Thursday, April 18, 2024
Homeগোয়েন্দা গল্পছদ্মনাম (বাক্স-রহস্য-৪) - সত্যজিৎ রায়

ছদ্মনাম (বাক্স-রহস্য-৪) – সত্যজিৎ রায়

ছদ্মনাম (বাক্স-রহস্য-৪) - সত্যজিৎ রায়

জটায়ু হল স্বনামধন্য রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী লেখক লালমোহন গাঙ্গুলীর ছদ্মনাম। সোনার কেল্লা অভিযানে এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এক ধরনের লোক থাকে যারা চুপচাপ বসে থাকলেও তাদের দেখে হাসি পায়। লালমোহনবাবু হলেন সেই ধরনের লোক। হাইটে ফেলুদার কাঁধের কাছে, পায়ে পাঁচ নম্বরের জুতো, শরীরটা চিমড়ে হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক ভাবে ডান হাতটা কনুইয়ের কাছে ভাঁজ করে বা হাত দিয়ে কোটের আস্তিনের ভেতর বাইসেপ টিপে দেখেন, আবার পরমুহূর্তেই পাশের ঘর থেকে আচমকা হাঁচির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠেন।

আপনার আর শ্ৰীমান তপোশের জন্য আমার লেটেস্ট বইটা নিয়ে এলুম।

ভদ্রলোক প্যাকেটটা ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। সোনার কেল্লার ঘটনার পর থেকে ভদ্রলোক মাসে অন্তত তিনবার করে আমাদের বাড়িতে আসেন।

এটা কোন দেশ নিয়ে লেখা? ফেলুদা প্যাকেট খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল।

এটা প্ৰায় গোটা ওয়ার্লডটা কভার করিচি। ফ্রম সুমাত্রা টু সুমেরু।

এবারে আর কোনও তথ্যের গণ্ডগোল নেই তো? ফেলুদা বইটা উলটেপালটে দেখে আমার হাতে দিয়ে দিল। এর আগে ওঁর সাহারায় শিহরণ বইতে উটের জল খাওয়া নিয়ে একটা আজগুবি কথা লিখে বসেছিলেন লালমোহনবাবু, পরে ফেলুদা সেটা শুধরে দিয়েছিল।

ভদ্রলোক বললেন, নো স্যার! আমাদের গড়পার রোদে বদন বাঁড়ুজ্যের বাড়িতে ফুল সেট এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়া রয়েছে। প্রত্যেকটি ফ্যাক্ট দেখে মিলিয়ে নিয়েছি।

ফেলুদার ব্রিটানিয়া না দেখে ব্রিটানিকা দেখলে আরও নিশ্চিন্ত হতাম-কথাটায় কান না দিয়ে লালমোহনবাবু বলে চললেন, একটা ক্লাইমেক্স আছে পড়ে দেখবেন–আমার হিরো প্রখর রুদ্রের সঙ্গে জলহস্তীর ফাইট।

জলহস্তী?

কীরকম থ্রিলিং ব্যাপার পড়ে দেখবেন।

কোথায় হচ্ছে ফাইটটা?

কেন, নর্থ পোলে! জলহস্তী বলচি না?

নৰ্থ পোলে জলহস্তী?

সে কী মশাই–ছবি দেখেননি? খ্যাংরা কাঠির মতো লম্বা লম্বা খোঁচা খোঁচা গোঁফ, দুটো করে বাইরে বেরিয়ে আসা মুলোর মতো দাঁত, থ্যাপ থ্যাপ করে বরফের ওপর দিয়ে–

সে তো সিন্ধুঘোটক। যাকে ইংরেজিতে বলে ওয়লরাস। জলহস্তী তো হিপোপটেমাস–আফ্রিকার জন্তু।

জটায়ুর জিভা লজ্জায় লাল হয়ে দু ইঞ্চি বেরিয়ে এল।

এঃ–ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা। ব্যাড মিসটেক। ঘোড়া আর হাতিতে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। জল আর সিন্ধু তো প্রায় একই জিনিস হল কিনা! ইংরিজিটা কারেক্ট জানা ছিল, জানেন। এবার থেকে গপ্পগুলো ছাপার আগে একবার আপনাকে দেখিয়ে নেব।

আমি আসছি বলে ফেলুদা তার ঘরে চলে যাবার পর আমাকে একা পেয়ে ভদ্রলোক বললেন, তোমার দাদাকে একটু গভীর দেখছি। কোনও কেস-টেস এসেছে নাকি?

আমি বললাম, সেরকম কিছু নয়, তবে একটা ব্যাপারে আমাদের সিমলা যেতে হচ্ছে।

সিমলা? কবে?

বাধহয় পরশু।

লং টুর?

না। দিন চারেক!

ইস, ওদিকটা দেখা হয়নি, বলে ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

ফেলুদা ফিরে এলে পর ভদ্রলোক আবার নড়েচড়ে বসলেন। আপনারা সিমলা যাচ্ছেন। শুনলাম। কোনও তদন্ত আছে নাকি?

ঠিক তদন্ত নয়। রাম-শ্যামের বাক্স অদল-বদল হয়ে গেছে। শ্যামের বাক্স রামের কাছ থেকে নিয়ে শ্যামকে ফেরত দিয়ে, শ্যামের কাছ থেকে রামের বাক্স নিয়ে রামকে ফেরত দিতে হবে।

আরেব্বাস রে–বাক্স-রহস্য?

রহস্য কি না এখনও বলতে পারি না, তবে সামান্য দু-একটা খটকার ব্যাপার–

দেখুন স্যার, জটায়ু বাধা দিয়ে বললেন, এই কমাসে আপনাকে আমি খুব থরোলি চিনেছি। আমার ধারণা, একটা কিছু ইয়ে না থাকলে আপনি কক্ষনও কেসটা নিতেন না। ঠিক করে বলুন তো ব্যাপারটা কী।

ফেলুদার কথায় বুঝলাম সে এই স্টেজে লালমোহনবাবুকে তেমন খোলাখুলি কিছু বলতে চাইছে না। বলল, কে সত্যি কথা বলছে, আর কে সত্য গোপন করছে, আর কে মিথ্যে বলছে— এগুলো পরিষ্কার না-জানা অবধি কিছু খুলে বলা সম্ভব নয়। তবে গণ্ডগোল যে একটা রয়েছে সেটা—

ব্যাস ব্যাস—এনাফ! জটায়ুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে। তা হলে বলুন—আপনার অনুমতি পেলেই আপনাদের সঙ্গে লটকে পড়ি।

ঠাণ্ডা সয় ধাতে? ফেলুদা প্রশ্ন করল।

ঠাণ্ডা? দার্জিলিং গেছি লাস্ট ইয়ারে।

কোন মাসে?

মে।

সিমলায় এখন বরফ পড়ছে।

জটায়ু উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

বলেন কী, বর–ফ? গতবার ডেজার্ট আর এবার স্নো? ফ্রম দি ফ্লাইং প্যান টু দি ফ্রিজিডেয়ার? এ তো ভাবাই যাচ্ছে না মশাই!

ফেলুদা যদিও এসব কথা বলে জটায়ুকে নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করছিল, ভদ্রলোক সহজে দমাবার পাত্র নন। খ্যাক খ্যাক করে ভিলেনের মতো একটা হাসি হেসে বললেন, খরচের ভয় কী দেখাচ্ছেন মশাই-একুশখানা রোমাঞ্চ উপন্যাস, প্রত্যেকটা কমপক্ষে পাঁচটা করে এডিশন, তিনখানা বাড়ি হয়ে গেছে। কালকেতা শহরে আপনাদের আশীর্বাদে। এসব ব্যাপারে খরচকে কেয়ার করি না মশাই। যত দেখব, তত প্লট আসবে মাথায়, তত বইয়ের সংখ্যা বাড়বে। আর সবাই তো ফেলুমিত্তির নয় যে জলহস্তী আর সিন্ধুঘোটকের তফাত ধরবে। যা লিখব তাই গিলবে, আর যত গিলবে ততই আমার লাভ। আমার লাভের রাস্তা আটকায় এমন কার সাধ্যি আছে মশাই? অবিশ্যি আপনি যদি সোজাসুজি নিষেধ করেন, তা হলে অবিশ্যি…

ফেলুদা নিষেধ করল না। লালমোহনবাবু যাবার আগে আমরা কবে যাচ্ছি, কদিনের জন্য যাচ্ছি, কী ভাবে যাচ্ছি ইত্যাদি জেনে নিয়ে একটা খাতায় নোট করে নিয়ে বললেন, একটা গরম গেঞ্জি, দুটো পুলোভার, একটা তুলোর কোিট আর তার উপর একটা ওভার কোট চাপালে শীত মানবে না বলচেন, অ্যাঁ?

ফেলুদা বলল, তার সঙ্গে এক জোড়া দস্তানা, একটা মাঙ্কি ক্যাপ, এক জোড়া গোলোস জুতো, গরম মোজা আর ফ্রস্ট-বাইটের ওষুধ নিলে খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

ইস্কুলে পরীক্ষা দিতে মোটেই ভাল লাগে না, কিন্তু ফেলুদার কাছে যে পরীক্ষাটা দিতে হয় তাতে আমার কোনওই আপত্তি নেই। সত্যি বলতে কী, তার মধ্যে বেশ একটা মজা আছে, আর সেই মজার সঙ্গে মাথাটাও বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।

রাত্রে খাবার পরে ফেলুদা তার খাটে উপুড় হয়ে বুকে বালিশ নিয়ে শুয়েছে, আর আমি তার পাশে বসে পরীক্ষণ দিচ্ছি। অর্থাৎ, এই নতুন কেসটার বিষয়ে ওর নানা রকম প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিা!

প্রথম প্রশ্ন হল–এই বাক্স বদলের ব্যাপারে কার কার সঙ্গে আলাপ হল বল।

প্রথম দীননাথ লাহিড়ী।

বেশ। লোকটাকে কেমন মনে হয়!

ভালই তো। তবে বই-টই সম্বন্ধে বিশেষ খবর রাখে না। আর, এই যে এতগুলো টাকা খরচ করে আমাদের সিমলা পাঠাচ্ছেন, এই ব্যাপারে যেন একটু খটকা…

যে লোক দু-দুটো ওরকম ডাকসাইটে গাড়ি মেনটেন করতে পারে, তার আর যাই হাক, টাকাৰ অভাব নেই। তা ছাড়া ফেলুমিত্তিরকে এমপ্লয় করা তো একটা প্রেসটিজের ব্যাপারসেটা ভুললেও তো চলবে না।

তই যদি হয় তা হলে আর খটকার কিছু নেই। দ্বিতীয় আলাপ–নরেশচন্দ্ৰ পাকড়াশী। তিরিক্ষি মেজাজ।

কিন্তু স্পষ্টবক্তা। সেটা একটা গুণ। সকলের থাকে না।

কিন্তু সব কথা সত্যি বলেন কি? দীননাথবাবু কি সত্যিই এককালে লায়েক ছিলেন? মানে, রেসের মাঠে-টাঠে যেতেন?

এক কালে কেন, এখনও আছেন। তবে তার মানেই যে লোকটা খারাপ, এমন কোনও কথা নেই।

তারপর অমরকুমার। মানে প্রবীর লাহিড়ী। কাকাকে পছন্দ করেন না।

স্বাভাবিক। কাকা তার অ্যাম্বিশনে বাধা দিচ্ছে, তাকে একটা বাক্স দিয়ে আবার নিয়ে নিচ্ছে, রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।

প্রবীরবাবুর শরীরটা বেশ মজবুত বলে মনে হল।

হ্যাঁ। হাতের কবজি চওড়া। তাই গলার আওয়াজটা আরও বেমানান লাগে।…এবার বল কালকা মেলের ফাস্ট ক্লাসের ডি কম্পার্টমেন্টের বাকি দুজন যাত্রীর কী নাম।

কেদিয়া। মাড়োয়ারি।

হ্যাঁ। সুদের ব্যবসা। সাধারণ চেহারা। নরেশ পাকড়াশীর সঙ্গে আগেই চেনা।

ভদ্রলোকের লেনিন সরণিতে সত্যিই আপিস আছে। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে দেখেছি।

অন্যজন জি সি ধমীজা। সিমলায় থাকে। আপোলের চাষ আছে।।

সেটার কোনও প্রমাণ নেই; সুতরাং বলা যেতে পারে যে থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে।

কিন্তু ধমীজার সঙ্গেই যে দীননাথবাবুর বাক্সটা বদল হয়ে গেছে সেটা তো ঠিক?

বাক্সটা ফেলুদার পাশেই খাটের উপর রাখা ছিল। সেটার ঢাকনা খুলে ভিতরের জিনিসপত্তরের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থেকে ফেলুদা প্রায় বিড় বিড় করে বলল, হ্যাঁ…ওই একমাত্র ব্যাপার যেটা সম্বন্ধে বোধহয়…

বাক্সের ভিতরে যে ভাঁজ করা দুটো দিল্লির খবরের কাগজ ছিল, সেগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ফেলুদা ঠিক সেই ভাবেই বিড় বিড় করে বলল, এই কাগজগুলো নিয়েই, বুঝেচিস, কী রকম যেন..মনের মধ্যে একটা…

ফেলুদার বিড়াবিড়োনি থামাতে হল, কারণ টেলিফোন বেজে উঠেছে। আগে টেলিফোনটা বৈঠকখানায় থাকত। এখনও থাকে, কিন্তু ফেলুদা সুবিধের জন্য একটা এক্সটেনশন টেলিফোন নিজের খাটের পাশে বসিয়ে নিয়েছে।

হ্যালো–

কে–মিস্টার মিত্তির?

ফেলুদার হাতে টেলিফোন থাকা সত্ত্বেও, রাত্তির বলেই বোধহয় অন্য দিকের কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল।

বলুন মিস্টার লাহিড়ী–

শুনুন, মিস্টার ধমীজার কাছ থেকে একটা খবর আছে।

এর মধ্যেই টেলিগ্রামের—?

না না। টেলিগ্ৰাম নয়। টেলিগ্রামের উত্তর কালকের আগে আসবে না। একটা টেলিফোন পেয়েছি। এই মিনিট পাঁচেক আগে। ব্যাপারটা বলছি। ধমীজা নাকি রেলওয়ে আপিসে খোঁজ নিয়ে রিজার্ভেশন লিস্ট দেখে আমার নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল। হঠাৎ চলে যেতে হয় বলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি, কিন্তু ওঁর এক চেনা লোকের কাছে আমার বাক্সটা রেখে গেছেন। তার কাছে ধমীজার বাক্সটা নিয়ে গিয়ে ফেরত দিলেই উনি আমার বাক্সটা দিয়ে দেবেন। এই লোকটিই আমাক্কে ফোন করেছিল। অতএব, বুঝতেই পারছেন। …

ম্যানুস্ক্রিপ্টটা রয়েছে কি না জিজ্ঞেস করেছেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ। সব ঠিক আছে।

বাঃ, এ তো ভাল খবর। আপনার সমস্ত ল্যাঠা চুকে গেল।

আজ্ঞে হ্যাঁ। খুব অপ্রত্যাশিতভাবে। আমি মিনিট পাঁচেকে বেরিয়ে পড়ছি। আপনার বাড়ি থেকে ধমীজার বাক্সটা পিক-আপ করে নিয়ে প্রিটারিয়া স্ট্রিটে চলে যাব।

আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি মিস্টার লাহিড়ী?

বলুন।

আপনি আর কষ্ট করে আসবেন কেন? সিমলাই যখন যাচ্ছিলাম, তখন প্রিটোরিয়া স্ট্রিটেই বা যেতে অসুবিধে কী? আমি বলি কী, বাক্সটা আমিই নিয়ে আসি। ওটা আজকের রাতটা আমার কাছে থাক; আমি একবার শম্ভুচরণের লেখাটায় চোখ বুলিয়ে নিই! এটাই হবে আমার পারিশ্রমিক। কাল সকালে গিয়ে লেখা সমেত বাক্স আপনাকে ফেরত দিয়ে আসব, কেমন?

ভেরি গুড। আমার তাতে কোনওই আপত্তি নেই। ভদ্রলোকের নাম মিস্টার পুরি, ঠিকানা ফোর বাই টু প্রিটারিয়া স্ট্রিট।

ধন্যবাদ!–অলসস ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল!

ফেলুদা টেলিফোন রেখে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে বসে রইল। আমার যে কী মনের অবস্থা তা আর বলে লাভ কী? সিমলা যাওয়া ফসকে গেল, ফসকে গেল, ফসকে গেল-মাথার মধ্যে এই কথাটাই খালি বার বার ঘুরছে, আর বুকের ভিতরটা কীরকম খালি খালি লাগছে, আর বরফের দেশে যেতে যেতে যাওয়া হল না বলে মার্চ মাসের কলকাতাটা অসহ্য গরম লাগছে। কী আর করি? অন্তত এই শেষ ঘটনার সময় ফেলুদার সঙ্গে থাকা উচিত। তাই বললাম, আমি তৈরি হয়ে নিই। ফেলুদা? দু মিনিট লাগবে।

যা, চট করে যা।

জামা ছেড়ে তৈরি হয়ে মিস্টার ধমীজার ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে প্রিটোরিয়া স্ট্রিটে পৌঁছতে লাগল কুড়ি মিনিটের কিছু বেশি। প্রিটারিয়া স্ট্রিটটা লোয়ার সারকুলার রোড থেকে বেরিয়ে খানিক দূর গিয়ে রাইট অ্যাঙ্গেলে ডাইনে গিয়ে আবার রাইট অ্যাঙ্গেলে বাঁয়ে ঘুরে থিয়েটার রোডে—থুড়ি, শেক্সপিয়ার সরণিতে গিয়ে পড়েছে। এমনিতেই রাস্তাটা নির্জন, রাতও হয়েছে প্ৰায় সাড়ে এগারোটা, তার উপরে আজ বোধহয় অমাবস্যা-টমাবস্যা হবে। আমরা লোয়ার সাকুলার রোড দিয়ে ঢুকে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা ট্যাক্সি চালিয়ে বুঝলাম গাড়ি থেকে বাড়ির নম্বর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। শেক্সপিয়র সরণির কাছাকাছি গিয়ে ট্যাক্সি থামিয়ে ফেলুদা পাঞ্জাবি ড্রাইভারকে বলল, নম্বরটা খুঁজে বার করতে হবে সর্দার জি-আপনি একটু দাঁড়ান, এই বাক্সটা একটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

সর্দারাজি বেশ অমায়িক লোক, কোনও আপত্তি করল না। আমরা রাস্তায় নেমে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বাঁ দিকে পাঁচিলের ওপাশে বাইশতলা বিড়লা বিল্ডিং বুক চিতিয়ে মাথা উচিয়ে আছে। ফেলুদা বলে, রাত্তির বেলা কলকাতার সবচেয়ে থমথমে জিনিস হচ্ছে এই আকাশ-ছোঁয়া আপিসের বিল্ডিংগুলো। কেবল ধড় আছে, প্ৰাণ নেই। দাঁড়িয়ে থাকা মৃতদেহ দেখেচিস কখনও? ওই বিল্ডিংগুলো হচ্ছে তাই।

খানিক দূর হাঁটার পর রাস্তার ডান দিকে একটা গেট পড়ল। যার গায়ে লেখা আছে চার। আরও এগিয়ে গিয়ে দেখি পরের বাড়ির নম্বর পাঁচ। তা হলে দুই বাড়ির মধ্যে যে গলিটা রয়েছে তাতেই হবে চারের দুই। কী নিঝুম রাস্তা রে বাবা। টিমটিম করে দু-একটা আলো জ্বলছে, সে আলো শুধু ল্যাম্প পোস্টের তলাটুকু আলো করেছে, বাকি রাস্তা অন্ধকার থেকে গেছে। আমরা গলিটা ধরে এগোতে লাগলাম।

খানিকটা গিয়েই আরেকটা গেট চোখে পড়ল। এটা নিশ্চয়ই চারের এক। চারের দুই কি তা হলে আরও ভেতরে ওই অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে? ওদিকে তো কোনও বাড়ি আছে বলে মনে হচ্ছে না। আর থাকলেও, সে বাড়িতে যে একটাও আলো জ্বলছে না। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গলির দুদিকে পাঁচিল; পাঁচিলের পিছনে বাড়ির বাগান থেকে গাছের ডালপালা রাস্তার উপর এসে পড়েছে। একটা ক্ষীণ গাড়ি চলাচলের শব্দ বোধহয় লোয়ার সাকুলার রোড থেকে আসছে! একটা গির্জার ঘড়ি বেজে উঠল। দূর থেকে। সেন্ট পলসের ঘড়ি। সাড়ে এগারোটা বাজল। কিন্তু এসব শব্দে প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের অস্বাভাবিক থমথমে ভাব বাড়ছে। বই কমছে না। কাছাকাছি কোথায় একটা কুকুর ডেকে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে—

ট্যাক্সি! সদারজি! সর্দারাজি!

চিৎকারটা আপনা থেকেই আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটা লোক ডান দিকের পাঁচিল থেকে লাফিয়ে ফেলুদার উপর পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা। ফেলুদার হাতের বাক্সটা আর হাতে নেই। সে হাত খালি করে এক ঝটিকায় ঘাড় থেকে প্রথম লোকটাকে ফেলে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এটা বুঝতে পারছি একটা প্ৰচণ্ড ধস্তাধস্তি হাতাহাতি চলেছে, কিন্তু অন্ধকারে ঠিক কী যে হচ্ছে সেটা বোঝার উপায় নেই। বাক্সটা চোখের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে। আমি সেটার দিকে হাত বাড়িয়েছি, আর ঠিক সেই সময় দ্বিতীয় লোকটা মুহুর্তের মধ্যে বাক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে এক ধাক্কায় রাস্তায় ফেলে। দিয়ে উৰ্ধৰ্বশ্বাসে গলির মুখটার দিকে দৌড় দিল। এদিকে বাঁ পাশে অন্ধকারে হুটাপটি চলেছে, কিন্তু লোকটাকে ফেলুদা কেন যে ঠিক কবজ করতে পারছে না সেটা বুঝতে পারছি না।

ওঁক!

এটা আমাদের পাঞ্জাবি ড্রাইভারের পেটে-গুঁতো-খাওয়া গলার শব্দ। সে আমার চিৎকার শুনে গাড়ি ছেড়ে দৌড়ে গলির মুখটায় এসেছিল, কিন্তু ব্যাগ-চার তাকে ঘায়েল করে পালিয়েছে। দুরে আবছা ল্যাম্প পোস্টের আলোয় দেখছি সদারজি ধরাশায়ী।

ইতিমধ্যে প্রথম লোকটাও পাঁচিল টপকে উধাও। ফেলুদা পকেট থেকে রুমাল বার করে হাত মুছতে মুছতে বলল, অন্তত সের খানেক সরষের তেল মেখে এসেছিল—পাড়া সিঁদেল চোর যেরকম করে।

এই তেলের গন্ধটা অবিশ্যি লোকগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছিলাম, কিন্তু গন্ধের কারণটা ঠিক বুঝতে পারিনি।

ভাগ্যিস!

ফেলুদা এই কথাটা যে কেন বলল, তা বুঝতে পারলাম না। এত বড় একটা দুর্ঘটনার পরেও সে বলছে—ভাগ্যিস?

আমি বললাম, তার মানে?

ট্যাক্সির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফেলুদা বলল, তুই কি ভাবছিস জি সি ধমীজার বাক্স চুরি করে নিয়ে গেল ওই শয়তানগুলো?

তবে?—আমি তো অবাক!

যেটা গেল সেটা ছিল দ্য প্ৰপাটি অফ প্রদোষ সি মিটার। ওর মধ্যে তিনখানা ছেঁড়া গেঞ্জি, পাঁচখানা ধুধধুড়ে রুমাল, গুচ্ছের ন্যাকড়া আর খান পাঁচেক পুরনো ছেঁড়া আনন্দবাজার। তুই যখন জামা বদলাচ্ছিলি তখন ওয়ান-নাইন-সেভানে টেলিফোন করে জেনেছি যে চারের দুই প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের কোনও টেলিফোন নেই। অবিশ্যি ওই নম্বরে যে কোনও বাড়িই নেই সেটা এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না।

আমার বুকে আবার ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে।

মন বলছে, হয়তো শেষ পর্যস্ত সিমলাটা যেতেই হবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments