Friday, April 26, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পমামাতো ভাইয়ের বিয়ে - হুমায়ূন আহমেদ

মামাতো ভাইয়ের বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

মামাতো ভাইয়ের বিয়ে (বৃহন্নলা-০৩) - হুমায়ূন আহমেদ

(বৃহন্নলা-০৩)

আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হল না। মেয়ে কিছুতেই কবুল বলল না। যত বার বলা হল, মা, বল কবুল।

তত বারই মেয়ে কঠিন গলায় বলল, না।

আমি ছেলের পক্ষের সাক্ষীদের এক জন। বড় বিব্রত বোধ করতে লাগলাম! মেয়ের এক খালা বললেন, আপনারা একটু পরে আবার আসুন। বাড়িতে এত বড় একটা দুৰ্ঘটনা ঘটেছে। মনটন খারাপ। বুঝতেই পারছেন।

আমরা চলে এলাম। ঘন্টাখানেক পর আবার গেলাম। বলা হল, মা, বল তো কবুল। মেয়েটি অস্ফুট গলায় কী-যেন বলল। মেয়ের খালা বললেন, এই তো বলেছে। মেয়েমানুষ চিৎকার করে বলবে নাকি? আমি শুনেছি, পরিষ্কার বলেছে। এখন যান, ছেলের কবুল নিয়ে আসুন!

আমি দৃঢ় গলায় বললাম, আমি কিছু শুনতে পাই নি। পরিষ্কার করে বলতে হবে!

উকিল বললেন, মা, বল কবুল।

মেয়েটি এবার স্পষ্ট করে বলল, না। বলেই তীব্র চোখে আমার দিকে তাকাল। সেই চোখে রাগ ছিল, ঘৃণা ছিল, কিঞ্চিৎ অভিমানও ছিল। যেন সে বুলছে—কেন তোমরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছ? তোমাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আমাকে মুক্তি দাও।

আমি বললাম, বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত বন্ধ থাকুক। শোকের ধাক্কাটা কমুক, তারপর দেখা যাবে।

আমরা চলে এলাম। মফস্বলের ঐ শহরের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক রইল না। তবে শহরটার স্মৃতি আমার মনে কাঁটার মতো বিধে রইল। স্মৃতির সবটুকুই গভীর বেদনায়। আমার মামা ওখান থেকে ফিরে আসার পরপরই মাইয়ো কার্ডিয়াক ইনফ্রাকশানে মারা গেলেন। ছেলের বৌ দেখার খুব শখ ছিল, সেই শখ মিটাল না। মামাতো ভাইটিও বিয়ে করতে রাজি হল না। বিচিত্র কারণে সে ঐ মেয়েটির ছবি বুকে পুষতে লাগল। শুধুমাত্র তার মুখের দিকে তাকিয়েই আবার বছরখানেক পর গেলাম ঐ শহরে। শুনলাম মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে।–ছেলে ডাক্তার।

সুধাকান্তবাবুর সঙ্গেও দেখা হল। আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না! যখন বললাম, আপনার সঙ্গে এক বার সারা রাত কাটালাম, আপনার কিছুই মনে নেই? তিনি বললেন, ও আচ্ছা, মনে পড়েছে। তাঁর চোখ-মুখ দেখেই বুঝলাম কথাগুলি তিনি ভদ্রতা করেই বললেন, আসলে কিছুই মনে পড়ে নি।

ভদ্রলোক আমাকে ভুলে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আমি তাঁকে মনে রেখেছি এবং বেশ ভালোভাবেই মনে রেখেছি। তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা প্রায়ই মনে হত। সেই অভিজ্ঞতায় আমারও কিছু অংশ আছে। কপাটের শব্দ আমি নিজের কানে শুনে এসেছি। বাতাস নেই, কিছু নেই, অথচ শব্দ করে কে যেন কপাট বন্ধ করল।

কাচের চুড়ির শব্দ। বাড়ির পিছনে খচখচ আওয়াজ-সবই আমার নিজের কানে শোনা।

সুধাকান্তবাবুর এই গল্প অনেকের সঙ্গেই করেছি। খুব আগ্রহ নিয়েই করেছি। ঝড়বৃষ্টির রাতে যখনি ভূতের গল্পের আসর বসেছে, আমি এই গল্প বলেছি। তবে গল্প তেমন জমাতে পারি নি। আমি যেমন অভিভূত হয়েছিলাম, আমি লক্ষ করেছি আমার গল্পের শ্রোতারা তার এক শ ভাগের এক ভাগও হয় না। অথচ আমি নিজে খুব ভালো গল্প বলতে পারি। হয়তো পরিবেশ একটা ব্যাপার! সুধাকান্তবাবুর বাড়িতে আধোজ্যোৎস্নায় যে-পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, ঢাকা শহরের ড্রয়িং রুমে সেই পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। তবু এটি আমার একটি প্রিয় গল্প। যত বার এই গল্প বলেছি, তত বার ঐ রাতের কথা মনে পড়েছে-একধরনের শিহরণ বোধ করেছি।

বছর তিনেক পরের কথা (বৃহন্নলা-৪)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments