Friday, April 26, 2024
Homeবাণী-কথাদিন-দুপুরে - লীলা মজুমদার

দিন-দুপুরে – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

দুপুর বেলা বাড়িসুদ্ধ সব্বাই ঘুমোচ্ছে। বাবা ঘুমোচ্ছেন, মা ঘুমোচ্ছেন, মেজোমামা পর্যন্ত এ খবরের কাগজে মুখ ঢাকা দিয়ে বেজায় ঘুমোচ্ছন। কিন্তু টুনুর আর ঘুমই আসে না। তাকিয়ে দেখল হাবুটা অবধি চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে আছে। তাকে ডাকা চলে না মেজোমামা যদি জেগে যান! টুনু শুয়ে শুয়ে ভাবছে বাবার নতুন ঘোড়া খুব সুন্দর হলেও দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালুর কাছে লাগে না। লালু কত কালের পুরোনো, সেই কবে মেজোমামা যখন ইস্কুলে যেতেন তখনকার! কীরকম প্রভুভক্ত! ওর গায়ে কী জোর! ভাবতে ভাবতে টুনুর মনে হল– বাদলা দিন বলে বাবা আবার আজ ঘোড়ায় চড়তে বারণ করেছেন। বড়োদের যদি কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে। আচ্ছা, আজকের দিনই যদি ঘোড়ানা চড়বে, তা চড়বে কবে!

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই টুনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, চোখ দুটো গোলমাল হয়ে গেল। দেখল দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালু কেমন যেন মুচকি হাসতে হাসতে উঠোন পার হয়ে বাবার নতুন ঘোড়া রতনের আস্তাবলে ঢুকল। টুনু উঠে এসে জানলার আড়ালে দাঁড়াল। একটু বাদেই রতন লালু দুজনেই আস্তাবলের কোণ ঘুরে কোথায় যেন চলে গেল।

টুনু ডাকল– ও কেশরী, ও সই-ই-স! লালু-রতন যে পালিয়ে গেল! কিন্তু গলা দিয়ে আর স্বরই বেরুল না। বাইরে এসে ইদিক-ঊদিক তাকিয়ে যখন কেশরী সিং কিম্বা সইসের পাত্তা পেল না, টুনু নিজেই চলল আস্তাবলের কোণ ঘুরে রতন-লালুর পিছন পিছন।

কী আশ্চর্য! আস্তাবলের পিছনে সেইসব ধোপাদের কুঁড়ে ঘর, তার সামনে নোংরা মাঠে ধোপাদের গাধা বাঁধা থাকত, আর ময়লা দড়িতে সাহেবদের কোট পেন্টেলুন রোদে শুকুত, সেইসব গেল কোথায়? টুনু দেখল দু-পাশে গা ঘেঁষে ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনোটা আলু কাবলির, কোনোটা লাল-নীল পেনসিলের, কোনোটা কাঁচের মার্বেলের। চারিদিকে দোকানে দোকানে বড়ো বড়ো নোটিস ঝোলানো।

এগজিবিসন!
এই দিকেà

আর একটা দাড়িমুখো মোটকা বুড়ো একটা ফুটো বালতি পিটোচ্ছে আর ষাঁড়ের মতন গলায় চাঁচাচ্ছে পয়সা না ফেলেই ঢুকে যান! পয়সা-টয়সা কিছু চাই না, গেলেই বাঁচি!

টুনু আরও এগজিবিশন দেখেছিল, কতরকম আশ্চর্য জিনিস থাকে সেখানে: দোকান, বাতিওয়ালা থাম, বায়স্কোপ, নাগরদোলা, গোলকধাঁধা!

তাই টুনু তাড়াতাড়ি চলল, মাঝপথে একটা ষণ্ডামার্কা লোক পথ আগলে বলল, এইয়ো! টুনু তাকে দেখতেই পেল না, পায়ের ফাঁক দিয়ে সুট করে গলে এগিয়ে চলল।

হঠাৎ একটা মস্ত খোলা জায়গায় উপস্থিত হল, তার যেদিকে তাকায় কেবল ঘোড়া! বড়ো ঘোড়া, ছোটো ঘোড়া, সাহেবের ঘোড়া, গাড়োয়ানের ঘোড়া, ভালো ঘোড়া, বিশ্রী ঘোড়া। আবার একটা মড়াখেকো হলদে ঘোড়া, ওলটানো টবে চড়ে গার্গেসে গলায় বক্তৃতা দিচ্ছে :

হে ব্যাকুল ঘোড়াভাই-ভগিনী, আজ আপনারা কীসের জন্য এখানে আসিয়াছেন? পুরাকালে আপনারা বন-বাদাড়ে সুখে বিচরণ করিতেন, এই দুষ্ট মানুষগুলাই তো আপনাদের পাকড়াও করিয়া বিশ্রী গাড়িতে জুতিয়াছে। পায়ে নাল বাঁধাইয়া, পিঠে জিন চড়াইয়া, দুই পাশে অভদ্রভাবে ঠ্যাং ঝুলাইয়া চড়িয়া বেড়াইতেছে। ছিঃ! ছিঃ! আপনারা কী করিয়া এই দু-পেয়েদের কুৎসিত চেহারা সহ্য করেন?

পিছন থেকে গাড়োয়ানদের ছোটো ছোটো ঘোড়াগুলো চেঁচিয়ে উঠল, কক্ষনো সইব না! সইব না! সইব না! মিটিং করে, রেজলিউশন করে, দানা না খেয়ে মানুষদের জব্দ করব!

হলদে ঘোড়া ঠ্যাং তুলে ওদের চুপ করিয়ে দিল, টুনুর মনে হল সে নিজের ছাড়া আর কারুর গলার আওয়াজ সইতে পারে না।

এক কোণে লালু রতন দাঁড়িয়েছিল, হলদে ঘোড়া হঠাৎ লালুকে বলল, আপনি প্রবীণ ব্যক্তি! আপনি কিছু বলুন। বলবামাত্র লালু তড়বড় করে টব থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বিনা ভূমিকায় আরম্ভ করলে :

বহুকাল ধরে আমি চৌধুরিদের বাড়িতে থাকি। তাদের মতন ছোটোলোক আর জগতে নেই– টুনুর শুনে ভারী দুঃখ হল। তার ওপর তারা এমন নিরেট মুখ যে বড়োবাবু পর্যন্ত সামান্য–যাক আমি কখনো কারো নিন্দে করি না। ওদের বাড়ির ছেলেগুলো আহাম্মুকের একশেষ। আমি শিক্ষা দেবার জন্য ইচ্ছে করে ওদের কাপড় রোদে দিলে মাড়িয়ে দিই, জানলা দিয়ে ঘরে মুখ বাড়াই, বোকারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে চিনি খেতে দেয়, আর কেউ যখন দেখছে না গিন্নির হিসেবের খাতা চিবিয়ে রাখি। তা ছাড়া নোংরা জিব দিয়ে ওদের সইসের মুখ চেটে দিই, ছোটো ছেলে একা পেলেই তেড়ে গিয়ে পা মাড়িয়ে দিই, এইরকম নানা উপায়ে জাতির মান রক্ষা করি।

সবচেয়ে বিশ্রী ওদের টুনু আর হাবু বলে দুটো পোষা বাঁদর। অমন বদ চেহারার বাঁদর কেউ যে পোষে জানতাম না। ওরা আমাদের ঘুমের সময়ে এসে ঘেমো হাতে উলটো করে আমাদের গায়ে হাত বুলোয়, এমন ঘেন্না করে যে কী বলব! আবার পাতায় করে যত অখাদ্য জিনিস এনে গদগদ হয়ে শুয়োরের মতো ছুঁচলো মুখ করে, চুচু শব্দ করে খাওয়াতে চেষ্টা করে–ইচ্ছে করে দিই ঘেঁচে! কিন্তু অমন নিকৃষ্ট জীবকে মারতেও ঘেন্না করে।

.

টুনু বিশ্বাসঘাতক লালুর কথায় অবাক হয়ে গেল, এমন অকৃতজ্ঞতা দেখে তার বড্ড কান্না পেল! ছি, লালুর জন্য দাদামশাই ভালো দানা আনান– সে কথা কই লালু তো বলল না! রতনের নতুন জিনের কথাও বোধ করি সে, ভুলে গেছে! টুনু প্রতিজ্ঞা করল আর কখনো আস্তাবলের দিকে যাবে না, ঘোড়া চড়তেও সে চাইবে না। লালুকে সে কত ভালোবাসে আর লালুর তাকে নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে! টুনু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেই চমকে দেখল, সে কখন জানি মেজোমামার ঘরে এসে শুয়ে রয়েছে আর লালুটাও ইতিমধ্যে এসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মেজোমামার হাত থেকে চিনি খাচ্ছে!

টুনুর বড্ড রাগ হল, ডেকে বলল, দিয়ো না ওকে মেজোমামা, ও বলেছে আমরা আহাম্মুক ছোটোলোক, নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে! মেজোমামা আহাঃ! বলে টুনুকে চুপ করিয়ে দিয়ে একমনে চিনি খাওয়াতে লাগলেন। টুনু হাঁ করে দেখল লালু দিব্যি চিনি সাবাড় করল, কিন্তু যাবার সময় মনে হল চোখ টিপে জিব বের করে বিশ্রী ভেংচে গেল! কিন্তু সে কথা কাকেই-বা বলে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments