Saturday, April 20, 2024
Homeবাণী-কথালুলু - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

লুলু – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

লুলু - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

লুলুই হচ্ছে সবকিছুর মূলে।

লুলু আসলে কে বা তার গুরুত্বই বা কী তা আমার কাছে অস্পষ্ট। তবে যতবারই দেশে কোনও-না-কোনও ঘটনা ঘটে তখনই আমাকে লুলুর কাছে আসতে হয়, তার সাক্ষাৎকার নিতে। এ যাবৎ তার কত যে সাক্ষাৎকার নিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তবু লুলু আমাকে আদপেই মনে রাখেনি। দেখা হলে সম্পূর্ণ নতুন করে পরিচয় দিতে হয় এবং পুরোনো পরিচয়ের কোনও স্মৃতির ঝলকানিও লুলুর ভাবসাবে কখনও ফুটে ওঠে না। এটাই যাকে বলে আপশোশ কি বাত।

১৯৪৭ সালের ষোলোই আগস্ট আমি লুলুর সাক্ষাৎকার নিতে আসি, মনে আছে। তখন লুলুর চেম্বার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছিল না, তবে সে তখনও এখনকার মতোই ব্যস্ত মানুষ ছিল। দেখা করার জন্য আমাকে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়। ঘরে ঢুকে কিন্তু লুলুকে একটুও ব্যস্ত দেখিনি। টেবিলের ওপর পা তুলে সে বসেছিল। চেয়ারটা পিছন দিকে হেলে দুটো পায়ার ওপর বিপজ্জনকভাবে ভারসাম্য রক্ষা করছে কোনওক্রমে। লুলু মৃদু হেসে বলল –বি কুইক।

–এই স্বাধীনতা, এই চূড়ান্ত জয়, এই দেশ বিভাগ এবং এই…এই…আবেগে আমার গলা বসে গেল।

লুলু মাথা নেড়ে বলল –হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই স্বাধীনতা, এই দেশ বিভাগ আর যা কিছু সবই খুব চমৎকার। অতি চমৎকার। এই জয়…তবে আমার একটা ভয় হচ্ছে যে, যেসব ইংরেজ এদেশে মারা গেছে তাদের ভূতগুলো চলে যাচ্ছে না। সেগুলোকে যদি না তাড়ানো যায় তবে পাকে প্রকারে ইংরেজও থাকছে। এবং ইংরেজিয়ানাও। এখন আমাদের উচিত হবে ভারতের অতীতের ভূতদের ইংরেজ ভূতের বিরুদ্ধে লাগানো।

লুলু যে সামান্য মাতাল অবস্থায় ছিল তা তখন আমি টের পাই।

গান্ধি হত্যার পর আমি লুলুর কাছে গিয়ে আবার ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর চেম্বারে ঢুকে দেখি লুলু অবিকল সেইভাবেই বসে আছে।

বলি–এই বিশ্বাসঘাতকতা, এই হত্যা…

লুলু মাথা নেড়ে বলল –জঘন্য। আসলে একজনকে খুন করার মধ্যে কী যে আছে আমার মাথায় আসে না। লাভ কী? আমার তো ভাবতেই জ্বর আসে? খুনের পর ধরা পড়তে হবে, দিনের পর দিন স্নায়ু–ছেঁড়া মামলা চলবে। তারপর ফাঁসি…ওঃ। তার চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আছে। ধরুন, কাউকে মারার ইচ্ছে হলে আমি তার একটা মূর্তি তৈরি করে সেটার ওপর গুলি চালালাম, ইচ্ছে মতো তারপর লোকটাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলাম যে, অমুক দিন অমুক সময়ে তোমাকে আমি মেরে ফেলেছি। ব্যস, লোকটাও তা জানার পর একদম মৃতের মতো হয়ে যাবে। অর্থাৎ সব কাজকর্ম অ্যাকটিভিটি বন্ধ করে দেবে। হত্যাটা হবে প্রতীকী এবং তাতে হিংস্রতাও থাকবে না। চিন যুদ্ধের সময় ফের পত্রিকার তরফ থেকে লুলুর কাছে যাই।

–এই যুদ্ধ সম্পর্কে…

লুলু অবিকল একইভাবে চেয়ারে দোল খেতে-খেতে বলে–হোপলেস। যুদ্ধ টুদ্ধের কোনও মানেই হয় না। বিশেষ করে চিনেদের সঙ্গে। আমার মনে হয়, এসব ডিসপিউট মেটানোর জন্য অন্য ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

সাগ্রহে বলি–কীরকম?

–ধরুন, চিনের সঙ্গে ভারতের একটা হকি ম্যাচের ব্যবস্থা হল। যদি ভারত জেতে তাহলে তার কথাই থাকবে। হকিতে আপত্তি থাকলে চিন পিংপংয়েও ভারতকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। যাই হোক, আমার কথা হচ্ছে, স্পোর্টসের যুদ্ধটা সেরে নেওয়া ভালো। সিরিয়াসলি মারপিটটা নিছক ছেলেমানুষি। আমি জানি চিন বলছে যে, তিব্বত তাদের। আমার প্রথম বিয়ের আগে আমার বউও বলত সে নাকি আমার, একান্তই আমার। তারপর আরও চারবার বিয়ে করতে হয়েছে আমাকে এবং এখন আবার আমি দারাহীন, কিন্তু প্রথম বউয়ের মতো সব বউই আমাকে ওই একই কথা বলছে, এবং ওই একই কথা হয়তো এখনও তারা তাদের নতুন নতুন প্রেমিক বা স্বামীর কাছে বলছে। এসবের কোনও মানে নেই। দুনিয়াতে কেউ বা কিছু কারও বা কিছুর নয়।

সেদিনই আমি লুলুকে বলি–আপনার চেম্বারটা এয়ারকন্ডিশনড করান না কেন? আর ওই বিপজ্জনক চেয়ারের বদলে আপনি তো অনায়াসে একটা রিভলভিং চেয়ারের ব্যবস্থা করতে পারেন।

এরপরও পাকিস্তান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম, কংগ্রসে ভাগ, নকশাল আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট ইত্যাদি বিষয়ে আমাকে লুলুর লাক্ষাৎকার নিতে হয়। কিন্তু সেগুলোর কথা থাক। ইমারজেন্সির পর যখন আমি লুলুর কাছে যাই তার বেশ কিছুদিন আগে তার চেম্বার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং সে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। একটু মাতাল।

বললাম–ইমারজেন্সি সম্পর্কে কিছু বলবেন?

লুলু টেবিলে মৃদু চাপড় দিয়ে বলে–আলবাত!

–কী?

–দেয়ার ইজ অ্যান ইমারজেন্সি। খুবই জরুরি ব্যাপার। খুবই আর্জেন্ট। অনেকক্ষণ ধরেই এটা আমি ফিল করেছি। চলুন যাওয়া যাক।

–কোথায়?

–জরুরি কাজে। খুবই জরুরি।

এই বলে লুলু উঠে পড়ে। আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামিয়ে আনে রাস্তায়, গাড়িতে ওঠায় এবং একটা মদের দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বলে–এ ব্যাপারটা খুবই জরুরি।

–কিন্তু আমি জরুরি অবস্থা জারি প্রসঙ্গে…

লুলু আধো চোখ আমাকে দেখল। খুবই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি। দুপেগ করে হুইস্কির হুকুম দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল –আপনি নতুন জার্নালিসম করছেন, তাই না?

–না। আমি দীর্ঘকাল ধরে…ইন ফ্যাক্ট আমি আপনার ইন্টারভিউই তো বহুবার…

লুলু মাথা চেপে ধরে একটা কাতর শব্দ করল। তারপর বলল –তাহলে আপনি একটি গর্দভ রিপোর্টার।

–কেন? আমি ফুঁসে উঠে বলি। পরমুহূর্তেই আমার মনে পড়ে যায় যে, লুলু অত্যন্ত ইমপর্ট্যান্ট লোক। দেশের অন্যতম প্রধান নায়ক। সব কিছুর মূলেই লুলু। তাই আমি আবার বিনীত হয়ে বলি–হতেও পারে।

লুলু বলে–অত্যন্ত জরুরি।

–কী?

–এই জরুরি অবস্থা। অন্তত সাতাশ বছর আগে এটা জারি করা উচিত ছিল।

–কেন?

লুলু তার হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে–ফর ওয়ান থিং। গত সপ্তাহে আমার দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে যাওয়া বাতিল করতে হয়। আমি ট্রেনের রিজার্ভেশন ক্যানসেল করার জন্য রেল অফিসে ফোন করি। ফোনের রিং হতেই ওপাশে কে যেন রিসিভার তুলে বলল নমস্কার। আমি রং নাম্বার ভেবে ফোন ছেড়ে দিই। কিন্তু তারপর আরও তিন–তিনবার সেই আশ্চর্য ঘটনা। রেল অফিস টেলিফোনের জবাব দিচ্ছে, এবং জবাব দেওয়ার আগে নমস্কারও জানাচ্ছে। জাস্ট থিংক অফ ইট। গত সাতাশ বছর ধরে আমি রেল অফিসে ফোন করে আসছি, কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি।

আমি খুব মন দিয়ে নোটবইতে কথাগুলি লিখছিলাম। লুলু নোটবইটা সরিয়ে নিয়ে বলল –ওহে ইডিয়ট রিপোর্টার, ইমারজেন্সির মর্ম কবে বুঝবে? তোমার হুইস্কির গ্লাসে এক্ষুনি একটা দারুণ ইমারজেন্সি দেখা যাচ্ছে। বরফ গলে গরম হয়ে যাচ্ছে হুইস্কি। আগে ওটা খাও, তারপর লিখবে।

লুলু খুবই ইম্পট্যান্ট। তার অবাধ্যতা চলে না। হুইস্কি খেতে-খেতে আমি বলি–কিন্তু রেল অফিস থেকে টেলিফোনে নমস্কার জানানোটাই তো বড় কথা নয় মিস্টার লুলু। এতে দরিদ্র ভারতবাসীর কী লাভ হবে। ভারতবর্ষের বহু কোটি লোক টেলিফোন জীবনে একবারও ব্যবহার করেনি বা তারা রেল অফিসেও কোনওদিন টেলিফোন করবে না।

লুলু গম্ভীরভাবে বলে–সরকারের বর্তমান নীতিই হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে জনসাধারণের হাতের কাছে, নাগালের মধ্যে টেলিফোন পৌঁছে দেওয়া। প্রত্যেক টেলিফোনের সঙ্গে নোটিশ দেওয়া থাকবে : নমস্কারের জন্য রেল বা সরকারি অফিসে টেলিফোন করুন।

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বলি–কিন্তু টেলিফোন করার জন্য তো পয়সাও দিতে হবে মিস্টার লুলু।

