Read free bangla books online

ছোটদের ঈশপের শিক্ষামূলক গল্প সমগ্র

ছোটদের ঈশপের শিক্ষামূলক গল্প সমগ্র

ঈশপ ছিলেন মিশরের ফারাও বাদশাহ আমাসিসের সময়কার লোক। সামস দ্বীপে তিনি বাস করতেন। ইয়াডমন নামে এক নাগরিকের ক্রীতদাস ছিলেন তিনি। ঈশপ দেখতে ছিলেন কদাকার কিন্তু বুদ্ধি ও হাস্যরসে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাপ্রদ অমর কাহিনীগুলো মানুষকে শোনাতেন।

বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষ ছিলেন তার গল্পের ভক্ত। তার মৃত্যুর পর গ্রীসের দার্শনিক জিমট্রিয়াস তার গল্পগুলো সংগ্রহ করে রাখেন। সেই থেকে ঈশপের গল্প আজও সারা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। ঈশপের প্রত্যেকটা গল্পে উপদেশ বা শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। আর তার গল্পের চরিত্রগুলো হয় পশু-পাখিদেরকে কেন্দ্র করে।

গাধা, শিয়াল ও সিংহ

এক বনে নানা রকম জীব-জন্তু বাস করত। একদিন এক গাধা ও শিয়াল বনের রাজা সিংহের সঙ্গে একটি চুক্তি করল। চুক্তিতে বলা হল, এখন থেকে তিন পশু একসঙ্গে শিকার করবে। শিকার যা পাওয়া যাবে তারা তা সমান ভাবে ভাগ করে নেবে। তিনজন একসঙ্গে শিকার করলে কাউকে না খেয়ে থাকতে হবে না।

সিদ্ধান্ত হল- গাধা শিকারযোগ্য প্রাণির ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখবে। কাউকে দেখতে পেলে সে তার দিকে এগিয়ে যাবে এবং নিজের পরিচয় দেবে। অন্য দু’জন আড়াল থেকে গাধার দিকে নজর রাখবে। গাধা পরিচয়পর্ব শেষ করার পর শিয়াল আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে গর্জন করে উঠবে। প্রাণিটি স্বাভাবিকভাবেই তখন ভয় পেয়ে যাবে। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করবে সে। তখন শিয়াল তাকে ধাওয়া করবে। প্রাণিটি তখন শিয়ালকে এড়াতে সোজা দৌড় দেবে, আর গিয়ে পড়বে সিংহের কবলে। সিংহ তখন এক আঘাতে তার দফারফা করবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সারাদিন ধরে শিকারের পর সন্ধ্যাবেলায় গাধা, শিয়াল, সিংহ সব শিকাল ভাগবাটোয়ারা করতে বসল। সিংহ গাধাকে বলল তার অংশ ভাগ করে দিতে। বনের রাজা সিংহের এ প্রস্তাব শুনে গাধা খুব খুশি হল। মনে মনে ভাবল- শিকার ভাগ করার দায়িত্ব দিয়ে সিংহ তাকে বিরাট সম্মান দেখিয়েছে। যাইহোক, গাধা খুব সাবধানতার সাথে সমস্ত শিকারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে। এরপর শিয়াল ও সিংহের উদ্দেশে বলল: ভাগের কাজ শেষ। এখন আপনারা দু’জন দয়া করে নিজেদের ভাগ গ্রহণ করুন।

গাধার কথা শুনে সিংহ ভাগগুলোর দিতে তাকিয়ে দেখল। তারপর বলল: তাহলে তোর মতে আমাদের তিনজনের ভাগই সমান হওয়া উচিত, তাই না? তুই কি মনে করিস যে, শিকারের সাথে তোর ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প করা আর তাকে আমার হত্যার কাজটা একই সমান?

এ কথা বলেই সিংহ গাধার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে হত্যা করল। তারপর শিয়ালকে শিকার ভাগ করতে বলে। গাধার পরিণতি দেখে শিয়াল ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে নিয়ে ভাগ করতে বসল। যা কিছু তারা একসাথে শিকার করেছিল তার প্রায় সবই একভাগে রাখল। আরেক ভাগে রাখল সামান্য একটু অংশ। বড় ভাগটা নেয়ার জন্য সিংহকে অনুরোধ করল। শিয়ালের ভাগ করা দেখে সিংহ বেজায় খুশি হয়ে বলল: আচ্ছা, এত চমৎকার আর ন্যায্য ভাগের কৌশল তোকে কে শিখিয়েছে?

শিয়াল বিনয়ের সাথে বলল: একটু আগে গাধার পরিণতি দেখেই এভাবে ভাগ করা শিখেছি, জনাব।

একথা বলে শিয়াল সিংহের সামনে থেকে চলে গেল। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল যে, ভবিষ্যতে আর কোনো কাজে সে কখনোই সিংহকে সাথে নেবে না।


নেকড়ে আর ভেড়ার গল্প

ঈশপ পশু-পাখির ধোঁকাবাজি নিয়েও গল্প লিখেছেন। এ সম্পর্কেই একটি গল্প নিচে উল্লেখ করা হল:

একদিন এক নেকড়ের শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল, কিছুতেই নড়তে পারছিল না। চলাফেরা করতে না পারার কারণে শিকারও সংগ্রহ করতে পারছিল না তাই পশু শিকারের জন্য একটি ফন্দি আঁটল।

নেকড়ের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল একটি ভেড়া। নেকড়ে তাকে ডেকে কাছের ঝর্ণা থেকে পানি এনে দেয়ার অনুরোধ জানাল। কাকুতি-মিনতি করে নেকড়ে বলল: “আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ। এক আঁজলা পানি এনে দিলেই চলবে। গোশতের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারব।”

নেকড়ের কখা শুনে ভেড়া বলল: “হ্যাঁ, তাতে আর সন্দেহ কি। আমি তোমায় এক আঁজলা পানি এনে দিই আর তুমি আমাকে দিয়েই গোশত জোগাড় করার কাজটাও করে ফেলতে পারবে!”

ভেড়ার জবাব শুনে হা করে তাকিয়ে রইল। ফন্দি ব্যর্থ হওয়ায় তার কষ্টের সীমা রইল না।


এক ডাঁশ আর এক সিংহ

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই মশা জাতীয় পতঙ্গ ডাঁশকে দেখেছো কিংবা নাম শুনেছো। ডাঁশ মানুষকে হুল ফুটিয়ে অবস্থা কাহিল করে ফেলে। ঈশপ এই ক্ষুদ্র পতঙ্গ ডাঁশ ও পশুরাজ সিংহকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছেন।

একবার এক ডাঁশ এক সিংহের কাছে এসে খুব তাচ্ছ্বিল্যের সঙ্গে বলল: “শোন রে সিংহ, আমি তোকে একটুও ভয় পাই না, আর তুই আমার থেকে কিছুই শক্তিশালী নোস। তোর জোরটাই বা কিসে? আঁচড়াতে পারিস নোখ দিয়ে, কামড়াতে পারিস দাঁত দিয়ে – এতে কি এল গেল? আবারও বলছি, শুনে রাখ, সব দিক ভেবে দেখলে আমার জোর তোর থেকে অনেক বেশী। কোনো সন্দেহ থাকলে আয় লড়াই করি, দেখি কে জেতে।”

এসব কথা বলে ডাঁশটি ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সিংহের উপরে। মুহূর্তেই সিংহের নাকের ডগায় ফুটিয়ে দিল হুল। সিংহ ডাঁশটাকে থাবার থাবায় মেরে ফেলতে গিয়ে নিজের নখে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে একসময় কাহিল হয়ে পড়ল। ডাঁশ এইভাবে সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ জিতে গোঁ গোঁ করে বিজয়-সঙ্গীত গাইতে গাইতে উড়ে চলে গেল। কিন্তু বেশীদূর যাওয়া হল না তার, সোজা গিয়ে জড়িয়ে গেল কাছাকাছি এক মাকড়সার জালে।

এর কিছুক্ষণ পরেই চলে গেল মাকড়সার পেটে। মরার আগে ডাঁশটা আফসোসের সঙ্গে বলল: “কী দুঃখের কথা, আমি সিংহের মত একটা মহা শক্তিশালী জন্তুকে অনায়াসে হারিয়ে দিয়ে এলাম, অথচ একটা তুচ্ছ মাকড়সাটার কাছে শেষ হয়ে গেলাম!”

এ গল্প থেকে আমরা শিখতে পারি যে, কারও সামনে অহেতুক আস্ফালন করা ঠিক নয়। কিংবা কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও উচিত নয়।


শিয়াল আর ছাগল

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, পশুদের মধ্যে শিয়ালকে সবচেয়ে চালাক মনে করা হয়। আর ছাগলকে বলা হয় সবচেয়ে বোকা। একদিন এক শিয়াল একটা কূয়োর মধ্যে পড়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও সে সেই কূয়োটা থেকে উঠে আসতে পারল না। এদিকে একটা ছাগলের ওই সময় খুব পিপাসা পেল। ছাগলটি ঘুরতে ঘুরতে কূয়োর পাশে এসে হাজির হল।

কূয়োর মধ্যে শিয়ালকে দেখে সে জানতে চাইল যে, কূয়োর খাওয়ার মতো পানি আছে কিনা। শিয়াল তখন নিজের দুরবস্থা চেপে গিয়ে এক গাল হাসিতে মুখ ভরিয়ে নানাভাবে সেই কূপের পানির প্রচুর প্রশংসা করল। বলল- “এই কূয়োর পানি এত সুমিষ্ট যে আশপাশের কোথাও এমন পানি পাবে না। তুমি নীচে নেমে এসে প্রাণভরে পানি খাও, কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।”

শিয়ালের মিষ্টি কথায় আর দেরি না করে ছাগল কূয়োর ভিতর লাফিয়ে পড়ল। পেটপুরে পানি খাওয়ার পর শিয়ালকে ধন্যবাদ দিল। এসময় শিয়াল তাকে জানাল- ভয়ানক অবস্থায় তারা আটকা পড়েছে। এই ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছাগলের কাছে সে একটা প্রস্তাব রাখল। বলল, “তুমি যদি তোমার সামনের পা দুটো তুলে কূয়োর দেয়ালে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াও আর তোমার মাথাটা নিচু করে রাখ, আমি তাহলে তোমার পিঠের উপর দিয়ে দৌড়ে কূয়োর বাইরে চলে যাব। আমি একবার বের হতে পারলে তোমাকেও তখন উদ্ধার পেতে সাহায্য করতে পারব।”

ছাগল কোনো ভাবনা-চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালের প্রস্তাবমত দাঁড়িয়ে গেল। শিয়াল লাফ দিয়ে ছাগলের পিঠে চড়ল। তার শিং ধরে নিজেকে সোজা করল। তারপর নিরাপদে কূয়োর বাইরে এসেই একটুও দেরি না করে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড় দিল। ছাগল যখন এতে তাকে শর্তভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করল, শিয়াল ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল “ওরে বুদ্ধু! তোর শরীরে যত চুল, তোর মাথায় যদি সেই পরিমাণ বুদ্ধি থাকত তা হলে উপরে ওঠার পথ ঠিক না করে তুই নীচে ঝাঁপিয়ে পড়তি না। যেই বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় তোর জানা নেই, সেই বিপদের দিকে নিজেই নিজেকে এইভাবে ঠেলে দিতিস না।”

এ গল্পের শিক্ষণীয় হচ্ছে, যেকোনো কাজ করার আগে দেখেশুনে পা ফেলা উচিত। শয়তানের চরিত্র জানা থাকা সত্ত্বেও যে তাকে বিশ্বাস করে তার ধ্বংস হওয়াটাই স্বাভাবিক।


অহংকারের পরিণতি

অহংকারের পরিণতি সম্পর্কেও ঈশপ বহু গল্প বলেছেন। তার একটি গল্প এ রকম:

এক বনের কিনারে ছিল বিরাট একটি গাছ। তার শিকড় যেমন মাটির অনেক গভীরে পৌঁছেছিল তেমনি ডালপালাও চারপাশের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়েছিল। গাছটির ঘন পাতার রাশি সূর্যের আলো প্রতিরোধ করে মানুষকে ছায়া দিত। গাছটিতে অসংখ্য পাখি বাস করত। মানুষ ও পাখির সমাগমে গাছটির চারপাশের এলাকা মুখরিত থাকত।

এই বিরাট গাছের নিচে একটি গাছের চারা গজিয়ে ওঠে। এটি ছিল একটি নমনীয় ও নাজুক হলদি গাছ। সামান্য একটু বাতাসেই তা নুয়ে পড়ত। একদিন দু’ প্রতিবেশী কথা বলছিল। হলদি গাছকে লক্ষ্য বড় গাছটি বলল: ওহে খুদে প্রতিবেশী, তুমি তোমার শিকড়গুলো মাটির আরো গভীরে প্রবেশ করাও না কেন? কেন আমার মত মাথা উঁচু করে দাঁড়াও না?

হলদি গাছ মৃদু হেসে বলল: তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। আসলে এ ভাবেই আমি নিরাপদ আছি।

বড় গাছ বলল: নিরাপদ! তুমি কি মনে কর যে তুমি আমার চেয়ে নিরাপদ আছ? তুমি কি জান আমার শিকড় কত গভীরে প্রবেশ করেছে? আমার কাণ্ড কত মোটা ও শক্ত? এমনকি দু’জন লোক মিলেও আমার কাণ্ডের বেড় পাবে না। আমার শিকড় উৎপাটিত করবে ও আমাকে ধরাশায়ী করবে- এমন কে আছে?

গাছটি হলদি গাছের দিক থেকে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। কার ভাগ্যে কখন কী ঘটে তা কে বলতে পারে? একদিন সন্ধ্যায় ওই এলাকার ওপর দিয়ে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। ঘূর্ণিঝড়ে শিকড়সহ গাছ উপড়ে পড়ে, বনের গাছপালা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।

ঝড়ের পর গ্রামবাসী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখতে বের হল। আকাশচুম্বী গাছগুলোর অবস্থা একেবারে শোচনীয়। সেগুলো হয় উপড়ে পড়েছে অথবা ভেঙে চুরে শেষ হয়ে গেছে। সারা বনের মধ্যে যেন গাছপালার কঙ্কাল ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে শুধু একটি ব্যতিক্রম সবার নজর কাড়ে। তা হলো হলদি গাছ। সেও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল ঝাপটার শিকার হয়ে এদিক ওদিক হেলে পড়েছে কিংবা মাটিতেও লুটিয়ে পড়েছে। ঝড় শেষ হয়ে যাবার পর সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ও আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার বিরাট প্রতিবেশী গাছটির কোনো চিহ্নও দেখা গেল না।

Facebook Comment

You May Also Like

x