Sunday, August 24, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পকালো মুখ সাদা চামড়া - মানবেন্দ্র পাল

কালো মুখ সাদা চামড়া – মানবেন্দ্র পাল

এখানে এসে পর্যন্ত গত কয়েক দিনের মধ্যে এমন দুটো জিনিস চোখে পড়ল যা খুব আশ্চর্যজনক বা ভয়ঙ্কর কিছু না হলেও অস্বাভাবিক।

যে জায়গাটায় আমরা দুজন রয়েছি সেটা যে নির্জন হবে এটা তো জানা কথাই। কারণ নির্জন জেনেই আমরা এখানে এসেছি।

পাঁচিলঘেরা অল্প খানিকটা জায়গায় দুখানা ঘর। কাঠের গেটের বাইরেই মাঠ। মাঠের দক্ষিণে কিছু গাছ-গাছালি।

বন্ধু বাসুদেবকে একটু চমকে দেবার জন্য বললাম, পরশু দিন বিকেল বেলা একটা বিরাট শেয়াল দেখলাম হে! ধীরে সুস্থে গেল।

শেয়াল!

হ্যাঁ।

কোন দিকে গেল?

উ গাছ-গাছালির দিকে।

কথাটা শুনে বাসুদেব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বললাম, অবাক হচ্ছ কেন?

বাসুদেব বলল, না, এখন তো শেয়াল বড় একটা দেখা যায় না। এখানে হঠাৎ এল কোথা থেকে? তাও আবার বলছ ‘বিরাট’ শেয়াল।

বললাম, শেয়াল এখন দেখা যায় না ঠিক। তা বলে একটিও শেয়াল দেখা যাবে না এমন কথা জোর করে কেউ বলতে পারে না।

বাসুদেব চুপ করে রইল। তারপর যেন গভীর চিন্তা করে বলল, তা হয় তো ঠিক। কিন্তু ঐ যে বলছ ‘বিরাট’ শেয়াল। খটকা ওখানেই।

বললাম, হ্যাঁ, তা বেশ বড়সড়। অত বড় শেয়াল আমি দেখিনি।

বাসুদেব বলল, ওটা শেয়াল বটে তো? ঠিক দেখেছ?

হাজার বার ঠিক দেখেছি। তখন সবে বিকেল। দিব্যি রোদ। কাজেই শেয়াল চিনতে আমার ভুল হয়নি।

বাসুদেব চুপ করে রইল।

সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। তালগাছের মাথার উপর দিয়ে অন্ধকার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। মাঠের ওপর, উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দিলাম।

কী ব্যাপার বলো তো? একটা শেয়াল নিয়ে এত কী গবেষণা করছ?

বাসুদেব চেয়ারে গা ছড়িয়ে বলল, তা গবেষণারই ব্যাপার বটে। দ্যাখো বিকাশ, শেয়ালটার কথা শুনে পর্যন্ত আমার মনে নানা প্রশ্ন উঠছে।

যেমন?

যেমন ধরো, অত বড় শেয়ালের কথা কখনও শুনিনি। দ্বিতীয়ত, শেয়াল সাধারণত সন্ধেবেলায় বেরোয়। আর শেষ প্রশ্ন হচ্ছে–শেয়াল কখনও ধীরে সুস্থে, হেলতে দুলতে যায় না। যায় দৌড়ে।

বললাম, বেশ তাই না হয় হল–তাতে কী? তোমার সন্দেহ হচ্ছে আমি সত্যিই শেয়াল দেখেছি কিনা?

বাসুদেব বলল, প্রথমে সেরকম সন্দেহ হয়নি। তারপর তুমি যখন জোর দিয়ে বললে, ওটা শেয়ালই, অন্য কিছু নয়, তখন মেনে নিলাম ওটা শেয়ালই। কিন্তু শেয়ালটা কোথা থেকে এসে কোথায় গেল তা তো বলতে পারছ না।

বললাম, ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। হঠাৎ দেখলাম একটা শেয়াল যাচ্ছে। সেটা গিয়ে ঢুকল ঐ ঝোপ-জঙ্গলে। ব্যস্। আমার কৌতূহলেরও শেষ।

ঠিক আছে বাবা। এখন বলো তো দ্বিতীয় অস্বাভাবিক জিনিসটা কী?

সেটা শুনে তুমি হাসবে। তবু বলছি গতকাল ঠিক ঐ সময়েই অর্থাৎ নির্জন দুপুরে দেখলাম একটা লোককে

কী হল? থামলে কেন?

ইশারায় চুপ করতে বলে দরজার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে কেউ আসছে।

এই সন্ধেবেলায় অচেনা অজানা জায়গায় কে আবার আসবে?

চাপা গলায় বললাম, চুপ। ঐ যে–এসে গেছে।

কেন যে অমন ভয়ে ভয়ে চুপ করতে বললাম তা নিজেও জানি না। কেউ না কেউ তো আসতেই পারে! তখনই দরজার বাইরে অপরিচিত গলা পাওয়া গেল, এই যে বাবুমশাইরা, খুব ব্যস্ত নাকি?

কে? একটু রাগ-রাগ গলায় জিগ্যেস করল বাসুদেব।

যদি অনুমতি করেন তো ভেতরে ঢুকি।

এবার আমিই তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালাম, অনুগ্রহ করে ভেতরে এসে বসুন।

বাঁ হাতে লণ্ঠন, ডান হাতে মোটা লাঠি, হাঁটু পর্যন্ত ভোলা ধুতি, গায়ে চাদর জড়িয়ে যে লোকটি ঢুকলেন তার বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। গায়ের চাদরটা দিয়ে এমন ভাবে মাথা-মুখ ঢেকে রেখেছেন যেন ভদ্রলোক নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন।

উনি হাসলেন একটু। গোল কালোমুখে সাদা দাঁতগুলো এমনভাবে প্রকট হল যে রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিল। মনে হল, কোনো অশুভ ঘটনার আগাম জানান দিতেই তিনি এসেছেন।

আমার নাম বগলা মজুমদার। এ অধমকে আপনারা চিনবেন না। তবে কাছাকাছি তিন চারটে গ্রামের লোক আমাকে মান্যি করে। যদি জিগ্যেস করেন কী এমন তালেবর মানুষ আপনি যে এত লোকে মান্যি করে, তাহলে তার সঠিক কারণ বলতে পারব না। এইটুকু বলতে পারি আমাদের তিন পুরুষের বাস এই গ্রামে। পাশাপাশি পাঁচখানা গ্রামের জমিদারি স্বত্ব কিনেছিলেন আমার পিতামহ করালিচরণ মজুমদার। দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন মশাই। তার দাপটে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। তারপর ইংরেজ আমলে আমার পিতাঠাকুর নীলকর সাহেবদের যে সাহায্য করেছিলেন তাতে ইংরেজরা খুশি হয়ে–ঐ দেখুন ভাই, আমিই বকে যাচ্ছি। এলাম আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করতে আমার ঠিক করে দেওয়া বাসাটা কেমন লাগছে?

বললাম, ভালোই।

কোনো অসুবিধে নেই তো?

নাঃ, দুজন তো ঝাড়া হাত-পা মানুষ। তা ছাড়া সপ্তাহ দু-একের তো মামলা।

বগলাবাবু সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, তা আপনারা তো কলকাতা থেকেই আসছেন?

বললাম, হ্যাঁ।

বাঃ, খুব ভালো। বসিরহাটের গগন কুণ্ডু যখন এখানে একটা ছোটো বাসা ভাড়ার জন্যে বললে তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। কলকাতা থেকে এখানে কেউ বাসা ভাড়া করে থাকতে আসে নাকি? তাও মাত্র দিন পনেরোর জন্যে। গগনের সঙ্গে একসময়ে বারাসতের ইস্কুলে পড়তাম। ইস্কুল ছাড়ার পরও যোগাযযাগটা আছে। কী করে আছে? আসলে কি জানেন, বাবুমশাই, অন্তরের টান। ইস্কুলে এই যাদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে ওঠাবসা–তাতে কোন স্বার্থের ভেজাল থাকে না। সে সম্পর্কটা একেবারে খাঁটি সোনা। তাই

বুঝলাম বগলাবাবু মানুষটি কথা শুরু করলে থামতে চান না। আর সেইজন্যে বাসুদেবও বেশ রেগে উঠছিল। তাই তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, গগনদা আমাদেরও অনেক দিনের চেনা। ওঁকে যখন কথায় কথায় এখানে ক’দিনের জন্যে বেড়াতে আসার প্ল্যানের কথা বললাম তখন উনিই বোধহয় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করে দিলেন।

এইটুকু বলতেই বগলাবাবু তৎক্ষণাৎ অল্প জলে ল্যাটা মাছ চেপে ধরার মতো আমার ওপর একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, ঠিক ঐ কথাটাই জানার জন্যে আমার আসা। বলে হেঁ হেঁ করে হাসতে লাগলেন।

কোন কথাটা বলুন তো।

ঐ যে বললেন এখানে আসার প্ল্যান। এইরকম গোভাগাড়ে জায়গায় আপনাদের মতো শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন যুবকদের আসার আসল উদ্দেশ্যটা কী?

বগলাবাবুর একথায় বাসুদেব রেগে যাচ্ছিল, তাকে কোনরকমে সামলে-সুমলে হেসে বললাম, এই সামান্য কথাটা জানবার জন্যে রাত্তিরেই চলে এলেন! আশ্চর্য!

বগলাবাবুর মুখটা যেন ঝুলে গেল। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ওটা বন্ধ করে দিলেই তো হয়। বাসুদেব বলল, কেন অসুবিধে কী, বেশ ফুরফুরে হাওয়া আসছে

ফুরফুরে হাওয়া বেরিয়ে যাবে। হঠাৎ যেন ভদ্রলোকটির ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়ল। খেঁকিয়ে উঠলেন, জানেন না তো কোথায় এসেছেন।

অবাক হবার ভান করে বললাম, জায়গাটা খারাপ নাকি?

আমি কিছু বলব না। দুদিন থাকুন। তাহলেই বুঝবেন।

দিনে না এসে সন্ধেরাতে আসার কারণটা বগলাবাবু যেন এড়িয়ে যেতে চাইলেন। উল্টে চাপ দিলেন, এবার বলুন তো হঠাৎ এখানে আসার আসল কারণটা কী? বলে, যেন কিছুই নয় এমনি ভাব করে হাসি-হাসি মুখে আমাদের দিকে তাকালেন।

বললাম, এটা জানা কি আপনার একান্ত দরকার?

বগলাবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, দরকারটা ঠিক আমার একার নয়। এ অঞ্চলে কাছেপিঠে আরও যারা আছে তারাও জানতে চায়। তারাও আপনাদের দেখে অবাক হয়েছে। কৌতূহলী হয়েছে। বুঝতেই পারছেন একসময়ে আমার পূর্বপুরুষেরা জমিদার ছিলেন। প্রজাদের সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ তাদেরই দেখতে হত। এখন জমিদারও নেই, জমিদারিও নেই। তবু তাঁদের বংশধর হিসেবে আমি রয়েছি যখন

হ্যাঁ, তখন সব দায়িত্ব আপনার।

একটু থেমে বাসুদেব বললে, আচ্ছা, আমাদের দেখলে কি হিমালয় আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যিখানের পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি জায়গার মানুষ ছাড়া ভিন্ন গ্রহের কোনো জীব বলে মনে হয়?

বগলাবাবু জিব কেটে বললেন, আরে, নানা। ওসব কিছু নয়। আসলে আপনাদের মতো মানুষজন তো বড় একটা এ পোড়া দেশে পা দেয় না। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আপনারা এখানে এসেছেন। সেই উদ্দেশ্যটা সম্বন্ধে আমাদের যৎকিঞ্চিৎ কৌতূহল আর কি।

উদ্দেশ্য খুব সাদা সরল। আমরা দুই বন্ধুতে পশ্চিম বাংলার ছোটো ছোটো অখ্যাত গ্রামগুলো সমীক্ষা করতে এসেছি।

শুনে বগলাবাবু কয়েক মুহূর্ত আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মুখ টিপে হেসে মাথাটা এদিক থেকে ওদিকে বাড়িয়ে বললেন, উ-হুঁ। ওসব সমীক্ষা-টমীক্ষা করতে এলে খাতা পত্তর, ম্যাপ, স্কেল, কম্পাস থাকে। আমি মুখ হলেও খুব বোকা নই।

মিথ্যে ধরা পড়ার জ্বালায় বাসুদেব একটু তেতে উঠে বলল, এতই যদি বুদ্ধিমান তাহলে আপনিই আন্দাজ করুন কোন মহৎ কার্যসিদ্ধির জন্যে কলকাতা থেকে এতদূরে মাত্র পনেরো দিনের জন্য ঘর ভাড়া করে রয়েছি!

বগলাবাবুর কুচকুচে কালো গোল মুখখানি আলোকিত করে শ্বেতশুভ্র দাঁতের মধ্যে দিয়ে একটুখানি হাসি দেখা দিল। মাথা দুলিয়ে বললেন, তাহলে আমিই বলব?

হ্যাঁ, বলুন।

আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না মহাশয়রা। বলব?

হ্যাঁ, চটপট বলে ফেলুন।

আপনারা পুলিশের লোক।

বটে-বটে-বটে! দারুণ বলেছেন তো! কদিন এখানে রয়েছি কেউ আমাদের চিনতে পারেনি। আর আপনি কিন্তু কী উদ্দেশ্যে পুলিশযুগল এখানে এলেন বলতে পারেন কি? বাসুদেব যেন রুখে উঠল।

নিশ্চয় পারি–নিশ্চয় পারি। আর সে বিষয়ে আপনাদের সাহায্য করতেই আসা।

তা হলে বলুন। আমরা শুনি।

বলছি। তবে আপনাদের আরও আগে আসা উচিত ছিল। কেননা ও তো এরই মধ্যে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। দু-দুটো আদিবাসী, তারপর

এবার আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না। বললাম, কী বলতে চাইছেন একটু স্পষ্ট করে বলুন।

বগলাবাবু বললেন, ঐ দেখুন, আপনারাও আবার লুকোচুরি খেলা শুরু করলেন। আচ্ছা, আপনারা যে ক’দিন এখানে রয়েছেন তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাননি?

অস্বাভাবিক। যেমন–?

যেমন রাত্তির বেলা ঘরের ঠিক বাইরে কারও নিঃশব্দে চলাফেরার শব্দ, কিংবা কোনো অজানা পশুর ডাক–

হঠাৎ বগলাবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, ক’টা বাজল, স্যার?

পৌনে সাতটা।

ওরে বাবা! এবার আমাকে উঠতেই হবে। আমার হয়েছে সব দিক দিয়ে জ্বালা। দিনের বেলা এলে সাহেব ব্যাটা কিংবা ওর শাগরেদ হয়তো দেখে ফেলবে। আর রাত হলে কী একটা জানোয়ারের হাড়-হিম-করা ডাক।

হাড়-হিম করা ডাক! জন্তুটাকে আপনি দেখেছেন?

রক্ষে করুন, মশাইরা। আপনাদের বাবা-মায়ের আশীর্বাদে যেন কোনোদিন তেনার দর্শন পেতে না হয়।

পেলে কী হবে? বাসুদেব জিগ্যেস করল।

কী হবে? ঐ জগা মোড়লের দশা হবে। যে কেসের তদন্ত করতে আপনারা এসেছেন– বেচারি সন্ধেরাতের একটু পরে বাড়ির কাছেই খামার ঘরে কিছু একটা শব্দ শুনে লণ্ঠন হাতে দেখতে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের পথ মশাই, কিন্তু সারা রাত্রেও ফিরল না।..আচ্ছা, চলি।

দাঁড়ান-দাঁড়ান। তারপর তার কী হল বলে যান।

সবই তো জানেন। তবে না জানার ভান করছেন কেন? পরের দিন বাঁওড়ের জলে তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেল।

কে খুন করল তাকে?

সে তো আপনারাই খুঁজে বের করবেন। তবে মানুষ নয়। আমি চলি মশাই।

মানুষ নয়! তবে? আর পাঁচ মিনিট। ঐ যে বাঁওড় না কী বললেন ওটা কী? কোথায়?

বাঁওড় জানেন না? তা জানবেন কী করে? আপনারা যে কলকাত্তাই মানুষ। বাঁওড় হচ্ছে বড় দীঘির মতো। তবে অল্প জল, নোংরা। ছিরিছাঁদ নেই।

বলেই বগলাবাবু লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন।

আর একটা কথা। সাহেব’ না কী বলছিলেন?

ঐ দেখুন, আবার লুকোচুরি! ঐ মুখপোড়া সাহেবটার ওপর লক্ষ রাখার জন্যেই যে এসেছেন তা কি আমি জানিনে? অথচ দেখাচ্ছেন যেন কিচ্ছুটি জানেন না। তবে ওকে ধরতে পারবেন কি? দেখুন চেষ্টা করে।

বলতে বলতে মজুমদার মশাই লণ্ঠন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়েই অন্ধকারে ঝাঁপ দিলেন।

আসবেন আবার।

বগলাবাবু কথা বললেন না। হাতের ইশারায় শুধু জানিয়ে দিলেন আসবেন।

দরজা বন্ধ করে আমরা জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম। মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা আলো দুলতে দুলতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

বড় অদ্ভুত লোক।

বাসুদেব বলল, হ্যাঁ।

.

মুখপোড়া সাহেব

এখানে এসেই একটি কাজের লোক পেয়ে গিয়েছিলাম। বড় গরিব। এ অঞ্চলের মানুষ। তাই মাইনে নিয়ে দরকষাকষি করেনি। দু’ বেলা পেট ভরে খেতে পাবে এতেই খুশি। শুধু বলেছিল, মাত্র পনেরো দিন?

হ্যাঁ, হরিপদ। আমাদের এখানে পনেরো দিনের জন্যেই আসা। তুমি অবশ্য পুরো মাসেরই মাইনে পাবে।

হরিপদর দু’চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। যাক, গোটা এক মাসের জন্যে খাবার ভাবনা তাকে ভাবতে হবে না।

হরিপদর কাজ অল্প সময়ের জন্যে। সকালে এসে জলখাবার করে দিয়ে দুপুরের রান্না সেরে ফেলে। তারপর ও এক মালসা ভাত নিয়ে দু’মাইল দূরে বাড়ি চলে যায়। বিকেলে আসতে চাইছিল না। বলেছিল যে, না হয় টাকা কম দেবেন। কেন আসতে চায়নি তা অবশ্য স্পষ্ট করে বলেনি। আমরাও চাপ দিইনি। শেষ পর্যন্ত রফা হয় তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে চলে যাবে। তাতেও সন্ধে উৎরে যায়।

আজ ঢের আগেই অর্থাৎ বগলাবাবু থাকতেই ও চলে গিয়েছিল। যাবার জন্যে যেন তর সয় না। সোজা কথা নয়, পাক্কা দু’মাইল রাস্তা হাঁটতে হবে মাঠ, পুকুর পার হয়ে।

খাওয়া-দাওয়া করে মশারি টাঙিয়ে ভালো করে চারিদিক গুঁজে, মাথার কাছে দুজনে দুটো জোরালো টর্চ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই ঘুম এল না।

লোকটা যেন কীরকম কীরকম।

কার কথা বলছ? বগলাবাবুর?

বললাম, ঠিক তাই। কী মতলবে এসেছিলেন তা বোঝা গেল না।

বাসুদেব মশা মারতে গিয়ে নিজের গালেই একটা চড় মেরে বলল, কিন্তু ভয়টা যে কীসের সেটাই বুঝলাম না। উনি তো দিনের বেলায় এদিকে আসতে ভয় পান পাছে কোন এক মুখপোড়া সাহেব দেখে ফেলে। আর, একটু রাত হলে কোন এক অজানা পশুর ভয়ঙ্কর নাকটা যেনয়ে শুয়ে পর ভালো করে চতে হবে ডাক!

তার ওপর আবার জগা মোড়লের ক্ষতবিক্ষত দেহ!

হ্যাঁ, আরও আছে। জিগ্যেস করেছিলেন, আমরা এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছি কিনা বা বাড়ির ঠিক বাইরে কারও পায়ের শব্দ ইত্যাদি শুনেছি কিনা।

বললাম, ভদ্রলোক সম্ভবত অলৌকিক কিছু ব্যাপার দাঁড় করাতে চাইছেন।

বাসুদেব চুপ করে রইল। তারপর বলল, আচ্ছা, তুমি বলছিলে দুটো অস্বাভাবিক জিনিস দেখেছিলে। তার মধ্যে একটা অতিকায় শেয়াল। অন্যটা এখনও বলনি।

বললাম, হ্যাঁ, সেটা একটা লোক।

লোক!

কীরকম?

বললাম, দু’ তিন দিন আগে। বেলা তখন আড়াইটে। দুপুরে ঘুমোবার অভ্যেস নেই। তাই ওদিকের রকে চেয়ারে বসে নিস্তব্ধ পল্লী-প্রকৃতি উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা মোটাসোটা লোক। খুব ফর্সা রঙ। সে যে কোথা থেকে এল বুঝতে পারলাম না। মাঠটার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গুটিগুটি।

গুটিগুটি হাঁটছিল কেন?

তা কী করে বলব ভাই! কোমরে ব্যথাট্যথা হলে ওরকম হাঁটে। কিন্তু কেন যে বারে বারে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের বাড়িটা লক্ষ করছিল তা বুঝতে পারছিলাম না। তা ঘাড় ঘোরানোটাও অস্বাভাবিক। কোনো মানুষ তার ঘাড়টা এত দূর পর্যন্ত ঘোরাতে পারে না।

আচ্ছা! বাসুদেব অবাক হল। তারপর? কোন দিকে গেল?

বললাম, ঐ জঙ্গলের মধ্যে। যেখানে শেয়ালটা ঢুকে গিয়েছিল।

বাসুদেব একটু ভেবে বলল, লোকটার অতখানি ঘাড় ঘোরানোটা সত্যি একটু অস্বাভাবিক।

না বন্ধু, আরও আশ্চর্যের ব্যাপার আছে। লোকটার পরনে একটা আন্ডারপ্যান্ট ছাড়া গায়ে আর কিছু ছিল না। একদম খালি গা। গায়ে অস্বাভাবিক লোম। অথচ ধবধবে ফর্সা রঙ। ঘাড় পর্যন্ত কঁকড়া কটা চুল। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে ওর মুখটা। যতবার এদিকে ঘাড় ফিরিয়েছে ততবারই দেখেছি মুখটা কালো। যেন পুড়ে গিয়েছে। অমন ফর্সা মানুষটার এমন পোড়া মুখ!

হঠাৎ বাসুদেব উৎসাহে উত্তেজনায় উঠে বসল বিকাশ–বিকাশ, বুঝতে পেরেছ কি?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম, কী?

বগলা মজুমদার খুব মিথ্যে বলেননি। তাঁর সেই মুখপোড়া সাহেবকেই তোমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বললাম, তা হলে তো লোকটার ওপর নজর রাখতে হবে।

বাসুদেব বলল, কিন্তু লোকটাকে পাবে কোথায়? মাত্র তো কয়েক মিনিটের জন্যে দেখতে পেয়েছিলে। কোথা থেকে বা কোন দিক থেকে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। আর এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ভয় পাওয়ার ঘটনা ঘটেনি যার জন্যে আমাদের নড়েচড়ে বসতে হবে।

বললাম, তা ঠিকই, বগলাবাবুর মুখ থেকেই যেটুকু শোনা। আর ওঁর কথা সত্য হলে আশা করা যায় খুব শিগগির কিছু একটা ঘটবে।

একটু থেমে বললাম, মনে হচ্ছে বেলেঘাটার তিনু ঘোষ যা বলেছিল তার কিছুটা সত্য।

বাসুদেব বলল, তিনু ঘোষের কথা কতটা সত্য তা যাচাই করার জন্যেই তো আমাদের এখানে আসা। শতকরা পঞ্চাশভাগ সত্য হলেও আমাদের অর্থব্যয়, আমাদের পরিশ্রম সার্থক মনে করব।

আমি হেসে ফেললাম।

হাসছ যে?

বগলাবাবু বেশ বলেছেন আমরা ছদ্মবেশী পুলিশ!

বাসুদেবও হেসে বললে, হাঁ, পুলিশ হলে আগে পাকড়াও করতাম বগলাকেই। লোকটাকে বোঝা গেল না। ঠিক কী উদ্দেশ্যে ভয়ে ভয়ে এখানে এসেছিলেন। শুধু কি কতকগুলো ভয়ের কথা শোনাতে?

বললাম, না। আরও কিছু ছিল। ওঁর ধারণা ঐ সাহেবটাই এখানে অশান্তি সৃষ্টি করছে। কিছু একটা ঘটাতে চাচ্ছে। অথচ তাকে নাকি ধরা কঠিন।

তাহলে জন্তুর ডাকটা কী?

সে ডাক শোনার সৌভাগ্য এখনও আমাদের হয়নি। কে জানে জগা মণ্ডলকে হয়তো সেই জন্তুটাই খতম করেছিল।

আমি একটু থমকে গেলাম। মনে পড়ল বেলেঘাটার তিনু ঘোষও সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবার আগে সন্ধ্যার পর একটা জন্তুর ডাক শুনেছিলেন। তবে সেটা অনেকটা শেয়ালের ডাকের মতো।

বাসুদেব হালকা সুরে বলল, বগলাবাবু মনে করেন পুলিশের ছদ্মবেশে আমরা কলকাতা থেকে এখানে এসেছি ঐ পোড়ারমুখো সাহেবটার ওপর নজর রাখতে। ওকে ধরে জেলে পুরতে পারলেই এখানকার অশান্তির শেষ হবে। বাসুদেব মস্ত বড় হাই তুলে বলল, যাই হোক, লোকটা আমার কাছে রহস্যময় হয়ে উঠেছেন। কোথা থেকে এসেছেন, কত দূরে বাড়ি, কী করেন, কিছুই জানা গেল না। এতই যদি ভয় তাহলে সন্ধের পর একা একা এলেন কেন? কথা বলতে বলতে উঠে পালালেনই বা কেন?

হঠাৎ বাসুদেব চুপ করে গেল। কেমন যেন সতর্ক হল।

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, আমার মুখ চাপা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, চুপ! কিছু শুনতে পেলে?

কই না তো।

ভালো করে কান পেতে থাকো।

এতক্ষণ বেশ হালকাভাবে কথা হচ্ছিল, এখন হঠাৎ এ আবার কী? নিশ্চয় বাসুদেবের কিছু ভুল হচ্ছে। তবু কান পেতে রইলাম।

এখানে কোনদিন এত রাত পর্যন্ত জাগা হয়নি। কাজ তো নেই, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি। তাই গভীর রাতে জায়গাটার চেহারা কীরকম হয় আজ পর্যন্ত তা দেখা হয়নি। দুজনে পাশাপাশি উৎকর্ণ হয়ে শুয়ে আছি কোনো কিছু শোনার প্রতীক্ষায়। চৌকি থেকে হাত দশেক দূরে খোলা জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের মাঠটা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। এটা শুক্লপক্ষ কি কৃষ্ণপক্ষ জানি না। মুমূর্ষ মানুষের ফিকে হাসির মতো ম্লান চাঁদের আলো এসে পড়েছে মাঠের ওপর। কেমন যেন রহস্যঘন ছায়া-ছায়া ভাব। দিকভ্রম হয়ে যায়। কোন দিকে সেই অতিকায় শেয়ালটা বা রহস্যময় সাহেবটা ঘাড় ঘোরাতে ঘোরাতে গিয়েছিল, বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে এই মুহূর্তে তা মালুম হচ্ছে না।

কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি নিস্তব্ধ নিশুতি রাতেরও নাকি ভাষা আছে। এটা যে কতখানি সত্য তার প্রমাণ আজ পেলাম। দূরে বনঝোপে একটানা ঝিঁঝি ডেকেই চলেছে। কোথা থেকে মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে শোঁ শোঁ শব্দ। অনেকটা ঝাউবনে বাতাস খেলা করার মতো। এ ছাড়া দূরে বাঁওড়ের ধারের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে ভয়-পাওয়া কুকুরের ডাক। আচ্ছা, কুকুর তো গৃহপালিত পশু। রাস্তাতেও দেখা যায়। তা বনে-জঙ্গলে? কী জানি।

এইসব ভাবছিলাম হঠাৎ বাসুদেব আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। চাপা গলায় বলল, ঐ শোনো।

শুনলাম।

তেমন কিছু নয়। শুধু বাড়ির ওদিকের বাইরের দেওয়াল ঘেঁষে একটা চাপা শব্দ– খস্ স্ খস্….

কেউ যেন ভারী ভারী পা দুটো ঘাসটাতে ঘাসটাতে খুব সাবধানে বাড়ির চারিদিকে ঘোরবার চেষ্টা করছে।

কে? আমাকেও চমকে দিয়ে বাসুদেব চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা থেমে গেল। একটু পরে মনে হল যে এসেছিল সে যেন দ্রুত চলে গেল।

শিগগির টর্চটা বলেই টর্চ নিয়ে বাসুদেব দরজার খিল খুলতে যাচ্ছিল, আমি আটকে দিলাম।

অজানা অচেনা জায়গায় দুঃসাহস দেখিয়ে লাভ নেই। কেউ যে এসেছিল এটা যেমন সত্যি তেমনি সত্যি সে আর যাই হোক সামান্য চোর-ডাকাত নয়। কারণ, কোনো মানুষের পায়ের শব্দ অমন হতে পারে না।

বাসুদেব সুবোধ বালকের মতো না বেরিয়ে বিছানায় এসে বসল। বসেই রইল থমথমে মুখে।

কী ভাবছ?

ভাবছি ব্যাপারটা কী ঘটল। কেউ যে বাড়ির কাছে ঘুরছিল তা তুমিও বুঝতে পেরেছ, আমিও। আর সে যে চোর-ডাকাত নয় তাও বোঝা গেছে। আরও প্রমাণিত হল বগলা মজুমদারও এই কথাটা বলেছিলেন। মনে আছে তো?

খুব আছে।

তাহলে কে এই গভীর রাতে এখানে বেড়াতে এসেছিল? কেনই বা এসেছিল?

পরিবেশটা হাল্কা করার জন্যে হেসে বললাম, দ্যাখো, হয়তো ঘাড়-বাঁকানো সাহেবই আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিল।

বাসুদেব একরকম ধমক দিয়ে বলল, তুমি হাসছ? দ্যাখো, কলকাতায় তিনু ঘোষ যা বলেছিল তা তেমন বিশ্বাস করিনি। ওর কথায় কৌতূহলী হয়ে নিছক বেড়াতে এসেছিলাম। তারপর আবির্ভাব হল বগলা মজুমদারের। তিনি যে কী বলতে এসেছিলেন বোঝা যায়নি। শুধু খানিকটা ভয় দেখিয়ে গেলেন। আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আজ রাত্তিরে যা শোনা গেল সেটা তো ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মতো উড়িয়ে দিতে পারছি না। পারছ কি?

মাথা নেড়ে বললাম, না।

এটাই এখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আচ্ছা, পায়ের শব্দ শুনে আগন্তুকটির উচ্চতা, ওজন আন্দাজ করতে পার?

বললাম, না ভাই, অত এক্সপার্ট নই। তবে একথা বলতে পারি সাধারণ মানুষের চেয়ে ঢের ভারী চেহারা।

যেমন শেয়ালটাকে দেখেছিলে। তাই তো?

হ্যাঁ, তাই।

বাসুদেব বলল, আর দেরি নয়। কাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে।

কিন্তু এ তো গোয়েন্দাগিরি নয় যে, হত্যার সূত্র ধরে হত্যাকারীকে খুঁজবে। কীসের ওপর নির্ভর করে কাজ শুরু করবে?

বাসুদেব আমার পিঠ চাপড়ে বলল, রাত্তিরে যিনি এখানে হানা দিয়েছিলেন, যে কোন কারণেই হোক, তিনি আমাদের টার্গেট করেছেন। অতএব চিন্তা নেই, তিনি আবার আসবেন। অল্প সূত্র রেখে যাবেন। অতএব এসো বন্ধু, বাকি রাতটুকু নিশ্চিন্তে গড়িয়ে নিই।

.

পায়ের ছাপ নেই, হাতের কারসাজি

ভেবেছিলাম এরপর বাকি রাতটুকু একটা লম্বা ঘুম দিয়ে কাটিয়ে দেব। একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোব। কিন্তু তা হল না। ঘুম ভাঙল অন্য দিনের মতোই ভোরবেলা।

ঘুম ভাঙ্গল, কিন্তু তখনই উঠতে পারলাম না। বড্ড দুর্বল লাগল। প্রথমে মনে হয়েছিল দেরিতে শোওয়ার জন্যেই বোধহয় ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু বোঝা গেল তা নয়। মাথাটা অসম্ভব ভার হয়ে আছে। সেই সঙ্গে বুকে কেমন চাপ ধরছে। মনে হল, বাড়িটা আর আশেপাশের বাতাস যেন খুব ভারী হয়ে উঠেছে। অথচ অন্য দিন তো এমন হয় না। তাহলে?

বাসু!

বিছানায় বাসুদেবকে দেখতে না পেয়ে ডাকলাম। সাড়া নেই। আবার ডাকলাম। সাড়া নেই। আবার ডাকলাম। এবারও সাড়া নেই। গেল কোথায়?

শরীরের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে গেলাম। না, সেখানেও নেই।

আশ্চর্য! গেল কোথায়? অন্য দিন তো এত সকালে ওঠে না। ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

বাসু!

দূর থেকে সাড়া পেলাম, এই যে এখানে। চলে এসো।

যাক, বাসুর তাহলে কিছু হয়নি। ইট বের করা সরু পথ ধরে ওদিকের ঝোপের দিকে গেলাম। দেখি বাসুদেব মাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে খুব মন দিয়ে কিছু পরীক্ষা করছে।

এখানে কী করছ?

কাল রাত্তিরে যিনি এখানে পায়চারি করেছিলেন তিনি কোনো চিহ্ন রেখে গেছেন কিনা দেখছি।

তাই বলে এই সক্কালবেলায়?

দেরি করলে তো চিহ্ন হারিয়ে যেতে পারে।

কিছু পেলে?

বাসুদেব মাথা নেড়ে বলল, নাঃ।

অথচ কেউ এসেছিলই, অনেকক্ষণ ছিলও। আর তার শ্রীচরণে কোনো ‘শু’ ছিল না।

তাই তো ভাবছি। শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছি যিনি এসেছিলেন তার নিশ্চয় কোনো পা ছিল না। অথচ

অথচ কী?

হাত ছিল। আর সেই হাত দিয়ে কয়েকটি প্রাণীর জীবন সংহার করেছিলেন।

চমকে উঠলাম। মানে?

ঐ ঝোপের মধ্যে দেখো।

দেখলাম। কতগুলো গলা-ছেঁড়া বাদুড় পড়ে আছে।

আরে সর্বনাশ! তাহলে রাতের আগন্তুকটি তো রীতিমতো হিংস্র জন্তু।

বাসুদেব গম্ভীরভাবে বলল, জন্তু কিনা বলতে পারি না। তবে আগন্তুকটি হিংস্র।

বললাম, তাহলে তো বগলা মজুমদারের আরও একটা কথা সত্য বলে মনে হচ্ছে।

বাসুদেব বলল, তুমি কি জগা মোড়লের কথা ভেবে বলছ?

হ্যাঁ। বাড়ির কাছে পাঁচ মিনিটের পথ খামারবাড়ি। রাত আটটার সময়ে কোনো শব্দ শুনে দেখতে গেল। আর ফিরল না। পরের দিন তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল বাঁওড়ের জলে। বগলা যদি গুল মেরে না থাকেন তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কে মারল তাকে?

বাসুদেব শান্ত গলায় বলল, বগলা মজুমদার সম্বন্ধে আমাদের আগে যাই ধারণা থাক, এখন দেখা যাচ্ছে তিনি বাজে কথা বলেননি। কিন্তু আমি অন্য কথা ভাবছি।

কী?

ধরেই নিলাম বগলা যা বলেছিল, ব্যাপারটা তাই-ই। প্রশ্ন এই, যে শব্দটা শুনে জগা মোড়ল রাত্তির বেলাতেই খামারবাড়ি ছুটেছিল সে শব্দটা কেমন? নিশ্চয়ই পা ঘষটানোর শব্দ নয়। তার চেয়ে জোরে কোনো শব্দ যা বাড়ি থেকে শোনা গিয়েছিল।

বললাম, তা তো বটেই।

শব্দটা কীসের? সে কথাটাই আমায় ভাবিয়ে তুলেছে।

বললাম, অত ভাবাভাবিতে কাজ কী? বগলাবাবু তো আবার আসবেন বলে গেছেন।

বাসুদেব হতাশার হাসি হেসে বলল, তুমি কি সেই আশায় বসে থাকবে?

বললাম, আসবেন না কেন?

আসবেন না এমন কথা বলছি না। তবে অতখানি পথ হেঁটে, বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কেন বারবার আসবেন বলো তো?

বললাম, তা বটে। তাহলে?

ওঁর কাছেই আমাদের যেতে হবে।

কিন্তু–ঠিকানা?

বাসুদেব একটু হাসল। বলল, জানই তো মজুমদার মশাইরা এককালের ডাকসাইটে জমিদার পরিবার। আর এই জায়গাটা মুঠোর মধ্যে ধরা যায়। কাজেই তার ঠিকানা খুঁজতে খুব অসুবিধে হবে না।

.

তিনু ঘোষের কথা

বেলেঘাটার তিনু ঘোষ যদিও একজন মামলাবাজ লোক তবু তাকে আমার ভালো লাগত। আমার দাদামশায় নামজাদা উকিল ছিলেন। তিনু ঘোষ ছিলেন আমার দাদুর বাঁধা মক্কেল। বিরাট সম্পত্তি তাঁর। শরিকও অনেক। ফলে মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকত। তবে ঘোষ মশাই-এর অঢেল টাকা। মোটা ফি দিয়ে দাদুকে কেস দিতে তার অসুবিধে ছিল না।

তিনু ঘোষ রোগা হলে কি হবে যেটা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করত সেটা তার বিরাট একজোড়া গোঁফ। কোনো মানুষের অতবড় গোঁফ থাকে তা ভাবতে পারতাম না। তিনি চিরুনি দিয়ে গোঁফ আঁচড়াতেন দিনে চার-পাঁচ বার। তাই আলাদা একটা চিরুনি ঘুরত পকেটে পকেটে। মোমও দিতেন। তিনি জোরে হাসতেন না। হাসতেন নিঃশব্দে। হাসলে তার চোখ দুটো কুঁচকে যেত।

তিনু ঘোষ দাদুর চেম্বারে এসেছেন জানতে পারলেই আমি দোতলা থেকে নেমে আসতাম। আমায় দেখলেই তিনি চোখ ছোটো করে গোঁফের ফাঁকে হাসতেন। আমার লক্ষ ছিল তার পাকানো গোঁফ জোড়াটার দিকে। একবার হাত দিতে চাইতাম। উনি মুখটা বাড়িয়ে দিতেন। আমি ঠিক গুনে দুবার তার গোঁফে হাত বোলাতাম।

দাদু বলতেন, তিনু ঘোষ নাকি অনেক ভূতের গল্প জানেন। কয়েকবার নিজেই ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন।

এ খবর জানার পরই একদিন তাকে চেপে ধরলাম, একটা সত্যি ভূতের গল্প বলতেই হবে।

উনি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, সত্যি ভূতের গল্প কীরকম?

বলেছিলাম, মানে আপনি নিজের চোখে যা দেখেছেন সেই রকম।

অ, আচ্ছা। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়েছিলেন। তারপর শুরু করেছিলেন তাঁর নিজের চোখে দেখা সত্যিকারের ভূতের গল্প।

বলেছিলেন, ভূত অনেকবার দেখেছি। মোকাবিলাও করেছি। কিন্তু এখন যার কথা বলব তাকে ভূত হিসাবে দেখেছি একটি বারই। তাও অনেক পরে। প্রথম তাকে দেখেছিলাম মানুষ হিসাবেই।

অবাক হয়েছিলাম। একই মানুষ আবার পরে সেই মানুষকেই ভূত হিসাবে দেখা। এমন তো বড় একটা ঘটে না।

নড়েচড়ে বসে বলেছিলাম, কাকু, বেশ জাঁকিয়ে ঘটনাটা বলুন না।

এরপর তিনি যা বললেন, তা এইরকম–

তখন ইংরেজ আমল। ইংরেজদের দাপট খুব। তারা আবার নেটিভদের অর্থাৎ কালা আদমি ভারতীয়দের সহ্য করতে পারত না। এক সাহেব ট্রেনে করে মুঙ্গের থেকে কলকাতা আসছিল। সঙ্গে একটা বিরাট কুকুর গ্ৰেহাউন্ড গোছের। সাহেব আর ওর কুকুর দুজনেরই চোখে হিংস্র দৃষ্টি।

সে সময়ে ট্রেনে চারটে ক্লাস ছিল। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস, আর থার্ড ক্লাস।

ফার্স্ট ক্লাসে যেত সাহেবসুবোরা, সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী ছিল মোটামুটি বড় অফিসাররা, ইন্টার ক্লাসে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা। রুগি নিয়ে যাবার দরকার হলে এই ইন্টার ক্লাসটাই সুবিধের ছিল। আর থার্ড ক্লাস ছিল সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের জন্য। ইন্টার ক্লাসের ভাড়া থার্ড ক্লাসের দেড়গুণ। তাই ইন্টার ক্লাসকে চলতি ভাষায় বলা ‘দেড়া গাড়ি। সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া ছিল থার্ড ক্লাসের ডবল, ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া থার্ড ক্লাসের চারগুণ। তখন ট্রেনে এত ভিড় হত না। এখনকার মতো তখন থার্ড ক্লাসে ফ্যান ছিল না। ফ্যান থাকত শুধু ফার্স্ট আর সেকেন্ড ক্লাসে। আপাদমস্তক পুরু গদি আঁটা সেকেন্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস। সাধারণ প্যাসেঞ্জার ঐ সব কমপার্টমেন্টে ওঠা তো দূরের কথা, ফুটবোর্ডে পা রাখতেও সাহস পেত না। প্ল্যাটফর্ম থেকেই কোনোরকমে ভেতরের গদি, ফ্যানগুলো দেখত।

এছাড়া সাহেবদের সঙ্গে অন্তত একজন ‘অ্যাটেনডেন্ট’ বা সাহায্যকারী থাকত ফাইফরমাশ খাটার জন্যে। তারা তো আর সাহেবের সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাসে বা সেকেন্ড ক্লাসে যেতে পারে না। তাই ওদের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের লাগোয়া একটা সাধারণ কামরা থাকত। সেটা শুধু সাহেবদের সার্ভেন্টদের জন্যে। সেখানেও অন্য প্যাসেঞ্জাররা ঢুকতে পারত না।

তখন গার্ডও ছিল ফর্সা চামড়ার। ড্রাইভারদের মধ্যেও অনেক অ্যাংলোকে দেখা যেত। তারা ইংরিজিতেই কথা বলত। কখনও কখনও হিন্দিতে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেত কিন্তু বাংলা বলতে পারত না।

এই ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের মুষ্টিমেয় প্যাসেঞ্জারদের অহংকারের সীমা ছিল না। তারা বাঙালিদের সহ্য করতে পারত না। একবার এক নিতান্তই মধ্যবিত্ত বাঙালি তাড়াতাড়িতে ভুল করে ফার্স্ট ক্লাসে উঠতে যাচ্ছিল, ফার্স্ট ক্লাসের সাহেব প্যাসেঞ্জারটি তাকে লাথি মেরে নামিয়ে দিয়েছিল।

লাথি হজম করে মাথা নিচু করে বাঙালিটি অন্য গাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। তখন সাহেবের বিরুদ্ধে নালিশ করার কোনো উপায় ছিল না। কে শুনবে নালিশ? ড্রাইভার, গার্ড, স্টেশন মাস্টার প্রায় সবাই তো ফর্সা চামড়ার সাহেব।

এইরকম সময়েই ঘটনাটা ঘটেছিল।

গাড়িতে সে সময়ে কুকুর বা হিংস্র কোনো পশু নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। অনেক লেখালেখি করে বিশেষ অনুমতি নিতে হত। যে সাহেবের কথা বলা হচ্ছে সে ওসব অনুমতি-টনুমতির ধার ধারত না। চিতাবাঘের মতো বিরাট কালো ছুঁচলে মুখ কুকুরটা তার নিত্যসঙ্গী। তার ঐ কুকুরটাকে দূর থেকে দেখলেই লোকে পালাত।

দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটা প্রথমে ঘটল আসানসোল স্টেশনে।

একজন মাড়োয়ারী সাহেবের কামরায় ঢুকতেই সাহেব তেড়ে গিয়েছিল।

-Get out!

মাড়োয়ারী ভয়ে কথা বলতে পারেনি। তবে টিকিটটা দেখিয়ে বলেছিল, Sir, here is my first class ticket. তাতে সাহেবের মাথা আরও গরম হয়ে গেল। শিস দিয়ে তার কুকুরটাকে লেলিয়ে দিল। কুকুরটা মূর্তিমান বিভীষিকার মতো গোঁ গোঁ শব্দ করে তেড়ে গেল। নির্দোষ প্যাসেঞ্জারটি ভয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে গেল।

এবারে ঘটনা ঘটল বর্ধমানে। যে বাঙালি ভদ্রলোক ভুল করে সাহেবের কামরায় উঠেছিলেন, তাঁকে দেখেই সাহেব তার নিত্যসঙ্গী জ্বলন্ত চুরুটটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে দাঁত কড়মড় করে হাঁকড়ে উঠেছিল, ‘You bloody get out! This is first class.’

এই বাঙালি ভদ্রলোকটি ইংরিজিতেই উত্তর দিলেন, সাহেব আমি জানি এটা ফার্স্ট ক্লাস। ভুল করে উঠেছিলাম। এখনি নেমে যাচ্ছি। তবে আবার আসব।

বলেই প্ল্যাটফর্মে নেমে গেলেন। একজন চেকারকে ডেকে তার সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটটা বদলে ফার্স্ট ক্লাসের করে নিলেন। তারপর সদর্পে ঢুকলেন সাহেবেরই ফার্স্ট ক্লাস কামরায়। দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সাহেব। হ্যাঁন্ডেল ঘুরিয়ে জোরে লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললেন বাঙালি ভদ্রলোকটি।

সাহেব গদিতে হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে চুরুট টানছিল। বাঙালিবাবুকে ফের ঢুকতে দেখে আবার তেড়ে এল, Get out-Get out! I say get out!

বাঙালি ভদ্রলোক নেমে তো গেলেনই না। ফার্স্ট ক্লাস টিকিটটা বের করে সাহেবের নাকের ডগায় ধরলেন

সাহেব বলল, শোনো বাবু, ভালো কথায় বলছি অন্য গাড়িতে যাও। আরও ফার্স্ট ক্লাস কামরা আছে।

বাঙালিবাবু বললেন, কেন যাব? এ কামরা কি তোমার রিজার্ভ করা?

কোনো কালা আদমি মুখের ওপর কথা বলে সাহেবরা তা সহ্য করতে পারত না। মুখ লাল করে বলল, হ্যাঁ, রিজার্ভ করা। তুমি যাও।

এও এক নাছোড়বান্দা বাঙালি। সাহেব-টাহেব কেয়ার করে না। বললেন, দেখি তোমার টিকিটে কেমন রিজার্ভেশন আছে।

সাহেব আর সহ্য করতে পারল না। বাঙালিবাবুকে লক্ষ করে ঘুষি মারতে লাগল। বাবুটির ব্যায়াম করা শরীর। খপ করে সাহেবের হাতটা ধরে ফেললেন। তারপর দাঁতে দাঁত টিপে বললেন, সাহেব, বিনা দোষে আমার গায়ে হাত তুলে ভালো করলে না। আমি দুর্বল নই।

সাহেব এবার বাবুটির নাক লক্ষ করে ঘুষি মারতে গেল। বাবুটি মাথা সরিয়ে নিয়ে জুজুৎসুর কায়দায় সাহেবের ঘাড়ে এমন রদ্দা মারলেন যে সাহেবের ঘাড় বেঁকে গেল। সাহেব আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভুভক্ত কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঙালিবাবুর দিকে। বাবু চট করে সরে গিয়ে কুকুরটার পেটে পেল্লায় একটা লাথি মারলেন। খোলা দরজা দিয়ে কুকুরটা ছিটকে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে সঙ্গে সাহেব পকেট থেকে রিভলবার বের করল।

বিপদ বুঝে নিরস্ত্র বাঙালিবাবুটি স্টেশনে লাফিয়ে পড়লেন। বাঁকা ঘাড়ের যন্ত্রণায় গোঁ গোঁ করতে করতে সাহেবও রিভলবার হাতে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে তাড়া করে গেল।

প্ল্যাটফর্মে হৈচৈ চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। গোলমাল শুনে পাশের ছোটো কম্পার্টমেন্ট থেকে সাহেবের অ্যাটেনডেন্টটি ভোজালি হাতে বেরিয়ে এল। লোকটা নিগ্রো। বেঁটেখাটো কুচকুচে কালো রঙ। মাথায় ছোটো ছোটো কেঁকড়ানো ঘন চুল। কুকুতে দুটো চোখ। যেন সাক্ষাৎ যমদূত। সেও বাঙালিবাবুটিকে তাড়া করল।

সাহেব গার্ড বুদ্ধিমান। সে ক্ষ্যাপা সাহেবকে চিনত। বিপদ বুঝে চেঁচিয়ে উঠল, মিস্টার জন, ডোন্ট ফায়ার!

কিন্তু কে কার কথা শোনে। জন যন্ত্রণায় ঘাড়টা বেঁকিয়ে গুলি ছুড়ল বাঙালিবাবুকে লক্ষ করে। এবার আর বাবুটি নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। গুলিটি পাঁজর ঘেঁষে হাতের খানিকটা মাংস খাবলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রক্তাক্ত দেহে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন বাবুটি।

এদিকে রক্ত দেখে খুন চেপে গেল পাবলিকের। একজন নিরস্ত্র নির্দোষ মানুষকে চোখের সামনে গুলি করল একটা হিংস্র সাহেব! লোকে লাঠি, ডান্ডা যা হাতের কাছে পেল তাই নিয়ে তাড়া করল সাহেব আর তার সঙ্গী নিগ্রোটাকে। কুকরটা ইটের ঘায়ে আগেই মরেছে। সাহেব আর নিগ্রো ছুটছে তো ছুটছেই। পিছনে উন্মত্ত জনতা। সাহেব জানে না কোথায় যাচ্ছে। গলিখুঁজি, পুকুরপাড় দিয়ে সে ক্রমশ স্টেশন থেকে দূরে শহরের বাইরে এসে পড়ল। নিগ্রোটাও…

এই পর্যন্ত বলে তিনু ঘোষ থেমে গিয়েছিলেন।

তারপর? জিগ্যেস করেছিলাম।

তিনু ঘোষ বলেছিলেন, এই পর্যন্তই জানি। ঘটনার সময় আমি স্টেশনেই ছিলাম। ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। নিতান্তই অল্পবয়সি ছেলে তখন। মারামারি খুনোখুনি দেখে হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল।

বললাম, কিন্তু আপনি যে বললেন, সত্যি করে ভূত দেখেছিলেন একবারই। তাও অনেক পরে। অর্থাৎ আপনার জীবনের পরের দিকে।

তিনু ঘোষ একটু চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ, তা বটে। আচ্ছা বলছি।

তিনু ঘোষ ফতুয়ার পকেট থেকে মোষের শিল্পে ডিবে বের করে তা থেকে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাকে খুঁজলেন। তারপর রুমাল দিয়ে সাধের গোঁফ জোড়াটা মুছে নিলেন। কী বলছিলাম যেন–হ্যাঁ, জমিজমা আমার প্রাণ। সারা জীবন এইসব জমি রক্ষা করার জন্য আমরা মামলা করেছি। বাড়িঘরও করেছি। আমার জন্ম, ক্রিয়াকলাপ সব বর্ধমান জেলায়। ইদানিং ইচ্ছে করত বেলেঘাটায় যেমন, বাড়িঘর আছে থাক। গ্রামের দিকে ফাঁকা জায়গায়। একটা সাদামাটা বাড়ি কিনব। যেখানে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচব। নিশ্চিন্তে ভগবানের নাম করতে পারব।

গ্রামে বাড়ি কেনার সঙ্গে সঙ্গে একটা গাড়ি কেনারও স্বপ্ন দেখলাম। গাড়ি থাকলে যখন তখন হুস্ করে গ্রামে যাওয়া যাবে।

কিন্তু এই বয়সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়ি খোঁজা, দরদাম করা পোষাবে না। তাই ইচ্ছেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ সেদিন কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম বর্ধমান থেকে অল্প দূরে কুচুট নামে একটা গ্রামে ফাঁকা জায়গার ওপর একটা দোতলা বাড়ি বিক্রি হবে।

কী নাম বললেন জায়গাটার? কুচুট?

হ্যাঁ। শুনতে খারাপ লাগছে তো ভায়া? কিন্তু খুব প্রাচীন গ্রাম। পুরনো মন্দির-টন্দির আছে। বর্ধমান থেকে কালনা পর্যন্ত যে বাসরাস্তাটা গেছে তারই ধারে গ্রামটা। আমি তখনই ঠিক করে ফেললাম যদি পছন্দ হয় আর দামে পোষায় তাহলে কিনে ফেলব।

তারপরই চাপা গলায় তিনু ঘোষ বললেন, আরও একটু ভেবে রেখেছিলাম কিনে ফেলতে পারলে লোকসান নেই। ভালো না লাগলে এক বছর দু’বছর পর বেশি দামে বেচে দেব। দিন দিন জায়গার দাম, বাড়ির দাম তো বেড়েই চলেছে। আখেরে আমারই লাভ।

আমি চুপ করে রইলাম। জমির দাম বাড়লে কার কতটা লাভ তা জানবার আগ্রহ মোটেই আমার ছিল না। আমি তো অন্য জিনিস জানতে এসেছি।

তারপর?

তিনু ঘোষ বললেন, বাড়িটা দেখলাম। দোতলা বাড়ি অনেকটা জায়গার ওপর। তবু রক্ষে বাড়িটা পুরনো হলেও ততটা জীর্ণ নয়। ছাদের পাঁচিলে ছোট ছোট গুল্ম লতা জন্মালেও অশথ বা বট গাছের শেকড় দেওয়াল ফুঁড়ে বের হয়নি। নীচে তিনটে ঘর। সবগুলোই অন্ধকার। দুটো ঘরের দরজায় তালা লাগানো। একটার দুটো কড়ায় দড়ি বাঁধা। তালাগুলো যে অনেকদিন খোলা হয়নি তা মরচে পড়া দেখলেই অনুমান করা যায়। একটা ঘরের পিছনে একটা ছোটোখাটো সিমেন্টের পাঁচিল তোলা, অনেকটা যুদ্ধের সময় বাফার ওয়ালের মতো।

এটা কী? বাড়ির মালিককে জিগ্যেস করলাম।

বললেন, ঠিকই ধরেছেন। বাফার ওয়াল করা হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে যাতে জাপানিরা বোমা ফেললে বোমার টুকরোয় ঘরের কোনো ক্ষতি না হয়।

জিগ্যেস করলাম, তা হঠাৎ এই বাড়িটার গায়ে বাফার ওয়াল কেন? তাছাড়াও তো দেখছি ট্রেঞ্চ কাটার মতো এখনও লম্বা গর্ত কাটা আছে।

বাড়িওলা বললে, হা, ওটা ট্রেঞ্চই। আসলে সে সময়ে কলকাতা এবং চারপাশে বম্বিং এর ভয় থাকায় অনেক জায়গায় মিলিটারি রাখা হত। মিত্রপক্ষের মধ্যে আমেরিকান সোলজাররাই বেশি এসব জায়গায় থাকত। এ বাড়িটা ছিল ওদের? এ অঞ্চলের এক নম্বর শেলটার।

ও! তাহলে এ বাড়িতে সৈন্যরাও ছিল।

আজ্ঞে হ্যাঁ। চলুন এবারে দোতলাটা দেখবেন।

দোতলায় আলো বাতাস বেশ ভালোই। ওপরেও নিখানি ঘর। বাড়ির মালিক ঘরগুলো খুলে খুলে দেখালেন। পশ্চিম দিকের ঘরটা অপেক্ষাকৃত ছোটো। ভেতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ নাকে এল। বাড়ির মালিক মন্মথবাবু একটি কথাও না বলে তাড়াতাড়ি জানলাগুলো খুলে দিলেন।

নাকে রুমাল চেপে বললাম, কিছু পচেছে। মন্মথবাবু সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, হতে পারে।

কিন্তু কী পচতে পারে, কেন পচতে পারে সে বিষয়ে কোনো কথাই বললেন না।

আমি পিছনের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এ দিকটাও ফাঁকা। জিগ্যেস করে জানলাম এখান থেকে আধ মাইলটাক দূরে একটা বাঁওড় আছে। বাঁওড় কাকে বলে জিগ্যেস করলে বললেন, ও নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাড়িটা কিনবেন কিনা বলুন।

বাবাঃ খুব ঘ্যাম!

সামান্য একটি কথার মানে জানতে চাওয়ায় এত বিরক্তি কেন বুঝলাম না! শুধু এইটুকু বুঝলাম কোনোরকমে বাড়িটা বেচে দিয়ে কিছু টাকা হাতাবার জন্যেই উনি ব্যস্ত।

আমি তবু জানলায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাড়িটার লাগোয়া যে বিরাট জমি সেটা তার দিয়ে ঘেরা। তারের বেড়ার শেষে পাথরের একটা ভাঙা ফলক দেখে জিগ্যেস করলাম, ওটা কী?

কোন্টা? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন মন্মথ কুণ্ডু।

বললাম, ঐ যে ভাঙা পাথরের ফলক? মনে হচ্ছে, এখানে এক সময় খ্রিস্টানদের বেরিয়াল গ্রাউন্ড-ট্রাউন্ড কিছু ছিল।

তিনি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন, তা হতে পারে। পুরনো জায়গা তো! নিন, নীচে চলুন।

বুঝলাম, বড্ড তাড়া!

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনের ভাব বোধহয় তিনি বুঝে নিতে পেরেছিলেন। একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আপনাকে আবার কলকাতায় ফিরতে হবে তো। সেইজন্যেই তাড়া দিচ্ছি। নইলে আমার কী? থাকুন না। যে সম্পত্তি কিনবেন সেটা ভালো করে দেখে শুনে নিন।

কথাটা লুফে নিয়ে তৎক্ষণাৎ বললাম, সেই ভালো। এখনই তো বেলা পড়ে এসেছে। রাতটা থেকেই যাই।

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের মুখটা এমন কালো হয়ে গেল যে আমার বুঝতে বাকি রইল না, আমার রাত্রিবাস করাটা উনি চাইছেন না। কিন্তু কেন?

আমতা আমতা করে উনি বললেন, আপনি থাকলে সে তো আমার অনেক সৌভাগ্য। কিন্তু মুশকিল হয়েছে আমার বাড়িতে আজ আত্মীয় স্বজন এসে পড়ছে। ছোটো বাড়ি তো

বললাম, ওর জন্যে ভাববেন না, আমি এই বাড়িতেই থাকব।

এই বাড়িতে!

বললাম, হ্যাঁ। দোতলার ঘরগুলো তো দেখলাম ভালো অবস্থাতেই আছে।

উনি বললেন, তবু–অনেকদিন এ বাড়িতে কেউ শোয়নি। একটু ঝটপাট দেওয়া ধোওয়া-মোছা!

বললাম, এক রাত্তিরের তত মামলা। একটা মাদুর, একটা বালিশ, সম্ভব হলে একটা মশারি আর এক ঘটি জলের যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন তাহলেই যথেষ্ট হবে।

দেখি। বলে আমাকে এ বাড়িতে একা বসিয়ে রেখেই উনি যেন চিন্তিতভাবে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

উনি তো চলে গেলেন। আমি একা চুপচাপ বসে রইলাম বাড়ির নীচে একটা ভাঙা বেদির ওপর। সত্যি কথা বলতে কি এই সময়টা আমার বেশ ভয় ভয় করছিল। বুঝলে, বিকাশ বাবা।

জিগ্যেস করলাম, কীসের ভয়?

তা ঠিক বোঝাতে পারব না। খোলামেলা জায়গার মধ্যে একটা শূন্য বাড়ি। যে বাড়িতে বহুদিন কেউ বাস করেনি। কেন করেনি কে জানে! ওদিকে মাঠের প্রান্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পাখিগুলো বাসায় ফিরছে। ফিরছে যেন খুব তাড়াতাড়ি। বোধহয় এখনি অন্ধকার নেমে আসবে বলে। আজ এই মুহূর্তে প্রথম বুঝলাম অন্ধকারকে শুধু মানুষই নয়, ঐ উড়ন্ত পাখিগুলোও ভয় পায়। তাই তারা অন্ধকার নামার আগেই নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছতে চায়। অন্ধকার নামবার আগে এই নির্জন অজানা জায়গা ছেড়ে আমারও কলকাতায় ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কেন যে দুঃসাহস দেখিয়ে বসলাম কে জানে!

জিগ্যেস করলাম, আর কোনো কারণে আপনার ভয় হচ্ছিল?

তিনু ঘোষ আর একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আরও দুটো কারণে। প্রথম বেরিয়াল গ্রাউন্ডের পোঁতা ভাঙা সেই পাথরের ফলকটা আর দোতলার ছোটো ঘরটায় যে পচা গন্ধ পেয়েছিলাম সেটা। মরা কোনো কিছু এমনকি বেড়াল বা ইঁদুর বা টিকটিকি পর্যন্ত ছিল না। তাহলে কীসের ঐ উৎকট গন্ধ? জানো ভায়া, বাড়ির মালিক পর্যন্ত কোনো কথা বললেন না। এই প্রশ্ন দুটোই তখন মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। মনে হচ্ছিল আজ রাত্রে এই বাড়িতে কিছু ঘটবেই–আর তা মোটেই শুভ নয়। অথচ কিছুতেই গিয়ে বাড়ির মালিককে বলতে পারলাম না–আমি থাকব না। বধৰ্মান যাবার লাস্ট বাস এখনও পাওয়া যাবে। কোনোরকমে বর্ধমান যেতে পারলে হাওড়া যাবার ট্রেনের অভাব হবে না।

অগত্যা থাকতে হবেই বলে মনকে প্রস্তুত করে নিলাম।

তার পরের ঘটনা তিনু ঘোষ যা বলেছিলেন তা এইরকম–

সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই মন্মথ কুণ্ডু আর তার বাড়ির কাজের লোকটি এসে মাদুর, বালিশ, মশারি, দড়ি, একটা কুঁজো-ভর্তি জল আর একটা গেলাস রেখে দিয়ে গেল। ওরা যখন চলে যাচ্ছিল তখন বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হল, একটু আলোর ব্যবস্থা তাহলে

বিলক্ষণ! এই যে তারও ব্যবস্থা করেছি। বলে মন্মথবাবু একটি মাত্র সরু মোমবাতি ব্যাগ থেকে বের করে রাখলেন।

দেশলাই আছে তো?

মাথা নেড়ে না জানাতে উনি যে কীরকম অপ্রসন্ন হলেন তা ওঁর গলার স্বরেই বুঝলাম। বললেন, সঙ্গে একটা দেশলাইও রাখেন না? কতই বা দাম! বলে পকেট থেকে নিজের দেশলাইটা বের করে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

হায়রে আমার কপাল! বুঝলে ভায়া, লোকের পকেটে পকেটে দেশলাই না থাকলে মনে করে নিতে হবে পয়সার অভাবেই দেশলাই রাখেনি। এই নইলে বাড়ির মালিক!

যাক গে, এবার আসল কথায় আসি। সরু অল্পপ্রাণ মোমবাতিটা জ্বেলে প্রথমে মাদুর আর চাদর বিছিয়ে বিছানা পেতে নিলাম। তারপর মশারিটা কোনোরকমে টাঙালাম। তারপর একটা তোবড়ানো টিনের গামলায় যে খাবার আনা হয়েছিল তা খেয়ে নিলাম। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া আমার অভ্যেস নয় কিন্তু বসে বসে মশার কামড় খেয়ে লাভ নেই। তাই ডান হাতের ব্যাপারটা সেরে নিয়ে দরজায় ভালো করে খিল এঁটে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লাম।

ভাগ্যি বুদ্ধি করে টর্চটা এনেছিলাম। ওটা রাখলাম বালিশের পাশে যাতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।

শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছিল না। মোমবাতিটা অর্ধেক জ্বলার পর নিভিয়ে রেখেছিলাম যদি গভীর রাতে দরকার হয়।

নানারকম চিন্তা করতে করতে কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ দূরে শেয়ালের ডাক শুনে ঘুমটা ছুটে গেল। শহরে এখন শেয়াল দেখা যায় না, কতকাল শহরের লোক যে শেয়ালের ডাক শোনেনি তা ঠিক নেই। তবে আমি ছোটোবেলায় শুনেছি। এমন কিছু ভয়ঙ্কর ডাক নয়। আর শেয়াল একটা ডেকে উঠলেই একপাল শেয়াল একসঙ্গে ডাকা শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণ ডেকেই থেমে যায়। তারপর আবার তিন ঘণ্টা পরে পরে ডাকে।

এই পর্যন্ত বলে তিনু কাকা আমাকে বললেন, জান তো বাছা, সমস্ত দিনরাত্তির ১/৮ সময়কে যাম বা প্রহর বলে। এক প্রহর বা যাম হচ্ছে তিন ঘণ্টা। তিন ঘণ্টা অন্তর এক এক প্রহর বা যাম। এক-এক প্রহরে শেয়াল ডেকে যাম ঘোষণা করে। সেইজন্যে শেয়ালের একটা নাম যামঘোষক।

তিনু কাকা আবার একটু থেমে বললেন, কিন্তু সেদিন রাত্রে যে শেয়ালের ডাক শুনলাম তা একটু অন্যরকমের। যেন হাঁড়ির মধ্যে থেকে শেয়ালটা ডাকছিল। এমনি বিকট শব্দ! আমি অবাক হলাম। এ আবার কোন দেশি শেয়াল! আর শেয়াল তো কখনও একা ডাকে না?

মরুক গে! বলে আমি আবার চোখ বুজলাম।

তারপর হঠাৎই ঘুমের ঘোরে মনে হল কারও পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কেউ যেন পা ঘেঁষটে ঘেঁষটে হাঁটছে। আমি কান পেতে রইলাম। মনে হল শব্দটা আসছে নীচে থেকে। তার পরেই মনে হল বাড়ির পিছনে দেওয়াল ঘেঁষে আস্তে আস্তে হাঁটছে। এই নির্জন জায়গায় গভীর রাত্রে কে অমন করে হাঁটবে! কী চায়? ও কি চোর? এ বাড়িতে বহুদিন পর আমার অস্তিত্ব দেখে এখানে চুরি করতে এসেছে?

আমি কান পেতে রইলাম। শব্দটা আস্তে আস্তে কোথায় যেন চলে গেল।

যাক, যে এসেছিল সে চলে গেছে। কিন্তু কেনই বা এত রাত্রে এসেছিল, কেনই বা। দরজা খোলবার চেষ্টা মাত্র না করে চলে গেল?

তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সমস্ত ঘরে চুরুটের গন্ধ। আমি চমকে উঠলাম। এত রাত্রে কে এসে চুরুট খাচ্ছে! আর যে খাচ্ছে সে যে খুব কাছেই আছে বুঝতে অসুবিধে হল না। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘরের মধ্যেই কেমন একটা চাপা শব্দ!

এইবার আমি খুব সাহসের কাজ করে ফেললাম। কী করে করতে পারলাম তা ভাবতে গেলে আজও অবাক হয়ে যাই। আমি মশারি থেকে বেরিয়ে মোমবাতিটা জ্বালোম। অন্ধকার ঘরে হঠাৎ মড়ার হাসির মতো মোমবাতিটা যেন ঘোলাটে হাসি হেসে উঠল। দেখলাম জানলার গরাদ দিয়ে একটা বিকট হাত দেওয়াল দিয়ে উঠে আসছে….মুখটা দেখে চমকে উঠলাম। ছোটোবেলায় দেখা ট্রেনের সেই খুনি সাহেবটা না…..তখনই নীচে থেকে ভেসে এল চাপা গর্জন। না কোনো ভুল নেই….

আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। তারপর….

তারপর আর কিছু মনে নেই।

.

এই হল তিনু ঘোষের বৃত্তান্ত। ঘটনাটা বলে উনি হাঁপাতে লাগলেন। বয়েস হয়েছে

বললাম, কাকাবাবু, তারপর বাড়িটা কী করলেন?

কলকাতায় ফিরে এসেই লিখে দিলাম, নানা কারণে এখনই বাড়িটা কেনা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

তারপরেও আমি অনেকক্ষণ তিনু কাকার সামনে চুপ করে বসে ছিলাম দেখে তিনু কাকা বললেন, কী ভাবছ?

আমি চুপ করে রইলাম। উনি হেসে বললেন, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না তো? এক কাজ করো, ঠিকানা দিচ্ছি। ওখানে একদিন চলে যাও। বাড়িটা যদি এখনও থাকে কিছু দেখতে পাবেই। তবে হয়তো গেলেই পাবে না। ওঁদের দেখা সহজে মেলে না। কয়েক দিন থাকতে হবে।

বললাম, যাব বলছেন?

হ্যাঁ, তোমরা আজকালকার ছেলে। নিজের চোখে না দেখলে অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে পার না। কাজেই অবশ্য অবশ্য যাবে। তবে একা নয়। আর গোঁয়ার্তুমি করবে না।

বলেই ঘোষমশাই এক টিপ নস্যি নিলেন।

.

‘দেবতার রোষ’

ঠিক হয়েছিল সেদিনই দুপুরে দু’মুঠো ভাত খেয়েই দুজনে বগলা মজুমদারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ব। দেরি করা চলবে না। কারণ গত রাত্রে যে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটে গেল আর আজ সকালে বাড়ির পিছনের ঝোপ থেকে যে মড়া বাদুড়গুলো পাওয়া গেল তা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। সত্যিই ভাবনার কারণ। কেননা বেশ কিছুকাল আগে বেলেঘাটার তিনু ঘোষ যা বলেছিলেন তা বিনা প্রতিবাদে শুনে গেলেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। আর আমার মুখ থেকে সব শুনে বাসুদেবও প্রায় হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর এখানে হঠাৎ বগলাবাবুর আবির্ভাব। তিনি তো প্রায় হুবহু তিনু ঘোষের কথাই শুনিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে শোনালেন মাঝে মাঝে সন্ধের পর কোনো হিংস্র জন্তুর অদ্ভুত ডাকের কথা। আর সেই ভয়েই এককালের প্রবল প্রতাপ জমিদারবংশের উত্তরাধিকারীটি আটটা বাজতেই ভয় পেয়ে বাড়ির পথে দৌড়লেন। এই অদ্ভুত ডাকটি কীরকম বা জগা মণ্ডল যে শব্দ শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খামারবাড়িতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল সেই শব্দটা কীরকম সে কথা বগলাবাবুকে জিগ্যেস করবার সেদিন আর সুযোগ পাওয়া যায়নি।

এসব অলৌকিক অবাস্তব ব্যাপার-স্যাপার আমরা মন-প্রাণ দিয়ে মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু গত রাত থেকে ভাবনায় পড়তে হয়েছে। এ ভাবনার সুরাহা করতে পারেন একমাত্র ঐ প্রৌঢ় বগলা মজুমদারই। তাই আবার তেমন ঘটনা ঘটার আগেই বগলাবাবুর পরামর্শ নেওয়া উচিত। কাজেই উনি কবে আসবেন না আসবেন তার জন্য অপেক্ষা না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদেরই যাওয়া উচিত।

মনের সঙ্গে এইরকম বোঝাপড়া করে আমরা যখন বনঝোপ থেকে বাড়ি এলাম বেলা তা বে আটটা।

বাড়ি ঢুকেই দেখা গেল হরিপদ ঠাকুর রান্নাঘরের বাইরে গামছা কাঁধে রকে বসে আছে গুম হয়ে। এমনটা সে করে না। এসেই চা জলখাবার করতে লেগে পড়ে। তাই অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম–কী ব্যাপার, হরিপদ? সক্কালবেলায় অমন হাঁড়িমুখ কেন?

হরিপদ দুহাতে মুখ ঢেকে বলল, আর আমার এখানে কাজ করা হবে না, বাবু।

কেন?

হরিপদ প্রায় ডুকরে কেঁদে বলল, আপনাদের ওপর ‘দেবতার রোষ’।

দোর রোষ! কোন দেবতা?

হরিপদ দু’হাত তুলে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল, তিনি হাওয়ায় ভেসে বেড়ান। শুনতে

কালো মুখ সাদা চামড়া পাই এই গেরামেই নাকি তেনার অধিষ্ঠান। কখন কার ওপর তেনার রোষ পড়বে কেউ জানে না। রোষ পড়লেই তার সব্বনাশ। মাঝে-মাঝেই তো দু-একজন যাচ্ছে। নইলে জগা মোড়লের মতো সোমত্ত জোয়ান বাড়ি থেকে বেরোল আর ফিরল না!

চা, জলখাবারের কথা ভুলে বাসুদেব একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়ল।

তুমি জগা মোড়লকে চিনতে?

চিনতাম বৈকি বাবু। তাগড়াই জোয়ান ছিল। একবার জ্যাষ্ট মাসে মোষের গাড়ির একটা মোষ গরমে হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে রাস্তা থেকে নেমে পুকুরের দিকে ছুটছিল। গাড়ি লাট খায় আর কি। জগা ফিরছিল হাট থেকে। ছুটে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে দুহাত দিয়ে শিঙ চেপে ধরেছিল মোযটার। বারকতক মাথা আঁকাবার পর ঠান্ডা মেরে গিয়েছিল মোষটা। অথচ সেই ছেলেটাই–এই পর্যন্ত বলে থামল হরিপদ।

হরিপদ বলতে লাগল, এখানে রাতের বেলায় এক-একদিন একটা শব্দ ওঠে। যেন দেৰ্তা আড়াল থেকে গজরাচ্ছেন। তারপরেই তিনি নেমে আসেন মাটিতে। সঙ্গে থাকে একটা শাগরেদ। যার সব্বনাশ করবেন তার বাড়ি নিশানা করে ঘুরবেন চারিদিকে। তারপর ঘরে ঢুকে

বাধা দিয়ে বললাম, তা জগার কী হয়েছিল বলো।

জগার মরণ-পাখা গজিয়েছিল। সে বলত ঐ শব্দটা ঠিক কীসের খুঁজে বের করবই। শব্দ উঠলেই ও দলবল নিয়ে মশাল জ্বালিয়ে হৈচৈ করে ছুটত। কখনও বড় বড় হাউই ছুড়ত আকাশের দিকে। বোকা গোঁয়ার ছোঁড়াটা ভাবত অশরীরী কেউ বাতাসে ভেসে থাকলে হাউই-এর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু কপাল মন্দ। তাই নিজেই মরল।

ব্যাপারটা কী হয়েছিল?

শুনলাম, সেদিন সারা দিনভর খাটাখাটনি করে সন্ধে রাতে ঘরে এসে শুয়েছিল। হঠাৎ কাছেই কোথাও যেন একটা কুকুর ডেকে উঠল। কুকুর তো কতই ডাকে বাবু। কিন্তু এ ডাক আলাদা। মেঘ ডাকার মতো গর্জন।

বাড়ির কাছে ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে বসেছিল ছোঁড়াটা। দলবল কেউ ছিল না। দেওয়ালের কোণ থেকে সড়কিটা নিয়ে লণ্ঠন হাতে ছুটল খামারবাড়ির দিকে।

ব্যস্, সেই যে গেল আর জীবন্ত ফিরল না। পরের দিন লাশ পাওয়া গেল বাঁওড়ের জলে।

এই বলে হরিপদ মাথাটা হেলিয়ে দিল দেওয়ালে।

কীভাবে মরেছিল জিগ্যেস করলাম।

কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না হরিপদ। তারপর দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, আজ্ঞে ঘাড়টা মুচড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল।

ওকে কে মারল ধারণা করতে পার? বাসুদেব জিগ্যেস করল।

হরিপদ ফের হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে শুধু বলল, দেবতার রোষ বাবু!

তোমাদের এই দেবতার উৎপাত এখানে কতদিন ধরে চলছে?

হরিপদ শিউরে উঠে জিব কাটল। বলল, ‘উৎপাত’ বলবেন না, বাবু। একেই তো আপনাদের ওপর রোষ বর্তেছে–বলুন দেবতার মর্জি।

যাই হোক, এটা চলছে কতদিন?

হরিপদ বলল, খুব বেশিদিন নয়। বাবা বলতেন, এমন চুপচাপ জায়গা এ অঞ্চলে আর ছিল না। কোনো হাঙ্গামা হুজ্জোৎ এখানে হত না। তারপর হঠাৎই একদিন দেবতার আবির্ভাব জানান দিয়ে গেল–পর পর তিনদিন বাজ পড়ল বাবু এক নাগাড়ে। তিন তিনটে বিরাট দেবদারু গাছ যা প্রহরীর মতো আমাদের গেরামকে রক্ষে করত–ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে! উঃ সে কী শব্দ!

তারপর?

তারপর থেকেই মাঝে মাঝে অনেক রাতে কুকুরের ডাক। প্রথমে কুকুরের কান্না। তারপর বুক-কাঁপানো গর্জন। তারপরেই রাত পোয়ালে দেখা যেত কোনো না কোনো প্রাণী মরে পড়ে আছে রাস্তায়।

প্রাণী? মানুষ নয়? জিগ্যেস করল বাসুদেব।

কত আর মানুষ খাবেন দো? গ্রাম তো উজাড় হয়ে যাবে। মানুষজন তো ভয়ে কাটা। জগা গেল, আরও দুজন আদিবাসী গেল। বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে নাকি একজন এসেছিলেন একটা বাড়ি কিনতে। এক রাত্তির থেকেই পালালেন প্রাণ হাতে করে। এই তো অবস্থা।

এ কি, উঠছ কোথায়?

আপনাদের চা-জলখাবারটা করে দিই।

সে হবেখন। আগে বলো আমাদের ওপর দোর রোষ কেন? কী করে বুঝলে?

বলব। আপনাদের ভালোর জন্যেই বলব। তার আগে চা-টা করে দিই।

বেশ, চায়ের জল চড়াতে চড়াতেই বলো বাঁওড়ের জলে যে জগার দেহ পাওয়া গিয়েছিল তার কারণ কী? বাঁওড়টা কোথায়? জগা মশাল হাতে দলবল নিয়ে ছুটত কোন্ দিকে? বাঁওড়ের দিকেই কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবু। বাঁওড় হচ্ছে মজে যাওয়া খাল বা জলা। ওর জল পচা। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিকে। বহুকালের পুরনো। ওখানেই শ্মশান, ওখানেই ভাগাড়। আবার ওখানেই যত ভয়। খুব দরকার না পড়লে ওদিকে কেউ যায় না।

কবরখানা নেই? জিগ্যেস করলাম।

হরিপদ বললে, আছে বইকি। ঐ বাঁওড়ের ধারেই। কোনো মড়া জ্বলে চিতার আগুনে। কোনো মড়া যায় মাটির নীচে। দুটোরই ব্যবস্থা পাশাপাশি। বিশেষ ভেদ নেই। বলেই হরিপদ চায়ের জল চড়িয়ে দিল।

চা-জলখাবার খাবার পর হরিপদ তার গতকাল রাত্রে অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল।

আপনারা বোধহয় নজর করেছিলেন কাল ঘড়িতে আটটা বাজার আগেই আমি তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলাম। কেন গিয়েছিলাম।

বাধা দিয়ে বললাম, না হরিপদ, আমরা কেউই নজর করিনি। কোনোদিনই দেখি না কখন চলে গেলে। আমরা জানি তুমি আমাদের রাতের খাবার বানিয়ে দিয়েই চলে যাও। তাছাড়া তুমি একটু তাড়াতাড়ি যাবে তা তো বলাই ছিল।

হরিপদ কৃতজ্ঞ হয়ে বলল, তা তো জানি। তবু কাল হঠাৎ এভাবে কেন গেলাম সেটা আপনাদের জানানো দরকার। বলছি শুনুন।

আমি রান্না করছিলাম, এই সময়ে দেখি লোকটি বাইরের ঘরে এসে ঢুকল। আপনারা কথা বলতে লাগলেন। রান্নাঘরের দক্ষিণ দিকের জানলাটা ভোলা ছিল-রোজই থাকে। বাইরে থেকে সাপখোপ যাতে ঢুকতে না পারে তাই জাল দেওয়া। এমনিই তাকালাম। বাইরে জমাট অন্ধকার। মনে হল অন্ধকারটা যেন বড্ড বেশি চাপচাপ। কেমন ভয় করল। মনে হল যেন কোনো বিপদ ঘটবে। হঠাৎ দূরে জঙ্গলের মধ্যে একফালি চোখ-ঝলসানি আলো জ্বলে উঠল। ঠিক যেমন হয় বিদ্যুৎ চমকালে। কিন্তু বিদ্যুৎ তো চমকাবে আকাশে। এটা অনেক নীচে জঙ্গলের মধ্যে।

কীসের আলো? ভাবতে ভাবতেই আলোটা আর দেখা গেল না। তারপরেই দূরে কোথায় যেন একটা কুকুর কেঁদে উঠল। একবারই। আমি বাবু, রীতিমতো ভয় পেলাম। বুঝলাম এর পরই সেই ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা যাবে। আর–বাবু, কুকুরের সেই হাঁকড়ানির পরেই দেবতার চলাফেরা শুরু হবে। মাঠ পার হয়ে বাড়ি পৌঁছোব কী করে ভেবে তখনই রামনাম করতে করতে বেরিয়ে গেলাম।

বাসুদেব জিগ্যেস করল, ডাকটা কি একটা কুকুরেরই?

তাই তো মনে হয়।

কুকুরটা দেখেছ কখনও?

না বাবু। কুকরটার ডাক এখানে অনেকেই শুনেছে। কিন্তু কেউ দেখেনি। ও দেখার জিনিস নয়।

কোন দিক থেকে শব্দটা আসে? জিগ্যেস করলাম।

বুঝতে পারা যায় না। কখনও মনে হয় পুব দিক থেকে, কখনও মনে হয় পশ্চিম দিক থেকে, কখনও উত্তর–এসব দোর মর্জি বাবু!

ঠিক আছে। তারপর?

তারপর হরিপদ যা বলল তা এইরকম–

আমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে হরিপদ চোখ-কান বুজে হাঁটতে লাগল মাঠের ওপর দিয়ে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। মনে হচ্ছিল চোখের সামনে যেন এক একটা অন্ধকারের পাঁচিল। এখুনি ধাক্কা লাগবে। নিতান্ত চেনা পথ বলে এগিয়ে যেতে পারছিল।

অল্প দূর যাবার পর চোখে পড়ল একটা ঘোলাটে আলো দুলতে দুলতে পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে ঠাওর করে দেখল একটা লোক আমাদের বাসার দিক থেকে এসে ‘ মাঠের ওপর দিয়ে খুব জোরে হেঁটে যাচ্ছে। তার হাতে একটা লণ্ঠন।

এই নির্জন মাঠে–যেখানে চারিদিক নিঝুম–গলা টিপে মেরে ফেললেও কেউ টের পাবে না।ভয়ে যখন কাঁটা তখন ঠাকুরের কৃপায় একজন মানুষকে দেখতে পেয়ে হরিপদ ভরসা পেল। সে ডেকে উঠল–একটু দাঁড়ান মশাই। আমিও যাব ঐ দিকে।….

কিন্তু হরিপদর ডাক শুনে উল্টো ফল হল। লণ্ঠন হাতে লোকটি যেন ভয় পেয়ে আরও জোরে হাঁটতে লাগল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল বাবু। আলোটাও আর দেখা গেল না। তাজ্জব ব্যাপার!

সঙ্গে সঙ্গেই হরিপদর আবার ভয় পেতে লাগল। নিজেকে কেমন অসহায় মনে হতে লাগল। পা দুটো কাঁপতে লাগল।

আর তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারল পিছনে কেউ একজন আসছে। নির্জন মাঠে সঙ্গী পাওয়া যাবে মনে করে হরিপদ পেছন দিকে তাকাল। কিন্তু

কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। শুধু একটা ঠান্ডা বাতাস মাঠের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।

মনের জোরে প্রাণপণে হাঁটতে লাগল হরিপদ। কিন্তু একী! এতক্ষণ হেঁটেও নিজের বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না কেন? সে কি পথ ভুল করল?

হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আবার তার পিছু নিয়েছে। সে এগিয়ে আসছে….ক্রমেই এগিয়ে আসছে। পাওয়া যাচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দ। সে নিঃশ্বাস না কি মানুষের নয়…..।

কথা শেষ করে হরিপদ হাঁপাতে লাগল।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সহানুভূতি জানিয়ে বাসুদেব বলল, খুবই বিপদে পড়েছিলে দেখছি। কিন্তু আমাদের ওপরই দের রোষ বুঝলে কী করে?

হরিপদ হাতের কাছের ঘটি থেকে খানিকটা জল খেয়ে গামছায় মুখটা মুছে নিয়ে বলল, এ কি আর বোঝার অসুবিধে হয়, বাবু? আপনারা তো ক’দিন হল এসেছেন। তার আগে যদিও বেশ কয়টা অঘটন ঘটে গেছে তবু আপনারা আসার পর থেকে এই প্রথম আপনাদের বাসা থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ভয় পেলাম। রান্নাঘরে বসে অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝিলিক দেখলাম। সত্যি বিদ্যুৎ হলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এ তো-ধরুন না কেন–বিদ্যুৎ কি মাত্র একবার চমকায়? খামোকা কুকুর অমন করে কেঁদে উঠবে কেন? তাও একবার। এ যেন শুধু আমাকে ভয় দেখাবার জন্য। অথচ আমি গরিব নিরীহ মানুষ। কোনো সাতে পাঁচে নেই। তাছাড়া–তাছাড়া দেখুন, ঐ যে লোকটি আপনাদের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে কথা বলছিলেন তিনিও তো একটু পরেই ভয় পেয়েই চলে গেলেন তাড়াতাড়ি। তা হলে আপনাদের এই বাসায় এমন কিছু ব্যাপার আছে যার জন্যে ‘দেবতা’ কুপিত!!

নিতান্ত মজা করেই বাসুদেব হরিপদকে সমর্থন করতে গিয়ে গত রাত্রের কথা বলতে যাচ্ছিল, আমি ইশারায় থামিয়ে দিলাম। সে কথা শুনলে হরিপদ আর কখনও আমাদের বাসামুখো হবে না।

জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা হরিপদ, তোমার তো বেশ বয়েস হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে। এখানেই তো আছ বরাবর?

হ্যাঁ বাবু। এখানেই জন্ম, এখানেই বড় হওয়া, এখানেই মরার ইচ্ছে।

তা এখন এই যে সব উৎপাত দেখছ–

হরিপদ জিব কেটে, দু’হাতে কান চাপা দিয়ে বলল, ‘উৎপাত’ বলবেন না! যা কিছু হচ্ছে তা তো দেবতার লীলা।

বললাম, আচ্ছা, তাই না হয় হল। তা এরকম লীলা এখানে ছোটোবেলায় দেখেছ?

আজ্ঞে না। কিন্তু পরে ক্রমশ নানা কথা ছড়াতে লাগল। তারপরেই দেৰ্তাদের লীলা শুরু হল। তারপর যখন আদিবাসীদের দুজন হঠাৎ মুখ দিয়ে রক্ত তুলে মল আর এই সেদিন জগা মণ্ডলের লাশ পাওয়া গেল বাঁওড়ের জলে, তখন থেকেই শুরু হল বুকের কাঁপুনি। আর এখন তো মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোনো ক্ষতি হবে আমাদের।

বাসুদেব বললে, হরিপদ, তুমি একটু আগেই বললে নানা কথা ছড়াতে লাগল’–তা সেই নানা কথাগুলো কী? দু একটা বলো না।

এ কথায় হরিপদর মুখটা শুকিয়ে গেল। বোঝা গেল তার বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু যে ইচ্ছে করছিল না তা নয়, ভয়ও করছিল।

কেন ভয় সেটাই জানতে চাই আমরা।

আমরা আবার বলতে বললাম। ও হাত জোড় করে বলল, ও সব কথা থাক না, বাবু। দেখছি তো দেদের নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করতে গিয়েছে–এমনকি কেন, কী বিত্তান্ত জানতে চেষ্টা করেছে হয় তারা মরেছে নয় প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে।

বুঝলাম এখানেই কোথাও বাড়ি কিনতে এসে এক রাত্তির কাটাতে গিয়ে বেলেঘাটার তিন ঘোষও ভয় পেয়ে পালিয়েছিলেন।

আসলে লোকটা ছিল তো সাহেবের জাত। আবার বলতে শুরু করল হরিপদ। সাদা চামড়া, আর অনেক টাকার মালিক বলে অন্য মানুষকে ঘেন্না করত। আর তারই ফলে প্রাণ হারাল কোথাও নয় এই গ্রামের পথে।

এইটুকু শুনেই আমরা দুজনে কান খাড়া করে রইলাম।–এই সাহেবের কথা আমরা জেনেছিলাম তিনু ঘোষের মুখে। কিন্তু পাবলিকের তাড়া খেয়ে বর্ধমান স্টেশন থেকে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তার কী দশা হল তা জানা যায়নি। কারণ, তিনু ঘোষ নিজেও তা সঠিক জানতেন না। এখন সেই অজানা তথ্য জানাচ্ছে আমাদের রাঁধুনি হরিপদ। এটা ভাবাই যায়নি।

তারপর? লোকটা তাহলে সাহেব ছিল?

হ্যাঁ বাবু, তবে তার একটা চাকর ছিল। সে আরও হিংস্র। আর ছিল সাহেবের পোষা কুকুর। এই তিনজনে একসঙ্গেই চলাফেরা করত বলে শুনেছি। সাহেবের কোনো বিপদ হলে তার চাকর আর ঐ কুকুরটা এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত তাদের প্রভুকে বাঁচাতে।

কিন্তু এবার সাহেবকে বাঁচাতে পারা গেল না, কী বলে?

কী করে যাবে! মারমুখি কাতারে কাতারে লোক। কুকুরও মল, চাকরটাও মল-সাহেবটাও।

কোথায় মানে কোন জায়গাটায় মরল সাহেবটা?

তা বলতে পারি না। তবে সাহেবের মড়া বলে বিভ্রাট হয়েছিল বলে শুনেছি। প্রথমে ওর চাকরটার সঙ্গে চিতায় তোলা হয়েছিল, সেই সময় গির্জার পাদ্রি গিয়ে পড়ায় ভুলটা শুধরে জ্বলন্ত চিতা থেকে সাহেবের মড়াটা তাড়াতাড়ি করে তুলে পাশেই গোর দেওয়া হল। সাহেবের মুখটা পুড়ে গিয়েছিল। আর তার পাশেই মাটি দেওয়া হয় কুকুরটাকে।

এর পর থেকেই কি এখানে যত খুন-খারাপি? কোনো কারণে প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে গ্রামবাসীদের হাতে মার খেয়ে অপঘাতে মরল ওরা তিনজন–তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে এখন ঐ সাহেব দো?

হরিপদ হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আর আমায় জিগ্যেস করবেন না, বাবু। জানে মেরে দেবে।

আর দু-একটা কথা জানতে চাইব। তুমি বুঝতে পারছ না হরিপদ, এসব কথা জানিয়ে তুমি আমাদের কত উপকার করলে। আচ্ছা, তুমি কি তোমাদের ঐ দেকে না ওর শাগরেদটিকে কখনও দেখেছ?

না, দেখিনি। রক্ষে করুন যেন দেখতে না হয়। গতকাল রাত্রেই তো মাঠের মধ্যে তেনার পায়ের শব্দ শুনেই ভিরমি খেয়েছিলাম।

এখানকার কেউ আজ পর্যন্ত তাকে দেখেননি?

হরিপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, দু-একজন দেখেছিল।

কোথায়? কোথায় তোমাদের ঐ দেবতার আস্তানা?

হরিপদ বলল, শুনেছি বাঁওড়ের ওপারে ফণিমনসার ঝোপের পেছনে একটা মাঠে। দোতলা বাড়ি।নাঃ বাবু, আমার আর বাঁচার পথ রাখলেন না। সব জেনে নিলেন।

অভয় দিয়ে বাসুদেব বলল, তুমি যতক্ষণ আমাদের কাছে আছ, তোমার কোনো ভয় নেই।

হরিপদ ব্যাকুলভাবে বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে রইল।

আচ্ছা, যারা দেখেছে তাদের জিগ্যেস করলে ওঁর সঙ্গীদের সম্বন্ধে আরও কিছু জানা যায় না?

হরিপদ তেমনি ভাবেই তাকিয়ে রইল।

আমরা তাহলে তোমার সঙ্গে তাদের দু-একজনের কাছে যাব?

হরিপদ হতাশ সুরে বলল, গিয়ে কী হবে? তাদের একজন নিরুদ্দেশ, একজন বিছানায় পড়ে আছে। কথা বলতে পারে না। আর একজন পাগল হয়ে গেছে।

ইস্! অসতর্কভাবেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শব্দটা বেরিয়ে এল। একটু চুপ করে থেকে বললাম, আর একটা কথা জিগ্যেস করব।

বাসুদেব কানে কানে বলল, এখন আর জিগ্যেস করো না। ও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।

চাপা গলায় বললাম, এর পর হয় তো সুযোগ পাওয়া যাবে না। ও বেলা থেকে ও আর নাও আসতে পারে।

তাহলে জিগ্যেস করো।

হরিপদকে জিগ্যেস করলাম, যিনি কাল সন্ধেবেলা আমাদের এখানে এসেছিলেন তাঁকে নিশ্চয় চেন?

হরিপদ মাথা নাড়ল।

অবাক হয়ে বললাম, সে কী! উনি তো খুব বড় ঘরের মানুষ। জমিদারবাড়ির বংশধর নাকি?

হরিপদ মোটেই আগ্রহ দেখাল না। শুধু মাথাটা নেড়ে গেল।

আশ্চর্য! এইটুকু জায়গা–সারা জীবন এখানেই কেটেছে। অথচ

ওঁর নাম বগলা মজুমদার।

হরিপদ ফের মাথা নাড়ল।

এ নামটাও তোমার জানা নয়?

না।

তারপর ওর ভুরু দুটো একটু কুঁচকে উঠল। কী যেন ভাবতে চেষ্টা করল।–কী নাম বললেন?

বগলা মজুমদার।

উনি কি জমির দালালি করেন? বাড়ি-টাড়ি

বললাম, তা জানি না। তবে আমাদের এ বাড়িটা তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

এ কথায় হরিপদ কেন যে চমকে উঠল বুঝতে পারলাম না। কারও জন্যে বাড়ি দেখে দেওয়া কি কিছু দোষের? তা হলে?

হরিপদ মুখ গম্ভীর করে বলল, সব্বনাশ বাবু। আর দেরি করবেন না। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারেন ফিরে যান।

বাসুদেব রাগতভাবে বলল, ফিরে তো যাবই। তবে আগে তোমাদের ‘দো’র স্বরূপটা নিজে চোখে দেখি। তারপরে।

হরিপদ চোখ বড় বড় করে বলল, এইজন্যেই কি আপনারা কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন?

বাসুদেব বলল, ধরো তাই।

হরিপদ গুম হয়ে গেল।

হঠাৎ দেখলাম মাঠের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে চলেছে বিরাট একটা শেয়াল। ঠিক যেমন প্রথম দিন দেখেছিলাম। আর যা সেদিন বাসুদেব বিশ্বাস করতে পারেনি।

তাড়াতাড়ি বাসুদেবকে ঠেলা দিয়ে বললাম, দ্যাখো দ্যাখো সেদিনের শেয়ালটা।

বাসুদেব আর হরিপদ দুজনেই মুখ বাড়িয়ে দেখল।

বাসুদেব অবাক হয়ে বলল, তাই তো। শেয়াল এত বড় হয়? আর অমন হেলেদুলে যায়? তাও দিন দুপুরে!

কিন্তু হরিপদ তখনই কিছু বলল না। সে আরও কিছুক্ষণ লক্ষ করল শেয়ালটাকে। তারপর ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ওটা কি শেয়াল?

ধমকে উঠল বাসুদেব। বলল, শেয়াল নয় তো কী?

ভালো করে দেখুন, বাবুরা–ভালো করে দেখুন। ঐ যে মুখটা বদলে যাচ্ছে…এবার ছুটছে জঙ্গলের দিকে বাঁওড়-বাঁওড়

তাই তো! ভালো করে চোখ রগড়ে নিলাম। শেয়ালটা হয়ে গেছে বিরাট একটা কালো কুকুর।

এসবের মানে কী? তাকালাম বাসুদেবের দিকে। বাসুদেব চুপ! একটু পরে বলল, ও কিছু না, চোখের ভ্রম।

তারপর হরিপদকে বলল, তোমার কী মনে হচ্ছে?

ভালো না বাবু, ভালো না। খুব খারাপ। ও তো রাস্তার কুকুর নয়। দেখেননি গলায় বকলস বাঁধা ছিল। ঐ লোকটা যিনি কাল সন্ধেবেলা এসেছিলেন তার খোঁজ করতে যাবেন বলেছিলেন, যাবেন তো? গেলে বলে দেবেন ওঁরও বিপদ।

হ্যাঁ যাব।

তা হলে তাড়াতাড়ি দুবেলারই রান্না করে দিয়ে আমিও চলে যাব। আর ওবেলা আসব না। আপনারাও যত তাড়াতাড়ি পারেন কলকাতায় ফিরে যান।

.

বগলার অন্তর্ধান

হরিপদ আমাদের খাইয়ে দিয়ে ওবেলার রান্না সেরে বেলা তিনটের মধ্যেই চলে গেল। যা, রাতের বেলার জন্যে নিশ্চিন্ত। কাল আর ও আসবে কিনা কে জানে।

হরিপদ চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ হরিপদর কথা নিয়ে আলোচনা করলাম। ও যা বলে গেল তা সব বিশ্বাস করা না গেলেও এটুকু বোঝা গেল এখানকার রহস্যময় ব্যাপারগুলোর অনেক কিছুই ও জানে। জানাটাই স্বাভাবিক। কারণ, ও তো এখানেই আছে জন্ম থেকে। ওর কথা থেকেই এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল তিনু ঘোষ যা বলেছিল তা অনেকটা ঠিক। ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরার সেই উদ্ধত অহংকারী সাহেব আর তার দুই সঙ্গী কুকুরটা আর নিগ্রোটা নিরীহ একজন প্যাসেঞ্জারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যে অপরাধ করেছিল তার প্রতিফল পেয়েছিল। পাবলিকের তাড়া খেয়ে বর্ধমান স্টেশন থেকে এতদূর পর্যন্ত ছুটে আসতে পেরেছিল। তারপর মৃত্যু ঘটেছিল এখানেই। এখানেই তাকে আর দুই সঙ্গীকে কবর দেওয়া হয়েছিল বাঁওড়ের ধারে। সাহেব মরার আগেও এতটুকু অনুতাপ করেনি। তাই তার ক্রুদ্ধ আত্মা শান্তি পায়নি। এই অঞ্চলের মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই অঞ্চলেই কোনো একটা বাড়িতে তার আস্তানা। এখনও পর্যন্ত সেই বাড়িটার সন্ধান আমরা পাইনি। সে চায় না তাকে কেউ বিরক্ত করুক। তাকে নিয়ে খোঁজাখুঁজি করুক। তাই যে কেউ যে কোনো ভাবে তার খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করছে তাকেই শেষ করে দিচ্ছে।

আর ঐ যে হরিপদ বলল, ‘আপনাদের ওপর দোর রোষ’ তার কারণ আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি তা সাহেবের পছন্দ নয়। ভালো মানুষের মতো নিজেরা চলে না গেলে আমাদের সরিয়ে দেবে। প্রথম রাত্তিরে ভয় দেখিয়েছিল। এবার ভয়টা কাজে পরিণত করবে।

কিন্তু শেয়ালটার কী ব্যাপার হল?

বাসুদেব নিজেও তো শেয়াল বলেই চিনেছিল। তারপর বলল, চোখের ভ্রম। এটা মনকে চোখ ঠারা। প্রথম অভিজ্ঞতায় যা অস্বাভাবিক যা অলৌকিক বলে মনে হবে, পরে জোর করে তা মন থেকে সরিয়ে দেবে। এ কেমন কথা? অলৌকিক বলে যে কিছু থাকতে পারে তা সে মানতেই চায় না।

এই যে একটু আগে শেয়ালটাকে স্পষ্ট দেখা গেল (আগের দিনও আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম, আজও বাসুদেবও দেখল)। তবু ও ওটাকে শেয়াল বলে মানবে না। না মানাটাই স্বাভাবিক। কারণ, চোখের সামনে দিনের বেলাতেই অতবড় শেয়ালটা আস্তে আস্তে বড় একটা কুকুর হয়ে গেল। এটা সম্ভব কী করে? তবু সম্ভব। কারণ, এখানে এসে পর্যন্ত আমরা একরকম অলৌকিক জগতে রয়েছি। বিশেষ করে, হরিপদ কুকুরটার গলার বকলস পর্যন্ত দেখতে পেল। অর্থাৎ শেয়াল থেকে কুকুরে যেটা রূপান্তরিত হল সেটা রাস্তায় একটা কুকুর নয়, সেটা যে সেই সাহেবেরই কুকুর তা প্রমাণিত হল। অথচ হরিপদ তো সে কুকুরটা দেখেনি, যেটা দেখেছিল তিনু ঘোষ নিতান্ত অল্প বয়সে। তাহলে সেই বাঙালি ভদ্রলোকের লাথি খেয়ে প্ল্যাটফর্মে ছিটকে পড়েও কুকুরটা মরেনি?

ঘণ্টাখানেক পর আমরা দুজনে বগলা মজুমদারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। যদিও হরিপদর কাছ থেকে অনেক কিছুই জানা গেল তবু বগলাকে আর একবার পাওয়া দরকার। দুজনের কথা শুনতে পেলে বিষয়টা অনেকটা পরিষ্কার হবে। আর তখনই ঠিক করতে পারা যাবে হরিপদর দোটির সঙ্গে দেখা করা সম্ভব কিনা।

কিন্তু আশ্চর্য, সারা দুপুর জায়গাটা এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত খুঁজেও বগলার খোঁজ পাওয়া গেল না। শেষে প্রায় পড়ন্ত বেলায় একটা হরিসংকীর্তনের আখড়ায় গিয়ে জানা গেল এখানেই তিনি থাকেন। খোল বাজান। একসময়ে নাকি এখানে ওঁর পূর্বপুরুষের কীর্তনিয়া হিসাবে নামডাক ছিল। এখন কিছুই নেই। নিজেরও কোনো সম্বল নেই। মড়া নিয়ে যাবার সময় বা শ্রাদ্ধে কিংবা হরিনামের আসরে বায়না পেলে দুটো পয়সা রোজগার। তা ছাড়া অবশ্য জমি, বাড়ির সামান্য দালালি করেন। লোকটি এক ধরনের পাগল। নিজেকে খুব বড়ো করে প্রচার করেন। হামবড়াই ভাব। জমিদার বংশের ছেলে। অথচ জানে না লোকে হাসে।

বগলার পরিচয় পেয়ে অবাক হলাম।

কীর্তনীয়াদের একজনকে জিগ্যেস করলাম, তার সঙ্গে একবার দেখা করা যায়?

লোকটি বলল, সে তো এখন নেই।

কোথায় গেছে জিগ্যেস করলে লোকটি বলল, এখানে কোথায় কলকাতা থেকে দুটি ছোকরাবাবু এসেছেন। তাঁদের সম্বন্ধে নানা জনে নানা কথা বলছে। মজুমদারকে সবাই ঠাট্টা করে কত্তা বলে ডাকে। তাই কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ কলকাতা থেকে ওঁরা এসেছেন জানবার জন্যে কেউ না বলতেই নিজে থেকে কাল সন্ধেবেলা সেখানে গেছে। কিন্তু আজও ফেরেনি।

অবাক হয়ে বললাম, সে কী! উনি তো আমাদের কাছেই গিয়েছিলেন। তারপর রাত আটটা বাজাবার আগেই চলে আসেন খুব ব্যস্ত হয়ে।

ওরা অবাক হয়ে বলল, কাল রাত্তিরেই চলে এসেছিল? সে কী! তাহলে কত্তা গেল কোথায়? সারা রাত থাকল কোথায়? ওর তো থাকার কোথাও তেমন জায়গা নেই।

আর একজন বলল, খুব ব্যস্ত হয়ে চলে এসেছিল বলছেন?

হ্যাঁ, বাসুদেব বলল, যেন ভয় পেয়ে।

কীসের ভয়?

বাসুদেব বলল, তা তো জানি না। তবে কথা বলতে বলতেই উনি হঠাৎ উঠে পড়লেন। বললেন, এখুনি হয়তো শুনতে হবে জন্তুটার হাড়-হিম-করা ডাক! তাই

তারপর?

তারপর উনি লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে পড়লেন।

একা?

হ্যাঁ, সঙ্গে আর কেউ ছিল না।

তারপর?

ওঁর আরো কিছু বলার ছিল–মানে আমাদের সাবধান করে দেবার জন্যে। সেটা বলার জন্যে ওঁর আবার আসার কথা ছিল। তা আমরা ভাবলাম, উনি আবার কষ্ট করে আসবেন কেন, আমরাই যাই। তাই

হরিপদও যে অন্ধকার মাঠ দিয়ে তাকে যেতে দেখেছিল সে কথা বললাম না।

কীর্তনিয়াদের আখড়া থেকে আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। খেয়ালই করিনি এরই মধ্যে বেলা শেষ হয়ে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু

কিন্তু বগলা মজুমদার কোথায় গেলেন?

সে চিন্তা আপাতত শিকেয় তুলে আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আন্দাজে অচেনা পথ ধরে হাঁটা–ভাবলেও শিউরে উঠছিলাম। এরকম ভয় আগে পাইনি। কিন্তু এখন যা সব ঘটছে–যা সব শুনছি তাতে মনের জোর হারিয়ে ফেলছি। মনে হচ্ছে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কোলকাতা থেকে এসেছিলাম তা মাঝপথেই বন্ধ করে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই।

অন্ধকারেই বাসুদেবের দিকে তাকালাম। সেও নির্বাক। কথা বলে এনার্জি নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছতে পারাই দরকার। তবু ভাগ্যি টর্চটা এনেছিলাম। দুজনে হেঁটে চলেছি। নিস্তব্ধ মাঠ। মাঝে মধ্যে গাছপালা, ঝোপঝাপ। ঝোপের মধ্যে ঝিঁঝি ডাকছে। কিন্তু সেসব শোনবার মতো মন নেই। আমরা হাঁটছি তো হাঁটছিই। শুধু দুজনের জুতোর শব্দ।

এক-এক সময়ে ভয় হচ্ছে ঠিক পথ ধরে যাচ্ছি তো? শেষ পর্যন্ত ভুল করে বাঁওড়ের ধারে গিয়ে পড়ব না তো?

হঠাৎ বাসু আমার হাত ধরে টেনে একপাশে সরিয়ে নিল। কী একটা ছোটোখাটো প্রাণী… জ্বলজ্বল করছে চোখ–একেবারে আমাদের গা ঘেঁষে গড়াতে গড়াতে চলে গেল।

কী ওটা? অমন ভরে যাচ্ছে কেন? জিগ্যেস করলাম বাসুকে।

বাসুদেব উত্তর দিল না।

শুধু আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগল।

একটু পরে কোথায় যেন কুকুরের কান্না শোনা গেল। খুব অস্পষ্ট। কে যেন কুকুরটাকে পিটিয়ে মারছে।

জিগ্যেস করলাম, বাসু, শুনতে পাচ্ছ?

বাসুদেব বলল, ওদিকে কান দিও না। চুপচাপ চলো।

বাসুদেবের গলায় যেন কেমন অন্যরকম সুর।

ক্রমে কুকুরের কান্না মিলিয়ে গেল। তারপরই হঠাৎ একটা ভীষণ হুংকারে চারদিক যেন কেঁপে উঠল। প্রথমে হুংকার। তারপর টানা গর্জন। যেন প্রচণ্ড রাগে কোনো জন্তু গর্জন করছে–করেই যাচ্ছে। জন্তুটার ডাকটা যে বিকটাকৃতি কোনো হিংস্র কুকুরের তা বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু কোন দিকে থেকে ডাকটা আসছে, কেমন করে আমরা সাবধান হব তা বোঝা গেল না। সেই ভয়ঙ্কর ডাকে নিস্তব্ধ মাঠখানা যেন কেঁপে উঠছিল। বাতাস চমকে উঠছিল।

সভয়ে বললাম, এই কি তাহলে সেই অশরীরী ডাক?

বাসুদেব বলল, এ যেন সেই কোনান ডোয়েলের লেখা ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলের হাউন্ডের ডাক! মনে পড়ছে তো? জোরে, আরো জোরে হাঁটো। নইলে হয় তো আরও বড় বিপদে পড়তে হবে।

ভয়ে ভয়ে বললাম, কিন্তু সামনে যদি কুকুরটা—

তাহলে মরতে হবে। তা বলে তো অন্ধকার মাঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

তারপর কী করে যে আমরা মাঠ পার হয়ে বাসায় এসে ঢুকলাম তা সঠিক বলতে পারব না।

অথচ নিরাপদে পৌঁছনোর কথা ছিল না। বিশেষ যখন হরিপদর মুখে শুনেছিলাম দের রোষ আমাদের মাথার ওপরে খাঁড়ার মতো ঝুলছে। নিষ্কৃতি নেই। আর কী কারণে তার রোষ তা আমরা মানি বা না মানি যুক্তির অভাব ছিল না। প্রধান কারণটা বোধহয় এই যে, আমরাই বেশি উৎসাহ করে ওদের রহস্যের জাল ছিঁড়ে প্রকাশ্যে টেনে আনার জন্যে একেবারে কলকাতা থেকে এখানে ছুটে এসেছি। এত সাহস!

এটাই আমাদের অপরাধ–গুরুতর অপরাধ!

যাই হোক মাঠের মধ্যে ঐ ভয়ঙ্কর গর্জন শুনেও আমরা যে নিরাপদে বাসায় পৌঁছতে পেরেছি তার জন্যে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। কিন্তু ভাগ্য যে পুরোপুরি প্রসন্ন ছিল না তা একটু পরেই বুঝতে পারলাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দরজার কাছে এসে কোনোরকমে তালা খোলা হল। কিন্তু দরজা খুলে আলো জ্বালতে গিয়ে দেখি আলো জ্বলছে না। ….বুঝি লোডশেডিং। টর্চের আলোয় কোনোরকমে শোবার ঘরে এসে ঢুকলাম। তারপর মোমবাতি খোঁজবার জন্যে টেবিলের কাছে যেতেই কালোমতো কী একটা জন্তু টেবিলের নীচে গরর গরর করে উঠল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। বাসুদেব ছুটে এল। টর্চের আলো ফেলা হল টেবিলের নীচে। কিন্তু আশ্চর্য! কিছুই নেই। অথচ জন্তুটাকে অন্ধকারেও আমি দেখেছি। কালো রঙের কুকুর জাতীয়। বেশ বড়। বাসুদেবও গরর গরর শব্দ পাশের ঘর থেকে শুনেছে।

তাহলে?

তাজ্জব ব্যাপার। দরজা বন্ধ, জানলা বন্ধ। অতবড় কুকুরটা এলই বা কোথা দিয়ে, গেলই বা কোথায়? নিশ্চয়ই দুটো ঘরের মধ্যেই কোথাও ঘাপটি মেরে রয়েছে।

টর্চের মিটমিটে আলোর ওপর ভরসা করে মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বোকামি। অপেক্ষা করতেই হবে। পাশের ঘরে যেতেও সাহস হয় না। অগত্যা এ ঘরের চৌকির ওপরই দুজনে বসলাম। পা গুটিয়ে একেবারে মাঝখানে। যাতে চট করে নাগাল না পায়। কী বোকা। এ কি সাপ বা বিছে যে পা তুলে বসলেই নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে? এ যে পেল্লায় একটা কুকুর! ছোট্ট একটা লাফ দিলেই একেবারে ঘাড়ের ওপর। তবু উপায়ই বা কী?

আমরা কলকাতার ছেলে। চট করে ভূতুড়ে কাণ্ড কিংবা অলৌকিক ব্যাপার মানতে পারি না। তাই কুকুরটাকে ঘরের মধ্যে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল রাস্তার কুকুর-টুকুর হবে। বাসুদেব তো ওর স্বভাবমতো বলেই বসল, কুকুরটা কখন ঘরে ঢুকে বসেছিল না দেখেই দরজা বন্ধ করে গিয়েছিলাম।

কিন্তু এখন দুজনেই অন্ধকারে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। সত্যিই তো অত বড় কুকুরটা দিন দুপুরে ঢুকল অথচ আমরা কেউ টেরই পেলাম না। এ কি সম্ভব! তখনই মনে পড়ল এইরকম একটা জন্তুকে সেদিন আমরা দেখেছিলাম মাঠ দিয়ে যেতে। প্রথমে মনে হয়েছিল শেয়াল, তারপর ধীরে ধীরে মুখটা বদলে হয়ে গেল কুকুর। সাংঘাতিক কিছু ঘটবার আগে ঐ কুকুরটাই কি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ডেকে ওঠে? এই কুকুরটার ভয়েই কি বগলা মজুমদার কথা বলতে বলতে উঠে চলে গিয়েছিলেন? সন্ধের মুখে মাঠ দিয়ে বাসার ফেরার সময় ঐ কুকুরটারই হাঁকড়ানি আমরা শুনেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই কুকরটাই কি একেবারে ঘরের মধ্যে?

খুব নিচু গলায় আমরা এই সব কথা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কী বুদ্ধি বিভ্রম! নিচু গলায় কথা বলছিলাম কেন? না, পাছে কুকুরটা যদি (ঘরের কোথাও থাকে) শুনতে পায়।

আরে মুখ্যু! শুনতে পেলেও কুকুর কি মানুষের ভাষা বোঝে, আসলে ভয়ে সব কিছু ঘুলিয়ে যাচ্ছিল।

অন্ধকারে বসে আছি তো বসেই আছি। বিকেলে চা খাওয়া হয়নি। রান্নাঘরে গিয়ে যে চা করব তার উপায় নেই। কে জানে হয়তো এখানেই কোথাও কুকুরটা বসে আছে।

ক’টা বাজল? টর্চ জ্বালতেও ভয় করে। না জানি কী দেখব! তবু জ্বালোম। সবে সাতটা। ঘড়িটা চলছে তো? ঘড়ি-বাঁধা কবজিটা কানে লাগালাম। টিক, টিক, টিক টিক–হ্যাঁ, ঘড়ি চলছে। কে জানে এমনিভাবে সারা রাত বসে থাকতে হবে কিনা!

হয়তো তাই হবে। উপায় কী?

একবার বাসুদেব বলল, দেশলাইটা খোঁজার দরকার। আলো জ্বালতেই হবে।

কিন্তু কী করে আলো জ্বালব? দুজনেরই কেউই তো চৌকি থেকে নেমে দেশলাই খুঁজতে যেতে পারছি না।

বাসুদেব বলল, তোমার হাতে টর্চ আছে তো?

তা আছে। নেবে? বলে ও কিছু বলার আগেই টর্চটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম।

হুঁ! বলে যেন চাপা একটু ধিক্কার দিয়ে বাসুদেবই আমার ওপর রাগ করে টর্চ জ্বেলে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল। যেন মরণ ঝাঁপ দিল। তারপর এক ছুটে গিয়ে দেশলাইটা নিয়ে এসে চৌকিতে উঠে বসল।

আমার লজ্জা করল। কিন্তু উপায় কী? সাহস বলে বস্তুটা তো সবার সমান থাকে না।

অবশেষে আরও ঘণ্টা তিনেক পরে আপনা থেকেই আলো জ্বলে উঠল। বাইরের দিকে তাকিয়ে বোঝার উপায় নেই। কারণ, বাইরের মাঠঘাট সবই অন্ধকারে ডুবে আছে।

তবু নামতে ভরসা নেই। অথচ নামতেই হবে। খাওয়ার দরকার। কোনোরকমে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলাম। বাসুদেব বাইরে দাঁড়িয়ে রইল সতর্ক হয়ে। মুশকিল এমন একটা লোহার রড বা ভাঙা ডালও নেই যে আত্মরক্ষা করা যাবে।

তাড়াতাড়ি দুজনে খেয়ে নিয়ে ভালো করে দরজায় খিল এঁটে শুয়ে পড়লাম। শোবার আগে চৌকির তলা, ঘরের কোনা, কুয়োতলা, জানলা বাইরের দিক দেখে নিলাম। দু’ঘরেই দুটো আলো জ্বালা থাকল।

কিন্তু দু’চোখ বন্ধ করেও চট করে ঘুম এল না। ঘরের মধ্যে ইঁদুর দৌড়নোর শব্দটুকুতেও চমকে উঠি–ওই বুঝি! জানলার বাইরে তো বারে বারেই কতরকমের শব্দ! একবার ঝুপ করে কী যেন লাফিয়ে পড়ল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

কী হল? ঘুম জড়ানো স্বরে বাসুদেব জিগ্যেস করল।

বাইরে কী যেন লাফিয়ে পড়ল।

পড়ুক। বলে পাশ ফিরে শুল।

ভাবি, এক-এক জন মানুষ আছে কত সহজেই তারা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে পারে।

ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের রাতও শেষ হয়। ঘুম এমনি জিনিস। খুব ভয় পাচ্ছে–ঘুমিয়ে পড়ো। ব্যস্ এক ঘুমে রাত কাবার করে উঠে দেখবে ভোর হয়ে গেছে। আলো ফুটছে মানেই ভয় পালিয়েছে।

কিন্তু আমাদের দুর্ভোগ তখনও কাটেনি। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে চা খেয়ে ভেতরের ঘরে এসে টেবিলের নীচে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।

রক্ত! এতটা রক্ত কোথা থেকে এল! আমরা দুজনেই ঝুঁকে পড়লাম। মনে হল যেন তাজা রক্ত। কুকুরটা যেখানে ছিল সেখানেই। তাহলে কি কুকুরেরই রক্ত? মনে হল কিছু দিয়ে জোর করে আঘাত করার ফলেই রক্তপাত হয়েছে। কিন্তু কুকুরকে মারল কে? কখনই বা মারল? আর এত বড় শক্তিশালী কুকুরটাকে আঘাত করা কি দু একজনের কাজ? কিন্তু কুকুরটা কই?

তাহলে?

এসব এমনই রহস্য যা এখনই দুজনে বসে আলোচনা করে মীমাংসা করা যাবে না। তার দরকারও নেই। গতকাল থেকেই ঠিক করে ফেলেছি। যথেষ্ট হয়েছে। আর এখানে নয়। অনেক কিছুই তো দেখা হল। বাকি থাকল শুধু সেই পোড়ামুখ সাহেবের বাড়িটা অন্তত দেখা যেখানে তিনু ঘোষ এক রাত্রি ছিলেন। যাক গে। এখন কলকাতা ফিরতে পারলে বাঁচি। বাসুদেব প্রথমে রাজি হয়নি। ও সেই বাড়িটা খুঁজে বের করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এখন রাত্রে সেই কুকুরের ছায়া-শরীর দেখে ঠিক করেছে আজকালের মধ্যেই কলকাতা ফিরে যাবে। নিজেরাই রক্তটা পরিষ্কার করে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালাম। অত বড় কুকুরটা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? রক্ত ছাড়া আর কোনো চিহ্নই রেখে যাবে না?

হঠাৎ নজরে পড়ল ছাদের কার্নিশ থেকে কিছুটা রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। ছাদে রক্ত এল কোথা থেকে? কুকুরটা কি রাত্তির বেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে গিয়েছিল? ছাদে গেলই বা কী করে? সিঁড়ি তো নেই!

বাসুদেব বলল, দ্যাখো দ্যাখো রক্তের ফোঁটা–ঐ যে ঐ দিকে চলে গেছে।

তাই তো!

চলো দেখা যাক। কোথায় শেষ হয়েছে।

দুজনে মাটির দিকে লক্ষ রেখে এগিয়ে চললাম। ফোঁটাগুলো সোজাসুজি যায়নি। গেছে এঁকেবেঁকে। বোঝা যায় কুকুরটা আঘাতের যন্ত্রণায় মাথা দোলাতে দোলাতে গেছে।

প্রায় আধঘণ্টা যাবার পর আমরা যে জলাশয়ের কাছে এসে পৌঁছলাম সে দিকে তাকিয়েই বাসুদেব বলে উঠল–নিশ্চয় এই সেই বাঁওড়!

কাদাগোলা জল কোথাও গোড়ালি ডোবা কোথাও এক হাঁটু। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ। কোথাও কচুরিপানা আঁক বেঁধে আছে। কোথাও শুকনো ডাঙা। অল্প জলে ছোটো ছোটো মাছ কিলবিল করছে। জলের ধারে গুগলি-শামুকের খোল। রক্তের ফোঁটা জলের ধারে এসে মিলিয়ে গেছে।

বাসুদেব বলল, যার গা থেকে রক্ত পড়ছিল সে সম্ভবত জলে নেমে গেছে।

জলে না হয় নেমে গেল। কিন্তু তারপর? কোথায়?

এর জবাব কে দেবে? কেই বা জানে?

তখন বেলা দশটা হবে। বাঁওড়ের ধারটা নির্জন নিঝুম। ডাঙা বরাবর শুধু বাবলা আর বড় বড় ঘাস। এত যে ঘাস অথচ একটা গরুও চরছে না। কাছেই একটা বহুকালের পুরনো বটগাছ। কিন্তু গাছে একটা পাখিও নেই।

বাঁওড়টা বেশি চওড়া নয়। সিকি কিলোমিটারের মতো। ওপারে একটা ডোঙা বাঁধা। কিন্তু মাঝি নেই।

ওপারে কী আছে কে জানে! আমরা দুজনেই তাকালাম। আশ্চর্য! শুধু বনঝোপ, লতাপাতা আর বুনো ফুল। পিছনে মাথা তুলে আছে পরপর কতকগুলো ঝলসানো দেবদারু গাছ আর একেবারে সামনে বর্শা হাতে প্রহরীর মতো সার সার দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাভরা ফণীমনসার গাছ।

সবকিছুই যেন অতি সাবধানে ওপারের অস্তিত্বটাই আড়াল করে রেখেছে লোকের চোখের সামনে থেকে। এ তো ভারী অদ্ভুত ব্যাপার!

তবু এপার থেকে দুজনেই এদিক-ওদিক মাথা হেলিয়ে, কখনও পায়ের চেটোর ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে খুঁজতে লাগলাম, যদি কিছু দেখা যায়।

দেখা গেল দুটো দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। কেন জানি না আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। চাপা উত্তেজনায় বাসুদেবকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলাম, দ্যাখো, দ্যাখো, ওপারে একটা দোতলা বাড়ি।

বাসুদেব গম্ভীর ভাবে বলল, দেখেছি। তুমি কি আরও কিছু দেখতে পেয়েছ?

না তো!

তাহলে আমার এদিকে সরে এসো। এবার তাকাও বাড়িটার ন্যাড়া ছাদের দিকে।

তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে যা দেখলাম তাতে শিউরে উঠলাম। বিরাট একটা কালো কুকুর ছাদ থেকে যেন আমাদেরই লক্ষ করছে। যেন অনেক চেষ্টার পর আমাদের ও এইমাত্র খুঁজে পেয়েছে। মনে হল লাফাবার জন্যে শরীরটা পাঁচিলের বাইরে ঝুঁকিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাসুদেব আমার হাত ধরে টান দিল, চলো শিগগির। না-না, ওদিক দিয়ে নয়, অন্য দিক দিয়ে–

অন্য পথ দিয়ে বাঁওড়েরই কিনারা ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এক জায়গায় ধোঁয়া উড়ছে দেখা গেল।

এখানে ধোঁয়া কেন?

বাসুদেব বলল, বোধহয় শ্মশান। হরিপদ বলেছিল শ্মশানের পাশেই কবরখানা। যেখানে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল সেই সাহেব আর দুই সঙ্গী নিগ্রো অনুচর আর কুকুরটাকে।

একটু এগোতেই শ্মশানে এসে পড়লাম। একটা মড়া পোড়ানো হবে। আর একটা মাটিতে চালির ওপর। দুজন পুলিশও রয়েছে। আর কেউ কী নেই! এমন কি বাড়ির লোকজন কেউ! কী ব্যাপার? পুলিশরা জানাল একজন লোককে দু’দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কাল বিকেলে পাওয়া গেছে বাঁওড়ের ধারে। ক্ষতবিক্ষত। লোকটি কোথাকার?

চেনেন নাকি? একজন পুলিশ রসিকতা করে মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে নিল। আঁতকে উঠলাম। ইস্! এ যে বগলা মজুমদার।

[শারদীয়া ১৪১৩]

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments