছেন! আপনি আবার রেলের ধড়াচুড়ো করে টিকিট চেক করছেন কী করে?

চুপ করে বসে রইলাম।

বসে বসে বরাতের কথা ভাবলাম।

আজ সারাটা দিন একজনের পর একজন কেবল মৃত লোকদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ব্যাপারটা কী?

নিজেকে সজোরে চিমটি কাটলাম। না, বেশ লাগছে।

তাহলে তো জেগেই রয়েছি। স্বপ্নের ঘোর নয়।

অথচ চোখের সামনে মেসোমশাই দাঁড়িয়ে। এক মুখ হাসি। গোঁফের ঝোড়া। মসৃণ টাক।

”তারপর কী করছিস এখন?”

বললাম, ”সামনে বি. এ. পরীক্ষা।”

”পরীক্ষা কি আর দিতে পারবি?”

”কেন?”

”কলকাতায় গোলমাল তো লেগেই আছে। প্রত্যেক বছর পরীক্ষার সময় ঝঞ্ঝাট।”

কী বলব, চুপ করে রইলাম।

আমি একবার ওদিকটা দেখে আসি।

চেকার মেসোমশাই ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ভাগ্য ভালো। হাওড়া পর্যন্ত কিছু হল না। আর কোনো চেকার উঠল না ট্রেনে। ভিড়ের সঙ্গে গেটও পার হয়ে এলাম।’

এবার কিন্তু আমি প্রিয়নাথকে সন্দেহ করতে শুরু করেছি। যে সব কথা বলছে, সে কথা সুস্থ মস্তিষ্কের কথা নয়। বেশি পড়ে পড়ে ছেলেটার মাথা খারাপ হল নাকি!

আমি কিছু বলাবার আগেই প্রিয়নাথ উঠে দাঁড়াল।

‘চলি রে, একটা কাজ মনে পড়ে গেল। আবার দেখা হবে।’

দ্রুত পদক্ষেপে প্রিয়নাথ পার্কের বাইরে চলে গেল।

একটু পরে আমিও উঠে দাঁড়ালাম।

এতক্ষণ বোধ হয় লাইন ঠিক হয়ে গেছে। পাখা আলো চালু হয়েছে। গিয়ে পড়াশুনো আরম্ভ করতে হবে।

চলতে চলতেই ভাবলাম, একবার প্রিয়নাথের খোঁজ নেওয়া দরকার।

প্রিয়নাথের মামার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। আর দূরে হলেও, বন্ধুর খবর নেওয়া খুবই দরকার। যেভাবে সে অবোলতাবোল কথা বলে গেল, তাতে রীতিমতো সন্দেহ হয়। নিশ্চয় মাথায় একটু গোলমাল হয়েছে।

প্রিয়নাথের বাড়ির দিকে পা চালালাম। সামনে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বেশ কিছু লোকের ভিড়।

একজনকে জিজ্ঞাসা করতে বলল, ‘বডি আনা হয়েছে।’

‘বডি? কার বডি?’

ভিড়ের পাশ কাটিয়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। উঠানেই শোয়ানো রয়েছে। গলা পর্যন্ত চাদর ঢাকা। মুখ খোলা, সারা মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন।

পাশে মাথায় হাতে দিয়ে মামা বসে। একটু দূরে মামী আর বাড়ির অন্য মেয়েরা। চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।

সব ব্যাপারটা বুঝতে আমার বেশ সময় নিল।

আস্তে মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছিল?’

‘বাস চাপা। আজ সকালে।’

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করে মামাকে বলব, যে প্রিয়নাথ খাটিয়ায় চিরদিনের জন্য ঘুমাচ্ছে, সে একটু আগে পার্কে বসে আমার সঙ্গে গল্প করে এসেছে। মরা মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার গল্প।

তবু মামাকে একবার বললাম।

‘আপনি কি প্রিয়কে লোচনপুরে পাঠিয়েছিলেন?’

মামা অবাক।

‘লোচনপুর? না, লোচনপুরের সঙ্গে তো আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে পাঠাতে যাব কেন?’

আর কিছু বললাম না। আর যা বলার তা কেউ বিশ্বাস করত না। বরং আমাকেই পাগল ঠাওরাত।

আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারলাম না। পরলোক থেকে আত্মারা কি প্রিয়নাথকে এগিয়ে এসে নিয়ে যেতে এসেছিল?

তাই-বা কী করে হয়!

প্রিয়নাথ যখন এসব কাহিনি আমার কাছে বলছিল, তার আগেই তো সে এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অন্য লোকে চলে গেছে।

যাই হোক, এখন আমার কর্তব্য প্রিয়নাথের শবানুগমন করা।

বাড়িতে বলে আসা প্রয়োজন।

বেরিয়ে রাস্তার কাছে এসেই থেমে গেলাম। ভিড় আর নেই। সবাই সরে গেছে।

টোকলের কাছে প্রিয়নাথ দাঁড়িয়েছিল। আমাকে দেখে হেসে বলল, ‘দেখলি তো কাণ্ডটা। এরা প্রমাণ করে ছাড়বে আমি বাস চাপা পড়ে মরেছি। অথচ তুই দেখ, জলজ্যান্ত বেঁচে। একটা আঁচড়ও আমার গায়ে লাগেনি।’

আমার সারা শরীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমিও তো মৃত লোকের মুখোমুখি হয়েছি। আমার অদৃষ্টে কী আছে কে জানে!

লক্ষ করিনি মাল বোঝাই লরিটা ততক্ষণে খুব কাছে এসে পড়েছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments