জেলখানাতে লাইব্রেরী – হুমায়ূন আহমেদ

জেলখানাতে লাইব্রেরী - হুমায়ূন আহমেদ

আপনারা জানেন কি না জানি না, সব জেলখানাতেই একটা করে লাইব্রেরী থাকে। লাইব্রেরীতে প্রচুর বই পত্রও থাকে তবে কোন কয়েদী সে সব বই পড়ে না। বই পড়ার জন্য কেউ জেলে আসে না।

একবার একটু অন্য রকম হলো–একজন কয়েদীকে দেখা গেল বই পড়ার দারুণ নেশা। রোজ বই নিয়ে যায়। লাইব্রেরীয়ান বিস্মিত হলেন–ব্যাপারটা কি? একদিন জিজ্ঞেসও করে ফেললেন, কি বই তুমি পড়?

কয়েদী মাথা চুলকে বলল, স্যার নাটকের বই।

: সে কি? শুধু নাটকের বই?

: জ্বি স্যার। নাটক ছাড়া অন্য কিছু আমি পড়ি না।

: খুব ভাল কথা। নাটক অবশ্যি আমাদের প্রচুর আছে পড়তে পারবে। দরকার হলে আরো কেনাব।

কয়েদী অল্প সময়ে সব নাটক শেষ করে ফেলল। তার জন্যে, আরো নাটক কেনা হল। সে সবও শেষ। কয়েদী লাইব্রেরীয়ানকে বিরক্ত করে মারছে–স্যার আরো দিন। আরো দিন। মোটা দেখে দিন।

শেষ পর্যন্ত লাইব্রেরীয়ান বিরক্ত হয়ে টেলিফোন ডাইরেক্টরীটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন–বাবারে এইটা নিয়ে যাও। কয়েদী হাসি মুখে টেলিফোন ডাইরেক্টরী নিয়ে গেল। তিন দিন আর তার খোঁজ নেই। চতুর্থ দিনে লাইব্রেরীয়ান নিজেই গেলেন খোঁজ নিতে। গিয়ে দেখেন টেলিফোন ডাইরেক্টরী কোলের উপর নিয়ে সে মহানন্দে পড়ছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন,

: কেমন লাগছে পড়তে?

: অদ্ভুত স্যার।

: বল কি?

: তবে স্যার চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশী। মনে রাখতে একটু কষ্ট হচ্ছে, তবুও চমৎকার। শেষের দিকে মনে হয় খুব জমবে।

লাইব্রেরীয়ান অবাক হয়ে এই পাঠকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না।

গল্পটা বলার পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক যে নানা পদের হতে পারে, সেই সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া। সেই সঙ্গে বলা, এই জাতীয় পাঠকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

সমালোচকরা হচ্ছেন এই জাতীয় পাঠক। প্রমাণ এবং ব্যুৎপত্তি ছাড়া আমি কিছু বলি না–প্রমাণ দিচ্ছি।

মাঝে মাঝে টিভিতে আমি কিছু নাটক-ফাটক লিখি। আহামরি কিছু নয়, আমার অন্যান্য রচনার মতই দূর্বল এবং নিম্ন মানের। এরকম একটা নাটক আর্মি লিখলাম একজন ডাক্তারকে নিয়ে যে ছুটি কাটাতে বাইরে যাবে, তখন একটা ঝামেলায় পড়ে গেল। রুগীর অপারেশন হবে ছুটিতে ডাক্তার যেতে পারলেন না স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হল ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটক প্রচারিত হবার পর দৈনিক বাংলায় কেন জানি আকাশ পাতাল প্রশংসা করা হল। প্রশংসাটা এতই বাড়াবাড়ি ধরণের হল যে আমার মত নির্লজ্জ লোকও লজ্জা পেয়ে গেল। আমার মধ্যে একটু অহংকারও দেখা দিল।

এক বৎসর পর একই নাটক আবার প্রচারিত হল। দৈনিক বাংলায় আবার একটা আলোচনা ছাপা হল। জঘন্য নাটক, কুৎসিত নাটক। ঘটনা নেই, কাহিনী নেই, কিছুই নেই। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।

আমি এক তরুণ লেখককে জানি যে নিঝুম দ্বীপ, নামে একটা বই লিখেছিল। সেই বইয়ের সমালোচনা করলেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। সমালোচনার অংশ বিশেষ–নিঝুম দ্বীপ বইটি সাগরে জেগে উঠা ভূখণ্ডের নয়া বসতির আদি পর্ব নিয়ে লেখা। লেখকের গদ্যের স্বচ্ছ প্রবহমানতা, ছোট ছোট ডিটেলের কাজ আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। সাগরের নীল বিস্তারে নিঃসঙ্গ দ্বীপটি লেখকের মমতায় জীবন্ত হয়ে উঠে। এই তরুন গদ্যকারকে অভিনন্দন–

খুবই ভলি সমালোচনা। যে কোনো তরুণ লেখকের অভিভূত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু এই লেখকটি হলেন না। বরং শুকনো মুখ করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কারণ নিঝুম দ্বীপ বইটি ঢাকার একটি বস্তি নিয়ে লেখা। লেখক বস্তিগুলোকে দ্বীপ হিসেবে কল্পনা করে জ্বালাময়ী উপন্যাস কেঁদেছিলেন।

এত দূর যেতে হয় না, আমি নিজের উদাহরণ দেই। আমার অনিন্দ বেদনার কাব্য নামে একটা বই আছে। গল্পের বই। জনৈক সমালোচক এক পৃষ্ঠার একটি সমালোচনা লিখে জানালেন যে আনন্দ বেদনার কাব্য নামের কবিতা সংকলনটি তাঁর ভাল লেগেছে। কিছু কিছু কবিতা সুন্দর হয়েছে আবার কিছু কিছু সাধারণ মানের। ছন্দের ত্রুটি লক্ষণীয়। মিল এবং অনুপ্রাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাকে আরো সাবধান হতে উপদেশ দিয়ে সমালোচক লেখা শেষ করেছেন। সেই সমালোচনা পড়ে আমি এতই ঘাবড়ে গেলাম যে, আনন্দ বেদনার কাব্য বইটি কিনে এনে উল্টে পাল্টে দেখলাম–কোন কারণে গল্পগুলি কবিতা হয়ে গেল কিনা। কিছুই তো বলা যায় না। দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন এন্ড আর্থ।

আমি লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশে দুধরণের সমালোচনা লেখা হয়। ক শ্রেণী এবং খ শ্রেণী।

ক. আকাশে তোলা সমালোচনা

খ. পাত্তালে পাতা সমালোচনা।

ক শ্রেণীতে আকাশে তুলে দেয়া হবে। নমুনা–এই তরুণ লেখক আমাদের মনে করিয়ে দেন দস্তয়েভস্কি, টলষ্টয় এবং চেখভের কথা। সেই সব মান লেখকের যে অন্তদৃষ্টি যে বর্ণনা শৈলী আমাদে, মোহাবিষ্ট করে এই তরুণ লেখকও তাই করেছেন। আমরা মুগ্ধ বিস্মিত।

তাদের হাতে টেলিফোন ডাইরেক্টরী ধরিয়ে যদি বলা হয় এটা একটি নাটক এর উপর একটি ক শ্রেণীর সমালোচনা লিখে দিন। তা হলে তারা লিখবেন–নাটকের চরিত্র অনেক বেশী, তাতে সাময়িক অসুবিধা হয়, তবে বর্ণনাক্রমিক সাজানো বলে সেই অসুবিধা প্রধান হয়ে ওঠে না। কাহিনীর গতি জায়গায় জায়গায় শ্লথ, হাস্যরসের প্রাধান্য আর একটু থাকলে ভাল হতো। বিশাল একটা নাটক ধরে রাখার ক্ষেত্রে হাস্যরসের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না–

খ শ্রেণীতে পাতালে পুঁতে দেয়া হবে। নমুনা–প্রথমে বলে নেয়া ভাল এটা একটা চোরাই মাল। লেখক অন্যের জিনিষ তার নিজের বলে চালাতে চেষ্টা করছেন। অতি নিম্নমানের শ্লথ গদ্য।  কাঁচা বর্ণনা শৈলী, শব্দের ভুল প্রয়োগ দেখে ভাবতে হয় কেন এই আবর্জনা ছাপা হল?

একই রচনাকে একজন সমালোচক ক শ্রেণী এবং অন্যজন খ শ্রেণীতে ফেলছেন এ রকম উদাহরণ প্রচুর আছে। আমি আমার নিজের একটি রচনার উপর প্রকাশিত সমালোচনা থেকেই দিতে পারি। কি হবে তাতে?

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.