–তা হবে। তবে নমস্কারটা ফ্রি পাওয়া যাবে।

কোলের ওপর নোটবই রেখে লুলুর চোখকে ফাঁকি দিকে মন্তব্যটা লিখে নিয়ে আমি বলি–নাগরিক অধিকার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উঠেছে এবং বাক স্বাধীনতা।

লুলু আরও দু-পেগ টেনে নিয়ে দু-পেগের প্রথম কিস্তিতে চুমুক দিয়ে বলে–মানবিক অধিকার ভারী সুন্দর কথা, কিন্তু মানে হয় না। অন্তত সতেরোটা ডিকশনারি খুঁজেও অর্থ বের করতে পারিনি।

আমি লুলুর ভুল শুধরে বলি–মানবিক নয়, নাগরিক।

–ওঃ! বলে লুলু হেসে বলে–তাই বলুন। নাগরিক অধিকার! আমি মানবিক ভেবে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! আসলে মানুষ এবং নাগরিক কথা দুটোই আলাদা, অর্থও দুরকম। নাগরিক মানেই কিন্তু মানুষ নয়। এ কথাটা মনে রাখলে আর কোনও গোলমাল থাকে না।

আমি একটু গোলমাল পড়ে গিয়ে জিগ্যেস করি–নাগরিক এবং মানুষ কি আলাদা শ্রেণি?

–আলবাত! লুলু প্রায় চেঁচিয়ে বলে ওঠে। চোঁ করে হুইস্কি টেনে নিয়ে আবার খুব নীচু গলায় বলে–আসলে কোনওটারই মানে হয় না।

আমি কিন্তু-কিন্তু করে বলি–কিন্তু…

–মূর্খ সাংবাদিক, আপনি অকারণ সময় নষ্ট করছেন। চারদিকে এখন জরুরি অবস্থা।

আমাদের প্রয়োজনগুলিও অত্যন্ত জরুরি। সময় নেই। আয়ু বয়ে যাচ্ছে, একদম সময় নেই। দেরি করলে যৌবন ফিরে যাবে, বসন্ত শেষ হবে। উঠে পড়ুন।

লুলুর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমি তার আদেশে উঠে পড়লাম।

গাড়ি করে লুলু আমাকে এক বিশাল ম্যানসনে নিয়ে গেল। এত বড় একটা বাড়ি কলকাতার মহার্ঘ প্রায় বিঘে দুই জমিতে কী করে জমিয়ে বসেছে তা ভাববার কথা।

স্বয়ংক্রিয় লিফটে ওপরে উঠতে-উঠতে লুলু আমার দিকে চেয়ে মহা বদমাশের মতো মুচকি হেসে বলে–এ-বাড়িতে আমার প্রায় আধ ডজন প্রেমিকা থাকে।

বলে লুলু আমার মুখের ভাব লক্ষ করতে লাগল। আমি যতদূর সম্ভব মুখখানা ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করতে-করতে বললাম–থাকতেই পারে। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

লুলু হাসল না। খুব গম্ভীর মুখে ভ্রুকুটি করে বলল –থাকতেই পারে কেন? আর স্বাভাবিক ব্যাপারই বা কী করে হল?

মুশকিলে পড়ে বললাম–বিজ্ঞান বলে পুরুষরা বাই নেচার বহুগামী।

লুলু–তাহলে আইন করে একাধিক বিয়ে বন্ধ করা হল কেন? যদি জানোই যে, পুরুষরা বহুগামী তবে তাদের সেই গমনপথে গর্ত খোঁড়ার মানে কী? পচা রিপোর্টার, অনেক লোক যদি বউ থাকা সত্বেও আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে শোয় তবে তোমরা তেমন গা করো না। বোধহয় তোমরা নিজেরাও শোও। কিন্তু একজন ভ ভদ্রলোক যদি দ্বিতীয়বার বিয়ে করে তবে সেটা তোমাদের কাছে খবর হয়ে দাঁড়ায়, বুদ্ধ সাংবাদিক, তুমি কি জানো তোমরা কতটা ইর‍্যাশনাল?

আমি একটু রেগে গিয়ে বলি, কোনও মেয়ের সঙ্গে শুই না। ইন ফ্যাক্ট আমি এখনও সুযোগই পাইনি। আমার আছে সোশ্যাল স্ট্যান্ডিং, সামাজিক সম্মানবোধ এবং নিজের স্ত্রী সম্পর্কে ব্যক্তিগত ভয়–সেই কারণে ইচ্ছে থাকলেও আমি চরিত্রহীন হতে পারছি না।

লুলু খুবই স্নেহের সঙ্গে আমার দিকে চেয়ে ‘তুমি’ থেকে আবার আপনিতে ফিরে গিয়ে বলে–রিপোর্টার মহোদয়, এবার বুঝতে পারছেন তো আপনার মতো একটি ছাগলের পক্ষে নাগরিক স্বাধীনতা কত অর্থহীন একটি শব্দ! এমনকী দেশ জুড়ে যেসব নাগরিক রয়েছে তারাও অধিকাংশই মানুষ নয়, আপনারই মতো ছাগল! নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য মহিলার সঙ্গে শোওয়ার ইচ্ছে ও স্বাধীনতাকে তারা স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছেন। সুতরাং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে আপনারা কী করবেন?

কত তলায় লিফট থেমেছে তা আমি লক্ষ করিনি। দোর খুলে লুলু বেরোল। সঙ্গে আমিও। খুব ঝকঝকে করিডোর দিয়ে লুলুর পিছু-পিছু হাঁটতে-হাঁটতে আমি বললাম কিন্তু বাকস্বাধীনতা? মিস্টার লুলু, স্বাধীনতার ব্যাপারটা নিয়েও কি আপনি ভাবছেন না?

লুলু সে-কথার জবাব না দিয়ে পিতলের পাতে নম্বর লেখা একটা দরজায় কলিংবেল টিপল। দরজা খুলে বছর পঁয়ত্রিশের এক অসাধারণ সুন্দরী দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে লুলুকে দেখতে দেখতে তার মুখ ভাবালু এবং মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল। চোখ আলোয় ভরে উঠল, ঠোঁট টসটস করতে লাগল, সমস্ত শরীর প্রত্যাশায় ভারসাম্য হারিয়ে টলোমলো করছিল। লুলু দু-হাতে তাকে শরীরের মধ্যে টেনে নেয়, চুম্বন করে এবং বলে–

যা বলে তা অবশ্য লেখা যায় না। চূড়ান্ত ভালোবাসার অসভ্যতম কথা সব। আমি চোখ নামিয়ে নিই এবং না শোনার ভান করতে থাকি।

লুলু সশব্দে তার দশম চুম্বন শেষ করে আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে চোখ টিপে বলে–গেতো রিপোর্টার, নোট নিচ্ছ না যে বড়? আমি যা বলছি এবং যা করছি এসব কি ইম্পর্টান্ট নয়? না কি তুমি আমাকে ঠিক গুরুত্ব দিতে চাইছ না?

আমি অনিচ্ছুক আঙুলে ডটপেন বাগিয়ে ধরি কিন্তু লিখতে হাত সরে না।

লুলু বলল –স্কাউন্ট্রেল ছোটলোক ইডিয়ট!

লুলুর গুরুত্বের কথা ভেবে আমি চুপ করে থাকি। এমনকী একটু হাসবারও চেষ্টা করি।

লুলু ঘরে ঢোকে এবং ইশারায় আমাকেও ঢুকতে বলে। আমি ঘরে ঢুকলে লুলু দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে–এবার বলো। আমি অভয় দিচ্ছি, তোমার কোনও ক্ষতি করব না।

আমি মুশকিলে পড়ে বলি–কী বলব?

লুলু অবাক হয়ে বলে–তোমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না?

–না তো!

ধূর্ত! খল! মিথ্যেবাদী! আমাকে তোমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না?

ভয় পেয়ে বলিনা। কিছুই না।

লুলু এবার হাহা করে হেসে বলে–তোমার সামনেই একটা নষ্ট মেয়েকে চুমু খেলাম; অসভ্য কথা বললাম, তোমাকে না হোক গালাগাল দিলাম, অথচ তোমার কোনও রি–অ্যাকশন হচ্ছে না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মহাত্মা রিপোর্টার? বরং তোমার এখন আমাকে খিস্তি করতে ইচ্ছে করছে, লাথি মারতে ইচ্ছে করছে। বলল , করছে না? কিন্তু হায়, তোমার সেই বাকস্বাধীনতা তুমি কখনওই কাজে লাগবে না। শোনো কাপুরুষ, আমার যদি কখনও কাউকে শুয়োরের বাচ্চা বা বেজন্মা বলতে ইচ্ছে করে তবে আমি বলি, তুমি কেন পারো না বলতে?

আমি গম্ভীর হয়ে বলি–ভদ্রতাবোধে বাধে।

লুলু হাহা করে হেসে ওঠে বলে–তাহলে বাক স্বাধীনতা দিয়ে তুমি কী করবে ভিতু সাংবাদিক? যখন যা মনে আসবে তা যদি বলে ফেলতে পারো তবে তোমার বাক স্বাধীনতা আছে, যদি না পারো তত নেই।

বিরক্ত হয়ে আমি বললাম–গালাগাল দেওয়ার অধিকারই তো একমাত্র বাকস্বাধীনতা নয় মিস্টার লুলু। পলিটিক্যাল ইডিওলজি নিয়ে যে মতবিরোধ, সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে যে বিরুদ্ধ সমালোচনা তাই যদি না করা যায়…

লুলু আমাকে একদম পাত্তা না দিয়ে তার ভাঁটানো যৌবনের সুন্দরী প্রেমিকার দিকে এক পা এগোল। ঘরের মাঝখান থেকে তার প্রেমিকাও লিত চরণে এগিয়ে আসে এক পা। তাদের দুজনেরই মুখচোখে আনন্দের মোহ, তীব্র কাম ও বিহুলতা তবু সে অবস্থাতেও লুলু আমার দিকে জ্বলন্ত একটা দৃষ্টিক্ষেপ করে চাপা স্বরে বলে–নোট নাও বুদ্ধ, সব কিছু নোট করে নাও। প্রত্যেকটা স্টেপ লক্ষ করো। সঙ্গম শেষে আমি আমার প্রেমিকাকে খুন করব। খুব লক্ষ কোরো ব্যাপারটা…

আমি চোখ বুজে ফেলি এবং কানে আঙুল দিই। এবং ওই অবস্থাতেই সোফায় বসে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ বাদে লুলুই আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগায়। আমি চোখ মেলতেই লুলু বিরক্তির গলায় বলে–ড্যাম ইনএফিসিয়েন্ট!

লুলুর পদমর্যাদার কথা মনে রেখে আমি বলি–আজ্ঞে।

একটা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচে ছায়া দেখে টাইয়ের নট ঠিক করতে-করতে লুলু। বলে রিপোর্টার, লাভ–হেট রিলেশন বলে কী একটা কথা আজকাল চালু হয়েছে না? অর্থাৎ আমরা যখন আমাদের প্রিয় বা প্রেমাস্পদকে একই সঙ্গে ভালোবাসি এবং ঘৃণা করি? আমরাও ঠিক সেই অবস্থা। আমি আমার চোদ্দোজন প্রেমিকাকে কেন ঘৃণা করি এবং ভালোবাসি বলো তো? এর আগে আমি আমার চোদ্দোজন প্রেমিকাকে খুন করেছি।

বাস্তবিকই লুলুর প্রেমিকাকে ঘরে দেখা যাচ্ছিল না। উপরন্তু সেন্টার টেবিলের ওপর লুলুর সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার পড়ে আছে। ঘরের বাতাসে বারুদের কটু গন্ধ। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে সোজা হয়ে বসি এবং বলি–মিস্টার লুলু, আপনি তাহলে সত্যিই আপনার প্রেমিকাকে খুন করেছেন? সর্বনাশ।

লুলু অবাক হয়ে বলে–খুন করার কথাই ছিল যে!

উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপতে থাকে, আমি চিৎকার করে বলি বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে মিস্টার লুলু। আমি এক্ষুনি পুলিশের কাছে যাচ্ছি। আপনি যত বড় মাতব্বরই হোন, এর জন্য আমি আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে।

মহান লুলু বোধহয় এই প্রথম একটু ভয় পেল। তার চোখে–মুখে দ্বিধা ফুটে উঠেছে। একটু চাপা ধমকের স্বরে সে বলে–চুপ করো মূর্খ! আশেপাশে কেউ শুনে ফেলবে।

আমি চেঁচিয়েই বলি–কিন্তু এটা যে খুন মিস্টার লুলু! আমি এটা চেপে রাখতে পারি না।

লুলু ব্যথিত মুখে চেয়ে বলে–বোকা, ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দ্যাখো। পুলিশের কাছে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি ভালো কাজ হবে না যাওয়া। এ ব্যাপারটা চেপে রাখার জন্য তোমাকে আমি অনেক টাকা দেব। অনেক টাকা, যত টাকা তোমার দশ বছরের বেতনের চেয়েও বেশি। উপরন্তু পুলিশের কাছে গেলে মামলা–মোকদ্দমা এবং তজ্জনিত নানা ঝামেলায় তোমাকে জড়িয়ে পড়তে হবে। আর-একটা কথা বলে লুলু তার রিভলভারটা তুলে নিয়ে আমার দিকে তাক করে বলে–ইচ্ছে করলে টাকার বদলে অন্য উপায়েও আমি তোমার মুখ বন্ধ করে দিতে পারি।

লুলু হাসল। আমার শরীরে ঘাম দিল। শ্বাস ছেড়ে আমি বললাম কত টাকা?

–দু-লাখ।

লুলু রিভলভার পকেটে পুরে নিয়ে আলমারি খুলল। কয়েকটা নোটের বান্ডিল আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল –এই টাকা দিয়ে একদিন আমি জিনিকে কিনে নিয়েছিলাম। এই টাকার হুকুমেই জিনি তার অন্য সব প্রেমিককে ভাগিয়ে দিয়েছিল। আজ সেই টাকায় তোমাকে কিনছি রিপোর্টার। কে জানে এই টাকাতেই কখনও আর-একজনকে কিনতে হবে কি না।

আমি টাকার বান্ডিলগুলো ছুঁয়ে থেকে একটু শিউরে উঠি। বলি–আপনি আমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছেন না তো মিস্টার লুলু?

লুলু গম্ভীর হয়ে বলে–না। কিন্তু এ ধরনের রোজগারে কিছু রিস্ক যেসব সময়েই থাকে, তা আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম।

আমি গম্ভীর হয়ে বলি–আমাকে ভয় দেখাবেন না মিস্টার লুলু, আমার হার্ট খুব ভালো নয়।

লুলু কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুরো প্রসঙ্গটি অবহেলায় ঝেড়ে ফেলে বলে–আপনি নাগরিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কী যেন জানতে চাইছিলেন?

পাশেরই ঘরেই হয়তো জিনির মৃতদেহ পড়ে আছে। পরিস্থিতিটা খুবই অস্বাভাবিক। তবু নিজের কর্তব্যে অবিচল থেকে আমি নোটবই বের করি এবং আগ্রহের গলায় বলি–দয়া করে বলুন।

কিন্তু পরমুহূর্তেই আনমনা হয়ে যায় লুলু। টাইয়ের ল্যাজে আদর করে হাত বোলাতে বোলাতে উলটোদিকের সোফায় বসে আপনমনে বলতে থাকে–ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে, ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে, অবহেলা করে দেখিয়াছি মেয়ে-মানুষেরে…

–মানে? আমি কিছু অবাক হই।

লুলু হাই তুলে বলে–লিখে নাও, আমরা চাই ভালোবাসার বা সঙ্গমের স্বাধীনতা, ঘৃণা করার স্বাধীনতা, খুন করার স্বাধীনতা।

মিস্টার লুলু! আমি মহান লুলুকে তার মন্তব্য সম্পর্কে সাবধান করার জন্য একটু ধমকের সুরে বলি।

লুলু আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে বলে–তুমিও কি তাই–ই চাও না রিপোর্টার? ভেবে দ্যাখো, খুব ভালো করে ভেবে দ্যাখো, একজন অ্যাভারেজ ভারতবাসী–সে চাকুরে, বেকার বা পলিটিক্যাল ওয়ার্কার যাই হোক তার মোটামুটি চাহিদাটা কী? সে কীসের স্বাধীনতা চায়? কীসের অধিকার তার কাম্য? ভেবে দ্যাখো রিপোর্টার, ব্যক্তিগত জীবনে তুমিও চাও ভালোবাসা বা আনন্দের স্বাধীনতা। এরপর সামাজিক জীবনের কথা ভেবে দ্যাখো। দেখবে প্রতিনিয়ত রোজ-রোজ রাস্তায়, ঘাটে, অফিসে দফতরে যত লোকের সঙ্গে তুমি মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের প্রায় অধিকাংশকেই তুমি ঘৃণা করো কি না। করো, তার কারণ তাদের অধিকাংশের আচার ব্যবহার, কথা, ইডিওলজির সঙ্গে তোমার চিন্তা বা বিশ্বাসের অমিল, তোমার স্ত্রী বা প্রেমিকা–যাদের কাছ থেকে তুমি যতটা চাও, তার অর্ধেকও পাও না তাদের কাউকে তুমি জেনুইনলি খুন করতে চাও। কি না। এবং সেই হননেচ্ছাকে প্রতিদিন তুমি ভদ্রতাবোধ, শিষ্টাচার, মায়া–মমতা ইত্যাদি দিয়ে চাপা দিয়ে রাখছ কি না। ধরো, যদি আজ একটা আইন করে বলা হয়, কেউ খুন করলে তার ফাঁসি বা জেল হবে না, কোনও শাস্তিই দেওয়া হবে না তাকে, তাহলে তোমার কি মনে হয় না যে। আইন পাশ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সারা দেশে লক্ষ-লক্ষ লাশ পড়ে যাবে?

–আমি জানি না মিস্টার লুলু।

–জানো জানো, স্বীকার করো না। বুদ্ধ রিপোর্টার, আমরা আসলে এই স্বাধীনতাগুলি চাই। লিখে নাও।

আমি ঘামতে-ঘামতে লিখতে থাকি।

লুলু উঠে দাঁড়ায় এবং ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায়। আমি লিখতে গিয়ে দেরি করে ফেলি। কোনওক্রমে লুলুর শেষ কথাগুলি টুকে নিয়ে যখন ধাঁ করে উঠে দাঁড়াই, তখনই হঠাৎ সামনে দেখি জিনির ভূত দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো। মুখে লোল হাসি এবং বিলোল মুগ্ধতা।

ভয় পেয়ে আমি আবার সোফায় বসে পড়ে আড়াই লাখ টাকায় গর্ভবতী আমার ব্রিফকেস চেপে ধরি বুকে। জিনি এসে আমার পাশে বসে। আমাকে ছোঁয় এবং বলে–আই অ্যাম ফর সেল।

–তুমি মরোনি জিনি? আমি বলি।

–মরেছি হাজার মরণে। জিনি বলে এবং হাসে।

আমি বুঝতে পারি যে, আড়াই লাখ টাকা আমি রোজগার করতে পারিনি। বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কিছুদিন আগে রাইটার্স বিল্ডিংসে আমি একজন মন্ত্রীর ব্রিফিং নিতে যাই। মন্ত্রীর সঙ্গেই যখন করিডোরে বেরিয়ে আসি, তখন বাইরেটা ঘন মেঘে কালো, তুমুল বৃষ্টি দেখতে থাকি। উনি তখন বলছিলেন, ন্যাশনাল ইনমেন্টের ফাংশনে দেওয়া ওঁর বক্তৃতাটা আমি কাগজে সবটুকু দেব কি না। আমি ওঁকে আশ্বাস দিচ্ছিলাম। আর তখন হঠাৎ সেই বর্ষা সমাগমের সৌন্দর্য দেখে আনন্দিত মন্ত্রী গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন–আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…। ঋতু বিচার করলে খুবই ভুল গান। কিন্তু তবু সেই অতুলন বৃষ্টির দৃশ্য দেখে তাঁর হৃদয় যে নেচেছিল, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কিছুক্ষণ উনি তো কাগজে ওঁর স্টেটমেন্টের কতটা ছাপা হবে, সেই দুশ্চিন্তা ভুলেছিলেন।

বলতে কি আমিও এই প্রবল সংকটের সময়ে গুনগুন করে গেয়ে ফেললাম–আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…

জিনি এগিয়ে আসে। মুখে–চোখে বিহুল আসঙ্গলিপ্সা, সম্মোহিত লিত বিভঙ্গ। আমিও কী রকম হয়ে যেতে থাকলাম।

কয়েক মাসের মধ্যেই জিনি তার আড়াই লাখ টাকা আমার কাছ থেকে বের করে নিল।

কংগ্রেসের বিপুল পরাজয় ও জনতা পার্টির ক্ষমতায় আসার পর আমি আবার লুলুর কাছে। যাই। দেখি, মহান লুলু আগের মতোই তার চেয়ারে বসে, টেবিলের ওপর পা।

বলি–মিস্টার লুলু।

–আপনি বোধহয় কোনও রিপোর্টার।

–আজ্ঞে। আমাকে চিনতে পারছেন না তো! এক সময়ে আপনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন।

লুলু নির্বিকারভাবে বলে–এখনও করি, কিন্তু তার মানে এ নয় যে চিনি।

তার অর্থ?

–ধরুন, ভারতবর্ষের কোনও মহান নেতা কোটি–কোটি দেশবাসীকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন। দিনরাত তাদেরই মঙ্গল চিন্তা করছেন। কিন্তু তার মানে এ নয় যে কোটি–কোটি ভারতবাসীর প্রত্যেককে তাঁর চিনতে হবে। এও নয় যে, একজন দুজন দশজন বা দশহাজার জন। ভারতবাসী না খেয়ে থাকলে, ভিক্ষে করলে, চুরি জোচ্চুরি রাহাজানি করলে, বন্যার কবলে পড়লে বা মরলে তাঁকে বুক চাপড়াতে হবে। এমনকী সারা দেশের মানুষের প্রত্যেককে একবার করে কুশল প্রশ্ন করতে হলেও তাঁর এক জীবনের আয়ুতে কুলোবে না। সুতরাং স্নেহ বা ভালোবাসার সঙ্গে চেনা-পরিচয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং আমি সবাইকে ভালোবাসি, কিন্তু নেসেসারিলি সবাইকে চিনি না।

আমি বিনীতভাবে বলি–বিখ্যাত ও মহানদের ক্ষেত্রে এটা খুবই সত্য কথা।

লুলু হাত নেড়ে প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দিয়ে বলে–সে যাক গে। আপনি কি কংগ্রেসের পতন এবং জনতার অভ্যুদয় সম্পর্কে জানতে চান?

–হ্যাঁ, এই পতন অভ্যুদয়ের কথা যদি বলেন।

লুলু উদাস গলায় বলে–জরুরি অবস্থা জারি করাটা খুই খারাপ হয়েছিল, আর তার ফলেই কংগ্রেসের পতন।

–কিন্তু মহান লুলু আপনিই বলেছিলেন আরও সাতাশ বছর আগেই জারি করা উচিত ছিল, কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আরও সাতাশ বছর আগে জরুরি অবস্থা জারি করলে আজ আর তার জারি করার প্রয়োজনই থাকত না।

–শ্রদ্ধেয় লুলু, জরুরি অবস্থায় যেসব বাড়াবাড়ি ঘটেছে সে সম্পর্কে আপনার মত কী?

খুবই বাড়াবাড়ি ঘটেছিল। রেল অফিস থেকে নমস্কার জানানোটা তার মধ্যে অন্যতম বাড়াবাড়ি।

–লুলু, আপনার কি মনে হয় না এখন রাষ্ট্রের ক্ষমতা বদলের ফলে নাগরিকদের জীবনে নিরাপত্তা ও অধিকার ফিরে এল? মনে হয় না কি জনগণের ইচ্ছাই এর ফলে জয়ী হয়েছে। এ কী জনগণের এবং গণতন্ত্রের জয় নয়?

–নিশ্চয়ই। তবে একথাও ঠিক যে, এই দেশে বরাবরই, এমনকী জরুরি অবস্থার সময়েও জনগণেরই শাসন বলবৎ ছিল। এই শাসক জনগণ হচ্ছে তারাই যাদের রাজ্য বা কেন্দ্রের কোনও মন্ত্রী, কোনও রাজ্যপাল বা স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ভালোবাসেন, কিন্তু চেনেন না। তাঁরা জনগণের অস্তিত্বর কথা জানেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা কারা সে সম্পর্কে ভালো ধারণা তাঁদের নেই। এই জনগণেরই একজন এক রিকশাওয়ালা বষ্টির দিনে সাউথ এন্ড পার্কের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে আমাকে পৌঁছে দেওয়ার সময় পাঁচ টাকা নিয়েছিল। আমি তাকে জরুরি অবস্থার কথা বলতে সে খুব কর্তৃত্বের গলায় বলেছিল–তাতে কী? একইরকমভাবে হাওড়া স্টেশনের এক কুলিও আমার কাছ থেকে পাঁচ টাকা আদায় করে। প্রিয় সাংবাদিক, আপনি মহান পুলিশের কথা ভাবুন, আপনি পবিত্র আদালতের কর্তব্যপরায়ণ কর্মচারীদের কথা ভাবুন, আপনি ছোট এবং বড় ব্যবসায়ীদের কথা ভাবুন, দোকানদারদের মুখশ্রী কি আপনার মনে পড়ে না? আপনি যেকোনও বৃত্তিতে নিযুক্ত মানুষদের কথা ভেবে দেখুন। বেকার ছেলেছোঁকরাদের কথা ভাবুন। এরা সবাই সেই মহান জনগণ। রাষ্ট্রের নামে এঁরাই বরাবর দেশ শাসন করে আসছেন। এদেশে পুলিশ যখন কোনও চোর, ঘুষখোর বা খুনিকে ধরে, তখন আপনার হাসি পায় জানি। কারণ, পুলিশ যাকে ধরে তার সঙ্গে পুলিশের নিজের কোনও পার্থক্য নেই। তবু মনে রাখবেন ওটুকু পুলিশ বেশি জনগণের ন্যায্য শাসন। আদালতে যখন আপনাকে হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য গুনোগার দিতে হয় তখন সেটাও জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন বলেই মনে করবেন। দোকানদাররা ভেজাল মাল দিলে, দামে বা ওজনে ঠকালে সেটাও তা জনগণেরই লাভ। পাড়ার ছোঁকরারা পুজো বা পলিটিকসের নাম করে চাঁদা তুলে যখন মাল খায়, তখন সেটা বেকার জনগণের জন্য জনগণের দেয় বেকার ভাতা বলেই ধরা উচিত নয় কি?

আমি উত্তেজিত হলে বলি–মিস্টার লুলু, আপনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছেন।

লুলু মাথা নেড়ে বলেনা প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক। আমি বলতে চাইছি, এদেশে জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বরাবরই ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। জনগণ এক বৃহৎ ও মহান শক্তি। এই শক্তি জনগণের মধ্যেই পারস্পরিক ক্রিয়া করে। রামকে। শ্যাম মারে, শ্যাম যদুকে ঠকায়, যদু মধুর কাছ থেকে চাঁদা তোলে এবং মধু রামকে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করে নেয়। আর এইভাবেই জনগণের বিপুল শক্তি তার ভারসাম্য রক্ষা করছে। আর এভাবেই চলবে। আমার মনে হয়, আমাদের দেশে আর গভর্নমেন্টের কোনও প্রয়োজনই নেই। আমরা স্টেটলেস সোসাইটির কল্পনাকে সার্থক করে তুলেছি।

আমি চোখ কপালে তুলে বলি–বলেন কি মহান লুলু! সরকার না থাকলে যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হবে।

লুলু মাথা নেড়ে বলে–শোনো মুখ, সরকার তুলে দেওয়ার কথা বলি না। নট্ট কোম্পানি বা বহুরূপীর নাটকে দলের মতো বা ইস্টবেঙ্গল–মোহনবাগানের মতো জনজীবনে উত্তেজনাময়। এন্টারটেনমেন্টের জন্য সরকারও থাকবে। একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্য একটা রাজনৈতিক দলের তরজা বা কবির লড়াই চলবে, ভোটযুদ্ধ হবে, সংসদে আজকের মতোই যাত্রার আসর বসবে। সেখানে জনগণের মঙ্গলের জন্য আইন পাস হবে, অর্থ বরাদ্দ হবে, ধাঁধা প্রশ্নোত্তরের আসর বসবে। কিন্তু সেগুলির সঙ্গে জনগণের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থার কোনও হেরফের হবে না।

আমি ভীষণ উত্তেজিতভাবে বলি–মিস্টার লুলু, আপনি এসব কী বলছেন এ যে সরকারের অসম্মান।

লুলু উঠে দাঁড়ায় এবং জানলার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে–সাংবাদিক, এসো দ্যাখো এসে বাইরে কী সুন্দর দৃশ্য।

আমি মহান লুলুর আদেশে জানলার কাছে যাই।

মুহূর্তে দুর্দান্ত লুলু আমাকে পাঁজাকোলে তুলে গরাদহীন জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। আমি বিকট একটা চিৎকার করে চোখ বুজে ফেলি।

কিন্তু পড়লাম না। লুলু আমার একটা হাত ধরে রেখেছে। একমাত্র লুলুর হাতটিই আমার অবলম্বন, পায়ের তলায় পাঁচতলার শূন্যতা। আমি ঊর্ধ্বমুখ হয়ে কাতর স্বরে বলি–হে মহান লুলু, হে দয়ালু লুলু, আমাকে তুলুন।

লুলু আমাকে ধরেই থাকে। ঠিক যেমন দেখেছিলাম ‘টু ক্যাচ এ থিফ’ ছবিতে। ক্যারি গ্র্যান্ট বাড়ির ছাদ থেকে একটা চোর মেয়েকে ঝুলিয়ে রেখে যেভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল, ঠিক সেইভাবেই লুলু বলল –বলো প্রিয় সাংবাদিক, দিল্লির বা রাজ্যের সরকার এখন তোমার জন্য কী করছে! তুমি যদি এখন মরে যাও তাহলে সরকার কতটা ধাক্কা খাবে? কিংবা তুমি মরে গেলে কি না সেই সংবাদ কি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছে কোনওদিন পৌঁছোবে? তুমি যে আছ তাই তাঁরা জানবেন না।

ঝুলতে ঝুলতে আমি লুলুর কথার সত্যতা খানিকটা বুঝতে পারি। বলি–মহান আপনার কথা অতি সত্য।

–মূর্খ সাংবাদিক, সরকার-সরকার বলে দিনরাত তোমরা চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছ কিন্তু কোনওদিন বুঝলে না সরকার নয়, তুমি বেঁচে আছ নিজেরই দায়িত্বে। তুমিই তোমার বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার জন্য দায়ী। তুমি কবে বুঝবে সরকার নয়, তোমার পাশেপাশের সামনের ও পিছনের জনগণই তোমাকে দেখছে, দয়া করছে, ঘৃণা করছে, খুন করছে আবার ভালোও বাসছে। মূর্খ, আমি সেই জনগণের এক প্রতিনিধি হয়ে তোমাকে আজ জিগ্যেস করি, বলল , তুমি এদেশে রাষ্ট্রমুক্ত সমাজের কথা মানে কি না!

আমি নীচের প্রকাণ্ড শূন্যতার দিকে চেয়ে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠি–মানি।

–বলো গণতন্ত্রের জয়।

–গণতন্ত্রের জয়।

–বলো তুমিই সেই জনগণ।

–আমিই সেই জনগণ।

এরপর মহান লুলু আমাকে টেনে তোলে। তারপর ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের অর্থ বুঝতে আমার আর দেরি হয়নি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments