মাঝি ও পণ্ডিত – জসীম উদ্দীন

'মাঝি ও পণ্ডিত' জসীম উদ্দীন

পণ্ডিত মহাশয় পদ্মা নদী দিয়ে নৌকায় করে বাড়ি যাবেন। সেইজন্য একমাল্লাই (এক জন মাঝিবিশিষ্ট) একখানা নৌকা ভাড়া করেছেন।

বহু দূরের পথ। পণ্ডিত মহাশয় কথা না বলে একা একা থাকতে পারেন না। তিনি মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা মাঝি! তুমি ইতিহাস পড়েছ?”

মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে উত্তর করল, “অ্যাঁ, না। কর্তা।”

পণ্ডিত মহাশয় বড়ই অবাক হলেন, “আচ্ছা, বল কি মাঝি! তুমি ইতিহাস পড় নাই? ইতিহাসে আগেরকার দিনের রাজা বাদশার কথা, কত যুদ্ধ বিগ্রহের কথা লেখা থাকে। আগেরকার দিনের লোকেরা কি ভাবে চলত, কিভাবে কি করত, আরও কত কি ইতিহাস পড়ে জানা যায়। তুমি এর কিছুই জান না?”

মাঝি বিনয় করে বলল, “না কর্তা! আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, এসব কিছুই পড়ি নাই।”

পণ্ডিত বললেন, “তাহলে তো তোমার জীবন এর চার আনাই (চার ভাগের এক ভাগ) বৃথা।”

খানিক যেতেই পণ্ডিত মহাশয় আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, মাঝি! তুমি ভূগোল পড়েছ?”

আগের মতই মাঝি বলল, “না কর্তা।”

পণ্ডিত মহাশয় বললেন, “মাঝি তোমর জীবনই বৃথা। গোলাকার পৃথিবীটার কোন কোনায় কোন দেশ, কোথায় কোন নদী, কোথায় কোন পাহাড়, কোন দেশের লোক কেমন, কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যায় এর সবকিছু ভূগোলে লেখা থাকে। সেই ভূগোল তুমি পড় নাই? তাহলেতো তোমার জীবন এর আট আনাই (চার ভাগের দুই ভাগ) বৃথা। মাঝি তোমার বেঁচে থেকে লাভ কি?”

মাঝি হাই তুলে নৌকা বাইতে লাগল।

খানিকবাদে পণ্ডিত মহাশয় আবার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন “মাঝি! তুমি কি বিজ্ঞান পড়েছ?”

মাঝি পূর্বের মতোই উত্তর করল, “অ্যাঁ, না কর্তা।”

“বল কি মাঝি? আজ পৃথিবীটা বৈজ্ঞানিকদের হাতের মুঠোর মধ্যে। কেন রোদ হয়, কেন বৃষ্টি হয়, কোথা থেকে বিজলি আসে, ইলেকট্রিসিটি, রেডিও, উড়োজাহাজ, আর অ্যাটম বোম কিসে হয় এর সবকিছুই বিজ্ঞান পড়লে জানা যায়। আজ বিজ্ঞানের জোরে মানুষ মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মাঝি! তুমি এর কিছুই জান না। বেঁচে থেকে তুমি মরার মতো হয়ে রয়েছো। তোমার জীবন এর বারো আনাই (চার ভাগের তিন ভাগ) বৃথা।”

এমন সময় আকাশের কোনায় একখণ্ড মেঘ দেখা দিল। ঝড় হয়-হয়। নৌকাও পদ্মানদীর মাঝখানে। ঝড়ের আগে নদীর কিনারায় আসার সুজোগ নাই।।

মাঝি তখন পণ্ডিত মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করল, “পণ্ডিত মহাশয়! আপনি সাঁতার জানেন? আকাশে যে মেঘ করেছে; ঝড় আসল বলে!”

পণ্ডিত মহাশয় ভয়ে ভয়ে বললেন, “না মাঝি! আমি তো সাঁতার জানি না।”

তখন মাঝি বলল, “আমি ইতিহাস জানি না, ভূগোল জানি না, বিজ্ঞান জানি না, এজন্য আমার জীবন বৃথা বলেছেন। কিন্তু এত জেনেও একমাত্র সাঁতার না শেখাতে আপনার জীবনের ষোল আনাই (পুরো জীবনই) বৃথা হতে চলল।”

কথা বলতে বলতে নদীতে ঝড় উঠে নৌকা ডুবিয়ে দিল। মাঝি সাঁতার কেটে তীরে উঠল। পণ্ডিত মহাশয় পানিতে ডুবে মারা গেলেন।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.