Friday, April 26, 2024
Homeরম্য গল্পমূকং করোতি বাচালং - শিবরাম চক্রবর্তী

মূকং করোতি বাচালং – শিবরাম চক্রবর্তী

স্বামীসুখ - শিবরাম চক্রবর্তী

খাবারের টেবিলই হচ্ছে আমার পাকিস্থান। পাকঘর থেকে বেরিয়ে পাকাশয়ে পৌঁছে পাকাপাকি স্থান লাভ করার মাঝখানে যেখানে ওরা আশ্রয় নেয়, তারই নাম টেবিল। খাবার টেবিল, নিজে খাদ্য নয়, কিন্তু চরাচরের যাবতীয় খাদ্যাখাদ্যের বাহন।

কেউ খাবার টেবিলে আমন্ত্রণ জানালে আমার ভারি আনন্দ হয়। পাকিস্থানলাভে রাজাগোপালাচারীর মতো আনন্দ। সেখানে আমি কোনো কাঁচা কাজ করি না—কাঁচিস্থানের কোনো কাজ সেখানে নয়। কারও পকেটের দিকে না দেখে, সুদ্ধ নিজের পেটের দিকে নজর রাখি। নিজেকে রাজা বলে মনে হয়, গোপালের মতো চেটেপুটে খাই, শেষ আচারটুকু পর্যন্ত সাবাড় করি। কেবল ওই টেবিলকে—ওই পাকিস্থান ছাড়া আর কারুকে ছাড়ি না। পারলে পরে কাঁটা-চামচ পর্যন্ত পকেটে পুরে আনি।

কিন্তু নেমন্তন্ন রক্ষা করতে অনুকূলের টেবিলে এসে আমি যেন অকূলে পড়লাম। সামনে এক শুকনো কাঠের টেবিল ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। টেবিলটা কাষ্ঠহাসি হাসতে লাগল। মনে হল কাঁচা কাজ করেছি।

বাধ্য হয়ে আমাকে বিবৃতি দিতে হল।

সব শুনে অনুকূল বললে, ‘তাই নাকি? তোমাকে নেমন্তন্ন করেছিলুম বুঝি? একদম মনে নেই তো! কিন্তু তাইতো, না করলে তুমিই-বা কেন আসবে! এমনি তো তোমরা আস না!…কিন্তু করলুম কখন! কোন অসতর্ক দুর্বল মুহূর্তে করে বসেছি কে জানে! কিচ্ছু মনে পড়ছে না।…’

‘তবে কি এসে আমায় ফিরে যেতে বল?’ আমার কন্ঠস্বর খুব করুণ শোনায়।

শোনাবার কথাই। অনুকূলকে স্রেফ আমার আনুকূল্য দেখানোর জন্যই এর আগে কয়েকটা (অপেক্ষাকৃত ছোটোখাটো) টেবিল হাতছাড়া করে এসেছিলাম।

‘না না, ফিরবে কেন! বন্ধু মানুষ ফিরে যাবে, তাও কি হয়? বন্ধুরা খেয়েদেয়ে গিয়েই কত নিন্দে করে, তুমি না খেয়ে গেলে কি আর রক্ষে রাখবে?’

সেও একটা কথা বটে। ভেবে দেখবার কথাই বই কী! আমিও ভেবে দেখি—বন্ধুনীতির দিক দিয়ে উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি সমস্যাটা। বন্ধুর জটিলতা বলেই মনে হয়!

‘কুছ পরোয়া নেই!’ অনুকূল লাফিয়ে উঠল। লাফিয়ে উঠে গেল। চক্ষের পলকে, কোত্থেকে কে জানে, রকমারি ঢঙের গেলাস আর বোতল এনে টেবিলের ওপর জড়ো করল।

‘কুছ পরোয়া নেই, জলপথেই তোমার সৎকার করা যাবে। কিচ্ছু মন্দ হবে না। একটু জলযোগ না করিয়ে অতিথিকে ছেড়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। এসো ভাই, কিছু মনে কোরো না, পথে এসো, জলপথে চলে এসো।

অনুকূলের আবাহন অমায়িক এবং মায়াহীন। আবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হল সমস্তটা। রংবেরঙের বোতলে, কেবল তাড়ি আর ভডকা বাদে, শ্যাম্পেন, শেরি, হুইস্কি, ব্রান্ডি, জিন সব আমার নজরে পড়ল। এমনকী, একটাকে আমার নামের অর্ধচন্দ্র ধারণ করতেও আড়চোখে দেখলাম। RUM—রাম!

অনুকূল গেলাসে গেলাসে ঢালতে থাকে। আমি অসহায় নেত্রে তাকিয়ে থাকি। বন্ধু না হয়ে শত্রুই হলাম নাহয়, কিন্তু অতিথি তো! তাকে ডেকে এনে এভাবে জলাঞ্জলি দেওয়া অনুকূলের অভিধানে সৎকার করা হতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে বেশি অসৎকার কী আছে আমি জানি না। কে নাকি কোথায় খাদ্যের বদলে লোষ্ট্রলাভ করেছিল, কোন ধনঞ্জয়কে কবে গুড়ের বিকল্পে লগুড় পেতে হয়েছিল, এই দৃষ্টান্তে সেইসব উদাহরণ আমার মনে উজ্জ্বল হতে থাকে।

‘জলপথে আসব কী—’ আমি সকাতরে বলে উঠি—‘আমি যে ভাই সাঁতার জানিনে।’ না বলে পারিনে শেষপর্যন্ত।

‘নাই-বা জানলে! অল্প একটু জলে নামতে দোষ কী? হাত-পা ছুড়তে পারবে তো, তাহলেই হবে!’ অনুকূল আমাকে আশ্বাস দেয়—‘আমি সাঁতার কাটব, তুমি দেখো। দেখবে কেমন কাটি।’

‘এই বেবাক বোতল আমি একাই ফাঁক করব।’ একটু থেমে ও আবার আমাকে অবাক করে।

অনুকূল কিন্তু চিরদিন এমন জলপথে ছিল না, যতদূর আমরা জানি। কখনো-সখনো এক-আধটু হয়তো থাকলেও, স্থলপথের নেশাই জোর ছিল ওর। হিল্লি-দিল্লি-বোম্বাইয়ের কোথায়-না ও ভ্রমণ করেছে! এমনকী, বোম্বাই পেরিয়েও ওর বাই গেছল—আফ্রিকার কাফ্রি-মুল্লুকে পা দিতেও দ্বিধা করেনি, এরকমও শোনা যায়। বাঙালির মধ্যে ভ্রাম্যমাণ খুব বেশি নেই, ভ্রমণকে ভ্রমের নামান্তর জ্ঞান করার লোকই বেশি, তার মধ্যে অনুকূল একটা বিরাট ব্যতিক্রম বলতে হবে।

অনুকূল একে একে দু-গ্লাস উড়াল। পাছে ও জলপথে আরও বেশিদূর গড়ায় এবং নিজের তোড়ে চাইকি আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সেই ভয়ে ওকে স্থলপথে টানবার চেষ্টা করলাম। বললাম—‘তোমার শেষের ভ্রমণকাহিনিটা বলো দেখি, শোনা যাক।’

‘ভ্রমণ আর আমি করি না। করবও না। ভ্রমণকাহিনি নয়, সেসব আমার মতিভ্রমের কাহিনি—সেশুনে কী করবে!’ এই বলে অনুকূল আরেকটা বোতলের উপকূলে পৌঁছোবার চেষ্টা করে।

‘সেই যে সেবার কোথায়, ভামো না মিচিনা কোত্থেকে বেড়িয়ে এলে হে—?’

বলতে বলতে বোতলটাকে ওর হাতের আওতা থেকে সরিয়ে নিই।

‘তুমি তো সেই এক চুমুক খেয়েই বসে আছ। আর বুঝি উৎসাহ পাচ্ছ না? বেশ, তুমি না খাও, আমিই খাই।’ এই বলে আমার সামনের টইটম্বুর গেলাসটাকে ও টেনে নিল। ‘হ্যাঁ, অমৃতে আমার অরুচি নেই। সব্বাই জানে।’

এতক্ষণে বলতে কী আমি একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম—‘এবার তোমার ভামোর গল্প বলো, শুনি।’

‘এই আমার একমাত্র ওষুধ। এই ওষুধ খেয়েই ভুলে থাকি ভাই, যতটা পারি এবং যতক্ষণ পারি! উঃ, কী কুক্ষণেই না মিচিনার সর্বনেশে কাচিনটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল—সেই বুড়ো ডানটার সঙ্গে। ব্যাটা আশি বছর আগে মারা গেছে, কিন্তু আমার সর্বনাশ করে যেতে কসুর করেনি।’

‘আশি বছর আগে, না আশি বছর বয়সে—কখন মারা গেছে বললে?’ আমার কেমন খটকা লাগে।

‘কত বছর বয়সে মরেছিল, আশি কি আটশো, জানিনে। তবে মরেছে আশি বছর আগে, এটা আমি ভালোরকম জানি। আর মরেনি কেবল, সেইসঙ্গে হতভাগা আমাকেও মেরে গেছে।

‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব?’ আমার প্রত্যয় হয় না।

‘কী করে সম্ভব হল, আগাগোড়া সব কথা শুনলেই তুমি বুঝবে। বুড়ো ডানটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করাই আমার ভুল হয়েছিল। ওর মরবার আগে পর্যন্ত, আশি বছর আগেকার কথা, মিচিনার সবাইকে ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খেয়েছে। আমি সব জেনে-শুনে নিজের পায়ে কুড়ুল মারলাম। নিজের হাতে খাল কেটে কুমির ডেকে আনলাম নিজের ঘরে।’ এই বলে অনুকূল চুপ করে গেল।

‘বেশ, তোমার আশি বছর আগের কথাই বলো, তাই শুনব।’ আমি উসকে দিলাম ওকে।

‘আমার বছর পাঁচেক পূর্বের কথা (অনুকূল শুরু করে)। সে-বার যখন মণিপুর হয়ে কোহিমা-ইম্ফলের পার্বত্য পথে উত্তর-ব্রহ্ম ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম—তখনকার কান্ড। ঘুরতে ঘুরতে কাচিনদের দেশ মিচিনায় গিয়ে পড়লাম। মিচিনার এক গ্রামে এই বুড়ো ডানটার সঙ্গে আমার দেখা হল। আগে থেকেই অনেকের মুখে ওর পরিচয় পেয়েছিলাম। ওর গুণের কাহিনি কত জনের কাছেই-না শুনেছি। কিন্তু তাহলেও বলব, বুড়ো ডানটার কোনোই দোষ ছিল না, আমিই কৌতূহলের বশে গায়ে পড়ে ওকে দেখতে গেছলাম—ওর গাঁয়ে।

অবশ্যি এই ডানটা তখন জ্যান্ত ছিল না। আশি বছর আগেই সেঅক্কা পেয়েছিল। কিন্তু তবুও, তখন পর্যন্তও সেসশরীরে ছিল একথা বলা যায়। নিজের স্থূল শরীরে বিরাজ করছিল, ঠিক একথা বলা না গেলেও একেবারে যে সূক্ষ্ম শরীর তাও নয়। প্রায় দুয়ের মাঝামাঝি।

ডাইনি কাকে বলে জান তো? কয়েক শতাব্দী আগে ধরে-বেঁধে যাদের পুড়িয়ে মারা হত, এটা ছিল তাদের এক পুং-সংস্করণ। তবে একে পোড়ানো বেশ একটু শক্তই ছিল। উলটে এ-ই মিচিনার সবাইকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারত।

জীবদ্দশায় এর কাজ ছিল, ডাইনিদের মতোই, শুধু তুকতাক করা। কারও জরু কি গোরু কি কুঁড়েঘরের ওপরে তুক করে দিত, সেভয়ে আর সেসব জিনিস স্পর্শ করতে সাহস পেত না এবং আশেপাশের অন্য কেউই তাদের প্রতি ফিরে তাকাত না। এমনকী, পরদ্রব্য কি পরস্ত্রী হলেও, নিতান্তই তাদের লোষ্ট্রবৎ জ্ঞান করত। ফলে হল কী, এই করে করে লোকটা অগাধ বউ, গোরু আর কুঁড়ে-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে পড়ল। সে-অঞ্চলে তুল্য বিত্তশালী আর কেউই রইল না।

কিন্তু বড়োলোক হওয়ার কী ঝামেলা, নিশ্চয় তুমি বোঝ। তুমি বড়োলোক নও, কাজেই হাড়ে হাড়ে না বুঝলেও, তোমার কল্পনাশক্তি দ্বারা আন্দাজ করে নিতে পারবে। যে ব্যবসায় বড়োলোক বানায়, স্বভাবতই সে-পথে লোকের বড়ো ভিড়। অচিরেই এই ডাইনের লাইনেও রেষারেষি দেখা দিল। এই বুড়ো ডানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দিল এক নয়া ডান।

এই ছোকরা ডানের কেবল মন্ত্রতন্ত্রেই নয়, গায়েও জোর ছিল বেশ এবং এর হাতেই বুড়োটার কপাল পুড়ল। কেবল কপালই নয়, কপাল থেকে শুরু করে আগাপাশতলার কিছুই পুড়তে বাকি থাকল না।

তুষানলে দগ্ধ হওয়া কাকে বলে জান কি? কখনো দগ্ধ হওনি, কী করে জানবে! এই কলকাতায় বাস করে কদাচ তোমার সেসৌভাগ্য হবে কি না সন্দেহ, কিন্তু মিচিনার সেই বুড়ো ডানটির হয়েছিল। তোমাদের কোনো অতি আধুনিক কবি কোনো বয়োবৃদ্ধ কবিকে একদা যেমন সমালোচনার আগুনে দগ্ধে ছিলেন, এই নব্য ডানটিও তেমনি সেই প্রবীণ সম-ধর্মাকে বেশ করে ঝলসে নিল। শিককাবাব হয়ে তার চেহারার কেমন খোলতাই হয়েছিল আমি দেখিনি, বাবুর্চিটিরও দেখা পাইনি, এইসব অগ্নিকান্ডের প্রায় আশি বছর পরে অকুস্থলে আমি উপস্থিত হয়েছিলাম।

আমি সেই বুড়ো ডানের মুন্ডুটা কেবল দেখেছিলাম। আম শুকিয়ে যেমন আমসি হয়, তেমনি কোনো অলৌকিক কায়দায় সেটাকে খর্ব করে ফেলা হয়েছিল। দুই নম্বর ডান এক নম্বরের মাথাটাকে দেহ থেকে ছাড়িয়ে, শুকিয়ে সংক্ষিপ্ত করে কদবেলের আকারে নিজের ঘরের তাকের ওপর সাজিয়ে রেখেছিল।

আমি যখন মিচিনায় গেলাম, তখন তিন নম্বর ডানের রাজত্ব। এই তিন নম্বর ছিল দু-নম্বরের শিষ্য—তবে গুরুমারা শিষ্য নয়। আমার কাছে তোমাদের আধুনিক কবিতার একখানা সংগ্রহ ছিল, তার থেকে কয়েকটা পদ্য তাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। সেবললে, এই মন্ত্রগুলো আরও জবর। নিজের হরফে ছড়াগুলো সেটুকে নিল এবং তার বিনিময়ে সেই এক নম্বরের মাথাটাকে আমাকে উপহার দিল। পেপার-ওয়েট করার মতলবে সেই মুখসর্বস্ব সওগাত আমি সঙ্গে নিয়ে এলাম।’

এত বলে অনুকূল চুপ করল। গলা ভিজিয়ে নেবার জন্যেই, বলা বাহুল্য!

‘তোমার গল্পের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর জায়গায় আসবার আগে আমায় জানিয়ো। আমি তৈরি হব।’ আমি বললাম।—‘আমার হার্ট খুব দুর্বল কিনা!’

‘নিয়ে তো এলাম। মুখপাত্রটিকে আমার টেবিলেও স্থান দিলাম। এখন মিচিনায় একটা কিংবদন্তি ছিল, একদিন না একদিন ওই বুড়ো ডানের শুকনো মুখে বোল ফুটবে। আবার সেকথা বলে উঠবে—যদি কেউ তার মনের মতো কথাটি কইতে পারে, তাহলে সেতার কাছ থেকে মুখের মতো জবাব নিশ্চয় পাবে। আবার তাকে বাক্যবাগীশ করে তুলতে হলে কেবল জুতসই কথা বলে একবার তাকে উসকে দেওয়ার দরকার।

বলা বাহুল্য, সেদিক দিয়ে মিচিনার কেউ চেষ্টা করতে কোনো কসুর করেনি—কিন্তু তিন পুরুষ ধরে এত চেষ্টা করেও একটা কথা বার করতে পারেনি তার থেকে! আমিও আবার আমার টেবিলে সামনে রেখে কত সাধ্যসাধনাই-না করলাম—কিন্তু আধখানা অস্ফুট বাণীও কোনোদিন শোনা গেল না।’

‘তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলে যে—?’ বাধা দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করতে যাই।

‘কলকাতার এই সভ্যতার অন্ধকূপে বাস করে পৃথিবীর কতটুকু তোমরা জান? যদি আমার মতো দিগবিদিকে ঘুরে ঘুরে তোমাদের দিব্যদৃষ্টি খুলত তাহলে জানতে যে, পৃথিবীতে অবিশ্বাস করবার মতো কিছু নেই। সব কিছুই এখানে সম্ভব।’

‘তা বটে।’ আমি বলি।

‘হ্যাঁ—কী বলছিলাম? কতরকমই-না চেষ্টা করা হল, কিন্তু কিছুতেই তার মুখ খোলানো গেল না। বলতে কী, আমি বেশ হতাশ হয়ে গেলাম। আমার আশা ছিল, ওর মুখ থেকে ঘোড়দৌড়ের, শেয়ার মার্কেটের খবরটবর আদায় করতে পারব। কিন্তু না, সেএকেবারে, যাকে বলে, স্পিকটি নট।’

‘বোধ হয়,’ আমি ব্যঙ্গের সুরে বাতলাই—‘বিশুদ্ধ কাচিন ভাষায় বলা হয়নি বলে সেহয়তো গোসা করে থাকবে, তাই তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়নি। মিচিনার লোকের মতো কথা পেড়ে কখনো দেখেছিলে কি?’

‘সেকথা বলতে হয় না। ওর সঙ্গে আলাপ জমাবার অভিপ্রায়ে মিচিনার কথ্য এবং অকথ্য দু-রকমের ভাষাই আমি আয়ত্ত করে এসেছিলাম—কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। অবশ্যি ভেবে দেখলে ভাষার ইতরবিশেষে এক্ষেত্রে কিছু যায়-আসে না। ডানটা মারা যাবার পরে পৃথিবীর কোনো ভাষাই এখন তার অজানা নয়। সবার কথা, সব কথাই তার বোধগম্য। তবু, কোনো বিশেষ ভাষার প্রতি তার আসক্তি থাকা কিছু বিচিত্র নয়। এই কারণে কোনো ভাষাই আমি বাদ দিইনি, বাংলা, অসমিয়া, উড়িয়া, উর্দু, হিন্দি সব ক-টাকেই কাজে লাগিয়েছিলাম। এমনকী, সংস্কৃত করে সুর করে ‘বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদি—হরতি দর তিমিরমতি ঘোরম’ বলতেও বাকি রাখিনি—কিন্তু এত করেও কোনো সুরাহা হল না। সেযেমন বোবা তেমনি বোবাই মেরে রইল।

আমি হাল ছাড়বার পর আমার বউ তখন লাগল। মেয়েরা কথায় ওস্তাদ কে না-জানে—কিন্তু তার ওস্তাদিও ব্যর্থ হল শেষে। ‘এখন ক-টা বেজেছে?’ ‘চিত্রায় আজ কী বই?’ ‘ভালো ডিজাইনের শাড়ি কোথায় পাব?’ ‘কোন দোকানের গয়না সবচেয়ে চমৎকার?’ ইত্যাদি থেকে শুরু করে ওর চেহারা আর স্বভাব-চরিত্রের ওপর খোঁটা দিয়ে কথা বলতেও সেকুন্ঠা করেনি—কিন্তু সে-মুখ তেমনি নির্বিকার। অবশেষে কথাটা চাউর হয়ে গিয়ে আমার পাড়াপড়শিরাও এসে বাক্যালাপের চেষ্টা করলেন। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, পরচর্চামূলক কোনো প্রশ্নই বাদ গেল না! কিন্তু বুড়োর কোনো হুঁ হাঁ নেই।

সবশেষে একজন মনস্তাত্ত্বিকও এসেছিলেন। ফ্রয়েডীয় মতে ডানটার মনোবিকলন করে মোক্ষম মোক্ষম কত রকমের প্রশ্নই-না তিনি ঝাড়লেন—এমন মোলায়েম সুরে এরূপ আদরকাড়া প্রশ্ন সব! যা কানের ভেতর দিয়ে একবার মরমে ঢুকলে, আকুল-ব্যাকুল করে মর্মভেদী প্রত্যুত্তর টেনে বার করে এনে তবে ছাড়ে—কিন্তু সেসব ব্রহ্মাস্ত্রও বিফল হল। তাকে কথা বলানো দূরে থাক, একটু হাসানো গেল না পর্যন্ত।’

‘খুবই দুঃখের বিষয়।’ আমি বললাম। ‘সেই মনোবিকলনকারী এখন কোথায়?’

‘রাঁচিতে বোধ হয়। শেষকালে আমরা হাল ছেড়ে দিলাম। ব্যাপারটা মিচিনা রসিকতা বলে মনে হতে লাগল। তারপরে আমাকে আরাকানে চলে যেতে হল—এই তো সেদিন—জাপানি আক্রমণের বছর খানেক আগের কথা। কিন্তু এবার পর্যটনে বেরিয়ে বেশিদিন বিদেশে থাকা গেল না। অকস্মাৎ চলে আসতে হল আমায়। আরাকানের এক অঞ্চলে এবার আমি মূল্যবান এক খনিজ সম্পদ আবিষ্কার করেছিলাম। তাই নিয়ে এখানকার দু-একজন মূলধনি বন্ধু পাকড়ে কোম্পানি ফেঁদে হঠাৎ বড়োলোক হবার মতলব আমার মাথায় খেলছিল।

যেদিন ফিরলাম সেইদিনই—সেই রাত্রেই আমার এক বন্ধুকে ফোন করলাম। একটু শুনেই সেএমন উত্তেজিত হল যে, তক্ষুনি এসে আমার সঙ্গে কথা কইতে চাইল। রাত তখন অনেক, কিন্তু সেপাকা ব্যাবসাদার লোক, তখন-তখনই পাকাপাকি করে ফেলতে চায়।

গোপন কথাবার্তা শলাপরামর্শের কোনো বাধা ছিল না। বউ কোনো সখীর বাড়ি নেমন্তন্ন রাখতে গেছল, চাকরবাকরদেরও ছুটি দিয়েছিলাম, সারা বাড়িতে আমি একলা। কোনো অসুবিধা ছিল না কোথাও।

মানুষ যা চায়, যা যা পেতে চায় জীবনে, তার সব—সমস্ত সাফল্য তখন আমার মুঠোয়। শরীর-মনকে চানকে নেবার জন্যে এক পাত্র ঢেলে পান করলাম। নিজেকে তৈরি করে নিলাম। এমন সময়ে ডানটার দিকে আমার নজর পড়ল। ওর কাছে এগিয়ে রহস্যচ্ছলেই আমি বললাম, ‘শোনো হাড়হাবাতে বুড়ো, কখনো যদি তোমার বোল ফোটে, আজ এখানে যা হবে তার একটি কথাও যেন কাউকে বোলো না। কক্ষনো না, বুঝেচ? আমার এক বিশেষ বন্ধু আজ রাত্রে আমার কাছে আসচেন।’

অনুকূল হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল, বহুক্ষণ তার আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

‘তারপর?’

‘বলব কী, অবাক কান্ড!’ বলল অনুকূল—‘সেই ডানটা হঠাৎ ফিক করে যেন হাসল—আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তারপর এক অনির্বচনীয় শুকনো আওয়াজ বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। তার মুখ খুলে গেল। আমি দিব্যি শুনলাম, সেবললে, ‘হে বঙ্গজ, তুমি কী বললে, আবার বলো।’

আমার অযত্নোচ্চারিত ওই কথার মধ্যে কি কোনো মন্ত্রশক্তি ছিল? প্রায় এক শতাব্দীর মূক কন্ঠ যে মুখর হয়ে উঠল ওই কথায়? আমি আবার বললাম—‘যদি কখনো ফের তুমি কথা বলো তাহলে আজ এখানে যা যা ঘটবে তার একটি কথাও যেন কাউকে নয়—কক্ষনো বলবে না। আমার একজন বিশেষ বন্ধু আজ রাত্রে আমার কাছে আসচেন।’

সেই ডানমুন্ড হাসতে লাগল আবার।—‘কী আশ্চর্য! হে বাঙালি, তুমিও যে দেখচি ঠিক সেই কথাই বলচ! এই কথাগুলি এমনি রাত্রে তোমার বউও যে আমায় বলত, মাঝে মাঝে যখন তুমি এখানে থাকতে না—’

অনুকূল আর কিছু বলল না। ওর নাগালের বাইরে যে বোতলটাকে আমি সরিয়ে রেখেছিলাম তাকে হাত করার চেষ্টায় লাগল। আমি তাকে আর হাতড়াতে দিলাম না। নিজহাতে বড়ো বড়ো আরও দু-গেলাস ভরতি করে ওর হাতে তুলে দিলাম। এ ছাড়া ওর আর কোনো পরিত্রাণ আছে বলে আমার মনে হল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments