Wednesday, August 27, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পডুবুরি জাহাজ - সুকুমার রায়

ডুবুরি জাহাজ – সুকুমার রায়

ডুবুরি জাহাজ – সুকুমার রায়

প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে একজন ফরাসি লেখক একটা গল্প লিখিয়াছিলেন, তাহাতে এক অদ্ভুত জাহাজের কথা ছিল। সে জাহাজকে মাছের মতো জলের উপর বা নিচ দিয়া যেমন ইচ্ছা চালান যাইত। সে সময়ে লোকের কাছে গল্পটা অসম্ভব গোছের শুনাইয়াছিল এবং অনেকে গল্পলেখকের ‘আজগুবি কল্পনার’ খুব প্রসংশা করিরাছিলেন। কিন্তু এখন আর এরূপ গল্পে লোকের আশ্চর্য হইবার কথা নয়,— কারণ, বাস্তবিকই ঐরকম জাহাজ এখন অনেকগুলি তৈয়ার হইয়াছে। শুধু ইংলন্ডেই এখন অন্তত পঁচাশিটা এইরূপ জাহাজ আছে।

জাহাজ যতক্ষণ জলের উপর থাকে ততক্ষণ তাহার পিঠে নানারকম মাস্তুল, দড়ি, কলকব্জা ইত্যাদি দেখা যায় কিন্তু জাহাজ ডুব মারিবার আগে এ সমস্ত গুটাইয়া লওয়া হয়। তখন কেবল দুটি চোঙা আর একটি টুপির মতো ঢাকনি জাহাজের উপরে থাকে। ঢাকনিটার গায়ে পুরু কাঁচের সারসি দেওয়া থাকে, তাহার ভিতর দিয়া জাহাজের কাপ্তান বাহিরের সমস্ত দেখিতে পান। জাহাজটা যতক্ষণ আধ-ডোবা অবস্থায় থাকে ততক্ষণ এইভাবে দেখার কাজ চলিতে পারে, কিন্তু আর কয়েক হাত ডুবিলেই সে পথ বন্ধ। তখন ঐ চোঙা দুটিই চোখের কাজ করে—চোঙার আগায় আয়না ও কাচ শুদ্ধ একটি যন্ত্র বসান থাকে, যন্ত্রটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া চারিদিকে তাকাইতে থাকে—আর জাহাজের কাপ্তান নিচে বসিয়া সেই আয়নার সাহায্যে বাহিরের সমস্ত অবস্থা দেখিতে পান। দশ হাতের নিচে গেলে এই ‘দিকবীক্ষণ’ যন্ত্রও ডুবিয়া যায়, তখন কেবল আন্দাজে আর কম্পাস্‌ দেখিয়া জাহাজ চালাইতে হয়।

জাহাজের মধ্যে একটা লোহার চৌবাচ্চা থাকে—চৌবাচ্চাটা খালি থাকিলে জাহাজ জলের উপর ভাসে কিন্তু চৌবাচ্চাটার মধ্যে জল ভরিলে জাহাজ ভারি হইয়া ক্রমে ডুবিয়া যায়। এইরকমে জল বাড়াইয়া বা কমাইয়া জাহাজকে অল্প বা বেশি ডুবান যায়। তাড়াতাড়ি জল ভরিবার বা খালি করিবার জন্য জাহাজের মধ্যে বড় বড় ‘পাম্প’-কল রাখা হয়—তাহার সাহায্যে এক মিনিটের মধ্যে জাহাজকে পঞ্চাশ হাত জলের নিচে ডুবাইয়া দেওয়া যায়। জাহাজের দুই পাশে ও পিছনে মাছের ডানা ও লেজের মতো হাল বসান থাকে, সেইগুলিকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া জাহাজের মুখ ডাইনে বাঁয়ে উপরে নিচে যেমন ইচ্ছা ফিরান যায়। পিছন দিকে দুইটা পাখার মতো ইস্ক্রুপ ঘুরিতে থাকে তাহাই জল কাটিয়া জাহাজকে চালায়। জাহাজের ভিতরে বড় বড় লোহার বোতলে চাপ দিয়া বাতাস ভরিয়া রাখা হয়। তাহাতে জাহাজের বাতাস অনেকক্ষণ পরিষ্কার রাখিবার সুবিধা হয় এবং অন্যান্য কাজও চালান যায়। ক্রমাগত চব্বিশ ঘণ্টা জলের নিচে থাকিলেও জাহাজের লোকেরা কোনরকম অসুবিধা বোধ করে না। জাহাজের এরূপ বন্দোবস্ত করা যায় যাহাতে একটা জাহাজ কোথাও না থামিয়া চার হাজার মাইল স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারে।

মনে কর আমরা এইরূপ একটা জাহাজের মধ্যে ঢুকিয়াছি—ঢুকিয়াই সকলের আগে চোখে পড়ে—জাহাজের এক মাথা হইতে আর এক মাথা পর্যন্ত কেবল চাকা আর লোহা আর কলকব্জা। চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র নাই বলিলেই চলে। সমস্ত জাহাজটা যেন একটা প্রকাণ্ড বৈদ্যুতিক কারখানা; সেই বিদ্যুতে জাহাজ চলে এবং জাহাজের বাতি জ্বালা রান্না করা পর্যন্ত সমস্ত কাজ হয়। জাহাজের কাপ্তান কোথায়? ঐ যে তিনি জাহাজের ‘টুপি’র নিচে বসিয়া দিকবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া চারিদিক দেখিতেছেন।

কাপ্তান উপর হইতে হুকুম করিতেছেন আর অন্য একটি কর্মচারী নাবিকদিগের দ্বারা সেই হুকুম তামিল করাইতেছেন। প্রত্যেক লোক তাহার নিজের নিজের জায়গায় প্রস্তুত হইয়া আছে—কখন কি হুকুম আসে! কাপ্তান বলিলেন, ‘জাহাজ ডাইনে ফিরাও’, অমনি একটা চাকা ঘুরাইবা মাত্র জাহাজ ডাইনে ফিরিয়া গেল। ‘থাম! টর্পিডোওয়ালা, প্রস্তুত হও।’ টর্পিডো কেন? শত্রুপক্ষের জাহাজ দেখা গিয়াছে। টর্পিডো বড় সাংঘাতিক অস্ত্র। একবার বিপক্ষের জাহাজে ভালমত টর্পিডো দাগিতে পারিলে আর দ্বিতীয়বার মারিবার দরকার হয় না। একটা প্রকাণ্ড ছুঁচোবাজির মতো তার চেহারা—তার ভিতরে বারুদ আর অদ্ভুত কল-কারখানা। ডুবুরি জাহাজের সামনেই টর্পিডোর কলখানা—সেই কলের চাবি টিপিলেই টর্পিডো ঘণ্টায় ৪০০ মাইল বেগে ছুটিয়া বাহির হয় এবং বিপক্ষের জাহাজে বা অন্য কোন শক্ত জিনিসে ঠেকিয়া বাধা পাইবামাত্র ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া ও জাহাজ ফাটাইয়া এক তুমুল কাণ্ড বাধাইয়া দেয়। বড় ডুবুরি জাহাজে ৩/৪টি পর্যন্ত টর্পিডো কল থাকে। ‘টর্পিডোওয়ালা প্রস্তুত হও!’ হুকুম আসিবামাত্র তাহারা প্রস্তুত! সকলেই জানিয়াছে বিপক্ষের জাহাজ আসিতেছে—কাহারও মুখে টুঁ শব্দটি নাই। জাহাজের মধ্যে কেবল কলের বন্‌ বন্‌ শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নাই।

হুকুম আসিল ‘৪০ হাত নামাও’—বলিতে বলিতে জাহাজ ডুবিতে লাগিল। একটা কলের কাঁটা আস্তে আস্তে সরিয়া যাইতে লাগিল—২০ হাত, ২৫ হাত, ৩০ হাত। ৪০-এর দাগে কাঁটা নামিল। এখন আর বাহিরের কিছুই দেখা যায় না। কাপ্তান এখন ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া আছেন। বিপক্ষের জাহাজটি ঠিক কোনদিকে এবং কতদূরে তিনি খুব ভাল করিয়া তাহার হিসাব লাইয়াছেন—তাঁহার জাহাজ কিরকম জোরে চলিতেছে তাহাও তিনি জানেন—সুতরাং তিনি ঠিক বলিতে পারেন কোন্‌ মুহূর্তে দুই জাহাজ কতখানি তফাৎ থাকিবে। নিঃশব্দে জলের নিচে জাহাজ চলিতেছে—শত্রুজাহাজ কিন্তু তাহার কিছুই জানে না। ‘জাহাজ উঠিতে দাও’—আবার কলের কাঁটা নড়িয়া উঠিল—’ত্রিশ হাত, বিশ হাত, দশ হাত—বাস!’—’সম্মুখের টর্পিডো হুঁশিয়ার হও!’ এতক্ষণে দিকবীক্ষণ যন্ত্র ভাসিয়া উঠিয়াছে—আবার সব দেখা যাইতেছে। আধ মাইল দূরে শত্রুর জাহাজ—প্রকাণ্ড যুদ্ধজাহাজ। প্রায় ২০টা ডুবুরি জাহাজের সমান। কাপ্তান একমনে হিসাব করিতেছেন জাহাজটা আরেকটু সামনে সরুক, আরেকটু, আরেকটু—বাস! ‘ছাড়’! একটা ভয়ানক ধাক্কা লাগিল—ডুবুরি জাহাজ কাঁপিতে কাঁপিতে প্রায় কাৎ হইয়া গেল—হালের নাবিক তাড়াতাড়ি তাহাকে সামলাইয়া লইল। কিন্তু বিপক্ষের জাহাজে যে টর্পিডো লাগিল সে আর তাহা সামলাইতে পারিল না। জাহাজের গায়ে বিশ হাত গর্ত—জাহাজটা মাতালের মতো টলিতে টলিতে গব্‌ গব্‌ করিয়া জল খাইতে লাগিল, তারপর মাথা নিচু করিয়া ডিগবাজী খাইয়া দেখিতে দেখিতে এত বড় জাহাজটা ডুবিয়া গেল।

ডুবুরি কিন্তু সেখানে দাঁড়াইয়া থাকে নাই—সে একেবারে ডুব মারিয়া প্রাণপণে ছুটিয়াছে। যতক্ষণ সে তাহার ‘চোখ’টুকু মাত্র বাহির করিয়া চোরের মতো আসিতেছিল শত্রুরা তাহাকে দেখিতে পারে নাই কিন্তু টর্পিডো ছাড়িবামাত্র জল তোলপাড় হইয়া উঠিল—আর সকলেই বুঝিতে পারিল ‘ঐ ডুবুরি’। বিপক্ষের কামান হইতে একটি গোলা যদি ডুবুরির ঘাড়ে পড়ে তবে আর তার রক্ষা নাই। শুধু যে যুদ্ধের সময়েই দুবুরি জাহাজের বিপদের ভয় থাকে তাহা নয়। জলের পথে চলা-ফিরা করিতে গিয়া তাহার যে কত সময় কতরকম দুর্ঘটনা ঘটে ভাবিলেও ভয় হয়। জলের নিচ হইতে উঠিতে গিয়া হয়ত কোন জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়া গেল। হয়ত কোনখানে এতটুকু ফাঁক, কোথায় কলের কব্জা এতটুকু বেঠিক বসিয়াছে—আর অমনি জাহাজ বিগড়াইয়া একেবারে পাথরের মতো ডুবিয়া গেল—শত চেষ্টায়ও আর তাহাকে উঠান গেল না। এরকম কতবার ঘটিয়াছে এবং কত লোক তাহাতে মারা গিয়াছে! জাহাজ ডুবিয়া গেল; ডুবুরি নামাইয়া দেখা গেল ভিতরে মানুষ বাঁচিয়া আছে, ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ করিলে তাহারা ভিতর হইতে সাড়া দেয়, অথচ তাহাদের বাঁচাইবার কোন উপায় নাই। যাহাতে এরকম দুর্ঘটনা না হয়, তাহার জন্য প্রতি বৎসর কত নূতন নূতন বন্দোবস্ত করা হইতেছে এবং জাহাজ ডুবিলেও যাহাতে ভিতরের লোকেরা পালাইয়া আসিতে পারে তাহারও ব্যবস্থা হইতেছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments