Tuesday, April 16, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পযখন নামিবে আঁধার - হুমায়ূন আহমেদ

যখন নামিবে আঁধার – হুমায়ূন আহমেদ

যখন নামিবে আঁধার - হুমায়ূন আহমেদ

যখন নামিবে আঁধার | মিসির আলি | Jokhon Namibe Adhar by Humayun Ahmed

গত তিন রাতেই ঘটনাটা ঘটেছে

গত তিন রাতেই ঘটনাটা ঘটেছে। অতি তুচ্ছ ব্যাপার। একে ‘ঘটনা’ বলে গুরুত্বপূর্ণ করা ঠিক না। তারপরেও মিসির আলি তাঁর নোটবুকে লিখলেন–

বিগত তিন রজনীতেই একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইয়াছে। রাত্রি তিনটা দশ মিনিটে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়াছে। ইহার কারণ অনুসন্ধান করিয়া পাইতেছি না।

মিসির আলির নোটবইটা চামড়ায় বাঁধানো। দেখে মনে হবে প্রাচীন কোনো বই। বইয়ের মলাটে সোনালি রঙে নাম লেখা–

ব্যক্তিগত কথামালা
ড. মিসির আলি
পিএইচডি

নোটবইটা তিনি কারও সামনে বের করেন না। বের না করার অনেকগুলো কারণের একটি হলো, তার কোনো পিএইচডি ডিগ্রি নেই। সাইকোলজিতে নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এমএস ডিগ্রি পেয়েছিলেন। নামের আগে ‘ড.’ কখনো লিখতে পারেন নি। যদিও বিদেশ থেকে প্রচুর চিঠিপত্ৰ পান যেখানে তারা ভুল করে ‘ড. মিসির আলি’ লেখে।

শুদ্ধ দ্রুত প্রবাহিত হয় না। ভুল হয়। নিজের দেশেও অনেকেই মনে করে তার পিএইচডি ডিগ্রি আছে। বিশেষ করে তার ছাত্ৰ-ছাত্রীরা।

চামড়ায় বাঁধানো এই নোট বইটা তাঁর এক ছাত্রী দিয়েছিল। ছাত্রীটির নাম রেবেকা। নোট বইটার সঙ্গে রেবেকার একটা দীর্ঘ চিঠিও ছিল। যে চিঠি পড়লে যে-কোনো মানুষের ধারণা হবে, রেবেকা নামের তরুণী তার বৃদ্ধ শিক্ষকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। চিঠির একটি লাইন ছিল এ রকম–‘স্যার, যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি আপনার পাশে থাকতে চাই। কে কী মনে করবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’

চিঠি পড়ে মিসির আলি তেমন শঙ্কিত বোধ করেন নি। তিনি জানেন, তরুণী মেয়েদের হঠাৎ আসা আবেগ হঠাৎই চলে যায়। আবেগকে বাতাস না দিলেই হলো। আবেগ বায়বীয় ব্যাপার, বাতাস পেলেই তা বাড়ে। অন্য কিছুতে বাড়ে না।

রেবেকা থার্ড ইয়ারে উঠেই ইউনিভার্সিটিতে আসা বন্ধ করল। মিসির আলি স্বস্তি বোধ করলেন। মেয়েদের হঠাৎ ইউনিভার্সিটিতে আসা বন্ধ করা স্বাভাবিক ঘটনা। বিয়ে হয়ে গেছে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, কিংবা বিদেশে চলে গেছে। আজকাল ছাত্রীরাও বিদেশ যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই রেবেকার ব্যাপারটা তিনি জানতে পারতেন। তার বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত। মিসির আলির ইচ্ছে করে নি।

মেয়েটা ভালো থাকলেই হলো। যদি কখনো দেখা হয় তাকে বলবেন, তুমি যে নোটবইটা আমাকে দিয়েছ, সেটা আমি যত্ন করে রেখেছি। মাঝে মধ্যে সেখানে অনেক ব্যক্তিগত কথা লিখি।

সমস্যা হচ্ছে, ব্যক্তিগত কথা মিসির আলির তেমন নেই। তিন বছর হলো ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। দুই কামরার একটা ঘর এবং অর্ধেকটা বারান্দা নিয়ে তিনি থাকেন। জসু নামের বার-তের বছরের একটা ছেলে আছে। বাজার, রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার সব সে করে। সন্ধ্যার পর তিনি তাকে পড়াতে বসেন। এই সময়টা মিসির আলির খুব নিরানন্দে কাটে। এক বছর হয়ে গেল তিনি জাসুকে পড়াচ্ছেন। এই এক বছরেও সে বর্ণমালা শিখতে পারে নি। অথচ অতি বুদ্ধিমান ছেলে। গত সোমবার তাঁর এমন মেজাজ খারাপ হলো—একবার ইচ্ছে করল জসুর গালে থাপ্পড় লাগাবেন। সে ‘ক’ ‘খ’ পর্যন্ত ঠিকমতোই পড়ল। ‘গ’-তে এসে শুকনা মুখ করে বলল, এইটা কী ইয়াদ নাই।

মাঝে মাঝে মিসির আলির মনে হয়। জাসুর সবই ‘ইয়াদ’ আছে। সে ভান করে ইয়াদ নাই। জসুর সবকিছুই ‘ইয়াদ’ থাকে, শুধু অক্ষর ইয়াদ থাকে না-তা কী করে হয় ? মিসির আলি নিশ্চিত, ছেলেটি অতি বুদ্ধিমান। প্রায়ই তার সঙ্গে তিনি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সে আলোচনায় অংশগ্রহণও করে। হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে না।

তাঁর যে প্রতিরাতেই তিনটা দশ মিনিটেই ঘুম ভাঙে—এটা নিয়েও তিনি জাসুর সঙ্গে কথা বলেছেন। জসু গম্ভীর হয়ে বলেছে, চিন্তার বিষয়।

তিনি বলেছেন, চিন্তার কোনো বিষয় না। আমার মতো বয়েসী মানুষের মাঝরাত থেকে ঘুম না হওয়ারই কথা।

জসু তার উত্তরে বলেছে, কিন্তুক স্যার, প্রত্যেক রাইতে তিনটার সময় ঘুম ভাঙে, এই ঘটনা কী ? এইটা চিন্তার বিষয় কি না আপনে বলেন। দেখি আপনার বিবেচনা।

মিসির আলি তেমন কোনো ‘বিবেচনা’ এখনো দেখাতে পারেন নি। তবে তিনি চিন্তা করছেন।

জসু তাকে সান্তুনা দেওয়ার মতো করে বলেছে, আপনে চিন্তা করেন, আমিও চিন্তা করব। দেখি দুইজনে মিল-মিশ কইরা কিছু বাইর করতে পারি কি না। ‘নদী-খাল-বিল আসল জিনিস মিল।’

জসুকে অত্যন্ত পছন্দ করেন মিসির আলি। এতে অবশ্য প্রমাণিত হয় না যে, জসু চমৎকার একটি ছেলে। সমস্যাটা মিসির আলির। যে-ই মিসির আলির সঙ্গে কাজ করতে এসেছে তাকেই তিনি পছন্দ করেছেন। এদের অনেকেই টাকা-পয়সা নিয়ে ভোগে গেছে। জসুর ক্ষেত্রেও হয়তো এ রকম কিছু ঘটবে। তবে না ঘটা পর্যন্ত মিসির আলির ভালোবাসা কমবে না। সন্ধ্যার পর রোজ তিনি তাকে পড়াতে বসবেন। রাতে একসঙ্গে খেতে বসে অনেক জটিল বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলবেন। ঘুমানোর সময়ও কিছু গল্পগুজব হবে। দু’জন একই ঘরে ঘুমায়। মিসির আলির বড় খাটের পাশেই জপুর চৌকি। রাতে জম্মু একা ঘুমুতে পারে না বলেই এই ব্যবস্থা। তার খুবই ভূতের ভয়।

সে একা ঘুমালেই নাকি একটা মেয়ে-ভূত এসে জাসুর পায়ের তলা চাটে। মেয়ে-ভূতটার নাম হুড়বুড়ি।

মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে হুড়বুড়ির কাটা জসুর মাথা থেকে দূর করা প্ৰয়োজন। মিসির আলি সময় পাচ্ছেন না।

সময় পাচ্ছেন না কথাটা ঠিক না। তার হাতে কোনো কাজ নেই। তিনি প্রচুর বই পড়ছেন। বই পড়া কাজের মধ্যে পড়ে না। বই পড়া হলো বিনোদন।

মিসির আলির ঘুমুতে যাওয়ার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই। জাসুর আবার এই বিষয়ে ঘড়ি ধরা স্বভাব। রাতের খাবারের পর থেকে সে হাই তুলতে থাকে। হাই তুলতে তুলতে বাড়িওয়ালার বাড়িতে (দোতলায়)। টিভি দেখতে যায়। রাত ন’টার দিকে ফিরে এসে চা বানায়। আগে এক কাপ বানােত, এখন বানায় দু কাপ। মিসির আলি যেমন বিছানায় পা ছড়িয়ে খাটের মাথায় হেলান দিয়ে চা খান, সেও তা-ই করে। চা শেষ করে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম।

আজও তা-ই হচ্ছে। দু’জনই গম্ভীর ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মিসির আলি দিনের শেষ সিগারেট ধরিয়েছেন। তার হাতে পপুলার সায়েন্সের একটা বই, নাম–The Other Side of Black Hole। লেখক প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন ব্ল্যাক হোলের ওপাশের জগতটা পুরোটাই অ্যান্টিমেটারে তৈরি। সেখানকার জগৎ অ্যান্টিমেটারের জগৎ। এই জগতে যা যা আছে অ্যান্টিমেটারের জগতেও তা-ই আছে। সেই জগতে এই মুহূর্তে একজন মিসির আলি চা খেতে খেতে Theother Side of Black Hole বইটা পড়ছে। তার সঙ্গে আসে জসু নামের এক ছেলে।

মিসির আলি বই নামিয়ে হঠাৎ করেই জলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, জসু, তুই একটু বাড়িওয়ালার বাসায় যেতে পারবি?

জসু বলল, কী প্রয়োজন বলেন?

মিসির আলি বললেন, খোজ নিয়ে আয় এই বাড়ির কেউ অসুস্থ কি না। আমার ধারণা, বাড়ির কেউ অসুস্থ, তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের একটা ডোজ পড়ে রাত তিনটায়। তখন ঘড়িতে অ্যালাৰ্ম দেওয়া থাকে। রাত তিনটায় অ্যালার্ম বাজে, তখন সেই শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। আমার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়। দশ মিনিট বাড়তি লাগে।

জসু বলল, বাড়িওয়ালার নাতির নিউমোনিয়া হয়েছে। তার নাম কিসমত। ছক্কা ভাইজানের ছেলে।

মিসির আলি বললেন, তারপরেও যা। জেনে আয় রাত তিনটায় অ্যালার্ম বাজে কি না।

জসু বলল, বাদ দেন তো স্যার। বাজে প্যাচাল।

মিসির আলি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে যা বাদ দিলাম।

জসু ঘুমুতে গেল। মিসির আলি রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে বসে রইলেন।

জসু ঘুমুতে গেল। মিসির আলি রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে বসে রইলেন। অ্যালার্ম বাজল তিনটা দশ মিনিটে। মিসির আলির ভুরু কুঁচকে গেল। বাড়িওয়ালার ঘড়ি ফার্স্ট, নাকি তারটা স্লো—এটা নিয়ে ভাবতে বসলেন।

মিসির আলির বাড়িওয়ালার নাম আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি পেশায় একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। এই বাড়িতেই (একতলা দক্ষিণ দিকে) তাঁর রোগী দেখার চেম্বার। পুরুষ ও মহিলা রোগীদের বসার ব্যবস্থা আলাদা। সিরিয়াস রোগী, যাদের সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করা দরকার, তাদের জন্য একটা ঘরে দুইটা বিছানা পাতা আছে। এটা তার হাসপাতাল। হাসপাতালে একজন নার্স আছে। এই ঘরের পাশেই হোমিও ফার্মেসি। রোগীদের এই ফার্মেসি থেকেই ওষুধ কিনতে হয়। বাইরে সব ওষুধই দু নম্বরি। আজিজুর রহমান মল্লিক সব ওষুধ সরাসরি হোমিওপ্যাথের জনক হানিম্যান সাহেবের দেশ জার্মানি থেকে আনান।

বাড়ির সামনে ১০ ফুট বাই ৪ ফুটের বিশাল সাইনবোর্ড। সেখানে লাল, সবুজ এবং কালো রঙের লেখা

সুরমা হোমিও হাসপাতাল
ডা. এ মল্লিক
এমডি
গোন্ড মেডেল (ডাবল)

মিসির আলি আজিজ মল্লিক সাহেবের বাড়ির একতলায় উত্তর পাশে গত এক বছর ধরে আছেন। গত এক বছরে তিনি রোগীর কোনো ভিড় লক্ষ করেন নি। তার ধারণা মানুষজন হােমিওপ্যাথি চিকিৎসার ওপর এখন আর তেমন ভরসা। করছে না।

রোগী না থাকলেও মল্লিক সাহেবের আর্থিক অবস্থা ভালো। তার ছয়টা সিএনজি বেবিট্যাক্সি আছে, চারটা রিকশা আছে। সম্প্রতি একটা ট্রাক কিনেছেন। আগারগাঁও বাজারে কাঁচ্চি বিরিয়ানির দোকান আছে। দোকানের নাম ‘এ মল্লিক কচ্চি হাউস’। কাঁচ্চি হাউসের বিরিয়ানির নামডাক আছে। সন্ধ্যাবেলা দুই হাঁড়ি কচ্চি বিরিয়ানি রান্না হয়। রাত আটটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে। দু’জনেরই বিয়ে হয়েছে। তারা বউ-বাচ্চা নিয়ে বাবার সঙ্গে থাকে। দু’জনের কেউ কিছু করে না। তাদের প্রধান কাজ, বাচ্চা কোলে নিয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করা। বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া। দুই ভাইয়ের মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা। তারা যখন রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে একসঙ্গে করে। চায়ের দোকানে সবসময় পাশাপাশি বসে চা খায়। পরিচিত কাউকে দেখলে দুই ভাই একসঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলে। তারা তাদের বাবার ভয়ে যেমন অস্থির থাকে, পরিচিতদের ভয়েও অস্থির থাকে।

সকাল আটটা। মল্লিক সাহেব মিসির আলির ঘরে বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি। চেহারা বিশেষত্বহীন। নাকের নিচে পুরুষ্ট গোফ আছে। মাথা কামানো। তার চেহারা, চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গিতে কার্টুনভাব আছে। মল্লিক সাহেবকে আজ অত্যন্ত গম্ভীর দেখাচ্ছে। দ্রুত পা নাচাচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে গেছে কিংবা এখনো যাচ্ছে। মল্লিক সাহেব মানুষটা ছোটখাটো। রাগে ও উত্তেজনায় তিনি আরও ছোট হয়ে গেছেন। তাঁর শোবার ঘর থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডেল চুরি গেছে। তার ধারণা টাকাটা দুই ছেলের কোনো-একজন নিয়েছে। রাগ ও উত্তেজনার প্রধান কারণ এইটাই। এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়, তিনি তা জানতে এসেছেন। মিসির আলির বিচার-বুদ্ধির ওপর তার আস্থা আছে।

মিসির আলি সাহেব।

জি।

ব্যবস্থা করে দেন।

কী ব্যবস্থা করব?

আমি আমার এই দুই বন্দপুত্রকে শায়েস্তা করব। এই দুইজনকে ন্যাংটা করে বাড়ির সামনে যে সাইনবোর্ড আছে, সেই সাইনবোর্ডের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখব। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা এই অবস্থায় থাকবে। এটা আমার ফাইনাল ডিসিশান।

মিসির আলি বললেন, চা খান। একটু চা দিতে বলি?

আজিজ মল্লিক বললেন, এই দুই বদকে শিক্ষা না দিয়ে আমি কিছু খাব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখনো নাশতা খাই নাই। এরা কত বড় বদ চিন্তা করেনবাপের টাকা চুরি করে ? কোনো আয় নাই, রোজগার নাই, দুইজনে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে। বউ-বালবাচ্চা নিয়ে বাপের ঘরে খায়, আবার বাপের টাকা চুরি করে।

আপনি কি নিশ্চিত যে, এরাই টাকা চুরি করেছে?

অবশ্যই। কাগজ কলম আনেন লিখে দেই।

চুরিটা কে করেছে? বড়জন, না ছোটজন?

দুই ভাই একসঙ্গে মিলে করেছে। এরা যা করে একসঙ্গে করে। এখন শাস্তিও একসঙ্গে হবে। থাক ন্যাংটা হয়ে।

মিসির আলি বিনীতভাবে বললেন, ভাই সাহেব, এক কাপ চা আমার সঙ্গে খান। জসু খুব ভালো রং চা বানায়।

আপনাকে তো একবার বললাম, দুই কুসন্তানকে শাস্তি না দিয়ে আমি কিছু খাব না। এক জিনিস বারবার কেন প্যাঁচাচ্ছেন?

সরি।

ইংরেজি এক কথা সবাই শিখেছে-‘সরি’। সরি দিয়ে কী হয়? সরি বলে কিছু নাই। পাপ করবে। পানিশমেন্ট হবে। সরি আবার কী?

মল্লিক সাহেব পুত্রদের সন্ধানে বের হয়ে গেলেন। তাদের কাউকে পাওয়া গেল না। এরা সকালবেলাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। দোতলা থেকে মেয়েদের কান্নার শব্দ আসতে লাগল। নিশ্চয়ই ছেলেদের দুই বউ কাঁদছে। জসু এসে খবর দিল-মল্লিক সাহেব ছেলের বউদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন বলেই কান্নাকাটি শুরু হয়েছে।

দুপুরের মধ্যে বাড়ি খালি হয়ে গেল। ছেলের বউরা কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেল। তাদের পেছনে পেছনে গেলেন মল্লিক সাহেবের স্ত্রী (দ্বিতীয়জন, প্ৰথমজন মারা গেছেন), তার কাজের দুই মেয়ে। মল্লিক সাহেব উঠানে দাঁড়িয়ে চোঁচাতে লাগলেন, যারা গেছে তারা যদি ফিরে আসতে চায় তাহলে তাদের এই উঠানে দশবার করে কান ধরে উঠবোস করতে হবে। কান ধরে উঠবোস, তারপর বাড়িতে ঢোকার টিকিট। আমি এ মল্লিক। আমার কথাই এ বাড়িতে আইন।

মিসির আলি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে এ মন্ত্রিক পরিবারের সদস্যদের বিদায়-দৃশ্য দেখছেন। এই দৃশ্য তাঁর কাছে নতুন না। আগেও দু’বার দেখেছেন।

জসু ঘুমিয়ে পড়েছে

রাত দশটা। জসু ঘুমিয়ে পড়েছে। সদর দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। দরজা খোলা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। ‘বৃষ্টিকণিকা নিয়ে ঠান্ডা বাতাসের আগমন’ এই বাক্যটা মিসির আলির মাথায় ঘুরছে। মাঝে মাঝে গানের কলি মাথায় ঢুকে যায়। সারাক্ষণ বাজতে থাকে। এই বাক্যটাও সেরকম। মিসির আলি বাক্যটা মাথা থেকে দূর করতে চাচ্ছেন। অ্যান্টিমেটারের জগৎ নিয়ে লেখা বইটা পড়বেন। মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। কোনো একটা বাক্য মাথার ভেতর ঘুরলে মাথা ঠান্ডা থাকে কীভাবে?

মিসির আলি সাহেব, জেগে আছেন?

মল্লিক সাহেবের গলা। মিসির আলি বললেন, জেগে আছি।

আপনার দরজা খোলা। আমি ভাবলাম দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি আজিব আদমি। আপনার পক্ষে সবই সম্ভব।

মল্লিক সাহেব! ভেতরে আসুন।

ভেতরে আসব না। দরজা বন্ধ করুন, আমি চলে যাব। দরজা খোলা রেখে ঘুমানো ঠিক না। চোর এসে সাফা করে দিয়ে যাবে। ভালো কথা, আপনার কাজের ছেলে জসু কি জেগে আছে?

জি-না। কেন বলুন তো?

এক ভয় ভয় লাগছে। সে জেগে থাকলে তাকে নিয়ে যেতাম।

বলতে বলতে মল্লিক সাহেব ঘরে ঢুকলেন। মিসির আলির বিছানার পাশে রাখা কাঠের চেয়ারে বসলেন।

মিসির আলি বললেন, চা খাবেন? একটু চা করি।

চা খাওয়া যায়।

মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। মল্লিক সাহেব বললেন, আপনি কেন যাচ্ছেন? জসুকে পাঠান।

বেচারা আরাম করে ঘুমাচ্ছে।

মুনিবের প্রয়োজন আগে, তারপর নফরের ঘুম। পাছায় লাত্থি দিয়ে এর ঘুম ভাঙান।

মিসির আলি কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। একবার ভাবলেন বলেন, মুনিব-নফরের বিষয়টা ঠিক না। অল্পদিনের জন্যে আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি। এখানে আমরা সবাই নফর। মুনিব কেউ না। যদিও রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা, আমরা সবাই রাজা। কিছুই বলা হলো না। উচ্চমার্গের কথা মল্লিক সাহেবের সঙ্গে বলা অর্থহীন। মল্লিক সাহেবের অবস্থান নিম্নমার্গে।

মল্লিক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চা ভালো বানিয়েছেন। বাংলাদেশ চায়ের দেশ। এখানে কেউ চা বানাতে পারে না। সবাই বানায় পিশাব। দিনে আট-দশ কাপ পিশাব খাই।

আপনার নাতির খবর কী?

কোন নাতি? নাতি তো একটা না, এক হালি।

আমি তো জানতাম দুই ভাইয়ের দুই ছেলে।

ভুল জানতেন। এরা দুই ছেলে কোলে নিয়ে ঘুরে, মেয়ে দুইটা ঘরে থাকে। এখন বলেন কোনটার কথা জানতে চান?

যার নিউমোনিয়া হয়েছিল।

ও আচ্ছা, কিসমতের কথা জানতে চান? আমি কোনো খবর জানি না। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর আর খোঁজ নেই নাই।

ওরা টেলিফোন করে নাই?

আমাকে কি টেলিফোন করার সাহস এদের আছে? আমার গলার শব্দ শুনলে পিশাব করে দেয়, এমন অবস্থা।

বলেন কী?

এইটা আমরা বংশপরম্পরায় পেয়েছি। আমার বাবার খড়মের শব্দ শুনলেও আমি দৌড়ে পালাতাম। দুই একবার প্যান্টে ‘ইয়েও’ করেছি।

মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে দুটা মনে হয় সেরকম হবে না। তারা সারাক্ষণই বাচ্চাদের কোলে নিয়ে থাকে।

এই দুই গাধার কথা তুলবেন না। এদের নাম শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায়।

মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে দুটার নাম কি আপনার দেওয়া?

আর কে দেবে? নাম ভালো দিয়েছি না? একজন ছক্কা আরেকজন বক্কা। ছক্কা বড়, বক্কা ছোট।

মিসির আলি বললেন, নাম দেওয়া থেকেই বোঝা যায় আপনার ছেলে দু’জনের জন্যে মমতা নাই।

মল্লিক সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, ওদেরও নাই। নাই-এ নাই-এ কাটাকাটি। আরেক কাপ চা খাব, যদি আপনার তকলিফ না হয়।

আমার তকলিফ হবে না। আপনি আরাম করে চা খাচ্ছেন দেখে ভালো লাগছে।

মল্লিক সাহেব বললেন, আপনার বসার ঘরের সোফায় আমি যদি শুয়ে থাকি তাহলে সমস্যা হবে?

মিসির আলি বললেন, কোনো সমস্যা হবে না। তবে ভাই, আমার বসার ঘরে সোফা নাই।

সোফা আমি আনায়ে নিব।

মিসির আলি এখন বুঝতে পারছেন, মল্লিক সাহেব তাঁর এখানে থাকতে এসেছেন। ‘সদর দরজা খোলা’ এই সাবধান বাণী ঘরে ঢোকার অজুহাত।

মল্লিক সাহেবের তাঁর ঘরে রাত্রিযাপনের বিষয়টা মিসির আলির কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। একা ঘুমাতে ভয় পাচ্ছেন, তা ঠিক আছে। খালি বাড়িতে অনেকেই একা ঘুমাতে ভয় পায়। কিন্তু মল্লিক সাহেবের বাড়ি খালি না। পরিবারের লোকজন চলে গেলেও অনেকেই এখনো আছে। বাড়ির দারোয়ান আছে, কাজের লোক আছে।

দ্বিতীয় কাপ চা মল্লিক সাহেব আগের মতোই তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। এর মধ্যে তাঁর লোকজন বসার ঘরে সোফা নিয়ে এসেছে। বালিশ চাদর এনেছে। মল্লিক সাহেব সব ব্যবস্থা করেই এসেছেন।

মিসির আলি বললেন, আপনি কি বিশেষ কোনো কারণে বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন?

মল্লিক সাহেব হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

কারণটা বলতে চাইলে বলতে পারেন।

বলতে চাই না।

তাহলে চা শেষ করে শুয়ে পড়ুন। আপনার সকাল সকাল ঘুমানোর অভ্যাস।

সবদিন সকাল সকাল ঘুমাই না। মাঝে মাঝে রাত জাগি। সারা রাতই জেগে থাকি।

আজ কি সারা রাত জাগিবেন?

হুঁ। আপনি ঘুমায়ে পড়েন।

মিসির আলি বললেন, সময় কাটানোর জন্য আপনাকে বই দেব?

গল্প-উপন্যাস আমি পড়ি না। বানানো কিচ্ছাকাহিনি। কথায় কথায় প্ৰেম। গল্প-উপন্যাস পড়লে মনে হয় দেশে প্রেমের হাট বসে গেছে। স্কুলে প্ৰেম, কলেজে প্রেম, ইউনিভার্সিটিতে প্ৰেম, অফিসে প্ৰেম, আদালতে প্রেম। ফালতু বাত।

মিসির আলি বললেন, প্রেম ছাড়াও আমার কাছে বিজ্ঞানের কিছু সহজ বই আছে।

মল্লিক সাহেব বললেন, বিজ্ঞান তো আরও ফালতু। আমাকে বইপত্র কিছু দিতে হবে না। আপনি আপনার মতো ঘুমান। আপনাকে শুধু একটা কথা বলে রাখি, ছক্কা-বক্কা এই দুইয়ে মিলে আমাকে খুন করবে। যদি খুন হই পুলিশের কাছে এদের নামে মামলা দিবেন।

মিসির আলি বললেন, পুলিশ আমার কথায় তাদের আসামি করবে না।

টাকা খাওয়ালেই করবে। টাকা খাওয়াবেন। আমি চাই ছক্কা-বক্কা দুইটাই যেন ফাঁসিতে ঝুলে।

আপনি যে-কোনো কারণেই হোক উত্তেজিত হয়েছেন। ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালো ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এই দুই ভাই সাক্ষাৎ শয়তান। বুঝার উপায় নাই। নিজের মাকে মেরেছে। ধাক্কা দিয়ে কুয়াতে ফেলে মেরেছে। প্রথমে বুঝতে পারি নাই। মামলা মোকদ্দমা হয় নাই। কীভাবে হবে বলেন! দুই ভাই কেঁদে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলেছিল। কিছুক্ষণ পর পর ফিট মারে। উপায়ান্তর না দেখে দুইজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম, তখন তো জানি না। দুই ভাই মিলে এই কীর্তি করেছে।

যখন জানলেন তখন পুলিশের কাছে গেলেন না কেন?

ছয় বছর পর জেনেছি। ছয় বছর আগের ঘটনা পুলিশ মুখের কথায় বিশ্বাস করবে। কেন? তারপরও বলেছি। রমনা থানার ওসি বাড়িতে এসেছেন। দুই ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুই ভাই চিৎকার করে এমন কান্না শুরু করল, বাড়িতে কাজ-কাম থেমে গেল। কাঁদতে কাঁদতে দুই জনই ফিট। ওসি সাহেব তখন তাদের উল্টা সাত্ত্বনা দেয়। বলে কী, তোমাদের বাবার বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঢুকে। তোমরা কিছু মনে নিয়ে না। আমাকে তিনি যখন বললেন তখনো বিশ্বাস করি নাই। ছেলের হাতে বাবা সম্পত্তির কারণে খুন হন। মা কখনো না।

মিসির আলি বললেন, আপনি কীভাবে জানলেন ছেলেরা মাকে খুন করেছে?

তাদের মা আমাকে বলেছে।

মৃত মা বলেছে?

জি। আমার একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা আপনাকে বলা হয় নাই। আমি মাঝে মধ্যে মৃত মানুষ দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে বাত-চিতও করি।

ও আচ্ছা।

আমার কথা মনে হয় এক ছটাকও বিশ্বাস করেন নাই।

মিসির আলি বললেন, শুরুতে আমি সবার কথাই বিশ্বাস করি। অবিশ্বাস পরের ব্যাপার।

মৃত মানুষদের সঙ্গে যে আমার কথাবার্তা হয়, এটা বিশ্বাস করেছেন?

জি বিশ্বাস করছি। এটা এক ধরনের ডিলিউশন।

ডিলিউশন জিনিসটা কী?

ভ্ৰান্ত ধারণা। যে ধারণার শিকার সে মানসিক রোগী। আমরা সাইকোলজিষ্টেরা মনে করি তার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।

মল্লিক সাহেব ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, আমার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।

মল্লিক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি, এখন চলে যাব। দরজা বন্ধ করে দেন, আমি নিজের বাড়িতে থাকব।

আমার এখানে থাকবেন না?

না।

জসুকে কি তুলে দিব? আপনার সঙ্গে ঘুমাবে?

প্রয়োজন নাই। নবাবের বাচ্চা ঘুমাইতেছে ঘুমাক।

আপনি মনে হয় আমার ওপর রাগ করেই চলে যাচ্ছেন।

কিছুটা রাগ করেছি। এখন বিশ্বাস পরে অবিশ্বাস, এটা কেমন কথা? আমার দুই পুত্ৰ যে আমাকে নিয়ে নানান কথা ছড়ায়, এটা নিশ্চয় জানেন?

জানি না।

আপনাকে কখনো কিছু বলে নাই?

জি-না। তাদের সঙ্গে আমার কখনো কথাবার্তা হয় না। এদের দূর থেকে দেখি।

এরা আমার বিষয়ে ছড়ায়েছে যে, আমাকে নাকি দুটা করে দেখে।

মিসির আলি বললেন, দুটা মানে বুঝলাম না।

মল্লিক বললেন, দুইজন আমি আমার ঘরে বসে আছি। এই রকম। সত্য কখনো কেউ বিশ্বাস করে না। অসত্য কথা, ভুল কথা, বানোয়াট কথা সবাই বিশ্বাস করে। এই দুই কুপুত্রের কারণে সবাই বিশ্বাস করে দুইজন মল্লিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ও আচ্ছা

এত বড় একটা কথা বললাম, আপনি ‘ও আচ্ছা’ বলে ছেড়ে দিলেন? আপনি কি আমার দুই কুপুত্রের কথা বিশ্বাস করেছেন?

না।

মল্লিক সাহেব বললেন, সব কথাই আপনি প্রথমে বিশ্বাস করেন, এই কথাটা কেন করলেন না?

মিসির আলি বললেন, বিশ্বাস করি নি, কারণ আমি দুইজন মল্লিককে দেখছি না। তা ছাড়া আপনার দুই পুত্রের কেউ আমাকে এ ধরনের কথা বলে নি।

তারা যদি বলত, আপনি বিশ্বাস করতেন?

প্ৰথমে অবশ্যই বিশ্বাস করতাম। তারপর চিন্তা-বিশ্লেষণে যেতাম। অ্যারিস্টটল একবার বললেন, মানুষের মস্তিষ্ক রক্ত পাম্প করার যন্ত্র। এক শ বছর মানুষ তা-ই বিশ্বাস করেছে। এক শ বছর পর অবিশ্বাস এসেছে।

অ্যারিস্টটল লোকটা কে?

একজন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী।

দার্শনিক, বিজ্ঞানী সবই ফালতু।

আপনার কাছে মনে হতে পারে।

মল্লিক সাহেব হঠাৎ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছু সময়ের জন্যে ঝিম ধরে গেলেন।

মিসির আলি বললেন, একটা সিগারেট কি খাবেন?

মল্লিক সাহেব বললেন, না। নিজের ঘরে গিয়ে আরাম করে সিগারেট খাব। আপনার এখানে না। আপনাকে শেষ কথা বলি—আমি কিন্তু সত্যি মৃত মানুষ দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলি। আপনার ঘরেও একজন মৃত পুরুষ দেখি। হাবে-ভাবে মনে হয়। সে আপনার পিতা।

ও আচ্ছা।

মল্লিক সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, এত বড় একটা কথা বললাম, আর আপনি ও আচ্ছা’ বলে ছেড়ে দিলেন? আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসাই ভুল হয়েছে।

মল্লিক সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। তিনি ছাতা নিয়ে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় ছাতা ছাড়াই বৃষ্টিতে নেমে গেলেন।

মল্লিক সাহেবের আর কোনো খোজ-খবর পরের এক মাসে পাওয়া গেল না। জলজ্যান্ত একজন মানুষ পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছক্কা-বক্কা দুই ভাই পরিবার নিয়ে ফাঁকা বাড়িতে ফিরে এল। আবার তাদের দু’জনকে ছেলে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেল। বাবার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, এতে তাদের দুঃখিত বা চিন্তিত মনে হলো না। মল্লিক পরিবারের সব কর্মকাণ্ড আগের মতোই চলতে লাগল। বক্কার ছোট ছেলের আকিকার অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হলো। আকিকা হলো। জসুকে আকিকার মাংস দেওয়া হলো।

বক্কার ছোট ছেলের নাম রাখা হলো, সৈয়দ শাহ আমিনুর রহমান বখতিয়ার খিলজি’।

ওজনদার নাম রাখতে পারার আনন্দে বক্কাকে অভিভূত বলে মনে হলো।

মল্লিক সাহেবের দুই পুত্ৰ

মল্লিক সাহেবের দুই পুত্ৰ মিসির আলির সামনে বসে আছে। তাদের বসার ভঙ্গি আড়ষ্ট, দৃষ্টি এলোমেলো। তবে এলোমেলো দৃষ্টিতেও শৃঙ্খলা আছে। এক ভাই ছাদের দিকে তাকালে, অন্য ভাইও ছাদ দেখে। ছাদ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একজন যদি জানোলা দিয়ে তাকায়, অন্যজনও জানালার দিকে তাকায়। কে কাকে অনুসরণ করছে? মিসির আলির কাছে স্পষ্ট না। কেউ কাউকে অনুসরণ করছে এ রকমও মনে হচ্ছে না। সম্ভবত যা করছে একসঙ্গে করছে।

দুই ভাইয়ের চেহারায় কোনো মিল নেই। বড়ভাই (শফিকুল গনি ছক্কা) শ্যামলা, মোটাসোটা, বেঁটে। ছোটভাই (আবদুল গনি বক্কা) ফর্সা, রোগা পাতলা এবং লম্বা। দু’জনেরই গোফ আছে। লুঙ্গির ওপর হাফ হাতা শার্ট। একই রঙের লুঙ্গি (সবুজ), একই রঙের শার্ট (কমলা)। মিসির আলি মনে করার চেষ্টা করলেন এরা আগেও মিল করে শার্ট পরত কি না। তাদের জুতাও একই রকম-কালো রাবারের জুতা।

শফিকুল গনি বলল, চাচা, ভালো আছেন? মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।

আবদুল গনি বলল, একটা কাগজ আপনাকে দেখাতে এনেছি। আপনার পরামর্শ দরকার।

মিসির আলি বললেন, কাগজ দেখাও।

দুই ভাই চুপ করে বসে রইল। কোনো কাগজ বের করল না। দু’জনই ডান পা নাচাচ্ছে এবং অতি দ্রুত নাচাচ্ছে। মিসির আলি এর আগে কাউকে এত দ্রুত পা নাচাতে দেখেন নি।

শফিকুল গনি বলল, একটা হ্যান্ডবিল ছাপাব, লেখা ঠিক আছে কি না। যদি দেখে দেন।

মিসির আলি বললেন, দেখে দিব। কাগজটা দাও।

এবারও কাগজ বের হলো না। দুই ভাই আগের নিয়মে পা নাচাচ্ছে, তবে এবার নাচাচ্ছে বা পা। মিসির আলি কাগজের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছেন এই দুই ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী কি না। সম্ভাবনা প্রবল। কাগজটা দেখে দিন বলার পরও তারা কাগজ বের করছে না-এটা মানসিক ক্ষমতার অভাবই বোঝায়।

তোমরা চা খাবে?

দু’জন একই সঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ল।

তোমাদের বাবার কোনো খোঁজ কি পাওয়া গেছে?

দু’জন আবারও একই সঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ল।

কাগজের কথা বলছিলে, কাগজটা কি আসলেই দেখাবে?

দু’জন একই সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল, তবে কাগজ বের করল না।

জসু ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। ট্রেতে তিন কাপ চা। দুই ভাই আগে চা খাবে না। বলেছে, এখন দু’জন একই সঙ্গে অতি দ্রুত চায়ের কাপ নিল এবং অতি দ্রুত চা শেষ করল। প্রায় শরবত খাওয়ার মতোই বড় বড় চুমুক দিল। মিসির আলি এই দুই ভাইয়ের মতো এত দ্রুত গরম চা কাউকে খেতে দেখেন নি।

শেষ পর্যন্ত ছোটভাই আবদুল গনি বক্কার শার্টের পকেট থেকে কাগজ বের হলো। পরিষ্কার ঝকঝকে হাতের লেখা। মানসিক প্রতিবন্ধীদের হাতের লেখা সুন্দর হয়। মিসির আলি বিজ্ঞাপনটা দু’বার পড়লেন।

সন্ধান চাই

আমাদের পিতাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ সন্ধান দিলে তাকে কুড়ি হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দেওয়া হইবে। কোনো পুলিশ ভাই যদি সন্ধান দেন, তিনিও পুরস্কারের দাবিদার হবেন। যদি কয়েকজন একত্রে সন্ধান দেন, তবে পুরস্কারের টাকা সমভাবে তাহদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এই নিয়ে কোনো বিবাদ বিসংবাদ করা যাইবে না।

বিবাদ উপস্থিত হইলে আমাদের দুই ভাইয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গণ্য হইবে।

ইতি
শফিকুল গনি ছক্কা (বড়ভাই)
আবদুল গনি বক্কা (ছোটভাই)

মিসির আলি বললেন, হ্যান্ডবিলে কি তোমাদের বাবার ছবি যাবে?

জি-না, ছবি পাওয়া যায় নাই।

ছবি না পেলে তার একটা বৰ্ণনা দিতে হবে। তা না হলে মানুষ বুঝবে কীভাবে এ মল্লিক দেখতে কেমন। তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম আছে, কিন্তু ঠিকানা কোথায়?

শফিকুল গনি বলল, ঠিকানা ইচ্ছা করে দেই নাই। ঠিকানা দিলে বাজে লোক ঝামেলা করবে। বলবে, এই জায়গায় দেখেছি। ওই জায়গায় দেখেছি।

মিসির আলি বললেন, ঠিকানা ছাড়া তোমাদের সন্ধান দিবে কীভাবে?

আবদুল গনি বলল, সন্ধান না দিলেও অসুবিধা হবে না।

মিসির আলি বললেন, আমি তোমাদের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমাদের কাছে যদি মনে হয় বিজ্ঞাপন ঠিক আছে তাহলে ঠিক আছে।

দুই ভাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তাদের আনন্দিত মনে হচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, যে সোফাটায় তোমরা এতক্ষণ বসে ছিলে সেটা তোমাদের। কাউকে পাঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।

শফিকুল গনি বলল, চাচাজি। এটা আপনার কাছে রেখে দিন। এটা আমার বাবার একটা স্মৃতি।

মিসির আলি বললেন, স্মৃতি বলছ কেন? তোমরা কি নিশ্চিত তিনি মারা, গেছেন?

দুই ভাই একসঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মৃত যদি তোমরা জানো তাহলে সন্ধান চেয়ে হ্যান্ডবিল ছাপাচ্ছ কেন?

শফিকুল গনি বলল, কেউ যেন না ভাবে আমরা সন্ধান করি নাই। চাচাজি যাই।

তোমরা হ্যান্ডবিলে ঠিকানা দাও নাই, এটা লোকজনের চোখে পড়বে না?

আবদুল গনি বলল, এটা নিয়ে কেউ কিছু মনে নিবে না। সবাই জানে আমরা বোকা।

মিসির আলি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তিনি ব্যক্তিগত কথামালার খাতা খুললেন। ছক্কা-বক্কা দুই ভাই’ শিরোনামে কিছুক্ষণ লিখলেন। তাঁর লেখা—

ছক্কা বক্কা দুই ভাই

বাবা-মায়ের উদ্ভট মানসিকতার কারণে অনেক সন্তানদের উদ্ভট ডাকনাম নিয়ে সমাজে বাস করতে হয়। আমার জানা মতে, কিছু উদ্ভট ডাকনাম–নাট-বল্টু (দুই যমজ ভাই। বাবা বুয়েট থেকে পাস করা আর্কিটেক্ট)

ডেঙ্গু (এক ডাক্তার বাবার পুত্রের নাম)

অংক, মানসংক (বাবা স্কুলের অংক শিক্ষক। অংক ছেলের নাম, মানসংক মেয়ের নাম)

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ছক্কা-বক্কা সম্পর্কে বেশি কিছু তিনি জানেন না।

জসুর কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। বুদ্ধি বিষয়ক তথ্য, তবে এই তথ্য ঘোলাটে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছক্কা-বক্কা এই দুই ভাইয়ের বুদ্ধি কেমন?

জসু বলল, দুই ভাই যখন একত্রে থাকে তখন বুদ্ধি নাই। আলাদা যখন থাকে তখন বেজায় বুদ্ধি।

আলাদা কখন থাকে? দুপুরে দুই ভাই দেখি কলপাড়ে একসঙ্গে গোসল করে।

জসু বলল, মাঝেমধ্যে আলাদা হয়। ধরেন, বড়ভাইরে তার পরিবার ডাক দিল। সে চইল গেল। তখন ছোটভাই একলা।

মিসির আলি বললেন, এরা নাকি তাদের বাবাকে দুটা করে দেখে। এমন কিছু শুনেছিস?

শুনেছি। শুধু এই দুইজনই না। তাদের পরিবারও দেখেছে। ছোটভাইয়ের বউ একবার দুই শ্বশুর দেইখা ফিট পড়েছে। খাটের কোনায় লাইগা মাথা ফাটছে। হাসপাতালে নিতে হইছে। তয় এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর ফিট পড়ে না।

একই মানুষকে দু’জন দেখা বিষয়টাকে মিসির আলি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অপটিক্যাল হেলুসিনেশন। দৃষ্টি বিভ্রম। এই দুই ভাই তাদের দৃষ্টি বিভ্রম স্ত্রীদের কাছেও ছড়িয়ে দিয়েছে। সাইকোলজির পরিভাষায় এর নাম Induced hallocination

দৃষ্টি বিভ্রমের বড় শিকার স্কিজোফ্রেনিক রোগীরা। তাদের ব্রেইন কাল্পনিক ছবি তৈরি করে। রোগীরা সেই ইমেজ সত্যি মনে করে। তারা যে বাস্তবতায় বাস করে তার নাম Distorted reality.

স্কিজোফ্ৰেনিক রোগীদের ধর্মকর্মে প্রবল আসক্তি থাকে। এই দুই ভাইয়ের তা আছে। সারা দিন এরা নামাজ পড়ে না। সন্ধ্যার পর বারান্দায় জয়নামাজ বিছিয়ে বসে। অনেক রাত পর্যন্ত নামাজ পড়ে। জিকির করে।

মিসির আলি জসুকে জিজ্ঞেস করলেন, এই দুই ভাই মানুষ কেমন?

জসু বলল, অত্যধিক ভালো। সবার সাথে তাদের মধুর ব্যবহার। একটা ঘটনা বললে বুঝবেন। এই দুই ভাই গলির সামনের স্টলে চা খাইতেছে, এমন সময় আমি সামনে দিয়া যাই! বড়ভাই আমারে হাত উচায়ে ডাকল। মধুর গলায় বলল, জসু! আমরার সাথে এক কাপ চা খাও। যদি না খাও মনে কষ্ট পাব। এই ঘটনা শুধু যে আমার জীবনে ঘটেছে তা না। অচেনা অজানা মানুষের সাথেও ঘটেছে। অনেক ফকির মিসকিনও দুই ভাইয়ের সঙ্গে চা খেয়েছে।

এই বিষয়টা স্কিজোফ্ৰেনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে কখনো ঘটে না। তারা কারও সঙ্গে মেশে না। আলাদা থাকে। তাদের বাস্তবতা আলাদা বলেই সাধারণ বাস্তবতার মানুষদের সঙ্গে মিশতে পারে না।

‘সন্ধান চাই? হ্যান্ডবিল ছাপা হয়েছে। হ্যান্ডবিলে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এ মল্লিক কচ্চি হাউসের ঠিকানা। হ্যান্ডবিল ফার্মগেটে বিলি হচ্ছে। কাচ্চি হাউসের কাস্টমারদেরও দেওয়া হচ্ছে।

ছাপা হ্যান্ডবিল নিয়ে দুই ভাই মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সেই আগের মতো অবস্থা। দু’জনের গায়েই এক রকম কাপড়। প্রথম দিনের মতোই দু’জন পা নাচাচ্ছে। সেই পা নাচানো অসম্ভব ‘সিনক্রানাইজড’। যেন একে অন্যের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে যুক্ত। বড়জনের ডান পা। যখন নাচছে, তখন ছোটজনের ডান পা-ই নাচছে। সামান্য এদিক-ওদিকও হচ্ছে না।

ছক্কা বলল, চাচাজি ভালো আছেন?

মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।

বক্কা বলল, বাবার কুলখানির তারিখ ফেলেছি। আগামী বিষু্যদবার বাদ মাগরেব। মিলাদ হবে, দোয়া হবে, এশার নামাজের পর বড়খানা।

ছক্কা বলল, বড়খানায় থাকবে মুরগির রোস্ট, কাঁচ্চি বিরিয়ানি আর বোরহানি।

মিসির আলি বললেন, মৃত্যু নিশ্চিত না করেই কি কুলখানি করা যায়?

বক্কা বলল, যায়। আমরা মুনশি-মৌলবির সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ ইচ্ছা করলে নিজের কুলখানির খানা খেতেও পারে।

ছক্কা বলল, চাচাজি, আপনি কি কুলখানিতে আসবেন?

মিসির আলি বললেন, না।

বক্কা বলল, সমস্যা নাই। টিফিন ক্যারিয়ারে করে আপনার আর জসুর খানা পাঠায়ে দিব।

মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি একদৃষ্টিতে দুই ভাইকে লক্ষ করছেন। তাদের অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করার চেষ্টা। ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করে রাখতে পারলে সুবিধা হতো। ভিডিও ক্যামেরা ছাড়াই মিসির আলি একটি বিষয় লক্ষ করলেন। এক ভাই যখন কথা বলে তখন অন্য ভাই ঠোঁট নাড়ে। যে কথা বলে তার দিকে দৃষ্টি থাকে বলে অন্যজনের ঠোঁট নাড়া চোখে পড়ে না।

ছক্কা বলল, চাচাজি, যদি অনুমতি দেন তাহলে উঠি। কাজকর্ম আছে।

মিসির আলি বললেন, অনুমতি দিলাম।

অনুমতি পাওয়ার পরেও দুই ভাইয়ের কেউই উঠছে না। বিরতিহীন পা নাচিয়েই যাচ্ছে। এখন দু’জনের দৃষ্টিই ছাদের দিকে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে—ছাদে বিশেষ কিছু ঘটছে। ভীতিপ্ৰদ কিছু। তারা দু’জনই ভয় পাচ্ছে। একজন আরেকজনের পাশে সরে এসেছে।

কুলখানি উপলক্ষে

বিষ্যুদবার। কুলখানি উপলক্ষে আসরের নামাজের পর থেকে বিপুল আয়োজন চলছে। মাদ্রাসার দশজন তালিবুল এলেম কোরান খতম দিচ্ছে। তালেবুল এলেমদের আরেকটি দল তেঁতুলের বিচি নিয়ে বসেছে। তারা খতমে জালালি নিয়ে ব্যস্ত।

এশার নামাজের পর বড়খানা শুরু হলো। জসু বিশাল টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে খাবার নিয়ে চলে এসেছে। তার চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল। সে শুধু খাবার নিয়ে আসে নি, খেয়েও এসেছে।

ঝড়-বৃষ্টির কারণে কুলখানির অনুষ্ঠান সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলো। রাত বারটা পর্যন্ত জিকিরের ব্যবস্থা ছিল। এগারটার মধ্যেই তালেবুল এলেমরা চলে গেল। মুনশি-মৌলবিরা খাওয়াদাওয়ার পরে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন।

মিসির আলি শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনা তার পছন্দের একটি বিষয়। দরজা ধাক্কানোর শব্দে তিনি জাগলেন। দরজা খুলে দেখেন রেইনকোট পরা মল্লিক সাহেব। মল্লিক সাহেব আহত গলায় বললেন, আমার দুই হারামজাদার কাণ্ড দেখেছেন!! বাপ জীবিত, তার কুলখানি করে বসে আছে।

মিসির আলি বললেন, ভেতরে আসুন।

মল্লিক ঘরে ঢুকলেন। মিসির আলি বললেন, আপনি বাড়িতে গিয়েছিলেন, নাকি সরাসরি আমার এখানে এসেছেন?

বাড়িতে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে আমার দুই পুত্র দুই দিকে দৌড় দিয়ে পালায়া গেছে।

আপনি ছিলেন কোথায়?

বিষয়সম্পত্তির দেখভালের জন্যে গিয়েছিলাম।

ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি?

বড়টার সাথে একবার মোবাইলে কথা হয়েছে। তারপরেও দুই কুলাঙ্গার কুলখানি করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।

কী মতলব থাকবে?

আমাকে খুনের পরিকল্পনা করেছে। সকালেই আমার মৃত্যুসংবাদ শুনবেন। কীভাবে মারবে তাও জানি। ধাক্কা দিয়ে কুয়াতে ফেলে দিবে।

মিসির আলি বললেন, আপনার কুয়ার মুখ তো বন্ধ। ফেলবে কীভাবে?

মল্লিক বললেন, এইটাই ঘটনা। ঘরে পা দিয়ে প্রথমেই গেলাম কুয়ার কাছে। মনে সন্দেহ, এইজন্যে গিয়েছি। গিয়ে দেখি কুয়ার মুখ খোলা। এরা কারিগর ডেকে খুলেছে।

মিসির আলি বললেন, বসুন, চা খান।

মল্লিক বললেন, চা খাব না। ক্লান্ত হয়ে এসেছি। স্নান করব, তারপর নিজের কুলখানির খানা খাব।

মিসির আলি বললেন, খাওয়াদাওয়ার পর যদি মনে করেন আমার সঙ্গে কথা বলবেন তাহলে চলে আসবেন। আমি জেগে থাকব।

আপনার জেগে থাকতে হবে না। আপনি ঘুমান। বটি হাতে নিয়ে আমি জেগে থাকব। দুইজনকে বটি দিয়ে কেটে চার টুকরা করব। কুয়ার ভেতর ফেলে কুয়া আটকে দিব। যেমন রোগ তেমন চিকিৎসা।

মিসির আলি বললেন, আপনি উত্তেজিত। উত্তেজনা কোনো কাজের জিনিস না। উত্তেজনা কমান। বসুন, গা থেকে রেইনকোট খুলুন। চা বানাচ্ছি, চা খান।

মল্লিক সাহেব গা থেকে রেইনকোটি খুললেন। হতাশ মুখে সোফায় বসলেন, নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, কেউ কোনোদিন শুনেছে ছেলে বাপ বেঁচে থাকতেই বাপের কুলখানি করে ফেলে? শুনেছে। কেউ? বাপের জন্মে। এই ঘটনা কখনো ঘটেছে?

চায়ে চুমুক দিয়ে মল্লিক সাহেব কিছুটা শান্ত হলেন।

মিসির আলি বললেন, আপনাকে মাঝে মাঝে ধূমপান করতে দেখি। উত্তেজনা প্রশমনে নিকোটিনের কিছু ভূমিকা আছে। একটা সিগারেট কি ধরাবেন?

বৃষ্টিতে সিগারেটের প্যাকেট ভিজে গেছে।

মিসির আলি তার প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। মল্লিক। সিগারেট ধরিয়ে আরও খানিকটা শান্ত হলেন। মিসির আলি বললেন, কখন থেকে আপনার দুই ছেলে আপনার কাছে অসহ্য হয়েছে?

মল্লিক বললেন, যখন বড়টার বয়স পাঁচ আর ছোটটার তিন।

তারা করত কী?

আমার সামনে যখন দাঁড়িয়ে থাকত তখন আমার দিকে তাকাত না। দুইজনেই আমার দুই ফুট দূরে, আমার ডানদিকে তাকায়ে থাকত। আমি কোনো প্রশ্ন করলে সেই দিকে তাকিয়েই উত্তর দিত।

এই কাজ কেন করত। জিজ্ঞেস করেন নাই?

করেছি। একবার না, অনেকবার করেছি।

তাদের জবাব কী?

তারা নাকি দুইজন বাবা দেখে। একটা বাবা খারাপ, একটা ভালো। তারা তাকিয়ে থাকে ভালো বাবার দিকে।

আপনি তাহলে তাদের কাছে খারাপ বাবা?

হুঁ। যতবার দুই ভাই এই রকম কথা বলেছে ততবার এদের শক্ত মাইর দিয়েছি। একবার তো বড়টার গলা চিপে ধরলাম। গো গো শব্দ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি ভাবলাম, মরে গেছে। কিছুক্ষণ পর উঠে বসে চি চি করে বলে, বাবা, পানি খাব।

আপনার দিকে তাকিয়ে কি বলেছে?

না, ওই যে বললাম, দুই ফুট দূরে তাকায়। আমার ডানে।

এরা দু’জন দেখি সবসময় একই রকম কাপড় পরে। এটা কখন থেকে শুরু হলো?

মল্লিক সাহেব হতাশ গলায় বললেন, তারা দু’জন যে শুধু একই রকম কাপড় পরে তা না, তাদের বউ দুইটারও একই চেহারা। যমজ বোন। একটার নাম পারুল, আরেকটার নাম চম্পা। বুঝার উপায় নাই, কোনটা কে। আমি কোনোদিনই বুঝি না। আমার ধারণা, আমার দুই বদ পোলাও জানে না কোনটা কে?

পুত্রবধূদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

খারাপ।

কতটা খারাপ?

পারুলকে আমি ডাকি বড় কুত্তি, চম্পাকে ডাকি ছোট কুত্তি। এখন বুঝে নেন সম্পর্ক কত খারাপ। এদের স্বভাব চরিত্রও কুত্তির মতো। কেন তা বলব না। শ্বশুর হয়ে পুত্রবধূদের বিষয়ে নোংরা কথা বলা যায় না।

মল্লিক উঠে দাঁড়ালেন, মিসির আলিকে কোনো কিছু না বলেই হঠাৎ করে বের হয়ে গেলেন। ঘুমুতে যাওয়ার আগে মিসির আলি ব্যক্তিগত কথামালার খাতা খুলে কিছুক্ষণ লিখলেন–

ছক্কা-বক্কা এবং তাদের বাবার ব্যাপারে আমি কিঞ্চিৎ আগ্ৰহ বোধ করছি। তাদের পুরো কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অসুস্থতা আছে। ছেলে দুটি মানসিক রোগগ্ৰস্ত, নাকি তাদের বাবা? বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার না। মন্ত্রিক সাহেবের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাঁর পুত্রবধূদেরও কিছু সমস্যা আছে।

দুটি ছেলেই বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। সেটাই স্বাভাবিক। যে বাবা শাস্তি হিসেবে গলা চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলেন, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই।

এমন কি হতে পারে, বাবাকে অসম্ভব ভয় পায় বলেই এরা অন্য এক বাবাকে কল্পনা করেছে, যে বাবা ভালো, স্নেহময়? কল্পনার সেই বাবা, খারাপ বাবার ডানদিকে দুই ফুট দূরত্বে থাকেন। মস্তিষ্ক চাপ সহ্য করতে পারে না। চাপ মুক্তির পথ খোজে। একটি ভালো বাবা কল্পনা করে নেওয়া চাপমুক্তির পথ।

দুটি ছেলেই অন্তর্মুখী। এদের পক্ষে দুই যমজ বোনের প্রেমে পড়ে নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করা অসম্ভব। আমি নিশ্চিত, মল্লিক সাহেব দুই ছেলের বিয়ের জন্যে জমজ বোন খুঁজে বের করেছেন। তাঁর আগ্রহেই বিয়ে হয়েছে।

দুই ভাই একই পোশাক পরে। বিষয়টা তারা করেছে, না তাদের বাবা ঠিক করে দিয়েছে?

একই চেহারার দুই স্ত্রী যিনি ঠিক করে দিয়েছেন, তিনিই একই পোশাকের ব্যাপারটা করবেন। সাধারণ লজিক তা-ই বলে।

আরও রহস্য আছে। ছক্কা-বক্কা দু’জনেরই একটি করে ছেলে (যদিও মল্লিক বলেন তাদের চারটি সন্তান)। তাদের বয়স কাছাকাছি। দুই থেকে তিন বছর। বেশির ভাগ সময় তারা বাবার কোলে থাকে। দুই বাবাই সন্তান কোলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিহীন হাঁটাহাঁটি করেন। ছক্কার ছেলেই যে ছক্কার কোলে থাকে তা না, কখনো সে থাকে বক্কার কোলে। কে কার কোলে থাকবে তা নিয়ে ধরাবাধা কোনো ব্যাপার নেই। রহস্য হচ্ছে যখন যে শিশু যার কোলে থাকবে তাকেই বাবা ডাকবে।

মল্লিক সাহেব দাবি করেন, তিনি মৃত মানুষদের দেখতে পান। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন। একটি পরিবারের সবাই ডিলিউশনে ভুগবেন, এটাই বা কেমন কথা! কোনো পরিবারে একজন কঠিন মানসিক রোগী থাকলে তার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়বে। এটা স্বাভাবিক। তবে সুস্থ মানুষ কখনোই অসুস্থ হয়ে পড়বে না।

দুৰ্বোধ্য রহস্যের মুখোমুখি হলে বেশিরভাগ মানুষ এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে শেক্সপিয়ার আওড়ায়। দার্শনিক ভােব ধরে বলে–There are many things in heaven and earth…

মিসির আলি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। তিনি রহস্যের ভেতর ঢুকতে চাইছেন। দুই ভাইয়ের কাছ থেকে কয়েকটা জিনিস জানা তার খুবই প্রয়োজন। দুই ভাইকে তিনি পাচ্ছেন না। তারা সারা দিন নানান জায়গায় ঘোরে, গভীর রাতে বাবার কাঁচ্চি হাউসে ঘুমিয়ে থাকে।

মিসির আলি কয়েকবার তাদের খোজে জালুকে পাঠিয়েছেন। জসু তাদের পায় নি।

দুই ভাই বিষয়ে মল্লিক এক রাতে তথ্য দিলেন। মিসির আলিকে আনন্দের সঙ্গে জানালেন, ওরা হাজতে।

মিসির আলি বললেন, হাজতে কেন? কী করেছে?

নতুন কিছু করে নাই। পুরানো পাপে হাজত বাস করছে। রমনা থানার ওসি সাহেবকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেছি, দুজনকে ধরে নিয়ে যেন ভালোমতো ডলা দেওয়া হয়। তিন দিন হাজত বাস করে ফিরবে। শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা। এ রকম শিক্ষা সফর আগেও একবার করেছে।

আপনি ব্যবস্থা করেছেন?

হ্যাঁ, ওসি সাহেবের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। প্রায়ই ওনাকে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস উপহার হিসাবে পাঠাই। একবার পাঠিয়েছিলাম এক কলসি রাবরি। রাবরি চেনেন?

চিনি।

আরেকবার পাঠিয়েছিলাম এক শ একটা ডাব। ডাব পাঠানোর পর উনার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে। মাই ডিয়ার লোক। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। পুলিশের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো। কখন কোন কাজে লাগে। চা খাব, আপনার কাজের ছেলেটাকে সুন্দর করে এক কাপ চা বানাতে বলেন। বাসায় ঝামেলা, চা বানানোর অবস্থায় কেউ নাই বিধায় আপনার এখানে চা খেতে এসেছি।

মিসির আলি বললেন, কী ঝামেলা?

ছক্কার ছেলেটা মারা গেছে। নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা বুঝে না-বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক বিষ ছাড়া কিছু না।

মল্লিক। সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি বললেন, আপনার নাতি মারা গেছে, আর আপনি স্বাভাবিকভাবে গল্পগুজব করছেন?

মল্লিক বললেন, মৃত্যু হলো কপালের লিখন। দুঃখ করে লাভ কী? যত স্বাভাবিক থাকা যায় ততই ভালো।

মিসির আলি বললেন, ছক্কা কি তার ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানে?

মল্লিক বললেন, না। পুলিশের ডলা খেয়ে বাড়ি ফিরে জানবে। ডাবল অ্যাকশান হবে।

জসু চা বানিয়ে এনেছে। মল্লিক তৃপ্তি করেই চা খাচ্ছেন। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন মানুষটার দিকে।

মল্লিক সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে মিসির আলির দিকে খানিকটা ঝুকে এসে বললেন, আপনাকে বলেছি না। আপনার বাসায় একজন মৃত মানুষকে ঘোরাফিরা করতে দেখি?

জি বলেছেন।

এই মানুষটার পরিচয় জেনেছি। উনি আপনার পিতা।

ও আচ্ছা।

মল্লিক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, “ও আচ্ছা” বলে উড়ায়ে দিবেন না। উনি আমাকে বলেছেন, আপনি মহাবিপদে পড়বেন। গাড়ি চাপা পড়ে মারা পড়বেন। গাড়ির রঙ কালো। গাড়ি চালাবে অল্পবয়সী মেয়ে। বুঝেছেন?

জি।

সাবধানে থাকবেন। সাবধানে। সাবধানের কোনো মাইর’ নাই। কথায় আছে–

বামে না ডানে
চল সাবধানে।

আপনার পিতা আমাকে বলেছেন আপনাকে সাবধান করে দিতে। সাবধান করে দিলাম।

মিসির আলি খাতা খুলে বসেছেন

মিসির আলি খাতা খুলে বসেছেন। আজকের দিন শুরু করবেন ব্যক্তিগত কথামালায় এক পাতা লিখে। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, পিরিচে টোষ্ট বিস্কুট।। সকালের প্রথম চা। জসু পরোটা-ভাজি আনতে গেছে। সে নিজে ভালো পরোটা বানায়, তবে নিজের বানানো পরোটা সে খেতে পারে না। তার পরোটা-ভাজি সে দোকান থেকে কিনে আনে। দুপুরে প্রায়ই সে মল্লিক সাহেবের কাঁচ্চি হাউস থেকে খেয়ে আসে। কাঁচ্চি হাউসের লোকজন তাকে চেনে। জসুকে টাকা দিতে হয় না।

মিসির আলি লিখছেন–

নাতিদের প্রসঙ্গে মল্লিক সাহেব দু’বার আমাকে বলেছেন, তার এক হালি নাতি। দুই নাতি এবং দুই নাতনি।

আমি তাঁর দুই নাতির কথাই জানি। জসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেও দুই জনের কথাই বলছে।

মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে যেমন তাদের দুই বাবাকে দেখে, মল্লিক সাহেবও কি একইভাবে দুই নাতির জায়গায় চার নাতি দেখেন? বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। হাতে সময় আছে।

মল্লিক সাহেবের বাড়ির অবস্থা শান্ত। “পশ্চিম রণাঙ্গন নিচুপ’-টাইপ শান্ত। একটি শিশু মারা গেছে, তার প্রভাব কারও ওপরেই মনে হয় পড়ে নি। ছক্কা-বক্কা ছেলে কোলে নিয়ে আগের মতোই হাঁটাহাঁটি করছে। আগে দু’জনের কোলে দুটি ছেলে থাকত। এখন একজন ভাগাভাগি করে দু’জনের কোলে থাকছে।

সুরমা হোমিও হাসপাতালে মল্লিক সাহেব নিয়মিত বসা শুরু করেছেন। সুরমা তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম।

এই স্ত্রীকে মনে হয় মল্লিক সাহেব খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর বেবিটেক্সির প্রতিটির পেছনে লেখা, ‘সুরমা পরিবহন’।

মল্লিক সাহেবের প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো আমার হাতে নেই। মহিলা রূপবতী ছিলেন, সবসময় বোরকা পরে থাকতেন। ঘরের মধ্যেও বোরকা খুলতেন না।

এই বাড়ির সবকিছুই জট পাকিয়ে আন্ধা গিন্টু হয়ে আছে। এই জাতীয় আন্ধা গিন্টুর সুবিধা হচ্ছে, কোনোরকমে একটা গিন্টু খুলে ফেললে বাকিগুলি একের পর এক আপনাতেই খুলতে থাকে। আমাকে অবশ্যি গিন্টু খোলার দায়িত্ব কেউ দেয় নি। কর্মহীন মানুষ কর্ম খুঁজে বেড়ায়। আমার মনে হয় এই দশাই চলছে।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ঠান্ডা সরপড়া চায়ে চুমুক দিলেন। তাঁর মুখ সামান্য বিকৃতও হলো না। নিজের মনেই ভাবলেন, এক ধরনের নির্বিকারত্ব সবার মধ্যেই আছে। তিনি যেমন চায়ের ঠান্ডা গরম বিষয়ে নির্বিকার, মল্লিকের দুই পুত্ৰও আশপাশে কী ঘটছে। সেই বিষয়ে নির্বিকার। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের শিশুপুত্ৰ বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। অবশ্য এই শিশুটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে তা না। মল্লিক সাহেব তার চিকিৎসা করেছেন। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেন নি। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শিশুদের জন্য বিষ।

সিগারেট হাতে বারান্দায় এসে মিসির আলি অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলেন। মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কানে ধরে উঠবোস করছে। কতবার উঠবোস। করা হচ্ছে তারা সেই হিসােবও রাখছে। শব্দ করে বলছে—৪১, ৪২, ৪৩

ছক্কা-বক্কা দুই ভাইয়ের একটির শিশুপুত্র দু’জনের মাঝখানে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। তার হাতে কাঠি লজেন্স। সে লজেন্স চুষছে।

এ ধরনের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। মিসির আলি ঘরে ঢুকে The Others Side of Black Hole বই খুললেন। বিজ্ঞান যে পর্যায়ে চলে গেছে এখন যে-কোনো গাঁজাখুরি গল্পও বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ব্ল্যাকহোলের বইটিতেও লেখক এই জিনিস করেছেন। কঠিন বিজ্ঞানের লেবাসে কল্পগল্প।

চাচাজি আসব?

মিসির আলি চমকে তাকালেন। দুই ভাই মুখ কাচুমাচু করে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে বাচ্চাটি নেই। মিসির আলি বই বন্ধ করে বললেন, এসো।

দুই ভাই ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ছিটিকিনি লাগিয়ে দিল।

চাচাজি, আপনার ঘরে একটু বসি?

বসো। কোনো সমস্যা নেই। চা খাবে?

জি-না।

সকালের নাশতা করেছ?

জি। বিরিয়ানি খেয়েছি। কথা বলছে বড়ভাই। ছোটভাই ঠোঁট নাড়াচ্ছে। এইবার ছোটভাই কথা শুরু

করল, বড়জন চুপ।।

বাবা এক শ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলেছিলেন, আমরা এক শ দশ

বার করেছি। দশটা ফ্রি করে দিয়েছি। ভালো করেছি না। চাচাজি?

অবশ্যই ভালো করেছি। শাস্তিটা হয়েছে কী জন্য? অপরাধ কী করেছিলে?

উনার দিকে তাকিয়ে হেসেছি।

হেসে ফেলার জন্য শাস্তি?

খারাপ হাসি হেসেছি চাচাজি।

হাসির ভালো-খারাপ আছে?

জি আছে।

মিসির আলি বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটা খারাপ হাসি দাও তো। দেখি ব্যাপারটা কী?

দুই ভাই চুপ করে আছে। মনে হয় তাদের পক্ষে খারাপ হাসি দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব না।

ছোটভাই বলল, চাচাজি, আপনি কি অন্য ঘরে যাবেন? আমরা এখন বেয়াদবি করব।

কী বেয়াদবি করবে?

সিগারেট খাব ৷

আমার সামনে খাও। অসুবিধা নেই।

চাচাজি, মন থেকে অনুমতি দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

আপনার মতো মানুষ ত্ৰিভুবনে কম আছে।

বলতে বলতে বড়ভাই শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করল। একটা সিগারেটই দু’জনে মিলে টানছে। কুৎসিত গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। তারা যে সিগারেট টানছে তা সাধারণ সিগারেট না। গাঁজাভর্তি সিগারেট।

মিসির আলির মনে হলো রহস্যের একটা জটি খুলেছে। গাজা ডিলিউশনের দরজা খুলে দেয়। এইজন্যেই লোকগানে বলা হয়-‘গাঁজার নৌকা শূন্যের ভরে যায়।’

বক্কা বিনীত গলায় বলল, চাচাজি কি একটা টান দিবেন?

মিসির আলি বললেন, না। তোমরা কি নিয়মিত খাও?

দুই ভাই একসঙ্গে বলল, জি-না। আজ একটা বিশেষ দিন।

বিশেষ দিন কী জন্যে?

দুই ভাইয়ের কেউই জবাব দিল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল।

তার মিনিট দশোকের, মাথায় জিপভর্তি করে পুলিশের গাড়ি চলে এল। পুলিশের কাছে দুই ভাই স্বীকার করল, তারা ধাক্কা দিয়ে তাদের বাবাকে কুয়ায় ফেলে দিয়েছে।

দমকল বাহিনীর লোক এসে গহিন কুয়া থেকে অনেক ঝামেলা করে মল্লিক সাহেবের ডেডবডি উদ্ধার করল।

মল্লিক সাহেবের ছোট ছেলের স্ত্রী

মল্লিক সাহেবের ছোট ছেলের স্ত্রী চম্পা এসেছে মিসির আলির কাছে। মল্লিক সাহেব এই ছেলের বউকেই ডাকতেন ছোট কুত্তি নামে।

মেয়েটি দেখতে কেমন মিসির আলি কিছুই বুঝলেন না। তার সারা শরীর গোলাপি রঙের বোরকায় ঢাকা। চোখ দেখা যাওয়ার কথা, তাও দেখা যাচ্ছে না। মশারির জালের আড়ালে চোখ। দুই হাতে কালো হাতমোজা। পায়ে টকটকে লাল লাল মোজা।

চাচাজি, আমার নাম চম্পা। আমি বক্কার স্ত্রী। আপনার কাছে বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।

যাকে দেখা যাচ্ছে না। তার সঙ্গে স্বস্তি নিয়ে কথা বলা যায় না। এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা আর দূরের কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা একই জিনিস।

মিসির আলি বললেন, মা! তুমি বসো। প্রয়োজনটা কী বলো?

চম্পা বসল। মিসির আলি লক্ষ রাখলেন এই মেয়ে তার স্বামীর মতো পা নাচায় কি না। পা নাচাচ্ছে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার কী জরুরি কথা বলো।

চম্পা বলল, আমার স্বামী আর ভাসুরকে হাজত থেকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করে দেন। তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ।

মিসির আলি বিব্রত গলায় বললেন, এরা দুজনই খুনের মামলার আসামি। খুনের কথা স্বীকার করেছে। পুলিশ এদের ছাড়বে না।

চম্পা বলল, খুন এরা করে নাই। এই দুই ভাই খুবই ভালো মানুষ। এরা পিঁপড়াও মারে না। খুন কি করবে! খুন আমি আর আমার বড় বোন পারুল আপা মিলে করেছি। উনার খাবারের সঙ্গে এন্টাসি মিশায়ে দিয়েছি।

নিজেকে সামলাতে মিসির আলির কিছুটা সময় লাগল। এই মেয়ে সহজ গলায় এইসব কী বলছে। মিসির আলি বললেন, এন্টাসি কী জিনিস?

ইঁদুর মারা বিষ। কোনো গন্ধ নাই। লেবুর শরবতের সঙ্গে মিশায়ে দিয়েছি। কয়েক চুমুক দিয়ে উনি চিৎ হয়ে পড়ে গেছেন। মৃত্যু হওয়ার আগেই দুই ভাই মিলে লাশ কুয়াতে ফেলেছে।

তোমরা দুই বোন পুলিশকে এই কথা বলতে চাও?

জি, চাচাজি।

তোমরা যে হত্যা-পরিকল্পনা করেছিলে এইটা কি ছক্কা-বক্কা জানত?

না। তাদের বলি নাই।

বিষ কে কিনে এনেছে?

ইঁদুর মারা বিষ ঘরে ছিল, কেউ কিনে নাই।

খুন করেছ কী জন্যে?

উনি খুব খারাপ লোক ছিলেন। সপ্তাহে একদিন উনার কাছে আমার কিংবা আমার বোনের যেতে হতো। রাতে থাকা লাগত। আমার বড়বোন কখনো থাকে নাই। আমি থেকেছি। কখনো বলেছি আমার নাম পারুল, কখনো বলেছি চম্পা। আমরা দুই বোন দেখতে একই রকম। উনি ধরতে পারেন নাই।

তোমার স্বামী বা ভাসুর এই ঘটনা জানে?

জি জানে।

মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে যা বলেছ। পুলিশকে কি তা বলতে পারবে?

পারব। ইনশাল্লাহ।

তোমাদের দু’বোনের কথা আমি পুলিশকে জানাতে পারি। তার আগে তোমার বড় বোন পারুলের সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে।

আমি আপনাকে যা বলেছি। পারুল আপা সেই কথাই বলবে। আলাদা কিছু বলবে না।

তারপরেও তার সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন।

চম্পা বলল, আমি চেষ্টা নিব উনাকে পাঠাতে। তবে চেষ্টায় কাজ হবে না। পারুল আপা কারও সঙ্গে কথা বলে না। চাচাজি, তাহলে আমি যাই। আসসালামু আলায়কুম।

মিসির আলি কিছু বললেন না। ঘটনা শুনে তিনি ধাক্কার মতো খেয়েছেন। ধাক্কা সামলাতে তার সময় লাগছে।

তিনি বড় বোন পারুলের অপেক্ষা করতে করতে সিগারেট ধরালেন। নিকোটিনের জট আলগা করার ক্ষমতা আছে। এই মুহুর্তে নিকোটিনের ধোঁয়া তার ওপর কাজ করছে না। জটি আলগা হচ্ছে না, বরং আরও পেঁচিয়ে যাচ্ছে।

পারুল এসেছে। ঠিক ছোটবোন চম্পার মতো বোরকা, মোজা, বোরকার রঙ কালো। পা এবং হাতের মোজার রঙও কালো। ছোটবোনের গা এবং বোরকা থেকে কোনো পারফিউমের গন্ধ আসে নি। বড়বোনের বোরকা থেকে হালকা পারফিউমের গন্ধ আসছে। লেবু ও চা-পাতার মিশ্র গন্ধের পারফিউম। ছোটবোনের গলা ঝনঝন করছিল। বড়বোনের গলা চাপা, কিছুটা খসখসে।

মিসির আলি বললেন, তোমার ছোটবোন আমাকে ভয়ংকর কিছু কথা শুনিয়েছে।

পারুল বলল, ভয়ংকর হলেও কথা সত্য। আপনার সঙ্গে যদি কোরান মজিদ থাকে, আমার হাতে দেন। আমি কোরান মজিদ মাথায় নিয়া বলব, ঘটনা সত্য।

তোমরা কি নিয়মিত নামাজ রোজা করো?

জি করি। আমরা দুই বোনই অনেক রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করি। তবে ইবাদত বন্দেগি শ্বশুরের আড়ালে করতে হয়। উনি পছন্দ করেন না। রাত তিনটা থেকে ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত আমরা নামাজ পড়ি। রাত তিনটায় ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখি।

মিসির আলির কাছে দুটা বিষয় স্পষ্ট হলো। রাত তিনটায় তাঁর নিজের ঘুম ভাঙার রহস্য তার একটি। চম্পা-পারুল এই দুই বোন স্কিজোফ্ৰেনিয়ার রোগী, তাও এখন স্পষ্ট। এই ধরনের রোগীদের প্রধান লক্ষণ হলো ধৰ্মকর্মে চূড়ান্ত আসক্তি।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, শ্বশুরের সঙ্গে রাত্রি যাপনের কথাটাও কি সত্যি?

জি চাচাজি। তবে আমি কখনো উনার কাছে যাই নি। চম্পা গিয়েছে। কখনো চম্পা হিসেবে গেছে, কখনো পারুল হিসেবে। চম্পার গর্ভে উনার একটি ছেলেও হয়েছিল। নাম কিসমত। এই ছেলেটিই নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।

মিসির আলি বললেন, আমি শুনেছিলাম ছেলেটি তোমার।

পারুল বলল, আমার কোনো ছেলেপুলে নাই। আমি নিঃসন্তান। চম্পার দু’বার যমজ সন্তান হয়েছে। একবার হলো এক সন্তান। কিসমত।

মিসির আলি বললেন, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা কি হয়েছিল?

আসল চিকিৎসা হয় নাই। ছেলের বাপ অৰ্থাৎ আমার শ্বশুর সাহেব হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেছেন। তার নিউমোনিয়া কীভাবে হয়েছিল জানতে চান?

বলো শুনি।

পারুল বলল, আমি আর চম্পা এই দুজনে শলাপরামর্শ করে কিসমতকে ছাদে খালি গায়ে দুই ঘণ্টা শুইয়ে রেখেছি, এতেই কাজ হয়েছে। পাপ বিদায়।

পারুল খিলখিল করে অনেকক্ষণ হাসল। তার হাসি থামার পর মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, তুমি পারুল না, তুমি চম্পা! পারুল সেজে দ্বিতীয়বার আমার কাছে এসেছ। গলা চেপে কথা বলছি। মাঝে মাঝে চেপে কথা বলার ব্যাপারটা ভুলে যাচ্ছ বলে মূল স্বর চলে আসছে। চম্পা! তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ। কেন করছ জানি না। জানতে চাচ্ছি না। তুমি এখন বিদায় হও। তোমার আর কোনো গল্প শুনতে আমি রাজি না। আমার ধারণা, তোমরা দুই বোনই অসুস্থ। স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী। তোমাদের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য না।

চাচাজি, পারুল আপা কখনো কোথাও যায় না। কারও সঙ্গে কথাও বলে না। এই জন্যে বাধ্য হয়ে পারুল সেজে এসেছি। আপনি দয়া করে আমাদের একটু সাহায্য করুন।

মিসির আলি বললেন, আমার সাহায্যের তোমার প্রয়োজন নেই। আমাকে যা বলেছ পুলিশকে তা-ই বলবে। পুলিশ তদন্ত করে বের করবে। ঘটনা কী?

চাচাজি! আমি এখন আপনাকে একটা জরুরি কথা বলব।

মিসির আলি বললেন, আমি তোমার কোনো কথাই শুনব না।

তাহলে কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা হবে।

বলো কী সমস্যা?

আপনি ভাড়াটে হিসেবে এখানে আর থাকতে পারবেন না। এখন সবকিছু চালাচ্ছে আমার বড়বোন পারুল।

মিসির আলি বললেন, সমস্যা নেই, আমি বাড়ি ছেড়ে দিব।

আজকেই ছাড়তে হবে। মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, পুরো মাসের ভাড়া আমার দেওয়া, তারপরেও আজ রাতেই বাড়ি ছেড়ে দেব।

মিসির আলির মনে হলো তিনি অতি বৃদ্ধ মানুষের মতো আচরণ করছেন। অতি বৃদ্ধরা অকারণে অভিমান করে। তিনিও তা-ই করছেন। চম্পা মেয়েটির ওপর অভিমান ঘটিত রাগ করেছেন। চট করে কারও ওপর রেগে যাওয়া তার স্বভাবেই ছিল না। এ রকম কেন হচ্ছে?

আজকের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হলে নতুন বাসা খুঁজে বের করতে হবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা শহরে বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

মিসির আলি অনেক খুঁজে পেতে মালিবাগের এক হোটেলে এসে উঠলেন। হোটেলের নাম ‘মুন হাউস’। হোটেলের মালিক কবীর সাহেবকে মিসির আলির কাছে যথেষ্টই ভদ্রলোক বলে মনে হলো। তিনি মিসির আলির বিছানা, বালিশ, সিঙ্গেল খাট, চেয়ার-টেবিল গুদামঘরে রাখার ব্যবস্থা করলেন। মিসির আলির বারো ইঞ্চি কালার টিভি তার ঘরেই লাগানোর ব্যবস্থা করলেন।

মুন হাউসে খাবারের ব্যবস্থা নেই। হোটেলের বয় টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। কবীর সাহেব মিসির আলিকে এই ঝামেলা থেকেও মুক্তি দিলেন। হোটেলের কর্মচারীদের জন্যে যে খাবার তৈরি হয়, তার সঙ্গে মিসির আলি এবং জসুও যুক্ত হয়ে গেল।

হোটেলে মিসির আলির রুম নম্বর ২১১ বি। ২১১-র দুটা ঘর আছে। একটা ২১১ এ, আরেকটা ২১১ বি। এ-বি দিয়ে রুম নম্বর দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি বুঝতে পারলেন না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমাদের এই জগৎ কার্যকারণের জগৎ। কাৰ্যকারণ ছাড়া এখানে কিছুই হয় না। প্রথমে Cause, তারপর effect। মিসির আলির ঘরটা বেশ বড়। ঘরে দুটা জানোলা। একটা পশ্চিমে আরেকটা পুবে। পশ্চিমের জানোলা খুললে প্ৰকাণ্ড এক কাঁঠালগাছ দেখা যায়। কাঁঠালগাছে কাক বাসা বেঁধেছে। জানালা দিয়ে তাকালে কাকের বাসায় চারটা ডিম দেখা যায়। কোকিলরা সন্তান বড় করার ঝামেলা এড়ানোর জন্যে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। এখানে কি কোনো কোকিলের ডিম আছে? মিসির আলি ঠিক করলেন, ডিম থেকে ছানা বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই হোটেলেই থাকবেন। নতুন বাসা খুঁজে বেড়াবেন না।

রাত ন’টার দিকে হোটেলের মালিক নিজেই টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এলেন।

গরম ভাত
মুগের ডাল

পটল ভাজি
কৈ মাছের ঝোল।

কবীর সাহেব বললেন, আয়োজন খারাপ, কিন্তু খেয়ে আনন্দ পাবেন। বাবুর্চির রান্না খুবই ভালো। সে যদি কাঁঠাল পাতার ঝোল রাধে, সেই ঝোল খেয়েও বলবেন, অসাধারণ! এই বাবুর্চি আবার ভালো পা দাবাতে পারে। আপনার যে বয়স তাতে পা দাবালে শরীর ভালো থাকবে। তাকে বলে দেব সে প্রতি রাতে এসে কিছুক্ষণ আপনার পা দাবাবে।

মিসির আলি বললেন, আমার পা দাবাতে হবে না। শারীরিক এই আরাম আমি নেব না। আপনি আমার প্রতি যে বাড়তি মমতা দেখাচ্ছেন, তার কারণটা কী বলবেন?

কবীর সাহেব বললেন, বাড়তি মমতা দেখাচ্ছি না।

হোটেলের সব বোর্ডারের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই খাবারের ব্যবস্থা করেন না, বা নিজে তার জন্যে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার আনেন না।

কবীর সাহেব বললেন, আপনার চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটা সবই আমার বাবার মতো। আমি আপনাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম।

আপনার বাবা কবে মারা গেছেন?

আমার বয়স যখন পাঁচ তখন।

মিসির আলি বললেন, পাঁচ বছর বয়সের কথা পরে মনে থাকে না। আপনার বাবার বিষয়ের খুব কম স্মৃতিই আপনার আছে। এই কারণেই অনেকের সঙ্গে আপনি আপনার বাবার চেহারার মিল পাবেন। আমার আগেও নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে আপনি আপনার বাবার চেহারার মিল পেয়েছেন। তাই না?

জি।

মিসির আলি রাতের খাবার খেয়ে সত্যি সত্যি আনন্দ পেলেন। পটল ভজিকে তিনি এত দিন। অখাদ্যের পর্যায়ে রেখেছিলেন। আজ মনে হলো এই ভাজি খাদ্যতালিকায় রোজ থাকতে পারে।

খাওয়া শেষ হওয়ার পর কবীর সাহেব বললেন, পান খাওয়ার অভ্যাস কি আছে?

মিসির আলি বললেন, নাই। তবে আজ একটা পান খাব। তৃপ্তি করে খাবার খেলে কেন জানি না জর্দা দিয়ে পান খেতে ইচ্ছা করে।

পান ছাড়া আর কিছু কি লাগবে?

একটা বাইনোকুলার কি জোগাড় করে দিতে পারবেন?

বাইনোকুলার দিয়ে কী করবেন?

কাঁঠালগাছে একটা কাক বাসা বেঁধেছে। ডিম পেড়েছে। ডিমে তা দিচ্ছে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার দৃশ্যটা দেখব।

কবীর সাহেব বললেন, পান এনে দিচ্ছি। সকালবেলা বাইনোকুলার এনে দেব। চলবে না?

অবশ্যই চলবে। থ্যাংক য়্যু।

কবীর সাহেব হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। তার হাসি দেখে মিসির আলির ভালো লাগল।

হোটেল জসুর খুবই পছন্দ হয়েছে। হোটেলের সব কর্মচারী বড় একটা ঘরে থাকে। জসুর ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে। বিনিময়ে বাবুর্চির ফুটফরমাশ খাটবে। জসুর মাথায় ঢুকেছে সে বাবুর্চি হবে। সে স্বপ্নে দেখেছে, বিশাল এক রেস্টুরেন্টের ক্যাশবাক্সে সে বসেছে। রেস্টুরেন্টের নাম ‘জসুর মোরগপোলাও’।

রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে জসু মিসির আলির খোঁজ নিতে এল। মিসির আলি বললেন, জসু, তোমার বিষয়টা নিয়ে আমি এখন চিন্তাভাবনা শুরু করব।

জসু অবাক হয়ে বলল, আমার কোন বিষয়?

মিসির আলি বললেন, এক ভূতনি এসে তোমার পা চাটে ওই বিষয়। ভূতনিটার বয়স কত?

জসু বলল, তার বয়স কত ক্যামনে বলব? আমি তো তারে বয়স জিগাই নাই।

তাকে তো দেখেছ?

জি দেখছি।

দেখে বয়স কী রকম মনে হয়?

পারুল আপার বয়সী মনে হয়। চেহারাও উনার মতো। খুবই সৌন্দর্য।

মিসির আলি বললেন, পারুল আপা হলো ছক্কার স্ত্রী?

জি। এমন সুন্দর উনার চেহারা। দেখলে আপনি ফিট পড়বেন। রাইতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।

মিসির আলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। জসুর ভূতনি ফ্রয়েডিয়, এটা বোঝা যাচ্ছে। তবে ফ্রয়েডিয় ভূতানির সঙ্গে ‘হুড়বুড়ি’ নাম যাচ্ছে না।

ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দা

২১২ বি ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দার মতো আছে। সেখানে কবীর সাহেব চাপাচাপি করে দুটা লাল লঙের প্লাস্টিকের চেয়ার এবং টেবিল ঢুকিয়েছেন।

নিয়ে দেখছেন। মিসির আলির ধারণা কাক-দম্পতিও বিষয়টা টের পেয়েছে। মনুষ্য সম্প্রদায়ের কেউ-একজন তাদের প্রতি লক্ষ রাখছে, এটা তারা জানে। বিষয়টাতে কাক-দম্পতি মনে হয় খানিকটা চিন্তিত।

দুপুর বারোটার মতো বাজে। জসু কিছুক্ষণ আগে প্লেটে করে সিঙারা দিয়ে গেছে। গরম সিঙারা, ভাপ উঠছে, কিন্তু কেন জানি মিসির আলির খেতে ইচ্ছা করছে না। এটাও বয়স হওয়ার লক্ষণ। ক্ষিধে হবে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করবে না।

মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, বিদেশিনী এক তরুণী হোটেলের বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটির পরনে ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। মাথায় স্কাফ। চোখে রোদ চশমা। মেয়েটি এগিয়ে আসছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলি বাইনোকুলার নামিয়ে তরুণীর দিকে তাকালেন। তরুণী বলল, চাচাজি, কেমন আছেন? আমার নাম পারুল। চম্পার বড় বোন পারুল। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। আমি কি আপনার সামনের চেয়ারটায় বসতে পারি?

চম্পা-পারুলদের কেউ হোটেল খুঁজে বের করে চলে আসবে, এটা মিসির আলি ভাবেন নি। পারুল মেয়েটা যে এত রূপবতী তাও ভাবেন নি। বিস্ময় চাপা দিয়ে মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, বসতে পারো। বোরকা নেই, ব্যাপার কী?

আমি তো কখনো বোরকা পরি না। আমার ছোটবোন পরে।

তোমার ছোটবোন কি তোমার মতোই রূপবতী?

জি। আমরা যমজ বোন। তবে আমার চোখ নীল, ওর চোখ কালো।

পারুল বসতে বসতে বলল, চাচাজি, আমি দূর থেকে দেখেছি আপনি বাইনোকুলার চোখে দিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী দেখছিলেন?

কাক দেখছিলাম।

কাক?

হ্যাঁ কাক। কেন কাক দেখছিলাম, এইসব জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করবে না। আমার কাছে কী জন্যে এসেছে সেটা বলে।

আপনাকে আপনার আগের বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার পা ধরে বসে থাকব।

মিসির আলি কিছু বোঝার আগেই পারুল চেয়ার থেকে মেঝেতে নেমে এসে দুহাতে পা চেপে ধরল।

মিসির আলি বললেন, পা ধরা অতি গ্ৰাম্য ব্যাপার। পা ছাড়ো।

পারুল বলল, গ্রাম্য ব্যাপার হোক বা আধুনিক ব্যাপার হোক, আমি আপনার পা ছাড়ব না।

আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছি কেন?

আমরা দুই বোন মহাবিপদে পড়েছি। আপনি আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। কী রকম বিপদ শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।

কী রকম বিপদ বলো?

আমাদের মৃত শ্বশুর ফিরে এসেছেন। বাসায় ঘোরাফিরা করছেন। খাওয়াদাওয়া করছেন। আপনার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। আপনি কোথায় গেছেন জানতে চাইলেন।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমি এই মুহুর্তে যদি তোমার সঙ্গে যাই তাকে দেখতে পাব?

হ্যাঁ দেখতে পাবেন।

একজন মৃত মানুষ জীবিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

জি।

মিসির আলি হাতের বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, চলে যাই।

দুর্বল মানুষের সমস্যা হচ্ছে, তারা নানান ধরনের ডিলিউশনে ভুগে। এই রোগ আবার সংক্রামক। একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে যায়। মাস হিস্টিরিয়াও আছে। মানবগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ডিলিউশনের শিকার হওয়ার ঘটনাও আছে। ইউরোপের ডাইনি অনুসন্ধান ছিল বড় ধরনের ডিলিউশন।

মিসির আলি নিশ্চিত, মল্লিক সাহেবের পরিবার দুই পুত্রবধূ ডিলিউশনে ভুগছে। তারা মৃত মল্লিককে ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখছে। মৃত মানুষকে জীবিত দেখা সাধারণ পর্যায়ের ডিলিউশন। অনেক পিতা-মাতাই তাদের মৃত সন্তানদের জীবিত দেখেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। এই বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছেন Christopher Bird। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম The Secret Life of Dead People। উপন্যাসের চেয়েও সুখপাঠ্য বই।

পারুল মিসির আলিকে তাদের মূল বাড়িতে নিয়ে এল। দোতলার একটা ঘরে ঢুকিয়ে বলল, চাচাজি, আপনি এই ঘরে অপেক্ষা করুন। আমি এখান থেকে আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব। অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখোব। আপনি কি চা-কফি কিছু খাবেন?

না।

আপনি খবরের কাগজ পড়ুন। আমি আসছি।

চারদিনের বাসি খবরের কাগজ টেবিলে পড়ে আছে। খাবার বাসি হলে যেমন দুৰ্গন্ধ ছড়ায়, বাসি খবরের কাগজও একই রকম দুৰ্গন্ধ ছড়ায়।

পারুল পাঁচ দশ মিনিটের কথা বলে গিয়েছিল। চল্লিশ মিনিট পার হওয়ার পর মিসির আলির হঠাৎ করেই সন্দেহ হলো—পারুল নামের মেয়েটা তাকে এই ঘরে আটকে ফেলেছে। ঘরের দরজা তালা দেওয়া। তিনি চেষ্টা করলেও সেই তালা খুলতে পারবেন না।

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে গেলেন, দরজা খুলতে পারলেন না। দরজা সত্যি সত্যি তালা দেওয়া। মিসির আলি দরজা ধাক্কাধাব্ধি কিংবা “পারুল পারুল’ বলে ডাকাডাকির ভেতর দিয়ে গেলেন না। ঘরের ভেতরটা ভালোমতো দেখতে শুরু করলেন।

গেস্ট রুম বা অতিথি কক্ষের মতো ঘর। সিঙ্গেল খাট পাতা আছে। খাটে বালিশ এবং চাদর পরিষ্কার। এই ঘরে কেউ ঘুমায় না।

আসবাবপত্রের মধ্যে একটা আলনা আছে, জানালার কাছে লেখালেখির জন্যে চেয়ার-টেবিল আছে। টেবিলে পুরনো রিডার্স ডাইজেস্টের দু’টা কপি এবং নেয়ামুল কোরান গ্ৰন্থ আছে। যে জানালার পাশে টেবিল-চেয়ার আছে, সেই জানালা বাইরে থেকে বন্ধ।

ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচিড বাথরুম আছে। বাথরুম অনেকদিন ব্যবহার হয় না। বাথরুমের র্যাকে সাবান-শ্যাম্পু আছে। ধোয়া টাওয়েল আছে। কমোডের ওপর ফ্লাশ-বেসিনে তিন মাস আগের একটা টাইম পত্রিকা দেখে মিসির আলি অবাক হলেন। মল্লিক সাহেবের বাড়ির কারোরই টাইম পত্রিকা পড়ার কথা না।

ঘরে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। বেশিরভাগ গেষ্টরুমের দেয়াল ঘড়ি ব্যাটারি শেষ হওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে থাকে। অতিথি এলেই নতুন ব্যাটারি লাগানো হয়। এই ঘড়ির কাটা সচল আছে। এখন বাজছে একটা পঁচিশ। মিসির আলির ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। টেনশনে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।

দেয়াল ঘড়ি ছাড়াও গাঢ় লাল রঙের একটা টেলিফোন সেট আছে। মিসির আলি রিসিভার কানে দিলেন। পাতালের নৈঃশব্দ্য। লাইন কাটা। এটা যুক্তিযুক্ত। বন্দিশালায় টেলিফোন থাকবে না।

মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। আবহাওয়া আরামদায়ক শীতল। ক্ষুধার্তা মানুষেরা সহজে ঘুমুতে পারে না, কিন্তু মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর ঘুম ভাঙল তিনটা দশে। প্রায় দুঘণ্টার আরামদায়ক ঘুম।

মিসির আলি মূল দরজা এবং টেবিলের সামনের জানালা পরীক্ষা করলেন। দুটা এখনো বন্ধ। তিনি যথেষ্টই ক্ষুধার্তা বোধ করছেন। তাঁকে খাবার দেওয়া হবে। কি না বুঝতে পারছেন না। তাকে আটকে রাখার উদ্দেশ্যও পরিষ্কার হচ্ছে না। পারুল মেয়েটা তার কাছে কী চাচ্ছে? মানুষের ধর্ম হলো, যাকে সে ভয় পাবে তাকে আটকে ফেলার চেষ্টা করবে। পারুল মেয়েটা কি তাকে ভয় পাচ্ছে? কিসের ভয়? তার কোনো গোপন কথা জেনে ফেলার ভয়।

গোপন কথা দূরে থাকুক, পারুল ও তার বোন চম্পা সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্য কোনো কথাও জানেন না। তিনি শুধু জানেন, এই বাড়ির ওপর এক ধরনের অসুস্থতা ভর করে আছে।

রাত এগারটা বাজে। মিসির আলিকে এখন পর্যন্ত কোনো খাবার দেওয়া হয় নি। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগের চেষ্টাও কেউ করে নি।

তিনি কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাব্ধি করেছেন। ‘পারুল পারুল’ বলে ডেকেছেন। কেউ সাড়া দেয় নি।

মিসির আলির কাছে মনে হচ্ছে, তালাবন্ধ অবস্থায় তিনি ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি নিঃশব্দ, নিচুপ।

মিসির আলি টাইম পত্রিকা, রিডার্স ডাইজেস্ট এবং নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের সবটা পড়ে শেষ করেছেন। নেয়ামুল কোরান পড়তে গিয়ে মিসির আলি বুঝতে পারলেন এই ঘরে আরও একজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। সে নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের অনেক জায়গায় যেসব কথা লিখেছে তা হলো—

১. আমাকে কত দিন তালাবন্ধ করে রাখবি?

২. ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি, খাওয়া দে।

৩. আমি তোরে ছাড়ব না। তোরে এইভাবে আটকায়ে রাখব।

৪. হে আল্লাহপাক। হে গাফুরুর রহিম। আমাকে উদ্ধার করো।

যাকে আটকে রাখা হয়েছিল তার নাম পারুল। এই তথ্য বের করতে মিসির আলির তেমন বেগ পেতে হয় নি। বালিশে পারফিউমের গন্ধ পেয়েছেন। এই গন্ধ তার চেনা।

প্রাইভেট জেলখানা থেকে মুক্তির একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে। এই বুদ্ধি কতটা কার্যকর হবে তা মিসির আলি এখনো বুঝতে পারছেন না।

মূল দরজাটি কাঠের। এই দরজা কি আগুন দিয়ে জ্বলিয়ে দেওয়া যাবে? পুরনো দরজা, শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে। কোনোরকমে দরজার এক কোনায় আগুন লাগালে দরজা পুড়ে যাবে।

আগুন লাগানোর জন্যে ম্যাচ বাক্স তার কাছে আছে। ম্যাচ বাক্সে এগারটা কাঠি। এগারবার জ্বালানো যাবে। কাগজ আছে। ধৈর্য ধরে দরজার একটা কোনায় আগুন ধরাতে হবে। কাজটা করতে হবে ভোেররাতে। যখন সবাই থাকবে ঘুমে। দরজার আগুন বা ধোয়ার বিষয়টা কারও চোখে পড়বে না। বাথরুমে তিনি শ্যাম্পূর একটি বোতল দেখেছেন। কিছু কিছু শ্যাম্পু যথেষ্ট দাহ্য। শ্যাম্পূর বোতলটা নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে।

খাটের নিচে তিনি একটা ফিডার পেয়েছেন। প্লাষ্টিকের ফিডারে আগুন ধরলে ধিকি ধিক করে অনেকক্ষণ জুলবে। কাঠের দরজার এক কোনায় আগুন ধরে যাওয়ার কথা। দরজায় চাকু দিয়ে দাগ দিতে পারলে হতো। এতে দরজার সারফেস এরিয়া বাড়বে।

রাত তিনটায় মিসির আলি দরজা পোড়ানোর সময় নির্ধারণ করলেন। রাত তিনটা ভালো সময়। তিন প্রাইম নম্বর। পিথাগোরাসের মতে, অতি রহস্যময় সংখ্যা।

দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি

দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি কাজ করল না। দরজার এক কোনায় আগুন ঠিকই জ্বলল, তবে সে আগুন স্থায়ী হলো না। দরজার খানিকটা পুড়িয়ে নিভে গেল। লাভের মধ্যে লাভ এই হলো যে, দরজা পোড়ানোর উত্তেজনায় মিসির আলির রাত কাটল নির্ঘুম। শরীরে ধস নেমে গেল।

বেঁচে থাকার জন্যে শরীরকে মোটামুটি ঠিক রাখতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে। তা তিনি খাচ্ছেন। বাথরুমের বেসিন থেকে নিয়ে মগভর্তি পানি। কিছুক্ষণ পরপর পানি। তার মন বলছে বাথরুমের বেসিনের পানি থাকবে না। যে তাকে আটকেছে সে পানি বন্ধ করে দেবে। তখন প্রবল তৃষ্ণায় কমোডের পানি ছাড়া গতি থাকবে না।

ক্ষুধার যন্ত্রণা কমে আসছে। কাজটি করছে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক যখন দেখে খাবার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন ক্ষিধে কমিয়ে দেয়। শরীরে জমে থাকা চর্বি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। একজন সবল মানুষ কোনো খাদ্য গ্ৰহণ না করে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

মিসির আলি কোনো সবল মানুষ না। নানান অসুখে পর্যাদস্ত একজন মানুষ। তিনি ধরে নিয়েছেন, এইভাবে তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন। দশ দিন। এর বেশি না। তবে শেষ দিনগুলো খুব কষ্টকর হবে না। তার হেলুসিনেশন শুরু হবে। বাস্তবতার দেয়াল ভেঙে যাবে। তিনি ঢুকে পড়বেন অবাস্তব এক জগতে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে অনেকবার সেই জগতে তার ঢোকার ইচ্ছে হয়েছে। ইচ্ছে এখন পূর্ণ হতে চলছে, কিন্তু তার ভালো লাগছে না।

বন্দি অবস্থায় মিসির আলি আটান্ন ঘণ্টা পার করলেন। ক্ষুধাবোধ এখন পুরোপুরি চলে গেছে। তৃষ্ণা আছে, তবে তা কম। বেসিনের কলের পানি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি শেষ পানি কখন খেয়েছেন তা মনে করতে পারছেন না। প্ৰবল ক্লান্তি তাকে ভর করেছে। সময় কাটাচ্ছেন বিছানায় শুয়ে। হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে। শুরুটা হলো ঘড়ি দিয়ে। মিসির আলি হঠাৎ দেখলেন ঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘুরছে।

মিসির আলি মনে মনে বললেন, ইন্টারেস্টিং। হাতে কাগজ-কলম থাকলে হেলুসিনেশনের ধাপগুলো লিখে ফেলতে পারতেন। হাতে কাগজ-কলম নেই।

ঠিক তিনটা বাজার সময় ঘড়ি উল্টোদিকে চলা শুরু করেছিল। এখন বাজছে দুটা। ঘড়ির কাটা কি দ্রুত ঘুরছে? তিনি বুঝতে পারলেন না।

মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে দেখেন, তিনি বাইনোকুলার হাতে হোটেলের বারান্দায় বসে আছেন। কাক-দম্পতি দেখছেন। তিনি কি সত্যি হোটেলের বারান্দায়? নাকি এটিও হেলুসিনেশন? যখন কাক মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করল তখন বুঝলেন এটা হেলুসিনেশন।

কাক বলল, মানুষের যেমন প্রাইভেসি আছে, আমাদেরও আছে। আপনি সারাক্ষণ বাইনোকুলার ফিট করে রাখছেন, এটা কি ঠিক? আপনার ওপর কেউ বাইনোকুলার ফিট করে রাখলে আপনার ভালো লাগত?

মিসির আলি বললেন, না।

কাক বলল, সবারই অনেক প্রাইভেট ব্যাপার আছে। হাগা-মুতা আছে। ঠিক কি না। স্যার আপনি বলেন?

মিসির আলি বললেন, অবশ্যই ঠিক। আমি দুঃখিত। আর বাইনোকুলার ধরব না।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। কতক্ষণ ঘুমালেন তিনি জানেন না। হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভাঙল অথবা দীর্ঘ সময় ঘুমালেন। ঘুম ভাঙলে প্রথমেই ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি উল্টাদিকে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে আছে। ঘড়ির হিসাবে সময় এখন বারোটা। দিন বা রাত বোঝা যাচ্ছে না।

বাথরুম থেকে শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, কে?

কিশোরীদের মিষ্টি গলায় কেউ একজন বলল, চাচাজি! আমি চম্পা।

মিসির আলি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আবার হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে।

মিসির আলি বললেন, বাথরুমে কেন? সামনে আসো।

চাচাজি! আমি বাথরুম পরিষ্কার করছি। আমার হাতে হাতমোজা নেই বলে আপনার সামনে আসতে পারব না। আপনার সামনে এলে আপনি আমার হাত দেখে ফেলবেন। আমার বিরাট পাপ হবে। শেষ বিচারের দিন জবাব দিতে পারব না।

মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছা।

চম্পা বলল, শরীরের উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে তো চাচাজি। কাউকেই এখন শরীর দেখাই না। হাত পায়ের আঙুল, চোখ, সব লুকিয়ে রাখি। চাচাজি! এই ঘরটা কি চিনতে পারছেন?

না।

আপনার এত বুদ্ধি, আর সাধারণ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না। ঘরে একটা মাত্র জানালা। সেই জানোলা কঠিনভাবে বন্ধ।

মিসির আলি বললেন, এই ঘরেই কি তুমি তোমার শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসো?

চম্পা বলল, আপনি খুব সুন্দর করে বললেন, দেখা করতে আসি। আমি দেখা করতে আসি না। বাধ্য হয়ে ভয়ংকর কিছু কর্মকাণ্ডের জন্যে আসি।

মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে আটকে রেখেছ কেন?

চম্পা বলল, আমি আপনাকে আটকে রাখি নি। বড়পা রেখেছে।

কেন?

বড়পা এই ঘরে অনেক দিন আটক ছিল। এই দুঃখে সে সবাইকেই এভাবে আটকে রাখতে চায়।

কত দিন আটকে রাখবে?

জানি না। মনে হয় ছাড়বে না।

ছাড়বে না?

না। চাবি কুয়ায় ফেলে দিয়েছে তো। দরজা খুলবে কীভাবে?

সেটাও একটা কথা।

চাচাজি! আমি এখন যাই। পরে আসব। হাতমোজা পরে আসব, তখন আপনার সামনে আসা যাবে। গল্প করা যাবে।

আচ্ছা।

আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসব। আপনি আরাম করে সিগারেট খাবেন।

শেষ হয়ে গেছে।

চম্পা বলল, অবশ্যই দিয়াশলাই আনব। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন তো চাচাজি। আপনার ঘুম দরকার। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াব?

মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, গান লাগবে না। এমনিতেই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

মিসির আলি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

একসময় ঘুম ভাঙল। তিনি অবাক হয়ে দেখেন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে ঘরের ভেতর। কাক-দম্পতির বাসও ঘরের ভেতর। বৃষ্টিতে ভিজে দুটা কাক শীতে থারথার করে কাঁপছে। পুরুষ কাকটা মিসির আলিকে বলল, স্যার, একটা ছাতা দিতে পারবেন? প্লিজ!

মিসির আলি বললেন, ছাতা পাব কোথায়? তাকিয়ে দেখো, আমিও ভিজছি।

কাক বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা কি করা যায় স্যার? বৃষ্টির পানি ভয়ংকর ঠান্ডা। ডিমগুলো পুরোপুরি ভিজে গেলে আর বাচ্চা ফুটবে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার বাসাটা কি আমার খাটের নিচে আনতে পারো? তাহলে বৃষ্টির পানির হাত থেকে বাঁচতে পারো।

থ্যাংক য়্যু স্যার। ভালো সাজেশন।

কাকা-দম্পতি অনেক কষ্টে বাসাটা খাটের দিকে আনছে। বাসা মিসির আলির হাতের নাগালে চলে এসেছে। তিনি ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে বাসাটা ধরে খাটের নিচে চালান করে দিতে পারেন, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর সমস্ত শরীর অবশ। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মিসির আলির কেন জানি মনে হচ্ছে এবার ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম ভাঙবে না। তিনি প্ৰাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করছেন।

স্যার স্নামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার ছাত্রী। আমার নাম রেবেকা।

ও আচ্ছা আচ্ছা।

চিনতে পারেন নি?

শরীরটা ভালো না তো। এইজন্যে সমস্যা হচ্ছে।

স্যার, আমি আপনাকে চামড়ায় বাধানো একটা খাতা দিয়েছিলাম।

এখন মনে পড়েছে। তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার একী অবস্থা!

একটু বেকায়দা অবস্থাতেই আছি। এরা আমাকে আটকে ফেলেছে।

কেন?

কেন তা তো জানি না।

স্যার, আপনি জানবেন না তো কে জানবে? আপনি হচ্ছেন মিসির আলি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বের করুন কেন তারা আপনাকে আটকেছে। এরা কি আপনার শত্রুপক্ষ?

না।

তাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু কি আপনি করেছেন?

না।

আপনাকে আটকে রাখলে তাদের কি কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয়?

না!

আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা ঠিক আছে কি না, সেই পরীক্ষা কি করবেন?

কী পরীক্ষা?

ক্লিৎস টেস্ট। স্যার, মনে পড়েছে?

হ্যাঁ, পড়েছে। ১০০ থেকে নিচের দিকে নামতে হবে।

প্রথমবার একটি সংখ্যা বাদ দিয়ে নিচে নামা।। ১০০ থেকে হবে ৯৮, তারপর দুটা সংখ্যা বাদ ৯৫, তারপর তিন সংখ্যা বাদ ৯১।

স্যার, পরীক্ষা দিতে থাকুন। এই ফাঁকে আমি পানি এনে দিচ্ছি। পানি খান।

পানি কোথায় পাবে? পানি তো বন্ধ।

আমি কমোড থেকে পানি আনব। আপনি কল্পনা করবেন ঝরনার পবিত্ৰ পানি খাচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্যে আপনার পানি খাওয়াটা জরুরি। ঠিক না। স্যার?

হ্যাঁ ঠিক।

মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি কতক্ষণ ঘুমালেন তা জানেন না। পানির পিপাসায় তাঁর বুক শুকিয়ে গেছে। বিছানা থেকে নামার শারীরিক শক্তি তাঁর নেই।

মাথার কাছে দুঃখিত চোখমুখ করে পারুল দাঁড়িয়ে আছে।

মিসির আলি বললেন, পারুল। আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?

আমি পারুল না। আমি এক ভূতনি। আমার নাম-হুড়বুড়ি।

ও আচ্ছা, তুমি হুড়বুড়ি?

জি হুড়বুড়ি। একটা ছড়া শুনবেন স্যার।

হুড়বুড়ি, থুরথুরি
বুড়বুড়ি, কুরকুরি
ফুরফুরি, ফুরফুরি

মিসির আলি বললেন, চুপ করো প্লিজ।

হুড়বুড়ি চুপ করল। তখন বেজে উঠল। লাল টেলিফোন। এই টেলিফোনের তার ছেড়া, তারপরেও বাজছে কেন? টেলিফোন নিশ্চয়ই বাজছে না। তিনি ভুল শুনছেন। তার বিভ্ৰান্তির কাল শুরু হয়েছে।

রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। এখন ভাঙচুরের শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী হচ্ছে?

হুড়বুড়ি বলল, স্যার! পুলিশ এসেছে। দরজা ভাঙছে। শব্দ শুনছেন?

মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ও আচ্ছা পুলিশ।

পুলিশের সঙ্গে জসু আছে। মনে হয় সে-ই আপনাকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশ এনেছে।

স্যার! দরজা ভেঙে ফেলেছে। তাকিয়ে দেখুন, পুলিশ ঢুকছে।

মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তিনি পুলিশ দেখতে পাচ্ছেন। জসুকে দেখতে পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মল্লিক সাহেবও আছেন। একজন মৃত মানুষ। যার ডেডবডি কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। মৃত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন।

মিসির আলি চোখ মেললেন

স্যার, চোখ মেলুন।

মিসির আলি চোখ মেললেন। তার কাছে মনে হলো তিনি হাসপাতালে আছেন। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার তার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ডাক্তার লাল সোয়েটারের ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে।

স্যার, আপনি একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আছেন এবং ভালো আছেন। আপনার শরীর খাদ্য গ্রহণের জন্যে এখনো তৈরি না বলে আপনাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। স্যার, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?

পারছি।

পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে চান। কথা বলবেন?

হুঁ।

পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব এসে সামনে দাঁড়ালেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মিসির আলির এখন মনে হলো, তার হেলুসিনেশন হচ্ছে না। তিনি বাস্তবে বাস করছেন। হেলুসিনেশনের দৃশ্যগুলো চড়া রঙে আঁকা হয়। এখন তা না।

মিসির আলি বললেন, আমি কত দিন বন্দি ছিলাম?

রকিব বললেন, ছয় দিন।

আমি বন্দি-এই খবর আপনাদের কে দিল?

একজন মহিলা টেলিফোনে জানিয়েছেন। তার নাম পারুল।

কবে জানিয়েছে?

যেদিন আপনাকে আটকানো হয় তার পরদিন ভোরবেলা। আমরা তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেই নি। কারণ এই মহিলা উদ্ভট সব কথা বলছিলেন। তাঁর মৃত শ্বশুর জীবিত হয়ে ফিরে এসেছেন, এইসব হাবিজাবি।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। কথা বলতে বা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, স্যার, আপনি রেস্ট নিন। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আপনার কিছু সাহায্যও আমাদের দরকার। মৃত মানুষকে জীবিত দেখার ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। একজন দাবি করছেন, তিনি মল্লিক সাহেব। তাঁর কর্মচারীরাও তা-ই বলছে।

মিসির আলি চোখ না মেলেই বললেন, একজন মৃত মানুষ কখনোই জীবিত হয়ে ফিরবে না। এটা মাথায় রাখুন। আমার ধারণা আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারব। তবে সুস্থ হওয়ার জন্যে আমাকে কিছুটা সময় দিন।

রকিব বললেন, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। চোখ মেললেন তের ঘণ্টা পর। শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

মুন হাউস হোটেলে ২১২ নম্বর ঘর। সময় সন্ধ্যা ৭টা।

মল্লিক সাহেব বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন।

কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট একটা নাটক হয়েছে। নাটক দেখেও তিনি তৃপ্তির হাসি হোসেছেন।

নাটকটার প্রধান চরিত্র জামু। সে মিসির আলির জন্যে চা নিয়ে এসেছিল। ঘরে ঢুকে মল্লিক সাহেবকে বসে থাকতে দেখে আর্ত চিৎকার দিল-ও আল্লাগো! হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মল্লিক সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ভয় খাইছে। প্যান্টে পিশাব না করে দেয়।

মিসির আলি বললেন, ভয় পাওয়ারই কথা। সবার কাছে আপনি একজন মৃত মানুষ। আপনার শবদেহ কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। তারপর আপনাকে জীবিত দেখা যাচ্ছে। আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন।

মল্লিক দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, পুরা ঘেংড়া অবস্থা!

মিসির আলি বললেন, ঘেংড়া অবস্থা মানে কী?

অতিরিক্ত বেড়াছেড়াকে বলে ঘেংড়া অবস্থা। পাবলিক তো ভয় খাবেই। পাবলিকের ভয় খাওয়ারই কথা। পুলিশও ভয় খাচ্ছে। ঘটনা শোনেন, মজা পাবেন। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব সাহেবের সঙ্গে হাত মিলাবার জন্যে হাত বাড়ালাম, উনি লাফ দিয়ে দুই ফুট সরে গেলেন। একমাত্র আপনাকে দেখলাম ভয় খান নাই। আপনাকে দেখে কিছুটা আচানক হয়েছি। আপনি কেন ভয় খান নাই?

মিসির আলি বললেন, আমি জানি মৃত মানুষ কখনো জীবিত হয়ে ফেরে না। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। এইজন্যে ভয় পাই নি।

মল্লিক সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, অন্য ব্যাপারটা কী? আমারে একটু বুঝায়ে বলেন।

মিসির আলি বললেন, আপনার যমজ ভাই আছে, যে দেখতে অবিকল আপনার মতো। সে মারা গেছে অথবা খুন হয়েছে। তার ডেডবডি কুয়ায় ফেলা হয়েছে। আপনার না।

কেউ জানল না-এটা কেমন কথা!

মিসির আলি বললেন, কেউ জানে না তা ঠিক না। আপনার দুই ছেলে তো প্রায়ই বলত, এরা দু’জন মল্লিককে দেখে। একজন ভালো। একজন মন্দ।

পাগলের কথা। আপনি ধরবেন? দুটাই পাগল। নির্বোধ পাগল। প্রায়ই দেখবেন। এরা কানে ধরে উঠবোস করছে। কেউ তাদের কানে ধরে উঠবোস করতে বলে নাই। তারপরেও করছে। বলুন তো কেন?

মিসির আলি বললেন, জানি না কেন?

অনুমান করতে পারেন?

না। অনুমানও করতে পারছি না।

মল্লিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই দুই ছাগলকে আমি প্রায়ই এক শ বার পঞ্চাশ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলি। এরা অ্যাডভান্স করে রাখে। খাতায় লেখা থাকে। সেখান থেকে বাদ দেয়। এদের কোনো কথার উপর বিশ্বাস রাখা যায়? আপনি বলেন? পাগলের সাক্ষী কি কোর্ট গ্রাহ্য করবে? চুপ করে থাকবেন না। কথা বলেন।

মিসির আলি বললেন, পাগলের সাক্ষ্য কোর্ট গ্রাহ্য করে না।

এই তো এখন পথে আসছেন। বড় পুত্ৰ ছক্কার ছেলে মারা গেল। কিসমত নাম। তার মধ্যে কোনো বিকার নাই। এক ফোঁটা চোখের পানি নাই। আরেকজনের বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে।

মিসির আলি বললেন, কিসমত কার ছেলে এই নিয়ে মনে হয় বিতর্ক আছে।

মল্লিক বললেন, কোনো বিতর্ক নাই রে ভাই। বিতর্ক দুই বদ পুলার দুই বদ স্ত্রী তৈরি করেছে। কুৎসিত নোংরা কথা চালু করেছে। এইজন্যে এদের একজনরে আমি ডাকি বড়কুত্তি, আরেকজনরে ডাকি ছোটকুত্তি। আরে কুত্তি, তোদের শ্বশুর নাকি তোদের তার সাথে সেক্স করতে বলে। এ রকম ঘটনা ঘটলে তোরা কেন সোনামুখ করে তার কাছে যাবি? কেন পাবলিকরে বলবি না? পুলিশের কাছে যাবি না? মিসির আলি সাহেব, বলেন, আমার কথায় কি যুক্তি আছে?

মিসির আলি বললেন, যুক্তি আছে।

মল্লিক বললেন, বড়কুত্তিটা আবার বলে তার কোনো সন্তানাদি নাই। আরে কুত্তি, সিজারিয়ান করে তোর পেটের সন্তান বের করা হয়েছে। পেটে সিজারিয়ানের দাগ আছে।

মিসির আলি বললেন, সে তাহলে মিথ্যাটা কেন বলছে?

মল্লিক সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানি না। আমি যেমন জানি না, যারা এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে তারাও জানে না। আমি ঘটনা জানার অনেক চেষ্টা নিয়েছি ভাইসাহেব। বড়কুত্তিটাকে তিন দিন খাওয়া পানি ছাড়া আটকায়ে রেখেছিলাম। ঘটনা কী বল। বললে ছাড়া পাবি।

ঘটনা বলেছে?

না, বলে নাই। তবে এই বিষয়ে আমার অনুমান একটা আছে! অনুমান সত্য কি না জানি না।

কী অনুমান শুনি?

দুই মেয়ে এই ধরনের কথা বলেছে যাতে আমার দুই পুত্র আমার উপর রাগ করে। আমাকে খুন করে। সমস্যা কি জানেন? আমার দুই পুত্রের রাগ করার ক্ষমতা নাই। একবার কী হলো ঘটনা শুনেন। বাড়ির একটা বিড়াল মটরগাড়ির চাকার নিচে পড়ে মারা গেল। আমার দুই পুত্ৰ দানাপানি বন্ধ করে দিল। দুইজনে দুইজনের গলা জড়ায়ে ধরে কাদে। আমি বললাম, বিড়াল তোদের বাপ না মা? বিড়াল মরে গেছে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস? কানে ধরে পঞ্চাশবার উঠবোস কর, তারপর খেতে বস। তারা দু’জনেই বলল, জি আচ্ছা। পঞ্চাশবার কানে ধরে উঠবোস করল, তারপর মল্লিক বিরানি হাউস থেকে দুই প্লেট বিরানি খেয়ে ঘুমাতে গেল, যেন কিছুই হয় নাই। আমি যে কথাগুলি বললাম, সেগুলি কি বিশ্বাস হচ্ছে?

হচ্ছে।

এখন আপনাকে আসল কথা বলি। এতক্ষণ যা বললাম। সবই ফালতু কথা। আসল কথা হচ্ছে, আমি বাবা-মা’র এক সন্তান। আমার কোনো যমজ ভাই নাই। আপনি এবং পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও কোনো যমজ ভাইয়ের সন্ধান পাবেন না।

মিসির আলি বললেন, কুয়াতে যে ডেডবডি পাওয়া গেল সেটা তাহলে কার?

মল্লিক সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, খুঁজে বের করেন কার। সিআইডি মিআইডি কী কী যেন আছে, সবে মিলে খুঁজুক। বার করুক ডেডবডি কার। ইন্সপেক্টর রকিব সাহেব যদি প্রমাণ করতে পারেন ডেডবডি আমার যমজ ভাইয়ের, তাহলে আমি উনার পিশাব গ্রাসে ভর্তি করে চুমুক দিয়ে খাব। এক হাজার বার কানে ধরে উঠবোস করব। এখন ভাই আমি বিদায় নিব। আপনাকে একটা শেষ কথা বলি। আমার উপর কোনো রাগ রাখবেন না। আমি আপনাকে আটকাই নাই। বড়কুত্তি আটকায়েছে। সে ভালো সাজার জন্যে পরদিনই পুলিশকে টেলিফোন করেছে। এমনভাবে করেছে যে, পুলিশ তার কথা পাগলের প্রলাপ ভেবেছে। আমি যখন টের পেলাম ঘরে কেউ আটক আছে তখন থানা থেকে পুলিশ নিয়ে এলাম। রকিব সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেই আমার কথার সত্যতা পাবেন। ভাইসাহেব, ইজাজত দেন। বিদায় নেই। আসসালামু আলায়কুম।

ব্যক্তিগত কথামালায় মিসির আলির সর্বশেষ লেখা
বিষয় : মল্লিক সাহেব

পুলিশ ব্যাপক অনুসন্ধান করেও মল্লিক সাহেবের কোনো যমজ ভাই আছে তা প্ৰমাণ করতে পারে নি। আমি অনেক চেষ্টা করেও পুলিশকে DNA পরীক্ষায় রাজি করাতে পারি নি। মৃত মানুষ এবং মল্লিক সাহেবের DNA পরীক্ষার ফলাফল তদন্তে সাহায্য করত।

আমার কাছে মনে হচ্ছে, পুলিশ তদন্তের বিষয়েও আগ্রহী না। ছক্কা-বক্কাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তারা আগের মতোই আছে। দুই ভাই বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে। একসঙ্গে স্নান করছে। সময় পেলেই কানে ধরে উঠবোস করে খাতায় হিসাব জমা করছে। মন্ত্রিক সাহেব নিয়ম করে হোমিও ক্লিনিকে বসছেন। রোগী দেখছেন। সব আগের মতো চলছে।

মল্লিক পরিবারের রহস্য সমাধানের চেষ্টা আমি করেছি। সমাধান করতে পারি নি। মন্ত্রিক সাহেব সহায়তা করলে হয়তো কিছু হতো। তিনি সহযোগিতার ধারে কাছেও নাই। তিনি আমার কাছে যে একেবারেই আসেন না, তা না। মাঝে মধ্যেই আসেন, নানান বিষয়ে কথা বলেন, একটি বিষয় ছাড়া। অবিকল তাঁর মতো দেখতে যে মানুষটির মৃতদেহ কুয়া থেকে তোলা হলো সে কে? তার সঙ্গে মল্লিক, সাহেবের সম্পর্ক কী?

মাল্টিপল পার্সোনালিটি মনোবিজ্ঞানের স্বীকৃত বিষয়। একজন ভালো মানুষ এবং একজন মন্দ মানুষ একজনের মধ্যে বিকশিত হতে পারে। ভালো মানুষ মল্লিক এবং মন্দ মানুষ মল্লিক-একই ব্যক্তি। এটি মনোবিজ্ঞানে গ্রাহ্য। কিন্তু দু’জন আলাদা দুই মানুষ, যাদের একজনকে খুন করা যায়, তা কী করে হয়?

আমি চেষ্টা করেছি চম্পা ও পারুলের সঙ্গে কথা বলতে। তারা রাজি হয় নি।

এই দুই মেয়ে মল্লিককে খুন করেছে বলে যে দাবি করছে তা মিথ্যা। অ্যান্টাসি নামে কোনো ইঁদুর মারা বিষ নেই। অ্যান্টাসি নামটাও হঠাৎ করে তাদের মাথায় এসেছে। অ্যান্টাসিড থেকে ‘ড’ বাদ দিয়ে অ্যান্টাসি। মন্ত্রিক সাহেবের বাড়িতে গোটাচারেক বিড়াল আছে। যে বাড়িতে বিড়াল থাকে সে বাড়িতে ইঁদুর থাকে না।

আমি একপর্যায়ে জীবিত এবং মৃত মল্লিকের DNA পরীক্ষা নিজ খরচে করতে চেয়েছিলাম, তাও সম্ভব হলো না। পরীক্ষাটা হয় সিঙ্গাপুরে। যে পরিমাণ অর্থ পরীক্ষার জন্যে প্রয়োজন, তা আমার ছিল না।

আমি নিজেও মনে হয় মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। প্রায়ই যে ঘরে বন্দি ছিলাম সেই ঘর স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে লাল টেলিফোন বাজতেই থাকে। আমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় একজন বলে–DNA টেস্ট করা হয়েছে। রিপোর্ট লিখে নিন। জীবিত এবং মৃত দু’জনের একই DNA, অর্থাৎ দু’জন একই ব্যক্তি।

স্বপ্ন আর কিছুই না, আমার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন। আমি কি তাহলে ভাবছি, মৃত এবং জীবিত একই মানুষ? এর মানেই বা কী?

আমি মুন হাউস হোটেলের ২১২ নম্বর ঘরে এখনো আছি। কাক-দম্পতির ওপর লক্ষ রাখছি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েছে। কাক-দম্পতির সে-কী আনন্দ! তাদের আনন্দ দেখে মল্লিক পরিবারের জটিলতা ভোলার চেষ্টা করছি। যখন মনে হয় পুরোপুরি ভুলে গেছি, তখনই স্বপ্নে লাল টেলিফোন বেজে ওঠে। কেউ-একজন বলে, জীবিত এবং মৃত মল্লিক একই ব্যক্তি। প্লিজ, টেক নোট।

মিসির আলি অসুস্থ

মিসির আলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি কিছু খেতে পারেন না। রাতে ঘুমুতেও পারেন না। যখন চোখে ঘুম নেমে আসে, তখনই লাল টেলিফোন বাজতে থাকে। তিনি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসেন।

মিসির আলি তাঁর অসুখের কারণ ধরতে পেরেছেন। মল্লিক পরিবারের রহস্য সমাধানে তার ব্যর্থতা। নিজেকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন-ব্যর্থতা সফলতারই অংশ। দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকেও কখনো কখনো হার মানতে হয়। যেখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদেরই এই অবস্থা, সেখানে তার অবস্থান কোথায়! সাইকোলজির খেলায় তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন না। অনেক রহস্য তিনি ভেদ করেছেন, আবার অনেক রহস্যেরই কিনারা করতে পারেন নি। তার একটি খাতা আছে যার শিরোনাম ‘অমীমাংসিত রহস্য’। যেসব রহস্যের তিনি কিনারা করতে পারেন নি, তার প্রতিটি সেই খাতায় লেখা আছে। তবে সুযোগ পেলেই তিনি পুরনো রহস্যের মীমাংসা করতে চেষ্টা করেন।

মিসির আলি নিশ্চিত, তিনি মল্লিক সাহেবের রহস্য নিয়ে অনেক দিন ভাববেন। নির্ঘুম রজনী কাটাবেন।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তৃতীয় দিনে মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এল বক্কা। দুই ভাই সবসময় একসঙ্গে চলাফেলা করে। আজ বক্কা একা।

বক্কা বলল, জসুর কাছে শুনেছি আপনি অসুস্থ। আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার জন্যে চারটা কচি ডাব এনেছি। ডাব বলকারক।

মিসির আলি বললেন, তোমার ভাই কোথায়?

বক্কা বলল, সে কুয়ার মুখ বন্ধ করছে। কুয়ার মুখ বন্ধ থাকা ভালো, তাহলে অ্যাকসিডেন্ট হয় না। আমার মা কুয়াতে ড়ুবে মারা গিয়েছিলেন, এটা কি আপনি জানেন?

জানি।

আমার মা’র নাম সুরমা। এটা জানেন?

জানি।

মা’র মনে অনেক কষ্ট ছিল তো, এইজন্যে তিনি কুয়ায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অনেক কষ্ট থাকলে কুয়ায় ঝাঁপ দিতে হয়। ঠিক না চাচাজি?

হ্যাঁ ঠিক। আমি আর ভাইজান কী ঠিক করেছি জানেন? আমাদের মনে যদি অনেক কষ্ট হয় তাহলে কুয়ায় ঝাঁপ দিব। মনের কষ্ট দূর করার জন্যে বাবাকে মারা ঠিক না। বাবা হলো জন্মদাতা পিতা। চাচাজি, ডাব কেটে দিব? খাবেন?

এখন খাব না। পরে খাব।

বক্কা বলল, চাচাজি, এখন কাটি? আপনি ডাবের পানি খাবেন। আমি খাব শাঁস।

মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে কাটো। ডাব কাটবে কীভাবে? দা লাগবে তো।

বক্কা বলল, দা নিয়ে এসেছি চাচাজি। দা খারাপ জিনিস। এইজন্যে রুমের বাইরে রেখেছি। ভালো করেছি না। চাচাজি?

হ্যাঁ, ভালো করেছ।

বক্কার ডাব কাটা দেখতে দেখতে মিসির আলি মল্লিক রহস্যের আংশিক সমাধান বের করলেন। এই সমাধানে ডাবের কোনো ভূমিকা নেই। কিছু মীমাংসা হঠাৎ করেই মাথায় আসে। বেশিরভাগ সময় স্বপ্নে আসে। কেকুলে বেনজিনের স্ট্রাকচার স্বপ্নে পেয়েছিলেন। মেন্ডেলিফ পিরিয়ডিক টেবিল স্বপ্নে পান। মিসির আলিও স্বপ্ন দেখছেন–জীবিত মল্লিক এবং মৃত মল্লিক একই। তাদের DNA তা-ই বলছে।

স্বপ্ন অনেককেই ইশারা দিয়েছে। তাকেও দিচ্ছে। কনশাস মস্তিষ্ক হিসাবনিকাশ করে আনকনশাস। মস্তিষ্ককে খবর দিচ্ছে। সেই খবর নিজেকে প্ৰকাশ করছে স্বপ্নে।

স্বপ্নে তিনি লাল টেলিফোন দেখছেন। এই টেলিফোন অবশ্যই তাঁকে ক্লু দিয়ে সাহায্য করবে।

বক্কা আগ্রহ নিয়ে ডাবের শাঁস খাচ্ছে। তৃপ্তিতে তার চোখ প্রায় বন্ধ। মিসির আলি বললেন, তোমাদের বাসার গেষ্টরুমে একটা লাল টেলিফোন আছে না?

বক্কা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

এই টেলিফোনের নম্বর জানো?

বক্কা বলল, এই টেলিফোনের নম্বর শুধু বাবা জানে। আর কেউ জানে না। তোমার বাবা কি ওই ঘরেই থাকেন?

বক্কা বলল, না। মাঝে মাঝে থাকেন। বাকি সময় ওই ঘর তালাবন্ধ থাকে।

তালাবন্ধ থাকে কেন?

ওই ঘরে ভূত থাকে, এইজন্যে তালাবন্ধ থাকে।

কী রকম ভূত?

বক্কা বলল, চাচাজি, কী রকম ভূত আমি জানি না। আমি কখনো দেখি নাই।

কেউ কি দেখেছে? আমার স্ত্রী চম্পা দেখেছে। বড় ভাইজানের স্ত্রীও দেখেছে। চাচাজি, আরও চাইরটা ডাব কিনে নিয়ে আসি?

আর ডাব দিয়ে কী হবে?

বক্কা লজ্জিত গলায় বলল, দুটা মাত্র ডাবে শাঁস হয়েছে। তৃপ্তি করে খেতে পারি নাই।

মিসির আলি বললেন, এখানে ডাব না। এনে তুমি বরং ডাব কিনে বাড়িতে চলে যাও। পুরুষ্ট দেখে কেনো, যাতে ভেতরে শাস থাকে। তারপর দুই ভাই মিলে খাও।

বক্কার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন দিশেহারা নাবিক দিশা ফিরে পেয়েছে।

চাচাজি, দা-টা কি নিয়ে যাব, না রেখে যাব?

দা নিয়ে যাওয়াই ভালো।

বক্কা বিদায় হতেই মিসির আলি কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। একটা লিষ্ট করবেন। যাদের সঙ্গে তার দেখা হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

১. ‘এ মল্লিক কাচ্চি হাউস’-এর ম্যানেজার মবিনুদ্দিন। ইনি শুধু কাচ্চি হাউসের ম্যানেজারই না, মল্লিক সাহেবের ডানহাত। যারা নিজেদের ডানহাত প্ৰমাণ করে, তাদের কাছে অনেক গোপন তথ্য থাকে। সমস্যা একটাই, এরা মুনিবের প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে কোনো তথ্যই প্ৰকাশ করে না।

২. মল্লিক সাহেবের মূল বাড়ির দারোয়ান আক্কাস মিয়া। এই লোক দীর্ঘ দিন ধরে দারোয়ানের কাজ করছে। সে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানে।

৩. পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব। তার সাহায্যে ছক্কা-বক্কা গ্রেফতার হওয়ার পর যে জবানবন্দি দিয়েছিল তার কপি আনতে হবে।

৪. চম্পা-পারুলের মা-বাবার একটা ইন্টারভ্যু দরকার। মল্লিক সাহেবের বাড়ির ভেতরের খবর নিশ্চয়ই দুই মেয়ে তার বাবা-মা’কে বলেছে।

৫. লাল টেলিফোনের নম্বর জানতে হবে। তারপর বের করতে হবে-এই টেলিফোন থেকে কাকে কাকে টেলিফোন করা হয় সেই তথ্য। মোবাইল ফোনে এই তথ্য সংরক্ষিত থাকে। ল্যান্ড টেলিফোনে থাকে কি না, তিনি জানেন না। চেষ্টা করতে দোষ নেই। মুন হোটেলের মালিক কবীর সাহেবের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই লোকের কানেকশান ভালো।

মিসির আলির শারীরিক অসুস্থতা মনে হয় সেরে গেছে। তিনি যথেষ্টই বল পাচ্ছেন।

মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ অর্ডার নিয়ে হোটেলে চলে যেতে হবে। হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে উঠতে হবে মল্লিক সাহেবের ভাড়া বাসায়। তাঁকে হোটেলে থাকলে হবে না। থাকতে হবে মূল ঘটনার কাছাকাছি।

এ মল্লিক কাচ্চি হাউসের ম্যানেজার মবিনুদ্দিন এবং
মিসির আলির কথোপকথন

মিসির আলি কেমন আছেন?

মবিনুদ্দিন : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনার দোয়া।

মিসির আলি : আপনি ভালো থাকুন। এমন দোয়া তো করি নাই।

মবিনুদ্দিন : আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, এতে আমার প্রতি আপনার মুহব্বত প্রকাশিত। যে মানুষ আমাকে মুহব্বত করে, সে তার নিজের অজান্তেই আমার জন্যে দোয়া করে।

মিসির আলি আমি আপনার কাছে দু’একটি জিনিস জানতে চাচ্ছি। মল্লিক সাহেব বিষয়ে কিছু তথ্য আপনি কি বলবেন?

মবিনুদ্দিন : মুনিবের ক্ষতি হয় এমন কিছু আমি বলব না। আমি উনার নুন খাই। যার নুন খাই তার গুণ গাই—এটা আমার ধর্ম।

মিসির আলি : আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মল্লিক সাহেবের ক্ষতি হয়, এমন তথ্য আপনার কাছে আছে?

মবিনুদ্দিন : আমি আপনার সঙ্গে বাহাসে যাব না। আসসালামু আলায়কুম।

মিসির আলি : চলে যাচ্ছেন?

মবিনুদ্দিন : জি। আল্লাহ হাফেজ।

মল্লিক সাহেবের বাড়ির দারোয়ান আক্কাস মিয়া
এবং মিসির আলির কথোপকথন

আক্কাস মিয়া : স্যার, আমি কিছুই জানি না। আমি কিছুই দেখি নাই। আমার রাতকানা রোগ আছে। রাইতে খালি অন্ধাইরা দেখি। আর কিছু দেখি না।

মিসির আলি : দিনে তো দেখেন।

আক্কাস মিয়া : আমি দিনেও দেখি না।

মিসির আলি : দারোয়ানের চাকরি করেন, রাতেও দেখেন না, দিনেও দেখেন না?

আক্কাস মিয়া : জি-না।

মিসির আলি : রাতেও দেখেন না, দিনেও দেখেন না-এই তথ্য কি মল্লিক সাহেব জানেন?

আক্কাস মিয়া : উনাকে জানাই নাই। জানালে চাকরি চলে যাবে, এইজন্যে। স্যার, আমি এখন যাই। আসসালামু আলায়কুম।

মিসির আলি এবং সুরমা হোমিও হাসপাতালের নার্স
জাহানারা বেগমের সাক্ষাৎকার

মিসির আলি : আপনি কি জানেন যে, আমাকে মল্লিক সাহেবের বাড়ির একটা ঘরে ছয় দিন আটকে রাখা হয়েছিল?

জাহানারা বেগম : জি-না, জানি না। আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। স্যারের বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমার নাই। স্যারের কুলখানিতে আমাকে উনার বড় ছেলে দাওয়াত দিয়েছিল, সেখানেও যাই নাই।

মিসির আলি : মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে ছক্কা-বক্কা দাবি করে যে তারা দুইজন মল্লিক দেখে। এই বিষয়ে কিছু জানেন?

জাহানারা বেগম : কিছু জানি না। তারা দুইজন বাবা দেখে না তিনজন দেখে, এটা তাদের বিষয়। আমার বিষয় না।

মিসির আলি : গত ছয় দিন ধরে মল্লিক সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। উনি কোথায় জানেন?

জাহানারা : জানি না, উনি কাজকমের মানুষ। উনি কাজকর্ম নিয়া থাকেন।

মিসির আলি : আমি শুনেছি আপনি মাঝে মাঝে রাতে বাসায় যান না। দুই বেডের হাসপাতালে থেকে যান। এটা কি সত্যি?

জাহানারা বেগম : কাজকমের চাপ যখন বেশি থাকে, তখন বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। রোগী ভর্তি হলে রাত জেগে তার সেবা-যত্ন করতে হয়, তখন থাকা লাগে।

মিসির আলি : মল্লিক সাহেবের এই হাসপাতালে কখনো কি রোগী ভর্তি হয়েছে?

জাহানারা আপনি উল্টা পাল্টা প্রশ্ন কেন করছেন? আপনি তো পুলিশের লোক না। পুলিশের লোক হলেও আমি ভয় পাই না। আপনাকে সত্যি কথা বলি-স্বামীর সঙ্গে আমার বনিবনা নাই। প্রায়ই ঝগড়া হয়। তখন এখানে থাকি। যাদের মনে পাপ, তারা এর মধ্যে পাপ দেখতে পারে, আমার মধ্যে কোনো পাপ নাই। আমি বুঝতে পেরেছি, কেউ আপনার কাছে কিছু লাগায়েছে। আপনাকে বলেছে যে, আমি যখন রাতে থেকে যাই, তখন মল্লিক স্যার আমার ঘরে থাকেন। ইহা সত্য না। মানুষের কথায় দয়া করে নাচবেন না। ক্লিয়ার?

মিসির আলি : জি ক্লিয়ার।

ইন্সপেক্টর রকিব এবং মিসির আলির কথোপকথন

মিসির আলি : আপনারা কি মল্লিক সাহেবের কেইসটা কোজ করে দিয়েছেন?

রকিব : জি-না। কেইস চালু আছে। গোপনে গোপনে তদন্ত চলছে। মাঝে মাঝে আমরা এ রকম করি। ভাব দেখাই যে মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। তখন সাসপেক্টরা গা ছেড়ে দেয়। এতে আমাদের সুবিধা হয়।

মিসির আলি : আপনি বলছেন তদন্ত চলছে–তাহলে মল্লিক সাহেব এখন কোথায় বলতে পারবেন?

রকিব : বলতে পারব। তিনি আগামসি লেনের এক বাড়িতে আছেন। মাঝে মাঝে এই বাড়িতে থাকেন।

মিসির আলি : আমি যে ঘরে বন্দি ছিলাম, ওই ঘরে একটা লাল টেলিফোন আছে। টেলিফোনের নম্বরটা কি আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবেন?

রকিব : স্যার, আপনার সঙ্গে যদি কাগজ-কলম থাকে তাহলে নম্বরটা লিখুন।

মিসির আলি : এই নম্বর তাহলে আপনারা জানেন?

রকিব : কেন জানিব না? বিস্ময়কর একটা ঘটনা ঘটেছে। একই মানুষএকজন জীবিত আরেকজন মৃত। আর আমরা ঠিকমতো তদন্ত করব না, তা কি হয়? আপনি দু’জনের DNA টেস্টের কথা বিশেষভাবে বলেছিলেন। আপনি শুনে খুশি হবেন যে, DNA টেস্ট হয়েছে। রেজাল্ট আমাদের কাছে আছে।

মিসির আলি : আমাকে কি DNA টেষ্টের রিপোর্টটা দেখানো যায় না?

রকিব (হাসতে হাসতে) আপনি বিখ্যাত মিসির আলি। আপনাকে কেন দেখাব না! ফটোকপি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মিসির আলি : আরেকটা ছোট্ট সাহায্য চাচ্ছি। আমি মল্লিক সাহেবের যে ঘরে বন্দি ছিলাম, সেখানে আরেক রাত থাকতে চাই।

রকিব : কেন?

মিসির আলি : আছে একটা বিষয়। তবে আমি ভয় পাচ্ছি, ওরা না আবার আমাকে আটকে ফেলে।

রকিব : আপনি কবে থাকতে চান বলবেন। সব ব্যবস্থা হবে। বাড়ির চারদিকে পুলিশ থাকবে। স্যার, এখন লাল টেলিফোনের নম্বরটা লিখুন।

মিসির আলি : নম্বর নিয়েই টেলিফোন করলেন। চারবার রিং হওয়ার পর তরুণীর গলা শোনা গেল, হ্যালো কে বলছেন?

মিসির আলি বললেন, চম্পা, আমি তোমার চাচাজি। মিসির আলি। তুমি ভালো আছ?

তরুণী জবাব দিল না। তবে সে টেলিফোন নামিয়েও রাখল না।

মিসির আলি বললেন, আগামী কাল রাতে আমি তোমাদের ওই ঘরে থাকব। ব্যবস্থা করতে পারবে?

তরুণী জবাব দিল না।

মিসির আলি বললেন, চম্পা, তুমি যে টেলিফোন কানে ধরে আছ তা আমি জানি। আগামীকাল রাত আটটার দিকে আমি চলে আসব। রাতে কি খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে?

তরুণী এইবার কথা বলল। প্রায় ফিসফিস করে বলল, কেন আসতে চাচ্ছেন?

মিসির আলি বললেন, স্মৃতি রোমন্থনের জন্যে। মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে হয়। এটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।

শারদ শশি

রাত আটটা। সারা দিন ঝলমলে রোদ ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মিসির আলি ছাতা মাথায় মল্লিক সাহেবের বাড়িতে এসে উঠেছেন। দেখে মনে হচ্ছে মল্লিক সাহেবের বাড়ি শশানপুরী। কেউ বাস করে না। বিড়ালের মিউ মিউ শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মিসির আলি দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বললেন, বাড়িতে কেউ আছেন?

কেউ জবাব দিল না। দারোয়ান আক্কাস মিয়াকে এক ঝলক দেখা গেল। সে দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলি দোতলায় উঠে গেলেন। যে ঘরে বন্দি ছিলেন, সেই ঘর খুঁজে বের করতে তার বেগ পেতে হলো না। মূল দরজা পুলিশ ভেঙেছে। দরজা ঠিক করা হয় নি। মিসির আলি ঘরে ঢুকে দেখেন ঘরের ভেতর কাঠের চেয়ারে মল্লিক সাহেব বসে আছেন। তার হাতে সিগারেটের প্যাকেট। মিসির আলি অবাক হলেন না। মল্লিক সাহেব এখানে থাকবেন, মিসির আলি তা ধরেই নিয়েছিলেন।

মল্লিক মিসির আলির দিকে না তাকিয়ে বললেন, ছোটকুত্তির কাছে শুনলাম রাতে আপনি খানা খেতে চেয়েছেন। সে আপনার জন্যে খানা পাকিয়েছে। মোরগপোলাও আর খাসির বটি কাবাব। তবে আমার উপদেশ, ছোটকুত্তির রান্না খাবার খাবেন না। খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে।

মিসির আলিকে দেখে মনে হচ্ছে না। তিনি মল্লিক সাহেবের কথা শুনছেন। তিন খাটে বসলেন। পরিচিত খাট। পরিচিত বিছানা। বালিশ-চাদর কিছুই বদলানো হয় নি। তিনি বালিশ নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকলেন।

মল্লিক বললেন, আপনার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় কিছু বলতে চান। বলতে চাইলে বলেন। বালিশ শুকাগুকির প্রয়োজন নাই। বালিশের মধ্যে হিসটরি’ লেখা নাই।

মিসির আলি বললেন, আপনার দুই ছেলে যে দু’জন বাবা দেখত সেই রহস্য ভেদ করেছি। তারা আসলেই ছোটবেলা থেকে দু’জন বাবা দেখত।

মল্লিক সাহেব বললেন, আপনাকে অনেকবার বলেছি-আমার কোনো যমজ ভাই নাই।

মিসির আলি বললেন, যমজ ভাই না, সে আপনার সৎ ভাই। আপনার বাবা তারও বাবা। DNA টেস্টে তা-ই পাওয়া গেছে। আপনার এই সৎভাইয়ের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। মনে হয় তার জন্ম কাজের মেয়ের গর্ভে। তবে আপনার বাবা তাকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেন নি। আগামসি লেনে তাকে একটা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। আপনার এই ভাই সত্যিকার অর্থেই ভালো মানুষ ছিল। সে আপনার দুই ছেলেকে অসম্ভব পছন্দ করত। এই ছেলে দু’টির টানেই সে মাঝে মাঝে গোপনে আপনার বাড়িতে আসত। সে লুকিয়ে থাকত এই ঘরে। আপনি তাকে খুন করেছেন।

মল্লিক বললেন, এত কিছু বলেছেন, কীভাবে খুন করেছি সেটাও বলেন। গলা টিপে মেরেছি?

মিসির আলি বললেন, ডাব কাটা হয় এমন দা-এর পেছন দিয়ে তার মাথায় বাড়ি দিয়েছেন।

মল্লিক অবাক হয়ে বললেন, এটা কীভাবে বললেন?

মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে বক্কা এই দা নিয়ে আমাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সে বলেছে—দা খারাপ জিনিস। তার কথা থেকে বুঝেছি।

মল্লিক বললেন, হারামজাদাটা আমাকে ধরায়ে দিয়েছে। দুই হারামজাদা ভাব ধরে থাকে যে এরা কিছুই বুঝে না। তলে তলে বিরাট বুদ্ধি।

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। তৃপ্তির সঙ্গে দুটা টান দিয়ে বললেন, আপনার সম্পর্কে আপনার দুই পুত্ৰবধু যা বলে তা ঠিক না। আপনি এই কাজ কখনো করেন নি। করলে এদের কুত্তি ডাকতেন না। আপনার রুচি নিম্নমুখী কাজের মেয়ে বা আপনার হাসপাতালের নার্সে সীমাবদ্ধ।

মল্লিক সাহেব বললেন, নার্স হারামজাদিও মুখ খুলেছে। আফসোস। বিরাট আফসোস। আপনি এত কিছু বের করে ফেলেছেন। এখন বলেন, আমার স্ত্রী সুরমাকে কে মেরেছে? আমি?

মিসির আলি বললেন, আপনি না। আপনার স্ত্রী নিজেই কুয়াতে ঝাপ দিয়েছেন। আমার ধারণা, আপনার পুত্রবধূরা আপনার বিষয়ে তাঁর কানে কথা তুলেছে। তিনি এই দুঃখ নিতে পারেন নি।

মল্লিক আনন্দিত গলায় বললেন, আপনার বিরাট বুদ্ধি। কিন্তু আপনিও শেষ পর্যন্ত ধরা খেয়েছেন। আমার স্ত্রীকে আমিই মেরেছি। সে স্বেচ্ছায় কুয়াতে ঝাপ দেয় নাই। কেন মেরেছি, সেটা একটা ইতিহাস। আপনাকে বলার প্রয়োজন নাই। খানা কি দিতে বলব? খানা খাবেন?

মিসির আলি হাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মল্লিক সাহেব বললেন, আপনাকে দেখে কখনো বুঝি নাই। একজন চিকন-চাকান মানুষের পেটে এত বুদ্ধি। জানলে কোনোদিন বাড়ি ভাড়া দিতাম না। লাত্থি দিয়ে বের করতাম।

মল্লিক কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শান্ত গলায় বললেন, ছোটকুত্তি, আমাদের খানা দাও। পুলিশ আজ রাতেই আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। বাড়ির চারদিকে পুলিশ। খালি পেটে থানায় যাওয়া ঠিক না।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। চম্পা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। আজ তার সারা শরীর বোরকায় ঢাকা না। অতি রূপবতী এই মেয়েকে দেখে মিসির আলি মুগ্ধ হলেন। তার কাছে মনে হলো, হেলেন অব ট্রয়, ক্লিওপেট্রা কিংবা কুইন অব সেবা কখনোই দুইবোন চম্পা-পারুলের চেয়ে রূপবতী না। বাঙালি প্রাচীন কবির মতো মিসির আলি মনে মনে আওড়ালেন–

“কে বলে শারদ শশি সে মুখের তুলা
পদ নখে পড়ে আছে তার কতগুলা।”

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments