Thursday, May 2, 2024
Homeকিশোর গল্পদূর থেকে দেখা - পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

দূর থেকে দেখা – পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

জাঁকালো শীতের রাত। কিন্তু কুবোও ঘুমোয়নি, কুবোর বোনও ঘুমোয়নি।
বোন কুবোকে ফিসফিস করে বলল, দাদা, তোমার বড়ো হতে ইচ্ছে করে না?

কুবো বলল, বয়েসে বড়ো? সে তো আমি হয়েই গেছি। আমার বয়েস কুড়ি। তুই আমার চেয়ে ছ-বছরের ছোটো।

কুবোর বোন বলল, না দাদা, আমি তোমাকে লম্বা হওয়ার কথা বলছি। তোমাকে সবাই হ্যাটা করে, পিছনে লাগে, কুকুর লেলিয়ে দেয়। মা বলে, ছেলেটা যেদিনই একটু বাইরে বেরোয় একটা না একটা আঘাত নিয়ে ঘরে ফেরে। সত্যিই তাই। সেদিন মিষ্টু ইঁট ছুঁড়ে তোমার পা খোঁড়া করে দিল। দাদা, তুমি এমন নরম মনের মানুষ, কারোকে কিচ্ছু বলতে পারো না। মিষ্টুদের ঘরে নালিশ করতেও দিলে না। তাই বলছি দাদা, আমি এমন একটা উপায় জানি যাতে তুমি অনেক বড়ো হয়ে উঠবে, নিজেকে মহাবলী বলে ভাবতেও ইচ্ছে করবে তোমার। আমি জানি তুমি কারোর ক্ষতি করতে – এমনকী ক্ষতি চাইতেও পারবে না। তবু ওইভাবে আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়াটা খারাপ নয়।

কুবো একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, বড়ো হতে ইচ্ছে করে বইকী। দৈত্যের মতো বিরাট। আমার সবচেয়ে অসহায় লাগে কোথায় জানিস? যখন অমিয় জেঠুর মতো কেউ এসে মা-কে বলে আমাকে কোনো সার্কাসে বেচে দেওয়ার কথা। তুই সেদিন ঘরে ছিলি না, জেঠু এসেছিলেন। ওই কথা বললেন। আমি জেঠুকে বললাম, আমি মা-কে খেতে দিতে না-পারলেও মা তো আমাকে বেচবেন না জেঠু! তিনি মা-র সামনেই বললেন, আমি হয়ত কোনো অভিশাপ পাওয়া যখ। আর বললেন যে, আমার বাবা ছিলেন স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান মানুষ, অমন মানুষ এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন কী করে তাই আশ্চর্য। আমার মা-ও স্বাভাবিক, আর বোন তো রীতিমতো সুন্দরী – তবে আমি কেন এমন? কুড়ি বছর বয়েসেও যাকে মাঝে-মাঝেই হয় মা-র কোলে নয় বোনের কোলে চাপতে হয়, কারণ আমার মাথা মা-র হাঁটুর কাছে আর বোনের কোমর পর্যন্ত মোটে পৌঁছায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও চেয়ার কিংবা খাটের বসার জায়গাটা-শোয়ার জায়গাটা নাগাল পাই না। অথচ এই আমার মুখেই দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। গায়ের চামড়া বড়োদের মতোই কর্কশ। হ্যাঁ, আমি মানছি আমার চেহারা কিম্ভূতকিমাকার! তা বলে তোরা আমাকে সার্কাসে বেচে দিতে পারিস, বল্‌! সেদিন মা-র মুখ দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। মা-র অমন করুণ মুখ আগে কোনোদিন দেখিনি আমি।

কুবোর বোন বলল, দাদা, এ-কথা তুমি আমাকে বলোনি কেন? দাঁড়াও কালই আমি অমিয়-র বিষ ঝেড়ে দিচ্ছি।

কুবো বলল, ওরে বদমাশ, বড়োদের নাম ধরতে হয়?

-–যাদের বাবা নেই, ছেলে বড়ো হয়েও অসহায়, তাদের ঘরের ছোটোদেরও একটু মুখরা হতে হয় দাদা।

–-ওর যা বলার বলেছেন, আমরা ওকে খারাপ কিছুই বলব না। কই মা তো রাজি হয়ে যায়নি জেঠুর কথায়।

–-ছিঃ, মা কি কখনো লোকের অমন কুপ্রস্তাব মেনে নেয়? মুখেও এনো না ওসব কথা। কিন্তু তোমাকে সেলুনে হেনস্থার কথা মনে নেই? তখন উনি তো প্রায়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতেন শুনেছি। ওকে অত সম্মান কিসের!

কুবো বলল, না, লক্ষ্মীটি, আমার দিব্যি, কারোকে খারাপ কিচ্ছু বলবি না। তার চেয়ে বল আমাকে বিরাট করে দেওয়ার বন্দোবস্ত তুই কোথা থেকে পেলি? কীভাবে পেলি? বন্দোবস্তটা কী?

বোন দাদার আর কাছে সরে এসে একটু ভেবে বলল, তোমাকে নিয়ে ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে মাত্র কিছুদিন আগেই, স্কুল ছুটির পরে আমার চার বান্ধবীর সঙ্গে সিঁয়াকুল তুলতে গিয়ে, কারখানা-ডাঙার মাঠে। তুমি আমার সঙ্গে এখনই ওদিকে একটু যাবে?

কুবো অবাক হয়ে গেল – এখন? এই ঠান্ডার রাতে?

–-চিন্তা নেই, আমি তোমায় আগাগোড়া কোলে নিয়ে যাব। তোমার কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। জানলা খুলে দ্যাখো আজ কী সুন্দর জ্যোৎস্না রাত! দাঁড়াও জানলাটা খুলি।

–-জানলা খোলার শব্দ পেলে ও-ঘরে মা কিন্তু জেগে যাবে। খুব বকুনি খাবি।

-–কিচ্ছু হবে না।… হলো একটুও আওয়াজ? বাইরে তাকাও। কতদূর দেখা যাচ্ছে দেখো।

–-সত্যিই সুন্দর। কিন্তু এখন যাব না। কেন, অন্য সময় তোর মন্তর খাটবে না?

–-মন্তর নয়, অন্য ব্যাপার, আলো কম হলে ভালো হয়।

–-ভোর বেলা?

–-হ্যাঁ, তাও চলবে। ভালো করে আলো না-ফোটার আগেই কিন্তু।

এক বছর আগেও কুবোকে নিয়ে একটা খেলা প্রচলিত ছিল। কুবোর তখন সদ্য দাড়ি-গোঁফ বেরোতে শুরু করেছে। বাদল নাপিতের সেলুনে একটা আরামদায়ক গদিমোড়া চেয়ার, কিন্তু বেশ উঁচু, কুবোর পক্ষে তো আরোই। কুবোকে দেখলেই বাদল নাপিত ছোঁ মেরে সেলুনের ভেতরে ধরে নিয়ে যেত আর একটা একটা শর্ত আরোপ করত। কুবো যদি নিজের চেষ্টায় চেয়ারে উঠতে পারে – তাহলে তার চুল-দাড়ি কাটা ফ্রি। চায়ের দোকানের মতো সব সেলুনেই কিছু আড্ডাবাজ লোক থাকে, অন্যের দুর্দশা দেখাই যাদের একমাত্র কাজ। কুবো এই পরীক্ষা দিতে না চাইলেও তাদের চক্রব্যূহ থেকে তার মুক্তি নেই। চেয়ারে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে কুবো কুমড়োর মতো মাটিতে গড়াগড়ি খায়। আর লোকগুলি হেসে হয় কুটোপাটি। কুবোর হাত-পা ছড়ে গিয়ে তখন রক্ত গড়াচ্ছে। এটা যে একটা নিষ্ঠুর খেলা তা কারোরই মনে হয় না। শেষে কুবো হয়ত অমিয় জেঠুকে দর্শকদের মধ্যে পেয়ে তাঁর হাত ধরে বলল, ও জেঠু, আমি তো আর পারছি না। ওদের বলে দাও না আমাকে ছেড়ে দিতে। আমি চুল-দাড়িও কাটব না।

অমিয় জেঠু বললেন, এই খেলার রেফারি বাদল নাপিত। ও বললে তবেই খেলা শেষ হবে।

বাদল নাপিত বলল, আমি যদি রটিয়ে দিই তুই পরীক্ষা ছেড়ে মাঝপথে পালিয়েছিস তাহলে পয়সা দিলেও অন্য কোনো নাপিত তোর চুল-দাড়ি কাটবে না।

এই উপদ্রবে মা বন্ধই করে দিলেন কুবোর সেলুন যাওয়া। কিছুদিন বোন নিজেই কাটতে লাগল দাদার চুল আর দাড়ি। কিন্তু এতে একটা মুশকিল হলো। আনাড়ি হাতে ক্ষুর চালাতে গিয়ে বোন প্রায়ই দাদার গাল কেটে ফেলে। রক্ত দেখে সে নিজেই ভয় পেয়ে যায়। মা বলল, কাঁচি দিয়ে আস্তে-আস্তে চুল ছাঁটতে পারিস তো পারবি – দাড়ি কাটার দরকার নেই – যেমন বাড়ে বাড়ুক।

সেই থেকে কুবোকে দেখায় বালখিল্য মুনিদের মতো। বালখিল্য মুনিরা ছিলেন আকারে বুড়ো আঙুলের মতো, এদিকে তাঁদের বুক অব্দি দাড়ি, মুখে বয়েসের ছাপ, তাঁরা থোকা-থোকা ফলের মতো ঝুলে থাকতেন গাছের ডালে।

কারখানা-ডাঙা এক দিগন্ত-জোড়া প্রান্তর। কোথাও-কোথাও চাপ-চাপ গাছগাছালি, তারপর পাথুরে ডাঙা। কোথাও লাল কাঁকুরে মাটি। তারপর আবার গাছপালার সন্নিবেশ, আবার ওরকম পাথর ও কাঁকর। এইভাবে পরম্পরাটা কত দূর যে গেছে তার ঠিক নেই। একসময় এখানে একটা বিরাট কারখানা হওয়ার কথা ছিল। ক্ষয়ে-যাওয়া অর্ধসমাপ্ত সীমানা-প্রাচীর এখনো কোথাও-কোথাও টিঁকে আছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই এই কংক্রিটের উপদ্রব পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যেসব বড়ো-বড়ো গাছ কাটা পড়েছিল, যে-কটি পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছিল তাদের আর ফিরে পাওয়া যাবে না। পুকুর ছিল চার-পাঁচটা এখানে বড়ো বড়ো। আছে সবচেয়ে ছোটো দুটো। সামকাঁহাল পাখিদের আস্তানা আর খাবার খোঁজার জায়গা সবই কমে গেছে। অত বড়ো দেহ, লম্বা ঠোঁট, সংখ্যায় অতগুলি তারা, উদ্বাস্তুদের মতো জীবন কাটাতে হয় তাদের। ফ্যাক্টরি তৈরি হওয়ার ফুর্তিতে মানুষ ওদের যথেষ্ট বিরক্ত করেছে, মেরেছে, সেই আতঙ্ক আজও যায়নি ওদের। যথেষ্ট সংখ্যায় সত্যিকার বড়ো গাছ না থাকায় সামকাঁহালের দল এখন বাধ্য হয়ে রাত কাটায় লোহার তৈরি গাছে, আকাশ-ছোঁয়া তারখুঁটিগুলোর ওপর।

আলো না-ফোটার আগেই কুবোদের এখানে চলে আসার কথা ছিল, কিন্তু আসতে আসতে ব্রাহ্ম-মুহূর্ত কেটে গেছে। ফর্সা হয়ে গেছে চারিদিক। কুয়াশা নেই, তবে বড্ড শীত এই ফাঁকা জায়গায়। পাতাফাতা জ্বেলে কুবোর বোন খানিকটা আগুন করল। নিজের হাতের চেটো আগুনে গরম করে দাদার গালে, পায়ের তলায় এনে দিল তাপ। একটা ছোট্ট ঢিপির ওপর কুবোকে বসিয়ে বলল, দাদা, এবার আমি অনেক দূর চলে যাব, ডাকলেও তুমি শুনতে পাবে না। তুমি চোখ বুজে কান খাড়া করে থাকবে, আমি তারখুঁটির গা পাথর দিয়ে জোরে জোরে ঠুকব। তুমি হয়ত অতটা জোরে নয় তবু ঠং-ঠং আওয়াজটা শুনতে পাবে ঠিকই। আওয়াজ শুনলে তবে চোখ খুলবে।

কুবো চোখ বন্ধ করে আছে। আওয়াজ আর আসছে না। (মনে মনে) এক-দুই-তিন-চার…পঞ্চাশ… এখনও শব্দ আসছে না মানে বোন বহু দূরে চলে গেছে। একসময় শব্দটা আসতে লাগল। খুব আবছা। কুবো চোখ খুলল। অনেক দূরে একটা তারখুঁটির নিচ থেকে বোন তার রঙিন চাদরটা নাড়ছে। রঙিন বলেই কোনোভাবে বোঝা যাচ্ছে, খানিকটা রঙের ছোপ। তারখুঁটিটা যেন অনেক নিচু হয়ে গেছে। অথচ সামনেরগুলো এখনো আকাশ-ছোঁয়া, আবার আরো দূরের কয়েকটা যেন কুবোর হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। দূরবর্তী গাছপালারও ওই দশা, দূরের কিছুই আর ততটা উঁচু নয়।

কুবোর চোখে জল এসে যাচ্ছে। এই জায়গাটা গাঁয়ের মধ্যেই, এতকাল সে আসেনি কেন? একসঙ্গে এতটা ফাঁকা কুবো এই প্রথম দেখল। ধীরে ধীরে রোদ উঠছে। গোরুর পাল চরতে আসছে। একেকটি গোরু আকারে খরগোশের চেয়ে বড়ো নয়। এইভাবে বোনের বুদ্ধিতে কুবো আকারে-আয়তনে এক বিরাট মানুষ হয়ে উঠেছে। তার এখন মনে হচ্ছে, তাকে কম-মানুষ হিসেবে দেখা শুধু দেখার ভুল। আকাশচুম্বী যে তারখুঁটি, ডালপালা মেলে-থাকা বড়ো বড়ো যে গাছ তারা পর্যন্ত এই ভুলের শিকার। কুবো যে তাদের নিজের চেয়েও ছোটো দেখছে তা কি সত্যি? কিংবা তা কি মিথ্যে? কোনোটাই নয়।

বোন কাছে এল। আবার কুবো ছোটো হয়ে গেল। একনাগাড়ে দৈত্য হয়ে থাকতে ভালোও লাগে না।

কুবো বোনকে বলল, এবার থেকে তোর কাজ বেড়ে গেল যে!

–-তোমাকে প্রায়ই এখানে নিয়ে আসতে হবে বলে বলছো?

–-হ্যাঁ, ঠিক তাই।

–-কিন্তু দাদা, এমনও তো হতে পারে আমি স্কুলে গেলাম আর তোমার এখানে আসতে ইচ্ছে হলো! মাঝে-মাঝে একা আসতে পারবে না?

–-লোকজনের মাঝ দিয়ে কোথাও যেতে আমার যে বড্ড ভয় রে! অন্য কিছুকে নয় নিজের গ্রামের লোককেই আমার বেশি ভয়।

–-তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে তুমি কী বিশাল হয়ে উঠতে পারো একনিমেষে! এই বিশ্বাসে ভর করেই তোমাকে গ্রাম পার হতে হবে।

–-আচ্ছা আমি তোর কাছে শিখে নিলাম বিদ্যেটা।

দু-জনে পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল। কুবো জোরে জোরে হাসছে, বোন মিটিমিটি।

ছোটোখাটো ব্যাপারে হা-হা হাসি আবার এমনই অনেক ছোটোখাটো বিষয়ে চোখ ভিজে যাওয়া–-এই হলো কুবোর অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য।

হারু ঘোষের কথা গ্রিনরুমের আড়াল থেকে শুনে একদিন তেমনি হলো।

হারু ঘোষ ছোটো দলে কাজ করেন, তিনি নায়ক আর তাঁর স্ত্রী নায়িকা। হারু ঘোষ এখানে আসছেন পর পর সাত বছর। আগামী বছরের পালা এবছরই কিছু আগাম দিয়ে বুকিং করতে হয়। কিন্তু আগামী বছর গ্রাম-ষোলো আনা আর হারু ঘোষকে চাইছে না। তারা চায় অন্য পালা, অন্য আর্টিস্ট।

ষোল আনার মুরুব্বি বারিদ দাদুকে হারু ঘোষ বলছেন, সামনে বছরও আমাদের বায়না করুন, না করবেন না দয়া করে। বছরে মোটে ষাট-সত্তরটি নাইট করতে পাই – তার বেশি নয়। আপনাদের দেখাদেখি এলাকার আরো কিছু জায়গায় আমাদের বুকিং হয়। তাই আপনাদের দিকে সারা বছর চেয়ে থাকি। আসছে-বারের যাত্রা আরো জমজমাট, মিলিয়ে নেবেন।

তারপর হারু ঘোষ খুবই দুঃখিত হয়ে বললেন, আসলে কী জানেন, আমরা যখন কোনো শহর-বাজারে যাই, কিংবা যে শহরে থাকি সেখানেও কেউ আমাদের পাত্তা দেওয়া দূরে থাকুক সম্মানও করে না। আপনারা পুকুরের মাছ ধরে কত যত্ন করে আমাদের খাওয়ান, কত সম্মান! মাঝে-মাঝে কেউ-কেউ দেখি খাতা নিয়ে এসেছে, অটোগ্রাফ লাগবে। মন ভরে যায়। জীবিকা ছাড়াও এসব পাওয়াও আমাদের কাছে বড়ো ব্যাপার। এরপর আর যদি আমাদের না বায়না করেন – যদি কোনোদিনই না আনতে চান আমাদের – এই দেখুন মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে – আচ্ছা, আমি আর আমার স্ত্রী না হয় এখানে অভিনয়-বাবদ আমাদের পারিশ্রমিক নিলাম না, সেই টাকাটা আপনাদের ছাড় দেওয়া হবে!

বারিদ দাদু বললেন, দেখি!

যাত্রা অভিনয়ের আগে মাইকে ঘোষণা হলো, নায়িকার চরিত্রে যিনি অভিনয় করবেন – শ্রীমতী অমুক (কুবো শুনেছে তিনিই নায়ক হারু ঘোষের স্ত্রী) তাঁর ছ-মাসের বাচ্চার খুব জ্বর। তাই অভিনয়ে তাঁর যদি কোথাও ভুল-ত্রুটি হয়, দর্শক যেন তাঁকে ক্ষমা করেন।

কুবোর আর যাত্রা দেখতে ইচ্ছে করলো না। গলার ভেতর জড়ো হতে লাগলো দলা-পাকানো বাষ্প।

কুবোর বিচিত্র চেহারার জন্য মা তাকে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে এনেছে। উপায় নেই। নইলে লোক ওকে উত্যক্ত করবে। যাত্রা দেখা মাথায় উঠবে।

কুবো দেখলও না পুরো যাত্রা। মাঝপথেই সে চাদর ঢাকা নিয়ে উঠে গেল। মা-কে ফিসফিস করে বলে গেল, ‘ছোটো-বাইরে’ যাবে।

কুবো এসে দাঁড়াল গ্রিনরুমের পিছনে। পালা এখন গমগম করছে, গ্রিনরুমের দিকে কারো আগ্রহ নেই।

ছেঁড়া কাপড়ের ফুটো দিয়ে কুবো দেখল, নায়িকার বাচ্চাটা একটা অয়েল-ক্লথের ওপর শোয়ানো, একটা ঢাউস বাক্সের মাথায়। ম্যানেজার খাতায় হিসেব লিখছে। বাচ্চাটা যে কখন থেকে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে, তার মুখ থেকে মধু-দেওয়া রবারের চুষিটি খসে পড়েছে, ম্যানেজারের ভ্রূক্ষেপই নেই। কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটা একসময় চুপ করে গেল, কিন্তু তখনো তার ছোটো পেটটা জোরে-জোরে ওঠা নামা করছে। তার মানে কান্না থামেনি, দম ফুরিয়ে গেছে। এসময় ওর মা-কে দরকার। স্টেজে ওর মা-র ভূমিকা শেষই হচ্ছে না। কুবোর ইচ্ছে করলো এক ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়।

কুবো সত্যিই থাকতে পারল না, গ্রিনরুমে ঢুকে পড়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। ম্যানেজার কুবোকে দেখে প্রথমে ভাবল, হয়ত কোনো বাচ্চা ছেলে, তারপর ওইটুকু বাচ্চার দাড়ি-গোঁফ দেখে অবাক হয়ে গেল।

কুবো বলল, বাচ্চাটা কাঁদছিল, আপনি শুনছিলেন না কেন?

ম্যানেজার বলল, ও সবসময়ই কাঁদে। ওটা ওর স্বভাব।

কুবো বলল, কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম মঞ্চ থেকে একজন মহিলা এসে ঢুকলেন, তিনি বসে রইলেন কিন্তু বাচ্চাকে কোলে নিলেন না!

ম্যানেজার বলল, দুপুরবেলা ওর মাছের পিস নায়ক-নায়িকার চেয়ে ছোটো ছিল, তাই ওর রাগ। ও বাচ্চাকে ছোঁবে না।

তারপর আবার আগের উৎসাহ ফিরিয়ে এনে ম্যানেজার কুবোকে বলল, তোমাকে আমাদের যাত্রায় খুব দরকার। আমাদের সঙ্গে তোমায় যেতে হবে। না বললে কিন্তু শুনছি না।

কুবো দু-পা পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দিতে পারল না।

ম্যানেজার বলল, নিজের ইচ্ছেয় যেতে না চাইলে তোমাকে এক্ষুনি বাক্সে পুরে ফেলব। দেখছো না, কতো বড়ো-বড়ো বাক্স আমাদের! তোমার মতো তিন-চারটে বাচ্চা – না, না – লোক, লোক – হেসে-খেলে ঢুকে যাবে।

ব’লেই, হাট্টাকাট্টা লোকটা হা-হা করে হাসতে লাগল।

কুবো বাচ্চা নিয়ে পালিয়েও যেতে পারছে না, আবার বাচ্চাকে কোল থেকে নামিয়েও দিতে তার মন সায় দিচ্ছে না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগল। তার মনে হলো, এটা যদি কারখানা-ডাঙা হতো, একটু দূর থেকে ম্যানেজার তার রূপ দেখেই চমকে উঠত, এবং মোটেও ঠাট্টাতামাসার মেজাজে থাকত না। বাচ্চাকে নিয়েও কুবোকে দোলাচলে পড়তে হতো না। কুবোর বলিষ্ঠ কোলে সে সুরক্ষিত থাকত।

নায়িকার বাচ্চাটি মারা গেল পরদিন দুপুরে। কাল গেছে পৌরাণিক, আজ সামাজিক পালা। পৌরাণিক কাহিনির চেয়ে সামাজিক গল্পেই সবার আকর্ষণ বেশি। বাচ্চার ঘটনাটি কারোর কাছেই এমন কিছু মনে হলো না। ওর সৎকারের পরেও হাতে থাকবে অনেকটা সময়, গাঁয়ের যাত্রা শুরুই হয় রাত-দুপুরে, তাহলে যাত্রা ক্যানসেল হবে কেন? লোকে গিয়ে ষোলো আনা কমিটিকে ধরল।

কমিটি বলল, ব্যবস্থা হচ্ছে।

খানিক পরে যাত্রার ম্যানেজার ওদের আশ্বাস দিয়ে বলল, যখন দুটো পালা একসঙ্গে হওয়ার কথা, তখন দুটোই হবে। মানে, একটা কাল হয়েছে, দ্বিতীয়টি আজ হবে, এর কোনো অন্যথা হবে না। আমাদের কোম্পানির নাম-বদমানের ব্যাপার জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে।

জনতা বলল, শুধু তাই নয়, ওই নায়িকাকেই চাই। ওনার অভিনয় আমরা ভালোবাসি। আচ্ছা আমরা কমিটিকে কথা ফিরিয়ে নিতে বলছি। সামনে বার আপনাদের কোম্পানি এসেই যাত্রা করুক।

ম্যানেজার খুশি হয়ে বলল, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। নায়িকা অবশ্যই আজ যাত্রা করবেন।

কুবো কোনোদিন নিজের রাগ টের পায়নি, এই ঘটনার কথা শুনে আজ তার শরীর রাগে রি-রি করতে লাগল। তার মনে হলো সে যদি মহাশক্তিশালী রূপটি সবার সামনেই ধারণ করতে পারত, সেদিন ম্যানেজারের কাছে তার ওই দশা হতো না। কী করেছিল সে, যার জন্য লোকটির পায়ে ধরে কেঁদেকেটে তাকে মুক্তি চাইতে হয়েছিল? সে কিছু অভিনয় না-জানা সত্ত্বেও তাকে জোকারের অভিনয় করে ওই ম্যানেজারকে এবং যে-অভিনেতারা সেইসময় স্টেজ থেকে গ্রিনরুমে ফিরে এসেছিল তাদের হাসাতে হয়েছিল! ভয় দেখানোর জন্য হলেও ওই রূপ কুবোর কাজে লাগত। এসব না-হয় তাকে নিয়ে লেগেই থাকে। তার গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তার ইচ্ছে করছে ওই রূপ ধরে সত্যি-সত্যিই অবুঝ মানুষের এই অমানুষিক আনন্দের আয়োজন ছারখার করে দিতে। গ্রিনরুমে নায়িকার বাচ্চাকে আলগোছে কাঁধের ওপর ফেলে কোলে নেওয়ার পরে কিছুটা ছানা হয়ে যাওয়া দুধ উঠে এসছিল বাচ্চাটার পেট থেকে। সেই টক-টক গন্ধ এখনো লেগে আছে কুবোর জামায়। কুবো ভুলতে পারছে না তাকে।

মনের দুঃখে কুবো চলে গেল সেই নির্জনে। আজ সব সীমা ছাড়িয়ে অ-নে-ক দূরে।

সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল। আকাশ বহু বর্ণে রাঙা। সামকাঁহালের দল রঙের ওপর কালো পেনসিল দিয়ে আঁকা বক্ররেখার মতো দল বেঁধে তারখুঁটির দিকে আসছে। দূরে দেখা যাচ্ছে কুবোদের গ্রাম, হাইস্কুলের তিনতলা বাড়িটি দেশলাই-বাক্সের মতো। সুদূরের একটা চিমনির গলা বেরিয়ে আছে চাপ-বাঁধা গাছপালার ভেতর থেকে। এখান থেকে তার দৈর্ঘ্য বড়োজোর একহাত হবে – তার বেশি নয়। চিমনির মুখে ট্যারাব্যাঁকা ধোঁয়া থমকে দাঁড়িয়ে আছে। কুবো ইচ্ছে করলেই এক ফুঁ-য়ে তৎক্ষণাৎ উড়িয়ে দিতে পারে। পাকা সড়কের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে যত গাড়ি, একটা ঢিপির ওপর দাঁড়িয়ে এতদূর থেকে কুবোর মনে হচ্ছে, দু-আঙুল দিয়ে তুলে সব ক-টা গাড়িকে অনায়াসে পকেটে পুরে নেওয়া যায়। অমন বিশাল পুকুর– বেহুলা– এখন তার হাতের চেটোয়-রাখা আচমন করার এক গণ্ডূষ জল! কুবোর ভেতর থেকে কে যেন বলল, হ্যাঁ, এই তো চাই, দ্যাখো, দ্যাখো, এখান থেকে-দেখা মানুষদের চাহিদা, লাফালাফি, সব ছোটো হয়ে গেছে। মানুষ নিজেই এমন ছোটো হয়েছে যে তাদের পোকার মতো কিলবিল করতে দেখে কুবোর করুণা হলো। নায়িকার বাচ্চাটির কথা আবার মনে পড়লো। ওর প্রতি সবাই এতটা হৃদয়হীন না হলেই পারত। তবু মানুষের সব কিছু ছোটো হয়ে আসার দিকে তাকিয়ে নিজের এই বিরাটত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে চোখ মুছতে-মুছতে কুবো সবাইকে কিছুটা ক্ষমাই করে ফেলল। সহৃদয় শক্তিমান যেভাবে ক্ষমা করে অক্ষমকে!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments