Thursday, April 25, 2024
Homeলেখক-রচনারচনা সমগ্রইন্দুবালা ভাতের হোটেল - কল্লোল লাহিড়ী

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল - কল্লোল লাহিড়ী

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল || Indubala Bhater Hotel by Kallol Lahiri

কুমড়ো ফুলের বড়া

জানালার কাছে বসন্তের নরম রোদে সার দিয়ে সাজানো আছে কাঁচের বড় বড় বয়াম। মুখগুলো ঢাকা আছে পরিষ্কার সাদা কাপড়ের ফেট্টিতে। বয়ামগুলোকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না তার মধ্যে কী রসদ লুকিয়ে আছে। কিন্তু যারা এই বাড়িতে রোজ ভাত খেতে আসে তারা ঠিক জানে। ভাতের পাতে লেবু, নুন, লঙ্কা দেওয়ার পাশাপাশি উড়ে বামুন ধনঞ্জয় একটু করে শালপাতায় ছুঁয়ে দিয়ে যায় বয়ামের সেই লুকোনো সম্পদ। কামরাঙা, কতবেল, জলপাই কিংবা কোনোদিন পাকা তেঁতুলের আচার। নতুন কাস্টমাররা অবাক হয়ে যায়। আর পুরোনো লোকেরা ভাবে আজ কোনটা পাতে আসবে? শুধু আচারের টানেই না, এই হোটেলে ভিড় লেগে থাকে পুব বাংলার এক বিধবা মহিলার হাতের রান্না খেতে। ইন্দুবালা কবে যে এই ভাতের হোটেল শুরু করেছিলেন আর কেন করেছিলেন নিজেও ঠিক মনে করতে পারেন না। তবু ভাসা ভাসা ছবির মতো মনে পড়ে অনেক কিছু। শুধু সেবার যখন কোলের এক মেয়ে আর ছোট্ট দুই ছেলেকে নিয়ে বিধবা হলেন, সেদিন থেকে বুঝতে শুরু করেছিলেন যারা এতদিন ঘিরে রাখতো তাঁদের, যারা সুযোগ সুবিধা ঠিক মতো আদায় করে নিয়ে যেত, তারাই এখন ছায়ার মতো সরে যাচ্ছে। স্বামীর জুয়া আর মদের নেশায় এতদিন যারা আট-কপাটি পর্যন্ত বিক্রি করায় সায় দিয়েছিলো তাদেরও আর দেখা গেল না বড় একটা। বরং সবাই কেমন যেন হারিয়ে গেল চারপাশ থেকে। বলা যায় ছেড়ে চলে গেল।

তখনও খুলনা থেকে মাঝে মাঝে ভাই এসে খোঁজ খবর নিয়ে যেত ইন্দুবালার। মা পোঁটলা করে পাঠাতো ভাজা চিড়ে, মুড়ি, বাড়ির সজনের ডাটা, চুইঝাল। তারপর সেটাও বন্ধ হলো। যুদ্ধ বাধলো। বাড়ির অনেক দিন কোনো খোঁজ পেলেন না। একদিন সকাল বেলায় গাঁয়ের থেকে পালিয়ে আসা এক পাগলাটে লোকের কথায় জানতে পারলেন পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু পাকিস্তানি মিলিটারি খান সেনারা। ভাই বাড়ির লোকজন আর কেউ বেঁচে নেই। এমনকি ভিটেটাও না। বাড়ির সামনের রাস্তাটায় বসে যুদ্ধের বীভৎসতার তাপ পোয়ানো লোকটা বিড়বিড় করে বকছিল। আর ইন্দুবালা তাঁর সমস্ত সত্তা নিয়ে মন দিয়ে শুনছিলেন কয়েকটা প্রিয় মানুষের তাঁর চারপাশ থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ইন্দুবালা একা হয়ে পড়ছিলেন। বড় একা। একটা শহরে তিন ছেলে-মেয়ে আর পুরোনো বাড়িতে নিজের শরীরের সমস্ত যৌবন নিয়ে এক্কেবারে একা। না ইন্দুবালা কাঁদেননি। কাঁদার মতো সময় তাঁর ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল না। ভেতর থেকে কেমন যেন শুকনো হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যেদিন উড়লো সে দেশের মাটিতে, এদেশে ইন্দুবালা ছেনু মিত্তির লেনের নীচের ঘর ঝাঁট দিয়ে উনুন ধরালেন। ভাঁড়ারে চাল ছিল বাড়ন্ত। ছেলেমেয়েগুলো খিদের জ্বালায় তারস্বরে কাঁদছিল। পাওনাদারের দল দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। লছমী মাছওয়ালী শেষ বাজারে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিল। আর থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নোনা ধরে ক্ষয়ে যাওয়া দোতলা বাড়িটার সামনে। লছমী দেখেছিল একটা বছর পঁচিশের মেয়ে সদ্য বিধবার সাদা ধবধবে শাড়িতে এলোচুলে চুপ করে বসে আছে ধরে ওঠা উনুনটার সামনে। উনুনে গুলের আঁচে ফর্সা মেয়েটার মুখ লাল হয়ে আছে। ওদিকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে চিল শকুনের মতো পাওনাদাররা। লছমীর যেন কী একটা মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তে। এই বাড়িতে মাছ বিক্রি করেছে সে বহুদিন। এই বাড়ির নুন খেয়েছে সে। একটুও সময় নষ্ট করেনি লছমী। সোজা এসে দাঁড়িয়েছিল ইন্দুবালার সামনে। গ্যাঁট থেকে দু টাকা বার করে মেঝের ওপর রেখে দিয়ে বলেছিল, “আজ তোমার বাড়িতে দুটো ভাত মুখে দেব মাজি। কছু মনে করো না। বারোটা পঁচিশের ক্যানিং লোকাল ছুঁড়ে গেল যে। এখন দুটো পেটে না পড়লে বাড়ি ফিরতে সাঁঝ হয়ে যাবে। আর শলীল চলবে না মাজি”।

ইন্দুবালা হ্যাঁ না কিছু বলেননি। তাঁদের খুলনার বাড়িতে অতিথিরা কোনোদিন ভাত না খেয়ে যায়নি। আজও তিনি লছমীকে ফেরত পাঠাতে পারলেন না। বলতে পারলেন না তাঁর ভাঁড়ারে ফোঁটাবার মতো চালটুকু নেই। লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে এক আনাও নেই যা দিয়ে তিনি তাঁর দোরে আসা লছমীকে মুড়ি কিনে খাওয়াতে পারেন। সাত-পাঁচ না ভেবে একটু কুণ্ঠা নিয়েই ইন্দুবালা লছমীর দেওয়া টাকাটা আঁচলে বাঁধলেন। উনুনে চাপালেন এক হাঁড়ি জল। ছোটো মেয়েকে দোতলার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে এসে বড় ছেলে প্রদীপকে পাঠালেন সামনের মুদিখানার দোকানে। খিড়কির দরজা খুলে নিজে বাড়ির পেছনের বাগান থেকে নিয়ে এলেন সবে কচি পাতা আসা কুমড়ো শাক। গাছের পাকা লঙ্কা। শাশুড়ির আমলের পুরোনো ভারী শিলটা পাতলেন অনেক দিন পরে। যত্ন করে ধুয়ে সেই কবেকার প্রাচীন হিমশীতল পাথরটার ওপর রাখলেন সর্ষে দানা। শিল আর নোড়ার আদিম ঘর্ষণে খুলনা থেকে পাঠানো মায়ের শেষ সর্ষেটুকু বেটে ফেললেন ইন্দুবালা অল্পক্ষণের মধ্যেই। লোহার কড়াইতে জল মরতে থাকা সবুজ ঘন কুমড়োশাকের ওপর আঁজলা করে ছড়িয়ে দিলেন সর্ষের মণ্ড। কয়লার আঁচে টগবগ আওয়াজে ফুটতে থাকলো কচি শাকগুলো। তার নরম পাতাগুলো। সাঁতলানোর ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাড়িতে। দোতলার ঘরে খুকি চোখ মেলে হাত পা নেড়ে খেলতে থাকলো। ছোটো দুই ছেলে গরম ভাত খাওয়ার বাসনায় থালা নিয়ে এসে বসে পড়লো রান্নাঘরের দরজায়। তখনও লাল লঙ্কা গুলোর গা থেকে ঝাল মিশছে কুমড়ো শাকের হালকা সবুজ মাখো মাখো সর্ষে ঝোলে।

রান্নার পাট শেষ হলে ইন্দুবালা ওপরের ঘরের তাক থেকে পাড়লেন গতবারের তেঁতুলের আচার। আসন পেতে লছমীকে যত্ন করে খাওয়ালেন। ফেরার সময় বাকি পয়সা ফেরত দিতে গেলে লছমী বললো, “এ কীরম বাত হলো মাজি? কাল যে আবার খাবো। হর রোজ পয়সা দেব না কি তোমায়? ওটা তুমি রেখে দাও”। লছমী সেই যে গেল পরের দিন ফিরে এলো আরও তিন জনকে সঙ্গে নিয়ে। এইভাবে আস্তে আস্তে বাজারের সবাই এসে খাওয়া শুরু করলো ইন্দুবালার নীচের ঘরে। একদিন উড়িষ্যা থেকে এলো ধনঞ্জয়। কেউ তাকে ডাকেনি। কেউ কথা বলেনি। দরজার কাছে শুধু ভাত খাওয়ার জন্য বসেছিল বেচারা। বড় মায়া হয়েছিল তাকে দেখে ইন্দুবালার। ওই বয়সের একটা ভাই ছিল যে তার। যুদ্ধের সময় খান সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে নাকি তাকে। আর একটুও মনে করতে চাননি সেসব কথা। অনেকটা ভাত আর ডাল দিলে চেটে পুটে খেয়ে নিয়েছিল সবটা ধনঞ্জয়। ছেলেদের খাইয়ে, মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে এসে ইন্দুবালা দেখেছিলেন সব কিছু সাফসুতরো। থালা বাটি বোয়া। এমনকি মাটির উনুনটা পর্যন্ত সুন্দর করে ল্যাপা। সেই থেকে ইন্দুবালার সংসারে থেকে গেল উড়িষ্যার কোন এক খরাপীড়িত অজ গাঁয়ের ধনঞ্জয়। সিঁড়ির নীচটা সাজিয়ে নিল তার নিজের মতো করে। সেখানেই থাকতে শুরু করলো সে। একদিন হঠাৎ রান্নার গন্ধে চলে এলেন সামনের কালেক্টর অফিসের বড়বাবু। ইন্দুবালার হাতের রান্না খেয়ে তাঁর কবেকার মরে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়লো। নিদান দিলেন তাঁর অফিসের সবাই এখানে খেতে আসবে। শুধু তাই নয় নিজে থেকে খুশি হয়ে একটা হলুদ রঙের এনামেল বোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন ইন্দুবালার বাড়ির বাইরের দরজার ঠিক ওপরে। সেখানে জলজল করে লেখা থাকলে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। পুরসভা থেকে লাইসেন্স হলো। দুই ছেলে বড় হলো। তারা দিব্য লেখাপড়া শিখে সুন্দর বিয়ে করে টুপটাপ সরে পড়লো। মেয়ে গেল জামাইয়ের সাথে পাঞ্জাবে, হিল্লিতে দিল্লিতে ঘুরে ঘুরে সংসার করতে। ইন্দুবালা একা থেকে গেলেন তাঁর ভাতের হোটেল নিয়ে। একদম একা।

একা কেন থাকলেন? তার একটা বিস্তৃত ব্যাখ্যান দেওয়া যেতই। গল্পের পরিসর জটিল করার জন্য প্যাঁচ পয়জার কম ছিল না। কিন্তু তাহলে এক তরফা ইন্দুবালার কথা শুনলে চলতো না। তার সাথে তাঁর দুই ছেলে এবং এক মেয়ের কথাও শুনতে হতো। চার পক্ষের কথা শুনলে মনে হতো বাঙালির চেনা গল্প। মা মানিয়ে নিতে পারছেন না ছেলেদের সংসারে। কেমন যেন পরপর মনে হচ্ছে নিজেকে। আজ পর্যন্ত সংসারের যে চাবিটা নিজের আঁচলের খুঁটে বাঁধা থাকতো তা যেন চলে গেছে অন্য কারো হাতের মুঠোয়। ওদিকে ছেলেরা বলতো মা বড় বেশি নিজের মতো করে চলতে চাইছে। কারও কথাই শুনছে না। বয়সেরও তো একটা ছায়া নিবিড় শান্তি আছে। কিন্তু ইন্দুবালার নিজের থেকেই সেসবের কোনো বালাই ছিল না। আর কোনো কালেই তো মেয়ের বাড়িতে বাঙালি মায়েরা থাকতে খুব আহ্লাদিত হননি। সব সময় কিন্তু কিন্তু করেছেন। কাজেই মেয়ের দিকের দরজায় অনেক আগেই খিল তুলে দিয়েছিলেন ইন্দুবালা। যদিও খোঁজ খবর নেওয়া, এসে দেখাশুনো করা এই সবই তারা করেছে। এমনকি মায়ের নিয়মিত ডাক্তারি চেক-আপও। নাতিরাও আহ্লাদ করে নাত বউ নিয়ে আসে মাঝেমাঝে। ঠামুনের খবর রাখে। কিন্তু বুড়ি নিজে এইসব জাগতিক মায়ার ছেদো বাঁধনে একটুও আটকা পড়তে চান না। একদিনও ভাতের হোটেল বন্ধ হয়নি লছমীর খাওয়ার দিন থেকে। বন্যা, কলেরা, ডেঙ্গু, দাঙ্গা, কারফিউ কোনো কিছুতেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের উনুনে আঁচ নেভেনি। ভাঁড়ারে বাড়ন্ত হয়নি চাল। বাড়ির পেছনের বাগানের কুমড়ো শাক। আজ ইন্দুবালার বয়েস যখন সাতের ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে তখন ছেলেরা মাকে এই ব্যবসা বন্ধ করতে বললে, নিজের হাতে রান্না-বান্না না করার ফরমান জারি করলে অশান্তি বাধে কালবৈশাখীর মতো। ফলে বেশ কিছুদিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকে দু-পক্ষের। তখন শিব রাত্রির সলতের মতো বিজয়া, পয়লা বৈশাখের নমস্কারটুকু টিকিয়ে রাখে নাতি-নাতনিরা। ছেলেরা দূর থেকে ফোন করে খবর নেয়। ধনঞ্জয়কে বকাঝকা করে মায়ের ঠিক মতো দেখাশুনো করার জন্য। আর ইন্দুবালাও তখন নিজের সামনে একটা পাঁচিল তুলে দেন। অভিমানের আদান প্রদান বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকে। কিন্তু তার মধ্যেই ইন্দুবালার রান্নাঘরে মরশুমি পদের কোনো বিরাম হয় না। সেখানে কৌটো ভর্তি হতে থাকে পৌষের পিঠেতে। বর্ষায় ভাপা ইলিশে। গরমের মুড়ি ঘন্টতে। ধনঞ্জয় সব দিয়ে আসে বুড়ির নাম করা টিফিন কৌটোতে ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকের বাড়ি-বাড়ি। পূর্ণিমায় বুড়ির গাঁটে বাতের ব্যথা বেড়ে যায়। অমাবস্যায় হাঁটতে পারেন না প্রায়। তবু মলম লাগিয়ে গরম জলের সেঁক নিয়ে রান্না করেন ইন্দুবালা। অতগুলো লোক আসবে। আঙুল চেটে চেটে খাবে। বায়না করবে একটু শুক্তোর জন্য। একটু মাছের মাথা দিয়ে করা ডালের জন্যে। পরিতৃপ্ত চাঁদপানা মুখগুলো দেখতেও ভালো লাগে যেন। এদের খাইয়েও সুখ। ইন্দুবালা তাই কোনোদিন কোনো তীর্থে যাননি। ধম্মে কম্মো করেননি। ঠাকুরের কথামৃতের বাণী মনের মধ্যে আউড়ে গেছেন। নারায়ণ সেবা। জীবে প্রেম।

তবে আজকে পূর্ণিমা, অমাবস্যা গ্রহণের মারপ্যাঁচ না থাকলেও পায়ের ব্যথাটা যেন বড় বেড়েছে ইন্দুবালার। সকালে পাঁজি খুলে আতিপাতি দেখেছেন কোথাও কোনো বক্র দৃষ্টি নেই গ্রহের। তবুও বাড়ির পেছনে বাগানের সিঁড়িটা দিয়ে নামতেই হড়কে যাচ্ছিলেন আর একটু হলে। কবে থেকে ধনঞ্জয়কে বলে যাচ্ছেন ওরে চুন ফ্যাল। একটু নারকেল ঝাঁটা দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার কর। তা কে শোনে কার কথা। থাকতো সেই আগের বয়স, কারও কাজের জন্য তিনি বসে থাকতেন নাকি? ওই দশ কেজি চালের ভাত নিজে করেননি এক সময়? ফ্যান গালার সময় বাজারের লোকগুলো এসে দাঁড়িয়ে থাকতো জুই ফুলের মতো ভাত দেখার জন্য। ওই কাঁড়ি কাঁড়ি ফ্যান টেনে তুলে দিয়ে আসতেন না পাড়ার কুস্তির আখড়ায়! ছেলেগুলো খেতো পরিতৃপ্তি করে। মা শিখিয়েছিল ভাত হলো লক্ষ্মী। তার কিছু ফেলা যায় না। কিছু ফেলতে নেই। কত মানুষ ওই ফ্যানটুকু খেয়ে বেঁচে আছে দুবেলা। এইসব বকতে বকতে ইন্দুবালা সিঁড়ি দিয়ে নামেন। খিড়কির দরজা খোলেন। সেখানেই তো সেই শাশুড়ির আমলের একটা ছোট্ট বাগান। একটা আমগাছ। একটা পেয়ারা। একটা লিকলিকে নারকেল গাছ খাড়াই হয়ে উঠেছে। এইসব ছাড়াও কয়েক ছটাক জমিতে ইন্দুবালা সাজিয়ে নিয়েছেন তার রান্নাঘরে কাজে লাগার মতো টুকিটাকি সবজি। যেন ফকিরের ঝুলি। কিছু না কিছু তুমি পাবেই। প্রচণ্ড পা ব্যথা নিয়ে এতটা সিঁড়ি ঠেলে বাগানে এসে ইন্দুবালার মন ভালো হয়ে যায়। গোটা বাগান আলো করে ফুটে আছে কুমড়ো ফুল। তার ওপর বিন্দু বিন্দু শিশির। এই ভরা বসন্তে এই সুন্দর সকালে শহরের ইট, কাঠ, পাথরের মধ্যে কোথা থেকে যেন ডেকে উঠলো একটা কোকিল। ইন্দুবালা কুমড়ো ফুলের ওপর হাত বোলালেন। কোথা থেকে যেন পুরোনো কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের এঁদো গলির দোতলা বাড়ির ছোট্ট বাগান হয়ে গেল খুলনার কলাপোতার নিকানো উঠোন। মাটির উনুনে শুকনো খেজুর পাতার জিরানো আঁচ। আর চাটুর ওপর ছ্যাঁক ছুক করে ভাজতে থাকা কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া। নামানোর সময় ঠাকুমা তার ওপর যত্ন করে ছড়িয়ে দিতেন অল্প কিছু পোস্তর দানা। পাশে বাটি হাতে করে বসে থাকা ছোট্ট ইন্দুবালা আর তার ভাই। ঝপ করে একটা সকাল নিমেষে পালটে দিল ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের আজকের মেনু। এক ঝুড়ি কুমড়ো ফুল তুলে নিয়ে এসে দোকানের সামনের কালো বোর্ডে চক নিয়ে লিখলেন ভাত, ডাল, কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া, সরষে মাছ, জলপাইয়ের চাটনি। ধনঞ্জয় গাঁক গাঁক করে উঠলো তার দেশওয়ালি ভাষায়। রেগে গেলে বাংলা তার ঠিক আসে না। আলুভাজা হওয়ার কথা ছিল। সরষে মাছের জায়গায় পটল আলু ফুলকপির ঝোল হওয়ার কথা ছিল। এইসব কিছু ছেড়ে কিনা কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া? ইন্দুবালা কোনো কথা কানে তুললেন না। উত্তর দিলেন না। স্নান করে ধবধবে সাদা কাপড়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।

বেলা যত বাড়তে থাকলো চারিদিকের আকাশ-বাতাস ছেয়ে গেল কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া ভাজার গন্ধে। সামনের মেস বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলো আজ বড় তাড়াতাড়ি ভাত খেতে এলো। কালেক্টর অফিসের কেরানিকুল বাড়ি থেকে খেয়ে এসেও দুপুরে চাড্ডি ভাত বেশি খেতে চাইলো। কবেকার খুলনার এক উঠোন রান্না জড়ো হলো ইন্দুবালার হোটেলে। সবার খাওয়ার তারিফ যখন তিনি রান্না ঘরের মধ্যে থেকে পাচ্ছিলেন, ছেলে-ছোকরাগুলো দিদা বলে এসে যখন জড়িয়ে ধরে আদর করে চলে যাচ্ছিল, বাড়ি যখন ম ম করছে গন্ধে ঠিক তখনই তাঁর সেই পড়ন্ত বেলার হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা ক্যাব। নেমে এলো যে মেয়েটি সেও প্রায় বছর দশেক পরে ফিরছে কলকাতায়। মেয়েটির ছোটো করে কাটা চুল, মেয়েটির হাব-ভাব, মেয়েটির পোশাক, তার বিদেশি লাগেজ, কাস্টমারের ভাত খাওয়ার ছন্দপতন ঘটায়। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে। এই সময়ে এই ছেনু মিত্তির লেনে পরী এলো কোথা থেকে? মেয়েটি সটান গটমট করে এগিয়ে আসে। চোখের রোদ চশমাটা মাথার ওপর তোলে। হেলে যাওয়া ক্ষয়টে এনামেলের বোর্ডে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল তার আমেরিকার প্রবাস জীবনে হারিয়ে যাওয়া বর্ণপরিচয়ে পড়তে অসুবিধে হয় না। দরজার সামনে এক ঘর লোকের মধ্যে অস্ফুট স্বরে ডাকে “ঠাম্মি”।

ইন্দুবালা তখন যত্ন করে শেষ কুমড়ো ফুলের বড়াটা ভাজছিলেন চাটুর ওপর। অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরে ঘুরে তাকান। তাঁর হাতে বেসনের প্রলেপ। কপালে উনুনের আঁচের বিন্দু বিন্দু ঘাম। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা একটু ঠিক করে এগিয়ে আসেন। ভালো করে দেখেন এক পশলা রোদ ঢোকা রান্না ঘরে মেয়েটার মুখটাকে। “নয়ন না?” জড়িয়ে ধরে সুনয়নী তার ঠাম্মিকে। কোনো শব্দ যেন আর বেরোতে চায় না তার গলা থেকে। শুধু ফোঁপানো কান্নায় বোঝা যায় ভাঙা ভাঙা কথা। “আমায় একটু তোমার কাছে থাকতে দেবে ঠাম্মি?” ইন্দুবালা কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না। তাঁর বড় ছেলের এই মেয়েটি ঠিক তাঁর মতোই। একরোখা। কারো কথা না শুনে, কাউকে তোয়াক্কা না করে কলেজ টপকে চলে গিয়েছিল বাইরে। কোন এক বিদেশিকে বিয়েও করেছিল মনে হয়। তারপর আর কেউ খবর রাখেনি। মেয়েটা যে এই বাড়ির কেউ ছিল, এই বাড়ির কেউ হয় সে কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল সবাই। শুধু নতুন বছরে একটা করে কার্ড আসতো ইন্দুবালার কাছে। ফুল, লতা পাতা, সূর্য দেওয়া। ইংরাজিতে লেখা থাকতো অনেক কিছু। ইন্দুবালা ওগুলো সাজিয়ে রেখে দিতেন দেওয়ালে। সেই নয়ন? “আমাকে ভুলে যাওনি তো ঠাম্মি? সবাই ভুলে গেছে আমাকে। বাবা, ভাই, কাকু, পিসি সবাই”। ইন্দুবালা নাতনির থুতনি ধরে চুমু খান। তাকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন রান্না ঘরের ছোট্ট টুলটায়। সামনের টেবিলে শালপাতার থালায় নিজের হাতে ভাত বাড়েন। মাটির গ্লাসে জল দেন। “আমার ঠাকুমা কী বলতো জানিস নয়ন? দুপুরের অতিথি হলো মেঘ না চাইতে জল। তাকে পেট পুরে না খাওয়ালে গেরস্তের অমঙ্গল হবে। মাঠ ভরা ধান হবে না। গোলা ভরা ফসল উঠবে না। মা লক্ষ্মী বিরূপ হবেন। ভিটে মাটি ছাড়া করবেন”। সুনয়নী ডুকরে কেঁদে ওঠে। তার যে ভিটে মাটি কিছু নেই আর। সব গেছে। ইন্দুবালা মেয়ের মাথায় হাত বোলান। মিষ্টি কুমড়ো ফুলের বড়া মুখের সামনে ধরে বলেন, “দ্যাখ তো দিদিভাই মনে পড়ে কিনা কিছু”? সুনয়নীর কিছু মনে পড়লো কিনা বোঝা যায় না। তখন সে তার সদ্য ছেড়ে আসা স্প্যানিশ বয় ফ্রেণ্ডের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্যাকুল। কিন্তু ইন্দুবালার মনে পড়লো অনেক কিছু। সুনয়নীর জন্ম হয়েছিল এমনই এক ঝলমলে দুপুরে। সেদিন ছিল বাসন্তী পুজো। তিনি সারাদিন উপোস করেছিলেন। বাটিতে ভেজানো ছিল নতুন ছোলা। কুমড়ো গুলো ডুমো ডুমো করে কাটা ছিল। দয়া গোয়ালিনী দিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে পাতা ঘি। ইচ্ছে ছিল কুমড়ো ছক্কা রাঁধার। সেদিনও এমন বিকেল হয়েছিল সব কিছু সারতে। বাড়িতে পাতা ঘি আর হিংয়ের গন্ধ ওঠা কুমড়োর ছক্কায় সারা বাড়ি যখন ম ম করছে। তখনই খবরটা এলো হসপিটাল থেকে। বাড়িতে কত দিন পর নতুন লোক এলো। নাতনির টানাটানা চোখ দেখে ভেবেছিলেন সত্যি ঠাম্মাই বুঝি ফিরে এসেছেন খুলনার কলাপোতার বাড়ির সব মায়াটুকু নিয়ে। চোখ চিকচিক করে উঠেছিল ইন্দুবালার। বড় আদর করে প্রথম নাতনির নাম রেখেছিলেন সুনয়নী।

সন্ধ্যেবেলা ধনঞ্জয় ধূপ দেখাতে এসে দেখলো কালো বোর্ডে লেখা আছে রাতের মেনু। রুটি, কুমড়োর ছক্কা, শিমাইয়ের পায়েস। ধনঞ্জয় আবার খিটখিট করতে পারতো বুড়ির মেনু চেঞ্জ করার জন্য। কিন্তু আজ সে টু শব্দটি করলো না। বরং বটিটা নিয়ে বড় একটা কুমড়ো কাটতে বসলো। আর কেউ না জানুক সে জানে বড় নাতনি সুনয়নী চলে যাবার পর থেকে আর একদিনও এই বাড়িতে কুমড়োর ছক্কা রাঁধেননি ইন্দুবালা।

বিউলির ডাল

ভাদ্রের যে এমন নাভিশ্বাসের গরম আছে ইন্দুবালা আগে কখনও জানতেন না। কিংবা ঠাহর করতে পারেননি তেমন। বিয়ের পর ছেনু মিত্তির লেনে এসে বুঝতে পেরেছিলেন শহুরে দমবন্ধ করা পরিবেশ কাকে বলে। গায়ে গায়ে ঠেকানো বাড়ি। চৌকো খোলা ছাদ। বাড়ির ভেতর থেকে একটুস খানি আকাশ। কর্পোরেশান কলের ছিরছিরে জল। শ্যাওলা ওঠা স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। বড় সোঁদা সোঁদা গন্ধ। আশে পাশে কোনো নদী নেই। পুকুর নেই। তার বদলে বাড়ির সামনে আছে মুখ হাঁ করা বড় বড় নর্দমা। তার দুর্গন্ধ। হুল ফোঁটানো মশা। গা ঘিনঘিনে মাছি। আর সন্ধ্যে হলেই টিমটিমে বিজলিবাতি। এটাই নাকি কলকাতা। এখানে আসার জন্য মানুষ স্বপ্ন দেখে। গড় হয়ে প্রণাম করে না-দেখা কালীঘাটের মায়ের কাছে। বটতলায় সত্যপীরের সিন্নি চড়ায়। মুখের খাবার বন্ধক রাখে ঈশ্বরের কাছে। একবার কলকাতায় আসতে পারলে ট্রাম, বাস, মনুমেন্ট, ফেরিওয়ালার কাছে কাঁচের চুড়ি। এইটুকু সাধের জন্য এতটা কষ্ট করা? শ্বশুর বাড়ির কোনো এক সমবয়সী মেয়েকে কোনো একদিন হয়তো নিজের মনের এই কথাগুলো বলে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা তাঁর সহজ সরল ভঙ্গিতে। তাঁর গেঁয়ো বিদ্যে তখনও শহরের মানুষের জটিল কুটিল মনের তল পায়নি। পরে যে পেয়েছিল তেমনটাও নয়। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিল কোনো এক গাঁয়ের মেয়ের কলকাতাকে দুর-ছাই করার সংবাদে। শাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিলেন “কোথাকার কোন রাজরাজেশ্বরী এল রে। পাকা দালান কোঠায় পা পড়ে না। শুনেচি তো সেখানে শেয়াল কুকুর ঘুরঘুর করতো”। তা ঠিক খুলনার কলাপোতায় সন্ধ্যে হলে বাঁশ বাগানে শেয়াল ডাকতো। তুলসী তলায় জোনাকিরা ভিড় করে আলো জ্বালাতো। মাথার ওপর সারা আকাশ জুড়ে থাকতো তারা। লণ্ঠন লাগতো না। ভাদ্রের এই সময়ে কাঠচাঁপার গন্ধে আকাশ-বাতাস ভরে যেতো। বিয়ের যেদিন সম্বন্ধ এলো অশ্বথ তলায় সেদিন অষ্টপ্রহর। রাজশাহী থেকে এসেছে কীর্তনের নাম করা সব দল। ছানা এসেছে খুলনা শহর থেকে। বড় ভিয়েন বসেছে সামনের বিশালাক্ষী তলার ভোগের ঘরে। এদিকে বাড়িতে ঠাম্মা বানাচ্ছে তুলতুলে নরম মোমের মতো তালের পিঠে। কলাপাতায় গরম গরম সেই ভাপ ওঠা পিঠে আজও যেন ইন্দুবালার চোখে জলছবি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ততক্ষণে অষ্টপ্রহরের মালসা-ভোগের দই চিড়ের জন্য মানুষের কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। ইন্দুবালার তাড়া আছে। সে মালসা ভোগও খাবে। তার সাথে বাড়িতে গিয়ে ঠাম্মার তৈরী তালের পিঠে। এদিকে দূর থেকে ধূর্জটি পিওন আসছে সাইকেলে চেপে। তারস্বরে চিৎকার করছে। বাবার নাম ধরে “ও ব্রজমোহন বাবু … শুনছেন…চিঠি আছে”। চিঠির কথায় ইন্দুবালা ফিরে তাকায়। একটু আড়াল নিয়ে দেখতে পায় বাবার হাতে একটা পোস্টকার্ড। ধূর্জটি পিওন বলে, “মাস্টারবাবু এত ঘনঘন চিঠি আসছে কেন বলুন তো? ইণ্ডিয়াতে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করলেন নাকি? এদিকে কি ছেলের অভাব ছিল? আমার ভাইপো তো এখন ঢাকায় সুতোর কলে কাজ করছে”। উত্তরে বাবা কিছু বলেননি। তাকিয়ে ছিলেন দূরে কপোতাক্ষের ওপার থেকে ভেসে আসা কালো মেঘের দিকে। তিনি জানতেন ওই মেঘে ধরা আছে বৃষ্টির জল। ঠিকঠাক বৃষ্টি হলে ক্ষেতের ফসল ভালো হবে। মেয়ের বিয়ের আর চিন্তা থাকবে না। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিলে তিনি পোস্টকার্ডখানা সাবধানে পকেটে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বাবার পেছন পেছন দূরত্ব রেখে বাড়ির পথ ধরলেন ইন্দুবালা।

ওঁ মা সিদ্ধেশ্বরী সহায়
সম্মানীয়, ব্রজমোহনবাবু
মহাশয়, আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনার পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব হওয়ার ত্রুটি মার্জনা করিবেন। কলিকাতা হইতে খুলনার দূরত্ব বিস্তর। না হইলে আমি স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকিয়া সমস্ত পাকা কথা আপনাকে জানাইয়া আসিতাম। ঈশ্বর সাক্ষী, ইতিমধ্যে অনেক বাক্যালাপই আমাদের পত্র মারফত হইয়াছে। পূর্বের পত্রে আপনার কন্যা ইন্দুবালার যে চিত্রখানি পাঠাইয়া ছিলেন তা আমার পুত্র মাস্টার রতনলাল মল্লিকের বড় পছন্দ হইয়াছে। পাত্রী গৌরবর্ণা, শিক্ষিতা, গৃহ কর্মে নিপুণা, আমার পুত্রের যথার্থ উপযোগী। আপনাদের অমত না থাকিলে এবং করুণাময় ঈশ্বরের কৃপা হইলে এই শ্রাবণে আমার পুত্রের সহিত আপনার কন্যার চারিহাত এক করিবার মনোবাসনা পোষণ করি। যত শীঘ্র সম্ভব আপনাদের মতামত জানাইবেন।

–নমস্কারান্তে
শেফালীরানী মল্লিক

পোস্টকার্ডটি এনে মায়ের হাতে দিয়ে ছিলেন বাবা। ততক্ষণে গোটা কলাপোতা জেনে গেছে ইন্দুবালার বিয়ের ঠিক হয়েছে কলকাতায়। একদিক থেকে ব্রজমোহনকে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছিল সেদিন। কারণ পারতপক্ষে তিনি চাননি মেয়ের এদিকে বিয়ে হোক। ভেবেছিলেন তার সোনার বরণ কন্যের যথাযথ মর্যাদা করতে পারবে ওপারের লোজনেরা। তাই খুব ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বয়সে বেশি দোজবরে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের একমাত্র মেয়ের। বাড়িতে আপত্তি উঠেছিল তীব্র। ঠাম্মা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। মা বলেছিল “এর চেয়ে মেয়েটাকে একটা কলসি আর গামছা দাও না। বোসদের পুকুরে ডুবে মরুক”। ভাইটা ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। হরিমতি দু-দিন দুধ দেয়নি। বিচালিও খায়নি। ভোলা কুকুরটা ঠায় শুয়েছিল দোর ধরে। তবুও কারও কথা শোনেননি বাবা। আর কেউ না জানুক তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কোনো না কোনো সময়ে বাপ ঠাকুরদার এই ভিটে ছেড়ে তাঁদের একদিন চলে যেতেই হবে। সেদিনের ভয়ে তিনি সারাক্ষণ অতিষ্ঠ হয়ে থাকতেন শেষের দিকে। তাঁকে অবশ্য কষ্ট করে চোরের মতো রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে আসতে হয়নি। খান সেনাদের ঢোকার অনেক আগেই তিনি চোখ বুজেছিলেন কপোতাক্ষের তীরে। বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে। কোনো এক অগ্রহায়ণের শিশিরে ভিজতে ভিজতে। আর বাকিরা জ্বলে পুড়ে মরেছিল স্বাধীনতার আগুনে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হোক, এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এক আশ্বিনের রাতে শিউলির গন্ধে।

ইন্দুবালার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে পুজো-আচ্চা হতো বেশি। শনি নামের যে এক দেবতা আছে, তার যে প্রত্যেক শনিবার পুজো হয় ইন্দুবালা এখানে এসে তার কথা সঠিক ভাবে জানতে পারেন। সেদিন বাড়িতে নিরামিষ। শাশুড়ি বউয়ের উপোস। সন্ধ্যেবেলা বারের পুজো দিয়ে তার প্রসাদ উঠোনে দাঁড়িয়ে খেয়ে তবে উপোস ভাঙতো। এছাড়াও শাশুড়ি ছেলের মতি গতি ফিরিয়ে আনার জন্য নানা মন্দিরে হত্যে দিতেন। পাঁজি ধরে ধরে করতেন নানা নিয়ম উপাচার। পূর্ণিমায় রাধারমণের মন্দিরে দেওয়া হতো বাতাসার হরির লুঠ। অমাবস্যায় সিদ্ধেশরীর মন্দিরে পোয়াটাক চাল ডালের অন্নভোগ। এইসব কর্মকাণ্ড তিনি একা কখনই করতেন না। ছেলের নতুন বউকে সঙ্গে নিতেন। পাখি পড়ানোর মতো সব কিছু শেখাতেন। খুব কঠিন নিয়মে বেঁধে রাখতেন। ইন্দুবালার গ্রামে ষষ্ঠী, ওলাইচণ্ডী, পুণ্যি পুকুর ব্রতে এত অনুশাসন ছিল না। চাপড়া ষষ্ঠীতে কাঁঠাল পাতার ভেতরে গুড় আর কলা দিয়ে মাখা আটার সিন্নি খেতে দিব্যি লাগতো। বাড়িতে হতো খুদ চালের পায়েস। এইসব কথা শুনলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হাসাহাসি করতো। তাচ্ছিল্যের নামে অপমান করতো। সেসব গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। পূর্ণিমা-অমাবস্যায়, তিথি নক্ষত্রের ফেরে ভালো দিনে ইন্দুবালাকে সঙ্গে নিয়ে মানুষে টানা রিক্সায় গঙ্গা স্নানে যেতেন শাশুড়ি। প্রথম দিনের ঘটনা আজও মনে আছে ইন্দুবালার। স্বামী ডেকে এনেছেন এমন এক জিনিস যা দেখতে আধভাঙা ঢাকাওয়ালা গাড়ির মতো। সামনে টানা দুটো শুড়ের মতো লাঠি। তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা সিঁড়িঙ্গে মতো লোক। তার হাতে একটা ঝুমঝুমি। “এরেই বুঝি টানা রিক্সা বলে”? স্বামীর সঙ্গে কথা হয় না শাশুড়ির সামনে। তা ছিল নিয়ম ভঙ্গের সামিল। শাশুড়ি জবাব দেন, “দেখেছো কখনও বাপের আমলে? নাও ওঠো এবার”। সেই বিষম বস্তুটায় উঠতে গিয়ে ইন্দুবালা কেঁদে ফেলেন আর কি! রিক্সায় বসার সাথে সাথে রিক্সা বুঝি উলটে যায়। শাশুড়ি চিৎকার করে বলেছিলেন, “বাঙাল মেয়ে কি সাধে বলি? রিফিউজির রক্ত যাবে কোথায়? আমারও যা কপাল”। উঠতে বসতে ইন্দুবালাকে ‘বাঙাল’ বলাটা এই বাড়ির রেওয়াজ ছিল। আর রিফিউজি’ তো তখন কলকাতার আকাশে বাতাসে। কান পাতলেই শোনা যেত। শাশুড়িই ধরিয়ে দিয়েছিলেন ‘বাঙাল’ শব্দটা। পরে বাড়ির লোকের অভ্যেসে পরিণত হয়। মানুষকে এভাবে যে সম্বোধন করা যায় সেটা ইন্দুবালা এপারে না এলে বুঝতে পারতেন না কোনোদিনও। এমনকি গায়ে পড়ে অপমানটাও। অনেক ছোটো বেলায় বাড়ির মাটির দাওয়ায় হেরিকেন জ্বালিয়ে এক সময়ের টোলে পড়ানো দাদু যখন কৃতদাসদের গল্প করতেন তখন শিউরে উঠতেন ইন্দুবালা। সারা দিন কাজ করতো মানুষগুলো। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। উঠতে বসতে মার। জাতের নামে অপমান। গায়ের রঙে অপমান। কাজ না পারলেই অন্ধকুঠুরিতে বন্ধ করে রাখা। এক এক সময় ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িটাকে অন্ধকুঠুরি মনে হতো ইন্দুবালার। মনে পড়ে যেত সেই রাতগুলো। দাদুর গল্প বলার আসরের মাঝে ঠাম্মা এসে কড়া ধমক লাগাতো। “বাচ্চা গুলান রাতে ঘুমাবে সেই খেয়াল আছে তো? থামাও তোমার হাবিজাবি গল্প”। ইন্দুবালা রাতে স্বপ্ন দেখতেন তিনি সেই কৃষ্ণকায় দাসের মতো পিছমোড়া হয়ে বাঁধা আছেন। গায়ে লেখা কতগুলো সংখ্যা। প্রচণ্ড ভয়ে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে ঠাম্মাকে পাশে খুঁজে পেতেন না। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে উঠোন পেরিয়ে ঠাম্মা তখন গোয়াল ঘরে। হরিমতির দুধ দুইছেন, বাছুরকে আদর করছেন। বিচালি আর ভেলি গুড় মাখিয়ে খাওয়াচ্ছেন। ঠাম্মার গা থেকে ভেসে আসছে খুলনার গন্ধ। কলাপোতার গ্রাম। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকেন ইন্দুবালা। পাছে চোখ খুললে স্বপ্নটা যদি চলে যায়।

চোদ্দ গুষ্টি ঘটির মাঝে কেন যে তাঁর শাশুড়ি বাঙাল মেয়ে বউ করে নিয়ে এসেছিলেন সেই সময়ে বুঝতে পারেননি ইন্দুবালা। অনেক পরে বুঝেছিলেন। কিন্তু সেদিকে গল্পের মোড় ঘোরাতে গেলে অনেকটা পথ যেতে হবে। উনুনের আঁচ হবে নিভন্ত। যা ইন্দুবালা কোনোদিনই সহ্য করতে পারবেন না। তাঁর হোটেলে উনুনের আঁচ মানে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। টগবগ করে ফোঁটা ভাতের গন্ধ মানে এই বাড়িতে প্রাণ আছে এখনও। এতদিন পরেও। বাড়িতে জমিদারি আমলের ভাঁড়ারে শাশুড়ি থাকাকালীন চালের অফুরান জোগান না থাকলেও ইন্দুবালার জীবনে প্রাণের অফুরান হয়নি কখনও। বাগবাজার ঘাটে গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম দিনে তাঁর কপোতাক্ষের কথা মনে পড়েছিল। বাড়ি থেকে লাল চেলী পড়ে, গা ভর্তি সোনা নিয়ে চলে আসার সময় মনে পড়েছিল ইচ্ছামতীর কথা। গ্রামের পাশে বোসদের বড় পুকুরটার কথা। সবার কথা স্মরণ করে ইন্দুবালা ছলছল চোখে গঙ্গায় ডুব দিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে বলেছিলেন ভালো থাকুক ইচ্ছামতী…কপোতাক্ষ…বোসদের পুকুর। মাস ছয়ের মধ্যে বড় ছেলে পেটে এলে গঙ্গার পাট চুকলো তাঁর। শাশুড়িও অসুস্থ হলেন।

বুড়ি খিটখিটে হলেও বউয়ের নিন্দা অন্যলোকে তার সামনে করছে কোনোদিন সহ্য করতে পারতেন না। তৎক্ষণাৎ মুখের ওপর জবাব দিতেন। ঠাম্মা শিখিয়েছিল ওপারের রান্না। আর শাশুড়ি খুব যত্ন করে, চিৎকার চেঁচামেচি করে, বাড়ি মাথায় উঠিয়ে শেখালেন এপারের রান্না। ওপারের রান্নায় যেখানে মিষ্টতার অভাব ছিল এপারে এসে সেগুলোতে একটু একটু মিষ্টি পড়লো। আর এপারের রান্নায় মিষ্টি সরে গিয়ে কাঁচা লঙ্কা বাটা এলো। মরিচ ঝাল এলো। চুইঝালের গন্ধ এলো। মৌরির ফোড়ন এলো। সারা বাড়ি ম ম করতে থাকলো ঘটি বাঙালের রান্নার সুবাতাসে। জ্ঞাতি কুটুমরা আড়ালে আবডালে কানাকানি করতো। কিন্তু হাঁড়ির খবর কিছুতেই বাড়ির বাইরে বেরোতে দিতেন না শাশুড়ি। তিনি জানতেন শকুনের চেয়েও হিংস্র হলো ওরা। যারা তার ছেলেকে নরকের দরজায় নিয়ে গেছে। মুখে হাঁ গো কী গো করলেও সারাক্ষণ শাপ শাপান্ত করতেন কুটুমদের নামে। ইন্দুবালাকে পই পই করে শিখিয়েছিলেন, “চিনে রাখ বউ এদের। কোনো শলা পরামর্শ করতে যাবি না ওদের সাথে”। ইন্দুবালা কোনোদিন যাননি। জীবনের চরম বিপদের সময়ও না। শাশুড়ি বুঝেছিলেন এই সংসার ডোবার হাত থেকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তাহলে সে এই বাঙাল মেয়েই। সাধে কি ছবি আসা ইস্তক তিনি ছুটেছিলেন গঙ্গার ধারে মায়ের বাড়িতে? মহারাজ ছবি দেখে বলেছিলেন “শেফালী, তোমার ঘর দুয়ার উত্তরসূরীদের বাঁচাবে এই মেয়ে। লক্ষ্মীমন্ত জেনে রেখো।” একটুও সময় নষ্ট করেননি তিনি আর। নিজের পেটের ছেলেকে ভালো করে চিনতেন। সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে খুলনার কলাপোতা গ্রামে চিঠি লিখতে বসেছিলেন। চোখের সামনে উজাড় হয়ে ছিল নাতি পুতিদের স্বপ্ন। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো ঘর আলো করে তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিজের চোখে দেখার জন্য বিভোর হয়ে থাকতেন বুড়ি। ইন্দুবালা তাঁর সেইসব স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন যা যা তিনি চেয়েছিলেন ছেলের বউয়ের কাছ থেকে। মুখ ফুটে কোনোদিনও শাশুড়ির মুখের ওপর কথা বলেননি। এক এক সময় নিজেই আশ্চর্য হয়েছেন। কলাপোতার সেই কলবলে মেয়েটা এই ছেনু মিত্তির লেনে এসে কী করে চুপ হয়ে গেল একদম? আসলে হতেই হতো। যে তীব্র যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনার অভিঘাত তাঁর ওপর দিয়ে চলেছিল দিনের পর দিন সেই সবের জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না। নিজেও কোনোদিন ভাবতে পারেননি এমনটা ঘটতে পারে। যে নির্মল ছন্দে জীবনের শুরু হয়েছিল তার পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলেন। চারপাশে এমন একটা মানুষও ছিল না, যাকে মনের কথা বলেন। এরও অনেক দিন পরে এক মাছওয়ালীকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। যে না থাকলে আজকের ইন্দুবালা এমন ভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারতেন না। কিন্তু সেতো গল্পের ধরতাইয়ের দিক। আর এখন এই মুহূর্তে বুকের চাপা কষ্ট কাকে বলবেন ইন্দুবালা? সেইসব কথা কিছুটা জানে কর্পোরেশানের ওই ছিরছিরে জল পড়া কল আর বাগানের আমগাছ, নারকেল গাছ। তার ডালে কদাচিৎ এসে পড়া পাখিগুলো। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না বেরোয় মুখের ভেতর কাপড় খুঁজে নিতেন ইন্দুবালা। শুকনো মাটিতে চোখের জল পড়লে বৃষ্টি নামতো শহর জুড়ে। শাশুড়ি জল ভরা মেঘের দিকে তাকিয়ে তাঁর সংসারের মঙ্গল কামনা করতেন।

সেদিন এমনই ছিল ভাদ্রের আকাশ। ঘরে ছিল গুমোট গরম। দুই ছেলের পর মেয়েটা তখন পেটে। শাশুড়ি আর হাঁটতে চলতে পারেন না। খুবই অসুস্থ। ঘরের বিছানায় শুয়ে সব কিছু। ইন্দুবালা প্রাণপণে সেবা করেন তাঁর এই ভরা অবস্থায়। তখন দুদিন প্রায় খাওয়া নেই বুড়ির। হঠাৎ একদিন সকালে ইন্দুবালার কাছে আবদার করলেন, “বউ একটু বিউলির ডাল রাঁধলে দুটো ভাত খেতে পারতুম”। ইন্দুবালা তাড়াতাড়ি উনুন ধরিয়েছিলেন সেদিন। ডাল সেদ্ধ করে মৌরি ফোড়ন দিয়েছিলেন। নামানোর আগে একটুখানি চিনি। বুড়ি ওঘর থেকে চিৎকার করছিলেন হাঁপ ধরা গলায়। “হলো তোর বউ? আর কত দেরী?” পদ্মকাটা বাটিতে ডাল ঢেলে, কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে যত্ন করে খাইয়েছিলেন শাশুড়িকে। সবটুকু ভাত আর ডাল বিছানার সাথে মিশিয়ে যাওয়া বুড়ি কোথায় যে নিয়ে নিচ্ছিলো ইন্দুবালা নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন না। খাওয়া শেষ হলে বুড়ির চোখ গড়িয়ে নেমেছিল করুণাধারা। আশীর্বাদ করেছিলেন, “সবাইকে এইভাবে খাইয়ে পরিয়ে সুখী রাখিস বউ”। কথিত আছে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ কথা খনার বচনের থেকেও নাকি ফলপ্রদ। সত্যি তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল ইন্দুবালার জীবনে। না হলে এতগুলো মানুষকে এই বয়সেও খাওয়াতে পারেন? তবে যেটা তিনি এখনও বুঝতে পারেননি মানুষ কী করে জানতে পারে এটাই তার শেষ খাওয়া? না হলে সেই ভাত খাওয়ার পর বুড়ি আর মুখে কুটোটি নাড়েনি সারাদিন। পরের দিন সকাল বেলায় চা নিয়ে শাশুড়ির ঘুম ভাঙাতে গিয়ে শুধু দেখেছিলেন পাঁচিলের গা ঘেষা জানলার দিকে তাকিয়ে আছেন বুড়ি অপলক দৃষ্টিতে। আকাশে তখন ভাদ্রের জল ভরা মেঘ। মা… মা… বলে দুবার ডেকেছিলেন ইন্দুবালা। শেফালীরানী আর কোনোদিন সাড়া দেননি। ছেনু মিত্তির লেনের অনেক পুরোনো বাড়ির মতো ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছেন মনের মণিকোঠায়।

ধনঞ্জয় হাঁপাতে হাঁপাতে দোতলায় আসে। হড়বড় করে বলে যায় কথা। “আমি কত বারণ করলাম। শুনুচি না আমার কথা। ওই ছেলেগুলানরে আরও মাথায় তুলুচি…। তো এমন হউচি”। ইন্দুবালা হেসে পারেন না। ধনঞ্জয়ের ভাষা ঘটি, বাঙাল ওড়িয়া মিলে মিশে একাকার। মাথার চুলগুলো সব সাদা ধবধবে। তাও ছোটো ছোটো করে ছাঁটা। আবার যত্ন করে একটা টিকিও রেখেছে। গামছা ছাড়া অন্য কিছু তিনি পরতে দেখেননি ধনঞ্জয়কে। শীতকালে শুধু গায়ে উঠতো একটা চাদর। তাও খুব জোরাজুরি করার পর। ইন্দুবালার জীবনে যেন অন্ধের যষ্টি এই ধনঞ্জয়। জীবনের নাড়ি নক্ষত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ধনার কাছ থেকে সবটা শোনার আগেই সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পান ইন্দুবালা। কারা আসছে? এইসময় তো কোনো পুজো নেই। চাঁদার বালাই হওয়ার কথা নয়। আর ছেলে ছোকরাগুলো চাঁদা চায় না তার কাছে। আবদার করে এটা ওটা নিয়ে যায়। কিংবা দুবেলা খেয়ে যায় সবাই মিলে এসে। বড় একটা কেউ দোতলায় ওঠে না নাতি-নাতনি ছাড়া। কিন্তু তাদেরও তো এখন আসার সময় নয়। কিছুদিন আগেই তো সুনয়নীকে ঠেলে পাঠালেন নিজের বাবার বাড়ি। শুনেছেন কোনো কলেজে নাকি পড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে সে এসে পড়লেও এখন তার মোটেই আসার কথা নয়। ইন্দুবালা এগিয়ে যান দোতলার সিঁড়ির কাছে। সামনেই যাকে দেখতে পান, সে কিংশুক। উলটো দিকের মেসে থাকে। কলেজে পড়ছে। মাঝে মাঝেই রান্না খেয়ে দিদা বলে জড়িয়ে ধরে। ফরসা দেখতে। চোখে আবার গান্ধি ফ্রেমের কালো চশমা। শহরে নতুন উঠেছে। আর চাঁদি পর্যন্ত ছাঁটা ফুলকাট চুল। তার ওপরটায় আবার ঢেউ খেলানো বাবড়ি। বড় ভালো লাগে এমন সব আজব সাজগোজ দেখতে ইন্দুবালার। ছেলেটা দোতলার একেবারে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়ায়। ধনঞ্জয় তেড়ে আসে। এরপর সে এগোতে দেবে না কাউকে। হড়বড় করে বলে যাওয়া কথায় যেটুকু বোঝা যায় কিংশুক হোটেলের সামনে টাঙানো কালো বোর্ডের লেখা মুছে দিয়েছে। যেখানে প্রতিদিনের মেনু লেখা থাকে। ইন্দুবালা বলেন “এ তো ভারী অন্যায় কিংশুক। আমার লেখা মোছো কী করে?” কিংশুক তখনও হাঁপাচ্ছে। তার সদ্য তারুণ্য হার মানতে শেখার নয়। “শোনো দিদা। সত্যি বলছি। আমি তো ছিলামই না কয়েকদিন। বাড়ি গিয়েছিলাম। কাল লাস্ট ট্রেনে বর্ধমান থেকে ফিরেছি। মুড়ি জল খেয়ে শুয়ে পড়েছি…। না না প্লিজ তুমি আগে আমার কথা শোনো। আজ সকালে উঠে দেখি ইন্দুবালা ভাতের হোটেল রান্না হবে কচুর ডালনা, মুসুরির ডাল, আর ট্যাঙরা মাছ? এ কেমন কথা দিদা? আজ সুজিতের জন্মদিন ও খাবে কী? এ্যাই সুজিত তুই আবার রূপম, সাবেরের পেছনে লুকোচ্ছিস কেন? এদিকে আয়”। পেছনের ছোট খাটো ভিড় ঠেলে যে ছেলেটা এগিয়ে আসে তাকে দেখে চমকে ওঠেন ইন্দুবালা। কোঁকড়ানো চুল। গালে হালকা দাড়ি। কালো বার্নিশে গায়ের রঙ। হাসলে টোল পড়ে গালে। চোখে শুধু চশমাটুকু নেই। এতোদিন পরে এইভাবে কেউ ফিরে আসে? সত্যি কি আসা যায়? তিনি শুধু জানেন অলোক কোনোদিন ফিরবে না। ফিরতে পারে না। কারণ অলোকের বুক ফুড়ে ঢুকে গিয়েছিল পাঁচ-ছটা গুলি। তার দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশের জিপ। অন্ধকারে ডুবে থাকা এই কলকাতা শহর শুধু সাক্ষী ছিল তার। “কী হলো দিদা? কথা বলছো না কেন?” কিংশুক সমেত ছেলেদের দলটা তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। “সুজিতকে আগে কখনও তো দেখিনি”। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন ইন্দুবালা। কিংশুক হেসে ফেলে। “ও এই কথা … তা দেখবে কী করে? ওকে তো হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।” হো হো করে হেসে ওঠে ছেলের দল। আর যে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন ইন্দুবালা অপলক দৃষ্টিতে যেন বহু যুগের ওপার থেকে সে যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। স্টুডেন্ট হোস্টেলের খাবার নিয়ে আন্দোলন করছিল বলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাড়িয়ে দিয়েছে সুজিতকে। ছেলেটা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ইন্দুবালাকে। এমনিতে কারও প্রণাম নিতে চান না তিনি। কিন্তু আজ নিলেন। কেন নিলেন নিজেও ঠিক জানেন না। আপত্তি করার সময় হয়তো দেয়নি ছেলেটা। শুধু মনে মনে ইন্দুবালা জানতে চাইলেন, “অমন ভাসা ভাসা চোখ নিয়ে এতোদিন পরে ফিরে এলে কেন অলোক?”

বড় বেতের ঝুড়ি দিয়ে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকতো রান্নাঘরে। অনেক রাতে শহর নিশুতি হলে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের পেছনের দরজায় কড়া পড়তো একবার। ওটা সাংকেতিক শব্দ। মানে “জেগে আছো কমরেড ইন্দুবালা?” “কমরেড? সেটার আবার কী মানে?” অলোক ফস করে সিগারেট জ্বালায়। “বন্ধু …সাথী..সহযাত্রী…সহযোদ্ধা…এক এক সময় এক এক রকমের মানে। আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। তা না জেনে আমাদের খাওয়াচ্ছেন কোন সাহসে? গোটা শহর আমাদের কী বলে জানেন?” ইন্দুবালা ঘাড় নাড়েন, না জানেন না। অলোক শিড়দাঁড়া সোজা করে বলে “নকশাল”। ইন্দুবালার চকিতে মনে পড়ে যায় অলোকের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনের কথা। সবেমাত্র হাতের সব কাজ সেরে হোটেল বন্ধ করে দোতলায় উঠবেন। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন। ধনঞ্জয় সে সময়ে কয়েকদিনের জন্য দেশে গেছে। হাওয়ার শব্দ ভেবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দোতলার সিঁড়ির দিকে ইন্দুবালা। কিন্তু আবার শব্দটা হলো। হ্যাঁ এবার স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন তিনি। থমকে দাঁড়াতেই হলো। রান্নাঘরের পেছনের দরজার দিক থেকে আসছে শব্দটা। ওদিকটায় বাগান। বাগানের শেষে পাঁচিল। লোকজন আসবার হলে সামনের দরজা দিয়ে আসে তারা। পেছনের দরজা সচরাচর কেউ ব্যবহার করে না ইন্দুবালা আর ধনঞ্জয় ছাড়া। তাহলে কি অন্য কেউ? কোন মতলবে? সেই সময়ে ইন্দুবালার বাড়ি নিয়ে শরিকি ঝামেলা তুঙ্গে। স্বামী নেই, শাশুড়ি নেই, মাঝে মাঝেই কেউ না কেউ বাড়িতে এসে হম্বিতম্বি করে চলে যায়। একলা বিধবা পেয়ে লিখিয়ে নিতে চায় সবকিছু। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারাই আবার গুণ্ডা পাঠালো না তো! আঁশ বটিখানা হাতে তুলে নেন ইন্দুবালা। একটাকে শেষ না করে আজ নিজেও শান্তি পাবেন না। তারপর না হয় বাচ্চাগুলোকে সঙ্গে করে নিজেই যাবেন থানায়। আর নিজে মরে গেলে তো শেষ হয়ে গেল সব কিছু। পরক্ষণেই মনে হয় তাহলে বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে? ওরা যে বড্ড ছোটো। নিজের মারা যাওয়ার চিন্তাটাকে আপাতত সরিয়ে রাখেন ইন্দুবালা। মনে প্রচণ্ড সাহস জুগিয়ে এগিয়ে যান দরজার দিকে। “কে? কে ওখানে?” উত্তর আসার বদলে আবার একবার কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। আর নিজেকে সামলাতে পারেন না ইন্দুবালা। রাগের মাথায় খুলেই ফেলেন দরজা। “আয় তোদের শেষ করবো আজকে আমি”। কিন্তু সেই লোডশেডিং-এর রাতে সামনে এরা কারা? বাগানের মধ্যে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে সব। নড়েও না, চড়েও না। কুপিখানা তুলে ধরেন ইন্দুবালা। আর ঠিক তখনই আলোছায়ার মধ্যে উপলব্ধি করেন এরা তো গুণ্ডা নয়। তার চারপাশে জ্ঞাতি কুটুমদের মতো সম্পত্তি লোভী কুলাঙ্গার নয়। চোখগুলো ভাসা ভাসা যেন কোনো এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সবচেয়ে রোগা ছেলেটা এগিয়ে আসে। “কিছু মনে করবেন না। এতো রাতে বিরক্ত করলাম আপনাকে। আমার নাম অলোক। আর এরা আমার বন্ধু। আমাদের একটু খেতে দেবেন? দু-দিন কিছু খাওয়া হয়নি।” অনেক রাতে ভাত বসিয়েছিলেন ইন্দুবালা। সাথে ছিল একটু আলু পোস্তর চচ্চড়ি। চেটেপুটে খেয়ে চলে গেল ছেলে মেয়েগুলো। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আসতে থাকলো অনেক রাতে। কখনও অলোক একা। অথবা সঙ্গে করে দু তিনজনকে নিয়ে। ওরা খাবারের পয়সা দিতে পারতো না। চাইতেন না ইন্দুবালা কোনোদিন। কিন্তু একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন নিজের চারপাশ জুড়ে। আর বদমায়েশ আত্মীয়রা তার ওপর খবরদারি দেখাতে আসতো না। ভয় দেখাতে তো নয়ই। বরং তাঁকে দেখলে সরে পড়তে টুপটাপ। লছমী কোথা থেকে খবর এনে দিল, “আচ্ছাসে ওদের ডরা দিয়া মাজি তোর ওই ছেলে মেয়ে গুলো। তুইও সাবধানে থাকিস। ওরা নকশাল আছে। কখন আবার পুলিশ আসে।” কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ইন্দুবালার গা। “নকশাল”? আজকেই তো কালেক্টর অফিসের কেরানিরা খেতে এসে কি সব ফিসফিস করে আলোচনা করছিল। “কটা ছেলে মারা গেছে। গঙ্গার ঘাটে বোমা। সব নকশাল … নকশাল…। বিপ্লব করে দিন দুনিয়া পালটে দেবে”।

অলোক তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। “এইবার তো জেনে গেলেন আমরা কে? নিশ্চই এর পরের বার থেকে আর দরজা খুলবেন না।” ইন্দুবালা কি সেদিন কিছু বলতে পেরেছিলেন? নাকি তার চোখ ভারী হয়ে আসছিল জলে। মনে পড়ে যাচ্ছিল ভাইয়ের কথা। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গড়ার দাবিতে সেও তো তখন মুক্তি যোদ্ধা। অনেক দিন পরে লুকিয়ে বাড়িতে এসেছিল দুটো ভাত খাবে বলে। মাও সেদিন বেড়ে দিয়েছিল গরম ভাত। প্রথম গ্রাস মুখে তোলার আগেই বাড়িটা দাউ দাউ করে জলে ওঠে। মাকে, ভাইকে কাউকেই বেরোতে দেয়নি খান সেনারা ওই জ্বলন্ত কুণ্ড থেকে। মালাউন পুড়িয়ে পুণ্য করেছিল তারা। ভাই কি সেদিন চিৎকার করেছিল? নাকি সেই লেলিহান শিখার মধ্যে মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসেছিল? মা কি তাকে সেদিন রাখালের পিঠে খাওয়ার গল্পটা বলছিল? নাকি ঘুম পাড়ানিয়া গান শোনাচ্ছিল সুর করে করে? এগুলো সেই পাগলাটে লোকটার কাছে জানা হয়নি সেদিন। জানতে পারেননি ইন্দুবালা। তার আগেই সে চলে গিয়েছিল। কোথায়? কেউ জানে না। “আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না কমরেড। ধরে নিচ্ছি আপনি আর চান না আমরা এখানে আসি।” দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল অলোক। ইন্দুবালা অস্ফুটে বলেছিলেন, “একদিন রাতে যখন দরজা ধাক্কিয়ে ভাত খেতে এসেছিলে তখন তো জানতে চাইনি কিছু। আজ কেন জানাচ্ছ? মা বলতো অতিথির কোনো পরিচয় হয় না। ধর্ম হয় না। তাঁরা হন ঈশ্বর”। তাকাতে পারেনি অলোক ইন্দুবালার দিকে। সে সাহস তার ছিল না। যদিও দুটো ঘোরেল পুলিশ ইন্সপেক্টর আর গোটা একটা গোয়েন্দা দপ্তরকে সে আদাজল খাইয়ে ঘোরাচ্ছিল সেই সময় কলকাতার রাস্তায়। অলিতে গলিতে। লালবাজারে একজন তাঁদেরও ওপরের লোক হাতে লোহার বেড়ি নিয়ে বসে ছিলেন এইসব বেয়াদপ ছেলে মেয়েদের কাছে নিজের সাদা-কালো আমিকে চিনিয়ে দেবার জন্য। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তারা। এতো সব দস্যিপনা করা ছেলেটা সেই নিশুতি রাতে এক সহজ সরল গেঁয়ো বাঙাল বিধবার কথার পিঠে কথা জুড়তে পারেনি। শুধু বিড়বিড় করেছিল “ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না কমরেড। কিন্তু আপনারা থাকুন। আপনারা থাকলে আমরা থাকব।”

অনেক রাত পর্যন্ত কান পেতে থাকতেন ইন্দুবালা। অপেক্ষা করতেন অলোকের জন্য। তার সঙ্গীদের জন্য। সারাদিন ওরা খালি পেটে, পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে বেড়িয়ে অধিকার আদায় করছে। মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। চাড্ডি ভাত-ডালের অধিকার। অপমানিত না হয়ে স্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়াবার অধিকার। ঠুক শব্দ শুনলেই নিজে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেন ইন্দুবালা। ছেলেটা সাতদিনের ভাত একদিনে খেয়ে কোথায় যে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যেত কে জানে! মজা করে ইন্দুবালা তার একটা ছদ্ম নাম দিয়েছিলেন, প্যাঁচা। প্যাঁচার জন্য রোজ ভাত বাড়া থাকতো। কিন্তু প্যাঁচা রোজ আসতো না। তার আসা সম্ভব ছিল না। রাতের অন্ধকারে শুধু একটা গলা ফিসফিস করে ভেসে বেড়াতো “কমরেড ইন্দুবালা আপনারা থাকলে আমরা থাকবো।” কিন্তু কই। ইন্দুবালা তো আছেন। তাহলে অলোক নেই কেন? সুশান্ত নেই কেনো? গোরা নেই কেন? কৃষ্ণা নেই কেন? প্যাঁচার দলটা যে আর ভাত খেতে আসেনি কোনোদিন। এরও অনেক পরে শুনেছিলেন বরানগর ঘাটে পিচ আর ব্লিচিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল রক্ত। অলোকের দেহটা দুবার নড়ে উঠে স্থির হয়ে গিয়েছিল সেদিন। চোখদুটো খোলা ছিল আকাশের দিকে। তারায় ভরা আকাশ দেখছিল কি অলোক? নাকি বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন শহর জুড়ে? ধুয়ে যাচ্ছিল রক্ত। মিশে যাচ্ছিল গঙ্গার জলের সাথে। ভেসে চলছিল নিথর দেহগুলো ঢেউয়ের তালে তালে সপ্ত ডিঙার মতো। অজানা এক স্বপ্নে। সত্তরের দশক মুক্তির দশক হতে পেরেছিল কিনা ইতিহাস তার মূল্যায়ন করেনি কোনোদিন। করবে কিনা তাও জানা যায় না। কিন্তু সেদিনও এক বিধবা হোটেল মালিক হাঁড়িতে কিছুটা চাল বেশি নিয়েছিলেন। যদি ফিরে আসে ছেলে-মেয়েগুলো। যদি তার কাছে এসে আবার ভাত চায়। অপেক্ষায় ছিলেন রাতের পর রাত। কিন্তু তারা কেউ ফেরেনি।

কেউ যেন একটা হাত ধরে ইন্দুবালার। ছানি না পাকা ঘোলাটে চোখে সামনে তাকান তিনি। কিংশুক দাঁড়িয়ে। পাশে সুজিত। আরও পেছনে ইন্দুবালার সব চাঁদপানারা। “দেখবে না দিদা তোমার বোর্ডে কী লিখেছি? তারপরে তুমি ডিসিশান নিও এইগুলো আজ রান্না করবে নাকি করবে না”। ওরা দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। ইন্দুবালা কি আর অত তড়বড় করতে পারেন? হাঁটুর ব্যথা, গেঁটে বাত নিয়ে এক দঙ্গল ছেলের সঙ্গে যখন সেই কবেকার কালো সিমেন্টের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ান তখন তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে ভাদ্রের বৃষ্টির মতো। কবেকার অলোক, গোরা, সুশান্ত, কৃষ্ণা যেন কিংশুক, সুজিত, রূপম, সাবেরের হাত ধরে এসে লিখে গেছে তার বোর্ডে। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের আজকের মেনুতে জ্বলজ্বল করছে ভাত, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত, কালো জিরে দিয়ে পার্শে মাছের ঝোল, বিলাতি আমড়ার চাটনি। ইন্দুবালা জানেন এরপর তিনি আর স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না। যতক্ষণ না ছেলেগুলোর মুখে হাপুস হুপুস শব্দ ওঠে। যতক্ষণ না সারা বাড়ি ছড়িয়ে যায় বিউলির ডালে মৌরি ফোড়নের গন্ধে। পার্শে মাছে কালো জিরের পাশে কাঁচা লঙ্কার আবেশ করা ঝোলে। আলু পোস্তর একটু কাঁচা তেলের সুবাসে। বিলাতি আমড়ার টকে সর্ষের মনকাড়া তীব্র ঝাঁঝে। টেবিলে কলাপাতা পাতা হয়। মাটির গ্লাসে জল। লেবু, নুন, লঙ্কা। এক পেট খিদে আর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কবেকার হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের হয়ে এখনকার প্রজন্ম ভাত খায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। ইন্দুবালা আজও বিশ্বাস করেন অতিথির কোনো ধর্ম হয় না। বর্ণ হয় না। জাত, গোত্র কিছু না। অতিথি হন ঈশ্বর।

ছ্যাঁচড়া

কোনো এক আষাঢ়ের সকালে জন্ম হয়েছিল ইন্দুবালার। মায়ের মুখে শুনেছিলেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি বেয়ে বৃষ্টির জল ঢুকেছিল আঁতুড় ঘরে। জল থইথই মেঝেতে সদ্য জন্মানো শিশুটি সাঁতার কাটছিল যেন। ঠাম্মা কোলে তুলে নিতেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। “এমন চাঁদপানা মুখ তুই পেলি কোত্থেকে এই বংশে”? সোহাগ করে নাতনির নাম রাখলেন ইন্দুবালা। তারও বছর পাঁচেক পরে মাঘের কুয়াশা ভরা ধান ক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে বাবার হাত ধরে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। শুধু এইটুকু মনে আছে ফুল ফুল ছাপ একটা ফ্রক পরেছিলেন। গায়ে ছিল মায়ের বোনা সোয়েটার। মাথায় উলের টুপি। ঠাম্মার কাছে শোনা রূপকথার রানী বলে মনে হচ্ছিল সেদিন নিজেকে। ঠাকুরদার টোলটা তখনও চলছে টিম টিম করে। সেই টোলে বর্ণপরিচয়, ধারাপাত এইসব টুকটাক শিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন সেখানে পড়া হলো না। আমের গাছে মুকুল ভরিয়ে, সরস্বতী পুজোয় হাতেখড়ি দিয়ে দাদুর বড্ড তাড়াতাড়ি ছিল হয়তো এক্কেবারে চলে যাওয়ার। শিশিরে ভিজেছিল টোলের রাস্তাটা। সেদিন কেউ আর দাওয়া ঝাঁট দেয়নি। উঠোন লেপেনি। পাশের মুকুল ভর্তি বুড়ো আমগাছটা কাটা হয়েছিল দাদুর সৎকারের জন্য। ঠিক এর পরেই দুটো গাঁ পেরিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন ছোট্ট ইন্দুবালা। পড়াশুনোয় তাঁর বেজায় মন ছিল। দাদু সেই ছোট্টবেলাতেই তাঁকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইয়া বড় বাড়ি। সামনে কত কত গাড়ি। বেণী দুলিয়ে, শাড়ি পরে ইন্দুবালা কলেজ করছে। এমন একটা ঝাপসা ছবি যেন আলপনার মতো আঁকা থাকতো মনে। ওইটুকুনি মেয়ে এত সব কিছু যে বুঝতো তেমনটা ঠিক না। শুধু অনেক দূরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতো। এক্কা-দোক্কা, লুকোচুরি, খেলনা বাটির বয়েস পার করে ইন্দুবালা প্রবেশ করলেন এবার হাইস্কুলে। সেখান মেয়ে বলতে হাতে গোনা ওই কজন। মাঝের পাড়া, পুবের গাঁ আর কলাপোতা মিলিয়ে মেয়ের সংখ্যা তেমন একটা ছিল না। থাকবেই বা কী করে? সবাইকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিতো না বাড়ির লোকজন। ছেলের পালের মধ্যে মেয়ে বসবে শুনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতো অনেকের। ইন্দুবালার মা’র পছন্দ ছিল না স্কুলটা। কোনোদিনই। বাড়িতেই তো পড়াশুনা করা যায়। অনেক বার সে কথা বলেছেন স্বামীকে। কিন্তু যার বাবার টোল ছিল, যে নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কালে পড়াশোনা করেছে; কিন্তু ভাগ্যের ফেরে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে এসে সংসারে হাত লাগিয়েছে, সে তার মেয়েকে পড়াবে না তা হতে পারে। তাই লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়াটা চলছিল ইন্দুবালার দিনের অন্যান্য কাজের মতোই। সেটাও অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মায়ের খানিকটা চিল চিৎকারেই হোক, আর চারপাশের পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যাওয়ার কারণেই হোক কোনো এক সূত্র ধরে বাবা চিঠি লিখেছিলেন তাঁর বনগ্রামের এক বন্ধুকে। কন্যার বিবাহ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করিতে চাই। ভালো পাত্ৰ থাকিলে জানাইও’। সেখান থেকে উত্তর পেতে দেরি হয়নি। ছেলে একেবারে ‘মাস্টার। নিজেদের দোতলা বাড়ি। বনেদী বংশ। বন্ধুর বিশেষ পরিচিত। শুধু একটু খুঁত আছে। “খুঁত?” ঠাম্মা সেদিন বাড়িতে তালের ভাপা পিঠে করেছিলেন। গ্রামে অষ্ট প্রহরের জন্য বাড়িতে ছিল নিরামিষ রান্না। হাঁড়িতে সেদিন বসেছিল আতপ চালের খিচুড়ি। আলুগুলো ডুমো ডুমো করে কাটা ছিল। বাগান থেকে ইন্দুবালা তুলে এনেছিলেন অসময়ের কাঁচা টমেটো। নামানোর আগে ঠাম্মা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন হরিমতির দুধে তোলা বাড়ির ঘি। কলাপাতায় ঘিয়ের গন্ধ ওঠা খিচুড়ি খেতে বসে ‘দোজবরে’ শব্দটা জীবনে প্রথম শুনেছিলেন ইন্দুবালা। ছাদনা তলায় ছেলেকে দেখে ডাকাত মনে হয়েছিল তাঁর। ইয়া গোঁফ, বাবরি চুল। চোখ লাল টকটকে। দাঁতগুলো খয়েরের ছোপে মলিন। নিশ্বাসে দুর্গন্ধ। ছেলে বরণ করে এসে এই প্রথম মা বাবার হাত ধরে জানতে চেয়েছিলেন “সব খবর নিয়ে দিচ্ছো তো মেয়েকে? গা দিয়ে যে গন্ধ বেরোয়। সবাই ফিসফিসাচ্ছে। বলছে মাতাল বর”। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসর ঘরে কড়ি খেলা শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই বউয়ের পাশে দোজবরে স্বামী ঘুমে ঢলে পড়লে ইন্দুবালা ভালো করে তাকিয়েছিলেন লোকটার মুখের দিকে। হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিক। নাক ডাকার চোটে বাইরে এসে বসেছিলেন ইন্দুবালা। চারিদিকের অন্ধকারে সেই শেষবারের মতো জোনাকিগুলো যখন আলো জ্বালিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরলো তখন নিজেকে আর সামলাতে পারেননি তিনি। ভেঙে পড়েছিলেন। একটা মেয়ে তার যাবতীয় শেষ স্বপ্নটুকু নিয়ে কাঁদছে। তার সাক্ষী কোনো কাছের মানুষ ছিল না সেদিন। কোনোদিনই অবশ্য থাকেনি ইন্দুবালার পাশে কেউ। কিন্তু জামগাছটা ছিল। তুলসীতলা ছিল। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠে আমগাছটা যেন ডালপালা নেড়ে বলেছিল “কাঁদিস না ইন্দুবালা। একটুও কাঁদিস না। এটা তোর নিয়তি”। এরপর ইন্দুবালার আর কোনোদিন বসা হবে না নিজের বাড়ির এই দাওয়ায়। ফেরা হবে না জন্মভূমিতে। কলাপোতা গ্রামটা সশরীরে মুছে যাবে তার ভৌগোলিক স্থাবর অস্থাবর সব কিছু নিয়ে। ইন্দুবালার শুধু মনে রয়ে যাবে এক অলৌকিক অনুভূতি। দেশ নামের স্পর্শ না করা এক স্বপ্নকে।

মেয়ের হাত থেকে কনকাঞ্জলি নিয়ে মা আর ফিরে তাকাননি। নিয়মও ছিল না। এক রাতের মধ্যেই তিনি বুঝেছিলেন কার হাতে মেয়েকে তুলে দিলেন শেষ পর্যন্ত। নিজের স্বামীকে বেশি কিছু বলতে পারনেনি। এমনকি দায় চাপাতেও না। কারণ তিনি জানতেন তাঁর মেয়ে দিন-দিন একটা আগুনের গোলা তৈরী হচ্ছে। ওই রূপ এই পাড়া গাঁয়ে, খাল বিল পুকুরের পাশে, শাপলা গন্ধরাজের মতো যত ফুটে বেরোবে, তত বাড়ির বিপত্তি বাড়বে। এমনিতেই রাত বিরেতে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। এগিয়ে গিয়ে দেখেন দরজার হুড়কো ভালো করে দেওয়া আছে কিনা। বাড়িতে আগুন রাখলে তার সাথে যে পর্যাপ্ত জলও রাখতে হয় সেটা মনে করেই হাত পা সিঁধিয়ে যেত তাঁর। পাশের গ্রাম থেকে মনিরুল মাঝে মাঝেই আসতো ইন্দুবালার কাছে পড়া দেখতে। সমবয়সী তারা। এক্কেবারে পছন্দ হতো না মায়ের। ইন্দুবালা সেটা বুঝতেন। কিন্তু মনিরুলকে খুব মিষ্টি লাগতো তাঁর। গুটি আমে সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, চিনি মাখিয়ে খেলে যেমন মনিরুল ঠিক তেমন। লজ্জায় মুখে লাল হয়ে যায় ইন্দুবালার। এইসব কী ভাবছেন তিনি? তড়িঘড়ি বাইরের দাওয়ায় আসন পেতে, কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে বসতে দিতেন মনিরুলকে। এই বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ির বাধ বিচার তেমন না থাকলেও মনিরুলের জায়গা কোনোদিন বাড়ির অন্দরে হয়নি। হতোও না কোনো কালে। যদিও ধর্ম-জাত এইসব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাতেন না দাদু। কিন্তু বাবা মা ছিলেন উলটো পথের পথিক। ছুত্সর্গের বাছ বিচার যে কত দূর যেতে পারে তা ইন্দুবালা দেখেছিলেন কলকাতায় এসে। শাশুড়ির সংসারে। তার জীবন থেকে সবাই চলে যাবার পর ইন্দুবালা এই সব এঁটো কাটা পরিষ্কার করেছিলেন দু হাত দিয়ে। তাঁর কাছে মানুষ মানে ছিল জীব। তিনি পেট ভরে খাইয়ে জীবে প্রেম করতেন।

মনিরুলের তখন সদ্য গোঁফ উঠেছে। কেষ্ট ঠাকুরের মতো বাঁশি বাজায়। চোখ গোল গোল করে বাতাবি লেবু গাছের তলায় চন্দ্রবোড়ার বাসার গল্প করে। নৌকায় দাঁড় বেয়ে নিয়ে যায় পাশের গ্রামে। শুধু তাই নয় সুর করে মাঝে মাঝে কবিতাও বলে …

“আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি।
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি
কোন সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি!”

‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এ সাজু আর রুপাইয়ের করুণ পরিণতি বারবার যেন শুনতে চান ইন্দুবালা মনিরুলের কণ্ঠে। জসীমউদ্দিন যে তাঁর বড় ভালোলাগা কবি। বাবার কাছে কত গল্প শুনেছেন। একবার যখন ইন্দুবালা খুব ছোটো, এই গ্রামে এসেছিলেন নাকি কবি। তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে চিড়েভাজা খেয়েছিলেন। ঠাম্মা দিয়েছিল কোঁচড় ভরা নাড়। আমসত্ত্ব। তাল পাটালি। মনিরুলের এইসব গল্প শুনতে ভালো লাগে। আর ইন্দুবালার ভালো লাগতো মনিরুলের গলায়, ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ শুনতে। চোখ ভিজে আসে সাজু আর রূপাইয়ের দুঃখে। ঝি ঝি ডেকে ওঠে। ঠাম্মা চুপ করে সলতে পাকান। ভাই কবিতা শুনতে শুনতে হাঁ করে বসে থাকে সবে সন্ধ্যে নামা কলাপোতার মাটির বাড়ির দাওয়ায়। দূরে আজানের শব্দ ভেসে আসে পাশের বাড়ির সন্ধ্যের শাঁখে। চেয়ে থাকেন ইন্দুবালা মনিরুলের দিকে। কবেকার মনিরুল তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সহজ সরল টানাটানা চোখে তাকায়। আর এদিকের সত্তর পেরোনো ইন্দুবালা যেন একটুও নড়তে পারেন না বিছানা থেকে। চুপ করে শুয়ে থাকেন। উনি জানেন এই ঘোরটুকু নিয়েই এখনও বেঁচে আছেন। যেদিন এই ঘোর কেটে যাবে, সেদিন তিনিও চিরকালের মতো ছেনু মিত্তির লেন ছেড়ে কোথায় কোন দূরের পথে পা বাড়াবেন।

ধনঞ্জয় নীচ থেকে ডাকছে। তাকে বাজারের টাকা দিতে হবে। ফর্দ করতে হবে। কিন্তু আজ তাঁর যেন কিছুই শুনতে ইচ্ছে করছে না। কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। বর্ষার বেলা গড়াচ্ছে, তিনি চুপটি করে শুয়ে আছেন। কারণ ওদিকে মা গ্রামের সেই সন্ধ্যে হয়ে আসা ভালোবাসার পরিবেশে শুধু শুধু তাড়া লাগাচ্ছে। মা বুঝতে পারছেন লক্ষণ ভালো না। আগুনের গোলা হয়ে উঠছে মেয়ে। সবার চোখ তার দিকে। এমনকি এই একরত্তি ছেলেটারও। শেষকালে কিনা মেয়ে বিধর্মী হবে? বাড়ি থেকে পালাবে? কিংবা পাশের গ্রামের স্বর্ণলতার মতো দেহটা ভেসে উঠবে পুকুরে? ছেলেটাকেও তো ছাড়েনি বাড়ির লোকেরা। ধান ক্ষেতে কুপিয়ে রেখে দিয়েছিল। ভাবতে পারেন না আর। একটা ছোট্ট ভুলের জন্য বেঘোরে যাবে দুটো প্রাণ। ছোট্ট ভুল? হ্যাঁ তাই তো। কবে আর কার জীবনে ভালোবাসা অনেক বড় হয়ে এলো? আর যদি আসতোই তাহলে চারপাশটা পালটে যেত না খুব তাড়াতাড়ি? মুখ দিয়ে বেরিয়েই যায় “এবার তুই উঠে পড় মনিরুল। অনেকটা পথ যাবি। তোর মায়েরও তো চিন্তা হয় তাই না?” কথাগুলো বলতে পেরে যেন শান্তি পান ইন্দুবালার মা। মনিরুল গুছিয়ে নেয় তার বই। ব্যাগ। হাতের বাঁশি। লণ্ঠন নিয়ে উঠোনটা পার করে দিয়ে আসেন ইন্দুবালা। দাঁড়িয়ে থাকেন বেড়ার দরজায়। যতক্ষণ না মনিরুল সামনের আলটা পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলেন কি মনিরুলকে ইন্দুবালা? বেসেছিলেনই তো। না হলে কে লুকিয়ে লুকিয়ে মনিরুলের জন্য নাড় নিয়ে যেত? মুড়ির মোয়া। কুলের আচার। গপ গপ করে ছেলেটা খেত। আর এক টানা গল্প করে যেতো। কত যে গল্প ছিল মনিরুলের ওই ছেঁড়া কাপড়ের ব্যাগে ঠাহর করতে পারতেন না ইন্দুবালা। তাহলে কেন কোনোদিন মনিরুলকে নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলতে পারেননি? ভয় করেছিল তাঁর? নাকি বড় অভিমান করেছিলেন। মনিরুলের ওপরে? মা আসতে বারণ করেছিল মনিরুলকে। তাই বলে সে আর এই পথই মাড়াবে না? স্কুলেও কথা বলবে না? লুকিয়ে লুকিয়ে থাকবে সব সময়? চোখ ফেটে জল আসতো ইন্দুবালার। টিফিন কৌটোতে পড়ে থাকতো আমলকি, নলেন গুড়ে পাকানো রুটি। তারা যে এক সাথে বসে দুজনে খেত। সে কথা কি মনিরুল ভুলে গেছে? খিদে পায় না বুঝি ইন্দুবালার? একদিন স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিল মনিরুল। কারা যেন রটিয়ে দিল কলাপোতার ইন্দুবালার সাথে সাতদিঘি গ্রামের মনিরুলের প্রেম হয়েছে। চিঠিও নাকি পেয়েছে তারা। বাড়িতে বন্দি হলেন ইন্দুবালা। আলের ধারের জানলার কাছে চুপ করে বসে থাকতেন। সন্ধ্যের শাঁখ বাজতো। আজান তার ঠিক সময় মতোই হতো। কিন্তু মনিরুলকে আর আলোর পথে দেখা যেত না। এতটাও কেন ভালোবাসতো মনিরুল ইন্দুবালাকে? যে ভালোবাসার দাম দিতে গিয়ে হারিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে।

বিয়ের অনেকদিন পরে শাশুড়ি যখন আর নেই। স্বামীর বাইরে থাকা এবং নেশার মাত্রা পাল্লা দিয়ে যখন আরও বেড়েছে। সংসারের হাল হয়েছে না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর মতো। ইন্দুবালা হিমশিম খাচ্ছেন ছোট্ট দুটো ছেলে আর কোলের মেয়েকে নিয়ে, তখন একজন ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন তাঁর সঙ্গে। সন্ধ্যের আলোতে জীবনের প্রথম প্রেমকে চিনতে একটুও দেরি হয়নি তাঁর। মনিরুলকে আরও সুন্দর লেগেছিল সেদিন। চশমা পরে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে সে। হাতে ছিল একটা চিরকুট। সেখানে পেন্সিলে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল ছেনু মিত্তির লেনের ঠিকানা। এত গল্প করা ছেলেটা এত শান্ত হয়ে যায় কী করে? বাড়ির ভেতরে এনে বসিয়েছিলেন মনিরুলকে। রান্নাঘরে ঢুকে আতিপাতি খুঁজছিলেন কী দিতে পারেন খেতে। অসহায় লাগছিল তাঁকে। বড়। কৌটোর তলানিতে পড়েছিল একটু চিড়ে সেইটুকুই ভাজলেন। সঙ্গে দিলেন চা। মনিরুলেরও বসার সময় ছিল না সেদিন। আত্মগোপন করে আছে যে সে কলকাতায়। পাকিস্তানের ঝানু গুপ্তচর ঘুরছে তাদের পেছনে। বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছে সে ইণ্ডিয়ায়। বালিগঞ্জের কোথাও ওরা একটা রেডিও স্টেশন খোলার চেষ্টা করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার। ইণ্ডিয়া সরকার তাদের সব রকম সাহায্য করছে। “একটা স্বাধীন দেশ পেতে চলেছি ইন্দু.. আর কোনো ভাবনা নেই…।” চোখ মুখ যেন জ্বলজ্বল করছে মনিরুলের। ইন্দুবালারও কি ইচ্ছে হচ্ছে না? আজ ওর হাত ধরে যদি সে সত্যিই বেরিয়ে যেতে পারতো। দেশের কাজে। কী ভালোই না হতো! কিন্তু যে চক্রব্যুহের মধ্যে তিনি তখন আটকে পড়েছেন সেখান থেকে বেরোবেন কী করে? একদিকে মাতাল নেশাতুর স্বামী। অন্যদিকে ছোটো ছোটো তিন ছেলে মেয়ে। ইন্দুবালার জগৎ তখন অন্য। মল্লিক বাড়ির বউ তিনি। চলে যাবার আগে ইন্দুবালার হাতে মনিরুল দিয়ে গিয়েছিল ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বইটা। তার প্রথম পাতায় সই করে লেখা ছিল “ইন্দুকে..জসীমউদ্দিন”। চোখে জল ভরে এসেছিল ইন্দুবালার। এমন উপহার আজ পর্যন্ত কেউ তাকে দেয়নি। মনিরুল বলেছিল কবির সাথে দেখা হওয়ার বিস্তারিত গল্প। বলেছিল ইন্দুবালার বাড়ির কথা। তাদের ছোট্ট গ্রাম কলাপোতার কথা। তাল পাটালি আর তিলের নাড়র কথা। কবির চোখে যেন জল দেখেছিল মনিরুল। সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিয়েছিলেন তিনি। এখনও মনে আছে তাহলে সব কিছু মনিরুলের? ভোলেনি সে কিছুই? না, মনিরুল ভুলে যায়নি। মনিরুল ভুলতে পারে না। বিয়েও করেনি সে। করতে পারতো না মণিরুল। রূপাই কি বিয়ে করেছিল আর? কবরে মাথা রেখে মরেছিল সে। মনিরুল মরবে দেশের জন্য। স্বাধীনতার জন্য। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গড়ার জন্য। এটা তার ভালোবাসার দিব্যি। এত কথা সেদিন মনিরুল ইন্দুবালাকে বলে আসতে পারেনি। বলে আসা যায় না। কিছুটা সঙ্গোপনে বয়ে বেড়াতে হয়। আর কিছুটা হারিয়ে যায়। মনিরুল সেটা জানতো। এরপর থেকে ইন্দুবালা পাগলের মতো খুঁজে চলতেন স্বাধীন বাংলার রেডিও স্টেশন। পেয়েও যেতেন মাঝে মাঝে। বাঁশির সুরে চিনতে পারতেন মনিরুলকে। হঠাৎই মনে পড়ে যেত কপোতাক্ষের ঘাট। সন্ধ্যেতে বাড়ির দাওয়া। স্কুলের মাঠ। বিশালাক্ষী তলা। মনিরুলকে ভোলা যায় না। মনিরুলকে ভুলতে পারেননি ইন্দুবালা। কিন্তু সেই মনিরুলও সত্যি সত্যি হারিয়ে গিয়েছিল একদিন চিরকালের মতো। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল ইন্দুবালার সাথে। সে তো আরও একটা ভুবন কাঁপানো গল্প। সেদিকে এখন প্রবেশ করলে ইন্দুবালার প্রথম জীবন অধরা থেকে যাবে। সংসারটা আর যে আর ঠিক করে করা হয়ে উঠবে না।

সেই যে এক ভরা বর্ষায় বিয়ে হয়ে ছেনু মিত্তির লেনের স্যাঁতসেঁতে বাড়িটায় ঢুকলেন তারপর তো আর কোথাও যাওয়া হয়নি তাঁর। একটিবারের জন্যেও না। বাপের বাড়ি যাওয়া কঠিন ছিল। খরচ ছিল, ভিসার ব্যাপার ছিল। এক এক করে সব গয়না বিক্রি করে সংসার চালাতে গিয়ে নিজের দেহকে অলঙ্কারহীন করে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা। মায়ের সামনে দাঁড়ালে তক্ষুনি বুঝে যাবে যে। তাই বিয়ের পর একমাত্র গঙ্গাস্নান ছাড়া আর কোথাও যাননি ইন্দুবালা। সেই যে এসে মল্লিক বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন আজও আছেন। কিন্তু তার জন্য কোনো খেদ নেই তাঁর মনে। বিয়ের পরে নতুন বউকে স্বামীর বাড়িতে এসে প্রথম দিনই দেখতে হয় রান্নাঘর ভরা আছে তোলা তোলা খাবারে। ডেকচি ভরা ডাল। কড়া ভরা মাছ। হাঁড়ি ভরা ভাত। দই, মিষ্টি। পেতলের পাত্র থেকে উথলে ওঠা দুধ। চারিদিকে ভরা ভরা সব কিছু। ভরা দেখলে তবেই না গেরস্থের সংসার সব ভরে উঠবে। কোলে-কাঁখে মা ষষ্ঠী কৃপা করবেন বছরের পর বছর। “শ্বশুরবাড়িতে প্রথমে রান্নাঘরে গিয়েই যেন হ্যাংলার মতো চোখ বড় বড় করে সব কিছু দেখো না।” পাখি পড়ানোর মতো শিখিয়ে দিয়েছিলেন মা। “যা লোভী মেয়ে একটা। হয়তো দেখা গেল রান্নাঘরে ঢুকেই শুক্তোর পাত্র নিয়ে বসে গেল। পাঁচ ভাজা থেকে নারকেলগুলো তুলে তুলে খেতে শুরু করলো। আনারসের চাটনি আর কারোর জন্যে একটুও রইলো না। তখন কি বেইজ্জতিটাই না হতে হবে কুটুম বাড়িতে।” ছোটো ভাই পাশ থেকে বলে “আর রসগোল্লা মা? কলকাতার বড় বড় মিষ্টি। সেগুলো দিদিভাই খাবে না? কিরে খাবি না?” বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়েছিলেন ইন্দুবালা। বয়ে গেছে তাঁর একটা অপরিচিত বাড়িতে গিয়ে শুক্তোর হাঁড়ি নিয়ে বসতে। নারকেল ভাজা খেতে। কত যে আনারসের চাটনি করো? ওই তো গাছেই পচ্ছে ফলগুলো। বয়ে গেছে… বয়ে গেছে… বয়ে গেছে। খাবেন না ইন্দুবালা কিছু। সামনে এসে বাবা, বাছা করলেও নয়। তখন অবশ্য বুঝতে পারেননি এতসব কিছু ইন্দুবালার কপালে জুটবে না কোনোদিন। প্রথম বউ মারা যাবার এক বছরের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে বলে সব কিছু লুকিয়ে রেখেছিল শ্বশুরবাড়ি। এমনকি বিয়েটাও। হঠাৎ হয়ে গেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনটা। অথচ এইভাবে কলাপোতায় বিয়ে হয়নি ইন্দুবালার। রীতিমতো জাঁক করে তিন গ্রামের মানুষ খাইয়ে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন ব্রজমোহন। ঠাম্মা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। বরযাত্রী বলতে বরের সাথে মোটে চারটে মানুষ এসেছে? পুরোহিত, নাপিত আর বরের দুই বন্ধু? ব্যস? বাবা বলেছিল “বুঝতে পারছো না কেন মা পাসপোর্ট ভিসার খরচ নেই? ওদিকেও তো ওদের অনুষ্ঠান আছে নাকি?” কিন্তু এদিকে সত্যিই কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। কোনো লোকজন আসেনি। সানাই বাজেনি। একটা ন্যাড়া বাড়ি দেখে বাবার শুধু চোখ উজিয়ে জল এসেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে মেয়েকে বিদায় জানিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে তক্ষুনি ফিরে গিয়েছিলেন দেশে। মেয়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারেননি। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কী মারাত্মক ভুলটা সত্যি তিনি করে ফেলেছেন এই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। ইন্দুবালার ইচ্ছে করছিল ছুটে চলে যান বাবা-ভাইয়ের সাথে। যেতে পারেননি। তারও বেশ কিছুদিন পরে পোস্টকার্ডে পেয়েছিলেন বাবার মৃত্যু সংবাদ। তখন আর যেতে পারেননি। শাশুড়ি ছিলেন অসুস্থ। গয়না বিক্রি করে যাওয়ার মতো অবলম্বনটুকুও ছিল না। নদীর ধার থেকে বিদায় দিয়ে এসেছিলেন মা-ঠাম্মাকে। বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ির দরজায়। ভাই এসে দিদিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেও জানে কোথায় নিয়ে যাবে তার দিদিকে? আর কীভাবে? ততদিনে যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। একের পর এক গ্রাম জ্বলছে। ভাইকে সেবারে ঠিক মতো খাওয়াতেও পারেননি ইন্দুবালা। কবেকার সেই পুরোনো কথা এখনও এঁটুলির মতো আটকে থাকে ইন্দুবালার সাথে। সবাইকে হারিয়ে এখন তিনি একা। তার কলাপোতার ভিটেবাড়ির মতো। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের মতো। বাগানের পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার মতো একা।

এইসব কিছু ভাবলে এখনও চিকচিক করে ওঠে ইন্দুবালার চোখ। মাথা ঢিপ ঢিপ করে। শরীর করে আনচান। মনে হয় প্রেশারের ওষুধ খেতে বুঝি ভুলে গেছেন। বেতের ছোট্ট ঝাঁপি খোলেন। ওষুধ খান। ওপরের জানলা দিয়ে সকালের বাগানটাকে এই ছেনু মিত্তির লেনেও স্বপ্নের মতো মনে হয়। রান্নাঘর ভরা খাবার শাশুড়ি দেখাতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। বুড়ি হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন নতুন বউকে বাড়ির পেছনের বাগানটায়। বলেছিলেন, “চোখ ভরে দেখ বউ। কেমন উপোছাপা হয়ে আছে আমার সংসার। বেধবা মানুষ আমি। শুভকাজে ভাতের হাঁড়ি চাপানোর অধিকার নেই আমার। নিজের সংসারে অমঙ্গল করতেও চাইনে। বাগান থেকে নিজের ইচ্ছে মতো যেটা মনে হয় সেটা তুলে আন গে। নিজের বউভাতের রান্নাটা যে আজ তোকেই করতে হবে”। কেমন যেন চমকে ওঠেন ইন্দুবালা। এর আগে কলাপোতায় রান্না করেননি এমনটা নয়। জোর করে ঠাম্মা রান্না করাতো নিজের কাছে নিয়ে বসে। কখনও সখনও নিজেরও ইচ্ছে করতো। ভাইকে বলতেন “যা তো কলাপাতা কেটে নিয়ে আয়। আজ চড়ইভাতি হবে”। ভাই আরও কয়েকজনকে জুটিয়ে একগাদা শুকনো খেজুরের পাতা টানতে টানতে নিয়ে চলে আসতো। খেজুরের শুকনো পাতার আঁচে ইন্দুবালা খুদ জাল দিতেন। ছোটো ছোটো আলু কেটে, নতুন ওঠা পেঁয়াজ কুচো করে, লঙ্কা চিরে লাল করে ভাজতেন। সবাই মিলে উঠোনে বসে যেন অমৃত খাচ্ছেন বলে মনে হতো। কিন্তু তাই বলে শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই তাকে রান্না করতে হবে? এমনকি নিজের বউভাতের রান্নাটাও? এই যে বাবা বলেছিল ছেলে নাকি মাস্টার? শিক্ষাদীক্ষা আছে। দোতলা পাকা বাড়ি। জমিদারের বংশ। রাজ্যের চাকর-ঝি। “আমাদের ইন্দু খাটের ওপর পা তুলে বসে খাবে”। খুব একটা বেশি দিন লাগেনি নিজের শ্বশুরবাড়ির স্বরূপ চিনতে ইন্দুবালার। যে স্বামীকে ‘মাস্টার’ বলে পরিচয় করানো হয়েছিল মেয়ের বাড়িতে সম্বন্ধ পাতানোর সময়, তিনি মাস্টার ছিলেন বটে তবে তাস, পাশা, জুয়ার। চিৎপুর যাত্রা পাড়াতেও বেশ যাতায়াত ছিল তাঁর। রথের পরে পরেই আর ঘরে মন টিকতে চাইতো না। মুখে বলতেন পালাকার। কিন্তু আদপেই তার ধারে কাছে কোনো কলম কোনোদিন দেখেননি ইন্দুবালা। এমনকি এক ছত্র লিখতেও না। কাজেই স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক যাই বলতেন তাই যে ইন্দুবালা বিশ্বাস করে যেতেন তেমনটা নয়। কিছুটা বিদ্যে তাঁর পেটেও ছিল। শুধু প্রথম যেদিন তাঁর সামনে কাবুলিওয়ালা রতনলালকে পিটলো সেদিনই সব কিছু আরও পরিষ্কার হল। হেন নেশা ছিল না যা স্বামী করতেন না। এপাড়া বেপাড়ায় তাঁর ভালোবাসার মানুষের অভাব ছিল না। শুধু তারা ভালোবাসতো টাকার বিনিময়ে। আর টাকা যেত ইন্দুবালার গয়না বিক্রি করে। কাবলিওয়ালা যখন বাড়ির সামনে অমন বড় মানুষটাকে বেধড়ক জুতো খুলে মারছে কেউ এগিয়ে যায়নি। অন্য শরিকরা মুখ চাপা দিয়ে হাসাহাসি করছিল। শাশুড়ি গিয়েছিলেন গঙ্গা স্নানে। ইন্দুবালা কী করবেন বুঝতে না পেরে মাথায় ঘোমটা টেনে সটান রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কী মনে হয়েছিল কাবলিওয়ালাটার কে জানে। রতনলালকে ফেলে রেখে দু দিনের নোটিশ দিয়ে চলে গিয়েছিল সে। যাবার আগে বলে গিয়েছিল “এমন ছ্যাঁচড়া আদমির সাথে আছিস কী করে মা তুই?” সেদিনই মাস্টার রতনলাল মল্লিকের অন্য নামটাও জেনে যান ইন্দুবালা। সবাই তাকে অলক্ষ্যে ছ্যাঁচড়া বলে ডাকে। দৈব্যের কী পরিহাস বিয়ের পরে প্রথম দিন শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট বাগানে শাশুড়ি যখন ইন্দুবালাকে একা দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তখন ইন্দুবালা দেখেছিলেন মাচার ওপরে পুঁইশাকের নতুন পাতা ওঠা ডগা। মাথা উঁচু করে যেন আকাশ দেখতে চায় তারা। ঝুড়ি ভরে পুইশাঁক তুলে নিয়ে এসেছিলেন মনের আনন্দে। কারণ তিনি জানতেন বাবা মেয়েকে দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি, কাপড় আরও অনেক কিছুর সাথে দিয়ে গেছেন দুটো বড় ইলিশ। ইলিশের মাথা আর পুঁইশাক দিয়ে অসাধারণ ছ্যাঁচড়া রান্না করেছিলেন সেদিন ইন্দুবালা। অত বড় ডাকাত চেহারার স্বামী আধ কড়াই ছ্যাঁচড়া একা নিজেই সাবাড় করেছিলেন। প্রথম রাতে তাই সোহাগ উঠেছিল তার দিক থেকে মাত্রা ছাড়া। ইন্দুবালা এত সবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। যখন ঘাড়ের ওপর ওই দশাসই চেহারা চেপে বসে একটু একটু করে কৌমার্য শুষে নিচ্ছিল তাঁর, তখন একবারের জন্যেও মনিরুলকে মনে পড়েনি ইন্দুবালার। ব্যথায় চোখ বন্ধ করলে উঠোনের জোনাকি গুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন স্পষ্ট। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠের আম তার ডালপালা নেড়ে ফিসফিস করে বলেছিল “নিয়তি…ইন্দুবালা..নিয়তি…”।

সামনের ভটচাজ বাড়ি থেকে গিন্নি তাঁর নাতনি রাকাকে পাঠিয়েছে। সে নাকি এবার সায়েন্স না কীসব নিয়ে পড়ছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে। একটা সুন্দর দেখতে ট্যাব তার হাতে। ইন্দুবালা আঁচলে চশমা মোছেন। এগিয়ে আসেন রাকার দিকে। এক্কেবারে মায়ের মুখ বসানো। থুতনি ধরে চুমু খান। “ভালোই হয়েছে। ভাগ্যিস শান্টুর মতো হোসনি। যা দস্যু ছিল ছেলেটা। মেয়েরা মায়ের মুখ পেলে জীবনে শান্তি পায়। জানিস কি সেটা?” রাকা মাথা নাড়ে। এইসব কিছুই সে জানে না। জামশেদপুরে থাকতো। বাবা কলকাতার কলেজে ভর্তি করে দিয়ে বললো এখানেই পড়াশুনো করো। পড়াও হবে আর দাদু-ঠাম্মাকে দেখাও। হাসেন ইন্দুবালা। “তা ভালো। তারা ছাড়া আর ওদের কেই বা আছে বল? তা সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস। অতবড় কলেজ। আমি তোকে কী পড়াবো? ছেলেদেরই আমি পড়াতে পারিনি কোনদিন। সব লোক রাখতে হয়েছিল। ইতু তো দাদাদের কাছেই পড়েছে। আমি কী শেখাবো বলতো তোকে?” আমতা আমতা করে বলেন ইন্দুবালা। এমনিতেই গা টা ম্যাজম্যাজ করছিল বলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আচারের বয়ামগুলো জানলার রোদে রাখেন। মাথার ওপর কাপড়ের সাদা ঢাকনাগুলোকে পালটান। ধনঞ্জয়কে উনুন ধরাতে বলেন। রাকা পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। ভালো লাগে ইন্দুবালার। নিজের নাতি-নাতনিগুলোর থেকেও বয়সে কত ছোটো। বাড়িতে এমন একটা কেউ না থাকলে চলে? কেমন যেন ছেলেগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার কথাও। নাতি নাতনি-নাতবউ ভরা সংসার তাঁর। কী এমন ক্ষতি হতো এই বাড়িটায় সবাই মিলে একসাথে থাকলে? ঠিক আছে। না থেকেছে ভালো হয়েছে বাবা। তারপর সেই তো কাটাকাটি, লাঠালাঠি। কম ঝক্কি পোহাতে হয়েছে এক সময়ে এই বাড়ির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। ভাগ্যিস উনি বেঁচে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা সেরে গিয়েছিলেন না হলে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে গঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরতে হতো। ভালোবাসতেন কি বাবু মাস্টার রতনলাল ইন্দুবালাকে? জিজ্ঞেস করেননি কোনোদিন ইন্দুবালা। স্বামীর সাথে কথা হতো কতটুকু? শুধু শেষ কয়েকদিন বিছানার সাথে যখন মিশে গিয়েছিলেন নিজের মায়ের মতোই, পেটটা ফুলে উঠেছিল বেঢপ। ডাক্তার বলেছিল জল জমেছিল পেটে। অথচ মধ্যরাতে যখন গঙ্গার জল খেতে চেয়েছিলেন, ইন্দুবালা জল গড়িয়ে এনে দেখেছিলেন সব শেষ। বাচ্চাগুলোর তখনও বোঝার বয়েস হয়নি কী ক্ষতি হল তাদের জীবনে। নাকি এই নরক থেকে চিরকালের মুক্তিলাভ!

ইন্দুবালা রোয়াকে নেমে রান্নার বাসনগুলোকে ভালো করে জল ঝরাতে দেন। রাকা অবাক হয়ে জানতে চায় “এই এতকিছু ইউজ হয় তোমার হোটেলে দিদা?” ইন্দুবালা হাসেন। কী আর উত্তর দেবেন ওইটুকু মেয়েকে? দোতলার ঘরে বড় কাঠের সিন্দুকটা দেখালে তো অক্কা পাবে। সব নিজের টাকায় বানানো। হাজার লোককে এখনও এক বেলায় খাওয়াতে পারেন ইন্দুবালা। রান্না ঘরে ঢুকে উনুনের আঁচ দেখেন। রাকা যাই দেখছে তাতেই অবাক হয়ে যাচ্ছে “ওহ মাই গড। কয়লার উনুন? গ্যাস থাকতে এখনও তুমি এইভাবে রান্না করো দিদা? আমার কলেজে বললে সবাই এক্ষুনি ছুটে আসবে দেখতে। ইভ আমাদের ম্যামও।” ঘুরে তাকান ইন্দুবালা। “এই তো বললি কীসব সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস, তাতে উনুন দিয়ে কী হবে? আর তোর কলেজের লোকজনই বা দেখতে আসবে কেন?” রাকা হেসে ফেলে। “তুমিও দিদা। পড়ছি তো হোম সায়েন্স নিয়ে। কুকিং আমার স্পেশাল পেপার। এক্কেবারে হান্ড্রেড মার্শ। উইথ প্র্যাকটিকাল। তাই না তোমার কাছে এসেছি।” ইন্দুবালা এতক্ষণে যেন ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারেন। “রান্না নিয়ে পড়ছিস নাকি তুই? সেটা আগে বলবি তো মেয়ে। সায়েন্স টায়েন্স শুনে আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা”। ভটচাজ গিন্নি চালাক চতুর। ঠিক বুঝেই নাতনিকে পাঠিয়েছে ইন্দুবালার কাছে। “বই-পত্তর, আর তোদের ওই কম্পিউটারের থেকে বেশি জানে বুড়ি। শিখে নিতে পারলে আর তোকে ঠেকায় কে”। ততক্ষণে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের প্রথম আঁচ গনগনে হয়ে যায়। আগুনের পাশে পেতলের থালায় সিধে রাখা। আতপ চাল। একটা গোটা পান। কাঁঠালি কলা। একটা আস্ত সুপারি। কোনোদিন মিষ্টি জোটে তো ভালো। না হলে বাতাসা। এতে অগ্নিদেব খুশি হয়। গেরস্থ বাড়িতে অনুষ্ঠানে হাঁড়ি চাপানোর আগে রান্নার ঠাকুররা এইসব চেয়ে চিনতে নিত। এখনও হয়তো নেয়। কিন্তু ইন্দুবালা এই আচার মেনে চলেন প্রতিদিন। মানুষের মুখের অন্ন বিক্রি করেন। যা তা কথা নয়। সামর্থ্য যদি থাকতো সবাইকে বিনা পয়সায় খাওয়াতেন ইন্দুবালা। তেমন খদ্দের যে নেই তা নয়। সেই লিস্টের খাতা না হয় অন্য কোনোদিন খোলা যাবে। ইন্দুবালার ঠাম্মা উনুনের প্রথম আঁচে কয়লার ওপর ছড়িয়ে দিতেন অল্প করে চিনি। এতে আঁচটাও ভালো হয় আর অগ্নিদেবকে তুষ্টও করা হয়। ইন্দুবালা উনুনের পাশে ধূপ জ্বেলে দেন। উনুনের ওপর মুঠো করে ছড়িয়ে দেন চিনি। আঁচের ওপর ধক করে জ্বলে ওঠে আগুন। হাতজোড় করে প্রণাম করেন। “সবার পাতে অন্ন জুগিও ঠাকুর”। রাকা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখে। এইসব তাদের কলেজে শেখায়নি কোনদিন। তাদের তো সব মডিউলার কিচেন। মর্ডান ইকুইপমেন্ট। জল গরম করতে হলে জাস্ট টাইমার দিয়ে দাও। ইন্দুবালা বড় হাঁড়িতে জল বসান। দুমুখো উনুনে আর একটাতে বসান বড় লোহার কড়াই। গরম হয়ে গেলে মুগের ডাল ভাজতে থাকেন। কেমন করে ডাল আন্দাজ করতে হয়। কেমন করে জল। মাথা গুনে ভাতে চালের পরিমাপ ইন্দুবালা শেখান রাকাকে। মনে মনে ভাবেন এইভাবে একদিন তাঁর ঠাম্মা তো তাঁকে রান্না শেখাতো। শুধু কত রকমের ফোড়ন হতো সেগুলো সব মনে রেখে দিতেন। এখনকার রাকা সেগুলো তার ট্যাবে লিখে রাখে চটপট। ছবি তোলে। ভিডিও করে। বাড়ির বাইরে গাড়ি এসে থামে। কেউ মা বলে ডাকে। ইন্দুবালা ঘুরে তাকান। বড় ছেলে, মেজো ছেলে তাদের বউদের নিয়ে এসেছে। যাক বাবার মারা যাবার দিনটা তাদের তাহলে মনে আছে। যদিও মনে থাকার কথা নয়। ইন্দুবালা মনে করিয়ে রাখতেন সেই ছোট্ট বেলা থেকে। রক্তকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা। ছেলেরা এসেছে অবশ্য তারিখটাকে লক্ষ্য করেই। বাবাকে তো তাদের মনে নেই। কিন্তু বিশেষ দিনটা মনে আছে। এই দিনে মা যে ছ্যাঁচড়াটা রান্না করে তা সারা বছর যেন মুখে লেগে থাকে।

আম তেল

বিয়ের পর সবুজ রঙের একটা ট্রেনে করে ইন্দুবালা যখন শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেছিলেন তখন তাঁর কাছে ইণ্ডিয়া দেশটা নতুন। খুলনার কলাপোতা গ্রামের বাড়ির উঠোনে নিভু নিভু আঁচের সামনে ঠাম্মা, বাবার কাছে শোনা গল্পের সাথে তার ঢের অমিল। এত বড় স্টেশন আগে কোনোদিন দেখেননি ইন্দুবালা। দেখবেনটাই বা কী করে? এই যে প্রথম ট্রেনে উঠলেন তিনি। নামলেনও। মাথার ওপর রাজপ্রাসাদের মতো ছাদ দেখলেন। এতবড় বাড়ি দেখলেন। এত লোক! সবাই যেন মাথা নীচু করে সামনের দিকে ছুটছে। কেউ কারো সাথে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে একটুও কথা বলছে না। কুশল বিনিময় করছে না। যে যার খেয়ালে আছে। সামান্য অসতর্ক হলে, চলাফেরার একটু এদিক ওদিক হলে সবাই বুঝি সবার গায়ে হুড়মুড়িয়ে পড়বে। তখন ইন্দুবালার জিনিসপত্রের কী হবে? নেই নেই করেও তো সঙ্গের জিনিস কম নয়। মা বারবার বলে দিয়েছিল “চোখ ছাড়া করবি না ইন্দু”..। ঠাম্মা বলে দিয়েছিল “আগলে রাখবি সব কিছু”..। যদিও অদৃষ্ট বড় নির্মম খেলা খেলেছিল ইন্দুবালার জীবন নিয়ে। কোনো কিছুই তিনি আগলে রাখতে পারেননি, একমাত্র এই ভাতের হোটেলটা ছাড়া। তবুও সব কিছুর ওপর বড় মায়া তাঁর। ঘরের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা ক্ষয়ে যাওয়া নারকেলের ঝাঁটা থেকে পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি। কিছুতেই মন চায় না কোনো কিছু ফেলতে। সব কিছু বুড়ি জমিয়ে রাখেন নিজের করে। তাঁর উপচে পড়া স্মৃতির মতোই।

মাঝে মাঝে এইসব জিনিসপত্র নিয়ে যে গোল বাধে না তেমনটা নয়। বেশ ভালোই চিৎকার চেঁচামেচি হয়। ধনঞ্জয় তখন তোক ডেকে নিয়ে এসে রেগেমেগে কিলো হিসেবে বিক্রি করে সব কিছু। বুড়ি ঘুরঘুর করে চারপাশ। “ওরে মূর্খ তুই কী করে জানবি .. ঠাম্মা বলতো বাড়ির আগাছাটাও তো দরকারি। নাহলে হরিমতি খাবে কী? আর দুধ দেবেই বা কী করে?” ধনঞ্জয় কাঁই মাই করে ওঠে। “বারবার তোমার খুলনার কলাপোতার গল্প শুনিও না তো মা। এখানে তোমার কোথায় হরিমতি? পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি তোমার কাছে আগাছা? এই এত এত ঘিয়ের খালি শিশি? রঙ চটে যাওয়া টিনের বাক্স?” টান মেরে উঠোনে ফেলেছিল ধনঞ্জয়। কেমন যেন আর্তনাদ করে উঠেছিল সেই কতদিন আগের ফুলছাপ তোরঙ্গটা। ডালাটা হাঁ করে খুলে পড়েছিল উঠোনে। ঠিক মরে যাওয়া মানুষের মতো। তার মুখ দিয়ে কিলবিল করে বেরোচ্ছিল আরশোলা। তারাও যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম খুলনার কলাপোতার স্বপ্ন নিয়ে বংশ বিস্তার করে চলেছে। “এটা তুই কী করলি ধনঞ্জয়? আমার এত দিনের জিনিসটা তোর কাছে পুরোনো মনে হলো?” ইন্দুবালা এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটু একটু করে তোরঙ্গটার দিকে। ধূসর হয়ে যাওয়া সবুজ রঙের ওপর লাল লাল ফুল। সেগুলোও কেমন যেন ঝরে পড়ার আগে তাকিয়ে আছে ইন্দুবালার দিকে। “আমার বিয়ের সময় বাবা কিনেছিলেন ঢাকা থেকে। তারপর তিনটে নদী পার করে নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনা। সেখান থেকে এই কলকাতা।” ধনঞ্জয় ক্ষয়ে যাওয়া নারকেল ঝাঁটায় আরশোলা মারতে মারতে বলে “তাহলেই বুঝে দেখো আর ওর জেবন প্ৰেদীপ থাকতে পারে? নিবে গেছে গিয়ে কবে।” ছ্যাঁৎ করে বুকে বাজে যেন ধনঞ্জয়ের কথা। তোরঙ্গের জীবন প্রদীপ নিভতে পারে তাহলে ইন্দুবালার নয় কেন? তাঁরও তো কম পথ অতিক্রম করা হলো না। এখনও কোন মায়ায় আটকে আছেন তিনি? কেনই। বা আছেন? কেমন যেন দম বন্ধ লাগে তাঁর। ঘাড় তুলে তাকান ইন্দুবালা এক টুকরো আকাশ দেখার জন্য। কিন্তু এখানে আকাশ কোথায়? ওই তো চার কোণের চৌখুপ্পি। তার ওপরে বাড়ির পেছনের আম গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে এসে পড়েছে খানিকটা ভেতরে। কাঁচা আম গুলো পুরুষ্টু হয়েছে গ্রীষ্মের রোদের খর তাপে। মন খারাপটা যেন কোথাও ঝুপ করে গায়েব হয়ে যায় ইন্দুবালার। আম দেখার আনন্দে এগিয়ে যেতে গিয়ে পায়ে কিছু একটা ঠেকে। নীচু হয়ে কুড়িয়ে নেন। সেই কবেকার প্রথম ট্রেনে চড়ার টিকিট!

“বিলাতি আমড়া খাবে গো নতুন বউ? বিলাতি আমড়া?” ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যায় ট্রেনের কামরায়। মুখের সামনে এনে দেখায় আমড়াগুলো। ততক্ষণে ইন্দুবালার কপালের চন্দন ফিকে হয়ে গেছে। গলায় রজনীগন্ধার মালা বাসি। চোখের কাজল কিছুটা ধেবড়ে গেছে। বাকিটা রাখা আছে বিস্ময়ে মাখামাখি হয়ে। মাথা নাড়েন ইন্দুবালা। না, তিনি খাবেন না। জানলার দিকে তাকিয়ে ভাবেন এই ফল আবার কিনে খেতে হয় নাকি? তাঁদের গ্রামে ফেলা-ছড়া যেত। কাঁচা কাঁচা পেঁসো আমড়া পেড়ে আনতো ভাই। মা চাটনি করতো। নুন দিয়ে কুটি কুটি করে কেটে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দিদি ভাইতে খেতো বোসদের পুকুর পাড়ে বসে। বৃষ্টির জল মেখে আমড়া পাকতো অম্বুবাচি পার করে। সেই সময় ঠাম্মার প্রায় সারাদিন উপোস। এক বেলা ফলাহার। কখনও ছাতু ভিজে। কিংবা সারাদিন মিছরির জল। বাবা এনে দিতেন সন্দেশ, কলা। সেইসব মুখে তুলতেন না তিনি বড় একটা। সব যেত নাতি নাতনির পেটে। অত বার চা খাওয়া যার অভ্যেস ছিল, সেও ওই কটা দিন চা না খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিত। ইন্দুবালা বিধবা হবার পর এতসব কিছু মানেননি। তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিল না। আর লছমী থাকতে তা করতেও দিত না। মাস্টার রতনলাল মল্লিক তাঁকে অনেক ছোটো বয়সে বিধবা করে কেটে পড়েছিলেন পরপারে। দায় ফুরিয়েছিল তাঁর। বড় ছেলেটাও এত ছোট তখন যে মালসায় ফুটিয়ে হবিষ্যির ভাত খাবে কী করে! মাঝরাতে মরেছিলেন মাস্টার রতনলাল মল্লিক। সকাল গড়িয়ে গেলেও কোনো আত্মীয় কুটুম কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। এমনকি যাদের সাথে নেশা করে ভাসিয়ে দিতেন সেই ইয়ারদোস্তরাও না। মাছ বিক্রি করতে এসে দরজা ধাক্কিয়ে ছিল লছমী। নীচে সাড়া শব্দ না পেয়ে সটান ওপরে উঠে এসেছিল সে। দেখেছিল মরা আগলে বসে আছে মল্লিক বাড়ির বাঙাল বউ ইন্দুবালা। দৃষ্টি স্থির। চুল এলোমেলো। চোখে জলের আভাসটুকু পর্যন্ত নেই। পাথরের মতো বসে আছে একটা মানুষ। মড়ার পাশেই ঘুমোচ্ছে তিন-তিনটে বাচ্চা। লছমী ডেকেছিল “মা..”। ইন্দুবালা ফিরে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। সেই চাহনি দেখে লছমী কী বুঝেছিল কে জানে? বাজার থেকে জড়ো করে নিয়ে এসেছিল লোক। তারাই খাট, ফুল, খই জোগাড় করেছিল। শ্মশানে গিয়েছিলেন ইন্দুবালা তিন ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। নিজে হাতে স্বামীর মুখাগ্নি করেছিলেন। শ্রাদ্ধও।

নিয়মভঙ্গের দিন লছমীর এনে দেওয়া ট্যাঙরা মাছ আর বাড়িতে দেওয়া বড়ি দিয়ে একটা তরিজুতের ঝোল বেঁধেছিলেন। অনেক দিন পর ছোটো ছোটো ট্যাঙরার মাথাগুলো চুষে চিবিয়ে খাওয়ার সময় মনে পড়েছিল ঠাম্মার কথা। অম্বুবাচিতে সারাদিন উপোস করে থাকার পর ছাতু খেতে খেতে তাঁর যখন আর কিছু মুখে রুচতো না তখন খোসা ছাড়িয়ে পাকা আমড়া মুখের কাছে ধরতেন ইন্দুবালা। ঠাম্মা চুষে চুষে সেই বুনো ফলের সব রসটুকু খেয়ে নিতো। সারা ঘর ম ম করতো পাকা আমড়ার গন্ধে। এসব কথা কোনোদিন ইন্দুবালা কাউকে বলতে পারেননি। এমনকি ছেলে-মেয়েদেরকেও না। নাতি নাতনি তো অনেক দূরের কথা। কিছু কিছু জানতো মাছওয়ালী লছমী, কিন্তু সে তো আজ কোন সুদূরের অতিথি।

সেদিনের সেই ট্রেনের কামড়ায় বিলাতি আমড়াই শুধু উঠেছিল তাই নয়। তার সাথে ছিল চিরুনি, পাতাবাহারে ফুল গাছ, সূঁচ, বশীকরণের ওষুধ, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, বসিরহাটের কাঁচাগোল্লা আরও কত কিছু। ভাই মাঝে মাঝে বাবার কাছে বায়না করে খাচ্ছিল। কিন্তু ইন্দুবালার নিজের খেতে ইচ্ছে করেনি কিছু। এমনকি নতুন জরির চুল বাঁধার ফিতে দেখেও কিনতে ইচ্ছে হয়নি। জানলার পাশ দিয়ে তখন বেরিয়ে যাচ্ছিল মাঠ-ঘাট, নদী, নৌকা, গ্রাম। ইঞ্জিনের কয়লার কালো ধোঁয়া। চোখ বড় বড় করে দেখছিলেন তাঁর বয়সী মেয়েরা কাজে যাচ্ছে। কলেজে যাচ্ছে। ইন্দুবালা কলেজ যেতে চেয়েছিলেন। পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হলো! মনিরুলের সজল কালো চোখ দুটো বাঁধা থাকলো তাঁর অন্তরে। নক্সী কাঁথার মাঠের সাজুর মতো তাকে সব স্মৃতি উপড়ে নিয়ে চলে আসতে হলো এপারে। রূপাই থেকে গেল অনেক দিনের পুরোনো অতীত হয়ে।

ট্রেনটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো কোন একটা স্টেশনে। কান ফাটানো আওয়াজ শোনা গেল বোমার। পুলিশের বন্দুকের। ঝুপ ঝুপ করে ট্রেনের জানলাগুলো পড়তে শুরু করলো। ইন্দুবালা তারই মধ্যে দেখলেন একদল ছেলে-মেয়েকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠি চালালো। কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লো। এইসব চেঁচামেচিতে পাশে বসে ঝিমোতে থাকা মাস্টার রতলনাল মল্লিকের ঘুম গেল ভেঙে। তিনিও বিরক্ত হয়ে ইন্দুবালার সামনের জানলা ফেলে দিলেন। গোটা কামরায় অসহ্য গুমোট গরম। বাইরে চোখ জ্বালা করা ধোঁয়া। কানে এলো গর্জনের মতো স্লোগান “পুলিশ তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশো বারো।” আবার একটা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটলো। কামরার ভেতরের লোকগুলো কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। তারই মধ্যে কয়েকটা ছেলে মেয়েকে হুড়মুড়িয়ে ট্রেনের কামরায় উঠতে দেখলেন ইন্দুবালা। ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো। এক নতুন দেশে বউ হয়ে আসার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বেশ মনে রাখার মতো হলো তাঁর। যে ছেলে-মেয়েগুলো হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠেছিল তাদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটেছে। কোনো রকমে সে হাত দিয়ে চেপে আছে ক্ষত জায়গাটা। রক্তে ভাসছে জামা কাপড়। তারই পাশ থেকে একটা ছেলে চিৎকার করে বললো, “ভয় পাবেন না বন্ধুরা..যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিনে একবেলা করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিজের ক্যাবিনেটের মন্ত্রীদের পেট ভরাচ্ছেন সেই শাসনের অবসান চাই আমরা। যে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে সেটা আর যাই হোক এই সরকার সামলাতে অপারগ…তাও আমরা যারা দুবেলা দুমুঠো এখনও খেতে পাচ্ছি.. রেশনে গিয়ে পচা চাল আর গম কিনতে পারছি; তাঁরা যদি এগুলো যারা একদম পারছেন না তাদের সাহায্যে কিছু দান করেন তাহলে লোকগুলো না খেয়ে অন্তত মরবে না। দয়া করে ভুলে যাবেন না এখনও এই দেশে একবেলাও খাবার না-জোটা লোকের সংখ্যাটা অনেক।” একটা ছিপছিপে ছেলে এতক্ষণ পুলিশের সাথে লড়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বলে চলেছিল কথাগুলো। আর তারই বন্ধুরা ট্রেনের যাত্রীদের সামনে গিয়ে হাতে একটা টিনের কৌটো নাড়িয়ে অনুদান চাইছিলো। সবটাই ইন্দুবালার কাছে নতুন। ধনধান্য পুষ্প ভরা গ্রাম থেকে এ কোন দেশে এলেন তিনি, যেখানে সরকার বলছে একবেলা খাও! পাশ থেকে খবর কাগজ পড়া মধ্যবয়স্ক লোকটা মাস্টার রতনলাল মল্লিককে বললেন, “খাদ্য আন্দোলন চলছে বুঝলেন কিনা। আইন হবে নাকি একবেলা ভাত আর এক বেলা রুটি খাবার। সরকার চাকরিও দিতে পারছে না। খেতেও দিতে পারছে না। দেশটার কী অবস্থা হয়েছে বুঝুন তাহলে…।” মাস্টার রতলনাল মল্লিক লোকটাকে পাত্তা দিলেন না। দ্বিতীয় বিয়ের ধাক্কা সামলাতে তিনি বেশ ক্লান্ত। ট্রেনের দুলুনির সাথে আবার ঝিমোতে শুরু করলেন। একজন তারই বয়সী মেয়ে ইন্দুবালার সামনে এসে যখন অনুদানের কৌটো ধরলো তখন খুব ইচ্ছে করলো মেয়েটির সেই কৌটোতে দু আনা হলেও দিতে। কিন্তু সেই মুহূর্তে ইন্দুবালার কাছে কোনো নয়া পয়সাও ছিল না। অথচ গা ভর্তি ছিল সোনার গয়নায়। হকৌটো ধরা মেয়েটা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ইন্দুবালার দিকে। একটা বালা কিংবা হার খুলে যদি দিতে পারতেন তিনি। মানুষগুলো না খেয়ে আছে যে।

তাঁর গ্রামে কপোতাক্ষের জল ঢুকে পড়লে বন্যা হতো। স্কুল বাড়ির পাকা দাওয়ায় গিয়ে উঠতো লোকজন। ঠাম্মা বাবাকে দিয়ে তার অনেক আগে থেকে চাল, ডাল পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে যা থাকতো। গ্রামের লোকেরাও মজুত করতো। সবাই এক সাথে রান্না খাওয়া হতো তখন। কত দূর দূর থেকে বুক পর্যন্ত জল ঠেলে মানুষগুলো খিচুড়ি নিতে আসতো। বড় যত্ন করে রাঁধতেন ইন্দুবালার ঠাকুমা। “অন্ন হচ্ছে লক্ষ্মী। মানুষের পাতে তুলে দিলে পুণ্যি হয়। যে দেশের সব মানুষ দুবেলা দুটো অন্ন পায় সে দেশের ভাণ্ডার ধন ধান্যে পূর্ণ হয়” বলেছিলেন ঠাকুমা। ইন্দুবালা সবেমাত্র তাঁর হাতের বালাটা খুলতে যাবেন বলে মনস্থির করছিলেন আর ঠিক সেই সময়ে তাঁর স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক খিঁচিয়ে উঠলে সরে গিয়েছিল অনুদান চাইতে আসা মেয়েটা। খারাপ লেগেছিল ইন্দুবালার। মানুষগুলোর পেটের ভাতের জন্য ওরা রাস্তায় নেমেছে। ভিক্ষে করছে। তারা যদি দুবেলা ভরপেট খেতে পারে তাহলে যে দোরগোড়ায় এসে অভুক্ত দাঁড়াচ্ছে, সে পাবে না কেন? সেই ইন্দুবালা তখনও জানতেন না তিনি একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিক হবেন। দুবেলায় তাঁর হোটেলে পাত পড়বে অসংখ্য মানুষের। সেই হোটেল থেকে বিনা পয়সাতেও খাবার বিলির বন্দোবস্ত থাকবে। সেটা সত্তরের জ্বালাময়ী দিনগুলোতেই হোক কিংবা তারও অনেক পরে মানুষগুলোর কাজ হারানোর সময়, সবাই জেনে গিয়েছিল এই একটা জায়গায় এমন এক অন্নপূর্ণা আছেন যাঁর ভাতের হাঁড়ি কারও জন্যে কোনোদিন খালি হয় না।

নতুন কনে ইন্দুবালার সঙ্গে মালপত্র হিসেবে এসেছিল বড় নক্সা করা একটি তোরঙ্গ। দানের বাসনের বড় ঘড়াটা। বাবার হাতে ছিল ওপারের বাজারের জোড়া ইলিশ। ভাইরের হাতে দইয়ের বড় হাঁড়ি। বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিকের হাতে ছিল বিয়ের ছাতা নিপাট ভাঁজ করা। কাঁধে ফেলা ছিল দানের শাল। হাতে চকচক করছিল আশীর্বাদের দু ভরি সোনার আংটিটা। স্টেশনে ট্রেন থামলে বরের বাড়ি থেকে লোক আসা দস্তুর ছিল। নতুন কনেকে যেভাবে গল্প শুনিয়েছিল তার বাড়ির লোকেরা, সে আরও অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। ব্যাণ্ড পার্টি। রঙ মশাল। ফানুস। কলকাতার রাজপথে শোভাযাত্রার মতো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। “তুই শুনলাম বনেদি বাড়ির বউ হলি ইন্দু। পা পড়বে তো মাটিতে”। ফুট কেটেছিল গাঁয়ের হিন্দু বাড়ির মেয়েরা। বন্ধুরা কেউ কেউ বলেছিল “আতসবাজি ফাটাবে নিশ্চয়। ঘোড়ার গাড়ি আসবে। ফুল ছড়াবে। আতরদানি থেকে আতর।” কিন্তু এইসবের ছিটেফোঁটাও ইন্দুবালার আশেপাশে ছিল না। নতুন বউকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কাউকে আসতে দেখেননি তিনি। বাবা একটু কুণ্ঠা নিয়েই জানতে চেয়েছিলেন “বাবা রতন… তোমার বাড়ির থেকে…?” কথা শেষ করতে দেয়নি মাস্টার রতনলাল মল্লিক। তাঁর সযত্নে লালিত বাবরি চুলের গোছা নেড়ে বলেছিলেন “তাই তো…তাই তো…এখন যে কী করি? বউভাতের যোগাড় যত্নে লেগে গেল কিনা লোকজন…। পুরুষ বলতে বাড়িতে আমি তো একাই…।” বাবা বিচলিত হতে বারণ করেছিলেন জামাইকে। তিনি থাকতে চিন্তার তো কিছু নেই। “শুধু এত জিনিস বলে লোকজনের খোঁজ করা। তা একটা কুলি নিলেই হয়ে যায় আর কি।” বাবা কুলি ডেকে তার মাথায় তুলে দিয়েছিলেন প্রায় সবকিছু। আর যেটুকু ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে সবার হাতে হাতে ধরে গেল। কপোতাক্ষর গাঁয়ের মেয়ে যখন ভাগীরথীর পাড়ে এসে প্রথম পা দিলো তখন কেউ শাঁখ বাজালোনা। কালো পাথরের থালায় দুধে আলতা মিশিয়ে কেউ পা ছোঁয়াতে বললো না। ঈশ্বরী পাটনীর মতো কেউ আদর করে পার করে দিল না শ্বশুরবাড়ির দোরটা। কিন্তু সে গল্প আমাদের জানা। যতই মাস্টার রতনলাল মল্লিক বলুন না কেন বউভাতের আয়োজনে বাড়ির সবাই ব্যস্ত আছে। আমরা তো জানি ইন্দুবালার বউভাতই হয়নি। কাকপক্ষীটিও টের পায়নি ইন্দুবালার শাশুড়ি এক বংশ ঘটির মাঝে একটা বাঙালি মেয়ে বউ করে নিয়ে আসছেন। জানাজানি হলে মুশকিল হতো। আগের বউটা বাচ্চা হতে গিয়ে মরেছিল নাকি মাস্টার রতলনাল মল্লিক গলা টিপে খুন করেছিলেন সে নিয়ে বিস্তর কানাঘুষো আছে। তাই বাড়তি কোনো আয়োজনের দিকে যাননি শাশুড়ি। নতুন বউয়ের সাথে তার বাবা আর ভাইকে দেখে মেজাজ তিরিক্ষে হয়েছিল তাঁর। আপদগুলোর আবার আসার দরকার কী ছিল! মেয়েটাকেই চেয়েছিলেন তিনি। পরিবারকে নয়। আর ইন্দুবালা দেখেছিলেন বাড়ির সামনে থেকে বাবা ছোট্ট ভাইয়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছেন অপমানিত হয়ে। তাদের কেউ একটু জল-মিষ্টি খাওয়ার কথা দূরে থাক বসার জন্য পর্যন্ত বলছে না। ছেনু মিত্তির লেনের গলিটা দিয়ে যেতে যেতে ভাইটা কাঁদছে। বাবা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনও জানেন না ইন্দুবালা এই তাঁর শেষ দেখা বাবার সাথে। এরপর আর কোনোদিন দেখতে পাবেন না বাবাকে। ইন্দুবালার বাড়ি ছেড়ে আসার বছর কয়েকের মধ্যেই মারা যাবেন বাবা। ঠাম্মা নাতনির মুখটা দেখতে চেয়েও পাবেন না। শেষ কদিন ইন্দু ইন্দু করে ঢলে পড়বেন চিরঘুমে। আর মায়ের কথা? সেগুলো যত্ন করে ইন্দুবালা শাড়ির ভাঁজে, আঁচলের ছোঁওয়ায় তুলে রেখেছেন। যেমন পঞ্চ প্রদীপের তাপ আঁচলে পুইয়ে গিঁট বেঁধে রাখতেন মা ঠিক তেমন করেই। ভাইটা তারও অনেক পরে যোগ দিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। চিঠি পত্রের আদান প্রদান অল্প বিস্তর যা ছিল যুদ্ধ শুরু হলে সেসবের পাটও চুকলো। জন্মভূমির সাথে যোগাযোগ একেবারে ছিন্ন হলো ইন্দুবালার।

কলকাতা শহর তখন বেশ সরগরম। মিছিলের পর মিছিল চলেছে রাস্তা জুড়ে। মানুষের পাতে ভাত নেই। মনে সুখ নেই। খাবার নিয়ে যে আন্দোলন হতে পারে ইন্দুবালা জানতেন না এই শহরে না এলে। স্টেশনের বাইরে থেকে অনেক দরদাম করে বাবা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলেন। সেই ট্যাক্সির মধ্যে ইন্দুবালা, ভাই, বাবা আর মাস্টার রতলনাল মল্লিক ঠিক এঁটে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল সেইসব জিনিসগুলো যা আজ ধনঞ্জয় কুড়িয়ে বাড়িয়ে ফেলে দিতে চাইছে। ও কতটুকু জানে এইগুলোর মাহাত্ম? গজগজ করতে করতে বুড়ি ভাঙা তোরঙ্গটার সামনে বসেন। ততক্ষণে ডালে ফোড়ন পড়েছে। নটা বাজতে চললো। কলেজের ছেলেগুলো খেতে এলো বলে। ইন্দুবালার কাজের তাড়া পড়ে যায়।

ট্যাক্সির জানলার পাশ আর ট্রেনের জানলার ধার ঠিক এক জিনিস নয়। ট্রেনের জানলার ধারে কত গ্রাম, নদী, জলা, জঙ্গল আর ট্যাক্সির পাশে শুধুই শহর। খেতে না পাওয়া মানুষের মিছিল। তখনও প্রথম ট্রেনে ওঠার ঘোরটা যেন কাটেনি ইন্দুবালার। অল্প অল্প মাথাটাও কি টলছিল ট্রেনের দুলুনির সাথে? তার রেশ রয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। কলকাতায় এসেই লুকিয়ে মনিরুলকে একটা না পাঠানো চিঠি লিখেছিলেন ইন্দুবালা। “জানিস মনিরুল ট্রেন যে কী ভীষণ বস্তু তোকে না বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের সেই বাঁশ গাছে দোল খাওয়ার মতো। তুই নিশ্চয়ই এতদিনে ঢাকায় পড়তে চলে গিয়েছিস। অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে তোর। অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। আমার কথা মনে পড়ে আর? বোসদের পুকুর? খানার ধারের ল্যাঙড়া..? গাজনের মাঠ..? কপোতাক্ষের ঘাট? আমি কিছু ভুলিনি মনিরুল। এখনও কি নানি সন্ধ্যে হলে বিষাদসিন্ধু পড়েন? তুই কি এখনও রাতের আঁধারে বাঁশি বাজাস? লণ্ঠনের আলোয় পড়িস নক্সীকাঁথার মাঠ? ঢাকাতে কি তোর দেখা হলো আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের? আমার যে সব কথা…সব কিছু বড় জানতে ইচ্ছে করছে মনিরুল…। আমি যে তোকে…।” এরপর আর লেখা এগোতে পারেননি ইন্দুবালা। তিনি মনিরুলকে কী? ভালোবাসেন? পছন্দ করেন? একসাথে থাকতে চেয়েছিলেন? নিজের কাছে উত্তরগুলো স্পষ্ট নয়। যেমন ঠিক স্পষ্ট নয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা আদৌও হয় কিনা। কিংবা ভালোবাসার অপর নাম শুধু শরীর কিনা। যে শরীরটাকে মাস্টার রতনলাল মল্লিক তার কয়েক বছরের বিবাহিত জীবনে তিন তিনটে বাচ্চার মা বানানোর ফ্যাক্টরি করে দিয়ে হঠাৎ উবে যাবেন কর্পূরের মতো হাওয়ায়। শরীরের সেই না পাওয়া কিংবা প্রচণ্ড পাওয়া কষ্টগুলো নিয়ে ইন্দুবালাকে বেঁচে থাকতে হবে দিনের পর দিন। তাও মলিন হবে না স্মৃতিগুলো। মানুষগুলো।

টগবগ করে ভাত ফোটে। ডাল ফোটে। মাছের ঝোলে মাছগুলো যেন ফুটতে ফুটতে ফড়ফড় করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তিন তিনটে উনুন জ্বেলে সেই স্মৃতি সম্ভাষণের আসন সাজান ইন্দুবালা।

নতুন যে দেশটায়, শহরটায় তিনি এসে পড়লেন, এই দেশ নিয়ে, শহর নিয়ে এর আগে তিনি কম গল্প শোনেননি। বাবার বাবা মানে ইন্দুবালার দাদু এক সময়ে নাকি কাজ করতেন কলকাতার বন্দরে। সেখানে সাহেব সুবোর খাতা লিখে তাঁর দিন গুজরান হতো। বড় বড় জাহাজে করে কত শত যে জিনিস আসতো তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। মেমসাহেবের ছোট্ট চিরুনি থেকে বেলজিয়াম কাঁচের আয়না। ইন্দুবালার গ্রামের বাড়িতে ঠাকুর দেবতার যা মূর্তি ছিল লক্ষ্মী থেকে শুরু করে শিব সব কিছু তার দাদুর আনা। চিনেমাটিতে বানানো সব হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। কলকাতার বড়লোক বাড়িতে ছেলে মেয়েদের খেলার জন্য বিদেশ থেকে আনা হতো। অনেক সময় বিয়ের তত্ত্ব যেত এইসব পুতুল সাজিয়ে। প্রত্যেকটা পুতুলের গায়ে লেখা থাকতো মেড ইন জার্মানি। বেশ নামডাক ছিল এই শিল্পের। এগুলো বাড়িতে রাখাও সম্মানের ব্যাপার ছিল তখন। ঠাম্মার খেলার জন্য দাদু এইসব পুতুল মাঝে মাঝে নিয়ে গেলেও ঠাম্মা সব কিছু সাজিয়ে রাখতেন পুজোর ঘরে। লক্ষ্মী, শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নিয়ে কেউ খেলে নাকি? শুক্রবার হলেই দাদু বাড়ি ফিরতেন শিয়ালদহ স্টেশন হয়ে খুলনায়। একটা সবজেটে ট্রেন দাদুকে নামিয়ে দিত কপোতাক্ষের ওপারে। শনি রবি বাড়ি থেকে আবার সকালের ট্রেন ধরে কলকাতায়। বাবাও দাদুকে অনুসরণ করেছিলেন। দাদুর কাছে কাজ শিখতে শিখতে কলকাতায় পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাঝখান থেকে দেশটা স্বাধীন হলো। শুধু স্বাধীন হলো তাই না দেশটা দু-টুকরো করে ভাগ করা হলো। দেশের নেতারা সেই দেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষদের কাছে অনুমতি নিল না, জানতে চাইলো না। এক মুহূর্তে ভিটে মাটি সব কিছু হয়ে গেল বিদেশ। রাতের আঁধারে, দিনের আলোয় মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। কে কোন অংশে যেতে পারবে তার যেন মারাত্মক মরিয়া প্রতিযোগিতা। তার সাথে বাধলো দাঙ্গা। রক্তক্ষয়ী। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি মারলো। মেয়ে লাঞ্ছিত হলো পড়শির কাছে। গোটা ভূখণ্ড জুড়ে চললো নরহত্যা। তিনশো বছরের ইংরেজ রাজত্বের পর স্বাধীনতা উদযাপনের সে কী ভয়ঙ্কর উৎসব।

নীল আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে দাদু প্রশ্ন করেছিলেন “এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম আমরা? এই স্বাধীনতার স্বপ্নই কি দেখেছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভ্যুত্থানের বীর শহীদ মাস্টারদা সূর্য সেন?” ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে যাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল? তারপর দড়িতে ঝুলিয়ে দেহটাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বুড়িগঙ্গার গভীর জলে? অত ছোট্ট মেয়ে প্রীতিলতাকেই বা মরতে হলো কেন? এত এত শহীদ কেন দ্বীপান্তরে গেলেন? জাতীয় পতাকা যদি সেই উড়লো দেশের স্বাধীন ভূমিতে তাহলে তখন দেশ বলে গড় করতে পারলাম না কেন? মনে অনেক প্রশ্ন, কষ্ট আর হতাশা নিয়ে দাদু ফিরে এলেন খুলনার কলাপোতায়। স্টেশনে আসার পথে দেখেছিলেন একদল লোক চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে “ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়”। খাবার নেই, জল নেই, নিজেদের বলতে কিচ্ছুটি নেই। হাতের সামনে যে যা পেরেছে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে উঠে পড়েছে ট্রেনে। কোথায় যাচ্ছে, এরপরে কীভাবে থাকবে তার কিচ্ছুটি জানা নেই কারও কাছেই।

বাবা আসতে চাননি কলকাতা ছেড়ে। তাঁর কাছে তখন নতুন দুটো ভূখণ্ড ভারতবর্ষ আর পাকিস্তান। বাবা থেকে যেতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষে। আর দাদু চেয়েছিলেন যে গ্রামের মাটিতে তাঁর বাবা, মা পূর্বজরা পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে আছেন, যে নদীর জলে ডুব দিলে জীবনে শান্তি পাওয়া যায় সেই কলাপোতায়। তখনও হয়তো তিনি মনে মনে বিশ্বাস করতেন এটা মানুষের সাময়িক ভ্রম। দেশ নেতাদের অলীক কল্পনা। “দেশ কখনও ভাগ করা যায় নাকি? এটা কি তোমার লাউটা, মুলোটা কাটলেই ভাগ হয়ে গেল?” সামনের বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। “বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাবে দুই দেশের সীমানা। তখন দেখো আবার আমি কেমন করে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে স্টেশনে নামি। বাড়ির দোরে এসে ডাক দিই…কোথায় ব্রজের মা…? হাতের ব্যাগখানা ধরো দেখি। তোমার জন্য বড় বাজারের মশলা আর ভীম নাগের সন্দেশ আছে।” বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দাদুর চোখে ছানি পড়েছিল। কিন্তু দুটো দেশ জোড়া লাগেনি। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন দাদুকে একা রেখে এইভাবে তিনি ইণ্ডিয়া চলে যেতে পারবেন না। কাজেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তাঁকে থেকে যেতে হয়েছিল। তার মধ্যে বুদ্ধি খরচ করে তিনি দাদুর জমানো টাকায় বেশ কিছু জমি কিনে নিলেন। চাষবাস দেখাশুনো করতে শুরু করলেন। আর দাদুর জন্য খুলে দিলেন একটা টোল। সেখানে দাদু পড়াতে শুরু করলেন গ্রামের বাচ্চাদের। না হলে মানুষটার সময় কাটবে কী করে? ভাবতে ভাবতে শেষকালে পাগল হয়ে যাবে না তো? টোল থেকে কোনো কোনো দিন দাদু বাড়ি ফিরতেন না। সবাই জানতো তিনি এখন চুপ করে বসে আছেন কপোতাক্ষের ধারে। ওপারের দিকে তাকিয়ে। মাঝিদের জিজ্ঞেস করতেন ওদিকের ট্রেন চলতে শুরু করেছে কিনা। এইসব ইন্দুবালা দেখেননি। শুনেছিলেন সব সেই ছোট্ট থেকে। শ্রুতিমালার সেই গল্পগুলো রয়ে গিয়েছিল তাঁর মনে। দাদুকে তিনি যখন দেখেছিলেন তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে মানুষটা। তবুও তাঁর সেই টোলের বারান্দায় চুপ করে বসে থাকা, মাঝে মাঝে দিদিভাই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ভুলতে পারেননি ইন্দুবালা। এখন ভাবেন এত কষ্ট নিয়ে কী করে বেঁচে ছিলেন দাদু? বন্ধু বান্ধব যা ছিল সবই ওপারে। আর এপারে ছিল প্রতিশ্রুতির বন্ধন। দাদু তাঁর বাবাকে কথা দিয়েছিলেন থাকবেন তিনি এই পিতৃপুরুষের ভিটেতেই। সেই কথার খেলাপ তিনি কোনোদিন করেননি। অসম্মান তো দূরের কথা। তার অবিচল সিদ্ধান্ত থেকে কেউ টলাতে পারেনি। তাহলে যেখানে সবাই রয়ে গেল ওই পারে, সেখানে একমাত্র ইন্দুবালা তাঁদের পিতৃপুরুষের স্মৃতি তর্পণের জন্য কেন রয়ে গেলেন এপারে? কেন বাবার মনে হয়েছিল একমাত্র ইন্দুবালাকেই ওপারে পাঠাতে হবে? অনেকের মতো কেন বাবা নিজেও সিদ্ধান্ত নিলেন না এপারে চলে আসার? ইন্দুবালা জানতেন বাবা শিকড় ছাড়া হতে পারতেন না। মাও না। ঠাম্মাও না। আর ভাই? তার কথা সোনার আখরে ইতিহাসে না লেখা থাকলেও ইন্দুবালা জানেন ওই যে মুক্তোর মতো বর্ণপরিচয়, সেখানেই লুকিয়ে আছে তাঁর ভাই। ভাষা শহীদ হওয়া কি মুখের কথা? সে তো জন্ম জন্মান্তরের পুণ্যের ফল। তাঁদের গোটা পরিবারের মাতৃভূমির কাছে ঋণ মোচন।

ঝোড়ো হাওয়ায় বাড়ির সব জানলা দরজাগুলো হুটোপাটি করে পড়ার শব্দে ইন্দুবালার ঝিমুনি কাটে। দুপুরে হোটেলের কাজ কম্ম শেষ করে তাঁকে এখন একটু বিশ্রাম নিতে হয়। না হলে রাতের দিকে আর উনুনের সামনে দাঁড়াতে পারেন না। ভেতরে কীরকম যেন একটা কষ্ট হয়। এইসব যদি ঘুণাক্ষরেও ধনঞ্জয় জানতে পারে তাহলে ছেলেদের বলে দেবে। তারা তখন মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ডাক্তার বদ্যি নিয়ে অযথা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবে। নিয়ম দিয়ে মাকে বেঁধে ফেলতে চাইবে ওরা সাত তাড়াতাড়ি। এইসব ভাবলেও বিরক্ত বোধ হয় ইন্দুবালার। ঝিম ধরা চোখে তাকান বাইরের দিকে। আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। কালবৈশাখী। কোনোরকমে গাঁটের ব্যথা সামলে উঠে পড়েন তিনি। ধনঞ্জয়কে ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। বাজার করতে গেল নাকি? এখন এতগুলো জানলা বন্ধ করবেন কী করে? তাও কোনোরকমে ওপরের ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করতে পারেন তিনি। আর ঠিক তখনই নজর পড়ে উঠোনের দিকে। বাগানের গাছটা থেকে টুপ টুপ করে আম পড়ছে ঝড়ে। সেদিনও কি এমন ঝড়টাই হচ্ছিল না? তবে সেটা ছিল ভোর। আর আজ বিকেল। ইন্দুবালা ভুলে যান তাঁকে বন্ধ করতে হবে বাড়ির আরও জানলা দরজা। ভুলে যান তাঁর বয়েস ছুঁয়ে গেছে সত্তরের ওপার। ঝোড়ো হাওয়া আর টুপটুপ আম পড়ার শব্দ তখন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। ইন্দুবালা নামছেন সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে। কোথায় তাঁর পায়ের ব্যথা? গাঁটের বাত? যেন ছুটছেন তিনি এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে উঠোনের দিকে। ছুটছেন ইন্দুবালা। ছুটছেন তীর বেগে। ঝোড়ো হাওয়ায় কেঁপে উঠছে হাতের লণ্ঠনের শিখা। কড়কড় করে বাজের শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। ভোর হতে তখন অনেক দেরি। পেছনে ছুটছে ছোট্ট ভাইটা। তার পেছনে মা, তারও অনেক পেছনে ঠাম্মা। গোটা আমবাগান জুড়ে কলাপোতার লোকজন জড়ো হয়েছে ওই আঁধার ভোরে। প্রায় একশো গাছের বাগান যাদের তারাও এসেছে। গাঁয়ের লোকের আম কুড়োনোতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এমনিতেই নষ্ট হয় কত। শিলের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আম পড়ছে হাওয়ায়। কেউ মারামারি করছে না। রেষারেষি না। সবার কোঁচড় ভরে উঠছে কাঁচামিঠে, ল্যাঙরা, বোম্বাই আমে। ঝড়ের সাথে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। কড়কড় করে বাজ পড়ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটা ঠকঠক করে কাঁপছে। বারণ করেছিলেন ইন্দুবালা। বাবার সাথে বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। শোনেনি ভাই। তাঁর সাথেই ছায়ার মতো থাকে যে। চলে এসেছে ছুটে ছুটে দিদির পেছন পেছন। এবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালেই হলো আর কি। তাড়াতাড়ি গিয়ে নিজের আঁচলে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালা ভাইকে। তাও কি বৃষ্টির থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? বিড়বিড় করেন, “লেবু পাতায় করম চা যা বৃষ্টি থেমে যা”। কিন্তু বৃষ্টি থামার নাম নেই। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে যেন বরফ জলের ঠাণ্ডা। ভাই বোন ঠকঠক করে কাঁপে। দুজনে আগলে রাখে কোঁচড়ে জমানো আমগুলোকে। একটা সময়ে ইন্দুবালা ইঠাই বুঝতে পারেন চারপাশে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু তাঁদের মাথায় বৃষ্টি নেই কেন? ওপর দিকে তাকাতে ইন্দুবালা দেখলেন একটা বড় কচু পাতা। সেটা ধরে আছে মনিরুল। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন, ইন্দুবালা বলে বোঝাতে পারেননি কাউকে। বলার সুযোগ ছিল না। রুমালের ওপর সুতা দিয়ে একটা ছেলেকে এঁকেছিলেন তিনি। তার হাতে দিয়েছিলেন একটা কচু পাতা। আর মেয়েটাকে রেখেছিলেন দূরে। এলোচুলে। বৃষ্টির মধ্যে। ইচ্ছে ছিল মনিরুলকে নিজে হাতে করে দেবেন রুমালটা। সেটা আর দেওয়া হয়নি। কেন দিতে পারেননি মনিরুলকে? মা দেখতে পেয়ে গিয়েছিল কি? বকেছিল খুব? মনে করতে বসেন ইন্দুবালা। নাকি তিনি নিজেই মিথ্যে বলেছিলেন মাকে? ভাইয়ের জন্য রুমাল করেছেন। ভাই সেই রুমালে সারাদিন নাক ঝেড়ে ঝেড়ে ভর্তি করেছিল। আর ইন্দুবালা পড়েছিলেন জ্বরে। বেজায় শরীর খারাপ হয়েছিল সেবার। সারছিলো না মোটেই। সাতদিনের মাথায় পথ্যি পেয়ে তবে মেয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল। গ্রীষ্মের রোদে ঘর থেকে বেরিয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল ইন্দুবালার। ঠাম্মা ততদিনে সেই ঝড়ে কুড়োনো আমগুলোকে কেটে, ধুয়ে হলুদ নুন মাখিয়ে কিছুটা আচার করে ছিলেন আর বেশ খানিকটা আমতেল বসিয়েছিলেন রোদে। সুয্যিদেব গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে রোদে তাতিয়ে তেলে মিশিয়ে কাঁচা আমগুলোকে জারিয়ে দেবেন। তারপর সেই তেল দিয়ে সারা বছর যা খাওয়া দাওয়া চলবে তার কোনো হিসেবের কুল কিনারা পাওয়া যাবে না। আম তেল মুড়ি দিয়ে মাখা হবে। গরমভাতে ঘিয়ের বদলে খাওয়া হবে। মাছের ঝোলে বিশেষ করে সরল পুঁটিতে আমের গন্ধ দেওয়ার জন্য আমতেল ব্যবহার হবে। আর গ্রামে পোয়াতির সংখ্যা নেহাৎ কম থাকে না সম্বৎসর। তারাও পাবে। পাতা কুড়োতে এসে খেন্তির মা পাবে। টিফিনে মনিরুল পাবে। ফকিরি গান গাইতে আসা অন্ধ কানাই পাবে। চুরি করে ঠাম্মার আম তেল আর আচার খেতে খেতে গরমের ছুটির দুপুরগুলো কেটে যাবে।

বৃষ্টিটা সবে ধরেছে। তবে হাওয়ার বেগ এখনও বেশ ভালোই। ঝিরঝিরে জোলো বাতাস চারিদিকে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইদানিং হয়েছে কী, কলকাতার এই ধরনের হুট করে আসা বৃষ্টিতে সবাই কেমন যেন তালকানা হয়ে যায়। ট্রাফিক সার্জেন্ট থেকে শুরু করে অটো চালক- সবাই। ইন্দুবালার বড় ছেলে প্রদীপ হঠাৎ নিজেই ড্রাইভ করে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। অন্যান্য বার আগে ফোন করে জানিয়ে রাখে মাকে কিংবা ধনঞ্জয়কে। এবার সেসব কিছুই করেনি। ভেবেছিল মাকে একটু চমকে দেবে। সদর দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলবে, “আজ কিন্তু বাড়ি যাবো না মা। থাকবো তোমার কাছে।” এমন কথা শুনলে তার মা কী বলবে এই বুড়ো ছেলেকে সেটা জানার জন্য তার খুব ইচ্ছে করছিল। যদিও জানে প্রদীপ, মা তাকে কোনোদিনই বউ বাচ্চা ছেড়ে থাকতে দেয়নি। এমনকি অন্যান্য মায়েরা যেমন খুব আদিখ্যেতা করে বাচ্চাদের আদর করে, খাওয়ায়; ইন্দুবালা তাঁর ছেলেদের বা মেয়েকে কোনোদিনই তেমন করে বড় করেননি। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা ছিল চোরাস্রোতের মতো। সেটা তিন ছেলে মেয়েই খুব ভালো করে টের পেতো। শরীর খারাপ করলে, জ্বর হলে ঠায় মাথার কাছে বসে থাকতেন। সারা রাত জাগার পর আবার সারাদিন হোটেলে ওই গনগনে উনুনের সামনে রান্না করা। মায়ের কষ্ট তারা বুঝতো। তাই জীবনের প্রথম চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েই প্রদীপ মাকে হোটেল বন্ধ করতে বলেছিল। দিল্লিতে যে কোয়ার্টারটা সে পাবে তাতে সবাই মিলে থাকা যাবে। ইন্দুবালা হাসি মুখে শুধু বলেছিলেন “এবার তুই ছেনু মিত্তির লেনের মায়া কাটিয়ে নতুন জীবন শুরু কর বড় খোকা”।

চাকরি পাওয়ার পর যেদিন প্রথম সে বাড়ি থেকে বেরোলো বড় মন কেমন করেছিল। ভাই, বোন এমনকি ধনাদা পর্যন্ত গিয়েছিল তার দিল্লির কোয়ার্টার গুছিয়ে দিতে। মা একবারও যায়নি। বিয়ের আগেও না। পরেও না। কেউ নড়াতে পারেনি তাকে এই বাড়ি ছেড়ে। হোটেল বন্ধ থাকা মানে যেন মায়ের প্রাণ চলে যাওয়া। ভাই আর খুকি বুঝিয়েছিল দাদাকে। মা যেমন আছে থাক। মেনে নিয়েছিল প্রদীপ। কিন্তু এখন তার মাঝে মাঝেই ভয় হয় এই বয়সে অতটা আগুনের সামনে একটা বিপদ যদি হয়ে যায়। কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার পরে এমনও হয়েছে সপ্তাহে দুবারও এসেছে সে। কিন্তু লক্ষ্য করেছে তাতে মা বিরক্ত হয়। ভাবে বুঝি নজর রাখতে এসেছে ছেলে। মার পছন্দ হয় না এমন কোনো কাজ প্রদীপ করতে চায় না। কিন্তু না জানিয়ে এসে সেকি আজ ভুল করলো? ধনঞ্জয়কে অন্তত ফোন করে আসলে ঠিক সময় মতো ও দাঁড়িয়ে থাকতো। গাড়ি পার্ক করার অসুবিধে হতো না। আজ বেজায় ঝামেলা হচ্ছে।

ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের সামনে একটু বৃষ্টিতেই গোড়ালি সমান জল। সেখানে আবার কোথায় গর্ত আছে, নর্দমা আছে সেইসব দেখে গাড়ি রাখতে প্রদীপের অনেকটা সময় লেগে যায়। এতক্ষণে বাড়িটার দিকে তাকানোর ফুরসৎ হয় তার। শহরের এক পুরোনো পাড়ায় বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেয় দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা কেমন যেন একলা হয়ে। কোথাও আলোটুকু পর্যন্ত নেই। তার মন কেমন যেন কু গেয়ে ওঠে। গোটা বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। এমনকি সামনে যে দু তিনটে খদ্দের ঘোরাঘুরি করে তারাও আজ নেই। বোর্ডে লাগানো আলোটাও আজ জ্বলছে না। প্রদীপ অনেক দিন পর মায়ের সাথে দেখা করতে এলো। আসবো আসবো করে তার আসাই হয় না। আজ এইটা কাল ওইটা লেগেই থাকে। তার আজকে আসার আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে এইবার পাসপোর্টটা ফারদার রিনিউ করার আগে সে একবার বাংলাদেশ ট্যুর করতে চায়। একটা প্যাকেজও পাচ্ছে প্রায় কিছু খরচ না করেই। ছেলে বুবাই বললো “যাও না ঠাম্মির দেশে! কীসব তোমাদের কলাপোতা…ফোতা।” আইডিয়াটা খারাপ লাগেনি প্রদীপের। বউ সম্পূর্ণাও রাজি হয়ে গিয়েছিল। কর্মসূত্রে স্বামীর সাথে তার বাইরের অনেক দেশ ঘোরা। কিন্তু বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি। নিজের চোখে হাতে করে একটু ঢাকাই মসলিন দেখে আসার ইচ্ছে আছে তার। সাথে কিছু কেনারও। এবার মা রাজি হলে তাহলে পাসপোর্টের একটা ঝামেলা থাকবে। মায়ের পুরোনো পাসপোর্টটা আছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। প্রদীপ যদিও জানে পাসপোর্ট করাতে সময় লাগবে না। বুবাইয়ের বন্ধু কাজ করে পাসপোর্ট অফিসে। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সব। সম্পূর্ণই তাকে ঠেলে পাঠালো। একবার কথা তোলবার জন্য। মেজাজ যা মাঝে মাঝে থাকে বুড়ির!

প্রদীপ বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল বৃষ্টি ছিল না। এই দিকেই হয়েছে তাহলে ভালো। গরমের বৃষ্টি কোথায় যে কখন হয় বোঝা যায় না। প্রদীপ এগিয়ে গেল ভেতরের দরজার দিকে। সিঁড়ির আলো জ্বালানো। বাইরের বারান্দার। না কোথাও কেউ নেই। দুবার ডাকলো “মা..মা” বলে। কোন সাড়া শব্দ পেলো না। প্রদীপ চিৎকার করে ডাকলো ধনঞ্জয়কে। “ধনাদা..”। উত্তর নেই। কেমন যেন ভয়ে পেয়ে গেলো প্রদীপ। যদি মা সত্যি না থাকে? এই কথাটা যেন প্রথম ভাবলো সবে সিনিয়র সিটিজেনের তালিকায় প্রবেশ করতে যাওয়া প্রদীপ। এমন ভাবে কোনোদিন এর আগে মনে হয়নি। মা থাকলে জগৎটা তার এক রকম। আর মা না থাকলে অন্য রকম। বাবাকে ঝাপসা মনে পড়ে। ঘুড়ি ওড়ালে বাবা লাটাই ধরা শেখাতো। ব্যস, ওইটুকুই। তার তো তাও এটা মনে আছে, ভাই আর বোনের সেটুকুও তো মনে নেই। সবটাই তো তিনজনের মাকে ঘিরে। একবার কি ফোন করবে তাহলে ভাইকে? খুকুকে? কিন্তু কী বলবে? ছেনু মিত্তির লেনে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে সে এসেছে অথচ ইন্দুবালাকে খুঁজে পাচ্ছে না? দোতলা ঘুরে এসে পিছনের দিকে কুয়োতলায় উঠোনের কাছে এসে আর একবার কাঁপা কাঁপা গলায় ডেকে উঠলো প্রদীপ “মা…”। এবার খুব শান্ত গলায় উত্তর ভেসে এলো “আয়..”। প্রদীপ তার মায়ের গলা শুনতে পেল কিন্তু মাকে সে দেখতে পেলো না তখনই। মোবাইলের টর্চ জ্বালালো। “কোথায় তুমি মা?” একটু এগিয়ে যেতেই সে তার মাকে খুঁজে পেলো। কাক ভিজে হয়ে সন্ধ্যের উঠোনে ঝাঁকড়া আমগাছের ডালটার নীচে বসে আছেন ইন্দুবালা। চারপাশে জড়ো করা ঝড়ে পড়া কাঁচা আম। প্রদীপ এগিয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে তার মাকে। “মা তুমি ঠিক আছে তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? পড়ে গিয়েছিলে নাকি? আমাকে ধরো মা..প্লিজ আমাকে ধরো…শক্ত করে ধরো…।” ইন্দুবালা ছেলের হাত ধরেন। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে, আধুনিক মোবাইলের এল ই ডি লাইটে ইন্দুবালা বলে ওঠেন “আমাকে একটু তেল কিনে দিবি বড় খোকা? আম তেল করবো…।”

এমনটা নয় যে ইন্দুবালার তেল কেনার টাকা নেই। এমনটা নয় ইন্দুবালা এইভাবে ছেলেদের কাছে টাকা চান। কোনোদিন কারো কাছে একটা টাকাও হাত পেতে চাননি সেই প্রথম দিন লছমী টাকা দিয়ে ভাত খেয়ে যাওয়ার পর থেকে। তারপর মা লক্ষ্মীর দয়ায় ক্যাশবাক্স ভর্তি থেকেছে সবসময়। তাই প্রদীপ একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। তার মনে ভয় ছিল ছোটোখাটো কোনো সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে কিনা। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছে মা। ততক্ষণে সারা রাজ্যের বাজার ঘুরে ধনঞ্জয় এসে পড়েছিল। প্রদীপ একটুও দেরি না করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিল। সোজা নিয়ে গিয়েছিল কাছের নার্সিংহোমে। এমার্জেন্সির ডাক্তার বরং উলটে কথা শোনালো প্রদীপকে “আমতেল করার জন্য টাকা চেয়েছেন বলে সোজা এখানে নিয়ে চলে এলেন মাকে? আচ্ছা ছেলে তো মশাই”। প্রদীপ ইচ্ছে করলে ডাক্তারকে বোঝাতে পারতো তার মা কোন ধাতে গড়া মানুষ। কিন্তু সেই পথে সে হাঁটলোই না। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলো। তারও যেন এক ঘোর লেগেছে চোখে। আমের স্কুপের মধ্যে বৃষ্টি ভেজা মাকে একা বসে থাকতে দেখে তার কি কান্না পেয়েছে? কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজেকে লুকোয় প্রদীপ। আর ওদিকে ডাক্তার অবাক হয়ে শোনেন দুবেলা এখনও তিনশো করে লোকের রান্না করা, কুটনো কাটা ইন্দুবালার দিনলিপি। আতিপাতি খোঁজ নিয়ে হোটেলের ঠিকানা চেয়ে দুটো এন্টাসিড লিখে ডাক্তার ছেড়ে দিলেন ইন্দুবালাকে। তার সাথে ইন্দুবালা তাঁকে বলে এলেন সকালে উঠে লেবুর জলের সাথে মধু খাওয়ার নিদান। তাও যে সে মধু নয়। সর্ষে ফুলের মধু। গরম জলের মধ্যে ঘুরবে তার ঝাঁঝ। চর্বি যাবে কমে। মন থাকবে ফুরফুরে। বাড়ি ফেরার পথে বড় খোকার গাড়ি থামিয়ে পাঁচ কিলো সর্ষের তেল কিনলেন। ততক্ষণে ছোট খোকা, খুকি বেসবাই ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে। ইন্দুবালার মুখে হাসি। তিনি এক্ষুনি মরছেন। নাকি? বড় খোকার গাড়িতে এই প্রথম উঠে বেশ লাগলো তাঁর। চারপাশটা কেমন যেন ঠাণ্ডা। কী সুন্দর জুই ফুলের গন্ধ গাড়ির মধ্যে। হুশ হুশ করে কত জায়গায় বেড়াতে যায় ওরা। অথচ সবাই কত কষ্টে বড় হয়েছে। ঈশ্বর করুন যেন এমন থাকে সবাই। দুধে, ভাতে, সুখে, আনন্দে। ওদের এই শ্রী বৃদ্ধি দু চোখ ভরে দেখার আশায় ঈশ্বরের কাছে আরও কয়েকটা বছরের আয়ু চেয়ে নেন তিনি মনে মনে।

ইন্দুবালার শরীর এখন বেশ ভালো। আদৌ কখনও খারাপ হয়েছিল কিনা বোঝা যায় না। তেলের মধ্যে আমগুলো যখন বেশ চুবো চুবো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রদীপ তার বউকে নিয়ে এলো একদিন। সেদিন যে কথাটা পাড়া হয়নি এবার বলেই ফেললো সাহস করে। “যাবে মা আমাদের সাথে বাংলাদেশ?” ইন্দুবালা খুব যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন তেমনটা নয়। এঁচোড় কাটছিলেন হাতে তেল মেখে আঠা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। কুটনো কাটা থেমে গেল তাঁর। বিয়ের পরে যখন দেশ থেকে এসেছিলেন তখন সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর আজ সেটা বাংলাদেশ। তাঁর ছেলে বলছে মাকে একবার বাংলাদেশ ঘোরাবে। সত্যি কানে ঠিক শুনছেন তো তিনি? কোনো ছলনায় এরা আবার এসে জোটেনি তো এই সাত সকালে? উঠে পড়েন ইন্দুবালা। পড়ে থাকে আধ কাটা এঁচোড়। ডালনার না কাটা আলু। মোচা। আরও অনেক তরিতরকারি। ছেলের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চান “হঠাৎ বাংলাদেশ যাওয়ার কথা বলছিস কেন? আমি না মরা পর্যন্ত এই বাড়ি তোমরা বিক্রি করতে পারবে না বড় খোকা”। প্রদীপ হো হো করে হাসে। “তুমি কী করে ভাবলে আমি বাড়ি বিক্রি করার জন্য তোমাকে বাংলাদেশের লোভ দেখাবো?” ইন্দুবালার বিশ্বাস হয় না বড় ছেলের কথা। “এই তো সামনের চক্কোত্তিবাড়ির মেয়ে দুটো বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট তুলে দিলো।” সম্পূর্ণা এবার এগিয়ে আসে। ইন্দুবলার বড়ছেলের বউ কম কথা বলে। কিন্তু যেটুকু বলে কাটা কাটা, তীক্ষ্ণ, নুন ছড়ানোর মতো। “আপনি ভুল বুঝছেন মা। চক্কোত্তি বাড়ির সাথে আপনার ছেলে-মেয়েদের গোলাবেন না। আমরা বাংলাদেশের ট্যুর প্ল্যান করছিলাম। আপনার ছেলে তাই ভেবেছিল আপনি গেলে আমাদের ভালো লাগবে। ও তো কোনোদিন দেখেনি…। কলকাতা স্টেশন থেকে এখন ট্রেনও ছাড়ছে। মৈত্রী এক্সপ্রেস। এর মধ্যে বাড়ি বিক্রির কথা আসছে কী করে? আর আমাদের সবার তো বাড়ি আছে মা…।” ট্রেন ছাড়ছে বাংলাদেশের জন্য এই বড় খবরটা ইন্দুবালার কাছে ছিল না এতদিন? “ট্রেনে করে যাওয়া যাবে খুলনা?” বড় ছেলে বলে যাবে। ইন্দুবালা প্রশ্ন করেন “জানলার ধারে সিট পাবো খোকা?” প্রদীপ জানিয়ে দেয় “পাবে। একটা কূপ রিজার্ভ করে নেবো মা। সেখানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না।” কেমন যেন ফুরফুরে মেজাজের হয়ে যান ইন্দুবালা। বাড়ির সামনের তুলসী মঞ্চটাকে স্পষ্ট দেখতে |||||||||| পান। মাকে…বাবাকে…ঠাম্মাকে…ভাইকে…মনিরুলকে…।

বড় ছেলে, বউকে এঁচোড়ের ডালনা, মোচার ঘন্ট, পাবদার ঝোল আর কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে বাড়ি পাঠান ইন্দুবালা। সঙ্গে দিয়ে দেন এক শিশি আম তেল। ভাত খেতে আসা কালেক্টর অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে সামনের মেসের ছেলেগুলো এমনকি পাগলা পাঁচুও জেনে যায় ট্রেনে করে ইন্দুবালা বাংলাদেশ যাবেন। সারা রাত ওপরের ঘরে খটর মটর করে কীসের যেন আওয়াজ হয়। ধনঞ্জয় যতক্ষণ জেগেছিল শুনেছে। অনেক ভোরে ইন্দুবালার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায় তার। “কী হয়েছে মা? এত ভোরে?” চোখ কচলায় ধনঞ্জয়। দেখে ইন্দুবালার পরিপাটি করে চুল বাঁধা। নতুন কাপড় পরা। কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি। “কী হলো কি মা তোমার? নাতি পাসপোর্টের ফটো তোলার জন্য তোমাকে নিয়ে যাবে বেলা নটায়। এখন থেকে কাপড় পরে বসে আছো কেন?” ইন্দুবালা হুকুমের সুরে বলে “একটা ট্যাক্সি ডাক। আমি কলকাতা স্টেশন যাবো।” ধনঞ্জয় বলে “এ্যাঁ? এতো সকালে কলকাতা স্টেশনে? দেশে যাওয়ার নামে তোমার মাথা কি সত্যিই খারাপ হলো?” ইন্দুবালা কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগোলে কোনোরকমে উঠে জামা পরে দৌড় লাগায় ধনঞ্জয়। এই মুড তার অনেক দিনের চেনা। বেশি কথা বললে জেদ আরও বাড়বে। নিজেও চলে যেতে পারে। তখন হিতে বিপরীত হবে। দাদাবাবুদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে দিতে জান কাবার হবার জোগাড়। তাই কথা না বাড়িয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিজেও চেপে বসে ধনঞ্জয়।

দুটো প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটা হয়। ইন্দুবালা বলেন “জিজ্ঞেস কর মৈত্রী এক্সপ্রেস কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে?” একজন টিটি দেখিয়ে দেয়। “ওই তো… দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওদিকে তো যেতে পারবেন না। সময় হয়নি এখনও। টিকিট আছে তো? পাসপোর্ট, ভিসা? সব চেক হবে কিন্তু।” ইন্দুবালার ওইসব কিছু নেই। তিনি দূর থেকে দেখেন মৈত্রী এক্সপ্রেসকে। ট্রেনের গায়ে বড় বড় করে বোর্ডে লেখা কলকাতা-খুলনা। কিন্তু সেই আগের ট্রেনটার মতো সবজেটে নয়তো। কেমন যেন ধূসর নীল। ইন্দুবালার বিশ্বাস হয় না। এবার নিজেই এগিয়ে যান টিটির কাছে, “আচ্ছা আপনি ঠিক বলছেন তো ভাই? এই ট্রেনটাই যাবে খুলনা?” বিরক্ত হয় টিটি। একে ইন্টারন্যাশানাল ট্রেন। তার ওপরে ঝক্কি আছে অনেক। সিকিউরিটির দিকে সব সময় খেয়াল রাখতে হয়। তার মাঝে কিছু লোক এসে দেশ দেশ করে এমন ন্যাকামো করে না। ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে, “দেখতেই তো পাচ্ছেন লেখা আছে সব কিছু”। ইন্দুবালা অবাক হন নাতির বয়সী ছেলেটার বিরক্তি দেখে। “ওকি রেগে যাচ্ছো কেন বাবা? ধনা, ওনাকে দুটো নাড়ু দে। ট্রেন দেখতে আসলে কেউ এরম করে বকে?” কী বলবে বুঝতে পারে না বছর সাতাশের অখিলেশ। নতুন চাকরির প্রথম পোস্টিং তার। হাতে নাড় নিয়ে দিদার মতো এক মহিলাকে একটু দূর থেকে ট্রেনটা দেখতে বলে এগিয়ে যায় সে নিজের কাজে। ইন্দুবালা অবাক হয়ে দেখেন ট্রেনটাকে। এর কত ভাগ্য। কতবার ছুঁয়ে আসছে দেশটাকে। আর তিনি? সেই যে চলে এসেছিলেন আর একটি বারের জন্যেও যাওয়া হয়নি। বলা যেতে পারে যাননি। ধনঞ্জয় তাড়া দেয় “হলো মা তোমার? হোটেলের দেরি হয়ে যাবে যে। রান্না বসাবে কখন?”। ইন্দুবালা ধমকান, “তুই থাম। কিচ্ছু দেরি হবে না। সব আমি সামলে নেবো। কী জানিস তুই এই ট্রেনের?” ধনঞ্জয় মনে মনে ভাবে জানার আর কী আছে? সেও তো দেশের বাড়িতে ট্রেনে করেই যায়। আর মা এখন আদেখলার মতো ট্রেন ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেন কোনোকালে ট্রেন দেখেনি। ইন্দুবালার ইচ্ছে করছিল একবার ট্রেনটার গায়ে স্পর্শ করতে। দুই দেশের মধ্যে যখন সব যোগাযোগ বন্ধ তখন সেই সবজেটে ট্রেনটাই কি একটা থমকে থাকা সময়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো না শিয়ালদার স্টেশনে? মাঝে মাঝে লছমীর সাথে শুধু সেই ট্রেনটাকে দেখবেন বলে চলে আসতেন ইন্দুবালা। সেই ট্রেনের গায়ে হাত দিলে তিনি তার দেশকে দেখতে পেতেন। গ্রামটাকে দেখতে পেতেন। গন্ধ পেতেন মায়ের আঁচলের। প্ল্যাটফর্ম এখনও ফাঁকা। ছোকরা টিটিকেও দেখা যাচ্ছে না আর। ইন্দুবালা আরও এগিয়ে যান ট্রেনটার দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করেন তার গা। কিন্তু কোথায়? ভেসে আসছে না তো তার দেশের গন্ধ। কলাপোতার গ্রাম। বোসদের পুকুর। কপোতাক্ষ নদ। ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির মিটমিট করে জ্বলে থাকা। না না না এই ট্রেন তাঁর সেই সবুজ কাঁচা আমতেল রঙের ট্রেন নয়। এই ট্রেনে করে তিনি দেশ ছেড়ে আসেননি। এই ট্রেন তাঁর দাদুকে শেষবারের মতো নামিয়ে দেয়নি কপোতাক্ষের ধারে। এই ট্রেন তো এখন বেড়াতে যাওয়ার। দেশে ফেরার নয়। উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করা নয় সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে দেখার জন্য। চোখ দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে জল। অনেক দিন আগে একাত্তরে তাঁদের কলাপোতার বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিল খানসেনারা। বাড়ির সাথে পুড়েছিল মা, ভাই আরও অনেকে। সেই চিতাভস্ম আর হাজার হাজার শহীদের রক্তে যে দেশটা গড়ে উঠেছে নতুন করে সেখানে আজ গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর বাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ইন্দুবালা নিশ্চিত জানেন। এবার যদি গিয়ে গ্রামটাকেই না খুঁজে পান? যদি বোস পুকুরটাই আর না থাকে? কপোতাক্ষের ঘাট? মনিরুলের বাড়ির উঠোন? বড় মাঠের ফলসা গাছ? তাহলে কার কাছে ফিরে যাবেন ইন্দুবালা? কার আঁচলে মুখ লুকোতে? যারা ছিল অথচ আজ নেই? নাকি যারা মরেও বেঁচে আছেন ইন্দুবালার মধ্যে? নীরবে কাঁদেন ইন্দুবালা। কোনো সদুত্তর পান না অন্তর থেকে। শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের ভিড় বাড়ে। পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার করে মানুষ। এক সময়ে যে দেশটা নিজের দেশ ছিল সেটারই বেড়া টপকায়। প্রত্যেক বছর বৃষ্টি আসে নিয়ম করে দু দেশেই। তবুও সীমান্তের দাগ মুছে যায় না সেই জলে। ওটা ইন্দুবালার দাদুর স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়।

কলকাতা স্টেশনে যাত্রীদের আনন্দের আতিশয্যের ফাঁকে সেদিন ট্রেনে ওঠার আগে কেউ কেউ লক্ষ্য করলেন এক সত্তর পেরোনো মহিলাকে। যার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে করুণাধারা। যিনি চুপ করে বসে আছেন দেশ নামের এমন এক স্বপ্ন নিয়ে, যে দেশে তাঁর জন্যে আজ আর অপেক্ষা করে থাকবার কেউ নেই। মনে মনে আরও একবার প্রতিজ্ঞা করলেন ইন্দুবালা। ভাতের হোটেল ছেড়ে তিনি কোত্থাও কোনোদিন যাননি। আজও যাবেন না। শত প্রলোভনেও না। হনহন করে হাঁটতে থাকেন তিনি ওভার ব্রিজ দিয়ে। এক্ষুনি তাঁর মনে পড়ে গেছে আজকের মেনুতে আম-কই এর কথাটা বোর্ডে লিখতে ভুলে গেছেন। ধনঞ্জয় শুধু জানে এই একটা পদ খেতেই আজ ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সামনে লাইন পড়বে। কই মাছের মাখো মাখো ঝোল থেকে সুবাস উঠবে আম তেলের।

মালপোয়া

ভোর থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার অনেক আগেই। অন্ধকার ঘরটায় শুয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনছিলেন ইন্দুবালা। অল্প অল্প বাতাসে দুলছিল জানলার হালকা পর্দাগুলো। তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল একটু একটু করে ফর্সা হতে থাকা মেঘলা আকাশ। একতলায় ভাতের হোটেলের ওপরে তাঁর এই ঘরটা ছোট্ট হলেও বেশ খোলামেলা। অন্তত এই বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলোর থেকে তো বটেই। ঘরের চারিদিক বরাবর বেশ কয়েকটা জানলা। সামনের দিকে এগিয়ে গেলে ছেনু মিত্তির লেন। হরেক মানুষ, গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াত, সার সার বাড়ি। আর পেছন দিকটা শাশুড়ির আমলের ছোট্ট বাগান। সিঁড়িঙ্গে নারকেলগাছ। উঠোনের আমগাছের ডালপালা আরও কয়েকটা জানলায় ছড়ানো ছিটানো। এই ঘরটা আসলে ছিল ইন্দুবালার স্বামী মাস্টার রতলনাল মল্লিকের আমোদের জায়গা। তিনি তাঁর ইয়ার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসে এই ঘরেই তুলতেন। দিন রাত তাস পেটা চলতো। তার সাথে গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি আর সোডা। ঘরখানায় ঢুকলে তখন মনে হতো কেউ যেন সক্কালের আঁচ ধরিয়েছে। ঝাঁট দিয়ে জড়ো হতো রাশিকৃত পোড়া সিগারেট, বিড়ি, আরও কত কী। শাশুড়ি উঠতে বসতে খোঁটা দিতো বউয়ের গতর নিয়ে। যে গতরে তাঁর বাহিরমুখো ছেলে অন্দরে মন বসাতে পারলো না। যে গতর দেখে তিনি ভিসা পাসপোর্ট করে ওপার বাংলা থেকে ছেলের জন্য বাঙাল বউ নিয়ে এলেন। অথচ যে গতর বিলিয়ে সংসারে নাতি নাতনির অভাব হলো না মোটেও। তিন তিনটে সন্তানকে রেখে মাস্টার রতলনাল মল্লিক যখন ইহ জীবনের মায়া ত্যাগ করলেন তখন ইন্দুবালা ভেতরের ঘর থেকে বাইরের এই ঘরে এসে থাকতে শুরু করলেন। শুধু কি অনেক আলো, হাওয়া, বাতাসের জন্য? না, তা মোটেই না। এই ঘরে থাকলে তিনি নীচের হোটেলের রান্নাঘর থেকে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের উপস্থিতি টের পেতেন। সিঁড়ির মুখ থেকে এই ঘরের দিকে নজর রাখা যেত খুব সহজে। আর এই ঘরটায় এলেই যেন ইন্দুবালার কলাপোতার বাড়ির দাওয়াখানা মনে পড়ে যেত। চারিদিকে সবুজের চাঁদোয়া।

ইন্দুবালা পাশ ফিরলেন। এই এত বয়সেও স্মৃতিগুলো কেন এলোমেলো হয়ে যায়? ভুলেও তো যেতে পারে মানুষ অনেক কিছু? অনেকে ভুলেও যায়। শুনেছেন তিনি। এমনকি নিজে কে ছিল। নাম কী। বাড়ির লোকজন পর্যন্ত সবাইকে ভুলে যায়। কিছু নাকি আর মনে থাকে না রোগটা হলে। চারপাশটাকে তখন কি আরও নতুন লাগে? পুনর্জন্মের মতো? কে জানে? আয়নার সামনে এই যে নিজেকে দেখে না চেনার বিড়ম্বনা। কিংবা নতুন আমিকে চিনে নেওয়া। সেটা কি আরও যন্ত্রণাদায়ক নয়? হয়তো। কিন্তু প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের এই স্মৃতির বোঝা টানা আরও কষ্টকর ইন্দুবালার কাছে। নিয়তিকে দোহাই দেন ইন্দুবালা। হয় ভুলিয়ে দাও। না হলে ভুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। অদৃষ্টকে সাত গাল পাড়লেও অনেক কিছু ভোলা হয় না ইন্দুবালার। ভাগ্যিস ভোলা হয় না। তাই তো আনাজের চুবড়ি থেকে, সূঁচ সুতোর কৌটো থেকে, ভাতের হাঁড়ির সুবাস থেকে বেরিয়ে আসে কত কত গল্প। ইন্দুবালা চোখ বন্ধ করে আবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করলেন। ঠাম্মা সন্ধ্যেবেলায় আফিম খেতো। ছোটো ছোটো কালো কালো গুলি করা থাকতো পিতলের কৌটোতে। বাবা খুলনা শহরের বড় এক আড়তদারের কাছ থেকে নিয়ে আসতেন। ফুরিয়ে আসতে থাকলেই ঠাম্মার মাথা যেত খারাপ হয়ে। একটানা আবদার চলতো তার। ধুয়ো টেনে টেনে ঠাম্মা বলে চলতো, “ও ব্রজ, নিয়ে আয় না বাবা। শেষ হয়ে গেল যে গুলি”। সেই কাতর চাহনি এখনও যেন মনে পড়ে ইন্দুবালার। ঠিক মরে যাওয়া মানুষের চাহনির সাথে তার কি কোনো মিল ছিল? ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকটা। শাশুড়ির কথা মনে পড়ে। স্বামীর কথাও। মৃত মানুষের চাহনি ইন্দুবালাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ঘিরে ধরে এক বৃষ্টি ভেজা সকালে।

মুকুলে ভরা আম গাছের তলায় শোয়ানো হয়েছিল দাদুকে। বসন্তের আগমনের আগাম জানান দিচ্ছিল দু একটা কোকিল দূরের কোনো গাছ গাছালির শাখায় বসে। ইন্দুবালা তখন খুব ছোটো। কিছুক্ষণ আগে ঠাম্মা ভাজছিলেন দাওয়া আলো করে নতুন গুড়ের মালপোয়া। গোটা গ্রামে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল গন্ধ। তেলের ছাঁক ছুক আওয়াজে উমনো ঝুমনোর পিঠে খাওয়ার গল্পটা আগাগোড়া বলে চলেছিল ঠাম্মা। হাঁ করে বসে শুনছিল ছোট্ট ইন্দুবালা। দাদু স্নান করতে যাচ্ছিল বোসদের পুকুরে। বাবা গিয়েছিল ধান বিক্রি করতে হাটে। মা ছিল শোওয়া। ভাই তখন পেটে। দাদুর ইচ্ছে হয়েছিল অসময়ে মালপোয়া খাওয়ার। মুখ ফুটে যে মানুষ কিছু চায় না কোনোদিন, সেই মানুষ যখন মালপোয়া খেতে চেয়েছে ইন্দুবালার ঠাম্মার আনন্দ আর গোপন থাকে না। নিজেই গম পিষিয়ে নতুন আটা বের করেছেন জাঁতি ঘুরিয়ে। চাল কুটেছেন ঢেকিতে। বেটেছেন শিলনোড়ায় মিহি করে। নতুন গুড়ের হালকা একটা রস করেছেন। কয়েকদিন খুব ব্যস্ত থেকেছেন নানা তরিজুতের ছোটোখাটো উপকরণ নিয়ে। আর ছোট্ট ইন্দুবালা ঠাম্মার আঁচল ঘিরে, কাপড় জড়িয়ে, কোলে শুয়ে সেই আখ্যানের অংশীদার হয়েছে। উমনো ঝুমনোর গল্প যখন ফুরিয়ে এসেছে, শেষ মালপোয়া যখন তেলের ওপর লাল হয়ে ফুলে উঠছে, মৌরির সুবাস যখন কলাপোতা গ্রামে ম ম করে উঠছে, দাদু স্নান সেরে এসে তুলসী প্রণাম করতে গিয়ে বসে পড়লেন দাওয়ায়। জীবনের শেষ প্রার্থনা আর তাঁর করা হলো না। একদিন কথা বন্ধ রেখে পরের দিন ভোরের সূর্য ওঠার আগে দাদু চলে গেলেন। আমতলায় শোয়ানো থাকলে তাঁর দেহ। হরিনাম সংকীর্তনের দল গোল হয়ে ঘিরে ঘিরে ইনিয়ে বিনিয়ে সুর তুললো। বাড়ি থেকে কেউ মরা কান্নার চিৎকার করলো না। ঠাম্মা বসে থাকলেন চুপ করে পাথরের মতো। বাবা কী করবে বুঝতে পারলো না। মায়ের তখন সবে প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে। ইন্দুবালা চুপি চুপি দাওয়ার পাশে ছোট্ট বেড়া দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরে তখন। কাঁসার রেকাবিতে চাপা দেওয়া আছে গতকালের মালপোয়া। রসে ফুলে ততক্ষণে সেগুলো টইটম্বুর। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতে তুলেছিল সবে ছোট্ট মেয়েটা। গ্রামের কোন এক বউ দেখে ফেলেছিল। রে রে করে উঠে এসে ধরেছিল হাত। “অশৌচের বাড়িতে খেতে আছে কোনো কিছু? ফ্যাল হাত থেকে। ফ্যাল বলছি”। ইন্দুবালা ফেলতে পারেননি সেই মালপোয়া। গোটা রাত ধরে নতুন গুড়ের রসে ভাসতে ভাসতে সেগুলো যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল। হালকা গন্ধ বেরোচ্ছিল মৌরির। এতক্ষণ যে ঠাম্মা কারো সাথে কোনো কথা বলেননি, তিনি উঠে এলেন রান্নাঘরে। খুব শান্ত অথচ কঠিন গলায় বললেন, “ছেড়ে দাও ওকে পাঁচুর মা। ওর খাওয়া মানে ওর দাদুর আত্মার শান্তি পাওয়া। আত্মা না জুড়ালে মায়া কাটবে কী করে?” গপ গপ করে গোটা তিনেক মালপোয়া খেয়ে নিয়েছিলেন ইন্দুবালা। তাঁর হাতে মুখে লেগেছিল রস। ঠাম্মা গড়িয়ে দিয়েছিলেন জল। নিজে হাতে খাইয়েছিলেন নাতনিকে। মুখ হাত ধুইয়ে, মুছিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, “ভালো লেগেছে ইন্দু তোর?” একটা বড় হ্যায় মাথা নেড়েছিলেন ছোট্ট ইন্দুবালা। ঠিক সেই সময় আঁতুর ঘর থেকে ভেসে এসেছিল নবজাতকের কান্নার শব্দ। ঠাম্মা নাতির মুখ দেখে বলেছিলেন, “সেই ফিরে আসতে হলো তো? কোথায় যাবে আমায় ছেড়ে?” তাঁর বিশ্বাস ছিল দাদু ফিরে এসেছেন আম, জাম, কাঁঠাল, মালপোর গন্ধ বুকে নিয়ে। বাবা ফিরেছিলেন শ্মশান বন্ধুদের সাথে বিকেলেরও পরে। ততক্ষণে ঠাম্মার সাদা থান পরা হয়ে গেছে। ছোট্ট ভাইটা হাঁ করে ঘুমোচ্ছে তার কোলে। এদের কারো মৃত মুখ দেখেননি ইন্দুবালা। ভাগ্যিস সেই চরম দুর্ভাগ্য হয়নি তাঁর।

খাটের ওপর চিৎ হয়ে শোন ইন্দুবালা। পিঠের ব্যথাটা আরও বাড়ে। রাতের নেওয়া হট ওয়াটারের ব্যাগটা তখনও অল্প অল্প গরম। কাছে টেনে নেন। পিঠের কাছে রাখলে আরাম পান। যন্ত্রণা শুধু স্মৃতির নয় শরীরেরও। সব যন্ত্রণা শেষ হলে মানুষ মুক্তি পায়। তাই হয়তো সেই অন্তিম লগ্নে মুখের ওপর ছেয়ে থাকে পরম শান্তির ছায়া। এখনও কি জীবনে শান্তি নেই ইন্দুবালার? দিব্যি শান্তি আছে। না হলে নিজেকে এইভাবে জিইয়ে রেখেছেন কী করে? শুয়ে শুয়েই বুঝতে পারেন রাস্তার উলটো দিকে কর্পোরেশানের কলে জল নিতে আসছে টুকটাক করে বাজারের লোকজন। উঠতে ইচ্ছে করছে না। সারা দেহের অবসাদ আজ যেন মনে নেমে এসেছে। ঠাম্মার মৃত্যু সংবাদ যেদিন ভাই নিয়ে এসেছিল সেদিন ইন্দুবালার সাধ। বাড়ি ভরতি লোক বিয়েতেই হয়নি সাধে হবে ভাবাটাও বোকামো। নিজের বউভাতের রান্না যেমন ইন্দুবালাকে নিজেই করতে হয়েছিল ঠিক তেমনি সাধের রান্নাটাও। গোনাগুন্তি মাছের দাগা ছিল। চাল নেওয়া হয়েছিল মাথা গুনে। শাশুড়িকে খাইয়ে, স্বামীকে খাইয়ে যখন ইন্দুবালা নিজে খেতে বসতে যাবেন দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। ওই ভরা অবস্থায় রান্নাঘর থেকে উঠে এসে সদর খুলতে হলো তাঁকেই। শ্রাবণের চড়া রোদ আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইটা তাঁরই সামনে। কতদিন পরে। চোখে তখন দিদির কপোতাক্ষের টলটলে জল। ইচ্ছামতী গাল বেয়ে গড়াচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতে বলবেন কী! ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন যেন ইন্দুবালা এতদিন পরে ভাইকে দেখে। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা। গালে কচি ঘাসের মতো দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ঠিক যেন মনিরুল সেজে দাঁড়িয়ে আছে ভাই। “ভেতরে আসতে বলবি না? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো?” ইন্দুবালা ভাইকে জড়িয়ে ধরেন। ঝুপ করে যেন তাকে ছুঁয়ে ফেলে কলাপোতার গ্রামটা। বোসদের পুকুর। তেপান্তরের ধানক্ষেত। কতবেলের আচার। আর ভাই দেখে তার দিদি আরও সুন্দর হয়েছে। গা থেকে খসে গেছে অজ গাঁয়ের পুরোনো চাদর। নতুন মা হবার যাবতীয় সব কিছু যেন গা থেকে তেড়েফুঁড়ে বের হয়ে আসছে তার। ঠিক এই সময়েতো ইন্দুবালার থাকা উচিত ছিল গ্রামে। ঠাম্মা কী খুশি হতো! উঠোন ভরে উঠতো আচারের বয়ামে। মা বিশালাক্ষ্মী তলায় পুজো দিতো। আর বাবা? সবার বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি দিয়ে বলে আসতো, “এই যে শুনছো আমার ইন্দু মা হবে। তোমরা ওকে সবাই আশীর্বাদ করো। সব যেন ঠিক মতো হয়ে যায়। নাতনির সন্তান দেখার আশায় ঠাম্মা ছিলেন না। এত সৌভাগ্য তাঁর কপালে জুটবে না সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন তাঁর এই শেষ শয্যায় মেয়েটা এসে একটু বসুক। বাবা চিঠি দিয়েছিলেন বেশ কয়েকটা। নিজেই আসতে পারতেন মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু তাঁর শরীরটা তখন ভালো নয়। ভাইটা পরীক্ষা দিচ্ছে। তার পক্ষে আসাও সম্ভব ছিল না। প্রত্যেকটা চিঠি আসার পরেই ইন্দুবালার শাশুড়ি মুখ ভার করে থাকতেন। এই বুঝি তাঁর ছেলেকে ফুসলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় বউ। কিন্তু সেই আশার আগুনে জল পড়তো বারে বারেই। ছেলে দু দিন পর পর যাও বা বাড়ি ফিরতো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত সারাদিন। শাশুড়ির তখন ছেলেকে খাওয়ানোর ধুম লেগে যেত। ইন্দুবালাকে উনুনের সামনে বসিয়ে ফিরিস্তি মতো এটা সেটা রান্না করিয়ে নিতেন। ছেলেও তখন দিন কতক ঘুমিয়ে, রাশিকৃত গিলে, পাউডার সেন্ট মেখে বউয়ের গা থেকে যেকোনো একটা গয়না খুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। সেই যে বেরোতো, টাকা না ফুরানো পর্যন্ত বাড়ি ফিরতো না। ছেলে না ফিরলে শাশুড়ির কাজও যেত কমে। একমাত্র বসে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া তখন আর তাঁর কিছু করার থাকতো না। এমনকি নাতিগুলো কী খেয়েছে না খেয়েছে সেসব দিকেও নজর থাকতো না তাঁর। ডালে চালে ফুটিয়ে চলে যেত সংসার। কোনো কোনো দিন লছমী এলে মাছ জুটতো বাচ্চাদের পাতে। এইসময় ইন্দুবালা সংসারের কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই চিঠিগুলো চোখের সামনে নিয়ে বসে থাকতেন। অক্ষরগুলোর গায়ে হাত বোলালে মানুষগুলোকে স্পর্শ করছেন বলে মনে হতো। কত কত রাত যে জেগে কাটিয়েছেন একা একা ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে, সঙ্গী থেকেছে তো এই স্মৃতিই। মনে মনে বুনে চলেছেন সেই কবে থেকে এক নক্সীকাঁথা। যতই অতীতকে গাল পাড়ুন না কেন সেই নক্সীকাঁথায় নিজেকে জড়ালে চার পাশে না থাকা মানুষগুলোর ওম পেয়েছেন ইন্দুবালা। ঠিক এখন যেমন পাচ্ছেন হট ওয়াটার ব্যাগের। এক বর্ষার ভোরে চোখে কেঁপে নামছে যেন সারা রাতের ঘুম।

ভাইকে দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন শাশুড়ি। “বলি কোন কাণ্ডজ্ঞান আছে তোমাদের? শুভ বাড়িতে অশৌচে এগোচো নাকি?” মাথা নেড়েছিল ভাই। শ্রাদ্ধ, নিয়মভঙ্গ সব কাজকর্ম মিটিয়ে তারপরে সে এসেছে। আরও বিরক্ত হয়ে বুড়ি বলেছিল “তাহলে আর কী! গেলাও কোটাও এবার ভাইকে।” খারাপ লেগেছিল ইন্দুবালার কথাটা শুনতে। ভাইয়েরও কি খারাপ লাগেনি? নিশ্চয়ই লেগেছিল। সে চলে যেতে চেয়েছিল তখনই। ইন্দুবালা বুঝিয়েছিলেন অনেক, “বয়েস হয়েছে তো। তাই এমন হয়ে গেছে মানুষটা। তুই রাগ করিস না ভাই। চট করে স্নানটা সেরে আয় দেখি”। ভাই চলে গেলে ইন্দুবালা খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই কতদূর থেকে তেতে পুড়ে এসেছে ছেলেটা। অমন ভাবে না বললেও হয়তো পারতেন শাশুড়ি। কিন্তু তিনি জানেন এই সংসারে একটা লোক বেশি খাওয়া মানে ভাঁড়ার ঘরে টান পড়া। ছেলের নেশা বেড়েছে। বাইরে মতি গতিও। কেমন যেন কঙ্কালসার হয়ে উঠছে বাড়ির চেহারাটা আস্তে আস্তে। বুড়ি সারাদিন তাই খিটখিট করেন। নিজের যা গয়না ছিল সেগুলো অনেক দিন আগেই গেছে। বউয়েরগুলো ছেলে নিচ্ছে। তাই এবার হাত পড়েছে বাসনের বাক্সে। ভারী ভারী সব গামলা, ঘড়া বিক্রি চলছে। এগুলো গেলে আর কিছু থাকবে না তাঁর আমলের। পাছে পোয়াতি বউয়ের অভুক্ত মুখটা দেখতে হয় তাই বুড়ি গিয়ে শুলো ওপরের বারান্দার ঘরে। আর এদিকে ইন্দুবালা আসন পেতে কাঁসার থালায়, বাটিতে সাজিয়ে দিলেন নিজের খাবারটুকু। পরম আদরে খাওয়ালেন ভাইকে। খুব ছোট্ট থেকেই ছেলেটা বড্ড আস্তে আস্তে খায়। তার খাওয়া নিয়েও ছিল নানান ঝামেলা। এটা খাবো না। ওটা খাবো না। মা বড় বড় দলা করে ভাতের গ্রাস গালের মধ্যে পুড়ে দিতেন। ঠাম্মা ওদিক থেকে চিৎকার করতো, “ও বউমা করো কী? মেরে ফেলবে নাকি দুধের বাচ্চাটাকে?” আর একটু বড় হলে এক থালায় ভাত নিয়ে স্কুলে যাওয়ার আগে ইন্দুবালা আর তার ভাই খেয়ে নিত। ভাইকে খাওয়াতে বড় ভালো লাগতো তাঁর। ছোটো ছোটো দাঁতগুলো আঙুলে ঠেকতেই কেমন যেন সুড়সুড় করে উঠতো হাত। সেই ভাই কী পরিপাটি করে আজ নিজে নিজেই খাচ্ছে। বসার ভঙ্গীটাও ঠিক বাবার মতো। বাবু হয়ে, সামনের দিকে মাথাটা বেশ খানিকটা ঝুঁকিয়ে। খাওয়ার সময় বাবা কথা বলতো না একটুও। ভাইও না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইন্দুবালা। যতক্ষণ না খাওয়া শেষ হয়। ভাইয়ের মধ্যে ইন্দুবালা কাকে খুঁজছিলেন সেদিন? বাবাকে? মনিরুলকে? নাকি নিজের ফেলে আসা অতীতকে? চলে যেতে চেয়েছিল ভাই সেদিনই। কলেজ স্ট্রিট। সেখান থেকে কোনো এক বন্ধুর বাড়ি। এখানে আবার তোর বন্ধু হলো কী করে?” সন্দেহ হয়েছিল ইন্দুবালার। “বল থাকতে ভালো লাগছে না দিদির বাড়ি। আদর যত্ন হচ্ছে না একটুও।” ভাই মিটিমিটি হেসেছিল। “তুইও দেখছি কলকাতার মতো কথা বলতে শিখে গেছিস দিদি”। সেদিন ভাইয়ের আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বরং বলা ভালো যেতে দেননি ভাইকে ইন্দুবালা। “একটু ঘুমিয়ে নে ভাই। তারপরে বিকেলে না হয় কলেজ স্ট্রিটের দিকে বেরোস। চিনতে পারবি তো রাস্তা”। ভাই যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ে ইন্দুবালা ঠায় বসে থাকেন তার মাথার কাছে। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করেন। অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু কিছুই জানা হয় না। একটু কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্ত ভাই। দিদির কোলের কাছে তার মাথাটা। চুলগুলো এলিয়ে পড়েছে কপালে। ঘুমিয়ে থাকা মুখের প্রশান্তি বড় ভালো লাগে ইন্দুবালার। এই প্রশান্তি কি তিনি দেখেননি স্বর্ণলতার মুখেও? পুকুরে ভাসছিল দেহটা। বউ সাজার বড় শখ ছিল তার। রিয়াজও ভালোবাসতো মেয়েটাকে খুব। স্বর্ণলতার ফুলে ওঠা দেহটাকে জল থেকে তোলা হয়েছিল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখটায়। বন্ধ করা চোখ দুটোয় ছিল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার শান্তি। ঠোঁটের কোনায় ছিল এক টুকরো হাসি। যেন জলের তলা থেকে ঘুমন্ত রাজকন্যেকে তোলা হলো এক্ষুনি। কথা ছিল রিয়াজ দাঁড়িয়ে থাকবে খেয়া ঘাটে। রাতের নৌকা তাদের পার করে দেবে সভ্য জনপদ। দূরে কোথাও তারা ভালোবাসার জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নেবে। যেখানে কেউ তাদের চেনে না। জানে না। ধর্মের পরিচয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে না। স্বর্ণলতা ঠিক পে ছৈছিল সময়েই। খেয়াও ছিল ঘাটে বাঁধা। শুধু রিয়াজ আসেনি। অনেক ভোরে আকাশ যখন সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে স্বর্ণলতা রিয়াজকে পেয়েছিল ধানক্ষেতের আলের ধারে। রিয়াজের কাছে সব কিছুই ছিল শুধু প্রাণটুকু ছাড়া। কারা যেন তার শ্বাসনালিটা কেটে দিয়েছিল এফোঁড় ওফোঁড় করে। এত রাগ ছিল তাদের রিয়াজের ওপরে, জানে মেরেও শান্তি পায়নি তারা। কুপিয়ে রেখে গিয়েছিল দেহটাকে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে স্বর্ণলতার তখন কান্নায়, দুঃখে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কোথায় লুকোবে সে? যেখানেই যাবে ভালোবাসাহীন মানুষগুলো তাকে কুরে কুরে খাবে। তাই ডুব সাঁতার দিয়েছিল সে জলে। যখন ভেসে উঠেছিল তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। জালের মধ্যে ঘুমন্ত রাজকন্যেকে দেখার জন্য আশেপাশের গাঁ থেকে ভিড় করে এসেছিল মানুষ। খবরটা প্রথমে এনেছিল মনিরুল। ইন্দুকে বলার পর ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল মেয়েটা। সেদিনও যে সৰ্বর্ণলতা স্বপ্ন দেখতো সংসারের। রিয়াজের সাথে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে কোথাও। বলেছিল চিঠি দেবে ইন্দুকে। সংসার সাজিয়ে তার খুঁটি-নাটি নিয়ে লিখবে অনেক কথা। পুণ্যি পুকুর ব্রত করতে গিয়ে বিড়বিড় করে মানত করতে স্বর্ণলতা। রিয়াজের সাথে সংসার যেন হয় তার। কেউ কথা শোনেনি মেয়েটার। এমনকি ঈশ্বরও না। এর আগে কোনোদিন মনিরুল ইন্দুকে কাঁদতে দেখেনি। যদিও প্রথম চিঠিটা ততদিনে দেওয়া হয়ে গেছে দুজনের। সেখানে ভালোবাসার কথা কোথাও লেখা ছিল না। ছিল শুধু বাংলার মাঠ ঘাট সবজেটে রঙের জীবনের কথা। ছিল এক দিন দেখা না হলে অন্যদিনের অনেক না বলা দুঃখ, মন কেমনের কথা। সেটাই কি ভালোবাসা নয়? ছটফট করে ওঠেন ইন্দুবালা। তাহলে কি এতক্ষণ ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি মনিরুলের কথাই চিন্তা করছিলেন? উঠে পড়েন। পেটের ভেতর থেকে লাথি মারছে বাচ্চাটা। যেমন খিদে পেয়েছে তার মায়ের। তেমনি তারও। রান্নাঘরে এসে দেখেন চাল বাড়ন্ত। ভাত বসাবেন তার যোগাড়টুকু নেই। এই এত বেলায় কী খাবেন? নজরে পড়লো বেতের ঝুড়ি শালপাতায় মোড়া। ভাই এনেছে। তাকে এতক্ষণ যত্ন-আত্তি করতে গিয়ে সেদিকে নজরও পড়েনি। ভুলেই গিয়েছিলেন ইন্দুবালা। শালপাতায় বাঁধা টুকরিটা খুললেন। তার মধ্যে থরে থরে সাজানো আছে মালপোয়া। চোখ ফেটে জল এলো ইন্দুবালার। গোগ্রাসে খেতে থাকলেন তিনি। যেন কত জন্মের খিদে নিয়ে দাদু ঢুকে পড়েছেন তাঁর পেটে। ঠাম্মার হাতে না হোক গাঁয়ের ভোলা ময়রার দোকানের মালপোয়া খেতে চাইছে গোটা শরীর তোলপাড় করে। অনেকটা খাওয়ার পর যখন থামলেন ইন্দুবালা তখন জলতেষ্টা পেয়েছে খুব। কিন্ত জল গড়িয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই হাতের কাছে। শুনেছিলেন ঠাম্মাকেও শেষ সময়ে জল খাওয়াতে পারেনি কেউ। গড়িয়ে পড়েছিল গালের পাশ দিয়ে সব জলটুকু। ঠিক তখনই সেই মুহর্তে বুক ছাপিয়ে, গলা কাঁপিয়ে কান্না পেলো ইন্দুবালার মৃত ঠাম্মার জন্য। পায়ের তলায় গোটা পৃথিবীটা যেন নড়ে উঠলো হঠাৎ। চোখে অন্ধকার দেখলেন। যা খেয়েছিলেন উগড়ে দিলেন সব। রান্নাঘর ভেসে গেল সাধ না-খাওয়া নতুন মায়ের বমিতে।

দরজা খোলার শব্দ পেলেন ইন্দুবালা। ধনঞ্জয় ঘর ঝাঁট দিতে এসেছে। নীচের রান্নাঘরে উনুনের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। “বাজার কিন্তু কিচ্ছুটি করা নেই মা। কী রান্না হবে?” ধনঞ্জয় জানতে চায়। ইন্দুবালা চুপ করে থাকেন। “কী গো বলল কিছু? শরীর খারাপ নাকি তোমার?” ইন্দুবালা তখন উনুনের ধোঁয়া দেখছেন। জানলার বাইরে সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠছে। বাজারের লোকেরা এসে বলেছিল, “নিমতলার ইলেকট্রিক চুল্লীতে কাজ চলছে মা। বডি কাঠে পোড়াতে হবে।” তখনও শ্মশানে স্বামীর খাট ছুঁয়ে বসে আছেন ইন্দুবালা। দূরে লছমী ছেলে-মেয়েদের সামলাচ্ছে। “তোমরা যা ভালো বোঝো করো।” এইটুকুই বলতে পেরেছিলেন তিনি। মাস্টার রতনলাল মল্লিকের দেহ যখন চিতায় তোলা হলো তখনও ইন্দুবালা আঁচ করতে পারেননি কাঠে পোড়ানোর বীভৎসতা। মনের মানুষ ছিলেন না কোনোদিনই মাস্টার। কিন্তু যে মানুষটা চারপাশে ঘুরে বেড়াতো, এদিক ওদিক থেকে যন্ত্রণা দিতে; সময় নেই অসময় নেই ঘাড়ের ওপর চেপে বসতো; জোর করে সরিয়ে দিত শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, সেই মানুষটা আগুন পাওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন চড়বড় করে উঠতে শুরু করলো তেলে পড়া মাছের মতো। শরীর ছুঁড়ে বেড়িয়ে আসতে থাকলো জল। যেন সারা জীবনের হুইস্কি, সোডা এক্ষুনি এই জ্বলন্ত সর্বগ্রাসী চিতাকে নিভিয়ে দেবে। লছমী এসে মুখ ঝামটা দিয়েছিল। “কী করছিস কি এখানে দাঁড়িয়ে তুই? আমাদের কি এসব দেখতে আছে? চল মেয়েটাকে দুধ খাওয়াবি চল। বড় কাঁদছে যে।” শ্মশানের মধ্যে বসে মেয়েকে দুধ খাওয়ালেন। স্বামীর চিতাভস্ম ভাসালেন গঙ্গায়। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসে নিজেই ভাঙলেন শাঁখা পলা সব কিছু। জোরে জোরে ইটের বাড়ি মেরে। সাবান দিয়ে মাথা ঘষে তুলে ফেললেন সিঁদুর। সাদা থান পরে নিজেকে যখন দেখলেন আয়নায় আর সামলাতে পারলেন না। হাউ হাউ করে চিৎকার করে কাঁদলেন ইন্দুবালা। সে শোক মাস্টার রতনলাল মল্লিকের জন্য নয়। মনিরুলের জন্য নয়। নিজের মুখটায় তিনি অবিকল ঠাম্মাকে দেখতে পেলেন।

ইন্দুবালা পাশ ফিরে শুয়ে ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “উনুন ধরিয়েছিস কেন? গ্যাস কি ফুরিয়েছে?” ধনঞ্জয় হাতের ঝাঁটাখানা মেঝেতে রেখে বলে “ওই দেখো। আজকের দিনটা কি ভুলে গেলে মা তুমি?” ইন্দুবালা হাতড়াতে থাকেন মনের মধ্যে। “আজকে আবার কী?” ধনঞ্জয় মাথায় হাত দিয়ে বলে “সত্যি এবার তোমার বয়েস হয়েছে মা। আজ যে রথ। কুমোরটুলিতে দুর্গার কাঠামোয় মাটি পড়বে। ইস্কনের লম্বা রথ বেরোবে। কত সাহেব সুবো নাচানাচি করবে। হোটেলের বোর্ডে তো গতকাল লিখে রেখেছো…।” উঠে পড়েন ইন্দুবালা এবার তাড়াতাড়ি করে। “কী লিখেছি রে?” ধনঞ্জয় উত্তর দেয়, “খিচুড়ি, পাঁপড় ভাজা, আনারসের চাটনি আর কাঁঠালের ক্ষীর”। বিড়বিড় করে জানতে চান ইন্দুবালা, “আর মালপোয়া? লিখিনি সেটা?” ধনঞ্জয় রে রে করে ওঠে। “না না ওইসব একদম কিছু লেখা ছিল না। হাঙ্গামা বাধিও না মা। চিনির দাম বড় বেড়েছে। আটা বাড়ন্ত। ময়দা বাড়ন্ত। গোল মরিচ আনা নেই।” ইন্দুবালা জানতে চান “আর মৌরি?” ধনঞ্জয়ের জবাবে জানা যায় সেটাও বাড়ন্ত। তাহলে সব কিছু এখনি আনতে হবে ফর্দ করে। ইন্দুবালা পাশ থেকে চশমা নেন। পেন খাতা নিয়ে বসে পড়েন ফর্দ করতে। আর একটু হলে কী মারাত্মক ভুলটাই না করতেন তিনি! মালপোয়া হবে না রথে তাও কি হয়? খাটনির বহরটার কথা একবার চিন্তা করে চিরকালের অভ্যেস মতো ধনঞ্জয় আবার কাকে যেন একটা গাল পাড়ে। সেই অদৃশ্য মানুষটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে ইন্দুবালার। যে ধনঞ্জয়ের গাল শুনেও মুখে রাটি কাটে না।

অনেক রাতে কলেজ স্ট্রিট পাড়া ঘুরে বাড়ি ফিরে আসে ভাই। হাতে তার একখানি চটি বই। তিন পাহাড়ের স্বপ্ন। “বেড়াতে যাওয়ার বই বুঝি?” ইন্দুবালা জানতে চান। ভাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। “ধুর বেড়াতে যাওয়ার বই কেন হবে? খুলে দেখলেই বুঝতে পারবি”। এগিয়ে দেয় বইটা। ইন্দুবালা অবাক হন। “কবিতা পড়িস নাকি তুই আজকাল”? ঘাড় নাড়ে ভাই। “পড়ি তো। তুই আর মনিরুলদা যেমন পড়তিস”। কথা বাড়াতে চান না ইন্দুবালা। এরপর কথা বললে আরও অনেক কথা উঠবে। সেই কথা মনের মধ্যে হাওয়ার সাথে উথাল পাথাল হলে রাতে ঘুম হবে না। এই ভরো ভরো অবস্থায় মাস্টার রতনলাল মল্লিক তখন ঘুম না আসা বউকে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন। দম বন্ধ হয়ে আসবে ইন্দুবালার। মাটিতে এখন তাই বিছানা। শরীরটাকে কোনোরকমে আড়াল করার চেষ্টা। “ওপরের ঘরে একা শুতে তোর ভয় করবে না তো?” অবাক হয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকায় ভাই। একদম মনিরুল যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ সরিয়ে নেন ইন্দুবালা। “ভয় করবে কেন? আমি তো এখন বাড়িতে একাই শুই মাঝের ঘরটায়। ঠাম্মার ঘরটা তো বন্ধই থাকে।” ইন্দুবালা জানতে চান, “ভয় করে না তোর?” ভাই বলে “ধুস…। ভয় করবে কেন? আমি কি এখনও ছোটো আছি নাকি?” ইন্দুবালা আদর করে ভাইয়ের নাক টিপে দেন। “থাক তোর আর বড় হয়ে কাজ নেই। দিদির সাথে কেমন আবার নাক ফুলিয়ে ফুলিয়ে কথা বলে।” ইন্দুবালার যখন বিয়ে হয় তখন ভাই তাঁর কাছে শুতে। জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে। কতটুকুনি ছিল তখন। মাঝে মাঝে ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যেত ঠাণ্ডায় শীত করতে বলে। উঠে দেখতেন গোটা খাট ভিজিয়ে ফেলেছে ভাই হিসি করে। সেগুলো সব আবার কাঁচতে হতো। শুকোতে হতো। ঠাম্মা মাকে বলতো, “দেখেছে বউমা আমার ইন্দু কেমন সব কিছু শিখে যাচ্ছে চটপট করে। একটা বাচ্চা মানুষ করা কি চাড়িখানি কথা দিদিভাই। মা যখন হবি বুঝবি”। ইন্দুবালা সেটা বুঝেছিলেন খুব কষ্ট করে। নিজেকে তার জন্যে তৈরী করেছিলেন আগাগোড়া। মা, ঠাম্মা শিখিয়েছিল সব হাতে ধরে। তাই এতো অভাবের সংসারেও মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি ইন্দুবালার। নতুন বউয়ের গলা পর্যন্ত শুনতে পেত না কেউ। ভাই আসায় কত দিন পরে যে এত কথা বলছেন ইন্দুবালা। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছেন তাই। “আর একদিন থেকে যা না…” মাথা নাড়ে ভাই। “নারে, এবার হবে না দিদি। কয়েক দিন পরেই পরীক্ষা। না গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আবার বাবার শরীরটাও..”। থেমে যায় ভাই। ইন্দুবালা জানেন তাঁর বাবার শরীর ভালো না। মাঝে মাঝে জ্বর হয়। কাশি হয়। মা লিখেছে কাশির সাথে রক্ত ওঠে। ভাই ঘুমিয়ে পড়ে। ইন্দুবালা টেনে নেন পাশে রাখা চটি বইখানা। কবে থেকে কবিতা পড়তে শুরু করলো তাঁর ভাই? ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’ বইটার লেখক কে যেন এক বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর কথাই বা সে জানলো কী করে? কলেজস্ট্রিটে গিয়ে একা একা কাদের সাথে যেন সে দেখা করেছে। মায়ের চিঠিতে জানতে পেরেছে ভাই আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছে নানা রাজনৈতিক কার্যকলাপে। ছোটো ছোটো দলে তারা নাকি ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে, জঙ্গলে। ভেবেছিলেন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইবেন সব। কিন্তু সময় পেলেন আর কোথায়? বইটাকে হাতে পেয়ে গন্ধ শুঁকলেন ইন্দুবালা। নতুন বইয়ের গন্ধ। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কোনো বইয়ের মুখ তিনি দেখেননি। এতবড় বাড়িতে কেবলমাত্র পাঁজি, লক্ষ্মীর পাঁচালি, নারায়ণের অষ্টোত্তর শত নাম আর গীতা ছাড়া কোনো বই নেই। কবিতার বই তো দূর অস্ত। বইটাকে একটু উলটে পালটে দেখতে ইচ্ছে করলো ইন্দুবালার। আর ঠিক তখনই ডাক পড়লো তাঁর। মাস্টার রতনলাল মল্লিক অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় অপেক্ষা করছেন যে।

ইন্দুবালার শরীর বেয়ে পেঁচিয়ে উঠছে আরও একটা শরীর। বিষধর ফণা তুলে গ্রাস করছে যেন সে। মাস্টার রতনলাল মল্লিক বিছানার ওপরে তার পোয়াতি বউটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে তখন। বন্ধ হয়ে আসছে ইন্দুবালার শ্বাস প্রশ্বাস। পেটের ভেতরে দংশিত হয়ে বাচ্চাটা যেন কেঁদে উঠছে বারে বারে। ভাই চিলেকোঠার ঘর থেকে গড়গড় পড়ে চলেছে ছোট্ট চটি বইখানা।

“ঘুমের মধ্যে শুনতে পেলাম
শঙ্খ চূড়ের কান্না
‘এ আনন্দ অসহ্য বোন;
দিসনে লো আর, আর না।‘
জেগে উঠলাম; দেখতে পেলাম
আর না দেবার সুখে
কেয়া ফুলটি ঘুমিয়ে আছে
বিষধরের বুকে।”

গলা বুজে আসছে ইন্দুবালার। কান্নায়। ঘেন্নায়। ভোররাতে উঠে ঠাণ্ডা জল মাথায় ঢালেন তিনি। একবার নয় বারবার। তারও অনেক দিন পরে ভাই যখন আর নেই, স্বামী যখন নেই, চারিদিক শূন্য খাঁ খাঁ; অনেক রাতে দরজা ধাক্কিয়ে খেতে এসেছিল কজন। তাদেরই কেউ হয়তো ভুলবশত ফেলে রেখে গিয়েছিল একটা কবিতার বই। পড়ে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা কবির নামটা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখন কলকাতায় বোমা। রাস্তায় ঘাটে মৃতদেহের সারি। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো গঙ্গায় ভাসছে লাশ হয়ে। পরের দিন অনেক রাতে ছেলেটা আবার এসেছিল এক পেট খিদে নিয়ে। হ্যাঁ সেদিনটাও ছিল রথের দিন। মনে আছে ইন্দুবালা পাঁপড় ভেজেছিলেন। হিঙের গন্ধ মাখানো খিচুড়ি হয়েছিল। আর ছিল চুসির পায়েস। প্রথম দিন ইন্দুবালার সাথে অলোকের কোনো কথা হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় দিন অনেক কথা হলো। বইয়ের প্রচ্ছদের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সে একবার নিয়ে আসবে বলেছিল। “ওই শীর্ণকায় উজ্জীবিত কবি আপনাকে দেখলে যে কী বলবেন কমরেড ইন্দুবালা, ভেবেই আমি শিহরিত হচ্ছি…। উনি সবাইকে বলেছেন কবিতা লেখো। ঢেকে ফেল শহরের প্রাচীরগুলো কবিতায়..বিপ্লবে।” অলোক ফিরে আসেনি। কবিও না। কিন্তু বইটা রয়ে গেছে এখনও তাঁর কাছে। মাঝে মাঝে বইটা খুললে অলোক ভেসে আসে। তাকে অনেক দিন না দেখলে কষ্ট পান। ইন্দুবালা।

.

তাড়াতাড়ি শিল নোড়া পেড়ে ফেলে ধনঞ্জয়। এই বেলা চাল না বেটে রাখলে বুড়ি নিজেই বাটতে শুরু করে দেবে। এই গুচ্ছের লোকের জন্য মালপোয়া বানানো কি মুখের কথা? এরই মধ্যে জলহস্তির ছানাগুলো ঘুরে গেছে। মানে সামনের হোস্টেলের ওই ছেলে মেয়েগুলো। ঠাকুমা দেওয়ালে কী লিখছে দেখতে এসেছে হুড়মুড়িয়ে। “কী গো সব পালটে দিচ্ছো নাকি? শুক্তো ভাত এই সব কিন্তু কিছু খাবো না আজকে”। ছোটো করে ছেলেদের মতো চুল ছাঁটা মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে। ধনঞ্জয়ের মনে হয় ঠাস করে গালে একটা ঠাটিয়ে থাপ্পড় দেয়। শুধু পাকা পাকা কথা। সেদিন আবার গলির মোড়টাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল মেয়েটা। দেখেছে ধনঞ্জয়। ইন্দুবালাকে বলতে এলে নিজেই ধাতানি খেয়েছিল বেশি। “কেন তুমি বিড়ি ফোঁকো না? তাও তো ওরা মনের সুখে দুটো টান দিতে পারে। আমরা কী পেয়েছি জীবনে?” ধনঞ্জয় কথা বাড়ায়নি আর। মাঝে মাঝে চিনতে পারে না ইন্দুবালাকে সে। মা যে কখন কী বলে বোঝা মুশকিল। এদের নিয়ে একটা কথা বলার জো নেই মায়ের কাছে। নিজের মনে গজগজ করে ধনঞ্জয়। বাবুই পাখির বাসার মতো চুল যে ছেলেটার সেটা আরও ধ্যাষ্টা। “কী গো? কী কী চেঞ্জ করছো দেখি?” এগিয়ে আসে সে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ইন্দুবালার কাছে। “তাই বলে কাঁঠাল ক্ষীরটা চেঞ্জ করো না প্লিজ। ওটার যে গল্পটা বলেছিলে সেটা কিন্তু আমি কালকে ফেসবুকে শেয়ার করেছি। ওখান থেকে অনেকে আসবে বলেছে খেতে”। মোটা ছেলেটা এরপর এগিয়ে আসে। খেয়ে খেয়ে একেবারে ঘাড়ে গর্দানে হয়ে গেছে। তাও থামার নাম নেই। “তোরা বড় ছটফট করিস। আগে দেখ না কী লেখে ঠাকুমা। ডিসটার্ব করিস না”। একরাশ ছেলে মেয়ে জড়ো হয় ইন্দুবালার আশেপাশে। সত্তর পেরোনো এক বুড়ি সাত সকালে ভাতের হোটেলের বোর্ডে চক দিয়ে লিখতে থাকে। খিচুড়ি, পাঁপড়ভাজা, আনারসের চাটনি, কাঁঠাল ক্ষীর তার নীচে বড় করে লেখা হয় মালপোয়া। ভিড়টা একসাথে হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে “ইয়া…”। জড়িয়ে ধরে ইন্দুবালাকে ওরা সবাই। কেউ তার মধ্যেই ফেসবুক লাইভ শুরু করে দেয়। “কাল যে আপনাদের কাঁঠাল ক্ষীরের গল্পটা বলেছিলাম আজ তার সাথে ইনক্লড হয়েছে মালপোয়া…”। গজগজ করতে করতে জোরে জোরে চাল বাটে ধনঞ্জয়। কারণ সে জানে এরপর স্নান সেরে এসে রান্নার ধুম পড়বে বুড়ির। একটা নেশার মধ্যে থাকবে সেই দুপুর পর্যন্ত। যতক্ষণ না শেষ রান্নাটুকু হয়, যতক্ষণ না শেষ মানুষটা খেয়ে চলে যায় হোটেল থেকে।

.

নতুন সাইকেল কিনেছে মনিরুল। সেটা দেখাতে এসেছিল। ইন্দু জানে এটা একটা অছিলা। আসলে তারা আজ যাবে মোক্তার পাড়ায় রথের মেলায়। মাকে কী করে বলবে সে? সাইকেল শেখাটা খুব সহজ মিথ্যের রাস্তা। ছেলে মেয়ে দুটো বাড়ছে যেন তালগাছের মতো। মায়ের মন সায় দিতে চায় না। বাবাও যে পছন্দ করে তেমনটা নয়। কিন্তু কেন কে জানে সেদিন বাবা রাজি হয়ে যায়। “যাবি তো, যা না। সামনের বারে আর একটু বড় ক্লাসে উঠলে ইন্দুকেও কিনে দেবো সাইকেল। তখন দুজনে একসাথে স্কুলে যাবি চালিয়ে”। সে সৌভাগ্য হয়নি ইন্দুবালার। তার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। স্বর্ণলতার আত্মহত্যা চোখ খুলে দিয়েছিল অনেক মায়ের। তারা কিছুতেই আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখতে চায়নি। বরং আগুনেই মেয়েকে বিসর্জন দিয়েছিল অনেকে। জ্বলে পুড়ে শেষ হয়েছিল মেয়েগুলো। কজন ইন্দুবালা হতে পেরেছিল? যাদের নিয়ে লেখা হয়েছিল খবরের কাগজে? ফেসবুকে? যাদের ঘিরে রেখেছিল অনেক অচেনা মানুষ নিজের মতো করে। সাইকেলের সামনের রডে বসতে লজ্জা করেছিল ইন্দুর। তবুও বসেছিল সে। হাওয়ার মতো উড়ছিল মনিরুলের সাইকেল কপোতাক্ষের তীর ধরে। হাতে হাত ঠেকে যাচ্ছিল দুজনের। শ্বাসে প্রশ্বাসে চরম উত্তেজনা। ওরা কাছ থেকে পাচ্ছিল দুজনের ওম। চোখ বন্ধ করেছিল ইন্দু। সে যেন কাঠের নাগরদোল্লা, ঘোড়ার দোল্লা, বুড়ির চুল, ঝাল ঘুগনি, পাঁপড় ভাজা, এইসব ছাপিয়ে মৌরির গন্ধ পাচ্ছিলো মনিরুলের গা থেকে। যে মৌরির গন্ধ পেয়েছে সে তার ঠাম্মার মালপোয়ায়। ভোলা ময়রার দোকানে। কিংবা তারও অনেক পরে রিভলবার নিয়ে খেতে আসা অলোকের কবিতার বইতে। স্নান সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ান ইন্দুবালা। কতদিন পর আজ তিনি মালপোয়া ভাজবেন! তাঁর চোখে মুখেও কি ফুটে উঠছে না এক প্রশান্তি? এটা কি মৃত্যুর বার্তাবহ? মনিরুলের মৃত মুখ তিনি দেখেননি। কিন্তু আন্দাজ করতে পারেন। শুনেছিলেন কলকাতা থেকে গোপনে ফেরত যেতে হয়েছিল তাকে। নিজের মা ছিলেন অসুস্থ। মাকে শেষবারের মতো দেখতে গিয়েছিল মনিরুল। পথে ধরা পড়ে সে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে। শেষ পর্যন্ত নাকি লড়েছিল মনিরুল বীরের মতো। একটা ছোট্ট দেশি রিভলবার দিয়ে সে জয় করে নিতে চাইছিল স্বাধীনতার সবটুকু স্বপ্ন। ঝাঁঝরা হয়েছিল তার দেহ গুলির মালায়। আরও দিন তিনেক পরে তাকে পাওয়া গিয়েছিল কপোতাক্ষের চরে। পাশে পড়েছিল তার ব্যাগখানা। তার মধ্যে ছিল হাতের নক্সা ভোলা স্বাধীন বাংলাদেশের একটা জাতীয় পতাকা। যা মনিরুলকে দিয়েছিলেন ইন্দুবালা শেষবার দেখা করার সময়। আর মনিরুল কী দিয়েছিল তাঁকে? আলমারি খোলেন ইন্দুবালা। কাঠের ছোট্ট বাক্স থেকে বের করেন বাঁশিটা। কপোতাক্ষের মাটি মেখেছিল মনিরুল সারা দেহে। স্থির দৃষ্টিতে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল তার নিষ্প্রাণ দেহটা। ঠিক ওখান থেকেই পুব আকাশের জ্বলন্ত সূর্যটা উঠবে। যার আলো ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের দিকে দিকে। যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আজ মনিরুল মৃত। আর ইন্দুবালা? কী স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি? সে কথা কেউ কোনো দিন জানতে চায়নি তাঁর কাছে। আজও না।

হইচই পড়ে গেছে গোটা অঞ্চল জুড়ে। ছেনু মিত্তির লেনে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে একেই ভিড় লেগে থাকে। আজ যেন আরও বেশি ভিড়। হাফবেলা অফিস করে কালেক্টার অফিসের কেরানিকুল চলে এসেছে খেতে। হোস্টেলের ছেলে-মেয়েগুলো হাজির হয়েছে। তার সাথে নিয়মিত বাজারের খদ্দেররাও আছে। আর আছে কিছু ফ্লাইং কাস্টমার। এর সাথে জুড়েছে রাজ্যের ফেসবুক ফ্রেণ্ডা। চারিদিকে শুধু কচিকাঁচাঁদের কলকলানি। মাথা খারাপ হবার অবস্থা ধনঞ্জয়ের। হোটেলটাও হয়েছে আজ দেখার মতো। যে যেখানে পেরেছে বসে গেছে। আর ধনঞ্জয়ের হয়েছে মুশকিল সে কোনো দিক থেকে কোনোভাবেই কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আজ যেন সব কিছুতেই তার প্রবেশ নিষেধ। ছেলে মেয়েগুলো নিজেরাই হাতে হাতে কাজ করে নিচ্ছে। কেউ জল দিচ্ছে। কেউ ক্যাশ সামলাচ্ছে। কেউ থালা পাতছে। কেউ পরিবেশন করছে। আর রান্নাঘরের দিকে তো যাওয়াই যাচ্ছে না। সেখানে আরও ভিড়। প্রায় সবাই ঝুঁকে পড়েছে তাদের মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে। সেই ছোট্ট স্ক্রিনে ফুলে ফুলে উঠেছে লাল হয়ে যাওয়া মালপোয়াগুলো। বড় ছাঁকনিতে তা সোজা চলে যাচ্ছে চিনির হালকা রসে। মৌরির গন্ধ, গোল মরিচের স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছে মেঘলা শহরের আকাশে বাতাসে। আর এসবের মধ্যে প্রশান্তি মাখা মুখ নিয়ে মালপোয়া ভেজে চলেছেন ইন্দুবালা। না এই মুহূর্তে কোনো মৃত্যুর স্মৃতি তাঁর আশেপাশে নেই। নেই খুলনা..কলাপোতা…ছেনু মিত্তির লেন। শুধু যে মানুষটি আজ উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন শিল্পী। যিনি নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মেতে উঠেছেন। তাঁর বুড়ো ডালপালাগুলো চারিদিক থেকে যেন শুষে নিচ্ছে তারুণ্যের আস্বাদ। যে স্বাদে রয়ে গেছে নতুন করে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।

চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল

কলাপোতা গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ নদ। এছাড়া চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল বিল পুকুর। সবুজ জংলা ঝোঁপের পাশে সন্ধ্যামণি ফুল। হেলেঞ্চার লতা। উঠোনের কোণ ঘেঁষে কাঠচাঁপা। পঞ্চমুখী জবা। সদরের মুখটায় শিউলি। সাদা আঁচলের মতো পড়ে থাকে ফুলগুলো। উঠোনের মাঝখানে বড় তুলসী মঞ্চ। অষ্টপ্রহরের সময় ঘুরে ঘুরে কীর্তন হয় সেখানে। বাড়ির পেছনে আছে নারকেল গাছ বেয়ে ওঠা চুইঝাল। রান্নায় এতটুকু ঝালের দরকার হলে মা টুক করে গিয়ে ছোট্ট ডাঁটি পেড়ে নিয়ে আসে। একটু ঘেঁচে ফেলে দেয় ঝোলের মধ্যে। নারকেল গাছটা সোজা রেখে এগিয়ে গেলে পুঁইয়ের মাচা। তার ডগাগুলো বর্ষার জল পেয়ে যেন আকাশের দিকে মুখ করে আছে আরও বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায়। পুঁই মাচাকে বাঁদিকে রেখে কয়েক পা হাঁটলেই কলকাতা থেকে আনা দাদুর ডালিম গাছ। তার পাশেই ঠাম্মার নিজের হাতে আদর করে বসানো গন্ধরাজ লেবু। কালনার আতা। যেন ছবির মতো আঁকা। এইরকম সাজানো গোছানো বাড়ি এই গ্রামের অনেকেরই আছে। সচ্ছল গেরস্থ হিন্দু বাড়ির ঘর দোর সাজানো এক রকমের। আবার মধ্যবিত্ত মুসলিম বাড়ির অন্দরের সাজ ভিন্ন ধরনের। হিন্দুবাড়ির চারিদিকের এমন খোলামেলা পরিবেশটা কিছুটা হলেও ঢাকা পড়তো মুসলিম বাড়িতে। ইন্দুবালার যে খুব একটা গ্রামের সেইসব বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হতো তেমনটা নয়। কিন্তু হাতে গোনা একজন দুজনের বাড়িতে নানা অছিলায় সে গিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেকেছে। ভালোলাগা কাছের মানুষদের হুট করে গিয়ে চমকে দিলে কেমন যেন একটা আনন্দ হয়। সেইরকম যে কতবার ইন্দুবালা মনিরুলের বাড়িতে গিয়ে তাকে চমকে দিয়েছে তার সংখ্যা গুনতে বসলে এই বয়সে ইন্দুবালার লজ্জা পাওয়ার কথা। দুজনের সেই নিঃশব্দ ভালোবাসার মধ্যে আর কারও না থাকুক প্রকৃতির তো সায় ছিল। না হলে কেন ইন্দুবালার এখনও মনে থাকবে মনিরুলের বাড়ির পেছনের বড় পুকুরটাকে। তার পেছনের বড় বাঁশ ঝাড়টা। তারপর আদিগন্ত ধানক্ষেত। ওখানে সন্ধ্যা নেমে আসতো। জোনাকিগুলো ঘুরে ঘুরে আলো ফোঁটাতো। যারা কোনোদিন দুজনে দুজনের সঙ্গে থাকলে না, সংসার করলো না, তাদের ভালোবাসার গল্প বয়ে বেড়ালো কত যুগ।

মনিরুলদের পুকুরপাড়ে জমাট অন্ধকারে জোনাকি দেখতে ভালোবাসতো ইন্দুবালা। সে সাধ অবশ্য বেশিদিন টেকেনি তার কপালে। ধিঙ্গি মেয়ে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, চোখ টাটাতো সবার। অচিরেই বন্ধ হলো সবকিছু। সমাজের চোখে যা যা নিষিদ্ধ, অক্ষরে অক্ষরে মানতে বাধ্য করা হলো মেয়েকে। রাতের আঁধার দেখা বন্ধ হয়ে গেল। তার মধ্যে থেকে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা জোনাকির আলোগুলোও দূরে চলে গেল। এই বয়সে মেয়েরা সংসারের জন্য একটু একটু করে তৈরী হতে থাকে। ঘরের কাজ কম্ম শেখে। স্বামীকে কীভাবে যত্ন নিতে হবে, কোনটার পরে কীসের উপাচার তা ভালোভাবে বুঝে নেয়। আর এই মেয়ে কিনা এক মুসলমান ছেলের সাথে রাতের আঁধারে পুকুর পাড়ে জোনাকি দেখবে? দাওয়ায় বসে বই পড়ার ধুম হবে? কানাকানি থেকে জানাজানি হয় গ্রামে। মুখ টেপাটিপি, হাসিও। কথাগুলো ইন্দুবালার বাড়ির লোকের কানে বেঁধে সঁচের মতো। সেই নিয়ে হুলুস্থুল কম হয় না বাড়িতে। মেয়ের জেদ পুকুর পাড়ে গিয়ে সে বসবেই। কেন বাড়ির কাজ কি সে করে না? নাকি বাবা, মা, ঠাম্মার কথা শোনে না? গ্রামের লোক যা বলবে তাই শুনতে হবে? প্রথম দিকে কঠোর শাসন চলতো। তারপর দেখা গেল মেয়ে মোটেই সুবিধের নয়। এই শাসনে আরও বেঁকে বসছে সে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে শরীরের অবস্থা কাহিল হবার যোগাড়। ঠাম্মার পরামর্শে মা আশেপাশের হিন্দু বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। যাদের বাড়িতে বড় পুকুর কিংবা ছোট্ট ডোবা কাটানো আছে। সেখানেও অন্ধকার গাঢ় হয়ে জমাট বাঁধে। জোনাকিরা মিটমিটে আলো জ্বালায়। কিন্তু সেইসব বাড়িতে তো আর মনিরুল ছিল না। তার বাঁশি ছিল না। জসীমউদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বা মীর মশাররফের ‘বিষাদ সিন্ধু’ কেউ দুলে দুলে পড়তো না। সবে কৈশোরকে পিছনে ফেলে যেতে থাকা কোনো সন্ধ্যে সজল দুটো চোখ তুলে জানতে চাইতো না, “বাড়ি যাবি না ইন্দু?” ইন্দুবালার বাড়ি যেতে এতটুকু ইচ্ছে না করলেও যেতে হতোই। হিন্দু পাড়ায় সন্ধ্যের শাঁখ বেজেছে। আর মুসলিম পাড়ায় তখন মাগরিবের নামাজ। ইন্দুবালার মন পড়ে থাকতো ওই পুকুরটার পাড়েই। অন্ধকারে জ্বলে ওঠা বিন্দু বিন্দু জোনাকির আলোয় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা মনিরুলের চোখের মাঝে। কেউ কেউ বলেছিল ঝাড়ফুঁক করো মেয়েকে। অমন ভাবে পুকুর পাড়ে কেউ বসে থাকে ভর সন্ধ্যেবেলা? তবুও ইন্দুবালা জেদ করে বেশ কিছুদিন একাই বসতেন। বাঁশ ঝাড়ে হাওয়া লেগে ঝিরঝিরে আওয়াজ হতো। দূরে বিশালাক্ষ্মী তলার মাঠ থেকে শেয়াল ডেকে উঠতো। ইন্দুবালার সেই প্রথম মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে তিনি বড্ড একা। চারপাশে কেউ নেই। হাত বাড়ালে অন্ধকারটুকু ছাড়া। সেই অন্ধকারে ইন্দুবালা প্রথম জ্ঞান হারালেন। তারপর থেকে বাড়ির বাইরে পা রাখা এক্কেবারে বন্ধ হলো। ঠাম্মা সত্যপীরের কাছে মানত করলেন। মেয়েকে সুযোগ্য পাত্রের হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত মা পালন করলেন ব্রত। বাবা মরিয়া হয়ে চিঠি লিখলেন কলকাতায়।

যখন বাড়ি থেকে বেরোনো এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেল। তখন ইন্দুবালার বারবার মনে হতো গ্রামে সবার বাড়িতে থাকলেও তাদের বাড়িতে কেন কোনো পুকুর বা ডোবা নেই? তাহলে সে তো চুপটি করে জলের পাশে একটু বসে থাকতে পারতো। এত সব কাণ্ডের পরেও মনিরুলকে ঠিক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাতো জোনাকির আলো। কারবালার যুদ্ধমুখর প্রান্তরটা কি মনিরুল তাদের পুকুর পাড়েই নামিয়ে আনতো না তখন? সাজু কি তাদের পুকুর পাড়ে এসে রূপাইয়ের খোঁজ নিতো না? অভিমান আর কষ্ট জমে উঠতো দু চোখ উজিয়ে। যদিও বাড়িতে পুকুর কেন ছিল না সেটা নিয়ে একটা গল্প সে ছোট্ট থেকে শুনে আসছে।

কিন্তু সেই গল্পে প্রবেশ করার আগে এই মুহূর্তে ইন্দুবালা কী করছেন সেটা জেনে নেওয়াটা আখ্যানের ক্ষেত্রে জরুরি। বর্ষা এবার শুধু দেরিতে নয় আষাঢ় পার করেও দেখা দিচ্ছে না। ভ্যাপসা গরমে সবার নাজেহাল দশা। সত্তর পার করা ইন্দুবালার অবস্থা আরও কষ্টের। দোতলার বারন্দায় ঠাণ্ডা মেঝের ওপরে চুপটি করে শুয়েছিলেন তিনি। অনেকক্ষণ হলো কারেন্ট নেই। হাত পাখাটাকে অভ্যাসবশত আস্তে আস্তে নাড়ছিলেন নিজের শরীরের ওপরে। তালপাতার স্নিগ্ধ হাওয়া ভালো লাগছিল তাঁর। কিছুক্ষণ আগে শেষ খদ্দের ভাত খেয়ে চলে গেছে। যা বাকি ছিল হাঁড়ি চেঁচে পুছে খাওয়ানো হয়েছে বাজারের ভিখারিদের। এমনকি কালু, ভুলু, নেলু বাজারের যে হরেক নামের বিড়াল এবং কুকুর আছে তাদেরও পাতের উচ্ছিষ্টাংশ এক জায়গায় জড়ো করে ধনঞ্জয়ের খাওয়ানো হয়ে গেছে। লছমী নিজে হাতে শুরু করেছিল এইসব। সেই প্রথা আজও দিব্য বহাল আছে। সবই ঠিক ছিল। এর সাথে যদি বাড়ির সঙ্গে একটা পুকুর থাকতো। তাহলে ঠাণ্ডা মিঠে জলের হাওয়া পাওয়া যেত এই ছেনু মিত্তির লেনেও। বেচারা ধনঞ্জয়কে তখন কর্পোরেশানের ছিরছিরে জল পড়া কলে ওই অতক্ষণ ধরে বাসন মাজতে হতো না। পুকুর ঘাটে গিয়ে মেজে ঘষে ঝকঝকে করে আনতে পারতো বাসনগুলো। পারলে দুটো ডুব দিয়ে আসতো না হয় তার সাথে। আজ অনেক ভোরে প্রচণ্ড গরমে ঘুম ভাঙার পরেই কেমন যেন বোসদের পুকুরটার কথা মনে পড়ছে তাঁর। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষকে। এমনকি শাশুড়ি যে পালা পার্বণে গঙ্গার স্নানে নিয়ে যেতেন তাও। সক্কাল হতে না হতে আজ নিজে থেকেই কেমন যেন ডুব দিয়ে স্নান করার বাসনা মনের মধ্যে জাগছিল ইন্দুবালার। কত দিন গভীর গহন জলে ডুব দেননি তিনি। এই সময় তো কপোতাক্ষের একূল-ওকূল ভাসে। গভীর রাতে জলের আওয়াজ যেন দোর পর্যন্ত এসে কলকল করে কত কথা শুনিয়ে যায়। বোসদের পুকুরের জল আরও ঘন সবুজ রঙ নিয়ে ভারী হয়ে ওঠে। পাশের ঝোঁপ থেকে অনবরত ডেকে চলে ঝিল্লি। ভিজে গায়ে বাড়ি ফিরতে স্যাঁৎ স্যাঁৎ করে ওঠে গা। ইন্দুবালার হঠাৎ আজ কেমন যেন ইচ্ছে হলো অমন বৃষ্টিভেজা ঝোপে ঢাকা মাটির রাস্তা দিয়ে স্নান করে ফিরতে। কিন্তু সে পথ কোথায় পাবেন তিনি ছেনু মিত্তির লেনে? আজ অনেক সকালে ঘুম ভেঙে তাই নীচে চলে এসেছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমেছিলেন। যেন ঘাটে নামছেন। সঙ্গে রয়েছে জল ভরে নেওয়ার ঘড়া।

“ধনঞ্জয়…ও ধনঞ্জয়…।” কোনো সাড়া পান না তিনি। মাথার ওপর দিয়ে চাদর চাপা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে সে সিঁড়ির নীচের ঘরে। আবার ডাকেন দরজার কাছটায় এসে। “ধনা, ও ধনা ওঠ না বাবা। আমাকে একটু গঙ্গা স্নান করিয়ে এনে দে।” ভোরের আধো ঘুমে ধনঞ্জয় চোখ কচলায়। ধড়মড় করে উঠে বসে। কানে ঠিক শুনছে কিনা বুঝতে পারে না। বুড়ি বলে কিনা গঙ্গায় যাবে? “বলি তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে মা? রোজ রাতে ঘিষঘিষে গা গরম থাকে তোমার। ডাক্তারের ওষুধ খাচ্ছে। তার ওপর তোমাকে নিয়ে গঙ্গা স্নানে গিয়ে আমার নিজের গঙ্গাপ্রাপ্তি হোক তাই না? তোমার ছেলেরা এসে আমাকে দুরমুশ করুক। হবে নাই।”

ধনঞ্জয় বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। যত বয়স বাড়ছে, চুল যত পাকা হচ্ছে তত মুখের বুলি ফুটছে। রেগে যান ইন্দুবালা। “ছেলেদের ভয় দেখাস তুই কোন সাহসে? তাদের আমি খাই না পরি? যেতে হবে না তোকে। আমি নিজেই যাবো।” বুড়ি এগোতে গেলে ধনঞ্জয় চিৎকার করে। “যাও না, যাও। ও বাড়ির চক্কোত্তির বউয়ের মতো শেষকালে হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকো। গুয়ে মুতে একাক্কার হও গে। সুস্থ আছে কপালে সইবে কেন?” থমকে যান ইন্দুবালা। সত্যি তো এই বয়সে একা যেতে গিয়ে একটা কাণ্ড বাধলে? ধিক ধিক করে মরা তার জীবনে সইবে না। তবু রাগ যায় না। নিজে দমে গেলেও ধনাকে ছাড়েন না তিনি। “তোকে আজ কোনো কাজ করতে হবে না ধনা। আমি নিজেই সব কিছু করবো। গায়ের কাছে একদম ঘুরঘুর করবি না। এই আমি বলে দিলাম”। ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয়। আপাতত নিশ্চিন্ত সে। বুড়ির গঙ্গা স্নান আটকাতে পেরেছে। বড় ফাড়াকেটেছে একটা। এইখানে নাকি গঙ্গার ঘাট? রিক্সা করে যাও। আবার হাঁটো। তারপর আবার রিক্সা। শুধু কি তাই? গঙ্গায় নামার আগে মায়ের একপ্রস্থ প্রণাম। “তোমর গায়ে পা দিচ্ছি মা, অপরাধ নিও না।” আবার ওঠার সময় আর এক প্রস্থ প্রণাম। তারপর ঘাটে কাপড় ছাড়ার জায়গা নেই। বুড়ি জেদ করে সেই ভিজে কাপড়ে আসবে। শুধু তাই নয় বাড়ি ফিরে আবার স্নান করবে। কিছু যদি একটা হয় তখন সামলাবে কে? এইসব বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে আবার ধনঞ্জয়।

ওদিকে ইন্দুবালা বাসি কাপড় ছেড়ে ঠিক করেন বাজারে যাবেন। একবার যখন বাইরে বেরোনোর বাই উঠেছে সেটা কাটানো মুশকিল। তার চেয়ে বাজারে গেলে মনটা শান্ত হবে। নিজে হাতে জিনিসপত্র দেখে কেনাকাটা করা যাবে। দুটো লোকের সাথে কথা বললে ভালো লাগবে। সদর খুলতেই মনে পড়ে যায় অনেক দিন পরে তিনি আজ নিজে বাজারে যাচ্ছেন। বেশ কিছু দিন হলো ধনঞ্জয় এইসব করে। হাঁটুর ব্যথায় খুব একটা নড়তে পারেন না ইন্দুবালা। কিন্তু এই তো কয়েক বছর আগেও নিজে হাতে বেছে বেছে। সবজি কিনতেন। মশলা দেখে, বেছে দরদাম করে নিয়ে আসতেন। সেগুলো পেশাই করে বাড়ি দিয়ে যাওয়ার লোক ছিল। লছমী যতদিন ছিল, মাছের ব্যাপারে ইন্দুবালাকে ভাবতেই হতো না। কিন্তু লছমী যাওয়ার পর থেকে মাছ দেখে শুনে বেছে নিতে হতো। কোথাকার কোন মাছ। কোন পুকুর, দিঘি, বিল সব ইন্দুবালার জানা চাই। না হলে রাঁধবেন কী করে? জল অনুযায়ী মাছের স্বাদ আলাদা হয় সবাই জানে সেটা। কিন্তু রান্না, সেটাও তো আলাদা হয়! শুধু কি তাই? কোথাকার বেগুন। কোথাকার লঙ্কা? কোথাকার ঢেঁড়শ জানা না থাকলে তাঁর রান্নায় মন বসে না। কুটনো কুটতে বসলে কড়াইতে ফোড়ন দিয়ে সেই ক্ষেতটাকেই যদি চোখের সামনে না দেখতে পান তাহলে রান্নায় মজা আসে না। স্বাদটাও। এইভাবেই একটু একটু করে ইন্দুবালার সাথে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল মেমারির কুমড়ো, বেলডাঙ্গার কাঁচা লঙ্কা, পুরশুড়ার আলু, বাঁকিপুরের মুসুরি, রিহান্দের রুই, লাল গোলার আড়, বাসন্তীর গলদার। বাজার করা তাঁর কাছে এক স্বপ্নের মতো। বাজার যদি ঠিক করে হয় রান্নায় তাহলে তরিজুত আসে। আর একবার হাত দিয়ে দেখে নেন ব্লাউজের ফাঁকে টাকার ব্যাগটা ঠিক নিয়েছেন কিনা।

অনেক সকালে মেসের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংশুক হীনযান ও মহাযানের তার্কিক পয়েন্টগুলো মিলিয়ে দেখছিল। ইতিহাস বইতে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের মতো ‘ঊষাকালীন মেঘমালা’ দেখার জন্য সে বেশ কয়েকদিন চেষ্টা করেছে। কিন্তু মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে গেছে তার মতো করে আর কিংশুক নিজে পাশ ফিরে শুয়ে অকাতরে ঘুমিয়ে ভাত খাওয়ার সময়ে উঠেছে। আজ কী কুক্ষণে যে এতটা গরম পড়েছে আর ঘুম ভেঙেছে সে বুঝতে পারছিল না। যাই হোক, উঠেই যখন পড়েছে তখন সে ইতিহাসের চ্যাপ্টার গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলো। সামনেই বি এ ফাইনাল। নালন্দা থেকে হস্তিনাপুর হয়ে তিব্বতে যাওয়ার আগে সে দেখলো ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের দরজা খুলে স্বয়ং ইন্দুবালা বেরিয়ে পড়লেন। হীনযান-মহাযান মধ্যপথে রইলো। কিংশুক চিৎকার করলো, “ও দিদা? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?” ইন্দুবালা হাতের ব্যাগখানা উঁচু করে দেখালেন। কিংশুক হুড়মুড় করে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে জামার বোতাম আটকাতে আটকাতে। “চলো আমিও যাবো”। ইন্দুবালা অবাক হয়ে তাকান কিংশুকের দিকে। “তুই যাবি কেন? ভোররাত থেকে তো দেখলাম পড়াশুনো করছিস। ঘরের আলো জ্বলছিল যে”। কিংশুক বলে “ধুর পড়ছিলাম কোথায়? বেজায় গরমে ঘুম আসে নাকি? তার চেয়ে বরং এটাই ভালো হলো তোমার সাথে বাজার করতে যাবো। দাও দেখি ব্যাগ দুটো”। ইন্দুবালার হাত থেকে কিংশুক ব্যাগ দুটো প্রায় ছিনিয়ে নেয়। ছেলেটাকে ভালো লাগে

ইন্দুবালার। সময় নেই অসময় নেই মেসের বারান্দা থেকে দিদা বলে হাঁক দেয়। ওদের ঘরটা ইন্দুবালার ঘরের ঠিক সামনে। রাস্তার উলটো দিকে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম না এলে ইন্দুবালা সেলাই ফোঁড়াই করেন। কিংশুক চিৎকার করে ওপারের জানলা দিয়ে। “এবার তো ঘুমোও। তোমার চোখ খারাপ হলে আমাদের উপোস করে থাকতে হবে। ধনাদার যা রান্নার হাত। গলা দিয়ে নামবে না যে”। নীচ থেকে ধনঞ্জয় কাঁইমাই করে ওদের শাপশাপান্তর করে। তার যত অভিযোগ ইন্দুবালাকে। তার জন্যেই নাকি ওই গাল টিপলে দুধ বেরোনো ছেলেগুলো তাকে হতচ্ছেদা করে। “আরও মাথায় তোলো তুমি ওদের মা। ঝেটিয়ে সব বিদেয় করবো দেখো। হা-হাভাতের দল সব”। যদিও খেতে না এলে ধনঞ্জয়ই ওদের ডেকে নিয়ে আসে। আদর করে বসিয়ে খাওয়ায়। শরীর খারাপ হলে সাতবার গিয়ে খবর নেয়। ছেলেরাও ভালোবাসে তাকে খুব। তার জর্দাটা, বিড়িটা হয়ে যায় ওই ছেলেগুলোর কল্যাণেই। তবে ছোটোখাটো খিটিমিটি লেগেই থাকে। না হলে ভালোবাসা জমবে কী করে?

“আজ কী বাজার করবে দিদা?”

“কেন? হোটেলের বোর্ড দেখিসনি?”

“দেখেছি তো। ভাত, সোনা মুগের ডাল, মোচার ঘন্ট, মাছ…। ওই দেখো…কোন মাছ লেখখানি কিন্তু”।

ইন্দুবালার সামনে দিয়ে তখন মাথায় ঝুড়ি ভর্তি কলমি শাক নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। একটা বউ। ইন্দুবালা থমকে দাঁড়ান। “ও বউ শুনছো..”। বউটা ঘুরে তাকায়। “কলমী শাক কোথায় পেলে? তোমার বাড়ির? বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছো?” বউটা হাসে। “মেয়ের বাড়ি গেছিলাম মা…। আমার তো আর পুকুর নেই…। ওর শাউড়ির বড় একটা পুকুর ছেল। তা সেই পুকুরের…”। ইন্দুবালা বলেন, “ছিল কেন বলছো? এখন আর নেই?” বউটার মাথা থেকে কিংশুক শাকের ঝুড়িটা নামাতে সাহায্য করে। হাঁপ ছাড়ে বউটা। “ডোবা হয়ে গেছে মা। এবার হয়তো ফ্যালাট উঠবে। তা মেয়ে বললো নিয়ে যাও। যে কদিন আছে”। ইন্দুবালা কলমী শাকের আঁটি তোলেন। সবুজ কচি মাথাগুলো সবাই যেন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাকের কাছে নিয়ে এসে শোঁকেন। জলের তাজা আঁশটে বুনো গন্ধ এখনও মিশে আছে ওদের ডালপালায়। কিংশুক জানতে চায় “এইভাবে বুঝি শাক চেনে? গন্ধ শুঁকে?” হাসে বউটা। “না গো না। মা আমার পুকুর চিনছে গো..”। ইন্দুবালার সামনে ভেসে ওঠে বর্ষার জলে থইথই উঠোন। ভাই বোন মিলে নাচানাচি। “আমাদের কেন পুকুর নেই ঠাম্মা?” ততক্ষণে ঠাম্মার কলমি শাক বাছা শেষ। “নিষেধ ছিল যে বংশে। পুকুর রাখা চলবে না”। “কেন নিষেধ ছিল কেন?” ইন্দুবালার প্রশ্নে ঠাম্মা জবাব দেন না। ইন্দুবালা ততক্ষণে শাকের আঁটি বেছে বেছে তোলেন ঝুড়ি থেকে। কিংশুকের পছন্দ হয় না ব্যাপারটা। শাক, লতা পাতা সে দু চক্ষে দেখতে পারে না। ওসব খাওয়ার জন্য তো গরু ছাগলরা আছেই। মানুষ কী জন্যে খেতে যাবে চারিদিকে এতো মাছ, মাংস, ডিম থাকতে। একটু বিরক্ত হয়েই বলে ওঠে সে “আজ কিন্তু কলমি শাক মেনুতে নেই দিদা।” ইন্দুবালা বিড়বিড় করেন, “নেই তো কী? হতে কতক্ষণ? দেখছিস না বাড়ির সামনে কেমন একটা আস্ত গোটা পুকুর ঝুড়ির মধ্যে করে চলে এসেছে।” কিংশুক জবাব দিতে পারে না দিদার কথায়। এই মহিলা যাই রান্না করে তাই যেন মুখে লেগে থাকে সারা জীবনের মতো। মনে মনে ঠিক করে নেয় কিংশুক কলমি শাকটা আজ না হয় সে একবার ট্রাই করে দেখবে। ইন্দুবালা প্রায় সব শাক কিনে নিয়ে খালি ঝুড়ি ফেরত দেন বউটাকে। বলে দেন “ওবেলা বাড়ি ফেরার পথে একবার ঘুরে যেও বউ। আমার বাজারে একটু সময় লাগবে”। বউটা মাথা নাড়ে। আর তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া ইন্দুবালাকে ধরতে প্রায় ম্যারাথন দৌড় দেয় কিংশুক।

ইন্দুবালার দাদুকে পিতৃস্বত্ব রাখতে দেশ ভাগ হওয়ার পরেও যেমন এপারে থেকে যেতে হয়েছিল ঠিত তেমনি তাঁর দাদুর দাদুও বাবার কথা ফেলতে পারেননি। কলকাতার পাট চুকিয়ে খুলনার কলাপোতায় যখন তিনি থাকতে শুরু করলেন তখন বর্ষাকাল। চারিদিকে উপছাপা হয়ে আছে নদীগুলো। খাল গুলো। বিলগুলো। বাড়ির মধ্যে চারিদিকে থই থই করছে জল। কোনটা পুকুর আর কোনটা উঠোন তা ঠাহর করা বেশ মুশকিল হচ্ছে। হামেশাই শোনা যাচ্ছে গ্রামে সাপের কামড়ে মৃত্যুর খবর। এদিকে যাকে বিয়ে করে এনেছেন বিশ্বম্ভর সে এক্কেবারে শহুরে মেয়ে। খাস নবদ্বীপের। সেই মেয়ে এই অজ গাঁয়ের চারিদিকে জল, সাপে কাটা এইসব দেখে প্রথম দিনই তো পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে। তার বাবা যে তার সাথে এই অবিচার করবেন কোনোদিন সে ভাবতে পারেনি। ভালো পাত্রের কি আকাল পড়েছিল জ্যোৎস্নাময়ীর জন্যে? কত কত সম্বন্ধ এসেছিল বর্ধমান, রাজশাহী, হাতিমপুর থেকে। ময়মনসিংহের এক জমিদারও এসেছিলেন। বাবা বুড়ো মানুষের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে সেই সম্বন্ধও নাকচ হলো। শেষকালে মেয়েকে গৌরীদান করবেন নাকি? যারা আসে তারা নাকচ হয়। এদিকে সম্মা রাগে শুধু ফুলে ফুলে ওঠে। তারই বয়সী এক মেয়ে বাড়িতে থাকবে ঘাড়ের ওপর? তাও কি কখনও সহ্য করা যায়? এখন চুপ করে আছে, পরে এই মেয়ে যে ফোঁস করবে না তা কে বলতে পারে? জ্যোৎস্নাময়ী থাকতো দোতলায় তার মায়ের দিকে। আর নতুন মা তার দাস-দাসী নিয়ে এক তলায়। ওপর নীচ করায় বাবার অসুবিধে হতো। হাঁপের টান ধরতো। হাঁপাতে হাঁপাতে জ্যোৎস্নাময়ীর বাবা তার মেয়ের বয়সী নতুন বউকে বোঝাতেন “ওই তো বয়েস মেয়েটার। ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিই কী করে? আর দিলেও সুপাত্রের হাতে দিতে হবে তো?” বুড়ো স্বামীর এই দ্বিচারিতা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল নতুন মাকে। মুখঝামটা দিতো যখন তখন। “মেয়েকে বিয়ে দেবেন না দোজবুড়োর সাথে অথচ নিজে বিয়ে করে এনেছেন মেয়ের বয়সী একটাকে। তা আমাকে মানুষ হিসেবে ঠাওরান? নাকি জন্তু জানোয়ার জ্ঞান করেন? রাতের সোহাগ দেখলে তো আর বাঁচতেও ইচ্ছে করে না।” চিল চিৎকারে কাক বসে না বাড়িতে। হাঁপানির টান বাড়ে জ্যোৎস্নাময়ীর বাবার। বুকে কর্পূর তেল মালিশ করে দেয় দাসী। ওপর থেকে সবই লক্ষ্য রাখে জ্যোৎস্নাময়ী। কিন্তু রাটি কাটে না সে মুখে। এক দিকে চুপ করে থাকে নিজের মতো করে। তার মা বড় শান্ত ছিল। লক্ষ্মী প্রতিমা যেন। বাড়িতে জোরে কথা বলতে পারতো না কেউ। আর অপমান বা হিংসে করা ছিল ভাবনারও অতীত। বাড়ির দরজায় এসে কেউ খালি হাতে ফিরছে কল্পনাই করতে পারতো না। সাধু সন্ত থেকে গরীব দুঃখী ভিখারি সবাইকে নিজে থেকে বসিয়ে খাওয়াতেন। দান ধ্যানে তিনি ছিলেন দরাজ হস্ত। বাড়িতে সারাক্ষণ একটা সুশ্রী ভাব বিরাজ করতো। এমন মা দুদিনের জ্বরে সেই যে চোখ বুজলেন আর খুললেন না। জ্যোৎস্নাময়ীকে এক্কেবারে একা করে দিয়ে চলে গেলেন। শোকাতুর বাবা খুব ধুমধাম করে মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তি মিটিয়ে এবার বিয়ে করে আনলেন এমন একটা মেয়েকে যার চিৎকারে বাড়িতে কাক পক্ষী পর্যন্ত বসে না। সৎ মা আর মেয়ের মুখ দেখাদেখিও হয় না। জ্যোৎস্নাময়ী এমন ছোটো মনের মানুষদের সাথে মুখোমুখি ঝগড়া দূরে থাক কথা পর্যন্ত বলেন না। তাঁর হয়ে চিৎকার করে দাসী। সৎ মা এবং মেয়ের এই বাক বিতণ্ডার খবর নবদ্বীপ অঞ্চলের কেউ জানে না তেমন নয়। “মেরেছ কলসীর কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না” গাইতে এসে বোষ্টমী পর্যন্ত দু পক্ষের মুখের ভাষা শুনে মূৰ্ছা যায়। বাবারই তখন অবস্থা হয় সঙ্গীন। এই অশান্তির আগুন কীভাবে তিনি নেভাবেন, তার হদিশ যেন আর পান না। এই ভাবেই শাঁখের করাতের মতো যখন দিন কাটছিলো তাঁর ঠিক সেই সময়ে শহরে কলেরার জন্য ভলেন্টিয়ার হয়ে এলো একদল যুবক কলকাতা থেকে। তারা গান্ধিজীর স্বদেশী ভাবনায় অনুপ্রাণিত। বিবেকানন্দের সেবা তাদের বুকে। রবীন্দ্রগানের কলি তাদের লজ। একদল উঠতি যুবকদের মধ্যে যে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তাকে হঠাৎই খুব পছন্দ হয়ে গেল জ্যোৎস্নাময়ীর বাবার। বেশ গোল গোল চোখ। চওড়া ছাতি। বুকের পাটা আছে বলেই না কলেরা রোগী দেখতে আসে। তিন কুলে একমাত্র খুলনায় পিতা ছাড়া আর কেউ নেই। ঝাড়া ঝাঁপটা হাত পা। কথায় বার্তায় নম্র, শান্ত, সদালাপী। সর্বোপরি কর্মঠ। এমন একটা ছেলেকেই যেন মনে মনে খুঁজছিলেন তিনি। দেরি করলেন না জ্যোৎস্নাময়ীর বাবা। কথা চললো তাড়াতাড়ি খুলনা আর নবদ্বীপের মধ্যে। পাকা কথা হয়ে গেলে আশ্বাস দিলেন বাবা মেয়েকে। “ভয় পাস না মা। এই জামাই আমার সোনার জামাই হবে দেখে নিস। কলকাতায় কত বড় একটা মেসে থাকে। কালীঘাটের মায়ের মন্দির তো পায়ে হাঁটা। দেখবি তোকে নিয়ে গিয়ে কেমন ট্রাম লাইনের পাশের বাড়িতে রাখে”।

জ্যোৎস্নাময়ী কোনোদিন ট্রাম দেখেনি। শুনেছে দুটো লিকলিকে লাইনের ওপর দিয়ে সেই ট্রাম কলকাতা শহরে চক্কর মারে। সাহেব সুবোরা সেই ট্রামে ওঠে। যে যার জায়গায় চলে যায়। ঠুং ঠুং করে কাঁচের চুড়ির মতো আওয়াজ হয় ট্রামে। জ্যোৎস্নাময়ী তো সেই ট্রাম লাইনের পাশের বাড়িতে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল। এদিকে তার বিয়ে হয়ে গেল বেশ ঘটা করে বোশেখের কোনো এক শুভ দিনে। ফুলশয্যার খাটে শুতে এসে জানতে পারল বিশ্বম্ভরের পরিকল্পনা। বিয়ে করে সে আপাতত বউকে রেখে যাচ্ছে বাপের বাড়ি। এই কদিন জ্যোৎস্নাময়ী একটু মানিয়ে গুছিয়ে এখানে থাকুক। কারণ মাত্র কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় যাওয়া মানে বিস্তর খরচ। একেই নতুন বউ তার ওপরে বাড়ি ভাড়া করা, সংসার নতুন করে পাতানো খুবই ঝামেলার হবে। আর তো এক মাসের মধ্যে কলকাতার পাট চুকিয়ে বিশ্বম্ভর চলে যাবে খুলনা। সেখানে তার বাবা মৃত্যু শয্যায়। ছেলেকে পাশে পেলে তিনি খুশি হবেন। ছেলের বউয়ের সেবা পাবেন। এগুলোর সাথে বাড়ির জমি জায়গাও দেখা শোনা করা যাবে। আর ডাক্তারি প্র্যাকটিসটা ঠিক ভাবে চালালে তো আর কথাই নেই, পিল পিল করে লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়াবে দরজার সামনে। যদিও কোনো দিন তেমন রোগীর ভিড় হয়নি বিশ্বম্ভরের। তবে স্বদেশী করা এক ডাক্তারকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি আশেপাশের গাঁয়ের মানুষদের। যতটা না আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ডাক্তারি করতেন বিশ্বম্ভর, তার থেকে বেশি সাহায্য হতো গরিবগুর্বো মানুষগুলোর। কিন্তু সেসব তো আরও পরের কথা। আপাতত তার সামনে যে নতুন বউটি বসে আছে। একবারের অনুরোধেই খুলে ফেলেছে মাথার ঘোমটা। সেই মেয়েটা কী ভাবছে বোঝার চেষ্টা করছে। বিশ্বম্ভর। যদিও সে দেখতে পাচ্ছে এই মুহূর্তে মেয়েটির টানা দুটো চোখ ভরে উঠেছে জলে। আর ভরবে নাই বা কেন? খুলনা জায়গাটা কেমন তার আগে ঠিক ধারণা ছিল না জ্যোৎস্নাময়ীর। ততদিনে তো সে একটা পাকাঁপোক্ত স্বপ্ন দেখে রেখেছে ট্রাম লাইনের পাশে বাসার। খোলা ছাদে রান্নাঘর। একটু দূরে কালীঘাটের মায়ের মন্দির। প্রতি অমাবস্যায় মায়ের মুখ দর্শন। পালা পাব্বনে গঙ্গায় স্নান। রথের মেলা। চড়কে জেলে পাড়ার সঙ। মাথায় আগুন জ্বলতে থাকে জ্যোৎস্নাময়ীর। কাজেই ফুলশয্যায় স্বামীর গায়ের ঘেমো গন্ধের সাথে খাটের রজনীগন্ধা কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে। মাঝরাতে দোর খুলে মেয়ে গিয়ে শোয় তার পুতুল খেলার ঘরে। নিজের মা থাকলে এমনটি কক্ষনও করতো না। দিতো অমন ছেলের মুখে নুড়ো জ্বেলে। বিয়ের আগে এক কথা। বিয়ের পরে অন্য? মা মরা মেয়ে বলে তার কোনো দাম নেই গো? কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল জ্যোৎস্নাময়ী। ভোর রাতে গা শিরশির করে উঠলে দেখেছিল ওই অত বড় পুরুষমানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে পুতুল ঘরে। কখন উঠে এসেছে খাট থেকে জানেও না সে। ভোরের আলো এসে পড়েছে বিশ্বম্ভরের মুখে। কী সুন্দর লাগছে! জ্যোৎস্নাময়ীর খুব ইচ্ছে করছিল লোকটাকে ভালোবাসতে। হালকা আলোয় ঠোঁটের ওপর, চোখের পাতায় চুমু খেতে। জ্যোৎস্নাময়ী পারেনি। তখনও মনের মধ্যে কলকাতায় না থাকতে পারার শোক উথাল পাথাল করছিল।

বিশ্বম্ভরের বাবা মারা গেলেন বিয়ের কিছু কালের মধ্যে। ছেলে শ্রাদ্ধ শান্তি করলো বউকে ছাড়াই। জেদ করে থাকলো জ্যোৎস্নাময়ী নবদ্বীপে। একটা চিঠি পাঠালেই তাকে যেতে হবে নাকি? স্বামী হয়েছে তাহলে কীসের জন্য? নিজে এসে নিয়ে যেতে পারে না? জ্যোৎস্নময়ী বাড়িতেই তার না দেখা শ্বশুরের জন্য অশৌচ পালন করলো। ঘাটের দিন নখ কাটলো বাড়ির মধ্যে পাঁচিল ঘেরা পুকুর পাড়ে বসে। পুরোহিত এসে জল দেওয়ালো শ্বশুরকে। ব্রাহ্মণ খেলো। নিয়মভঙ্গের দিন অশৌচ কাটাতে জলঙ্গীতে গেলো বাড়ির পালকি জ্যোৎস্নাময়ীকে স্নান করাতে। বর্ষার জলঙ্গী তখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। পালকি শুন্ধু জ্যোৎস্নময়ীকে জলে চোবানো হলো। এমন শীতল জলে এর আগে কোনোদিন সে স্নান করেনি। আর এইভাবে পালকির ঘেরাটোপের মধ্যেও না। তার যেন মনে হলো জলঙ্গীর জলরাশির প্রবল চাপে এক অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে পালকিটা। চোখ খোলার চেষ্টা করলো জ্যোৎস্নাময়ী। আর ঠিক তখনই যেন সে দেখতে পেল বিশ্বম্ভরের শান্ত মুখটা। শিরশির করে উঠলো গা জ্যোৎস্নাময়ীর। এমন শিরশির করেছিল সেই ভোর রাতেও। যখন দুটো শক্ত হাত তাকে পরম মমতায়, ভালোবাসায় জড়িয়ে শুয়েছিল পুতুল ঘরে। একটা দেহের ওম যেন আরও একটা দেহ স্পর্শ করছিল। ঘাড়ের কাছে ঘন নিশ্বাসের হলকা লাগছিল যেন জ্যোৎস্নাময়ীর। এইসব সাত পাঁচ ভাবছেন যখন তিনি ঠিক সেই সময়ে সারা গা বেয়ে যেন কীসব উঠতে থাকে। চিড়বিড় করতে থাকে তারা গোটা গা জুড়ে। মনে হয় কারা যেন আঙুল বোলাচ্ছে তার গায়ে। প্রচণ্ড ভয়ে পালকির ভেতরের অন্ধকারে জলের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে যেন তার। চিৎকার করে ওঠে জ্যোৎস্নাময়ী। পালকির বেহারারা বুঝতে পারে পুণ্যস্নান হয়েছে বটে মেয়ের। তারা আবার ডাক ছাড়তে ছাড়তে ঘাট পেরোয়, মাঠ পেরোয়। আর এদিকে দিনের আলোতে জ্যোৎস্নাময়ী দেখে তার পালকির মেঝেতে, কাপড়ের কোঁচড়ে, শাড়ির আঁচলে জাপটে জড়িয়ে আছে চিংড়ি মাছের ঝাঁক। কোনোটা নড়ছে। কোনোটা অল্প জলেই পালকির কাঠের মেঝেতে খাবি খাচ্ছে। ভয়টা কেটে যাচ্ছে জ্যোৎস্নাময়ীর। তাহলে এরাই এতক্ষণ গায়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। চিড়বিড় করছিল? কী যেন এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠছে তার। কুড়িয়ে বাড়িয়ে আঁচল ভর্তি করছে সে। একটাও চিংড়িও যেন নষ্ট না হয়।

বাড়ি ফিরে দাসীর হাতে আঁচল ভরা চিংড়ি দিয়ে জ্যোৎস্নাময়ী হুকুম দেয়, “দোতলায় মায়ের আমিষের রান্নাঘরটার দোর খোল। পরিষ্কার কর। আমি রান্না করবো”। দাসী যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে কী মেয়েটা! আজ শ্বশুরের তেল ছোঁওয়ানি। বাইরে থেকে বামুনরা এসে বসে আছে। মেয়ে পায়ে তেল চুঁইয়ে গেছে জলঙ্গীতে ডুব দিতে। ফিরে এসে পাতে তুলে দেবে ইলিশ মাছ ভাপা। গরম ভাত। মাছের ডিমের বড়া। এই যে এত রান্না করলো ঠাকুর। বিরক্ত হয় জ্যোৎস্নাময়ী। “উনুনটা নিকো দেখি। আমি চট করে কাপড়টা ছেড়ে আসি”। দাসীর মুখে আর কথা সরে না। যে মেয়ে খায় না দায় না বাড়ির কারো সাথে কথাটি ঠিক করে বলে না সেই মেয়ে উনুন নিকানোর কথা বলছে কেন? আঁচল ভর্তি চিংড়ি মাছও বা কোথায় পেলো? দাসী সময় নষ্ট করে না। রান্নাঘর পরিষ্কার করে। উনুন ধরিয়ে বসে থাকে। জ্যোৎস্নাময়ী নতুন একটা তাঁতের শাড়ি ভেঙে, আলতা পরে, কপালে সিঁদুর দিয়ে রান্না ঘরে ঢোকে। দাসীর মনে হয় যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা এসে ঢুকলেন রান্নাঘরে। তার যেন গড় হয়ে পেন্নাম করতে ইচ্ছে হলো।

এই রান্নাঘর ব্যবহার হয় না মোটেই। জ্যোৎস্নাময়ীর মায়ের রান্নাঘর। মা মারা যাবার পর এই রান্নাঘরের পাট উঠছে বাড়িতে নতুন মা আসার পর থেকে। তাও সেটা অনেক দিন তো হলোই। তাই জিনিসপত্র বাড়ন্ত। এই অবেলায় কোথায় বা আর কিছু খুঁজতে যাবে সে? চট করে তাকিয়ে নেয় চারপাশটা। কী আছে আর কী নেই এর হিসেবটা পরিষ্কার হয়ে যায় নিজের কাছে। দাসী সেই কচি চিংড়িগুলোতে ততক্ষণে মাখিয়ে রেখেছে নুন, হলুদ। জ্যোৎস্নাময়ী লোহার কড়াই উনুনের আঁচে বসায়। অল্প তেলে চিংড়িগুলোকে ছেড়ে দেয়। একটু নেড়ে চেড়ে কাঁচা লঙ্কা আর কালো জিরের ফোড়ন দিয়ে জল ঢালে। জলঙ্গীর কচি চিংড়ির গা থেকে বেরোতে থাকে মিষ্টি জলের রস। গোটা বাড়ি কালো জিরের ফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা আর হলুদের সুবাসে ভরে যায়। জ্যোৎস্নাময়ীর বাবা ব্রাহ্মণ বিদায় দিয়ে সবে ছোটোপক্ষের রান্নাঘরের পিঁড়েতে বসতে যাচ্ছিলেন দুপুরের আহার সারতে। কিন্তু তা আর হলো না। পঞ্চ দেবতাকে স্মরণ করে প্রথম গ্রাস মুখে তোলার আগেই উঠে এলেন দোতলায় অনেক দিনের বন্ধ রান্নাঘরের সামনে। জ্যোৎস্নাময়ী আন্দাজ করেছিল এমনটাই হবে। আসন পেতে জলের গ্লাস নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেদিন তার বাবা, মায়ের রান্নাঘরে কতদিন পরে খেতে বসলো। মনে পড়লো বড় বউয়ের কথা। তার হাতে

চিংড়ির হলুদ গালা ঝোলের সুবাস। হাপুস হুপুস করে বাবা ভাত খায়। ঝোলের কাঁচা লঙ্কা ডলে। চোখ দিয়ে জল পড়ে তার। সেটা বড় বউয়ের স্মৃতিতে নাকি অনেক দিন পরে পুরোনো রান্না খাওয়ার আনন্দে বোঝা যায় না ঠিক। খাওয়া শেষ হলে পান এগিয়ে দেয় জ্যোৎস্নাময়ী। বাবা মেয়েকে আশীর্বাদ করেন। “কী চাস মা? একবার মুখ ফুটে বল”। সারা বাড়ি কানাকানি হয়। এই বুঝি মেয়ে তার নিজের নামে সব সম্পত্তি চেয়ে নিল। খাওয়া ছেড়ে অন্দরের দোরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে ছোটো মা ভয়ে ভয়ে। জ্যোৎস্নাময়ী অস্কুটে তার বাবাকে বলে, “একবার চিঠি লিখুন কলাপোতায়। তিনি যেন আমাকে এসে নিয়ে যান”। কথাগুলো বলেই জ্যোৎস্নাময়ী লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় ঝোলের চিংড়িগুলোর মতোই। মেয়ে বাড়ি লিখিয়ে নিলো না। জমি জমা সম্পত্তি কিছুটা না। এমনকি শখের পুতুলগুলোও না। শুধু গরুর গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে গেলো মায়ের রান্নাঘর। ডেয়য়া, ঢাকনা, খুন্তি। আর সেই আমিষের বড় লোহার কড়াইটা। বিশ্বম্ভর বাধা দেয়নি। সে জানতো নতুন সংসার করতে তার সবটাই লাগবে। কোনো কিছুই ফেলা যাবে না।

“এই এত কলমী শাক কী হবে দিদা?” সকালের চড়া রোদে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে কিংশুক। “কলমী ভাজা। কলমী শুক্ত। কলমী চাটনী?” ফিরে তাকান ইন্দুবালা। “একদম শাক তরি-তরকারি না খেয়ে তোদের বুদ্ধির এই অবস্থা হয়েছে। আর শরীরগুলো তো লিকলিকে ঢ্যাঙা গাছ। করে দেবোখন রান্না। একটু কাসুন্দি দিয়ে খাস। দুবারের বেশি চেয়ে খেতে হবে তখন”। ইন্দুবালা এগিয়ে যান তড়বড় করে মাছের বাজারটার দিকে। “এই যে ঘনা… ওই চিংড়ি গুলো কি তোর বিক্রি হয়ে গেছে?” ঘনা অনেক দিন পরে দেখলো ইন্দুবালাকে। “সেকি গো মা তুমি আজ বাজারে? ধনাদার কী হলো আজ?” ইন্দুবালা চিংড়িগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে বলেন “কিচ্ছু হয়নি তার। কী আবার হবে? কেন আমি এসেছি ভালো লাগছে না তোর?” ঘনা চা আনতে পাঠায়। “নিয়ে যাও মা সবটা। ভেড়ির নয়কো”। ইন্দুবালা চেনে। কোনটা ভেড়ির চিংড়ি। আর কোনটা নদীর। সক্কাল বেলা একটা বড় গামছা নিয়ে ভাই বোনে চুপি চুপি চলে যেতেন কপোতাক্ষের ঘাটে। ততক্ষণে জড়ো হয়েছে গ্রামের অন্যসব ছেলে মেয়েরাও। ওদিকে আকাশ আসছে কালো হয়ে। ফুঁসে ফুঁসে উঠছে সেই কবেকার দাঁড়াও পথিকবরের নদ। গামছা জলে ফেললেই উঠছে ঝাঁকের চিংড়িগুলো। হাতে করে একটা জ্যান্ত চিংড়ি তুলে মুখের সামনে ধরেন কিংশুকের। “কেমন এখনও নড়ছে দেখেছিস?” কিংশুক ভয়ে দুপা পিছিয়ে আসে। এমনিতে সে বড় পেটুক। খাবার পেলে আর কিছু চায় না। কিন্তু এইসব শাক সবজি মাছ সে বরাবর দেখে এসেছে মরা। জ্যান্ত জিনিস যে এমন হতে পারে সেই অভিজ্ঞতা তার এই ছাত্র জীবনের বাইরে। “এই ছোটো চিংড়ি দিয়ে বুঝি মালাইকারি হবে?” ইন্দুবালা বলেন, “তোর মুণ্ডু। কেমন হলুদ গালা ঝোল করে দেবো দেখিস”। কিংশুক মাথা নাড়ে। “ঠিক হচ্ছে না কিন্তু দিদা। বোর্ডে এইসবের কথা লেখা ছিল না মোটেই”। ইন্দুবালা বলেন, “কেন মাছের কথা লেখা ছিল। এই তো হয়ে গেল। চিংড়ি মাছ নিলাম”। কিংশুক মাথা চুলকোয়। “চিংড়ি আবার মাছ কোথায়? বইতে লেখা আছে ওগুলো জলের পোকা”। অনেক দিন পরে যেন ইন্দুবালা একটু হা হা করে হাসেন। বাজারের লোজন পাশে জড়ো হয়। “কী হয়েছে মা হাসো কেন?” ইন্দুবালা মাথা নাড়েন। “কিচ্ছু না। তোমরা তাড়াতাড়ি খেতে এসো সবাই”। ফেরার পথে একবার ইন্দুবালা দাঁড়িয়েছিলেন কাশী মুদির দোকানে কালো জিরে কিনতে। বোর্ডটা কিংশুককে দিয়ে মুছিয়ে লেখালেন ভাত, কলমী শাক, চিংড়িমাছের হলুদ গালা ঝোল, বেগুনের টক। অনেক দিন পর বাজার করে এসে প্রসন্ন চিত্তে স্নান করতে গেলেন ইন্দুবালা কর্পোরেশানের তোলা জলে। গায়ে জল পড়তেই পুকুরের ভাবনাটা আবার মাথায় চাগাড় দিতে শুরু করলো। বাড়ির পেছনের বাগানটার সাথে এই বাড়িতেও যদি একটা পুকুর থাকতো? কী ভালো হতো, তাই না? এই একটা ব্যাপার শাশুড়িকে বলার পর মুখ ঝামটা খেতে হয়নি। বাড়ির সেই সময়কার আত্মীয়রা মশকরা করতে এলে শাশুড়ি মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, “ঠিকই তো বলেছে বউ পুকুর থাকলে কত সুবিধে হতো বল দেখি। নিজের জল বলেও তো কিছু একটা থাকতো। তা ও বউ তোমাদের গ্রামের বাড়িতে কি পুকুর আছে?” উত্তর দিতে পারতেন না ইন্দুবালা। তিনি জানেন নেই বললেই তার শাশুড়ি মস্করা করতে ছাড়বেন না। আর মিথ্যে কথাও এই বুড়ো মানুষটাকে বলা যায় না। সন্ধ্যে দেবার অছিলায় উঠে পড়তেন তিনি। কথা আর এগিয়ে যাওয়ার পথ পেতো না।

জ্যোৎস্নাময়ীর কোনো ছবি ইন্দুবালা দেখেননি। একমাত্র ফ্রেমে বাঁধানো উঁইয়ে কাটা আলতা রাঙানো পায়ের দুটো ছাপ ছাড়া। ঠাম্মা সেখানেই চন্দন দিতো। সন্ধ্যে দেখাতো। তার শাশুড়ি শিখিয়ে দিয়েছিল নাকি এইসব। আর মাঝে মাঝে সেই লোহার কড়াই সিন্দুক থেকে বেরোলে গল্প হতো জ্যোৎস্নাময়ীর। “কই রে ইন্দু, নিয়ে আয় হলুদের কৌটোটা”। ঠাম্মা হাঁক পাড়ে। বেলা যে অনেক হলো। ভাইকে পাঠায় পাশে ভবেশদের বাড়িতে কাঁচা লঙ্কা আনতে। ইন্দুবালারা গামছা দিয়ে যে চিংড়ি ধরেছে সেগুলো দিয়ে আজ ঠাম্মা রান্না করছে চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল। “কিন্তু এই গল্পের সাথে বাড়িতে পুকুর না থাকার কী সম্পর্ক?” প্রশ্ন করেন ইন্দুবালা। “দাও দেখি আমি একটু নাড়ি ঝোলটাকে”। ইন্দুবালা ঠাম্মার হাত থেকে খুন্তিটা নিয়ে নাড়তে থাকে এদিক থেকে ওদিকে। চিংড়িগুলো সেই হলুদ ছোপা ঝোলে কেমন যেন ডুব সাঁতার দিতে দিতে ভেসে ওঠে। ওই দেখো না সন্ধ্যারা কী সুন্দর বাড়ির পুকুরেই জারিয়ে রাখে মশারির জালে চিংড়িগুলো। মনিরুল তো আরও বুদ্ধি করে পাটকাঠি দিয়ে সরজাল করে। অল্প অল্প করে পুকুরের মধ্যেই জমায় মাছগুলো। তারপর একদিন চিংড়ি খাওয়ার মোচ্ছব হয়। আর তুমি কিনা মাটির হাঁড়িতে জারিয়ে রাখতে বলো চিংড়িগুলোকে। ওইটুকু হাঁড়িতে আর কতটুকুই বা ধরে?”

একদম ভালো লাগে না ইন্দুবালার। বোসদের মতো যদি তাদেরও একটা পুকুর থাকতো। নয়তো বুনুদের মতো অন্তত একটা ডোবা। কী মজাই হতো তাহলে! টগবগ করে ফুটতে থাকা ঝোলে আরও দুটো লংকা দিয়ে ঢাকনা দেয় ঠাম্মা। পুকুর নেই বলে তার নাতনির বড় দুঃখ। তারও যে ছিল না তেমনটা তো নয়। পুকুর হলো গেরস্থের লক্ষ্মী। মাছটা শাকটা জলটা তা থেকে যেমন পাওয়া যায় ঠিক তেমনি কাজে লাগে চাপড়া ষষ্ঠীতে কাঁঠালপাতায় সিন্নি ভাসাতে। ইতু পুজোয় ঘট বিসর্জন দিতে। বাস্তু পুজোয় জল পুজো করতে। বিয়েতে জল সইতে একটা নিজের পুকুর থাকবে না তাও কী হয়? কিন্তু ওই যে অদৃষ্ট। “যাও তোমার কাছে আর কোনো গল্প শুনবো না”। চিৎকার করে ইন্দুবালা। তার ভাইও ঠাম্মার আঁচল ধরে বলে, “দিদি কাঁদছে ঠাম্মা। বলো না পুকুরের গল্পটা”।

জ্যোৎস্নাময়ীও কাঁদতো সারাক্ষণ। এই নদী নালার দেশে বর্ষাকালে সংসার পাততে এসে চোখের জলে নাকের জলে হচ্ছিল সে। নবদ্বীপে ছিল বাবার পাকা বাড়ি। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। আর খুলনার অজ গাঁ কলাপোতাতে শ্বশুরের মাটির বাড়ি। মাটির দাওয়া। উঠোন ভর্তি পাশের বাড়ির পুকুরের জল। সাপে কামড়ানোর সব ভয়ানক গল্প। লক্ষ জেলে কোনোরকমে রান্না করে জ্যোৎস্নাময়ী। সন্ধ্যে হতে না হতেই বেড়ার দিকে উঠোনের শেষভাগে কাদের যেন চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। “ওরা কি সব ভূত, প্রেত অশরীরী? পাশের বাড়ির বিধবা বউ রাধারানী এসে বলে যায়, “মোটেই না ওগুলো সব শেয়াল। সন্ধ্যে হতেই খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। সাবধানে থেকো বউ, ওরা পারলে মানুষ তুলে নিয়ে যায়”। আঁতকে ওঠেন জ্যোৎস্নাময়ী। বিশ্বম্ভর অনেক রাতে রোগী দেখে একা একা বাড়ি ফেরে। তার যদি কিছু হয়ে যায়? শেয়ালে যদি ধরে? সাপে যদি ছোবল মারে! চিন্তায় চিন্তায় কেমন যেন শুকিয়ে যেতে থাকে জ্যোৎস্নাময়ী। এইদিকে বর্ষা গিয়ে শরৎ আসে। শরৎ গিয়ে হেমন্ত। শরীর ঠিক হয় না তার। গাঁয়ের লোক বলে হাওয়া লেগেছে বউয়ের। পীরের কাছে যাও। বিশালাক্ষ্মী তলায় মাঝে মাঝে আসে কত পীর। কত সাধু সন্ন্যাসী। এদের একটুও বিশ্বাস করে না বিশ্বম্ভর। যত বুজরুকি। কিন্তু জ্যোৎস্নাময়ীর মন চায় একবার অন্তত যাক সে। এতদিনে পেটেও তো এলো না কোনো সন্তান। কেন? কোন কারণে? এর মধ্যে গ্রামে এলো এক জল বাবা। কতশত পাহাড় ডিঙিয়ে। অনেক মন্ত্র তন্ত্র পড়ে। সে নাকি জলে মুখের ছায়া দেখে সব বলে দিতে পারে। রাধারানীই দিলো খবরটা জ্যোৎস্নাময়ীকে। তাজ্জব সব কথা বলে নাকি লোকটা। দরকার পড়লে বাঘে গরুতেও এক ঘাটে জল খাওয়াতে পারে। একদিন বিশ্বম্ভর যখন সদরে গেছে ওষুধ কিনতে জ্যোৎস্নাময়ী পাশের বাড়ির রাধারানীর সাথে বেরিয়ে পড়লো। বিশালাক্ষ্মী তলায় সেদিন ভিড় ছিল কম। বেদীর ওপর বসে এক ভিন দেশের সাধু। তিনি অনেকক্ষণ ধরে জ্যোৎস্নাময়ীকে দেখলেন। পেতলের সরার মধ্যে জল নিয়ে এগিয়ে পিছিয়ে মুখাবয়ব দেখলেন। আর তাকে চমকে দিয়ে নানা রকমের কথা বলতে শুরু করলেন। যেমন তার মায়ের মৃত্যুর আগের দিন পুকুর পাড়ে নারকেল গাছে বাজ পড়েছিল। জ্বলে গিয়েছিল গাছটা। দিনটা ছিল সোমবার। এটা একমাত্র জ্যোৎস্নাময়ী ছাড়া এই গ্রামের কারও জানার কথা নয়। এমনকি রাধারানীকেও সে কোনোদিন গল্প করেনি। সাধু ভুরু নাচিয়ে বলে, “নদীতে স্নান করার সময় গায়ে উঠেছিল চিংড়ি”। আঁতকে ওঠে জ্যোৎস্নাময়ী। সব সত্যি যে! সাধু জানতে চায়, “বল কী দিবি? নিদান বলে দেবো। সব বিপদ কেটে যাবে”। জ্যোৎস্নাময়ী হাতের বালা খুলে দিয়েছিল। সাধু খুশি হয়ে বলেছিল “তোর বাড়ির চারপাশে

ঘুরে বেড়াচ্ছে উপছায়া। পাপ। বাড়িতে একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার কর যাতে অন্য নতুন প্রাণ আসতে পারে”। এই নতুন প্রাণটা কী হতে পারে সেটা বুঝতে পারে না জ্যোৎস্নাময়ী। স্বামীকে বলা যায় না। যদি শোনেন সাধু সন্তের কাছে যেতে শুরু করেছে তার বউ তাহলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। রাধারানী একদিন দুপুরে পান খেতে এসে বুদ্ধি দেয়। “যদি বউ বাড়িতে একটা নতুন ডোবা করিস। সেটাও তো একটা নতুন কিছু করা হয়। জল তো প্রাণ তাই না?” বুদ্ধিটা ফেলতে পারে না জ্যোৎস্নাময়ী। স্বামীকে বলে। অন্যের পুকুরে যেতে তার বড় সমস্যা। কেমন লজ্জা লজ্জা করে। নিজের বাড়িতে যদি একটা পুকুর থাকতো। নিদেনপক্ষে একটা ডোবা। বিশ্বম্ভর রাজি হয়ে যায়। তারও অনেক দিনের শখ নিজের বাড়িতে একটা পুকুরের। জলাশয় শুভর প্রতীক। কল্যাণকর। পুকুর কাটানোর দিনক্ষণ দেখা হয়। সে মহা ঝক্কির ব্যাপার। এতসব জানতো না জ্যোৎস্নাময়ী। ভূমিকে পুজো করে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ নিয়ে প্রথম মাটি কাটা হয়। এক দিনেই অনেকটা মাটি গোল করে কেটে ফেলে লোকজন। বাড়ির চারপাশটা যেন মেলার মতো মনে হয়। কত লোক দেখতে আসে পুকুর কাটা। সেদিন হঠাৎ রাতে বৃষ্টি নামে। কড়কড় করে বাজ পড়ে। আর সে কী ঝড়! অনেক ভোরে জ্যোৎস্নাময়ীর ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে দেখে বিশ্বম্ভর অকাতরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ যেন তার মনে হয় জলের কল কল আওয়াজ। প্রথম দিনের পুকুর কাটাতেই জল ভর্তি হয়ে গেল নাকি? জল দেখতে উঠে পড়ে জ্যোৎস্নাময়ী। আধ খোঁড়া পুকুরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। কোথায় জল? শুকনো খটখটে মাটি। আর সেই হাঁ করা বিশাল মাটির গর্তে পড়ে আছে সাদা থান পড়া পাশের বাড়ির বিধবা বউ রাধারানী। যার মুখের এক দিকটা খুবলে নিয়ে গেছে শেয়াল। বাতাস ভারী হতে থাকে। ফিসফিস করে যেন কারা কথা বলে চারপাশে। পেছন ফিরতেই জ্যোৎস্নাময়ী দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কবেকার মরে যাওয়া তার মৃত মা। “জানতিস না খুকু মরার আগে যে একটুও জল পাইনি আমি” আঁতকে ওঠে জ্যোৎস্নাময়ী। চোখ মেলে দেখে ঘুমোচ্ছিল সে। পাশে বিশ্বম্ভর নেই। বীভৎস স্বপ্নের রেশ নিয়ে দালানে এসে বুঝতে পারে কাজ বন্ধ রেখেছে মাটি কাটাইয়ের লোকেরা। পাশের বাড়ি থেকে কান্নার সুর ভেসে আসছে। বিধবা রাধারানী হঠাৎই ভোরবেলায় মারা গেছে ভেদ বমিতে। পুকুর কাটানো বন্ধ করে দিল বিশ্বম্ভরের গাঁয়ের লোকজন। বাধা পড়েছে কাজে। মাটি কাটার লোকগুলোও ফিরে গেল। তারও অনেক পরে বাড়ির পুব দিকে বিশ্বম্ভর একটা

কুয়ো খনন করেছিল। ততদিনে অবশ্য তার ছেলে মেয়েতে সংসার ভরে উঠেছে। এই গ্রামে সেই প্রথম কুয়ো। যে কুয়োতে ইন্দুবালার ভাই একটা কচ্ছপ পুষেছিল। নাম রেখেছিল কুমড়ো। ওপর থেকে মুড়ি দিলে কুমড়ো ভেসে উঠতো। ছোট্ট হাঁ করে জলে ভেজা মুড়িগুলো গিলে গিলে খেতো। ঠাম্মার কূর্ম অবতারের গল্প হয়তো মনে ছিল তার। সবাই আজ একটু তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আসে। বাবা, ইন্দু, ভাই। মাকেও খেতে বসে যেতে বলে ঠাম্মা। গরম ভাতের সাথে আজ যে শুধু চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল সেই কবেকার গল্প হয়ে যাওয়া জ্যোৎস্নাময়ীর লোহার কড়ায়। লোহার কড়াই ইন্দুবালার হোটেলেও আছে। কিন্তু জ্যোৎস্নাময়ীর মায়ের কড়াইয়ের মতো নয়। তিনি যদি তার মায়ের সব বাসনগুলো নিয়ে আসতে পারেন তাহলে ইন্দুবালাই বা পারবেন না কেন? লছমী তার চোখ গোল্লা পাকিয়ে বলেছিল “হাঁ ঠিকই তো লিয়ে আসলি না কেন ওইগুলা?” ইন্দুবালা হাসেন। “তখন কী করে জানবো এই এত্ত বড় ভাতের হোটেল হবে আমার?” লছমী বলে “এক মাছওয়ালী বন্ধু হবে”। “তিন তিনটে ছেলে মেয়ে নিয়ে অকালে বিধবা হব? আর কখনও কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। এমনকি বাপের বাড়িও না”। থম মেরে বসে থাকেন ইন্দুবালা। কিন্তু আজ লছমীও বা কোথায়? তাঁর চারপাশে কেউ কোত্থাও নেই। আর যখনই মনে হয় কেউ নেই, তখন যেন আর শরীর চলে না ইন্দুবালার। কিন্তু ইন্দুবালার একজন ওপরওয়ালা আছেন। তিনি বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে বেড়ান। গরম তেলের ওপর কালো জিরের ফোড়ন পড়তেই চড়বড় করে ওঠেন। রান্নার নানা রকমের সুবাস পাঠিয়ে লোক জড়ো করেন। ইন্দুবালার তখন আর একা থাকা হয় না। কিংশুক হোস্টেল উজিয়ে ছেলে মেয়ের দলকে তো নিয়ে এসেছেই, চিংড়ি মাছের হলুদ গালা ঝোল খেতে সেই কতদূর থেকে ডাক্তার হোস্টেলের ছেলে-মেয়েগুলোও আজ এসেছে। তাদের মধ্যে কলমী শাক বিক্রি করা বউটাও আছে। কাসুন্দি দিয়ে কলমি শাক মাখার সময় ইন্দুবালা তার চোখে জল দেখেছেন। আহা ওরও পুকুরের শখ ছিল গো ঠিক ইন্দুবালার মতোই। ওর যেন একটা বড় পুকুর হয় এই মনস্কামনা করার সাথে সাথে মেঘ ডেকে উঠলো। মুষল ধারায় বৃষ্টি নামলো। রেডিওতে এক ছোকরা জকি দু কলি গান শুনিয়ে বললো অবশেষে বর্ষা নামলো শহরে। ইন্দুবালা বিকেলের উঠোনে ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজলেন। মনে হলো তাঁর সাথে যেন ভিজছে গ্রামের ভিটেখানাও। ভিজছে পুঁইয়ের মাচা, ডালিম গাছ, গন্ধরাজ লেবু, কালনার আতা, নারকেল গাছে জড়িয়ে ওঠা চুইঝাল। এখনও সেখানে জল থৈ থৈ করে কিনা কে জানে! গামছা দিয়ে কেউ কি আর চিংড়ি মাছ ধরে? তার হলুদ ঝোল হয়? বৃষ্টির জলে যেন ডুব দিতে থাকেন ইন্দুবালা অনবরত। মনে মনে প্রার্থনা করেন এই ডুবের যেন শেষ না হয় ঠাকুর, কোনো দিন শেষ না হয়।

চন্দ্রপুলি

ধনঞ্জয় বাজার থেকে এনেছে গোটা দশেক নারকেল। কিলোটাক খোয়া ক্ষীর। দশ কেজি মতো চিনি। আরও অনেক কিছু। ইন্দুবালা ফর্দ করে দিয়েছিলেন। সেগুলো দেখে দেখে সে নিয়ে এসেছে। কিন্তু না নিয়ে আসা জিনিসও আছে তার মধ্যে অনেক। যেমন ইন্দুবালা ফর্দে লেখেননি ছোটো এলাচের কথা। সেটা মুখে বলে দিয়েছিলেন। ভুলে গেছে ধনঞ্জয়। জোয়ানের কথা বলেছিলেন। একবার নয়, অন্তত বার তিনেক–সেটাও আনেনি। একটু দাঁড়িয়ে গেলে এগুলোও সব লিখে দিতে পারতেন ইন্দুবালা। কিন্তু সে সময়টাও ধনঞ্জয় দেয়নি। তাড়াতাড়ি বাজারে বেরিয়েছে সে। নেশায় টান পড়েছে যে তার। আগের রাত থেকে গুড়াকু ফুরিয়েছে। কাজেই তখন তার প্রাণ সংশয়ের অবস্থা। দিনে অন্তত বার আষ্টেক গুড়াকু দিয়ে দাঁত না মাজলে মেজাজ ভালো থাকে না ধনঞ্জয়ের। সকালে উঠে কৌটো কেঁখে যেটুকু পেয়েছে তাতেই কাজ চালিয়েছে। কিন্তু যত বেলা বেড়েছে তত মনে হয়েছে হাত পা যেন চলতে চাইছে না আর। মাথা ঝিমঝিম করছে। এইসব কাটাতে ধনঞ্জয় তাই বার দুয়েক জর্দা খেয়েছে। উলটো দিকে ভুবনের পানের দোকান থেকে কাঁচা সুপারি খেয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গুড়াকুর নেশা বেড়েছে বই কমেনি। তাই কোনো মতে সে মায়ের কাছ থেকে ফর্দ নিয়ে দৌড় লাগিয়েছে বাজারের দিকে। এদিকে ইন্দুবালা যে সমানে বলে চলেছেন আরও কী কী আনতে হবে, কী কী লেখা হয়নি খাতায় সেগুলো কিছুই প্রায় কানে ঢোকেনি ধনঞ্জয়ের। যেন হাওয়ায় ভেসে বেরিয়েছে সে। ফল হয়েছে মারাত্মক। ভুলে যাওয়া জিনিসপত্রের তালিকা অনেক। তার মধ্যে আছে ছোটো এলাচ, লবঙ্গ, জোয়ান, গোল মরিচ, আরও কত কী! এদিকে বয়েস বেড়েছে ধনঞ্জয়ের। ইন্দুবালারও ধিকি ধিকি করে অনেক। দুজনের বাক যুদ্ধ শুরু হলে থামানোর কেউ নেই। রান্নার কোনো জিনিস কিনে আনতে ভুলে গেলেই ইন্দুবালা প্রচণ্ড রেগে যান।

তাঁর হাতের কাছে সব ঠিকঠাক মতো থাকা চাই। রান্নার সময় এটা নেই ওটা নেই তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। এই নিয়ে সকালে ধনঞ্জয়ের সাথে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়েছে। ছোটোখাটো ঝগড়াও। সপাটে ইন্দুবালা বলে দিয়েছিলেন “মুখের ওপর কথা বলবি না ধনা”। এটা যে কতবার দিনে বলেন আর কতবার যে নিজেই ধনঞ্জয়কে ডেকে কথা বলেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রত্যেকদিন নিজে খেতে বসার আগে এখনও পর্যন্ত ধনঞ্জয়কে খাওয়ান। হ্যাঁ, নিজে বসে থেকে। সবার খাওয়া হলে তারপর ইন্দুবালা ভাত নিয়ে বসেন। আজকাল খাবারেও রুচি নেই। ভালো লাগে না কিছুই। সব কিছু ফেলে রেখে একদলা আচার দিয়ে কোনোমতে ভাতগুলো খান। এইসব ধনঞ্জয় জানে না। জানলে আর রক্ষে থাকবে না। ইন্দুবালার ভালো-মন্দ সব কিছুর ওপর প্রচণ্ড নজর ধনঞ্জয়ের। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই ছেলেদের ফোন করে মাথা খারাপ করে দেবে। তারাও ধনাদা বলতে প্রাণ। এতকাল একটা লোকের থাকা মানে বাড়ির সাথে, বংশের সাথে শিকড় গজিয়ে যাওয়া। নিজের সন্তানদের থেকেও বেশি বিশ্বাস আর ভরসা করেন ইন্দুবালা তাকে। তবুও কথা কাটাকাটি, ঝগড়া, কথা বন্ধ হয় দিনে বেশ কয়েকবার। না

হলেই বিপত্তি ঘটে। ধনঞ্জয় বার বার তখন জিজ্ঞেস করে, “হাঁ গো মা, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? বড় খোকাকে ফোন করি? ডাক্তার ডাকুক।” এর উত্তরে ইন্দুবালা মুখ ঝামটা দিলে ধনঞ্জয় ভাবে, না বুড়ি ঠিক আছে। সুস্থ আছে। কোনো অসুবিধে কিছু নেই।

পুজো এলেই ইন্দুবালার মন ভালো থাকে না। কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যান। পইপই করে ধনঞ্জয় বলেছিল, “খুকি ডাকছে এত করে, ঘুরে এসো।”ইন্দুবালার একমাত্র মেয়ে ইতু থাকে ব্যাঙ্গালোরে। এ বছরেই তাদের সেখানকার পাট উঠবে। জামাই চলে যাবে ইউক্রেনে। মেয়ে তার ছেলেপুলে নিয়ে এসে উঠবে দিল্লির শ্বশুরবাড়িতে। তারপর সেখান থেকে সোজা স্বামীর কাছে। তাই ওরা বারবার বলেছিল একবার আসতে। বিশেষ করে জামাই সুকান্ত। “একবার আসুন মা। অনেকদিন আপনার সাথে দেখা হবে না।” আবদার করেছিল। ছোটো খোকা ধরিয়ে দিয়েছিল হাতের ফোনটা। সেখানেই তিনি ভিডিও কলে দেখতে পাচ্ছিলেন জামাইকে, খুকিকে, তাদের ছেলেপুলেদের। সবাই চাইছিল ইন্দুবালা যেন ওদের ওখানে যান। একটু থেকে আসেন ওদের সংসারে। খুকি কেঁদেছিল, “সেই কবে বিয়ে দিয়েছ একবার দেখতে পর্যন্ত আসেনি। এবার বাইরে চলে যাচ্ছি আবার কবে

দেখা হবে …” কথা শেষ করতে পারেনি খুকি। ইন্দুবালা খুব শান্তভাবে বলে দিয়েছিলেন, “এবার ছুটি দে না তোদের মাকে। আর ধরে রাখিস না। এই তো তুই, ছোটো খোকা, বড় খোকা সবাই কেমন মিলেমিশে আছিস। সেইভাবেই থাকবি। আমাকে ছেড়ে দে।” খুকি এরপরে একটুও কথা বলতে পারেনি। তার কান্না আরও বেড়েছিল। জানতো তার মা কোনদিন আসবেন না তার কাছে। দাদাদের কাছেই যায়নি। তার কাছে আসবে কেন? কিন্তু এবার যে চলে যাচ্ছে সে অনেক দূর। হুট করে মায়ের কিছু হলে আসতে তো তিন দিন চলে যাবে।

ফোন রেখে দেওয়ার পরে ছোটো খোকা সুদীপ বেশ কড়া করেই বকে দিয়েছিল ইন্দুবালাকে। একমাত্র তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে সুদীপই একটু শাসন করে ইন্দুবালাকে। বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা ঘটলে, মনোমালিন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে দাদা, বোন যখন কেউ পারে না সামাল দিতে মাকে তখন সব শেষে আসে সুদীপ। ছোট খোকা এসে বেশি কিছু করে না। হোটেলের রান্না ঘরে একটা মোড়া নিয়ে চুপ করে বসে থাকে গ্যাঁট হয়ে। শুধু নজর রাখে ইন্দুবালাকে পুলিশ ইন্সপেক্টারের মতো। যদিও অনেক ছোটো থেকে সে তার দাদা বা বোনের চেয়ে এই ঘরে কাটিয়েছে অনেকটা সময়। রান্না করতে ভালোবাসে সুদীপ। মায়ের অনেক রান্না তার জানা। বাড়ির লোকজনও বেজায় খুশি হয় তার রান্না খেয়ে। অনেকে বলে ইন্দুবালার রান্নার হাত নাকি এই ছেলেই পেয়েছে। একটু বড় হওয়ার পরে সুদীপের খুব ইচ্ছে ছিল হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার। ইন্দুবালা সেসব হতে দেননি। কে যেন তাঁর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ভালো করে পড়ে, সরকারি পরীক্ষায় বসে বাঁধা চাকরির কথা। হয়তো কালেক্টার অফিসের বাবুদের দেখে তাঁর মাথায় আসতে পারে। কাজেই সুদীপকে সরকারি পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। চাকরি করতে হয়েছিল মায়ের কথা শুনেই। তিন ভাইবোন কেউই মায়ের অবাধ্য ছিল না। তারা একটু সময়ের জন্যেও মাকে কষ্ট দেয়নি। যা বলেছেন ইন্দুবালা তাই করেছে। এমনকি বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিলেও মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু সুদীপ তাও মাঝে মাঝে এসে গায়ের ওপরে পড়ে থেকেছে। হম্বিতম্বি করেছে। আরও দুটো বেশি কাজের লোক রাখতে বলেছে। টেবিলগুলো সানমাইকা দিয়ে ঠিক করতে বলেছে। মিস্ত্রি নিয়ে এসে বসে থাকলেও ইন্দুবালা নিজের হোটেলে তাকে নাক গলাতে দেননি। তিনি জানেন ভালোবেসেই করছে সে। তবুও তাঁর রক্তরা যেন আর এই ছেনু মিত্তির লেনের মায়া জালে না জড়ায় আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। আর তত দুই ছেলে, মেয়ে সবাই খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের চিলেকোঠা, আচারের বয়াম, নীচে রান্না ঘরে ঝুড়ি চাপা দেওয়া মাছের ডিমের বড়া। মায়ের কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজানো নাড়, নিমকি, কুচো গজা। এর থেকে তাদের যে নিস্তার নেই। সুদীপ মোড়াটা এগিয়ে আরও উনুনের ধারে নিয়ে এসেছিল। “দাও দেখি মৌরলা মাছগুলো ভাজি”। ইন্দুবালার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়। বাইরের কাপড়ে, স্নান না করে তুই রান্না ঘরে বসিস কী করে?” সুদীপ বলে “যাই তাহলে স্নান করে আসি। রান্না করতে দেবে তো?” ইন্দুবালা বলেন “কক্ষনও না। নিজের কাজ করোগে যাও।” রান্নার সময়ে কেউ যদি তাকে বিরক্ত করে মোটেই সহ্য হয় না তাঁর। সেটা সুদীপ জানে। আর জানে বলেই সে ইচ্ছে করেই আজ এইসব করছে। “টক করবে না ঝোল? আর একটু বড় সাইজের কেনা উচিত ছিল মা তোমার।” সকালে মাছগুলো দেখে ইন্দুবালার মনে হয়েছিল একবার। টকের জন্য আর সামান্য বড় হলে ভালো হতো। নিজের মনের কথাগুলো যেন পড়ে ফেলছে ছোটো ছেলে। লছমী বলতো “ওটাকেই তুই বেশি ভালোবাসিস মা।” ইন্দুবালা বলতেন, “ধুর ওইভাবে ভালোবাসা ভাগ হয় নাকি। একটাকে বেশি আরেকটাকে কম। বলতে পারিস আমি কাউকেই ভালোবাসি না।” লছমী চোখ বড় বড় করে বলেছিল “আচ্ছা? তাই তুই ওদের জন্য এতো কিছু করিস তাই না?” ইন্দুবালাও চুপ করে থাকার মানুষ ছিলেন না। জীবনটাকে যে দেখে ফেলেছেন অনেকটা, “কর্তব্য করি রে লছমী। এইটুকু যদি ওরা মনে রাখতে পারে, তাই অনেক।” মনে রেখেছিল সন্তানরা। ভোলেনি কেউই। ছোটোবেলায় সুদীপ যখন এসে দাঁড়াতো মায়ের সামনে। বায়না করতো একসাথে বাজার যাওয়ার। ইন্দুবালার মোটেই সেগুলো প্রশ্রয় দিতেন না। “যখন যা বলবো সেটাই করবে। বাড়তি কাজের তো দরকার নেই। সেই সময়টা পড়াশুনা করো”। ছেলেটা লুকিয়ে চুরিয়ে তবুও চলে যেত ধনঞ্জয়ের সাথে। বাজার করতো। ইন্দুবালা অবাক হয়ে যেতেন অত ছোট্ট ছেলের গুছিয়ে বাজার করা দেখে। পরীক্ষার পরে অন্যান্য বন্ধুরা যখন নানা খেলায় মেতে আছে; দাদা, বোন সবাই আঁকার ক্লাসে, তখন সুদীপ রান্না ঘরে। মায়ের সাথে পোস্ত বড়া করেছে। প্রচণ্ড রেগে গেলেও, চিৎকার চেঁচামেচি করলেও ছোটো খোকাকে নিরস্ত করতে পারেননি। মাছের টকে বড় না ছোটো মাছ সেই দিকে আলোচনা না এগিয়ে, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে এসে বসলেন

ইন্দুবালা ছোটো খোকার সামনে। তিনি জানেন এই ছেলে সহজে ছেড়ে দেওয়ার নয়। ইতুর বাড়ি যাওয়ার ফয়সালাটা সেরেই তারপর এখান থেকে উঠবে।

“কী চাস কি তুই?”

“পুজোয় খুকির কাছ থেকে ঘুরে এসো। ততদিন আমি হোটেল চালাবো”।

“তোর অফিস?”

“বন্ধ থাকে মা।”

“এর আগে কোনোদিন হোটেল চালিয়েছিস?”

“দেখেছি তো তোমাকে। তাছাড়া ধনাদা আছে। কিরে পারবো না?”

ধনা মাথা নাড়লে কড়া চোখে তাকান ইন্দুবালা।

“তুই পুজোতে এখানে পড়ে থাকবি…আর ছেলে মেয়ে বউ এরা কী করবে?”

“সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি সামলে নেবো।”

“আমাকে করুণা করছিস তাই না?”

“যাহ বাব্বা…করুণার ব্যাপার এলো কোথা থেকে?”

“আমার হোটেল নিয়ে তোমাদের কাউকে ভাবতে হবে না। যাও বেরিয়ে যাও এক্ষুনি বাড়ি থেকে।”

“যাবো না। তুমি কী করবে করে নাও।”

কেন খুকির বাড়ি ইন্দুবালা যাবেন না তাই নিয়ে অশান্তি চরমে উঠেছিল। সুদীপের বউ পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। “কেন তোমরা মাকে জোর করছো? যেতে চাইছেন না যাবেন না। মিটে গেল। তুমি দাদাভাই দেখা করে এসো না ইতুর সাথে। আমি আর দিদিভাই না হয় দিল্লিতে গিয়ে ওদের সি অফ করবো।” ইন্দুবালার ছোটো ছেলের বউ খুব একটা এই বাড়িতে আসে না। পালা পার্বণে নমস্কার, খাওয়া দাওয়া ছাড়া বড় একটা ঘেঁষতে দেখেন না। কিন্তু খোঁজ রাখে ইন্দুবালার সে। দিনে অন্তত একবার ফোন করে। কী কী রান্না করলেন ইন্দুবালা, নতুন কিছু হল কিনা সব। তার সাথে কথা না হলেও ধনঞ্জয়ের সাথে তো হয়ই। বড় ছেলের মেয়ে সুনয়নী যখন বিদেশ থেকে অতদিন পরে এলো, সেই খবর প্রথমে পেয়েছিল এই ছোটো ছেলের বউ নন্দিতা। সেই সবাইকে জড়ো করে। বড় ছেলে, বউমারা রাগ মিটিয়ে আবার সুনয়নীকে টেনে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। ছোটো খোকা যা রগচটা। এই বউ সামলে রেখেছে তাকে সব দিক থেকে। তাই মুখে কিছু না বললেও ছোটো বউকে সমীহ করেন ইন্দুবালা। আর সেও বেশ দূর থেকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ভক্তি দেখায়। আর দেখাবেই বা না কেন। ইন্দুবালার সাথে তার যে আছে এক অন্তরের যোগ। সে অনেকদিন আগের কথা। নন্দিতা তখন কলেজের গণ্ডি সবে পেরিয়েছে। মল্লিক বাড়ির যে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে তার সাথে বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছিল না মোটেই। মেয়ের সাথে বাবা-মায়ের মুখ দেখাদেখি যখন বন্ধ হবার যোগাড়, খবর কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে যখন বাড়ির সামনে ছেলের বাড়ির লোকজন এবং ছেলেরাও লাইন দিতে শুরু করেছে নন্দিতাকে দেখবে বলে। সেই রকমই একদিন সে সটান চলে এসেছিল এই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। সুদীপ নামের যে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে তার মায়ের সাথে কথা বলতে। সদর দরজা হাট করে ভোলা ছিল। ওটাই যে হোটেলে ঢোকার রাস্তা সে জানতো না। ঘরের মধ্যে ঢুকে খাবারের কাঠের পংক্তিগুলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে ডান হাতে পড়ে রান্নাঘর। সেই ঘরে ঢুকে নন্দিতা দেখেছিল সন্ধ্যের আঁচে চিঁড়ের পায়েসের দুধ জাল দিচ্ছেন ইন্দুবালা। কয়লার আগুনের লাল আভা ছড়িয়ে আছে ভদ্রমহিলার সারা মুখ জুড়ে। এত শান্ত কেউ হতে পারে নন্দিতা ভাবতেও পারেনি। কারণ এমন মানুষের সংস্পর্শে সে এর আগে আসেনি। সব খুব একটা যে গুছিয়ে সেদিন বলতে পেরেছিল নন্দিতা তেমনটাও নয়। ইন্দুবালা এটুকু বুঝেছিলেন, তাঁর ছেলেকে ভালোবাসে এই মেয়েটি। বিয়ে করতে চায়। বাড়ির লোক দিতে চাইছে না বলে সোজা ছেলের মায়ের কাছে চলে এসেছে। তাও ছেলেকে না জানিয়ে অনেক আঁটঘাট বাঁধা বন্ধের চিন্তা না করেই। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন নন্দিতার মুখের দিকে ইন্দুবালা। তাঁর কোনোদিন সাহস হয়নি বাড়িতে বলার যে, ভালোবাসেন মনিরুলকে। বিয়ে করতে চান। পালিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে স্বর্ণলতাকে মরতে হয়েছিল পুকুরে ডুবে। মনিরুলকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল কপোতাক্ষের তীরে। তাদের সবার প্রতিনিধি হয়েই কি মেয়েটা এই সন্ধ্যেবেলায় তাঁর কাছে এসেছে? চিড়ের পায়েসটা শেষ করে জানতে চেয়েছিলেন, তাকে ভালোবাসে তো তাঁর ছেলে? থাকতে পারবে তারা দুজনে সুখী হয়ে? মেয়েটা ঘাড় নেড়েছিল। আর ইন্দুবালা সেই সন্ধ্যের প্রথম আঁচে চিড়ের পায়েস নামিয়ে অল্প একটু অগ্নিকে উৎসর্গ করে বাটি ভরে এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছোটো বউয়ের দিকে। বলেছিলেন, “চিন্তা করো না। আমি বড় খোকাকে চিঠি লিখছি দিল্লিতে। সে এলে তাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাবো। কথা বলে আসবো তোমার বাবা মায়ের সাথে।” অবাক হয়েছিল মেয়েটি। এতো নির্বিবাদে কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নিলেন সব কিছু ইন্দুবালা? কোনো প্রশ্ন করলেন না কোথায় থাকে নন্দিতা। কী জাত? বাবা মায়ের পরিচয়। আদৌ কিছু পড়ে কিনা। দু সপ্তাহ পরে ইন্দুবালা চলে গিয়েছিলেন বড় খোকা আর খুকিকে নিয়ে নন্দিতার বাড়ি। নন্দিতা অবাক হয়ে গিয়েছিল ওই একলা একটা ভাতের হোটেল চালানো মেয়েমানুষের কথা শুনে। যে মহিলাকে না দেখেই তার বাবা মা হতচ্ছেদা করেছে। সেই মহিলাই রাজি করিয়ে নিলেন বাড়ির লোককে। শুধু তাই নয় এক সপ্তাহের মধ্যে বাবা-মা বিয়ের পাকা কথা বলার জন্যে চলে এলেন ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। সেই থেকে নন্দিতা আরও অনেক কাছের হতে পারতো ইন্দুবালার। কিন্তু বিয়ের পরে কিছু দিন ছেনু মিত্তির লেনে থেকেই সে বুঝে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চিরকালের জন্য একা হয়ে যান। তখন তাঁরা সেই একাই একটা জগতের মধ্যে বাঁচতে ভালোবাসেন। ইন্দুবালার সেই নির্জন জগৎ হলো তাঁর ভাতের হোটেল। জোর করে তাই সেখানে প্রবেশ করতে চায়নি নন্দিতা। সুদীপকেও বুঝিয়েছিল তার মতো করে।

বউয়ের কথা মতো সুদীপ ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলিয়েছিল খুকির। ভেবেছিল খুকি ঠিক রাজি করিয়ে নিতে পারবে মাকে। উলটে মা-ই কাঁদিয়ে ছাড়লো খুকিকে। কেমন যেন মেনে নিতে পারে না সুদীপ। দুই ভাইয়ের বোন অন্ত প্রাণ যে! “সব কিছুর একটা লিমিট আছে মা। খুকিকে এইভাবে না বললেও পারতে।” ভারী ফ্রেমের চশমায় ছোটো খোকাকে কেমন যেন মাস্টার রতনলাল মল্লিকের অল্প বয়সের মতো লাগে ইন্দুবালার। হাব ভাব, ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলা। ঠাকুরের কৃপায় শুধু স্বভাবটা বাবার মতো না। চলে যাচ্ছিল রেগে মেগে সুদীপ। ইন্দুবালা খেয়ে যেতে বললেন। থেকে যেতেই হলো সুদীপকে। মুখের ভাতকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস তার নেই। মাকে অসম্মান করা তো নয়ই। তাছাড়া অনেক দিন সে মায়ের হাতে মাছের টক খায়নি। ছোটো ছেলে এসেছে। বলে ইন্দুবালা সেদিন জম্পেশ করে বেঁধেছিলেন মুড়ি ঘন্ট। সুদীপ বড় ভালোবাসে যে। গরম মশলার হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল সারা ঘরটা জুড়ে। আসন পেতে বাবু হয়ে বসে খেতে ভালো লাগে সুদীপের। যদিও বাত ধরতে শুরু করেছে তারও। রান্না ঘরের মেঝেতে থালার পাশে যখন বাটিগুলো সাজিয়ে দিলেন ইন্দুবালা, চোখে জল এল ছোটো খোকার। খেতে খেতে বিষম খেলে বার দুয়েক ষাট ষাট বললো তার মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বারবার মনে মনে সুদীপ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো তার মা যেন এইভাবেই রয়ে যায় চিরটা কাল। ভর দুপুরে এক পেট খেয়ে, ইন্দুবালার দোতলার ঘরে খাটের ওপর টানটান হয়ে ঘুমিয়ে সন্ধ্যের সময় যখন বাড়ি যাবে বলে নীচে নামলো সুদীপ, তখন সত্যি তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। ওই সন্ধ্যেতেই ইন্দুবালার উনুনে নতুন আঁচের কয়লা পড়েছিল। তার সত্তর পেরেনো মা কতকগুলো নাতির বয়সী ছেলে মেয়ের আবদার মেটাচ্ছিল। আর সুদীপের সেই মুহূর্তে খুব হিংসে হচ্ছিল ছেলে মেয়েগুলোকে। সেও যদি তার মায়ের চারপাশে এইভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতো। তার স্ত্রী নন্দিতা ঠিকই বলে “তোমাদের থেকেও মা ভালোবাসেন ওই হোটেলটাকে। ওর থেকে মাকে আলাদা করার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। তাহলে আর বেশি দিন রাখতে পারবে না মাকে।” ইন্দুবালা ছোটো খোকার হাতে ধরিয়ে দেন খাবারগুলো। ছোটো বউমা, নাতি নাতনিরা খাবে। রাতে ফোন করে বোনকে সুদীপ বোঝাতে পেরেছিল “মা যেমন আছে থাকতে দে। পারলে তোরা বিদেশ যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাস। সেটাই ভালো হবে”।

অনেক রাতে শুতে এসে ইন্দুবালা ভেবেছিলেন ছোটো খোকাকে বললে সে কি থেকে যেতো আজকে? কতদিন তো দুই ছেলে, মেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমোননি তিনি। তালপাতার পাখা নেড়ে নেড়ে বাতাস করেননি। বড় খোকাকে তো ডেকে নেওয়া যেত ফোন করেই। দুই ছেলেকে পাশে নিয়ে ইন্দুবালা শুয়ে আছেন। নিজের ভাবনাতেই কেমন যেন খটকা লাগে তার। যা তিনি সন্তানদের ছোট্ট বেলাতেই করেননি আজ কেন সেগুলো করতে চাইছেন? তাহলে এই কি তাঁর সত্যিকারের শেষের সময়? ছ্যাঁৎ করে ওঠে গা টা। তিনি না থাকলে এই বাড়িটার কী হবে? কী এক বিষণ্ণতা যেন ঘিরে ধরে ইন্দুবালাকে। এমন পাথর কেন হয়ে গেলেন তিনি? এই বাড়িটায় থাকতে থাকতেই এমনটা হলো কি? আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে গেলেন এই বাড়িটার সাথেই? কোথাও কোনোদিন তাঁর যাওয়া হল না। সেটা কি নিজের ইচ্ছেতেই? নাকি সত্যি তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। চিলেকোঠার ছাদ থেকে বাড়ির পেছনের বাগান। হোটেলের রান্নাঘর। খাবার ঘর। রাস্তার ওপারে কাশী মুদির দোকান। বড়জোর রেল লাইনের ধারে সকালের বাজার। এইটুকু ভৌগোলিক আলোছায়ার মধ্যে ইন্দুবালা নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলেন। কেন রেখেছিলেন? তাহলে বাইরে যেতে ভয় করতো কি তাঁর? ধুর কী সব ভাবছেন। ফুরসত পেতেন না অন্য কোথাও যাওয়ার। প্রাপ্তবয়েস না হওয়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদেরও কোথাও যেতে দেননি তিনি। আগলে রেখে ছিলেন কঠিন কঠোর শাসনে। কারণ তিনি জানতেন এই মল্লিক বাড়ির রক্ত খারাপ। একটু আলগা দিয়েছো কি সবাই মাস্টার রতনলাল মল্লিক তৈরী হবে। ইন্দুবালা তাই তাঁদের কবেকার খুলনার বাড়িতে বসা দাদুর টোলটাকে ওপরের ঘরে গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো করে। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এক পুব বাংলার বিধবা যখন হোটেল চালাচ্ছে তখন তাঁর বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কচি গলায় পড়ার আওয়াজ। “ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয় বেগুনী রঙের শাড়ি…চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই…তেপান্তরের পার বুঝি ওই…”। বড় খোকা হেরিকেনের আলোয় পড়ছে সহজ পাঠ। ছোটো খোকা স্লেটে লিখছে অ আ ক খ। আর পুঁচকে মেয়েটা কাঁথায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে অকাতরে। জাগলেই দাদারা কেউ না কেউ তাকে দুধ খাইয়ে দেবে। আর ইন্দুবালা তখন দুটো গনগনে উনুনের সামনে। কোনোটাতে ফুটছে সোনা মুগের ডাল। কোনোটাতে বা ভাত। এটা ছিল খুব চেনা একটা ছবি। ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের অনেক দিনের খদ্দের যাঁরা তাঁদের কারও কারও মনে থাকার কথা। গরিবের একমাত্র হাতিয়ার লেখাপড়া। সেটা যদি তাঁর সন্তানরা করে উঠতে পারে তাহলে এই যে দিন রাতের পরিশ্রম করছেন ইন্দুবালা তা সার্থক হয়।

বোনকে বেশ খানিকটা বড় করে তুলেছিল দাদারাই। তাই মেয়ে মায়ের থেকেও দাদাদের ন্যাওটা বেশি। সেই ছোটো থেকেই। দাদারাও খুকি বলতে প্রাণ। তিনজনের বড় হয়ে ওঠাটা একে অন্যকে অবলম্বন করে। তার মাঝে খাড়া হয়ে বট গাছের মতো আছে যেন মা। ঝুরির সাথে বট গাছের যেমন সম্পর্ক ঠিক তেমনি ছিল ইন্দুবালার সাথে ছেলে মেয়েদের সম্পর্ক। মা আছে জানলে ওরা নিশ্চিন্ত হতো। আর ইন্দুবালা নিশ্চিন্ত হতেন ওদের সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখে। খুব যে হুজ্জতি ওরা করতে তেমনটা নয়। সেই সময়ও ওরা পেত না। ছোটো থেকেই ওরা জেনে এসেছে ওদের মা বাবা একজনই। আর তিনি হলেন ইন্দুবালা। যার আবার একটা হোটেল আছে। সেই হোটেল না চললে ওদের ভাতও জুটবে না। কেমন করে যেন ফুস মন্তরের মতো কানে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ইন্দুবালা। তাই ছোটো থেকেই ওদের চাহিদা ছিল খুব কম। মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যেতেন। ওরা যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিল ওদের দেখে নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়তো তাঁর। নিজেও তো ভাইকে একদিকে দিদি আর একদিকে মায়ের মতো বড় করে তুলছিলেন। তবুও যেটুকু স্নেহ পরশ শীতের হিমের মতো তাঁদের গায়ে লেগে থাকতো এই বাচ্চাগুলোর কপালে তাও জোটেনি। সেই স্নেহ কোমলতা ইন্দুবালা নিজের শরীরের অন্তঃপুরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কখনও কোনো দুর্বলতার মুহূর্তেও তিনি প্রকাশ করেননি। ইন্দুবালাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি তাঁর তিন ছেলে মেয়ের কেউই। শুধু তারা দেখেছে মায়ের অমানুষিক পরিশ্রম। নিয়মের একটু এদিক ওদিক হতে দেননি তিনি। ছোটো, বড় নানা অনুশাসনে মানুষ হয়েছে প্রদীপ, সুদীপ আর ইতু। পান থেকে চুন খসার জো ছিল না। মিথ্যে কথা বলা ছিল আরও অপরাধের। কোনো দিন অবশ্য তা বলতে হয়নি তাদের। চোখের দিকে তাকাতেই মা কেমন যেন বুঝে যেত মনের কথা সব। নিয়মিত ছেলেদের স্কুলে গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন ইন্দুবালা। ঠিক মতো পড়ছে কিনা। বড় ছেলেও সামলাতে অনেকটা। কিন্তু সেও তো তখন অনেক ছোটো। শুধু স্কুলের ভরসাতেই বাচ্চাদের লেখাপড়া ছেড়ে দেননি ইন্দুবালা। বাড়িতে এক সময়ে তাঁকে পড়াতেন বাবা। তারও আগে দাদু। কিন্তু এখানে তাঁর বাচ্চাদের কে পড়াবে? ইন্দুবালার হাতে সময় নেই একটুও। তা সত্ত্বেও বর্ণপরিচয় নিজেই পড়িয়েছিলেন ছেলেদের। আর ছেলেরা পড়িয়েছিল বোনকে। স্কুলে ভর্তি করার অনেক আগেই বাড়িতে রেখেছিলেন পড়ানোর জন্য মাস্টার। খোঁজ নিয়েছিলেন ছেনু মিত্তির লেনে পুব দিকে যে স্কুলটা আছে সেটা নাকি কর্পোরেশানের স্কুল। ওখানে পড়তে টাকা পয়সা তো লাগেই না তার ওপরে আবার কোন এক সংস্থা থেকে দুপুর বেলা বাচ্চাদের ভাত খেতে দেয়। ওই স্কুলের এক অঙ্কের স্যার মাঝে মাঝেই ইন্দুবালার হোটেলে খেতে আসতেন। ইন্দুবালা তাঁর কাছ থেকে সব নিয়ম নীতি শুনে স্কুলে চলে গিয়েছিলেন নিজেই। দুই ছেলেকে সেই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। প্রথম দিকে ধনা গিয়ে দিয়ে আসতো তাদের। কয়েকদিনের পরে নিজেরাই যেতে শিখলো।

ছেলেদের হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ঘরের কাজ। রান্না-বান্না। কাপড় কাঁচা। বাসন মাজা। বড়টা অতটা গুছিয়ে করে উঠতে না পারলেও ছোটোটি শিখেছিল খুব মন দিয়ে। তার ওইসব বেশ ভালো লাগতো। বড়টা আগলে রাখতে শিখেছিল ভাই বোনকে। কখনও কখনও মাকেও। কাজ না পারা নিয়ে বড় খোকা কম মার খেয়েছে ইন্দুবালার কাছে? ধনঞ্জয়ের আবার এইসব কিছু সহ্য হতো না। “ওইটুকু ছোটো ছোটো হাতে ছাই ঘাঁটবে মা?” ইন্দুবালার জবাব ছিল, “না হলে পদ্ম হবে কী করে?” ইন্দুবালা ছেলে মেয়েদের সামনে যে কঠোর কঠিন অনুশাসন রেখেছিলেন আমাদের বাঙালি ঘরে সেটা বড় একটা দেখা যায় না। কেন এমন কঠোর হয়েছিলেন ইন্দুবালা? তাঁকে তো এমন অনুশাসনের মধ্যে বড় হতে হয়নি। একটা নয় একাধিক কারণ এর পেছনে ছিল। তিনটে নদী পেরিয়ে যেদিন তিনি কলকাতায় এসে এই মল্লিক বাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন থেকেই বুঝেছিলেন তার ভাগ্য কলাপোতায় যেমন টিমটিম করে জ্বলছিল এখানে এসে বুঝি তা নিভলো। কলকাতার বাবুরা বিকেলে গলায় পাউডার মেখে তাস পেটায়। রাতে বউ পেটায়। ভোরে সোহাগ করে। আর গোটা দিন পাশ বালিশ বুকে জড়িয়ে ঘুমোয়। কিংবা চিৎপুরে কোনো মনের মানুষের বাড়িতে মাছের তেল চচ্চড়ি খেয়ে গা-হাত-পা মালিশ করায়। ইন্দুবালার এই বাড়িতে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা ছিল। জীবনের নানা চড়াই উতরাই বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে ইন্দুবালাকে করে দিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যদি কোনোদিন কোনো সন্তান আসে তাঁর জীবনে তাহলে এই বাড়ির কোন পূর্ব পুরুষের ছায়া তিনি তাদের ওপর পড়তে দেবেন না। বড় ছেলে যখন পেটে শাশুড়ি তখন সবে তাঁর চলৎশক্তি হারাতে বসেছেন। তাও তাঁর খানদানি মেজাজে তখনও বয়সের জং পড়েনি। নাতির মুখ যে বুড়ি দেখতে পাবেন সেই আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। কাজেই বাড়িতে পিতৃপুরুষের মুখে জল দেওয়ার লোক এসেছে শুনে তিনি আহ্লাদিত হয়েছিলেন। কিন্তু নাতিকে তেল মাখানো ছাড়া বড় বেশি সোহাগ করার সময় পাননি। ছোটো ছেলে যখন হলো শাশুড়ি বিছানা নিলেন। আর মেয়েকে দেখে যাওয়ার অবকাশ তাঁর হয়নি। যে বাড়িতে মা ষষ্ঠী বিরূপ বলে দোজবরে ছেলের আবার বিয়ে দিয়েছিলেন সেই বাড়ির উঠোন জোড়া বাচ্চাদের কলকাকলি শুনে যাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। কিন্তু মনে মনে এক পরম শান্তির গিঁট দিয়েছিলেন তিনি। এক গুষ্টি ঘটির মাঝে এক বাঙাল মেয়ে নিয়ে আসার দূরদর্শিতার বাহবা দিতে দিতে বুড়ি চোখ বুজেছিলেন। মাস্টার রতনলাল মল্লিক পরলোকে গিয়েছিলেন তারও কিছুদিন পরে। ইন্দুবালা নিজে হাতে মুখাগ্নি থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধ শান্তি তো করে ছিলেনই এমনকি এখনও পর্যন্ত প্রত্যেক মহালয়ায় বাড়িতে পুরোহিত ডেকে বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির স্বর্গীয় আত্মীয়স্বজনদের জলের ব্যবস্থা করেন। নিজে দিতে পারেন না বলে পুরোহিতকে দিয়ে দেওয়ান। ছেলেমেয়েদের সেই দিকে ঘেঁষতে দেন না একটুও। বড় হলেও না। এই নিয়ে তাদের অনেক প্রশ্ন ছিল। সব জবাব থেমে যেত ইন্দুবালা যখন বলতেন “আগে মরি তারপর নিজেরাই সব সামলিও”। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ছেলেরা মল্লিক বাড়ির শেকড়ের উৎস সন্ধানে নিজেরা যখন আগ বাড়িয়ে গেছে আশেপাশের আত্মীয়স্বজনের সাথে মিশতে তখন হোঁচট খেয়েছে বারে বারে। তারা বুঝতে পেরেছে মা কেন তাদের বাড়ির চারপাশের জমাট অন্ধকার থেকে এইভাবে দূরে রেখেছে। কেন তাদের কাছে স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে। খুলনার কোন এক অখ্যাত অজ গাঁ কলাপোতা। বাবার থেকে তারা না-দেখা মামার বাড়ির গ্রামটাকে যেন বেশি করে চেনে। মাস্টার রতনলাল মল্লিক তাদের কাছে বাবা হিসেবে কাগজে কলমে পরিচয় ছাড়া আর কিছুই কোনো দিন ছিলেন না। মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ার মতো শ্বশুরবাড়ির কোনো দূর সম্পর্কের বদ আত্মীয় এসে সম্পত্তি বাগাতে চেষ্টা করেছে। ছেলেদের উস্কিয়ে দিয়েছে। লোভ দেখিয়েছে। ইন্দুবালা নিজে সেই সব ফাটল মেরামতি করেছেন। এখানে এইগুলো হয়তো বিস্তারে বলা যেতে পারতো তাহলে আর পাঁচটা ঘরের কূটকচালির মতো শোনাতো ব্যাপারটা। লাউয়ের খোসা পোস্ত দিয়ে ভাজার স্বাদটা আর থাকতো না। গরম ভাতও হয়ে যেত জুরোনো। ছোটো থেকে বাচ্চারা এই ছেনু মিত্তির লেন ছেড়ে বেরোয়নি খুব একটা। বাবা বাছা করে আদর করেনি তাদের কেউ। মামার বাড়ি থেকে আসেনি তাদের জন্য কোনোদিন পুজোর জামা। কিংবা বাবার দিকের কোনো কুটুম পয়লা বৈশাখে পাঠায়নি মিষ্টির হাঁড়ি। অথচ তারা জানতো খুলনা বলে একটা জায়গা আছে। কলাপোতা বলে একটা গ্রাম। সেই গ্রামে একটা বড় উঠোনওয়ালা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে একটা তুলসী মঞ্চ আছে। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে আছে মায়ের স্কুল। একটা নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য তাদের মামা, দিদা সবাই শহীদ হয়েছে। তাদের মা আসলে শহীদ পরিবারের মেয়ে।

আদর আহ্লাদে ইন্দুবালা বড় করেননি ছেলে মেয়েদের ঠিকই তাই বলে ভাব ভালোবাসা ছিল না বললে কথকের পাপ বাড়বে। ইন্দুবালার ভালোবাসা সেই ছোট্ট থেকে ছেলে মেয়েরা বুঝে গিয়েছিল অন্যরকম ভাবে। তাদের জন্য বড় বড় বয়ামে, কাঁচের শিশিতে, অ্যালুমিনিয়ামের কৌটোয় ইন্দুবালা যত্ন করে কত কিছু যে খাবার করে রাখতেন। কোনটাতে নাড়ু, কোনটাতে মুড়ির মোয়া, চিড়ে ভাজা, কুচো নিমকি, গজা। আরও কত কী যে! আজ তা নিজেও মনে করতে পারেন না। বড় ছেলে যেবার বি এ পরীক্ষা দিল সেবার নিজে গিয়ে কালীঘাটের মায়ের কাছে পুজো দিয়ে এসেছিলেন। বলে এসেছিলেন কোনোদিন নিজের জন্য তিনি কিছু চাননি কিন্তু ওকে দাঁড়াবার জায়গাটুকু করে দিও মা। ছেলে ভালোভাবে পাশ করেছিল। ইন্দুবালা জানতেন একটাকে দাঁড় করাতে পারলে বাকিগুলোও ঝপঝপ করে দাঁড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে তাই হয়েছিল। বড় ছেলে প্রথম চাকরির মাইনে সবটাই মাকে মানি অর্ডারে পাঠিয়ে ছিল দিল্লি থেকে। ইন্দুবালা খুশি হয়েছিলেন মনে মনে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করেননি। টাকা তো তিনি নেননি। বরং কয়েক মাসের মধ্যে ছেলের বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিয়েছিলেন। বাকি দুটো কথা শোনাতে এলে ইন্দুবালা তাদের মুখের ওপর সোজাসাপটা বলে দিয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এবার নিজেদের পথ দেখতে হবে। তাঁর চারপাশে থেকে ভিড় বাড়ানো বরদাস্ত করবেন না তিনি। বড় রুক্ষ মনে হয়েছিল সেদিন কি ইন্দুবালাকে? তা তো হয়েছিলই। কিন্তু তিনি জানতেন প্রথম থেকে দূরে না সরালে আর কোনোদিনই যে ওরা নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারবে না। নিজের সংসার হবে না। মাথা গোঁজার জায়গাও।

আস্তে আস্তে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল ইন্দুবালার। জীবনটা তো তারও অনেকদিন আগেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ধনঞ্জয় শাপশাপান্ত করলো। “কেমন মা তুমি? ছেলে মেয়েদের দূর করে দিলে? মরার সময় জল পাবে না দেখে নিও”। ভর সন্ধেবেলায় ধনঞ্জয়ের কথাটা বুকে বড় বেজেছিল। কিন্তু ইন্দুবালা জানতেন তাঁর দুই কূলে কেউই মরার আগে জল পায়নি। তিনিও যে পাবেন সেই আশাও করেন না। ইন্দুবালা তাই প্রতি বছর মহালয়ায় পিতৃপক্ষে কালো তিলের সাথে গঙ্গাজল উৎসর্গ করেন। কলাপাতার ডোঙায়, কুশের আংটি পরে পিতামহ থেকে শুরু করে মাতামহ, শ্বশুর বাড়ির তিনকূলের কেউই বাদ পড়ে না। এমনকি মনিরুল, সেই কবেকার একাত্তরের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া নিজের প্রথম প্রেমকে পর্যন্ত সারাদিন নির্জলা থেকে ইন্দুবালা জল দেন। প্রথম প্রথম লোকজনের খুব চোখ টাটিয়ে ছিল। “মেয়ে মানুষ আবার তর্পণ করবে কি গো?” আত্মীয় কুটুমরা যাঁরা তখনও সাপে নেউলের মতো পেছনে পড়েছিল, কথা শোনাতে ছাড়েনি। ইন্দুবালা কারোর কথা কিছু শোনেননি। একটা লম্বা নামের তালিকা তৈরী করে চারপাশের অসংখ্য পরিচিত অপরিচিত আত্মার মুখে কালো তিল আর গঙ্গা জল কুশের আংটি পড়ে ঢেলে গেছেন। “তোমরা যারা জল পাওনি জল খাও। ইন্দুবালাকে ক্ষমা করে দিও।” গড় হয়ে প্রণাম করে শেষে এই কথাগুলো বলতেন তিনি। কাজেই যাদের কাছে মহালয়া ছিল সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ, “জাগো তুমি জাগো…” গানের ধুয়ো। ইন্দুবালার কাছে ছিল সেটা মৃত্যুর উৎসব। অতি প্রিয়জন থেকে শুরু করে অচেনা লোকদের আবাহন করা। এক বিস্মৃত স্মৃতির পথে নিরন্তর পরিক্রমণ। মনটা ঝুপ করে খারাপ হয়ে যায় ইন্দুবালার। ধনঞ্জয় সেটা বুঝতে পারে। বিরক্ত করে না তখন সে একটুও। নিজে নিজে উনুন ধরায়। সবজি কাটে। আটা মাখে। ইন্দুবালা নীচে নামেন অনেক দেরি করে। মহালয়ায় ইন্দুবালার হোটেলের মেনু সাদা তিলের বড়া, নারকেল ডাল, কুচো মাছের চচ্চড়ি আর চালতার চাটনি। মেসের ছেলে মেয়েগুলো হাপুস হুপুস করে খেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে চলে যায়। চাঁদপানা মুখগুলো আবার কয়েকদিন দেখতে পাবেন না ইন্দুবালা। সবাই বাড়ি যাবে যে পুজোর ছুটিতে। যাওয়ার আগে কেউ প্রণাম করে। কেউ আবার বা আদর করে জড়িয়ে ধরে। কেউ চুমু খায়। কেউ আবার সেলফি তোলে। দিদাকে তারা নাকি খুব মিস করবে। “ভালো থেকো তুমি। আর পুজোয় একদম ভালো ভালো রান্না করো না। তাহলে ওই ধনাদাই সব খাবে”। কত কী সব কলবল করতে করতে বেরিয়ে যায় ওরা। আরও ফাঁকা হয়ে যায় ইন্দুবালার চারপাশ।

কিচ্ছুটি মুখে না দিয়ে ইন্দুবালা ওপরের ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসেন। কাদের জন্য তার এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে? সব্বাইকে নিয়ে থাকলে আজ এই নিশুতি রাতে বাড়ি গমগম করতো। কোনো ঝগড়া নেই, ঝাঁটি নেই, মনের কোনো মালিন্য নেই। তবুও ছেলে মেয়েগুলোকে এত দূরে সরিয়ে রেখে কি পেলেন তিনি? একা বাঁচার সুখ? কার ওপর অভিমান করে একা হয়ে গেলেন তিনি? বাবা? মনিরুল? মাস্টার রতনলাল মল্লিক? নাকি অদৃষ্ট? দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। রাতগুলোতে দুচোখের পাতা এখন আর এক করতে পারেন না। ঘুম যেন তাঁর থেকে দূরে পালায়। সাত পাঁচ চিন্তা মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে কপোতাক্ষের ঘোলা জলের মতো। ঠিক এইরকম সময়ে ইন্দুবালার যেটা হয় তিনি আর চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। কাজ করতে হয় তাঁকে। প্রচুর কাজ। মনে পড়ে যায় দশটা নারকেলের কথা। কিলোটাক ক্ষোয়া ক্ষীর। কেজি খানেক চিনি। ধনঞ্জয় মাঝরাতে শুনতে পায় রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে খড়খড় আওয়াজ। চোর ঢুকলো নাকি পুজোর আগে রান্নাঘরে। একটা বড় গামলা নিয়ে গেলেও তো অনেক। পা টিপে টিপে এগিয়ে দেখে দরজা হাট করে খোলা। রান্নাঘরের মেঝেতে সব কিছু সাজিয়ে নিয়ে নারকেল কুরছেন ইন্দুবালা। খিঁচিয়ে ওঠে ধনঞ্জয়। “নিজে তো শান্তি পাবেই না। আমাকেও শান্তি দেবে না তুমি?” ইন্দুবালা মুখ না তুলেই বলেন “তুই শুতে যা ধনঞ্জয়। আর যাওয়ার সময় রান্না ঘরের দোরটা দিয়ে যা”। ধনঞ্জয় যেতে চায় না। “কাল সকালে এইসব নিয়ে বসলে হতো না? এই এতো গুলো নারকেল এখন কুরবে? বাটবে?” ইন্দুবালা বলেন “আমার ঘুম আসছে না।” ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়। “তা আসবে কেন? ঘুমের ওষুধ খেয়েছো?” ইন্দুবালা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেন না। অনেকবার তাকে ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও সে ওষুধ খাননি। তাঁর মনে হয় একবার খেলে আর যদি কোনোদিন ঘুম না ভাঙে? এই তো কয়েকদিন পরেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়বেন চিরকালের জন্যে। তার আগে ওষুধ খেয়ে কী হবে? তার চেয়ে এই ভালো। সারা রাত ধরে কাজ করবেন। ধনঞ্জয়ের মেজাজ তিরিক্ষে হয়। “ওঠো তো এবার। যাও ঘরে যাও। ঘুম না আসে তো ছেলে মেয়েরা পুজোয় কত কী পাঠিয়েছে সেগুলো দেখো গিয়ে। প্যাকেট পর্যন্ত খোলার সময় হয়নি তোমার।” প্রত্যেক বছর ছেলের বউরা কত দামি দামি শাড়ি দেয়। সেগুলো পরা হয় না তেমন ইন্দুবালার। আলমারি ঠাসা হয়ে পড়ে থাকে। বড় নাতনি সুনয়নী আলমারি খুলে একবার অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত এত কাপড় তার ঠাম্মি জমিয়ে রেখে দিয়েছে? ইন্দুবালা হেসে বলেছিলেন “একটা সময় ছিল দুটো কাপড়ে সারা বছর চালিয়েছি। এখন ওগুলো দেখেও সুখ। কোথাও কি যাই যে পরবো?” সুনয়নী তাঁকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কোথাও না সিনেমা দেখতে। “যাবে ঠাম্মি? একবার চলো না। কী বিশাল বড় মল। তার মধ্যে সিনেমা হল। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো দোতলায়। মোটা গদিওয়ালা সিটে হেলান দিয়ে বসবে।” ইন্দুবালা যাননি। লছমীও তাকে বলেছিল সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে সেবার। টিকিট কেটে এনেছিল। কিন্তু কলকাতা তখন জ্বলছে। সিনেমার হলের সামনে থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল তিনটে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। বোম পড়েছিল। কারা যেন বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। একটা বড় মিছিলের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। কোন রকমে বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছিলেন ওরা। তারও অনেক পরে অলোকরা ভাত খেতে এলে বুঝেছিলেন কলকাতার পরিস্থিতি। না হলে এই ছেনু মিত্তির লেনে দিন দুনিয়ার খবর তিনি পাবেন কী করে? ধনঞ্জয় আবার ঘ্যানঘ্যান করে। “ঘুম না এলে সেলাই-ফোঁড়াই করো। সেটাও ভালো না লাগলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। আমি গরম জল করে হট ব্যাগে ঢেলে দিচ্ছি। পিঠে নিয়ে শোও আরাম পাবে”। ইন্দুবালা খুব শান্তভাবে তাকান ধনঞ্জয়ের দিকে। এই সময়ে তাঁর একটুও ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না। “আমি কী করবো না করবো সব তুই বলে দিবি নাকি ধনা?” ইন্দুবালার এই চাহনি ধনঞ্জয় চেনে। মনে যা ভেবেছে তাই করবে। সে দাঁড়ায় না। রান্নাঘরের দোর এঁটে চলে যায়। নারকেল কুরতে কুরতে কোথা থেকে ইন্দুবালা যেন বাতাসে পান শিউলি ফুলের গন্ধ। চোখ বন্ধ করলে হরি বোষ্টমীর গান ভেসে আসে। “যাও গিরিরাজ আনিতে গৌরী… উমা আমার কত কেঁদেছে”। ঠাম্মার হাতে সিধে। মায়ের চোখ জলে ভরো ভরো। কপোতাক্ষের ধার ধরে কাশ ফুলের মাঠ পেরিয়ে আসছে ঢাকির দল। বাবা এনেছে নতুন শাড়ি ইন্দুর জন্য। লাল পাড়ের ওপর ডুরে কাটা। কখন সেটা পরবে ভেবেই আর ঘুম আসছে না তার। ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে অধিবাসের ঘট বসে গেছে। মহালয়াতে পুজোও হয়েছে কাঁসর ঘন্টা পিটিয়ে। তিনটে গ্রাম পেরিয়ে ঠাকুর গড়তে আসা কুমুদ পালের তখনও চোখ আঁকা হয়নি মা দুর্গার। তাঁর ছানাপোনাদের। অনেকের সাথে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ইন্দুবালাও চণ্ডীমণ্ডপে থামের সামনে। টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। কুমুদ পাল তোরজোড় করছে কাজ শুরু করার। ঠিক সেই সময়ে কেউ একজন খোঁচা মারে ইন্দুবালাকে। সে বিরক্ত হয়। পেছন ফিরে দেখে অতসী। স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। তারই দিকে তাকিয়ে। “মুখে বল না অতসী ওমন খোঁচাচ্ছিস কেন?” অতসী ফিসফিস করে বলে, “বাড়ি চল। মেয়েদের ন্যাংটা হঠাকুর দেখতে নেই। মা বলেছে”। ইন্দুবালা বলে “তোর মা বলেছে যখন তুই যা না। আমি এখন চোখ আঁকা দেখবো। তারপর দুগগার শাড়ি পরাও”। অতসী মুখ বাঁকায়। “এইজন্যে সবাই তোকে ঢুলুনি বলে। ব্যাটাছেলেদের গায়ে পড়া। ওই দ্যাখ কে এসেছে। ডাকছে তোকে”। ইন্দুবালা ফিরে তাকায়। দূরে অন্ধকারে বড় জাম গাছটার নীচে টিপ টিপ জোনাকির আলোর মধ্যেই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনিরুল। যদিও মনিরুল তাকে ডাকছে না একটুও। অনেক দূর থেকে সে দেখছে ঠাকুরের রঙ করা। তার সমবয়সী অনেক মুসলমান ছেলে এইসব দেখা হারাম বলে এই পথ মাড়ায় না বড় একটা। কিন্তু মনিরুলের কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগে। ওই টানা টানা চোখ দুটোতে লাল কালির কাজল পরানো। কোন মায়া যেন তাকে ডাকে। ঠিক তার ইন্দুবালার চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে যায় তখন। ভাবতে অবাক লাগে তার একটা মাটির তাল কীভাবে হয়ে ওঠে ঠিক রক্ত মাংসের মানুষের মতো। তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। ঘরের মেয়ে বলে পুজো করা হয় তাকে। হনহন করে এগিয়ে আসে ইন্দুবালা মনিরুলের দিকে। এত রাতের আঁধারে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার রাগটা যেন চড়াং করে মাথায় ওঠে। “এখানে কী করছিস তুই?” মনিরুল যে তৈরী ছিল না এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য। সে ভেবেছিল তাকে যদি দেখতে পায় ইন্দুবালা, তাহলে হয়তো ভালো লাগবে তার। কিন্তু যেভাবে ইন্দুবালা ঝাঁপিয়ে এসে পড়লো তার সামনে ব্যাপারটা একটুও সুবিধের বলে মনে হলো না মনিরুলের। এমনিতেই হিন্দু পাড়ায় পুজোর সময়ে চণ্ডীমণ্ডপের সামনে ঘোরাঘুরি অনেকেই পছন্দ করে না। এমনকি তার ধর্মের মাতব্বর লোকজনও না। কাজেই বেশ ঝুঁকি নিয়েই আসে মনিরুল। তার ওপরে আবার ইন্দুবালার রাগ। আমতা আমতা করে বলে, “ঠাকুরের রঙ করা দেখছিলাম ইন্দু।” ইন্দুবালা আরও রেগে যায়। “তোর আবার ঠাকুরের রঙ করা দেখার কী আছে? আমি যা করবো তোকেও তাই করতে হবে মনিরুল?” রাগলে মেয়েটার নাকটা ফুলে ওঠে। মনিরুলের সেটা দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু এখন একটুও তাকাতে পারছে না সে ইন্দুবালার মুখের দিকে। সবে গোঁফ ওঠা ছেলেটা মাথা নীচু করেই বলছে “তোর খারাপ লাগবে জানলে আসতাম না”। ইন্দুবালা আরও ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে “আসবি না”। চলে যাচ্ছে মনিরুল আস্তে আস্তে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে। ইন্দুবালাও ফিরে যাচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপে। কিন্তু সে দেখতে তো পাচ্ছে না মনিরুলের চোখে তখন শরতের জলে ভরা মেঘ। দু চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা। সবে ওঠা দাড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে ভালোবাসার অভিমানে। জোনাকিগুলো ফিসফিস করে বলছে “ভালোবাসিস নাকি মনিরুল তুই ইন্দুকে…?”

ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে ততক্ষণে মা দুগগার চোখ আঁকা হচ্ছে। কুমুদ পাল তার শিল্পী হাতের ছোঁওয়ায় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন। কপোতাক্ষের মাটির ঠাকুরও যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে একটু একটু করে। কিন্তু এইসব তখন আর ভালো লাগছে না ইন্দুবালার দেখতে। মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে তার। বাড়ি চলে যাচ্ছে ইন্দুবালা। কেন অমন করে বলতে গেল সে মনিরুলকে? কী ক্ষতি হতো মনিরুল দুগগার চোখ আঁকা দেখলে? সবাই তো দেখছিল। ওই অতসীটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ইন্দুবালাকে বলে কিনা ছেলে ঢলানি? যত রাগটা সে অতসীর দিকে নিয়ে যেতে চায় তত রাগ গড়িয়ে আসে নিজের দিকে। ঠিক করলো কী ইন্দুবালা? নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে অমন করে বললো সে? প্রত্যেক বছরই তো মনিরুল চণ্ডীমণ্ডপে আসে। ওদের সাথেই ঠাকুরের রঙ করা দেখে। এবার কেন মনিরুলকে তার অন্যরকম মনে হচ্ছে? কেন বারবার মনে হচ্ছে এইসব কিছু আসলে মনিরুলের জন্যে করছে সে। মা দুর্গার চোখ আঁকা দেখে এসে ভেবেছিল সে একটা বড় চিঠি লিখবে মনিরুলকে। এবার যদি মনিরুল সেখানেই এসে গেল তাহলে লিখবে কী করে? আর যদি লেখেও তাহলে কী থাকবে সেই চিঠিতে! এমন কিছু তো আর নেই যা দেখেনি মনিরুল! “আমি তোকে ওইভাবে বলতে চাইনি মনিরুল। আমি আসলে আমার আনন্দগুলো তোকে লুকিয়ে চিঠিতে লিখতে চেয়েছিলাম”। থমকে দাঁড়ায় ইন্দুবালা অন্ধকারে আমলকি গাছটার নীচে। এইসব কী ভাবছে সে? নিজের গোপন আনন্দগুলো লিখতে চায় মনিরুলকে? ভালোবেসে ফেললো নাকি ছেলেটাকে? অন্ধকারে পুকুর পাড়ের সেই আমলকি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেই যেন নিজের মুখ চাপা দেয় ইন্দুবালা। কী বলছে সে? এক মুসলমান ছেলের সাথে এক হিন্দু মেয়ের বিয়ে? এই গ্রামের কেউ হতে দেবে না। কোনোদিন না। ঠিক সেই সময়ে ঝোঁপ থেকে বুড়ো তক্ষকটা যেন বলে উঠছিল ঠিক ঠিক। এই নিস্তব্ধ রাত্রে পুকুরে জলের মধ্যে ঢেউ তুলে সেই কবে রিয়াজকে ভালোবাসতে গিয়ে মরে যাওয়া স্বর্ণলতা ভেসে উঠে বলেছিল “সাবধান ইন্দু… সাবধান..ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না…।” প্রচণ্ড ভয়ে সেই আঁধার রাতে ছুটেছিল ইন্দুবালা। প্রথম ভালোবাসার আবিষ্কার যেন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল গোটা পথ জুড়ে।

খিড়কির দরজা খুলে তার মনটা অবশ্য ভালো হয়ে গেল। ঠাম্মা উঠোন জুড়ে বসে নারকেল কুরছে। আর একদিকে দুধ জ্বাল দিচ্ছে কাঠের উনুনে। “কী করবে ঠাম্মা?” ঠাম্মা হাসে “দ্যাখ না কী করব”। ইন্দুবালা নাছোড়। না আমাকে বলতেই হবে কী করছো তুমি”। ঠাম্মা বলে “ওই বারকোষটা তোল তো ইন্দু”। এগিয়ে যায় ইন্দুবালা। বারকোষ তোলে। তার নীচে সাজানো ছোটো ছোটো ছাঁচ। কোনোটা ময়ূর। কোনোটা পান পাতা। কোনোটা আলপনার নক্সা। ইন্দুবালার মুখটা যেন এই অন্ধকারে আরও আলো হয়ে ওঠে। “তুমি চন্দ্রপুলি গড়বে ঠাম্মা?” সরাসরি কোনো উত্তর দেয় না ইন্দুবালার ঠাম্মা। “মা দুগগাকে দেখেছিস তো দিদিভাই? কেমন এক চালার নীচে স্বামী সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে আছে। ওই শান্তিটাই বড় জিনিস। ওটা না থাকলে জীবনে কিছুই থাকবে না”। ইন্দুবালা নড়ে চড়ে বসে। “অশান্তির কী হলো ঠাম্মা? আমি কি কিছু করেছি?” ঠাম্মা নারকেল বাটতে বাটতে বলে “না তুই কেন করবি দিদিভাই। মানুষ করে। মানুষ মানুষের নামে বদনাম রটায়। এতো রাতে সোমত্ত মেয়ে বাইরে থাকলে বাড়ির অমঙ্গল হয়। গাঁয়ের লোকে দু চার কথা বলে”। ইন্দুবালার চোখ ফেটে জল আসে। “আমি কিছু করিনি ঠাম্মা। মনিরুলকে চলে যেতে বলেছিলাম।”। মেয়ের সরলতা দেখে ঠাম্মা কী করবে বুঝতে পারে না। বাড়ির ভেতরে যাতে আওয়াজ না যায় তাই তক্ষুনি ইন্দুবালার হাতে ধরিয়ে দেয় হাতাখানা। “দুধটা আস্তে আস্তে ঘন হয়ে উঠছে দিদিভাই। যতক্ষণ না ক্ষীর হচ্ছে নাড়তে হবে। তলায় লেগে গেলেই মুশকিল। ধরা দুধের গন্ধ হলে চন্দ্রপুলি কেউ খাবে না যে”।

নারকেল কোরা হয়ে গেছে ইন্দুবালার। এই বয়সে দশটা নারকেল কোরা চাড্ডিখানি কথা নয়। ঘামছেন তিনি। এবার বাটতে হবে শিলে ফেলে পুরোটা। মিহি করে। যাতে একটু এবড়ো খেবড়ো কুচি না পড়ে মুখে। জিভে দেওয়ার সাথে সাথে যাতে গলে যায় চন্দ্রপুলি। দিনের বেলা হলে ধনঞ্জয় জোর করে মিক্সিতে বাটতে বলতো। কিন্তু ইন্দুবালা জানেন প্রাচীন এক শিলায় নারকেল বাটা আর যন্ত্রে বাটার মধ্যে অনেক তফাত থাকে। পাথরের ওই স্বাদটা কি তিনটে স্টেনলেস স্টিলের ব্লেড দিতে পারে? কখনোই না। ইন্দুবালা তাঁর শ্বশুরবাড়ির সেই কবেকার ভারি শিলখানা পাতেন। বাটতে বসেন। আর ওই দিকে তখন কবেকার যুগ এফাল ওফাল করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে বড় খোকা, ছোট খোকা তার কোলে আবার খুকি। “আমরাও খাবো মা”। ইন্দুবালা বলেন “আগে হোক। তারপর খেও। এখন ঘুমিয়ে পড়ে যাও”। কিন্তু কেউ যেতে চায় না। তিনজনেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। ইন্দুবালা বুঝতে পারেন এরা এখান থেকে কেউ নড়বে না। মায়ের জেদ আর ধৈর্য দুটোই তারা পেয়েছে যে। বড় ছেলেকে উনুনে দুধটা নাড়তে দিয়ে ছোটো ছেলেকে এলাচ ছাড়াতে বলেন। মেয়েটা কোলে ঢুললেও বারবার জেগে উঠছে। ছোটোর দিকে তাকিয়ে দাদ-দা বলছে। ও বাবা বলতে শেখেনি। কারণ বাবাকে ও দেখেনি। তাছাড়া এই বাড়িতে বাবা বলে কেউ কাউকে ডাকে না। তাই ওই শব্দটা আপাতত ওর জীবন থেকে উধাও। দুধ উথলে ওঠার মতো হলে বড় খোকা ফুঁ দেয়। ইন্দুবালা বকেন। “ওইভাবে মুখের হাওয়া দিতে আছে? ঠাকুর খাবে না?” ছোটো খোকা “এলাচ ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, “তাহলে আমরা কখন খাবো মা?” মেয়েটা কোল থেকে “মা…মা..” বলে ডেকে ওঠে। ইন্দুবালা নারকেল বেটে চলেন। রাত বাড়তে থাকে। ঘন দুধ ক্ষীর হলে তার মধ্যে ওই নারকেল বাটা চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়তে থাকেন। যতক্ষণ না মণ্ডটা শক্ত হয়। ছেলে দুটো ততক্ষণ বসে থাকে। রান্নাঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঢোলে। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কাদা। ছোটো ছোটো ছাঁচে পুরগুলো পোরেন ইন্দুবালা। বড় কাঁসার থালায় ভর্তি হতে থাকে ময়ূর, নক্সাকাটা নৌকা, পাঁপড়ি মেলা ফুল, জলের মধ্যে হাঁস, পদ্মপাতার আলপনা আরও কত কত কী! ঘুম থেকে তুলে দেখান দুই ছেলেকে। মেয়েটার তো তখন অত বোঝার বয়েস হয়নি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ছেলে দুটো। অবাক হয়ে। আর ইন্দুবালার ঠিক সেই মুহূর্তে কান্না পায়। ভীষণ কান্না। ফাঁকা রান্না ঘরে থালা ভরা চন্দ্রপুলি নিয়ে সত্তর পেরোনো ইন্দুবালা মুখে কাপড় খুঁজে হাহাকার করেন। পাছে ধনঞ্জয় শুনতে পায়। ছেলেদের ফোন করে ডাকে। ওরা যদি জেনে যায় ওদের মা সত্যি কত ভালোবাসে। ইন্দুবালা জানতে দিতে চান না তাঁর এই ভালোবাসা কাউকে। যাঁদেরই ভালোবাসতে গেছেন তারাই চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। এটা যে অভিশাপ তাঁর জীবনে। উনি এই বয়সে সন্তান শোক পেতে চান না।

ঠাম্মা তাকিয়ে থাকে ফর্সা হয়ে আসা আকাশের দিকে। কাঠের উনুন প্রায় নিভে গেছে। উঠোনখানা ভর্তি হয়ে আছে হাতে গড়া ঠাম্মার চন্দ্রপুলিতে। “মেয়ে মানুষের এত কান্না কিসের? বুকে পাথর না বসাতে পারলে মেয়ে মানুষ হয়েছিস কী জন্য তুই? যা সাজি ভরে শিউলি ফুল তুলে নিয়ে আয়তো দিদিভাই। বোধনের পুজোতে লাগবে। সঙ্গে কয়েকটা চন্দ্রপুলি নিয়ে যা। যাকে ভালো লাগবে তাকে দিস। জীবনে বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই রে”। ইন্দুবালা শাড়ির আঁচলে বাঁধে চন্দ্রপুলি। সাজি নিয়ে সারা রাত না ঘুমোনো চোখে কন্যে চলে ফুল তুলতে। কিন্তু কোনদিকে যাচ্ছে সে? এ তো ভটচাজ পাড়া নয়। বিশালক্ষ্মী তলা পেরিয়ে সে যাচ্ছে মোক্তার পাড়ায়। কেন যাচ্ছে সে? অনেক ভোরে মোক্তার পাড়ার মাঠে শিউলি গাছটার নীচে কারা যেন সাদা চাদর মেলে বসে থাকে। সেই চাদরের টুকরোগুলো কুড়িয়ে সাজিতে ভরতে ভালো লাগে ইন্দুবালার। শরতের এই ভোরেও কেমন যেন হেমন্তের হাওয়া দিচ্ছে। শিরশির করছে গা। চারিদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে। থমকে দাঁড়ায় ইন্দুবালা শিউলি গাছটার সামনে এসে। কে ওখানে দাঁড়িয়ে? কে? এগিয়ে আসে মনিরুল। “এতো ভোরে এখানে কী করছিস?” কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছিল মনিরুল। যদিও সে জানতো এই গাছেরই ফুল কুড়োতে আসবে ইন্দুবালা। তাকে আসতেই হবে। সারা রাত তো ঘোরের মধ্যে এঁকেছে ইন্দুবালার চোখ। কাজল দিয়ে। টানা টানা। ইন্দুবালা ডাকে “মনিরুল…”। দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটা। এগিয়ে আসে ইন্দুবালা। মনিরুল বিড়বিড় করে। কোনো এক শরৎ সকালে জীবনের প্রথম ভালোবাসার জন্য মিথ্যে কথা বলে “আমি জানতাম না তুই এখানে আসবি…। আমি তো…।” ইন্দুবালা হাত দিয়ে চাপা দেয় মনিরুলের ঠোঁট। যেন ছ্যাঁকা লাগে মনিরুলের। এতো তাপ কীসের? ইন্দুবালার হাত কাঁপছে। সে তাকিয়ে আছে মনিরুলের দিকেই। “আমাদের ঠাকুর ঘরে নবদ্বীপ থেকে আনা অনেক পুরোনো একটা কেষ্ট ঠাকুর আছে। ঠাম্মার শাশুড়ি তার শাশুড়ির ঠাকুর সেটা। তুই তার মতো চোখ কেন পেলি রে মনিরুল? সারাক্ষণ আমার চোখে ভাসে।” আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়েছিল ঠোঁটের ওপর থেকে হাতটা। বাড়ি ফিরে কতবার সেই হাত নিজের ঠোঁটের উপর রেখেছিল ইন্দুবালা। তার আগে শাড়ির খুঁট খুলে মনিরুলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সারা রাত ধরে তার আর ঠাম্মায় মিলে করা চন্দ্রপুলি। “ঠাম্মা বলেছে যাকে ভালো লাগবে তাকে দিস”। আর একটাও কথা না বলে, একটাও শিউলি ফুল না কুড়িয়ে খালি সাজি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল মেয়ে। সেবার ইন্দুবালা বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছিল পুজোটা। ধুম জ্বরে দশমীর সকালে দেখেছিল তার জানলার কাছে রাখা আছে এক মুঠো শিউলি ফুল। ছোট্ট চিরকুটে লেখা ছিল, “মা দুগগা বললো যাকে ভালো লাগে তাকে দিও”। সেদিন মনিরুলের হাতের লেখা চিনতে একটুও দেরি হয়নি ইন্দুবালার। দুজনের ভালো লাগা কোনো এক শরতের সকালে চন্দ্রপুলি আর শিউলি ফুলে মিলে গিয়েছিল। তারও অনেক দিন পরে কোনো এক শরতের মন কেমন করা দিনে কপোতাক্ষের পলি কাদা মেখে পড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধা মনিরুলের দেহ। সে বছর সেই গ্রামে কোনো দুর্গাপুজো হয়েছিল কিনা জানেন না ইন্দুবালা। সেই বছর তো যুদ্ধ। নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন সবার চোখে। সেই চোখগুলো খুঁজে খুঁজে গঙ্গা জলে কালো তিল দিয়ে তর্পণ করেন ইন্দুবালা। পুজোতে তাই মন ভালো থাকে না তাঁর। পুজো কাটে বিষণ্ণতায়।

সকালে উঠে ধনঞ্জয় দেখে কাঁচের বয়ামে ভর্তি করে রাখা আছে চন্দ্রপুলি। ইন্দুবালা তখন কুচো গজা ভাজছেন। ঠিক করে রেখেছেন ওবেলায় লবঙ্গ লতিকা করবেন। ধনঞ্জয় বুঝতে পারে না এটা কি ইন্দুবালার পাগলামো না জেদ? “সারা রাত এইসব করে তুমি তো মরবেই। তোমার ছেলেরা আমাকে জেলে দেবে।” ইন্দুবালা কুচো গজা ছাঁকনি দিয়ে তুলে চিনির রসে ভিজিয়ে দিয়ে বলেন, “আহা ধনা তুই ওইভাবে বলিস না। ছেলে-মেয়েগুলো বিজয়ার পরে এসে একটু মিষ্টি মুখ করবে না? ওই যে চাঁদা তুলতে এসেছিল নন্টু পিন্টু। বাজারের লোকগুলো। কালেক্টার অফিসের বাবুরা। এদের একটু দেবো না হাতে তুলে?” হোটেল যবে থেকে শুরু হয়েছিল সেই বছর পুজো থেকেই বিজয়ার মিষ্টি শুরু করেছিলেন ইন্দুবালা। সেই সময়ে লছমী থাকতো। হাতে হাতে কাজগুলো করে দিত মাঝে মাঝে। দুই ছেলে, মেয়েও সাহায্য করতো অল্প স্বল্প। একটু বড় হলে তারা ঠাকুর দেখার নাম করে কেটে পড়তো যে যার মতো। শুধু ইন্দুবালা থেকে যেতেন একা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী কেটে যেত তাঁর রান্নাঘরে বিজয়ার মিষ্টি তৈরীতে। তাঁর না ছিল নতুন কাপড় পরা। না ছিল প্যাণ্ডেলে গিয়ে অঞ্জলি দেওয়া। সেসব তিনি বিয়ের আগে কলাপোতার কপোতাক্ষে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলেন অনেক দিন আগেই।

দশমীর সন্ধ্যেতে বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সামনে এক এক করে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। বড় খোকা আসে। ছোটো খোকা। তাদের বউরা। নাতি-নাতনি সবাই। প্রণাম করে। একতলা থেকে দোতলা সবাই হইচই করে দাপিয়ে বেড়ায়। মায়ের হাতে তৈরী চন্দ্রপুলি, কুচোগজা, লবঙ্গ লতিকা, নিমকি সবাই পেট পুরে খায়। ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যায়। ওরা সবাই গল্প করে। ওদের মাঝে বসেই ইন্দুবালা চুপ করে শোনেন সেই গল্প। কোথায় কোন ঠাকুর কত বড় হলো। কে প্রাইজ পেলো। তাঁতের সবচেয়ে দামি শাড়িটা পরতে গিয়ে বড় বউয়ের কী হলো? নাতি নাতনিরা কীভাবে পুজো কাটালো। কোথায় কত লোক হলো। অঞ্জলি দিতে গিয়ে পুরোহিত কেমন বাজে করে মন্ত্র পড়ছিল। ছোটো বউরা কোন রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে গিয়ে একেবারে মুখে তুলতে পারেনি এইসব। তার মধ্যে খুকি ব্যাঙ্গালোর থেকে ভিডিও কল করলে ওদের নিজেদের মধ্যে গল্প আরও বাড়ে। সবাই সবার সাথে কথা বলে। কিন্তু ওদের সবার মধ্যে বসে থেকেও ইন্দুবালার কিছু গল্প করার থাকে না। ছেলেরাও একবারের জন্যেও জানতে চায় না তাদের মা কোথাও গিয়েছিল কিনা। অঞ্জলি দিয়েছে কিনা। তারা জানে তাদের মায়ের ধর্ম কর্ম সব ওই একটিই। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। ঠাকুরের আপ্ত বাক্য যা সারা জীবন ধরে মেনে চলেছেন, “জীবে প্রেম’। আর কে না জানে খাওয়া ছাড়া প্রেম সম্পূর্ণ হয় না? তাই ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ নামের এক নির্জন দ্বীপে ইন্দুবালা সেই ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে রাখেন। সবাই আসে তাদের ভালোবাসা ভাগ করে নেয়। কিন্তু ইন্দুবালার কিছু ভাগ করার থাকে না। তিনি শুধু অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে। যারা বুঝতে পারে তারা একটু বেশি আনন্দ পায়। আর যারা খাবারের সাথে মজে থাকে তারা শুধু রসনায় মজা পায়। ভেতরের মানুষটার নয়।

অনেক রাতে শুতে এসে প্রতি বছরের মতো এই বছরেও ইন্দুবালা তার হিসেবের খাতা টেনে নেন। একটা সাদা পাতায় লাল কালিতে লেখেন ‘শুভ বিজয়া। সেটা যে কাকে লেখেন, কেন লেখেন আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।

কচু বাটা

বয়েস বাড়ার সাথে সাথে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে ইন্দুবালার জীবনে। যেগুলো আগে ছিল না। কিন্তু এখন আছে। সারাদিন এক নাগাড়ে কাজ করে বেড়ানো মানুষটার এখন বেলার দিকে একটু ঝিমুনি ধরে। ইদানিং ভাত খেয়ে উঠলে হয়। তখন ইন্দুবালার আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না। শরীর যেন আর চলে না। তার সাথে কলকাতার বাতাসে উত্তরের শিরশিরানি খেললে শরীরটা একটু রোদ চায়। হাত-পাগুলো মনে হয় রোদে পোহাই। কিন্তু সেই ফুরসত কি আছে ইন্দুবালার? তাঁর হোটেলে আসা মানুষগুলো তো সবে ভাত খেয়ে যে যার কাজে গেছে। দুপুরের পড়ন্ত রোদে তার একটা হিসেব রাখার আছে। কজন খেলো। কজন এলো না। কারা আবার ওবেলা আসবে। কাদের বাড়িতে পাঠাতে হলো। কাদের শুধু ঘন্ট আর পোস্তোর বড়া অর্ডার হলো। কতটা বাঁচলো। কতটা না। এইসব বিস্তারিত লেখালেখির একটা খাতা ইন্দুবালার আছে। সেই একাত্তর সন থেকে। এটা যদি হিসেবের খাতা হতো তাহলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এখানে টাকার অঙ্কে কিছু মেলানো থাকে না। যা থাকে তাতে আরও নানান কিছু যোগ হয়। এত পুরনো এক জাদা খাতা এতদিনে শেষ হয়ে যাবারই কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। তার কারণ বছর বছর ইন্দুবালা সেই খাতার সঙ্গে আবার পাতা জোড়েন। মোড়ের মাথায় গণেশ বাইণ্ডিং থেকে আগে হারান আসতো। পয়লা বৈশাখের আগের দিন সেই খাতায় বড় ঝুঁচ ঢুকিয়ে ফুটো করে জোড়া হতো পাতা। সেলাই করে আবার খাতার গায়ে জামা করে দিতেন ইন্দুবালা। সেই নতুন জামা আবার পরের বছরে পালটে যেত। গেলবার হারান চোখ বোজার পর তার ছেলে শিব আসে। ইন্দুবালা নিজে সেই খাতা নাড়া চাড়া করতে পারেন না এখন আর। ওপরের ঘরে টেবিলের ওপরে রাখা থাকে। প্রতিদিন সেই খাতায় ইন্দুবালা নানা কিছু লিখে রাখেন। তার সাথে ফুল তোলা নক্সা। সোয়েটারের মাপ। দিদা বলে ঝাঁপিয়ে পড়া ছেলে-মেয়েগুলোর ফোন নাম্বার, আরও কত হিজিবিজি।

ধনঞ্জয় বলে ওটা নাকি চিত্রগুপ্তের খাতা। বুড়ি পরপারে গিয়েও হিসেব মেলাবে। কিন্তু কী হিসেব, সেটা ধনঞ্জয় জানে না। বড় নাতনি সুনয়নী একবার দেখেছে সেই খাতায় আছে নানা রান্নার কথা। কিছু কিছু ইন্দুবালার কথাও। সেই যে গেলবার সে বিদেশ থেকে এসে তার ঠাম্মার কাছে থাকলে বেশ কয়েকমাস তখন এটা সেটা নেড়ে চেড়ে দেখেছে মেয়ে। আর অবাক হয়েছে। এতো সুন্দর গুছিয়ে লিখতে পারে তার ঠাম্মি? একটা সাদা কালো ছবিও পেয়েছিল সে খাতাটার মধ্যে। ইন্দুবালার বিয়ের আগের ছবি। কোনো এক নড়বড়ে স্টুডিওতে গিয়ে তোলা। তাঁকে দেখালে বলেছিলেন কলাপোতা থেকে নৌকা করে টাউনে গিয়ে কোনো এক স্টুডিওতে তুলেছিলেন ছবিটা। এই ছবি দেখেই নাকি তাঁর শাশুড়ি শেফালীরানীর পছন্দ হয়েছিল। সুনয়নী জানতে চেয়েছিল “আর দাদু? তিনি কিছু বলেননি?” ইন্দুবালা কোনো উত্তর দেননি নাতনির কথার। “কাজের সময় বিরক্ত করিস না” বলে বড়জোড় একটু ধমকে দিয়েছিলেন। সুনয়নী এই বাড়িতে তার দাদুর ছবি দেখেনি। এমনকি বাবা, কাকা, পিসি কারও কাছেই নয়। “কেমন ছিল দাদুকে দেখতে ঠাম্মি? কেন দাদুর ছবি একটাও নেই বাড়িতে?”পাগল করে দিত মেয়েটা প্রশ্ন করে করে। এমনকি বিয়ের একটা ছবি পর্যন্ত নেই কেন? আশ্চর্য হতো সুনয়নী। এটা কিছুতেই সে বুঝতে পারতো না থাকবে কী করে? সেই অজ গাঁয়ে কি আর ফটোগ্রাফার ছিল? খুলনা শহর থেকে কিংবা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতে হতো তাদের। ইন্দুবালাকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবার আর একটুও খরচ করার মতো অবস্থা ছিল না তখন। ছেলেকে পণ না দিতে হলেও মেয়ের গয়না গড়ার ছিল। ইণ্ডিয়াতে মেয়েকে পাঠানোর খরচ ছিল। তার সাথে আশেপাশে গ্রামের মানুষদের আপ্যায়ন, খাতির যত্নে কম খরচ হয়েছে নাকি? কাজেই কোনো ছবি ওঠেনি। এমনকি শ্বশুরবাড়িতে এসেও না। বউভাত হয়নি। লোকজন আসেনি। তাহলে আর ছবি উঠবে কোথা থেকে? ফুলশয্যার দিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন মাস্টার রতনলাল মল্লিক। তার পরদিন বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আবার বেরিয়ে গিয়েছিলেন। শাশুড়ি কতবার বলেছিলেন ছেলেকে, “রতন বৌমাকে নিয়ে একটা ফটো তুলে আয় বাবা”। আজ যাবো কাল যাবো বলে আর যাওয়া হয়নি রতনের। নিমতলা শ্মশানে যেদিন মড়ার খাট ধরে বসেছিলেন ইন্দুবালা, একটি সিঁড়িঙ্গে মতো লোক গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসে বলেছিল “কি গো মা ছবি তুলবে নাকি? শেষ স্মৃতি বলে কথা”। লছমীর মুখ ঝামটায় পালানোর পথ পায়নি সে। কাজেই ইন্দুবালার এই বাড়িতে তাঁর স্বামীর কোনো ছবি নেই। আলতা ছাপ পায়ের চিহ্ন নেই। যাবতীয় যা কিছু তিনি সেই শ্মশানেই অস্থির সাথে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার বংশরাই তো ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। ঠাম্মা, দিদা, মা বলে ডেকে চলেছে। জানতে চাইছে মাস্টার রতনলাল মল্লিকের ছবির কথা। এইসব কিছু ওই খাতায় লেখা নেই। ইন্দুবালা লেখেননি। নিজের মনের রাগ, দুঃখ, অভিমান, কষ্ট সেগুলো বড় আপনার। নিজের কাছেই রেখে দিতে হয়। না হলে যে মানুষটাকে তার বংশের কেউ দেখলো না জানলো না তার সম্পর্কে খারাপ কথা তাদের মনে বাজবে। ইন্দুবালা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের কাছে তার বাবার কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। নিন্দা মন্দও না। এই বাড়ির রেওয়াজ মেনে শুধু মৃত্যুদিন পালন হয়েছে। শাশুড়ির আমলে ব্রাহ্মণ খাওয়ানো হতো। সবাই চলে যাওয়ার পর ইন্দুবালা সেইসব প্রথা তুলে দিয়েছেন। অনেক দিন পরে সুনয়নী প্রশ্ন করলে একবার ভেবেছিলেন সব বলবেন। তারপর ভাবলেন থাক। যা মা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে এসেছেন তার দিকে ফিরে তাকাবেন না। ওটা নিজের কাছে খুব সংগোপনে থাক।

খাতাটা এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল সুনয়নীর সারাদিন সেটা নিয়ে বসে থাকতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো সব কিছু। দেখতো। নোট রাখতো তার আই প্যাডে। ঠাম্মিকে যেন একটু একটু করে চিনতে পারছিল সে। বারবার মনে হয়েছিল কেন আগে তার ঠাম্মিকে সে এত কাছ থেকে দেখেনি। কেন আরও অনেক অনেক কথা জানতে চায়নি। সবটা যে পেরেছিল তা নয়। কিন্তু সুনয়নী এটা বুঝেছিল তার চারপাশে দেখা মানুষগুলোর থেকে ইন্দুবালা কতটা আলাদা। চিন্তায়, ভাবনায়, জীবনে চলার পথে। এই খাতাটা নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল তার। একদম যেমন আছে এই জাবদা খাতাটা ঠিক সেই ভাবে যদি তাকে ছাপানো যায়। তাহলে তো একটা সময়ের ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। যে ইতিহাসের কথা কোন পাঠ্য বইতে লেখা থাকে না। এমনকি সমাজ ইতিহাসের গভীরে যাঁরা উঁকি দেন সেই সব গম্ভীর প্রবন্ধেও না। তার চেয়ে এই খাতাটা ছাপা হলে একজন একলা মহিলার পথ চলাটা বেশ পরিষ্কার ধরা পড়বে সময়ের নিরিখে। নিজের মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল সুনয়নী তার ঠাকুমাকে। এমনকি এটাও বলেছিল যেগুলো পছন্দ নয় সেগুলো রাখা হবে না বইটাতে। ইন্দুবালার একটুও পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। “হিসেবের খাতা কার কোন কাজে লাগে দিদিভাই? তুই আর নাড়াঘাঁটা করিস না ওটাকে। একেই যা অবস্থা।” সুনয়নী তবুও হাল ছাড়েনি। শেষ খড়কুটো আঁকড়ে থাকার মতো বলেছে, “অন্তত রান্নাগুলো ছাপাই। সবাই তো ভুলে গিয়েছে ঠাম্মি। তোমার মতো ছাঁচড়া কেউ রান্না করতে পারে? সেটাই না হয় জানুক লোকজন।” ইন্দুবালা হেসেছেন মেয়ের কথা শুনে। “ছ্যাঁচড়ার কথা কেউ পড়বে না দিদিভাই। তুই বরং তার লেখা পড়ার বই বার কর। সবাই পড়বে।” নাতনি থামতে চায় না। বারবার ফোন করে। বন্ধুদের দেখাবে বলে বায়না করে। ইন্দুবালা একদিন নিরুপায় হয়ে বলে দেন, “আমি আগে মরি, তারপর না হয় যা খুশি করিস তোরা”। এরপর আর কোনো কথা বলা যায় না। মোক্ষম বার্তাটা তাই এক্কেবারে শেষেই দ্যান। ইন্দুবালার হোটেলে যে কটা জিনিস সেই পুরোনো আমল থেকে রয়ে গেছে এই খাতা খানাও তার মধ্যেই পড়ে। সেটাকে কী করে তিনি বাইরের লোকের হাতে তুলে দেন? সুনয়নী পড়ছে পড়ুক। কিন্তু তার সাথে তার বন্ধু বান্ধবরাও পড়বে? রাজ্যের যত লোক জেনে যাবে ওই খাতাটার মধ্যে কী আছে। ওমা তাই কখনও হয় নাকি? ওর পাতায় যে জিরান দেওয়া আছে মনিরুলের বকুল ফুল। লছমীর বাড়ির তেজপাতা। তিন ছেলে-মেয়ের হাত ছাপ। অলোকের ফেলে যাওয়া নিষিদ্ধ ইস্তেহারের একটা পাতা। আরও যে কত কী, তা না দেখলে কল্পনাও করা যাবে না। অলোক খুব সুন্দর শিস দিয়ে একটা গান করতো। কীসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজে লাফিয়ে হই পার’। গানটাও লেখা আছে সেখানে। চোখ বন্ধ করেন ইন্দুবালা। সুরটা খোঁজার চেষ্টা করেন। পারেন না। কারেন্ট অফের সেই রাতগুলোকে হাতড়ান। কোথায় তারা? যে দিনগুলোকে ইন্দুবালা নিজেই ফিরে পান না, সেইসব কিছু তিনি দুহাত উজিয়ে দিয়ে দেবেন কী করে? থাকবার বলতে এইটুকুই তো তাঁর নিজের। স্মৃতির বিসর্জন মানে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া।

ধনঞ্জয় ছাদ থেকে কাপড় তুলতে এলে বুড়িকে দেখে মায়া হয় তার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে বুড়ি ঝিমোচ্ছে। মাথা নেমে এসেছে পায়ের কাছে। একটা বালিশ নিয়ে রোদটায় শুলে কী হয়? সারা জীবন কারোর কথা কোনোদিন শুনলো না। দুপুরের পর কতবার সে বলেছে “ওগো মা একটু এলিয়ে এসো দিকিনি গা খানা বিছানায়”। বুড়ি কথা শোনেননি। এত কাজ কাজ করে মাথা খায় বুড়ি যে কারো দম ফেলার সময় থাকে না। ঘর থেকে বালাপোশটা এনে বুড়ির গায়ে চাপা দেয় ধনঞ্জয়। যত্ন করে পায়ের ওপর দিয়ে টেনে দেয় তা। মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকে। যার সব থাকতেও কেউ নেই। যার ঘর আলো করা সংসার। দুই ছেলে, মেয়ে তাদের সব বাচ্চারা। হইহই করে মাথায় করে তুলে রাখতো তোমাকে। এইভাবে কেন এত কষ্ট করে আছো মা? একবার মুখ ফুটে বললেই তোমার সন্তানরা চলে আসবে তোমার কাছে। যা চাইবে তাই দেবে। রাজরানী হয়ে থাকবে মা। এক বিশাল সংসারের মধ্যমণি হয়ে। ভালো লাগবে না তখন? চাল ধুতে ধুতে ইন্দুবালা ধনঞ্জয়কে বলেছিলেন, “ওরকমটা সবার মনে হয় রে ধনা। বোঝাকে বেশিক্ষণ মানুষ ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে রাখতে পারে না। মনে হয় কতক্ষণে নামাবে সে মাটিতে। আমি কারো বোঝা হতে চাইনা রে”। ধনঞ্জয় কী বুঝেছিল কে জানে, শুধু সেদিন আর আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে যায়নি। বুড়ি নিজেই তার কাজ খুঁজে নিয়েছিল বিস্তর। যত খাটছিলেন ইন্দুবালা হোটেলকে নিয়ে, তত তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে দিকে। এবেলার রান্না কোনদিন ওবেলা কাউকে খাওয়াননি তিনি। কোনো খাবার নষ্ট হতে দেননি কোনোদিন। বেঁচে যাওয়া খাবার কোথায় কোথায় যাবে তারও একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা তৈরী করে ফেলেছিলেন। সেইসব মানুষগুলো আজও অনেক আশা নিয়ে বসে থাকে।

রান্নাঘরের উনুনটা এখনও আগের মতো নিজের হাতেই পরিষ্কার করেন। মাঝে মাঝে ধনঞ্জয় করে না এমনটা নয়। কিন্তু নিজে করলে সুখ পান ইন্দুবালা। যত্ন করে মাটির প্রলেপ বোলান উনুনের গায়ে। আজকের উনুন? কত জন্ম জন্মান্তর ধরে মল্লিক বাড়ির লোকজন এই উনুনে চাল ফুটিয়ে দুবেলা ভরপেট খেয়েছে। রান্না তো আর শুধু রান্না নয়। যেন অগ্নিকে উপাসনা। আঁচের একটু এদিক ওদিক হলে সব ভণ্ডুল হবে। নড়ে চড়ে বসে বুড়ি। বালাপোশের গরমে আরাম পেয়েই হোক কিংবা ঝিমিয়ে পড়া দুপুরে ঘুমন্ত আঁচের কথা ভাবতে ভাবতেই হোক ইন্দুবালার ঘুম কাটে। সামনে দেখেন হাঁ করে চুপটি করে বসে আছে ধনঞ্জয়। মুখের দিকে তাকিয়ে। ইন্দুবালা হাসেন। “এখনও বেঁচে আছি রে ধনা। মরিনি। এই দ্যাখ শ্বাস প্রশ্বাস চলছে এখনও”। বিকেলের শেষ আলো তখন জানলার ওপর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। ইন্দুবালা হুড়মুড় করে উঠতে যান। “আমার না হয় ভিমরতি ধরছে তাই বলে তোর কোনো আক্কেল জ্ঞান থাকবে না? বেলা যে পড়ে এলো। কাজ কত বাকি তার কি খেয়াল আছে?” ইন্দুবালা চাটাই গোটান। বালাপোশ ভাঁজ করেন। ধনঞ্জয় সুড়সুড় করে সরে পড়ে সেখান থেকে। বসে থাকলে বুড়ির গজগজ কানে শেলের মতো বিধবে। তখন আবার দুটো কথার উত্তর না দিয়ে ঝগড়া না করে স্বস্তি পাওয়া যাবে না।

ইন্দুবালার কাজের কোনোদিন শেষ বা শুরু বলে কিছু নেই। সারাদিনটাই পড়ে থাকে কাজের জন্য। দুপুরে সব খদ্দের খেয়ে চলে গেলে আনাজ দেখে, মিলিয়ে কী কী আনতে হবে আর না হবে তার একটা ফর্দ করার থাকে। রাতের রান্না কী হবে তাও ভাবতে হয়। সেই মতো ধনঞ্জয়কে নানা কিছু বলার থাকে। কী কী ভেজাতে হবে। ছোলা, মটর, বাদাম, হিঙ, কিসমিস, কাজু। কী কুটনো কাটতে হবে। কোন রান্নাটা গ্যাসে হবে আর কোনটা উনুনে। কয়লা আর গ্যাস ঠিক আছে কিনা। মানে যার যেমন দিনের বরাদ্দ সেটাই আছে কিনা। মাঝপথে ফুরিয়ে যাওয়াটা অলুক্ষুণে। কাজেই আগে ভাগে সব দেখে রাখা চাই। ইন্দুবালা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। এতটুকু এদিক ওদিক হবার জো নেই। যদি কোনোদিন ইন্দুবালার সাথে সারাদিন ঘুর ঘুর করা যায়, তাঁর হেঁশেলে উঁকি দেওয়া যায় তাহলে একটা দিনলিপি লেখার ইচ্ছে করবে। এমন যে কেউ করেনি সেটাও বলা যায় না। অনেক কাগজেই ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের কথা ছাপা হয়েছে। তার সাথে তার বড় বড় দুটো উনুন, গ্যাস, সেই প্রাচীন শিলনোড়া, মশলা রাখার বাক্স, পেল্লাই সাইজের ভাতের ডেকচি, হাঁড়ি, কড়াই, রান্নার ছবি, খাবারের ছবিও ছাপা হয়েছে। শুধু যদি এটা হতো তাহলে তো কথাই ছিল না। এমনটা তো অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। এই শহরে তার উদাহরণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি। কিন্তু যেটা হয়নি সেটা হলো একদল মানুষ সে বুড়ো থেকে শুরু করে ছেলে মেয়ে বাচ্চাকাচ্চা সমেত এতো হুজুগ একটা ভাতের হোটেলকে নিয়ে খুব কমই হয়েছে। যারা অনেক দূরে থাকে বা অনেক কাছে, যারা কলেজে পড়ে, হোস্টেল বা মেসে থাকে, যারা অফিস করে, ব্যবসা করে মানে যারাই ইন্দুবালার সংস্পর্শে একবার এসেছে তারা আবার ইন্দুবালাকে যেন দুচোখে হারায়। ফলে এই যুগে চ্যাটাং ট্যাটাং করে কথা বলা ছেলে মেয়েগুলো ফেসবুকে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের একটা কমিউনিটি পর্যন্ত খুলে ফেলেছে। সেখানে যেমন প্রতিদিনের মেনু আপডেট হয় ঠিক তেমনই রান্নার ছবি থাকে। তার সাথে সেই রান্নার গল্প। এমনকি সেই দিন ইন্দুবালার মেজাজ কতটা উনুনের আঁচের সাথে ওঠানামা করছে সেটাও। কত কত মানুষ যে এই পেজ লাইক করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ইন্দুবালার কাছে তাদের ভাত খাওয়ার কথা লিখেছে। গল্প লিখেছে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্বজন-পরিজন ছেড়ে চলে আসা এক অচেনা অজানা শহরে শুধুমাত্র একটা ভাতের হোটেল কীভাবে তাদের বাড়ির কথা, মায়ের কথা, ঠাম্মার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে সেই নিয়ে ভুরি ভুরি লেখা আছে। কমেন্ট আছে। জাঁকিয়ে চলছে গ্রুপটা।

ইন্দুবালা এতো কিছু জানেন না। তাঁর ইচ্ছেও করে না এইসব নিয়ে মাতামাতি করতে। হোটেলে অনেক কাজের মধ্যে তিনি অন্য কিছু যেন ভাবতেও পারেন না। তবুও কি ভাবতে হয় না তাঁকে? হয়। এই ফেসবুকের পেজ হওয়ার পর থেকে নানা রকমের বিপদ নানা দিক থেকে আসতে থাকে। এই যেমন সেদিনকে সবে রোদে পা ছড়িয়ে একটু ঝিমোতে বসেছেন অমনি সামনের মেসের নতুন মেয়েটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চশমার ভেতর থেকে গোল গোল চোখ করে বললো “তুমি কচু বাটা কেন আর করো না ঠাম্মা?” ইন্দুবালা ঝিমোচ্ছিলেন। ঘোর লাগা চোখে বোঝার চেষ্টা করেন কী বলছে মেয়েটা। “কোথায় থাকো? খাওয়া হয়েছে? খিদের পেটে কচু খাবে কেন? ধনাকে বলো ভাত গরম করে দেবে। আর অবেলায় ভাত খেতে ইচ্ছে না করলে রুটি করে দেবে। চাও যদি বেগুন পোড়াও খেতে পারো। অল্প করে কুলের তেল দিয়ে মেখেছি। গন্ধ হয়েছে বেশ”। মেয়েটা আরও চোখ গোল গোল করে বলে “ধুর তুমি কি সব ভুলে যাও নাকি ঠাম্মা? এই তো খেয়ে গেলাম। রুটি না খেলেও বেগুন পোড়া ছাড়বো তুমি ভাবলে কী করে? খেয়েছি। কী করে যেসব অদ্ভুত জিনিস মাথা থেকে বার করো বেগুন পোড়ায় কুলের তেল। জাস্ট ফাটাফাটি”। ইন্দুবালা হাসেন।

বড় বড় বয়ামে কুল জিরানো থাকতো তেল দিয়ে। ঠাম্মার যে কত রকমের আচারের আহ্লাদ ছিল। প্রত্যেক ঋতুতে আলাদা আলাদা ফল। তাদের আচার। তার সাথে তেল। সেই তেল আবার রান্নার সাথে মেশানো। “সে অনেক ঝক্কি ঝামেলার কাজ। আমি অত পারি না। তা কোথায় থাকো তুমি?” মেয়েটা হাত তুলে দেখায় “ওই তো রাস্তার ওই দিকের মেসে থাকি। সঞ্চারী। খাতায় যে নাম লিখলাম”। ইন্দুবালা এগোন রান্নাঘরের দিকে। “বাহ সুন্দর নাম তো সঞ্চারী। কে রেখেছিল, মা?” সঞ্চারী বলে “ধুর…মা রাখবে কোথা থেকে? সে তো জন্মের দিনই মারা গেছে”। থমকে দাঁড়ান ইন্দুবালা চৌকাঠের কাছে। ঘুরে তাকান মা মরা মেয়েটার দিকে। সঞ্চারী এগিয়ে আসে। “বাবা দিয়েছিল নাম। তা বাবাও এখন আর নেই। একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল। চলে গেছে। মামা-মামীর কাছে থাকি। মানে ওরা আমাকে দেখে। লোকাল গার্জেন। এমনিতে আমার কেউ নেই জানো। কিন্তু অনেক অনেক বন্ধু আছে। এখন তো কলেজ। তাই মেসে থাকতে হয়”। বকবক করে সরলতায় ভরা চোখ মেয়েটা। ইন্দুবালা কিছু বলেন না। এগিয়ে যান রান্নাঘরের দিকে আস্তে আস্তে। পেছনে থাকে সঞ্চারী।

প্রত্যেকদিন এই হোটেলে যারা খায় তাদের একটা মাসিক টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। নিজেরাই খাতায় নাম লেখে। নিজেরাই হিসেব রাখে। ওই দেনা পাওনার হিসেব ইন্দুবালাকে কোনো দিন মেলাতে হয়নি। কোনো দিনই না। তাঁর পয়সা মেরে দিয়ে পালানোর লোকের সংখ্যা হাতে গোনাও যাবে না। ইন্দুবালা মনেও রাখেন না। দু মুঠো ভাত খেয়ে যার ইচ্ছে হয় পয়সা দেবে। যার ইচ্ছে না হয় দেবে না। ঠাম্মার কথাগুলো আজও তাঁর কানে বাজে। মহাভারতের সেই কবেকার পুরোনো বইটা খুলে গড়গড় করে পড়ে চলতো। “বনপর্বে যুধিষ্ঠির কী বলছে জানিস? শোন ইন্দু। সব তো আমাদের ঘরের কথাই লিখে গেছে। মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম হল মোদ্দা কথায় অপর মানুষের সেবা করা। সেই সেবা কেমন? যেমন ধর যুধিষ্ঠির শুধু বলছেন না। মনে করিয়ে দিচ্ছেন” অন্ধকারে প্রদীপ জ্বলছে টিম টিম করে। কাঠের উঁচু পাটাতনের ওপরে রাখা কবেকার মহাভারত। ধূপ দানিতে ধূপ, মাটির ধুনুচিতে ধুনো সব জ্বলছে। বারকোষে রাখা সন্ধ্যামণি ফুল। ঠাম্মা সেই ঘোর লাগা পরিবেশে যুধিষ্ঠিরের কথা উচ্চারণ করছে, “সাধুগণের গৃহে তৃণ, ভূমি, জল, ও সুশৃতবাক্য এই চারি দ্রব্যের কোনোকালেই কোনো অপ্রতুল থাকে না। গৃহস্থ ব্যক্তি পীড়িত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্রান্ত ব্যক্তিকে আসন, তৃষিত ব্যক্তিকে পানীয়, ক্ষুধিত ব্যক্তিকে ভোজন ও অভ্যাগত ব্যক্তির প্রতি নয়ন, মন ও প্রিয় বচন প্রয়োগ এবং উত্থান পূর্বক আসন প্রদান করিবে। ইহাই সনাতন ধর্ম।” ঠাম্মা যেন বারবার মনে করিয়ে দিত মানুষকে সেবা করে আরাম পাওয়া যায়। মনের আরাম। ইন্দুবালা কি সেই জীবে প্রেম করছেন না? কোথায় করছেন? এটা কি জীবে প্রেম? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজেন ইন্দুবালা। আর ঠিক তখনই ঘোর কাটে, “কি গো ঠাম্মা কচুবাটা করবে কিনা বলো”। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা নাছোড়। ইন্দুবালা রাতের আনাজ মিলিয়ে দেখছিলেন। রোদটা আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঘুরছে। এবার ছাদের আলসের মাথায় চড়ে এক্কেবারে হারিয়ে যাবে। আর দেখা যাবে না। “ওইদিকের বড় ঝুড়িখানায় দেখতে গোটা বিশেক আলু আছে কিনা?” সঞ্চারী গোনে ঠিক বাচ্চাদের মতো করে। ইন্দুবালা মশলার বাক্স হাঁটকান। দেখে নেন সব ঠিক করে। সঞ্চারী এগিয়ে আসে। “বিশটারও বেশি আলু আছে”। ইন্দুবালা বিড়বিড় করেন, “তাহলে আনাতে হবে আরও। সর দেখি ধনাকে বলি”। সঞ্চারী হাত ধরে নেয় ইন্দুবালার। “বললে না তো কচুবাটা করো না কেন এখন?” ইন্দুবালা বঁটিখানা নিয়ে এসে আলুর খোসা ছাড়াতে বসেন। “ওইসব আমি করেছি নাকি কোনোদিন? তোর পড়াশুনো নেই? যা গিয়ে পড়তে বোস। আমাকে কাজ করতে দে”। সেই মেয়েও ছাড়বার নয়। “কচুবাটা করোনি মানে? এই দেখো ফেসবুকে একজন লিখেছে নারকেল আর কাঁচা লংকা দিয়ে তোমার হাতের কচুবাটা যে খায়নি সে তো ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের কিছুই জানে না”। এবার একটু বিরক্ত হন ইন্দুবালা। “এইসব আবার কে লিখেছে? তোরাই বা এইসব লিখতে বলিস কেন?” মেয়েটা অবাক হয়। “আমরা লিখতে বলেছি নাকি? এই যে দেখো অমলেন্দুবাবু কৃষ্ণনগরে থাকেন। কলেজে ফিজিক্স পড়ান। তিনি লিখেছেন। এখানে থেকে পড়ার সময় এইট্টিজে রোজ ভাত খেতে আসতেন তোমার হোটেলে। চিনতে পারছো?” ইন্দুবালা মেয়েটার ফোনের মধ্যে থেকে একটা অস্পষ্ট মুখ দেখেন। “এতো কিছু কি মনে থাকে দিদিভাই? কত লোকতো আসে। কত লোক চলে যায়। মেয়েটা শুনবে না। “ওসব জানি না কিছু। কচুবাটা খাওয়াতে হবেই হবে। আমি আজই লিখে দিচ্ছি ফেসবুক পেজে তুমি আবার কচুবাটা খাওয়াচ্ছো আমাদের। বুঝলে?”

ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের নোনাধরা সিমেন্টের কালো বোর্ডটা যে কবে থেকে ফেসবুকের বোর্ড হয়ে গেছে ইন্দুবালা সেটা জানেন না। জানার কথাও না। এখনকার ফোন ইন্দুবালা ব্যবহার করেন না। তাঁর আছে সেই কবেকার ল্যাণ্ড লাইন। সরকারের ফোনের ব্যবসা লাটে উঠলেও ইন্দুবালা সেই ফোনে আজও কাজ চালান। ছেলেরা, মেয়েরা ওই ফোনেই মায়ের খবর নেয়। ইন্দুবালা দুটো কথা বলে শান্তি পান। তবে এই এখনকার ছেলে মেয়েদের ফোন ব্যবহার না করলেও তিনি বুঝতে পারেন এর মাহাত্ম কী! ওখানে কিছু লেখা হয়ে গেলেই গোটা বিশ্বের লোক জানতে পারবে। আর ঠিক তখন থেকেই বাড়বে উৎপাত। সেই কবেকার পুরোনো ল্যাণ্ড লাইন ফোনটা আবার বাজতে থাকবে। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। বাড়ির সামনে ভিড় হবে। দশ জনের বদলে একশোজন ভাত খেতে চলে আসবে। পাড়ার লোক বিরক্ত হবে গাড়ি রাখার জায়গা পাবে না বলে। ধনঞ্জয় বড় খোকা, ছোট খোকা, খুকি সবাইকে ফোন করবে। নালিশ জানাবে। আর কেউ না আসুক বড় খোকা এসে বসে থাকবে ঠায়। নজর রাখবে। তাকে নজরে রাখার জন্য তার বাড়ি থেকে বউ ফোন করবে। ছেলে ফোন করবে। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এইসব ভেবেই শীত আসা সন্ধ্যেয় ইন্দুবালা ঘামতে শুরু করেন। আগে এমন হতো না। কেউ খেতে চাইলেই ইন্দুবালার আনন্দ হতো। এখনও হয়। কিন্তু এত বড় হয়ে যায় ব্যাপারটা সব কিছু ইন্দুবালা যেন সামলাতে পারেন না। তবুও বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না বুড়ির। এখনও সাধারণ দিনে ভাতের হোটেলে পাত পড়ে কম করে তিনশো মানুষের। বুড়ি এই বয়সে উনুনের সামনে এসে যখন কড়াই পেতে দাঁড়ান সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা মেনে গড় করে অনেকে।

“কী হলো? কিছু বলছে না যে?” সঞ্চারী তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। ইন্দুবালার মুখে হাসি ফোটে। “কোথা থেকে আমার ঠাম্মার মতো অমন চোখ পেয়েছিস বলতো? আর অমন পাড়া গেঁয়ে বিধবাদের মতো চুল কেটেছিস কেন?” সঞ্চারী বলে “ইশ। পাড়াগেঁয়ে বিধবাদের মতো লাগছে নাকি? কত টাকা দিয়ে চুল কেটেছি জানো? শুনলে মামা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। কেন খারাপ লাগছে দেখতে?” ইন্দুবালা হাসেন। “মোটেই না। মিষ্টি লাগছে। মামা না হয় চুল কাটার দাম জানতে পারলো না। কিন্তু এই যে দিন নেই রাত নেই মেসের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ফস ফস করে সবাই মিলে সিগারেট টানা হয় সেটার কথা জানে তো?” মেয়েটা জিভ বার করে। “তুমি কি সব খেয়াল রাখো ঠাম্মা?” ইন্দুবালা হাসেন। “একদিন সময় করে নিশ্চয়ই কচুবাটা খাওয়াবো দিদিভাই। কিন্তু আজকে ওই সব তোমাদের কি সব পেজ-টেজে লিখোনা কিছু কেমন?” মেয়েটা বলে “কেন লিখলে কী হবে?” ইন্দুবালা বোঝান। “আগে ওই নরম কচুটাকে আমায় পেতে হবে তো। সেই শহর কি আছে? বললেই কেউ ছাই গাদায় হওয়া একটা কচু গাছ অমনি উপড়ে নিয়ে চলে আসবে? আর যে সে কচু হলে তো হবে না। সেই মানকচুর ভেতরে দুধে টইটম্বুর হতে হবে। গাছ দেখলে বুঝতে হবে গর্ভিনী সে। অনেক তরিজুত করে তাকে তুলতে হবে। রান্না করতে হবে। তবেই না অনেক দিন পর তুইও আমাকে মনে রাখবি? তখন হয়তো কোনো বিদেশ বিভুই থেকে আমার কথা লিখবি”। এই ভর সন্ধ্যে নামার আগে এক অচেনা মেয়ের চোখ চিক চিক করে ওঠে। “আমি কোথাও যাবো না ঠাম্মি। কোথাও না। আমি শুধু ওই মেসবাড়িটায় থাকবো আর তোমার রান্না খাবো”। ছুট্টে চলে যায় সঞ্চারী। অমন ছলছল চোখ করে একদিন ইন্দুবালাও বলেছিল সে কলাপোতা ছেড়ে কোথাও যাবে না। কোনোদিন না। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন। ঠাম্মা বলেছিল “মেয়েদের প্রাণ হল কই মাছের জান। কত কী যে করতে হবে আর দেখতে হবে জীবনে। এই ছোট্ট গ্রামটায় আমার মতো কেন পড়ে থাকবি বলতো?” সবে শীত আসা সন্ধ্যেয় কবেকার ঠাম্মার মুখ মনে করায় এক অচেনা ছোট্ট মেয়ে। কার বেশ ধরে এসে তুমি আমার কাছে আজ খেতে চাইছে ঠাম্মা? আমি যে বড় বুড়ি হয়ে গেছি। তোমার ইন্দু যে আগের মতো আর নেই গো। চোখ থেকে জল পড়ে। ধনঞ্জয় ঘরে এলে বুড়ি চোখ মোছে। “একটু পরে দেওয়া যেত না আঁচটা? ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে গেল যে ধনা”।

লছমীও মাঝে মাঝে এমন ছলছল চোখে তাকাতো। কী হয়েছে জানতে চাইলে কিছুতেই বলতো না। স্বামীটা যে তার কোথায় পালিয়েছিল কেউ জানে না। অতগুলো বাচ্চা নিয়ে লছমী সেই কতদূর থেকে মাছ নিয়ে এসে বাজারে বিক্রি করতো। ইন্দুবালা বুঝতে একজন একা থাকা মানুষই বুঝতে পারে আর একজনের একার লড়াইয়ের মর্ম। ওরা যেন দুজনে দুজনের পরগাছা হয়ে জড়িয়ে থাকতো একে অপরকে। খুব টানাটানির সময়ও কিছুতেই লছমীকে টাকা পয়সা দেওয়া যেত না। ইন্দুবালার হোটেল শুরু হবার পর লছমীর কোচড়ে বেঁধে দিত তার ছেলে মেয়েদের জন্য খাবার। লছমী নেবে না কিছুতেই। ইন্দুবালা বলতো এক মা তার সন্তানদের দিচ্ছে। তুই নিবি না তো? লছমী তার প্রতিদানে ফিরিয়ে দিয়ে যেত অনেক কিছু। মাছ ছাড়াও কচু, মেটে আলু যেগুলো চট করে বাজারে পাওয়া যেত না। কবে সে যেন একবার নিয়ে এলো কোথা থেকে জোগাড় করে চুইঝাল। ইন্দুবালার সেদিন যেন সারাদিন ঘোরের মধ্যে কাটলো। এক টুকরো খুলনাকে যেন লছমী বয়ে নিয়ে এলো আঁচলে করে। ইন্দুবালা কিছুটা রান্না করলেন চুইঝাল দিয়ে। একটু তুলে রাখলেন। আর বাকিটা বসিয়ে দিলেন নারকেল গাছের কাছে। ভাবলেন একবার যদি চুইঝাল গাছটা বেঁচে যায় তাহলে তিনি সেটাকে নারকেল গাছে ওঠাবেন। আর সব রান্নায় চুইঝালের মিষ্টি গন্ধে ভরিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। বাঁচেনি গাছটা। সেও হয়তো বুঝেছিল উদ্বাস্ত হয়ে বাঁচার দায় অনেক।

একটা সময় ছিল যখন লছমী নানা রকমের খবর রাখতো। কার বাড়িতে কচু হয়েছে। কার বাড়িতে লাউ। কে কুমড়ো শাক ফেলে দিতে চায়। সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আসতো লছমী। এই হোটেল মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে লছমীর অবদান কম নয়। ও না থাকলে আজ এই হোটেল হতোই না। এক মাছওয়ালী কেমন যেন ইন্দুবালার মনের কথা সব জেনে যেতো। টের পেত ইন্দুবালা কী ভাবছে। “তুই কি ঝাড়ফুক তুকতাক জানিস লছমী?” বারান্দায় পা ছড়িয়ে বেলা শেষে বাড়ি যাওয়ার আগে গল্প করতো সে। “ওইসব জানলে সেই কোথা থেকে এসে মাছের টুকরি নিয়ে দোরে দোরে ফিরি মা?” ইন্দুবালা ভাবেন তাও ঠিক। তাঁর গল্প লছমী জানে। কিন্তু লছমীর গল্প তাঁর তো জানা নেই। এমনকি লছমী কোথায় থাকে সেটাও জানেন না ইন্দুবালা। “এই লছমী তোর বাড়ি কোথায় রে?” লছমী হাসে। “কেন তুই যাবি?” ইন্দুবালা বলেন “হাঁ যাবো। তুই আগে বল কোথায় থাকিস?” লছমী বলে “শোনো তাহলে। এখান থেকে ইস্টেশন”। ইন্দুবালা বলেন “মানে শিয়ালদা?” লছমী ঘাড় নাড়ে। “হ্যাঁ গো। সেখান থেকে ক্যানিং লোকালে চড়ে একেবারে লাস্ট স্টেশনের আগে তিনটে স্টেশন। ওখান থেকে আবার রিক্সাভ্যান। চল যাবি আজকে?” হাসে লছমী। ইন্দুবালা বলেন “আজ তো যাবো না। তোকেও যেতে দেবো না। এতো দূর থাকিস তুই? একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। তার ওপরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। থেকে যা লছমী। এই শীতের দিনে নাই বা এতটা দূরের পথে বাড়ি গেলি?” লছমী অবাক হয়ে বলে “হাই রাম। কী বলছিস তুই মা? বাড়ি না গেলে মাছ আনবো কী করে? মাছ না আনলে খাবো কী? তুই হোটেল চালাবি কী করে?” লছমী সেই শীতের বাদলে বেরিয়ে যায়।

অনেক সকালে এসে দরজা হাটকায় লছমী, “মা..ওই মা..এখনও তুই শোয়ে আছিস?” ইন্দুবালা বেরিয়ে দেখেন মাছের সাথে একটা মস্ত মানকচু। “তুই এটার কথাই বলেছিলিস না মা?” ইন্দুবালা অবাক হয়ে যান। “এটাকে কোথায় পেলি তুই?” লছমী বলে যায় “সে অনেক বড় গল্প আছে মা। বাজার ফেরতা পথে বলবো।” লছমী চলে যায়। দুই ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে ইন্দুবালা কচু কাটতে বসেন। সেগুলোকে জলে ভেজান। কুরনি নিয়ে এসে টুকরোগুলো কুরতে বসেন। ধনঞ্জয় নেয়ে ধুয়ে এসে ভীষণ চোটপাট করতে শুরু করে। কোনো সহজ রান্না তোমার হেঁশেলে নেই না? একে কচু। তার ওপর এই নারকেল। কী হবে শুনি?” ইন্দুবালা গম্ভীর হয়ে বলেন, “কয়লার বস্তার মুখ ঢেকেছিলি কাল রাতে? সব তো জলে চিপসে হয়ে গেছে। রান্না হবে কী দিয়ে? লছমী কচু না আনলে লোকগুলো ফিরে যেত। অনাচ্ছিস্টি হতো। এখন কথা না বাড়িয়ে উনুন ধরাও গে। দেখো ঠাকুরের কৃপায় ভাতটা হয় কিনা”। ধনঞ্জয় কথা বাড়ায় না। নিজে ভুল করেছে। কয়লার বস্তা ঢাকেনি। ভিজে গেছে সব। মাথা নীচু করে উনুন ধরাতে চলে যায় ধনঞ্জয়।

ইন্দুবালা কুরনিতে কচু আর নারকেল কোরান। সেই কচু আর নারকেল সরষে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বড় শিলটায় বাটতে থাকেন। চারপাশটা ভরে উঠতে থাকে এক বুনো গন্ধে। অনেকদিন পর খুলনার কলাপোতা যেন হাতছানি দেয় তাঁকে। ইন্দুবালাকে ডাকে বোসপুকুরের পাশে বাঁশঝাড় পেরিয়ে কচু বন। শীতের অবেলার বৃষ্টি। মাথায় দুটো বড় কচুপাতা নিয়ে দুই ভাইবোন কচু তুলতে যায়। গা হাত পা চুলকোয়। মা বকে। ঠাম্মার কাঁদো কাঁদো মুখটা আজও কেমন যেন মনে পড়ে যায় ইন্দুবালার। জ্বরের পরে স্বাদহীন মুখে খেতে চেয়েছিলেন কচুবাটা। মাকে বলেননি। জানেন এই বাদলায় কিছুতেই তিনি ইন্দুবালাকে পাঠাবেন না। ইন্দুবালাকে ডেকে বলেছিলেন “নিয়ে আসবি নাকি ইন্দু? বোসেদের বাগান থেকে একটা কচু তুলে?” ইন্দু না বলতে পারেনি। ভূতের ভয় ছিল তার। তাই ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু ইন্দু চিনবে কী করে ভালো মানকচু? সেসব তো অনেক দিন আগেই ঠাম্মা নিজে হাতে করে শিখিয়েছে। “চারপাশ থেকে ছড়ার মতো পাতা যার বেরিয়েছে। ফুলের মতো হয়ে আছে গাছ। সে জানবি গর্ভবতী। মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছে সন্তানকে। তার মধ্যে টইটম্বুর দুধ। গোড়ায় ডেউ পিঁপড়েগুলোকে দেখেছিস? লোভীর মতো কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে?” ঠাম্মা বড় শাবল নিয়ে এসেছিলেন। ভিজে মাটিতে তাড়াতাড়ি বসে যাচ্ছিল শাবল। উঠে আসছিল ঘন কৃষ্ণকায় মাটি। গর্ত যত গম্ভীর হচ্ছিল দেখা যাচ্ছিল শিকড়টাকে। যেখানে লুকিয়ে রেখেছে তার খাবার। একটু পরেই মাটি খুঁড়ে গর্ত করে কচু বের করা হল। গায়ে শক্তি ছিল বুড়ির। সেই কচু কেটে বেটে গাঁ সুষ্ঠু লোক খেলো। আর আজ ঠাম্মার জ্বর। তাকে মা একটু কচু বেটে দিতে পারছে না? ভাইটা পাশে দাঁড়িয়ে খালি গা চুলকোচ্ছে। কচুর রস লেগে লাল হয়ে গেছে তার হাত পা। চুলকোতে চুলকোতে ফুলে গেছে হাতের ওপর দিকটা। তার সাথে মা গাঁ মাথায় করছে চিল চিৎকার করে। “বুড়ির মরার সময় এল, নোলা গেল না”। ইন্দুবালা চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢোকে। পিঁড়ি পেতে বসে। কচু কেটে, কুরে বাটতে বসে। কচুর ওপর ছড়িয়ে দেয় কাঁচা তেল। অনেক দিন পর দুপুর বেলা ধোঁয়া ওঠা ভাতে কচুবাটা খেতে বসে ঠাম্মার চোখে জল। সেটা কাঁচা লঙ্কা সর্ষের তেলের? নাকি আনন্দের বুঝতে পারে না ইন্দুবালা। খাওয়া হয়ে গেলে এক পরিতৃপ্তির মুখ নিয়ে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালাকে। তার হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে কীসব বিড়বিড় করে বলেন। আশীর্বাদ করেন। ঠাম্মা কি জানতো একদিন ইন্দুবালাকে এই হাত দুটোই বাঁচিয়ে দেবে? তারই কি ডাল সাঁতলানোর প্রস্তুতি সেরে রাখছিল ঠাম্মা?

বিকেলের দিকে চাদর গায়ে দিয়ে ইন্দুবালাকে বেরোতে দেখে পথ আটকায় ধনঞ্জয়। “চললে কোথায় শুনি?” ইন্দুবালা বলেন “হেতালের মাকে একটু বলে আসি। যদি একটু কচি কচু পায়”। ধনঞ্জয় রেগে যায়। “সেটা কাল সকালে বললেও হবে। এক্ষুনি সন্ধ্যে নামবে। রাতে ভালো দেখতেও পাও না। আমি হোটেল ছেড়ে বেরোতে পারবো না। একা কী করে যাবে শুনি?” ইন্দুবালা ধনঞ্জয়ের নাক ফোলানো দেখে হাসেন। “জানিস না আমার যে একজোড়া বেড়ালের চোখ আছে। রাতেও দেখতে পায় ভাল”। ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়। “কচুবাটা করতেই হবে? যে যা বলবে তোমাকে তাই করতে হবে? না বলতে পারো না তুমি, তাই না?” ইন্দুবালা বলেন, “ওমা সে কী কথা! মেয়েটা মুখ ফুটে একটু কচুবাটা খেতে চেয়েছে, না বলবো কী করে?” ধনঞ্জয় চিৎকার করে। “তুমি কিন্তু বলেছিলে লছমী মারা যাওয়ার পরে এই বাড়িতে কচুবাটা হবে না”। কেমন যেন ধাক্কা খান ইন্দুবালা। সন্ধ্যে নামছে সবে শীত আসা শহরে। ছেনু মিত্তির লেনে যে কটা পুরোনো বাড়ি রয়ে গেছে, যেগুলো এখনও ফ্ল্যাট হয়ে যায়নি সেগুলোর জানলা বন্ধ। অনেক উঁচু উঁচু

ফ্ল্যাটগুলোতে বাইরে থেকে বোঝা যায় না সেখানে মানুষ থাকে কিনা। কিংবা থাকলেও প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। মাঝে মাঝে কাপড়জামা জানলা কিংবা বারান্দায় ঝুললে বোঝা যায় ওখানে কেউ বাস করে। ইন্দুবালার এই মুহূর্তে নিজেকে বড় একা মনে হয়। কবেকার লছমীর কথা মনে পড়ে যায়। সারাক্ষণ চারপাশে যাদের সাথে কথা বলেন তাদের মধ্যে যে লছমী নেই সেটাই ভাবতে পারেন না তিনি। চান না। কেন তিনি এতদিন বেঁচে আছেন এই ভাবনা মাথায় চাগাড় দেবার আগেই হনহন করে হাঁটতে থাকেন ইন্দুবালা হেতালের মায়ের ঝুপড়ি ঘরের দিকে।

বাজার থেকে ফেরার পথে লছমী বলে “কই মা দাও দেখি ভাত খাই তোমার কচুবাটা দিয়ে”। শীতের বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে লছমী। ইন্দুবালা আলমারি থেকে নিজের একটা কাপড় বের করে দেন। লছমীর বারণ করা সত্ত্বেও গরম জল করে দেন স্নানের জন্য। আসন পেতে গরম ভাত খেতে দেন লছমীকে। কচুবাটা দিয়ে ভাত মেখে লছমী মুখে তোলে। “এটা কী করেছিস মা?” অবাক হয়ে তাকায় ইন্দুবালার দিতে। “ভালো লাগেনি তোর?” ভয়ে ভয়ে জানতে চান ইন্দুবালা। লছমী বলে “ভালো মানে বহুত ভালো”। শুধু কচুবাটা দিয়ে সব ভাতটা খেয়ে নেয় লছমী। কত দিন পরে তাকে এইভাবে বসে কেউ খাওয়ালো। কতদিন পর? বয়েস যখন বারো কি চোদ্দ শাদি হয়ে গিয়েছিল তার। ইন্দুবালা অবাক হন “এত ছোটোবেলায়?” লছমী বলে “তা নয়তো কি? বাপ তো মেয়েকে বিদাই দিতে পারলে বাঁচে। গ্রামে তো আর আমার বয়সী একটা মেয়েও ছিল না। তারপর বাবা চারটে ভইষ সওদা করে টাকা দেয় আমার মরদকে। তখন রাজি হয় সে। তোমার কত সওদা হয়েছিল মা?” ইন্দুবালা হাসেন। সবটা তো আর বাবা বলেনি। তবে গা ভর্তি গয়না পরিয়ে দিয়েছিল মা। সেই গয়নার আজ একটাও নেই। বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিকের হাত দিয়েই সব খরচ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। লছমীরও কোনো গয়না নেই। মন খারাপ করে বসে থাকে দুজনে। গয়নার জন্য কি শুধু? মোটেই না। “কবে তুই শেষ তোর গ্রামে গেছিস লছমী?” লছমী বলে “তাও বছর দশ আগে। বাবা মা কলেরায় মারা গেল। তারপর কমলা নদীতে বান এলো। ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। সব কুছ। আমাদের গাঁওটা আছে জানি। কিন্তু আর কার কাছে যাবো মা?” লছমীর গল্পে ইন্দুবালাও যেন কেমন খুঁজে পান নিজেকে। বিয়ের পরে একবারও যাওয়া হয়নি কলাপোতায়। কার কাছে যেতেন? কেউ ছিল না সেই পোড়া ভিটেয়। সেদিন ইন্দুবালা লছমীকে আর যেতে দেননি। পরের দিন বনধ। অনেক করে বলেছিলেন থেকে যা না লছমী। সারা রাত দুজনে গল্প করবো। সত্যি করেও ছিলেন তাই। কত কত যে গল্প দুজন দুজনের জন তুলে রেখেছিলেন তার হিসেব ওই জাবদা খাতাও দিতে পারতো না। “তুই যদি আমাদের গাঁও কি দরওয়াজার কাহানী শুনিস না মা তাজ্জব বনে যাবি”। ইন্দুবালা অতশত হিন্দি জানেন না। লছমীর সাথে থেকে একটু একটু করে কয়েকটা শব্দ বোঝেন। “গাঁও কি দরওয়াজা সে আবার কী রে?” শুনে লছমী জিভ কেটেছিল লম্বা করে। “হাই রাম! তুই গাঁও কি দরওয়াজা জানিস না মা? তাহলে শোন। গাঁওয়ের বাইরে একটা ছাউনি করে রাখা থাকে। সেখানে এসে বসে দূর গাঁও থেকে আসা মেহমান। রাম দুলার ওখানে বসেই ভজন করে। বরাতির থাকা হুয়া মেহমান ওখানেই রাতে নিন্দ যায়। ছররা সিং ওখানেই রাতে ছাগলগুলোকে বেঁধে রাখে। আরও কত কী যে হয়! ওখানেই তো আমাদের মুখিয়া তার মেয়ের শাদিতে দশ গাঁওয়ের লোককে বৈঠ কর খিলালো। ওটা যখন দূর থেকে দেখতে পেতাম না মা, মনে হতো আমার গাঁও চলে এসেছি। আর যাবার সময় মনে হতো এই যে ছেড়ে যাচ্ছি আবার কখন ফিরতে পারবো?” মাঝরাতে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ইন্দুবালা হালকা করে দেন। “আরে আমাদের জলসত্রের মতো। বিশালাক্ষ্মী তলায় ছিল তো। দূরের অচেনা অজানা পথিক তেষ্টার জল পেয়ে বিশ্রাম করতো। বোষ্টম বোষ্টমী ওখানেই সিধে পেয়ে দুটো চালে ডালে ফুটিয়ে খেত। গাঁয়ের বুড়োরা আচ্ছা জমাতো ওখানেই”। দুটো মেয়ে তাদের দুজনের সবচেয়ে ভালোলাগা জায়গা দুটোর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে উঠে ইন্দুবালা দেখেন লছমী নিজে উনুন ধরিয়েছে। আটার বড় বড় গোল গোল লেচি বানিয়েছে। তার মধ্যে ছাতু দিয়ে উনুনের আঁচে সেঁকছে। দিশি টমেটো সেদ্ধ করেছে। তার মধ্যে ধনে পাতা, কাঁচা লঙ্কা এইসব দিয়ে একটা চাটনি করেছে। “তোকে আমার কমলা গাঁওয়ের একটা খানা খাওয়াবো মা”। ইন্দুবালা চেখে দেখেছেন অন্যরকম স্বাদ তার। শুকনো পিঠে যদি এইভাবে করা যেত? ছাতুর বদলে নারকেলের পুর। “কী বলে রে এই খাবারটাকে লছমী?” লছমী জানতে চায় “আগে বলো ভালো লাগছে কি? আমার মরদ এক সাথে কত খেয়ে নিতো। বাচ্চারা আমার এই লিট্টি খাওয়ার জন্য বসে থাকে মা। আর চাটনি? পসন্দ হয়নি?” খুব ভালো লেগেছে ইন্দুবালার। “লছমী আমি তোর এই কমলা গাঁওয়ের চাটনিটা নিয়ে নিলাম রে। লিট্টি তো আর তোর মতো বানাতে পারবো না। চাটনিটা চেষ্টা করে দেখতে পারি”। সেদিন বিকেলে বাস ট্রেন চলার পরে লছমী চলে গিয়েছিল। কিন্তু গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেল ইন্দুবালার একটা না দেখা কমলা গ্রামকে। তার পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা কমলা নদীকে। নদীর ধারে ছট পুজো, হোলিকে।

আজ যেন মনে হচ্ছে হেতালের মায়ের দোকানটা বড্ড বেশি দূরে। ধনঞ্জয়কে সঙ্গে আনতে পারলে ভালো হতো। রাগ করে এইভাবে ছুটে বেরিয়ে আসা মোটেই উচিত হয়নি ইন্দুবালার। যদি রাস্তায় পড়ে যান তাহলে একটা কাণ্ড ঘটবে। ঠিক যেমন হয়েছিল লছমীর। বুঝতে পারেনি ট্রেন আসছে। মাথায় ছিল মাছ ভর্তি ঝুড়ি। তাড়া ছিল বাজারে আসার। সেদিন আবার কালেক্টার অফিসের বড়বাবু বলেছিলেন কচুবাটা খেতে আসবেন। লছমীর ঝুড়িতে ছিল মাছ। কাঁধের বস্তার বোঁচকায় ছিল বড় কচু, দিশি ছোট টমেটো, খুব ঝাল লঙ্কা, ধনে পাতা। অনেক ভোরে, কুয়াশার মধ্যে অন্যমনস্ক লছমী বুঝতে পারেনি ট্রেন এসে পড়েছে খুব কাছেই। পার হতে পারেনি লাইন। ছিটকে পড়েছিল মাছের ঝুড়ি। কাঁধের বস্তা। দেহ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল ওই হাসিখুশি মুখটা। অনেক বেলায় খবরটা এসেছিল। ইন্দুবালা তখন কালেক্টার অফিসের লোকজন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। ভেবেছিলেন লছমী আসেনি হয়তো শরীর খারাপ করেছে। কিন্তু মনে মনে দুশ্চিন্তাও করেছেন এমন কথার খেলাপ তো লছমী করে না। সব ভাবনা চিন্তা চাপা দেওয়ার জন্য ইন্দুবালা আরও রান্নার পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। কচুবাটার জায়গায় ঢুকে পড়েছে ছ্যাঁচড়া। সবাই যখন গরম গরম ভাত দিয়ে খাবে এতসব রান্না ঠিক সেই সময়ে রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলো দয়ারাম। লছমীর সাথেই আসতো সে। তার পাশে বসেই মাছ বিক্রি করতো। দুজনের যত ঝগড়া ছিল তত ভাব। শুকনো মুখে দয়ারামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাঁক করে উঠেছিল বুক। “কী হয়েছে রে দয়ারাম? ওরকম শুকনো মুখ কেন তোর?” দয়ারাম বসে পড়েছিল দোরগোড়ায় মাথায় হাত দিয়ে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলেছিল পুরো ঘটনাটা। চুপ করে শুনেছিলেন ইন্দুবালা। নিজের মনের ভেতরের তোলপাড় কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। নিজের সব সময় ভেবে এসেছেন এই হোটেলের যদি কেউ অংশীদার থেকে থাকে তাহলে সে হলো লছমী। তার সেই প্রথম দিনের টাকায় হোটেল শুরু না হলে কোনদিন ইন্দুবালা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন না। শান্তভাবে সবাইকে খাইয়ে, স্নান করে নতুন কাপড় পরলেন ইন্দুবালা। দয়ারামকে নিয়ে নিজে গেলেন মর্গে। সেখানে একবার শেষ দেখা দেখবেন ভাতে কাপড়ে তাঁকে বাঁচিয়ে যাওয়া বিহারের সেই কোন অজ কমলা গ্রামের মেয়েটিকে। যার বাবা মা বিয়ে দেওয়ার নামে পণ দিয়ে বেচে দিয়েছিল কোনো এক নেশাখোর মানুষের কাছে। লছমী চুপ করে শুয়ে ছিল মর্গের মেঝেতে তার হাসি হাসি মুখ নিয়ে। শুধু গলার কাছে। ছিল একটা চওড়া সেলাই। বসে পড়েছিলেন ইন্দুবালা ঠিক লছমীর পাশে মর্গের মেঝেতেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন মৃত সখীর। “এমন তো কথা ছিল না রে। উনুন ধরিয়ে বসেছিলাম তোর জন্যে। তুই এলি না। কথা রাখলি না”। এত শুকনো চোখেও জল পড়ে ইন্দুবালার। ভেপসে ওঠা মর্গটাও যেন শোকের সজীবতা পায়।

লছমীকে দেখেই কাজ শেষ হয়ে যায়নি ইন্দুবালার। পুলিশের কাছে যে ফর্ম থাকে অশনাক্ত বডির সনাক্তকরণের সেইসব কিছু ফর্মালিটি করতে হল তাঁকেই। বাজারের একগাদা গরীব গুর্বো লোকের সাথে ভদ্রঘরের এক বিধবাকে দেখে পুলিশের লোকজন একটু অবাক হয়েছিল বটে তবে বিস্তারিত প্রশ্ন করার অবকাশ ছাড়েনি। লছমী যে তাঁর আত্মীয় হয় পুলিশের কাছে বলেছিলেন ইন্দুবালা। “ঠিক কি ধরনের আত্মীয় যদি একটু বলেন দিদি?” জানতে চেয়েছিল লোকাল থানার ওসি বিষ্ণুপদ হাজরা। ইন্দুবালা বলেছিলেন “বোন..”। ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছিল ওসি, “একজন বিহারী বাঙালির বোন?” ইন্দুবালা সরাসরি তাকিয়ে বলেছিলেন “কেন হতে পারে না? আমার আপনার রক্তের হিসেব কার কাছে লেখা আছে স্যার? রক্তের আত্মীয়তাই কি সব?” ওসি কথা এগোয়নি। এমনিতে বেশি মাল কড়ি পাওয়া যাবে না এদের কাছে। ফর্মে সই করে ছেড়ে দিয়েছিল। বেরিয়ে আসার সময় ইন্দুবালা দেখেছিলেন দরজার কাছে পড়ে আছে কচুটা, ঝুড়িটা। আইডেন্টিফিকেশানের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। কাউকে কিছু না বলে কচু আর ঝুড়ি দুটোই নিয়ে এসেছিলেন ইন্দুবালা। যিনি কোনোদিন তাঁর স্বামীর একটা ছবি বাড়িতে রাখেননি তিনি তাঁর সখীর শেষ চিহ্নটুকু নষ্ট হতে দেননি।

দয়ারামকে সব খরচ দিয়েছিলেন ইন্দুবালা। লছমীর অন্ত্যোষ্টি, শ্রাদ্ধ সব কিছু। এমনকি লছমীর ছেলেকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের দশ হাজার টাকা। মায়ের জায়গায় ব্যবসা শুরুর জন্য। বাড়ি ফিরে খুব হালকা লেগেছিল তাঁর। খুব কাছের মানুষ চলে গেলে যেমন চারপাশ ফাঁকা হয়ে যায়। লছমী চলে যাওয়ার পরেও তাই মনে হয়েছিল। কিছু খাননি সেদিন সারাদিন। পরের দিন সকালে স্নান করে, উনুন ধরিয়ে কচু বাটতে বসেছিলেন। সেদিন হোটেলের মেনু ছিল গরম ভাত, কচুবাটা আর দেশি কাঁচা টমেটোর চাটনি। পরে সেটা নাম বদল করে রেখেছিলেন লছমী চাটনি। চাটনি হয়ে গেলে তার ওপরে ছড়িয়ে দিতেন গন্ধরাজ লেবুর সুবাস। প্রথম ভাত নামার পরেই শাল পাতার থালায় তুলে নিয়েছিলেন সেদিন ইন্দুবালা। কচুবাটা আর চাটনি পাশে দিয়ে বাগানের নারকেল গাছটার তলায় রেখে এসেছিলেন। মাটির গ্লাসে ছিল জল। গড় হয়ে প্রণাম করে সেই খোলা বাগানে লছমীকে অনুরোধ করেছিলেন শেষবারের মতো ভাত খেয়ে যেতে। আর পেছন ফিরে তাকাননি। বাগানের দরজা বন্ধ করে ধনঞ্জয়কে বলেছিলেন আজকের পর থেকে কচুবাটা রান্নাটা বন্ধ তাঁর হোটেলে।

তাহলে এখন হঠাৎ এই অবেলায় অচেনা এক মেয়ের অনুরোধে ইন্দুবালা রাজি হয়ে গেলেন কেন আবার সেই রান্না করতে? কে জানে কার মধ্যে দিয়ে কে বারবার এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে। সেদিনে বিকেলে বাগান থেকে এসে ধনঞ্জয় বলেছিল, “মা শালপাতার থালা পরিষ্কার। একটা ভাতও নেই। শুধু কি তাই? জলটা পর্যন্ত খেয়ে গেছে গো”। ইন্দুবালা ধমকে ছিলেন ধনঞ্জয়কে। “ওইভাবে বলতে নেই ধনা। মানুষ মারা গেলে ঈশ্বর হয়ে যান”। এখনও কাঁচা মাছ আসলে প্রথমে ওই লছমীর ঝুড়িতেই রাখা হয় সব। তারপর সেখান থেকে সব ধুতে যায়। ভাজতে যায়। কিছু কিছু অদ্ভুত সংস্কার ইন্দুবালা আজও মনে মনে মেনে চলেন।

সেদিন হেতালের মায়ের দোকান বন্ধ ছিল। কাজেই ইন্দুবালাকে বেশ কয়েকদিন পর পর নতুন কচুর জন্য বাজারে হেতালের মাকে বলে রাখতে হলো। সেই বউটি অনেক খুঁজে পেতে সোনারপুর পেরিয়ে আরও কোন অজ গাঁয়ের থেকে কচু এনে দিলে ইন্দুবালা পরপর কয়েকদিন কচুবাটা করেলেন। ঝামেলা হলো বিস্তর। চারপাশের লোকজন তো এলোই। কৃষ্ণনগর থেকে এলেন সেই অধ্যাপক অমলেন্দু। সঞ্চারী পরিচয় করিয়ে দিলো। কাঁচা পাকা দাড়ি, চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। “চিনতে পারছেন না আমাকে দিদি?” যখন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো তখনও বুঝতে পারেননি ইন্দুবালা। চশমা খুলতেই ঝন্টুকে চিনতে পারলেন তিনি। এমন জ্বর বাধিয়ে ছিল ছেলেটা নিজে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতেন ইন্দুবালা। “তোর মনে আছে লছমীকে ঝন্টু? ওই যে ঝুড়ি করে মাছ দিয়ে যেতো আমাকে?” ঝন্টু মনে করার চেষ্টা করে, পারে না। ধনঞ্জয় খ্যাচ খ্যাচ করে। কচুর ডাঁই পড়ে আছে। সেগুলো কখন কাটা হবে, বাটা হবে কে জানে। ঝন্টু তার ব্যাগ থেকে কৃষ্ণনগরের সরভাজা বার করে দেয়। ইন্দুবালা সবাইকে বসতে বলেন। কচি কচুকে ভালো করে ধুয়ে, কুরে, নারকেল, সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মিহি করে বেটে ওপরে ছড়িয়ে দেন কাঁচা সরষের তেল। গরম ভাতে সেই কচুবাটা নিমেষে শেষ হয়। সবাই হাপুস হুপুস শব্দ তোলে। কচি দেশি টমেটোর চাটনি লোকজন চেটেপুটে খায়। অনেকদিন পরে পড়ন্ত বেলায় রান্না ঘরের দরজায় লছমী এসে দাঁড়ালে ইন্দুবালা একটুও অবাক হন না। শুধু বিড়বিড় করে বলেন তোকে আজ আর কেউ মনে রাখেনি রে লছমী। লছমী হাসে। কোনো কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। কী বলতে চাইছে লছমী ইন্দুবালাকে? বিদায় বেলার আমন্ত্রণ?

ইন্দুবালার কেমন যেন শীত করে। তড়িঘড়ি দোতলায় ওঠেন। ধনঞ্জয়ের বেড়ে দেওয়া ভাতের থালা সরিয়ে রেখে কিচ্ছুটি না খেয়ে বারান্দায় একচিলতে রোদে আচার, কাসুন্দি আর বড়ির পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। পশ্চিম দিকে পাটে যাওয়া বেলাশেষের একটু রোদ এসে পড়ে তাঁর পরিতৃপ্ত শঙ্কাহীন মুখে।

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments