Thursday, March 28, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পযার যা খাদ্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

যার যা খাদ্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভৌতিক গল্পসমগ্র - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

শহরের বাইরে নদীর ধারে এই বাড়িটা অনেকদিন খালি পড়েই ছিল। মুরারিবাবু চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর বাড়িটা কিনেছেন। নিরিবিলি নিঃঝুম জায়গা। গাছপালা, ঝোঁপজঙ্গল আনাচে কানাচে প্রচুর। মুরারিবাবুর হই-চই পছন্দ হয় না। তাই বাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছিল।

কিন্তু বাস করতে গিয়েই ঝামেলায় পড়লেন। রাত দুপুরে উঠোনে টুপ-টুপ করে ঢিল পড়ে। ছাদে কারা হেঁটে বেড়ায় ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ। বেরিয়ে গিয়ে টর্চের আলোয় খোঁজাখুঁজি করেন। কাকেও দেখতে পান না। প্রথমে ভেবেছিলেন, দুষ্ট লোকের কাজ। তাকে তাড়ানোর মতলব করছে। তাই থানায় গিয়েছিলেন। দুজন পালোয়ান চেহারার সেপাই পাঠানো হয়েছিল রাতে বাড়ি পাহারা দিতে। কিন্তু তাতেও টিলপড়া বা ছাদে হাঁটাচলার শব্দ বন্ধ হয়নি। বরং ঘুম ভেঙে শোনেন, সেপাই দুজনে পরস্পর তুমুল ঝগড়া করেছে। এ ওকে বন্দুক তুলে শাসাচ্ছে। ব্যাপারটা কী?

বেরিয়ে গিয়ে মুরারিবাবু দুজনকে শান্ত করেছিলেন। কিন্তু কারুর রাগ পড়ে না। একজন আর একজনের দিকে আঙুল তুলে বলে,–ও আমার গোঁফ টেনেছে। আরেকজন বলে,-মিছে কথা! ও আমার কানের লতিতে কামড়ে দিয়েছে।

সেই সময় আচমকা একটা বিদঘুঁটে ব্যাপার ঘটে গেল। তিনজনের মাথায় তিনটে অদৃশ্য হাতের চাঁটি পড়ল। চাটিগুলো একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা।

এমন টি খাওয়ার পর কি এ বাড়ির ত্রিসীমানায় থাকার হিম্মত থাকে কারুর? সেপাই দুজন সেই রাতেই রাম-রাম বলে চ্যাঁচিতে-চ্যাঁচিতে পালিয়ে গিয়েছিল। মুরারিবাবুও চটপট ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটেছিলেন। টের পেয়েছিলেন ব্যাপারটা নিছক ভৌতিক।

কিন্তু এমন পছন্দসই একটা বাড়ি কিনে নেহাত ভূতের ভয়ে চলে যাওয়া কাজের কথা না। বোঝা যাচ্ছে বাড়িটা পোডড়া হয়েছিল বলে ভূতেরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এখন দখল ছাড়তে চাইছে না।

মুরারিবাবু তাই ঠিক করলেন ভূতগুলোকে তাড়াতে হবে, এ কাজ ওঝা ছাড়া আর কারুর নয়। এখানে ওখানে খোঁজাখুঁজির পর এক ওঝার নাম-ঠিকানা পাওয়া গেল।

তার নাম হরিপদ। থাকে রামনগরে। ঘুঘুডাঙা থেকে বাসে ঘণ্টা তিনেকের পথ। হরিপদর খুব নামডাক আছে নাকি। তার মন্তরটন্তরের চোটে ওই এলাকা থেকে সব ভূত পালিয়ে গেছে। বাড়ি খালি থাকলেও সেখানে বড়জোর বাদুড়, চামচিকে বা আরশোলা, টিকটিকি গিয়ে জোটে। ভূতের ঢোকার সাধ্য নেই। আহা, ঘুঘুডাঙার হরিপদ এসে থাকলে কী শান্তিতে না থাকা যেত।

অনেক ফিকির মাথায় নিয়েই মুরারিবাবু রামনগর চললেন। হরিপদকে মাইনে দিয়ে বরং কাছে রাখবেন। টুকিটাকি কাজকর্ম করবে আর থাকবে তার কাছে। বরাবরের জন্য ভূতের হাতে থেকে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।

বাসেই খবর পেলেন, গতমাসে এই এলাকায় খুব বন্যা হয়েছিল। এখন জল নেমে গেছে। তাই ফের বাস চলাচল করছে। একটু ভাবনাও হল মুরারিবাবুর। হরিপদ বন্যায় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি তো কোথাও।

রামনগরে বাস থেকে নেমে মুরারি দেখলেন, নামে নগর হলেও একেবারে অজপাড়াগাঁ। একফালি কাঁচা রাস্তা গ্রামে ঢুকেছে। সে রাস্তায় বিস্তর জলকাদা। একটু ঘাবড়ে গেলেন। ঘন গাছপালার মধ্যে একটা করে মাটির বাড়ি। বাড়িগুলো বন্যায় প্রায় ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। কোনওটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কোথাও লোক নেই। খাঁখাঁ করছে। আশ্চর্য, একটা পাখিও ডাকে না।

জুতা হাতে নিয়ে হাঁটু অবধি ধুতি গুটিয়ে মুরারিবাবু জলকাদা ভেঙে গাঁয়ে ঢুকলেন। হরিপদর বাড়ি জেনে নেওয়ার মতো কাকেও দেখতে পেলেন না। বন্যায় কি সবাই গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল, এখনও ফেরেনি কেউ? কিন্তু সামনেই ভাঙা বাড়িটার কাছে গিয়ে চোখে পড়ল একটা লোক দাওয়ায় বসে হুঁকো খাচ্ছে। মুরারিবাবু খুশি হলেন। যাকগে, লোকেরা ফিরছে তাহলে।

মুরারিবাবুকে দেখে লোকটা উঠে দাঁড়াল। কালো কুচকুচে গায়ের রং। চুল, গোঁফ, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি পেকে সাদা ভূত। সেলাম করে বলল, মশাই কি রিলিফের বাবু?

মুরারিবাবু বললেন, না। আমি এসেছি হরিপদওঝার কাছে। ওর বাড়ি কোনটা বলতে পারো ভাই?

এই রাস্তায় গিয়ে বারোয়ারি বটতলা দেখবেন তার পেছনে। –বলে লোকটা একটা কাণ্ড করল। এক হাতে হুঁকো অন্য হাতে পায়ের কাছ থেকে একদলা শুকনো গোবর তুলে মুখে পুরল। বলল, চলে যান। হোরেকে পেয়ে যাবেন।

মুরারিবাবু দুঃখিত হয়ে ভাবলেন, আহা! বন্যার ফলে বেচারিদের বুঝি খিদের জ্বালায় কত অখাদ্য-কুখাদ্য না খেতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে শুকনো গোবর? মুরারিবাবু বললেন,–দেখো বাপু, একটা কথা বলি। আর যাই খাও, গোবর-টোবর খেও না। ওকি কেউ খায়? ছ্যা-ছ্যা!

লোকটা একগাল হেসে ফের আর এক খাবলা কুড়িয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, যার যা খাদ্য বাবুমশাই! আপনার এত কথায় কাজ কী? হোরের কাছে যাচ্ছেন, তাই যান।

মুরারিবাবু বিরক্ত হয়ে পা বাড়ালেন। যার যা খাদ্য মানে কী? লোকটা পাগল নয় তো?

বারোয়ারি বটতলায় গিয়ে দেখেন, একটা রোগা-সিঁড়িঙ্গে চেহারার লোক বসে আছে। সেও জিগ্যেস করল, মশাই কি রিলিফের লোক? মুরারিবাবু মাথা দোলালেন।

বোঝা যাচ্ছে, এ গাঁয়ে রিলিফ এখনও পৌঁছায়নি। ফিরে গিয়ে সরকারি অফিসে খবর দেওয়া দরকার! মুরারিবাবু বললেন, হরিপদ ওঝার বাড়ি কোনটা ভাই?

ওই তো! যান, হোরে বাড়ি আছে। বলে লোকটা কেঁচড় থেকে কী একটা বের করে কামড় দিল। মুড়মুড় করে চিবুতে থাকল।

মুরারিবাবু আড়চোখে দেখলেন, লোকটা সাদা একটা লম্বাটে জিনিস খাচ্ছে। শসা কি? মনে হচ্ছে যেন হাড়। কী বিদঘুঁটে কাণ্ড রে বাবা! আগের লোকটা শুকনো গোবর খাচ্ছিল। এ খাচ্ছে হাড়। সন্দিগ্ধভাবে পা বাড়ালেন। তারপর ভাবলেন, মানুষ তো আসলে সবই খায়। কী না খায়! সাপ ব্যাঙ কেঁচো আরশোলা–সবই খাদ্য। এমনকী চীনারা নাকি পাখির ঝোল রান্না করে খায়। আর এ তো বন্যার বিপদের সময়। খিদের চোটে যা পাবে, খাবে। এই তো সেদিন কাগজে পড়লেন, কোথায় পাহাড়ের ওপর প্লেন ভেঙে পড়েছিল। দৈবাৎ একজন যাত্রী বেঁচে যায়। সে খিদের চোটে তার শ্বশুরের আধপোড়া মাংস খেয়েছিল। শ্বশুর-জামাই একই প্লেনে যাচ্ছিল কোথায়। কাজেই বিপদের দিনে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে সবই খায়।

হরিপদর দেখা পাওয়া গেল। দাওয়ায় বসে সেও খাচ্ছে। তবে এনামেলের থালায়। তার বউ মুরারিবাবুকে দেখে ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকল। হরিপদ বলল, আসুন বাবুমশাই বসুন। বাড়ির কাউকে ভূতে ধরেছে তো? ঠিক আছে। যাব। খাওয়াটা সেরে নিই।

মুরারিবাবু তার পাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,–ও সব কী খাচ্ছ হরিপদ?

হরিপদ লাজুক হেসে বলল, আজ্ঞে, টিকটিকির লেজ, আরশোলার ঠ্যাং আর বাদুড়ের নখের ঘণ্ট। কঁকড়ার খোলের ঝোল। আর সাপের খোলসের সঙ্গে ব্যাঙের চচ্চড়ি।

মুরারিবাবু অবাক। বললেন,–তোমাদের গাঁয়ের লোকেরা তো দেখছি খুব কষ্টে আছে।

হরিপদ বলল, কেন, কেন?

কেউ শুকনো গোবর খাচ্ছে! কেউ হাড় খাচ্ছে। আবার তুমি দেখছি…

হরিপদ কথা কেড়ে নেন, আজ্ঞে যার যা খাদ্য।

যার যা খাদ্য! ফের সেই কথা। মুরারিবাবুর খটকা লাগল। ঠিক সেই সময় রাস্তার দিকে অনেক লোকের কথাবার্তা শোনা গেল। অমনি হরিপদ লাফিয়ে উঠে চাপা গলায় বলল, এসে গেছে। এসে গেছে। পালাও-পালাও। তারপর হরিপদ আর তার বউ এক দৌড়ে পেছনের জঙ্গলে গিয়ে লুকোল।

মুরারিবাবু হতভম্ব। রাস্তায় জলকাদা ভেঙে অনেক লোক আসছে। তারা মুরারিবাবুকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। মুরারিবাবুর খটকা আরও বেড়ে গেল।

একজন এগিয়ে এসে বলল,–বাবুমশাই, আপনি কে! এখানে কী করছেন?

মুরারিবাবু বলেন, হরিপদর কাছে এসেছিলাম। তোমরা বুঝি গাঁয়ের লোক?

আপনি হরিপদর কাছে এসেছিলেন? সে তো বানের জলে ডুবে মরেছে। –লোকটা গম্ভীর হয়ে বলতে লাগল, আরও কতজন মারা গেছে বাবুমশাই। রামনগরে খুব বান হয়েছিল। আমরা জল নেমে গেছে কি না দেখতে এসেছি এতদিনে। আমরা সেই পলাশপুরের হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম কিনা!

মুরারিবাবুর মাথা ঘুরে উঠল। হ্যাঁ, সব বোঝা যাচ্ছে এবার। যার যা খাদ্য এ কথার মানেও বোঝা গেল। আসলে হয়েছিল কী, বন্যায় গাঁয়ের লোকেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতেই ভূতেরা এসে জুটেছিল। বাড়ি খালি থাকায় এই ঝামেলা। এখন লোকজন এসে পড়েছে। কাজেই ভূতেরা পালিয়ে যাচ্ছে।

সাহস করে ঘুঘুডাঙার বাড়িতে থাকতে পারলে সেই ভূতেরাও পালাবে একদিন। মুরারিবাবু রামনগর থেকে শেষপর্যন্ত আশা নিয়েই ফিরলেন। অভিজ্ঞতা হল। ভূতের খাদ্য কী, তাও জানতে পারলেন। অতএব বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে শুকনো গোবর, হাড়গোড়, সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, আরশোলা ইত্যাদি হটাতে পারলে খাদ্যের অভাবে ভূতেরাও অন্যখানে চলে যাবে। ওঝার দরকারটা কী?

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments