Sunday, May 5, 2024
Homeকিশোর গল্পমানাত - মাশুদুল হক

মানাত – মাশুদুল হক

আমার দাদুকে আমরা কোনো দিন কাঁদতে দেখিনি, শুধু এক দিন ছাড়া। হয়তো এ জন্যই যে বড় হয়ে কাঁদাটা ঠিক শোভন নয়, আর অত ছোট আমাদের সামনে তো নয়ই। কিন্তু তোমরা যদি কেউ আমার দাদুকে চিনতে তাহলে আমার কথা হেসেই উড়িয়ে দিতে, বলতে নিজের ছেলে মরে যাওয়ার পরও যাঁর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়ায়নি, তিনি আবার কিসে কাঁদবেন। কথাটা সত্যি, মায়ের কাছে শুনেছি, তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলেটি যেবার অসুখে মারা গেলেন, সেদিন তাঁর চোখে কেউ জল দেখেনি। মা বলেন, লোকটা দুঃখ পাননি সেটা তো হতে পারে না, তবে দশজনকে দেখিয়ে জল ফেলাটা তাঁর ধাতে নেই। তাহলে এমন কী ঘটল যে ছোট-বড় সবার সামনে সেই এক দিন দাদু অমন হড়বড়িয়ে কেঁদে গেলেন? সেদিন কেউ মারাও যায়নি, হারিয়েও যায়নি। সত্যি বলতে কি, কারণটা আমি ঠিক বুঝিইনি। আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে বলব সেটার পরিস্থিতি ছিল না তখন, দাদুর কান্না দেখে বাবা, বড় চাচা, ফুপু আর বাকি সবাই এমন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে তাঁদের দিকে তাকাতেও আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।

তাহলে ঘটনাটা বলি তোমাদের। সেবার শহরে কী এক ঝামেলা চলছিল, বাবা আমাকে, আমার ছোট্ট বোন নিমি আর মাকে দাদুর বাড়ি রেখে গেলেন। কয়েক দিন পর নিজেও এসে পড়লেন, শহরে নাকি ঝামেলা দিন দিন বাড়ছে। বড় চাচাও শহরে ছিলেন, তিনিও চলে এসেছিলেন। তাতে অবশ্য আমার খুব ভালো হলো, বড় চাচার মেয়ে তুশি আপা অনেক মজার মজার খেলা জানতেন। আমাকে আর নিমিকে তিনি সৈন্য বানিয়ে নিজে হতেন সেনাপতি, বাড়ির পেছনের জলপাই বাগানে ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের বিনাস করতে করতে আমাদের দিন কাটত, তারপর সন্ধ্যার দিকে যখন পাকা চালতার ঝাঁজাল গন্ধ আসত কুয়াশার সঙ্গে, তখন তুশি আপা গল্প করতেন, জলপাই বাগানের পরে যে রাজ্য, সেখান থেকে অমন গন্ধ আসছে; ওখানে থাকে এক দঙ্গল রাক্ষস-খোক্কস। আমাদের সেনাবাহিনী যখন আরও বড় হয়ে উঠবে, লোকসংখ্যায় আর গোলাবারুদে, তখন আমরা সেসব রাজ্যে অভিযানে যাব।রাতে যখন বড় করে চাঁদ উঠত, জোছনায় এমন জ্বলজ্বলে হয়ে উঠত চারপাশ যে মনে হতো আকাশ থেকে কেউ মস্ত পাউডারের কৌটা উল্টে দিয়েছে, সেই সাদা সাদা গুঁড়োতে মোড়ানো উঠোনে বসে বড় চাচা গল্প করতেন, কত রকমের গল্প যে ছিল তাঁর ঝুলিতে তা এই মারাত্মক গম্ভীর মানুষকে দেখে কখনোই বোঝার উপায় ছিল না।

আমাদের আরও এক আগ্রহ আর আনন্দের ব্যাপার ছিল, সেটা হলো দাদু সে সময় এক হাতি পালতেন। দেখো তো ওর কথা এখনো বলিনি। সেদিনের ঘটনায় এই হাতিরও কিছু অংশ ছিল। দাদু হাতির কাছে ঘেঁষতে মানা করতেন তিনি না থাকলে। কারণ দাদুই ওকে অনেক দিন ধরে পালছেন তো, আর আমরা তো নতুন, আমাদের চিনতে না পেরে যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসে, সেই চিন্তা ছিল তাঁর মনে। তুশি আপা অবশ্য বলতেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, হাতিরা নাকি দারুণ ভালো আর এই হাতিটার যেহেতু গজদন্ত নেই, তাই এটা মেয়ে হাতি। মেয়ে হাতির মনে খুব মায়া। পরে অবশ্য বাবার কাছে শুনেছি, এটা ছেলে হাতিই। কিন্তু গজ দাঁত গজায়নি, সব ছেলে হাতির সেটা গজায় এমন কোনো কথা নেই।

হাতিটার নাম ছিল মানাত। নামটা আমাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকত। দাদুকে একবার জিজ্ঞেস করায় দাদু বলেছিলেন, নামটা তাঁর দেওয়া না, তিনি যে লোকের কাছ থেকে কিনেছেন, তাঁর দেওয়া। আর এ নামে ও অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় নতুন নামকরণ করে সুবিধা হবে না।

দিন আমাদের ভালোই কাটছিল। মানে দাদুবাড়িতে থাকার অর্থ ছিল আমাদের অফুরন্ত ছুটি আর খেলা, গল্প শোনা, হোমওয়ার্ক নেই, স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই, সন্ধ্যার দিকে মা যদিও কিছু পড়তে বলেন, সেটাও বেশিক্ষণের জন্য না।

অবশ্য বড়দের ব্যাপারটা একই ছিল না, বাবা অফিস কামাই দিয়ে বসে থেকেও খুব সুখে ছিলেন বলে মনে হতো না। মা, বড় চাচা, চাচি সবাই মাঝেমধ্যেই গম্ভীর হয়ে নানা কথা বলতেন। রাত জেগে দাদুর জরদগব সাইজের রেডিওতে খবর শুনতেন সবাই। আমাদের অবশ্য বারণ ছিল, তাই ব্যাপারগুলো ঠাহর করতে পারতাম না। তুশি আপা অবশ্য বলতেন, শহরে একপাল খোক্কস এসেছে নিশ্চয়ই। বড়রা শহর থেকে পালিয়ে রেডিওতে তাই নজর রাখছে খোক্কসগুলো না এদিকটাতেও এসে পড়ে। বাবা-চাচাদের গায়ে জোর নেই বলে তাঁরা পালিয়ে এসেছেন, বাকি মানুষেরা নিশ্চয়ই খুব একটা ফাইট দিচ্ছেন, বলে তুশি আপা তলোয়ার চালানোর ভঙ্গি করেন আর আফসোস করেন বাহিনীটা আরেকটু বড় হলেই হতো, আমরাও ফাইট দিতে পারতাম। তবে আমাদের ছোট চাচা মনে হয় তাঁদের দলের। কারণ, তিনি এখনো দাদুবাড়ি আসেননি। আর বড়রা তাঁকে নিয়ে প্রায়ই নানা দুশ্চিন্তা করেন।

কিছুদিন পর এমন একটা ব্যাপার শুরু হলো, যেটার সঙ্গে আমরা কোনো দিন পরিচিত ছিলাম না। মা এক সকালে ফিসফিস করে বললেন, আজকে সকালে কোনো নাশতা নেই, এটা নিয়ে মন খারাপ করিস না বাবা! পাকা কুল আছে, এটা খেয়ে নে! ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতে লাগল, খোক্কসদের হামলার কারণেই হয়তো বা দাদুর ব্যবসাপাতি যা ছিল সবই নাকি বন্ধ হয়ে গেছে – কথাবার্তায় আমরা আন্দাজ করলাম, তারপর আবার বাড়িতে অনেক বাড়তি মানুষ। দাদুবাড়ির নানা জিনিসপত্রও কমতে লাগল, ভারী ভারী সব আসবাব প্রায়ই লোকেরা এসে নিয়ে যেত, দাদু শুকনো মুখে চেয়ে থাকতেন লোকেরা চলে যাওয়ার পর।

আমাদের ছোটরা এসবে খুব একটা বিচলিত ছিলাম না। কারণ, আমাদের যে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল তা না। তুশি আপা বলতেন, এটাকে বলে অভাব, অভাবে নাকি মানুষ মারাও যেতে পারে। কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হতো না, তুশি আপা অনেক কিছুই বাড়িয়ে বলেন। তবে একটা ব্যাপার আমার মনে হলো, অভাব থাকলে বড়রা ছোটদের ওপর খবরদারি কমিয়ে আনেন। কারণ, আমরা তখন আগের চেয়েও বেশি বাইরে থাকতে পারতাম, আশপাশের অনেক ছোট ছেলেপিলের সঙ্গে আমরা মিশতে শুরু করলাম, খেলতাম, এটা প্রথম দিকে খুব বারণ ছিল।

তারও বেশ কিছুদিন পর অভাবটা মনে হয় আমরাও বুঝতে শুরু করলাম। কারণ, যেসব দিন আটার রুটি হতো সেদিনগুলোতে কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করত, আর ভয় হতো এ দিনটা না আবার কত দিন পরে আসবে। অথচ সেগুলো একটা সময় আমি খেতেই পারতাম না। প্রতিদিন রাতের খাবারে সাদা ভাত আর সঙ্গে কীসব যেন খেতে বিস্বাদ লাগলেও আপত্তি করতাম না। কারণ, সেটা করলে বাকি সবার এমন মন খারাপ হতো যে কী বলব!

এবার আসি সেদিনের ঘটনায়। ঘটনার আগের দিন মানাত, মানে আমাদের হাতিটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দাদু অস্থির হয়ে পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে খুঁজলেন, বাবাও তাঁর সঙ্গে বের হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন। রাতের বেলা শুনলাম, দাদু ভীষণ খেপে হাতিটাকে গালাগালি করছেন – পাঁজি, বদমাশ কোথাকার, অভাব দেখে পালিয়েছে। নিমকহারাম কোথাকার, তোকে তো কোনো দিন কষ্টে রাখিনি, এক দিনও না খাইয়ে রাখিনি।

নিঝুম রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাদুর আহাজারি শুনে কেন যেন খুব ভয় হচ্ছিল। বড় চাচা বলেছিলেন, মানুষের দুঃসময় বুঝতে পারলে পোষা পশুপাখি আগেভাগে পালিয়ে যায়। আমাদের সামনে কি তাহলে আরও খারাপ সময় আসছে?

বাবা বললেন, হাতিটাকে বিক্রি করে দেওয়া উচিত ছিল, তাহলে বরং কিছুটা উপকার হতো।

  • মনে হয় কেনার লোক বসে আছে তোমার জন্য? মা বাবার কথা শুনে ফোঁস করে বললেন।
  • তা ঠিক, এই যুদ্ধের বাজারে কেই বা হাতি কিনবে! আর কিনলেও বাবা বেচতেন না। আজকে সারা দিন যেভাবে পাগলের মতো খুঁজলেন, দেখে খুব খারাপ লাগল।

পরদিন সকালে শোরগোলে ঘুম ভেঙে গেল। তুশি আপা বললেন, শিগগির আয়, মানাত ফিরে এসেছে!

আমি তাড়াতাড়ি চোখ ডলে বাইরে গেলাম। দেখি বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে আছে উঠোনে, মানাত ফিরে এসেছে!

তুশি আপা আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে, দাদু সবার সামনে কাঁদছে!আমি গিয়ে মাকে ধরলাম, মা, দাদুর কী হয়েছে?

মা কোনো জবাব না দিয়ে নিজেও চোখ মুছলেন আঁচল দিয়ে। খানিক পরে বললেন, হাতিটা শুঁড়ে করে ২০ টাকা নিয়ে এসেছে যেন কোথা থেকে। এটা দেখেই নাকি দাদু হুহু করে কেঁদে যাচ্ছেন।

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। হঠাৎ করে একদিন আমাদের অভাবও মিটে গেল। আমরাও ফিরে গেলাম শহরে, দাদু তাঁর হাতি নিয়েই ছিলেন। পরে জেনেছিলাম, হাতিটা দাদু এমন একজন থেকে কিনেছিলেন, যে মানাতকে দিয়ে ভিক্ষে করাত। দাদু অনেক কষ্টে সে অভ্যাসটা দূর করিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সে সীমাহীন অভাবে হাতিটার অভ্যাসটা ফের ফিরে আসে, ব্যাপারটা দাদু কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।

বাবা বলতেন, ব্যাপারটা আমি বড় হলে বুঝব।

দাদুর সে কষ্টটা বোঝার জন্য আমাকে সত্যি সত্যিই অনেক বড় হতে হয়েছিল!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments