
এ কাহিনি কাউকে কোনোদিন বলিনি। জানি, বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
আমার নিজেরই মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ব্যাপারটা আদৌ ঘটেছিল কিনা। যখন হাতে কোনো কাজ থাকে না, বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে বসে কলকাতার ঘনায়মান সন্ধ্যার দিকে চেয়ে থাকি। রাস্তার যানবাহনের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে, তখন সব ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
অনেক বছর আগের কথা।
আমি তখন ম্যান্ডেলে জেলের ডেপুটি সুপার। ম্যান্ডেলের উত্তর বর্মার প্রধান শহর। ম্যান্ডেলেকে বাংলায় লেখা হয় মান্দালয়।
সেই জেলে একবার এক দুর্ধর্ষ আসামি এসেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ— সামান্য দশটা টাকার জন্য সে ভাইকে ছোরা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল।
লোকটার নাম পে মঙ। বয়স খুব বেশি নয়। বছর বাইশ-তেইশ। বাপ ছিল না। দু-ভাই ঠাকুরদার কাছে মানুষ। পে মঙ স্কুলের ধার দিয়ে যেত না। কেবল লুকিয়ে পরের পুকুরে ছিপ ফেলা, পরের গাছের ফলপাকুড় পাড়া, সিনেমা দেখে দেখে বেড়ানো— এইসব করত।
পে মঙের ছোটো ভাই ঠিক তার বিপরীত। লেখাপড়া তো করতই। অবসর সময়ে ঠাকুরদার চাষবাসের সাহায্য করত। সপ্তাহে সপ্তাহে তরিতরকারি হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত।
এইভাবে সে কিছু পয়সাকড়ি জমিয়েও ছিল।
একদিন পে মঙ ভাইকে বলল, ‘দশটা টাকা ধার দিবি, শহরে যাব। রেলভাড়া আর হোটেল খরচ লাগবে। তোকে টাকা আমি একমাসের মধ্যে শোধ করে দেব।’
ভাই দাদাকে খুব ভালোই চেনে। এর আগে কয়েক বার সে টাকা ধার দিয়েছিল, সেটাই ফেরত পায়নি।
আর দাদা ফেরতই বা দেবে কোথা থেকে! তার এক পয়সা তো উপার্জন নেই। তাই বলল, ‘আমার কাছে পয়সা নেই। থাকলেও দিতাম না।’
এই নিয়ে কথা কাটাকাটি, গালাগালি তারপর মারামারিও শুরু হয়ে গেল। পাড়ার লোক এসে দুজনকে ছাড়িয়ে দিল।
দুজনেই দুজনকে শাসাল, দেখে নেব।
পে মঙের ভাই সব কিছু ভুলে নিজের কাজে মেতে গেল। পে মঙ ভুলল না। তক্কে তক্কে রইল।
একদিন ভোরে পে মঙের ভাই হাটে চলেছে। মাথার ঝুড়িতে শাকসবজি, ফলপাকুড়। পে মঙ পিছু নিল।
নির্জন রাস্তা। অত ভোরে বিশেষ লোক চলাচল নেই। হাটের জিনিস নিয়ে গোরুর গাড়ির সার আগের রাতে চলে গেছে।
মাঝামাঝি রাস্তায় পে মঙ পিছন থেকে ভাইয়ের গলা চেপে ধরল। ‘এইবার কে তোকে বাঁচাবে! দে, সঙ্গে যা টাকাকড়ি আছে।’
আচমকা আক্রমণে ভাইয়ের মাথা থেকে ঝুড়িটা ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ে গিয়েছিল। সে ফিরে দাঁড়িয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি।
পে মঙ কোমর থেকে ছোরা বের করে বাইয়ের বুকে বার তিনেক বসিয়ে দিয়েছিল।
রক্তে তার গেঞ্জি আর লুঙ্গি লাল হয়ে গিয়েছিল।
ভাইয়ের পকেট থেকে টাকা সাতেক বের করে নিয়ে পালাতে গিয়েই থামতে হয়েছিল।
পুলিশের দারোগা একেবারে সামনে।
একটা খুনের তদারক সেরে পাশের গাঁ থেকে দারোগা পুলিশ সঙ্গে নিয়ে সাইকেলে ফিরছিল, পে মঙকে একেবারে হাতে-নাতে ধরে ফেলল। এই হচ্ছে পুলিশের কাহিনি।
তারপর হাজত, হাজত থেকে কোর্ট, কোর্ট থেকে জেল।
পে মঙকে বাঁচাবার জন্য তার ঠাকুরদা অনেক চেষ্টা করেছিল। একটা নাতি তো গেছেই, আর একজনকে যদি বাঁচাতে পারে। বাঘা বাঘা উকিল দিয়েছিল।
কিছু হয়নি।
জেলা কোর্ট ফাঁসির হুকুম দিল। হাইকোর্ট সে হুকুম বহাল রাখল।
পে মঙ যখন ম্যান্ডেলে জেলে এল, তখন সে বিলাতে রাজার কাছে প্রাণদণ্ডের আদেশ মুকুব করার আবেদন করেছে।
পে মঙ বরাবর বলে এসেছে ভাইকে সে মারেনি। ভাইয়ের সঙ্গে গালিগালাজ ধস্তাধস্তি হয়েছে বটে, কিন্তু মেরেছে অন্য লোক। পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মেরে পালিয়েছে।
পে মঙকেও মারত কিন্তু দারোগা এসে পড়ায় পারেনি।
পে মঙের এ-কাহিনি ধোপে টেকেনি।
প্রমাণ হয়েছে, এ ছোরা তার। দারোগা নিজের চোখে দেখেছে পে মঙ ভাইয়ের বুকে বার বার তিনবার ছোরা বিঁধিয়ে দিয়েছে।
দারোগার সঙ্গে পে মঙের কোনো শত্রুতা নেই যে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলবে।
আমি যখন পে মঙের সেল-এ যেতাম তখনও তার এক কথা।
‘হুজুর বাঁচান, আমার বিনাদোষে ফাঁসি হবে! মরতে আমার বড়ো ভয় হুজুর। কীই-বা আমার বয়স। আমি বাঁচতে চাই!’
আমি তাকে কোনো আশ্বাস দিতে পারতাম না। কেবল বলতাম, ‘আজ বিকালে ফুঙ্গি (বৌদ্ধ পুরোহিত) আসবেন, তাঁর কাছে তোমার যা বলবার বলো।’
ফুঙ্গি এলেই পে মঙ খেপে উঠত। কোনো ধর্মের কথা সে শুনতে চাইত না। চিৎকার করে বলত, ‘আমাকে বিনাদোষে যারা ফাঁসি দেবে, তাদের আমি ছাড়ব না। আমি শয়তানের কাছে রক্ত বিক্রি করে যাব। আমার আত্মা প্রতিশোধ নেবে।’
পে মঙের কথা শুনে শুনে আমার নিজেরই মাঝে মাঝে কেমন সন্দেহ হত। সত্যিই হয়তো পে মঙ দোষী নয়। বিচারেও তো কত সময়ে ভুল হয়!
কিন্তু ডেপুটি জেলার হিসেবে আমার কিছু করার নেই।
বিলাত থেকে অর্ডার এল। আবেদন মঞ্জুর হয়নি।
তার মানে ফাঁসি ছাড়া পথ নেই।
খবরটা পে মঙকে জানিয়ে দেওয়া হল।
কিছুক্ষণ গরাদ ধরে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে হঠাৎ একটা অব্যক্ত আর্তনাদ করে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
ভয় পেয়ে গেলাম। অনেক দুর্ধর্ষ আসামিও ফাঁসির হুকুম শুনে জ্ঞানহারা হয়ে যায়। কিংবা রীতিমতো অসুস্থ।
ফাঁসির আসামিদের খুব সাবধানে রাখা হয়। যাতে তারা আইনকে ফাঁকি দিয়ে আত্মহত্যা না করতে পারে!
তাদের সেলের চার দেয়াল খড় দিয়ে নরম করে দেওয়া হয়, যাতে আসামি দেয়ালে মাথা ঠুকে না মরতে পারে। রোজ ডাক্তার এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। খাওয়াদাওয়ার খুব তরিবৎ।
খবর শোনার পর থেকে পে মঙ একেবারে বদলে গেল।
চুপচাপ বসে থাকে। দিন-রাত বিড়বিড় করে কী বলে! ফুঙ্গি কাছে এলে তাকে গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয়। ওয়ার্ডারকে বলে, ‘আমি খুন করিনি, তবু এরা আমাকে ফাঁসি দিচ্ছে। আমি কাউকে ছাড়ব না। সবাইকে দেখে নেব।’
ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া সত্ত্বেও তার চেহারা শীর্ণ হয়ে যেতে লাগল।
বোঝা গেল, এটা হচ্ছে মানসিক চিন্তায়।
অবশেষে সেইদিন এল।
জেলার সাহেব ছুটিতে, কাজেই দায়িত্ব আমার ওপর।
একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে, একজন ডাক্তার আর আমি।
ভোর পাঁচটা দশে ফাঁসি।
সাড়ে চারটে থেকে আমরা তৈরি।
আসামিকে স্নান করিয়ে আনা হল। ফুঙ্গি ধর্মের বাণী উচ্চারণ করল। কোনো গোলমাল নয়, চুপচাপ শুনল।
গোলমাল বাধল ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাবার সময়।
কিছুতেই যাবে না। পাগলের মতন চিৎকার।
‘তোমরা একজন নিরীহ লোককে ফাঁসি দিচ্ছ! ফয়া (ভগবান) তোমাদের ক্ষমা করবেন না! নির্বংশ হবে তোমরা! কুষ্ঠরোগে মারা যাবে!’
টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হল।
ঠিক সময়ে কাজ শেষ।
কালো কাপড়ে ঢাকা দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠেই নিস্পন্দ হয়ে গেল চিরদিনের জন্য। একটা মানুষের আকুতি, প্রতিরোধ সব শেষ হয়ে গেল।
এর দিনদুয়েক পরেই ব্যপারটা ঘটল।
রাত তখন বারোটা হবে। একটু আগে পড়া শেষ করে সব শুয়েছি। দরজায় প্রচণ্ড করাঘাত।
জেলের মধ্যে আমাদের সব সময়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বাস করতে হয়। অঘটন একটা ঘটলেই হল।
দরজা খুলে দেখি রাতের ওয়ার্ডার।
দুটো চোখ বিস্ফারিত। উত্তেজনায় প্রশস্ত বুক ওঠা-নামা করছে। শীতের রাত কিন্তু সারা মুখ ঘর্মাক্ত।
‘কী হল?’
‘হুজুর পে মঙ!’
‘কে?’
‘পে মঙ হুজুর! যার ফাঁসি হয়ে গেল!’
ধমক দিয়ে উঠলাম, ‘কি নেশা-ভাঙ করেছ নাকি? মাঝরাত্তিরে আজেবাজে কথা বলছ। তোমাকে জরিমানা করব।’
‘বিশ্বাস করুন হুজুর, আমি একলা নই, অন্য কয়েদিরাও দেখেছে।’
বেরিয়ে পড়লাম। দেখে আসি কী রহস্য।
গিয়ে দেখলাম পে মঙের সেলের আশেপাশের কয়েদিরা সব গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি যেতেই চেঁচামেচি শুরু হল।
‘হুজুর, পে মঙ!’
অনেক কষ্টে তাদের থামিয়ে আসল কথাটা শুনলাম।
কোনো এক কয়েদির প্রথম চোখে পড়ে। চাঁদের আলোয় চারদিক পরিষ্কার। কোথাও একটু অন্ধকার নেই। একটা চাপা গোঙানি কানে যেতেই কয়েদিটা পে মঙের সেলের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠেছিল।
কালো কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তি শূন্যে ঝুলছে। ঠিক ফাঁসিকাঠ থেকে যেমন ঝোলে।
একজনের চিৎকারে অন্য সবাই উঠে পড়ে। সকলেরই চোখের সামনে এক দৃশ্য। তাদের হল্লায় রাতের ওয়ার্ডার এসে হাজির। সেলের সামনে এগিয়ে গিয়েই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কালো কাপড়ে ঢাকা মূর্তিটা মৃত্যুযন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে! আর সে অপেক্ষা করেনি। প্রাণপণে ছুটে আমার দরজায় ধাক্কা দিয়েছে।
সেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেল ফাঁকা। কোথাও কিছু নেই।
চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও হাতের টর্চটা সেলের এদিকে-ওদিকে ফেললাম। কড়িকাঠেও।
সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
ঘুরে দাঁড়িয়ে জোর ধমক দিলাম। ‘মরা মানুষ আবার ফিরে আসে নাকি? যত সব বাজে ঝামেলা। যাও সব শুয়ে পড়ো।’
ওয়ার্ডারকে কড়া করে বকলাম। ‘ফের এরকম ছেলেমানুষি ব্যাপার করলে চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।’
সবে তন্দ্রা এসেছিল এমনই সময়ে উটকো ঝামেলায় মেজাজ রুক্ষ হয়ে গেল। জানি না, আবার কখন ঘুম আসবে।
দ্রুতপায়ে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে এলাম। একলাই থাকি। তখনও বিয়ে করিনি।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।
বাইরের ঘরে বাতি জ্বালানোই ছিল। এই ঘর দিয়েই আমাকে শোবার ঘরে যেতে হবে। বাইরের ঘরটা অফিসঘর। কোণের দিকে একটা টুলের ওপর পে মঙ বসে!
বিস্ফারিত দুটি চোখ। মনে হল, চোখের মণি দুটো বুঝি বের হয়ে আসবে। জিভটা ঝুলছে। গলায় লাল দাগ, ফাঁসির দড়ির।
আমি ভীত এমন অপবাদ শত্রুও দিতে পারে না, কিন্তু মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল বুকের হৃদস্পন্দন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে উঠেছে। সমস্ত শরীর কাঁপছে ঠকঠক করে। তালু শুকিয়ে কাঠ।
একটু জল পেলে হত। ঠান্ডা এক গ্লাস জল।
‘কে?’ ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলাম।
‘আমি পে মঙ হুজুর। বড়ো কষ্ট পাচ্ছি। বড়ো যন্ত্রণা। তাই আপনার কাছে এসেছি।’
খুব সাবধানে দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে এপাশের চেয়ারের ওপর বসে পড়লাম। দাঁড়িয়ে থাকার আর শক্তিও ছিল না।
এ তো চোখের ভুল নয়। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পে মঙ আমার সামনে বসে রয়েছে। মাত্র হাত চারেক দূরে। ফাঁসির পরের অবস্থা।
মৃদুকণ্ঠে বললাম, ‘আমার কাছে কী দরকার?’
বুঝতে পারলাম কণ্ঠস্বর আমার আয়ত্তের মধ্যে নয়।
‘আপনার কাছে ছাড়া আর কার কাছে আসব হুজুর। যা-কিছু বলার আপনার কাছেই তো বলতে এসেছি।’
‘কী বলবার আছে বলো?’
‘আমি নির্দোষ হুজুর। এ খুন আমি করিনি।’
‘এখন আর এসব কথা বলে লাভ কী? তোমার তো যা হবার হয়ে গেছে।’
‘আছে হুজুর। পরকাল আছে, সেখানে আমি শান্তি পাচ্ছি না।’
কী উত্তর দেব। চুপ করে রইলাম।
পে মঙই বলতে লাগল—
‘সেদিন ভাইকে খুন করতে আমি চাইনি হুজুর। পিছন থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার টাকাপয়সা কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তার ওপর। দুজনে রাস্তার ওপর যখন গড়াগড়ি খাচ্ছি তখন পাশের ঝোপ থেকে একজন লাফিয়ে বের হল। আমি ওপরে ছিলাম। আমার কোমর থেকে ছোরাটা বের করে আমার ভাইয়ের বুকে বার কয়েক বসিয়ে দিল। আমাকেও হয়তো মারত, কিন্তু দারোগার সাইকেল দেখতে পেয়ে আবার ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আমি পয়সার জন্যই যদি খুন করব হুজুর, তাহলে পুলিশ আমার কাছ থেকে কি কোনো পয়সা উদ্ধার করতে পেরেছিল?’
স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর নয়। শ্বাসনালীতে চাপ পড়লে যেমন ফ্যাঁসফেঁসে শব্দ হয়, ঠিক তেমনই আওয়াজ।
কথার সঙ্গে সঙ্গে জিভ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তে লাগল মেঝের ওপর।
‘ঠিক আছে, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।’
পে মঙের বীভৎস রক্তাক্ত মুখে হাসি ফুটে উঠল।
‘করলেন তো হুজুর, তাতেই আমার শান্তি। দারোগাকে বলেছি, কোর্টে বলেছি, কেউ বিশ্বাস করেনি হুজুর। আপনার ওপরওয়ালা জেলারও নয়। তাই আমার এই অবস্থা। আমার মোটে তেইশ বছর বয়স হুজুর, এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।’
কতক্ষণ এ কাহিনি চলবে জানি না।
দূরে জেলের ঘড়িতে ঢং করে একটা বাজল।
বাইরে রাতের ওয়ার্ডারের ভারী জুতোর শব্দ ভেসে আসছে— মস, মস, মস।
এবারে পে মঙ দাঁড়িয়ে উঠল। ‘যাচ্ছি হুজুর, তবে যারা আমার এ অবস্থার জন্য দায়ী তাদের আমি ছাড়ব না।’
বুকটা দুপদুপ করে উঠল।
তার চরম অবস্থার জন্য পে মঙ কি আমাকেও দায়ী করছে। আমার ওপরও প্রতিশোধ নেবে?
বেশ বুঝতে পারলাম, ঘাড়, পিঠ ঘামে একেবারে ভিজে গেছে।
রুমাল বের করে ঘাম মুছব, সে শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি।
হঠাৎ ঘরের মধ্যে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। বাইরে বরফ পড়লে যেমন হয়। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া। ধোঁয়াটা সরে যেতেই দেখলাম পে মঙ নেই। চেয়ার খালি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।
বাকি রাতটুকু আর ঘুম হল না। এপাশ-ওপাশ করলাম; চোখ বন্ধ করলেই পে মঙের বীভৎস, রক্তাক্ত মূর্তি ভেসে ওঠে।
ভোরে উঠে চোখে-মুখে জল দিয়ে নিজেকে বোঝালাম।
সবই মিথ্যা। নিজের মনের ভয়টাই বাইরে তার প্রতিবিম্ব ফেলেছে। পে মঙের দেহ তো গতকালই কবর দেওয়া হয়েছে। সে ফিরে আসবে কী করে!
কয়েদিদের ভীতি আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল।
বারান্দায় চা নিয়ে বসলাম।
খবরের কাগজটা দিয়ে গিয়েছিল।
খবরের কাগজের প্রথম পাতার ওপর চোখ বুলিয়েই চমকে উঠলাম।
‘জেলা জজ বেকার নিহত। গত রাত্রে শয়নকক্ষে বেকারকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে। তাঁর কণ্ঠনালী ছিন্ন। আশ্চর্যের বিষয়, বাড়ির কোনো জিনিসপত্র চুরি যায় নাই। পুলিশ এই রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের কিনারা করিতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করিয়াছে।’
মিস্টার বেকারের এজলাসে পে মঙের বিচার হয়েছিল।
গতকাল রাত্রেই তো পে মঙ প্রতিশোধ নেবার কথা বলে গিয়েছিল। ব্যাপারটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
তবে কি পে মঙের প্রেতাত্মা সত্যিই এসেছিল আমার কাছে?
তা কি সম্ভব!
খবরের কাগজ হাতে করেই বাইরের ঘরে এলাম।
সব স্বাভাবিক। পে মঙ এসেছিল, তার কোনো চিহ্ন কোথাও নেই।
কোণের এই টুলেই তো সে বসেছিল।
মেঝের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম।
লাল রক্তের কয়েক ফোঁটা রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে!
পে মঙের জিভ থেকে এই রক্ত ঝরেছিল।
ফাঁসির পর এরকম রক্ত তো বের হয়।