Wednesday, April 17, 2024
Homeবাণী-কথাচিহ্ন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

চিহ্ন – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

নবদুর্গা - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

অন্ধকারে ভেসে যাচ্ছে জ্বলন্ত মোমবাতি।

হলুদ আলোয় যেন জলের মধ্যে জেগে আছে ইভার মুখ। মুখখানা এখন ভৌতিক। একটু নীচুতে আলো, শিখাটা হেলছে, দুলছে, কাঁপছে। ইভার মুখে সেই আলো। গালের গর্তে, চোখের গর্তে, কপালের ভাঁজে ছায়া। মুখখানা যেন বা এখন ইভার নয়। ইভা এ ঘর থেকে ও ঘরে যাচ্ছে। মাঝখানের পরদা উড়ছে হাওয়ায়।

অমিত বলে–সাবধান। পরদায় আগুন না লাগে!

ইভা কিছু বলল না। জলে ক্লান্ত সাঁতারু যেমন শ্লথ গতিতে ভেসে যায়, তেমনি এ ঘর থেকে ও ঘরে চলে গেল।

অন্ধকারে চৌকিতে বসে আছে অমিত। তার কোল ঘেঁষে পাঁচ বছরের ছেলে টুবলু আর তিন বছরের মেয়ে অনিতা। যখনই কারেন্ট চলে যায় তখনই অমিত তার দুই ছেলেমেয়েকে ডেকে নিয়ে বিছানায় বসে থাকে। বড্ড ভীতু অমিত। অন্ধকারে কোথায় কোন পোকামাকড় কামড়ায় কিংবা আসবাবপত্রে হোঁচট লাগে। কিংবা খোলা পড়ে–থাকা ব্লেড বা ইভার পেতে–রাখা অসাবধান বঁটিতে গিয়ে পড়ে। কিংবা এরকম আর কিছু হয় সেই ভয় তার। বুক ঘেঁষে ছেলেমেয়েরা বসে আছে বুকের দুই পাঁজরে দুজনের মাথা। অমিত ঘামছে।

–একটা মোমবাতি এ-ঘরে দেবে না? অমিত চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে।

রান্নাঘর থেকে ইভার উত্তর আসে না! ইভা ও রকমই। আজকাল দু-তিনবার জিগ্যেস না করলে উত্তর দেয় না।

–কী গো? অমিত বলল ।

ইভা আস্তে বলে–মোমবাতি দিয়ে কী হবে? তোমরা তো বসেই থাকবে এখন!

–অন্ধকারে কি ভালো লাগে?

–না লাগলেও কিছু করার নেই। মোমবাতি একটাই ছিল।

–ওঃ। অমিত সিগারেট ধরাল।

অনিতার মাথাটা বুক থেকে লিত হয়ে কোলে নেমে গেল। তার দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ হয়। ঘুমিয়ে পড়বে মেয়েটা।

অমিত নীচু হয়ে ডাকল–অনি, ও অনি!

–উঁ। ক্ষীণ পাখি–গলায় সাড়া দেয় অনিতা।

–এখন ঘুমোয় না মা, ভাত খেয়ে ঘুমোবে।

–খাবো না।

–খাবে না কি? খেতে হয়। গল্পটা শোনো।

ঘুমগলাতেই অনিতা বলে–বলো তাহলে।

এইটুকু বয়সেই কি টনটনে উচ্চারণ মেয়েটার। পরিষ্কার কথা বলে, এতটুকু শিশুসুলভ আধো–কথার জড়তা নেই। অমিত মাঝে-মাঝে ইভাকে বলে–আমরা ছেলেবয়সে এত পাকা কথা বলতে পারতামই না। এখনকার ছেলেমেয়েরা কীরকম অল্প বয়সেই পাকা হয়ে যায়।

ঘুমন্ত মেয়েটাকে টেনে বসায় অমিত। মাথাটা আবার পাঁজরে লাগে। অনেকক্ষণ চুপচাপ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে টুবলু বলে–আমি ঘুমোই না। ঘুমোই বাবা?

–না তো। তুমি লক্ষ্মী ছেলে।

ছেলেটার জন্য কত মায়া অমিতের, ভারী ভীতু ছেলে, ঘরকুনো। এ-বয়সে যেমন দুরন্ত হয়। বাচ্চারা, তেমন নয়। রোগা দুর্বল ন্যাতানো। স্টেশন রোড-এর এক বুড়ো হোমিওপ্যাথ গত বছরখানেক যাবৎ ওষুধ দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেটার তেমন বাড়ন নেই। খেতে চায় না, কখনও ওর তেষ্টা পায় না, খেলে না। ইভার ইচ্ছে একজন চাইল্ড স্পেশালিস্টকে দেখায়। সেটা হয়তো ধারকর্জ করে দেখাতেও পারত অমিত। কিন্তু তার কলেজের একজন কলিগ ছেলেকে স্পেশালিস্ট দিয়ে দেখানোর পর যে খাওয়ার চার্ট আর ওষুধ বিষুধের ফিরিস্তি দিয়েছিল তাতে অমিত ভড়কে যায়। তাই গত একবছর যাবৎ ইভা বিস্তর অনুযোগ করা সত্বেও অমিত গা করেনি। যাক গে, কৃষ্ণের জীব, টিকটিক করে বেঁচে থাক। বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলে বয়সে অমিতও তো কত ভুগেছে, মাসেক ধরে রক্ত আমাশা, চিকিৎসা ফিকিৎসা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। গ্যাঁদাল পাতা বাটা, থানকুনির ঝোল, পুরোনো আতপ চালের গলা ভাত, পাড়ার এল এম এফ ডাক্তারের দেওয়া ক্যাস্টর অয়েল ইমালশান, এই খেয়ে ফাঁড়া কাটিয়ে আজও বেঁচে আছে। তার ছেলেটাই বা তাহলে বাঁচবে না কেন?

সিগারেটের আগুন ফুলকি ছড়াচ্ছে। অন্ধকারে হাতড়ে অ্যাসট্রেটা ঠাহর করে অমিত। সাবধানে ছাই ঝাড়ে। বলে–একদিন একটা টিয়াপাখি উড়ে এল খরগোশের বাড়িতে, বলল –খরগোশ ভাই, আমি তোমার কাছে থাকব। খরগোশ–থাকবে তো। কিন্তু ঘর কোথায়! আমার তো ছোট্ট একটু খুপড়ি! টিয়াপাখি বলে–আমার বাসা পড়ে ভেঙে গেছে, এখন আমার ডিম পাড়বার সময়, তাহলে উপায়? তখন খরগোশটায় দয়া হল, একটা ছোট্ট খুপরি বানিয়ে দিল টিয়াপাখিটাকে। টিয়াপাখি থাকে, ডিম পাড়ে, তা দেয় মনে ভারী আনন্দ, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুবে। কত আদর করবে বাচ্চাকে, উড়তে শেখাবে, খেতে শেখাবে, শিকার করতে শেখাবে। খরগোশ একদিন খাবার আনতে বাইরে গেছে, এমন সময়ে এক মস্ত ইঁদুর এসে হাজির। বলল –এই টিয়াপাখি, দে তোর দুটো ডিম। টিয়া বলল , কেন দেব? ডিম ফুটে আমার বাচ্চা হবে, কত আদর করব, তোকে দেব কেন? ইঁদুর বলল –দিবি না তো। তবে রে বলে দাঁত বের করে কামড়াতে গেল…অনি ও অনি।

–উঁ।

–আবার ঘুমোচ্ছিস? বলে অমিত গলা ছেড়ে বলে–ইভা, ভাত হয়েছে? অনি ঘুমিয়ে পড়ছে যে।

–বাবা, তারপর? জিগ্যেস করে টুবলু।

–বলছি দাঁড়া। দ্যাখ না বোন ঘুমিয়ে পড়ছে! ও অনি!

হঠাৎ অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো আসে ইভা। কথা বলে না। নড়া ধরে হিঁচড়ে টেনে নেয় মেয়েটাকে। ছেলেটাকে টানতে হয় না। ভীতু ছেলে। অন্ধকারেই টের পায় মা’র মেজাজ ভালো নেই। সে রোগা পায়ে লাফ দিয়ে নামে চৌকি থেকে। মার পিছু পিছু বাধ্য ছেলের মতো যায়।

দু-ঘরের মাঝখানে পরদা উড়ছে। ওপাশেরটা আসলে ঘর নয়। রান্নাঘর। সেখানে মোমের আলোর আভা। অন্ধকারে বসে অমিত সেই মৃদু আভার দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটা খেতে চাইছে না। ইভা তার হাতের চুড়ির শব্দ তুলে দুটো চড় কষাল। মেয়েটা কাঁদছে। ইভা চাপা স্বরে মেয়েকে বকছে এবং মেয়েকে বকতে–বকতেই বকার ঝাঁঝটা নিজের কপালের এবং ভাগ্যের প্রসঙ্গে বলে যাচ্ছে। অমিত চুপ করে বসে শোনে। ইচ্ছে করে উঠে গিয়ে একটা লাথিতে মেয়েমানুষটাকে চুপ করায়।

লাথি যে কখনও মারেনি অমিত তা নয়। লাথি বা চড় চাপড় কয়েকবারই মেরে দেখেছে। লাভ হয় না। সদ্য–সদ্য একটু ফল হয় বটে কিন্তু ইভা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

অবিকল ছাগলের মতো একটা লোক গলা পরিষ্কার করছে কোথায় যেন। ‘হ্যাঁ-ক’ ‘হ্যাঁ-ক’ শব্দটা শুনলে নিজেরও যেন বমি তুলতে ইচ্ছে করে।

কান্না থামিয়ে ছেলেমেয়েরা এখন খাচ্ছে। গুনগুন করে এখন আবার সোহাগের গলায় ওদের গল্প শোনাচ্ছে ইভা। ইভাকে নিয়েই দিনের অধিকাংশ সময় ভাবে অমিত। বিয়ে করে তারা সুখী

অসুখী তা ঠিক বুঝতে পারে না। কেউই বোধহয় পারে না। মেয়েমানুষ জাতটার মুখের সঙ্গে মনের মিল নেই। যখন তারা খুবই সুখে আছে তখনও পুরোনো দুঃখের কথা তুলে খোঁটা দেবেই।

খেয়ে–দেয়ে ওরা এল। ইভা মশারি টাঙাল। ওরা গল্পের বাকি অর্ধেকটা না শুনেই ঘুমিয়ে পড়ল।

কারেন্ট এখনও আসেনি। পৃথিবীজোড়া অন্ধকার।

মোমবাতিটা মাঝখানে রেখে দু-ধারে নিঃশব্দে খেতে বসে ইভা আর অমিত, সম্পর্কটা সহজ নেই যেন। একধারে ছেলেমেয়েদের এঁটো থালা পড়ে আছে। তাতে ডাল–ঝোল মাখা কিছু ভাত। অমিত আড়চোখে চেয়ে দেখল। এখন দু-টাকা আশি কেজি যাচ্ছে চাল! তাদের রেশন কার্ড নেই। বলল –ভাত নষ্ট করো কেন!

–কী করব? শেষ কয়েকটা গরাস খেল না।

–কম করে নেবে। গুচ্ছের গেলাতে চাইলেই কি হয়। ওদের পেটে জায়গা কত।

–দুটো ভাতই তো, আর কী ভালোমন্দ খায়! ঘি মাখন মাছ–মাংস কি যায় ওদের পেটে?

–গরিবের সন্তান, যা জোটে তাই খেয়ে বাঁচবে।

–মুরোদ না থাকলেই ওসব কথা বলে লোকে।

–চালের দাম জানো?

–জানতে চাই না।

মেয়েমানুষটা ঝগড়া পাকিয়ে তুলছে। রোগা, দুর্বল, রক্তহীন। তবু গলা এতটুকু ক্ষীণ নয়। সবচেয়ে আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি ইভার। বিয়ের সাত বছর ধরে প্রতিদিন অমিত যত অন্যায় করেছে, যত অবহেলা, যত অপমান সব হুবহু মুখস্থ বলে যায়। মেজাজ ভালো থাকলে মাঝে-মাঝে বলে -এরকম মেমারি নিয়ে লেখাপড়া করলে না ইভা, কেবল স্কুল ফাইনাল পাস করে বসে রইলে।

জ্বলন্ত মোমবাতির ওপর দিয়ে বাঘের চোখে ইভার দিকে চেয়ে থাকে অমিত। ইভাও চেয়ে থাকে বনবেড়ালের মতো। একটুও ভয় পায় না। ভিতরটা হতাশায় ভরে যায় অমিতের। কীরকম করলে কীভাবে তাকালে সেও একটু ভয় পাবে। একটু সমীহ করবে তাকে। অমিত আবার পাতের ওপর মুখ নামায়। লাল রুটিগুলো দেখে এবং ভাবতে থাকে সে হিপনোটিজম শিখবে। কিংবা আরও রাগি হয়ে যাবে! কিংবা একদিন কিছু না বলে কয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে।

নিরুদ্দেশও একবার হয়েছিল অমিত এক রাতের জন্য। পরদিন ফিরে দেখে ইভার কি করুণ অবস্থা। পাড়াসুদ্ধ মেয়েপুরুষে ঘর ভরতি, মাঝখানে পাথর হয়ে ইভা বসে, দু-চোখে অবিরল ধারা। তাকে দেখে সাতজন্মের হারানো ধন ফিরে পাওয়ার মতো উড়ে এসেছিল। তারপরই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সেই দৃশ্য মনে পড়লে আজও বুকে ব্যথা করে। ইভার ভালোবাসাও তো নিখাদ। অমিতও কি বাসে না? বাসে। ভীষণ। তেরাত্রি ইভাকে ছেড়ে থাকলে নিজেকে অনাথ বালকের মতো লাগে। সেই জন্যই ইভা বহুকাল বাপের বাড়ি যায় না। অমিতের জন্য।

.

চালওয়ালা দুঃখিত মুখখানি তুলল। ভ্রাম্যমাণ পুরুত কপালে চন্দনের আর সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে গেছে, কানে গোঁজা বিল্বপত্র। শ্বাস ফেলে বলে–তিন টাকা দশ।

–বলো কী? অমিত চমকায়। তার মাস মাইনে একশো আশি প্লাস কলেজ ডি–এ। রেশন কার্ড নেই।

করুণ একটু হাসে চালওয়ালা–আজ তো এই দর। কাল আবার কী হবে কে জানে।

–গত সপ্তাহে দু’টাকা আশি করে নিয়েছি।

–গত সপ্তাহে! সে তো বাবু গত সপ্তাহ। বলে পাল্লা তুলে বলে–কতটা দেব?

দশ কেজি নেওয়ার কথা বলে দিয়েছিল ইভা। কিন্তু সাহস পেল না অমিত। বলল –চার কেজি।

–গত সপ্তাহে আপনাকে বলেছিলাম, কিছু বেশি করে নিয়ে রাখুন। এ সময়টায় দর চড়ে। চাল ওজন করতে-করতে চালওয়ালা বলে। তারপর বিড়বিড় করতে থাকে। রাম…রাম…দুই…দুই . তিন…তিন…

ক’বছর আগেও চাল কিনলে এক আঁজলা কি এক মুঠো ফাউ দিত। এখন আঙুলের ডগায় গোনাগুনতি দশ কি বারোটা চাল বাড়তি দিল।

ঘামে পিছলে নেমে এসেছিল চশমাটা। অমিত ঠেলে সেটা সেট করল। ইভাকে ধমক দিতে হবে। ছেলেমেয়েদের পাতে যেন আর ভাত নষ্ট না হয়। আর, এবার থেকে ইভা আর অমিতের মতো ওরাও রাতে রুটি খাবে। পেটে সহ্য হয় না বললে চলবে না। সকলের ছেলেমেয়ে রুটি খায় ওদের ছেলেমেয়ে খাবে না কেন? খেতে-খেতে অভ্যাস হয়ে যাবে। ইভা হয়তো ঝগড়া করবে, তেড়ে আসবে, তবু বলতে ছাড়বে না অমিত।

বাজার আর চালের বোঝা দু-হাতে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে অমিত ইভা কী বলবে এবং সে তার কী উত্তর দেবে তা ভাবতে-ভাবতে যায়। এবং মনে-মনে সে ঝগড়া করতে থাকে। প্রচণ্ড ঝগড়া। রাগে ফেটে পড়ে। ইভাকে লাথি মারে, চুলের ঝুঁটি ধরে হিঁচড়ে টেনে বের করে দেয় ঘর থেকে, বলেইঃনবাবের মেয়ে।

কিন্তু সবই ঘটে মনে-মনে। একটু অন্যমনস্কভাবে সে রাস্তার দূরত্ব অতিক্রম করতে থাকে। আজকাল ইভার কথা ভাবলেই তার মাথা আগুন হয়ে ওঠে। মনে-মনে সে যে কত গাল দেয়। ইভাকে। ভালোও কি বাসে না? বাসে। ভীষণ। এবং এই দুটি অনুভূতিই তাকে দু-ভাগে ভাগ করে খেয়ে নিচ্ছে।

ইভা রাগ করল না। মন দিয়ে অমিতের কাছে চালের দর, দেশের দুর্দিনের কথা শুনল। তারপর সংক্ষেপে বলে–দেখি।

–হ্যাঁ। দ্যাখো। গাঁয়ে মাস্টারি করতাম, সে বরং ভালো ছিল। শহরে নতুন প্রফেসারি নিয়ে এসে ফেঁসে গেছি। চেনাজানা লোকও তেমন নেই যে টপ করে হাত ধরব, দোকানেও ধারবাকি আনার মতো চেনা হয়নি। বুঝলে?

ইভা বুঝেছে। মাথা নাড়ল। এবং একটু পরে এক কাপ অপ্রত্যাশিত চা–ও করে দিল। ইকনমিক্স-এর সাহা বেঁটে এবং কালো, মুখখানা সবসময়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সহজেই উত্তেজিত হয় লোকটা, সহজেই আনন্দিত হয়। তার সঙ্গে মোটামুটি ভালোই ভাব হয়ে গেছে অমিতের। দ্বিতীয় পিরিয়ডের পর দেখা হতেই লোকটা খুব উত্তেজিতভাবে বলল –এ হচ্ছে অঘোষিত দুর্ভিক্ষ। ফেমিন ইন ফুল ফর্ম।

–তাহলে সেটা ওরা ডিক্লেয়ার করুক।

তাই করে? ইজ্জতের প্রশ্ন আছে না? আমি সেদিন ঠাট্টা করে একজন ছাত্রকে বোঝাচ্ছিলাম, ইনফ্লেশন কাকে বলে। বলছিলাম, এখন দেখছ বাবা পকেটে টাকা নিয়ে যায় আর থলি ভরে বাজার করে নিয়ে আসে। যখন দেখবে বাবা থলি ভরে নিয়ে যায় আর পকেট ভরে বাজার নিয়ে আসে তখনই বুঝবে ইনফ্লেশন। জার্মানিতে বিশ্বযুদ্ধের পর ওরকমই হয়েছিল। এখন দেখছি ঠাট্টা নয়। ব্যাপারটা দিনকে দিন তাই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নাইনটিন সিকসটি ওয়ানের তুলনায়। টাকার ভ্যালু…

কিন্তু এও ঠিক, সকালে তিন টাকা দশ কিলো দর–এ চাল কিনলেও অমিত টেরিকটনের হাওয়াই শার্ট পরে কলেজে এসেছে। পরনে জলপাইরঙা টেরিলিনের প্যান্ট, পায়ে বাটার জুতো, গাল কামানো। এখনও অধ্যাপকদের পরনে এরকমই পোশাক, কিংবা মিহি আদ্দির পাঞ্জাবি আর ভালো তাঁতের ধুতি। কিন্তু ক্লেশের চিহ্ন নেই।

একজন অধ্যাপক বলে–দক্ষিণ ভারত থেকে এক সন্ন্যাসী ডিক্লেয়ার করেছে সেভেনটি ফোর ইজ দিব্ল্যাকেস্ট ইয়ার ইন দি হিস্টোরি অফ ম্যানকাইন্ড

এ সবই হচ্ছে হাই–তোলা কথা। গায়ে লাগে না কারও। অধিকাংশ অধ্যাপকই অধ্যাপকসুলভ গম্ভীর, বিদ্যাভারাক্রান্ত চিন্তাশীল। দু-চারজন ছোঁকরা প্রফেসর একটু কথা চালাচালি করে হালকাভাবে। সামান্য একটু অস্বস্তিবোধ করে অমিত এখনও। দশ বছর স্কুল মাস্টারি করার পর হঠাৎ চাকরিটা পেয়েছে সে। অধ্যাপকদের মেলায় এখনও নিজেকে একটু ছোট লাগে তার। যেন বা দয়ার পাত্র সকলের। কিন্তু তা নয়। এখানে কেউ কাউকে তেমন লক্ষ্য করেই না। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গাঁয়ে থেকে নোনা বাতাসে অমিত একটু কালো হয়ে গেছে, একটু গ্রাম্যও। তাই বোধ হয় সে একাই বসে-বসে সকালে শোনা অবিশ্বাস্য চালের কথা ভাবে। সেই মহার্ঘ ভাত এখনও তার পেটে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে।

কলকাতায় এসেই রেশন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে রেখেছিল। এখনও এনকোয়ারি হয়নি। কবে যে হবে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আশুতোষ মুরুব্বি গোছের লোক। পলিটিকস করে, নেতাদের সঙ্গে ভালোবাসা আছে। সে অভয় দিয়েছিল।

কলেজের পর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অমিত গেল তার কাছে।

–একটু দেরি হতে পারে বুঝলে পেঁপেচোর! আশু বলে–রিসেন্টলি একগাদা ভুয়া কার্ড ধরা পড়েছে। এনকোয়ারি না করে নতুন কার্ড ইস্যু করবে না।

–তুমি তো জানোই ভাই, আমার লুকোছাপা কিছুই নেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী আর দুটো মাইনর–

–হয়ে যাবে। ভেবো না।

–চালের দর আজ–

–জানি, আমিও তো ভাত খাই।

–আর দু-চারদিন খোলা বাজারে চাল কিনলে আমার থ্রম্বসিস হয়ে যাবে।

আশু হাসল। বলল , তুমি তো তবু পেঁপেচোর। আমি যে কেন্নো!

আশু বোধহয় প্রফেসরিটাকে তেমন ভালো চোখে দেখে না। অমিত চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই আশু তাকে প্রফেসরের বদলে পেঁপেচোর বলে ডেকে আসছে। কেরানি হল গে কেন্নো।

–দ্যাখো ভাই। বলে অমিত।

আশু তাকে খাতির করল। ক্যান্টিনে নিয়ে ফুট স্যালাড খাওয়াল। কফিও খাওয়াতে খাওয়াতে বলল –দুর্দিনের জন্য তৈরি হও। সারা দুনিয়ায় এবার ফলন কম। রাশিয়া, চিন সবাই ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে বেরিয়েছে।

পিওর ম্যাথেম্যাটিক্সের প্রফেসর অমিত এত খোঁজ রাখে না। তার বাড়িতে খবরের কাগজ নেই। উদ্বেগের সঙ্গে বলে–সে কী?

বলছি কী! কেবল ওই মার্কিন মুলুকেই যা ফলার ফলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যুতে আমেরিকার সঙ্গে বাস্তু হয়ে গেছে আমাদের।

–দুনিয়ার মাটি কি শুকিয়ে যাচ্ছে আশু?

–শুকোবে না? যুবতীও তো বুড়ি হয় ভাই।

যুবতী ও বুড়ির কথায় তৎক্ষণাৎ অমিতের ইভার কথা মনে পড়ে। বাস্তবিক যুবতী যে কী বুড়ি হয় তা অমিতের চেয়ে বেশি কে আর জানে! দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সেই গাঁয়ের কিশোরী মেয়েটি কত চট করে বুড়ি হয়ে গেল। ব্রোঞ্জের চুড়িওয়ালা এত ঢলঢল করে হাতে যে মনে হয়। হঠাৎ বুঝি খসে পড়ে যাবে। হাতেটাতে শিরা উপশিরা জেগে আছে। ভেজাল তেলের জন্যই কিনা কে জানে, মাথার চুলও উঠে শেষ হয়ে এসেছে। মুখের ডৌল দেখে অমিতের চেয়েও বেশি বয়সী মনে হয়।

কত লোকের কত থাকে, কিন্তু অমিতের ওই একটা বৈ মেয়েমানুষ নেই। রাগ সোহাগ সব ওই একজনের ওপর। যুবতী বলো যুবতী, বুড়ি বলো বুড়ি, অমিতের ওই একটাই মেয়েমানুষ। ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ অমিত মনে-মনে ঠিক করে, আজ ফিরে গিয়েই ছেলেমেয়ে দুটোকে শোওয়ার ঘরে কপাট আটকে রেখে রান্নাঘরে ইভাকে জাপটে ধরে হামলে আদর করবে। ভাবতে-ভাবতে তার শরীর চনমন করে ওঠে। সারাদিনের নানা ক্লীবত্ব ভেদ করে পৌরুষ জেগে ওঠে।

চাঁদ নয়, হেমা মালিনী। অনেক ওপরে ধর্মতলার মোড়ে বড় বাড়িটার গায়ে লটকানো। হোর্ডিং। হোর্ডিং জুড়ে যেন চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নার মতো ঝরে-ঝরে পড়ছে হেমা মালিনীর হাসি। অবিরল। এবং স্থির সেই হাসি। কে সি দাসের দোকানের উলটো দিকে যেখানে ট্রাম লাইনের কাটাকুটি সেইখানে একটু মেটে জায়গায় কে যেন জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে রেখেছে। সেই ভেজা মাটির ওপর পড়ে আছে একটি যুবতী মেয়ে। ভিখিরি শ্রেণির। মাটির রঙেরই একখানা শাড়ি জড়ানো। কিন্তু সর্বাঙ্গ ঢাকা পড়েনি। বুকে পাছায় কিছু মাংস এখনও আছে। একটি স্তন কাত হয়ে ঝুলে মাটি স্পর্শ করেছে। আশেপাশে অমিত গুনে দেখল ঠিক চারটে বাচ্চা। সবচেয়ে ছোটটা বোধহয় বছর দুয়েকের। পুটো–পুটো সেইসব বাচ্চারা উদোম ন্যাংটো। সবাই মড়ার মতো শুয়ে আছে। চোখ বোজা, কেউ নড়ছে না। শ্বাস ফেলার ওঠানামা লক্ষ্য করা যায় না। তাদের চারধারে মেলা দুই নয়া তিন নয়া ছড়িয়ে আছে। তারা কুড়িয়ে নেয়নি। কেউ কুড়িয়ে নেয়নি। দয়ালু মানুষেরাই পয়সা ফেলে গেছে। আবার এও হতে পারে ওইসব ঝরে পড়েছে হেমা মালিনীর হাসি থেকেই। কে জানে! অমিত চোখ তুলে দেখল, ভুল নয়, দশমী পুজোর দিন দুর্গামূর্তির হাস্যময় মুখে যেমন কান্নার চোখ ফুটে ওঠে তেমনিই হেমা মালিনীর চিত্রার্পিত মুখে দেবীসুলভ কারুণ্য।

দুর্ভিক্ষ? অমিত চমকে ওঠে। বড় হওয়ার পর সে আর দুর্ভিক্ষের কথা ভাবেনি। ধারণা ছিল, দুর্ভিক্ষ এখন আর হয় না। ভারতবর্ষে গম চাল না হলে আমেরিকায় হবে, থাইল্যান্ড, বার্মায়, অস্ট্রেলিয়ায় হবে। পৃথিবী থেকে মানুষ দুর্ভিক্ষ তাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন করে আবার বুক খামচে ধরছে একটা ভুলে যাওয়া ভয়।

পর মহূর্তেই ভয়টা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে সে। ওই তো মেট্রোর আলো জ্বলছে। দপদপিয়ে উঠছে নানা বিজ্ঞাপনের নিওন সাইন। কত দামি–দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে দামাল, উত্তেজিত, আনন্দিত কলকাতা! ভিখিরির তুলনায় ভ ভদ্রলোক বহু গুণ বেশি।

জায়গাটা পেরিয়ে যায় অমিত দুটি নয়া ছুঁড়ে দিয়ে। কুড়িয়ে নেবে তো! না কি মরে গেছে ওরা? আত্মহত্যা করেনি তো? না-না, তা করেনি ঠিক। ভিখিরিরা কতরকম অভিনয় করে তার কি শেষ আছে। এটাও একটা কায়দা!

একটু দোটানার মধ্যে থেকে ভারী মনে অমিত বাস স্টপে এসে দাঁড়ায়। বড্ড ভিড়। সে ঠিক এই সব ভিড়ে এখনও অভ্যস্ত নয়। দাঁড়িয়েই থাকে।

দুটো বাড়ন্ত যুবা কথা বলে বাসস্টপে। একজন বলে–কলকাতায় এই যে লোকে বাসে উঠতে পারে না, ঘণ্টার–পর–ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে অফিস টাইমে, কিংবা ঝুলে–ঝুলে যায়; ঠিক সময়ে কোথাও পৌঁছতে পারে না। এর জন্যই দেখিস একদিন বিপ্লব শুরু হয়ে যাবে। দুমদাম ভদ্রলোকেরা প্যান্ট গুটিয়ে কাছা মেরে ইট পাটকেল ছুঁড়তে লাগবে বেমক্কা, ভাঙচুর করে সব উলটেপালটে দেবে একদিন।

অন্যজন হাসে।

অমিত হাসে না। তার মনে একটা ভয়ের প্রলেপ পড়ে। চারিদিকে কী যেন একটা ধনুকের টান–টান ছিলার মতো ছিড়বার অপেক্ষায় আছে। যেন এক্ষুনি ছিড়বে এবং হুড়মুড় করে পৃথিবীটা ভেঙে পড়বে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? নাকি পৃথিবী জোড়া খরা, দুর্ভিক্ষ? নাকি মহাপ্লাবন আবার? কিংবা ছুটে আসবে অন্য একটি গ্রহ পৃথিবীর দিকে যেরকম একটা গল্প সে পড়েছিল ইন্টারমিডিয়েটের ইংরেজি র‍্যাকপিডে।

রাতে শোওয়ার পর নিজস্ব মেয়ে মানুষটাকে হাঁটকায় অমিত, হাঁটকায় কিন্তু যা ভুলতে চায় ভুলতে পারে না। কিছুই ভুলতে পারে না। ইভা তার বুক থেকে অমিতের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, সারাদিন কত খাটুনি যায় বোঝ না তো, ঘুমোতে দাও।

পাশ ফিরে শোয় ইভা।

একটামাত্র মেয়েমানুষ থাকার ওই একটি দোষ। সে দিলে দিল, দিলে উপোস থাক! অমিত এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ভেবে পেল না। লাথি মারবে? মেরে দেখেছে অমিত, লাভ হয় না। লাভ নেই। খুব রাগ হয় অমিতের, কিন্তু রাগ চেপে শুয়ে থাকে। কিন্তু তখন বুকে একটা চাপ–বাঁধা কষ্ট হতে পারে। পৃথিবীর মাটি শুকিয়ে গেছে খরায়। বুড়িয়ে গেছে ফলনের পর ফলনে, এবার কালো এক দুর্ভিক্ষ এসে যাবে।

সে স্বপ্নে দেখতে পায়, কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা মরা মেয়েমানুষের স্তন ঝুলে সেই মরা মাটি ছুঁয়ে আছে। আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে সে। আকাশ থেকে পয়সা বৃষ্টি হচ্ছে। শুকনো পয়সা ঠন ঠন শব্দে ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে। কেউ কুড়িয়ে নিচ্ছে না।

তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগাল ইভা। বলল –ফিরে শোও। বোবায় ধরেছে।

অমিত ফিরে শুল। আর তখন হঠাৎ দুখানা হাতে তাকে কাছে টানল ইভা। চুমু খেল। বলল –এসো।

.

চালওয়ালার কপালে আজও ভ্রাম্যমাণ কোন পুরুত চন্দনের ফোঁটা দিয়ে গেছে, কানে বিল্বপত্র! মুখ তুলে হাসল চালওয়ালা।

অমিত ফিসফিস করে জিগ্যেস করে–দর কী হে?

–কমেছে। পুরো তিন। একটু নীচে দু-টাকা আশি। বলে চালওয়ালা পাল্লা হাতে নেয়–কত দেব?

কমেছে! কমেছে! ঠিক বিশ্বাস হয় না অমিতের।

–দশ কেজি। বলে অমিত।

চালওয়ালা মায়া মমতা ভরে চেয়ে হাসে। বলে–এখন কমতির দিকে।

ভারী ফুর্তি লাগে অমিতের। না, না, বাজে কথা ওসব। পৃথিবী জুড়ে দুর্ভিক্ষ আসছে এ কখনও হয়? চালের দাম কমে যাবে ঠিক।

অমিত হাঁটে। দু-হাতে বোঝা। কিন্তু ভারী লাগে না। আজ ইভা বেশি চাল দেখে খুশি হবে। খুব খুশি হবে।

চারদিকে কতরকম চিহ্ন ছড়ানো, দুর্ভিক্ষের আবার প্রাচুর্যেরও। মানুষ কখন কোনটা দেখে ভয় পায় কোনটা দেখে খুশি হয় তার তো কিছু ঠিক নেই।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments