Thursday, March 28, 2024
Homeকিশোর গল্পরূপকথার গল্পচীনের উপকথা: স্বপ্নের প্রাসাদ

চীনের উপকথা: স্বপ্নের প্রাসাদ

চীনের উপকথা: স্বপ্নের প্রাসাদ

বহু বহুকাল আগে, অনেক দূর পুবের দেশে এক দরিদ্র বুড়ি থাকতো । সে সুতো তৈরি করতো আর সেই উজ্জ্বল সুন্দর সুতো দিয়ে কাপড়ে আশ্চর্য সুন্দর সব নক্সা বুনতো । সেই নক্সাকরা কাপড় বাজারে বিক্রি করে যা টাকা পেতো, তা দিয়ে সংসার চালাতো সে ।

বুড়ির তিনটি ছেলে ছাড়া সংসারে আর কেউ ছিল না । তাদের মধ্যে আবার সবচেয়ে ছোটো ছেলেটি ছিল মায়ের সবচেয়ে বাধ্য । সে নিজে যেমন মাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো তেমনি মাও তাকে খুব ভালোবাসতো ।

ছেলেরা বনে কাঠ কেটে সেই কাঠ বাজারে বেচে মাঝে মাঝে কিছু টাকা পেতো । তখন তারা সেই টাকা মাকে দিতো যাতে সংসারে কিছু সুসার হয় ।

তাদের গ্রামটি ছিল এক বিরাট পাহাড়ের পাদদেশে । কুয়াশায় ভরা থাকতো সেই উপত্যকাটি বছরের বেশিরভাগ সময়েই । সেই কুয়াশাভরা গ্রামে ছোট্টো কুটিরে বুড়ি তার তিন ছেলেকে নিয়ে সুখে-দু:খে দিন কাটাচ্ছিলো ।

একদিন সে তার সদ্য-বোনা নক্সাতোলা কাপড় নিয়ে বাজারে গেছে, বিক্রি করে পয়সা পেলে সেদিনের চাল ডাল তেল নুন কিনে নিয়ে যাবে । সেসব রাঁধবে, তবে ছেলেরা খেতে পাবে ।

সুন্দর নক্সাগুলি বিছিয়ে বসে আছে খদ্দেরের আশায়, হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পাশের এক দোকানের দিকে । অপূর্ব সুন্দর একটি ছবি ঝুলছে সেই দোকানে । এক অপরূপ সুন্দর প্রাসাদের ছবি, সেই প্রাসাদ ঘিরে আশ্চর্য এক উদ্যান, সেই উদ্যানে কত না সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ, ফলের গাছ — সেইসব গাছে অপরূপ সুন্দর সব পাখি প্রজাপতি — কত ফোয়ারা, সরোবর — পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি স্রোতময়ী নদী, জল তার টলটলে, স্বচ্ছ । সমস্ত দৃশ্যটা সোনালি সূর্যকিরণে ঝকঝক করছে । বুড়ি তার চোখ সরিয়ে নিতে পারলো না ।

আত্মবিস্মৃত হয়ে সে ছবিটির দিকে চেয়ে রইলো । চারিদিকে বাজারের হই-হল্লা, চিত্কার-চেঁচামেচি, গণ্ডগোল — সব তাঁর চারপাশ থেকে মিলিয়ে গেল । সে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ছবিটির দিকে চেয়ে রইলো । কোন অমরলোকের ওই প্রাসাদ, উদ্যান, বৃক্ষরাজি ? ওই অদৃষ্টপূর্ব পাখি, প্রজাপতি, সরোবর ? একবার, একটিবার মাত্র, সে যেতে পারেন না সেখানে ?

বুড়ি তার সমস্ত নক্সার বিনিময়ে ছবিটি কিনতে চাইলো দোকানির কাছে । সে রাজি হলে বুড়ি ছবিটি বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো ।

বাড়িতে ছেলেরাও সবাই ছবিটি দেখে খুব প্রশংসা করলো প্রথমে । কিন্তু তারপরে যখন দেখলো মা কোনো খাবার আনেনি কিনে, ঘরেও কিছু নেই– তখন বড়ো দুই ছেলে গেল ক্ষেপে । তাদের ছোটোভাই কোনোরকমে তাদের শান্ত করে নিজে বনে গেল কাঠ কাটতে । সেই কাঠ বিক্রয় করে সে সেদিনের খাবার কিনে আনলো ।

তারপরে দিন গড়িয়ে যায় নিজস্ব গতিতে । ছেলেরা বনে কাঠ কাটে, খাবার কিনে আনে । বুড়ি সংসারের কাজ করে, কিছু নক্সা বোনে, ছেলেদের রেঁধে দেয় । আর মাঝে মাঝেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে । দিন দিন মনোবেদনায় সে শীর্ণ ও দুর্বল হয়ে যেতে থাকে ।

আর কারুর চোখে না পড়লেও ছোটোছেলের কিন্তু ঠিক চোখে পড়েছে যে মা আর আগের মতন হাসিখুশি নেই । আগের মতো সুস্থও যেন নেই । কারণও সে জানতো– সেই আশ্চর্য প্রাসাদের ছবিটি । মা রাতদিন সেই প্রাসাদ আর উদ্যানের কথাই ভাবে ।

সে একদিন তার মাকে ডেকে বললো, “মা, কেন তুমি তোমার ওই সুন্দর উজ্জ্বল সুতো দিয়ে ওই প্রাসাদটার মতো একটা নক্সা তৈরি করছো না ? উদ্যান, সরোবর, সূর্য– সব সমেত ?” মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো । “তাই তৈরি করবো বলছিস ? ঠিকই, হয়তো তাতেই আমি শান্তি পাবো ।”

পরের দিন থেকে বুড়ি নাওয়া-খাওয়া ভুলে নক্সা তোলায় মগ্ন হয়ে পড়ে । দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সে বুনতে থাকে । এখন আর সে সংসার দেখে না, ছোটোছেলেই বনে কাঠ কাটে, বাজারে বিক্রি করে, খাবার কিনে আনে, সকলের জন্য রান্না করে । বড়োছেলে আর মেজোছেলে মায়ের উপর খুব ক্ষেপে গেছে । এ কী বেয়াক্কেলে কাণ্ড শুরু করেছে সে ? নিজের কাজ ছেড়ে এ কী খামখেয়ালি ?

একদিন ওরা দুজনে মায়ের হাত থেকে বুনুনি কাঠি কেড়ে নিতে গেল । ছোটোভাই কোনোরকমে ওদের শান্ত করলো । সে বললো, “দয়া করে মাকে বাধা দিও না তোমরা । দোহাই তোমাদের । এ কাজ করতে না পারলে মা বাঁচবে না ।”

বুড়ি বুনে চলো, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস । সে তো বোনা নয়, যেন নিজের হৃদয় মন প্রাণ নিংড়ে সবটুকু বুনে দিচ্ছে ওর মধ্যে । ধীরে ধীরে সেই আশ্চর্য প্রাসাদ, উদ্যান ও সরোবর রূপ নিতে থাকে । নদী বয়ে যেতে থাকে, সোনার আলোয় সব ঝলমল করে উঠতে থাকে । ওই নদী যেন তারই অশ্রু দিয়ে তৈরি, ওই রা`ঙা ফুলের গুচ্ছ যেন তার বুকের রক্ত দিয়ে তৈরি ।

তিন বছর পরে বোনা শেষ হয় । মা মুখ তুলে তাকায় । পুরো কাপড়টি মেলে দেয় । আস্তে আস্তে তার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখে ফুটে ওঠে হাসি ।

সে এক অপরূপ শিল্প । তুলনা হয় না ভুবনে । সেই অমরলোকের উদ্যান, প্রাসাদ, নদী– অবিকল রূপ পেয়েছে সেখানে । তাদের পূর্ণ রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে বুড়ির নক্সার মধ্যে ।

তিন ছেলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।

বাইরে নিয়ে দিনের আলোয় দেখবে বলে বুড়ি যেই না মেলেছে কাপড়টা অমনি কোথা থেকে ঝড় এসে কাপড়খানা উড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে পুবের দিকে । ছেলেরা ছুটে যায় ধরতে, কিন্তু পারে না । দস্যু ঝড়, বুড়ির প্রাণের নক্সাখানি চুরি করে পালিয়ে যায় সুদূর পুবের দিকে, ওই যেখান থেকে সূর্য উঠে, সেখানে ।

ছেলেরা ফিরে এসে দেখে মা অচেতন হয়ে পড়ে আছে তাদের কুটিরের দরজায় । ছোটোছেলে তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল দিয়ে মায়ের চেতনা ফেরায় । তারপরে তাঁকে ধরে ধরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায় ।

বুড়ি বাচ্চা মেয়ের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে থাকে । বলো, “বাছারা, ও নক্সা না ফিরে পেলে আমি বাঁচবো না । তোরা আমার ছেলে, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য তোরা কিছু করবি নে ?”

বড়ো ছেলে এগিয়ে আসে । বলে, “ঠিক আছে, আগামীকাল খুব ভোরে আমি বেরিয়ে পড়বো । ত্রক্রমাগত যাবো পুবের দিকে । দেখি কেউ যদি তোমার সে নক্সার হদিশ বলতে পারে । “

পরদিন বড়ো ছেলে পুঁটলিতে খাবার বেঁধে নিয়ে রওনা হয়ে পড়লো পুবের দিকে । মা ভগবানকে ডাকলো, যেন সে সফল হয়ে ফিরতে পারে ।

দিনের পর দিন সে চলে চলে আর চলে । কেউ সে কাপড়ের কথা কিছুই বলতে পারে না । অবশেষে একদিন সে এলো এক পাহাড়ের ধারে । সেই পাহাড়ে ছিল একটি গুহা । বড়োছেলে দেখে অবাক হয়ে গেল যে গুহার মুখে একটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, সে নড়েও না চড়েও না । আরও এগিয়ে সে দেখলো ঘোড়াটা প্রস্তরীভুত । গুহায় থাকতো এক জাদুকরী বুড়ি । সে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো, “কে তুমি ভালোমানুষের বাছা, এসেছ এত দূরে ?”

বড়োছেলে সব খুলে বললো বুড়িকে । বুড়ি সব শুনে বললো, “হুম । খুবই জটিল ব্যাপার । তবে আমি জানি কে নিয়েছে তোমার মায়ের নক্সা চুরি করে ।”

“সে কি ? তুমি জানো ? কে নিয়েছে ? এক্ষুনি বলো আমায় ।”

“পুবের সূর্যপাহাড়ের পরীমেয়েরা চুরি করে নিয়ে গেছে তোমার মায়ের জিনিস । ওরা তোমার মায়েরটা দেখে দেখে নিজেরা নক্সা তুলবে, তাই । ও জিনিস ফিরে পাবার আশা ছাড়ো বাছা । সেখানে পোঁছানো খুব কঠিন ব্যাপার ।”

“কিন্তু আমার মা যে মরে যাবে ওটা না ফিরে পেলে । ও বুড়িমা, বলে দাও না পথ । কিকরে সেখানে যাওয়া যায় ।”

বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসলো । তারপরে বললো, “এই যে দেখছো পাথরের ঘোড়া, এ এক জাদুঘোড়া । তুমি যদি তোমার সামনের দাঁত দুটো ভেঙে দাও, সে-দুটো ওর মুখে পুরে আমি মন্ত্র বলি । তাহলেই ঘোড়া জ্যান্ত হয়ে উঠবে । ওই যে লতাটা — খাবার জন্য ওর এত ইচ্ছে, ওটা খেতে পারবে । তারপরে তোমাকে পিঠে নিয়ে উড়ে যাবে পুবের দিকে । প্রথমে পড়বে আগুনের নদী, তার ভিতর দিয়ে যেতে হবে তোমাকে — আগুনে ঝলসে গেলেও কোনো শব্দ করতে পারবে না । যদি করো সেই মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তুমি । তারপর পড়বে তুষারের নদী, ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে গেলেও কোনো শব্দ করতে পারবে না । যদি করো সেই মুহূর্তেই ওই তুষারের নদীতে ডুবে যাবে তুমি । সেইসব পার হয়ে তবে সুর্যপাহাড় । সেখানের মন্দিরে পরীমেয়েরা এখন ওটা দেখে নিজেরা নক্সা তুলতে ব্যস্ত । এবার বলো বাছা, পারবে যেতে ?”

বড়োছেলের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছিল । দেখে বুড়ি জাদুকরী আবার হাসলো । বললো, “কি দরকার বাছা, এই অল্প বয়সে জীবনটা খোয়ানোর ? তার চেয়ে তোমায় কিছু সোনাদানা দিই, তাই নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও ।”

বড়োছেলে এক পুঁটলি সোনা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরলো । কিন্তু পথে তার মনে এলো এক অন্য চিন্তা । সে ভাবলো, বাড়ি গেলে তো সবার সঙ্গে এ ধন ভাগ করে নিতে হবে । তার চেয়ে দূরের শহরে পালিয়ে গেলে এর সাহায্যে খুব ভালোভাবেই আরামে আয়েসে জীবন কাটানো যাবে । কেন বোকার মতো অন্যদের দিই ? পুরোটাই নিজে নিয়ে রাজার হালে থাকি । এই ভেবে সে দক্ষিণের শহরের দিকে চললো । বাড়িত শয্যাশায়ী মা, দুটি ভাই — তাদের কারো কথা একটিবার বিবেচনাও করলো না সে, লোভ এরকমই ভয়ানক ।

বছর ঘুরে এলো । মা ছেলের পথ চেয়ে চেয়ে শীর্ণ দুর্বল । কেঁদে কেঁদে তার দুচোখের দৃষ্টি ঝাপসা ।

মায়ের দু:খ দেখে এবার মেজোছেলে রাজি হলো নক্সা খুঁজতে যেতে ।

সেও চললো পুবের পথে, এক পুঁটলি খাবার বেঁধে নিয়ে । চলতে চলতে সেও একদিন পোঁছলো সেই জাদুকরী বুড়ির গুহার সামনে । সেও দেখলো সেই পাথরের ঘোড়া, দেখলো জাদুকরীকে, শুনলো তাঁর কথা ।

কিন্তু হায়, তার পরিণতিও হলো ঠিক তার দাদার মতো । বুড়ির দেওয়া এক পেটিকা সোনা নিয়ে সেও কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেল দক্ষিণের শহরে । বাড়িতে মৃতপ্রায় মা আর ছোটোভাইটির কথা সে মনেও আনলো না ।

দ্বিতীয বছরও ঘুরে এলো । মা এখন কেঁদে কেঁদে অন্ধ । বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে তার শীর্ণ দেহটি । ছোটোছেলে প্রাণ দিয়ে তার সেবা করে, কিন্তু সে ভালো হয় না, হবে কিকরে ; ওই নক্সাতোলা কাপড়খানা যে ছিল তার প্রাণের ধন, ওটা না পেলে তো সে ভালো হবে না !

তৃতীয বছরের শুরুতে ছোটোছেলে বললো এবার সে যাবে ওটা খুঁজতে । মা কেঁদে বলো, “ওরে, তুই চলে গেলে কে আমাকে দেখবে ? এই অবস্থা আমার, চোখেও দেখতে পাই না । তুই চলে গেলে কিকরে থাকবো ?”

ছোটোছেলে বলে, “তুমি ভাবনা কোরো না মা । প্রতিবেশিরা ভালো লোক । ওদের বলে দেখি । যদি ওরা তোমার দেখাশোনা করে, তাহলে তোমার সে প্রাণের জিনিস যেমন করে পারি খুঁজে নিয়ে আসি ।”

ছোটোছেলে পাড়া প্রতিবেশিদের সব জানিয়ে অসহায় বুড়ির দেখাশোনার অনুরোধ জানালো । তারা সত্যিই ভালোলোক ছিল, তারা সাগ্রহে রাজি হলো । শুভদিনে মাকে প্রণাম করে ছোটোছেলে চললো পুবের পথে । চললো চললো আর চললো । অবশেষে পোঁছলো সেই জাদুকরীর গুহার সামনে । দেখলো সেই পাথরের ঘোড়া, দেখলো বুড়িকে, শুনলো তার কথা । পুবের সূর্যপাহাড়, সেখানের পরীমেয়েরা চুরি করে নিয়ে গেছে মায়ের নক্সাতোলা কাপড় । সেখানে পোঁছতে হলে প্রথমে ভেঙে দিতে হবে নিজের সামনের দুটি দাঁত, তারপরে পেরোতে হবে আগুনের নদী আর বরফের নদী ।

এবার কিন্তু তার দুই দাদার মতো তার মুখে ভয়ে সাদা হয়ে গেল না । জাদুকরী তীক্ষণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছিল । কিন্তু সেও তার মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না । ছেলেটি এক খণ্ড পাথর তুলে নিয়ে সেই মুহূর্তেই ভেঙে দিল নিজের দুটি কাঁচা দাঁত । ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল, কিন্তু তাতে ছোটোছেলের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ।

জাদুকরী সেই দাঁত দুখানা পাথরের ঘোড়ার মুখে পুরে মন্ত্র বলতে লাগলো । পাথরের ঘোড়া জ্যান্ত হয়ে উঠলো । এরপর সে ছেলেটিকে পিঠে নিয়ে উড়ে গেল আকাশে ।

তার পিঠ আঁকড়ে ধরে বসে রইলো ছোটোছেলে । তার মনে কেবল ভেসে আসছিল তার দু:খিনী মায়ের শীর্ণ মুখখানা । নিজের কাঁচা দাঁত ওপড়ানোর ব্যথা আর মায়ের ব্যথার তুলনা হয় নাকি ?

এরপরে এলো আগুনের নদী । তীব্র তাপে ঝলসে যেতে লাগলো ছেলেটির সর্বাঙ্গ । অসহ্য যন্ত্রণা হওয়া সত্বেও সে একটি কাতর শব্দও করল না । ঘোড়ার পিঠ আঁকড়ে বসে রইলো শক্ত হয়ে ।

অর্ধেক দিন ধরে সেই আগুনের নদী পার হলো ঘোড়া ।

তারপরেই তুষারের নদী । আগুনে ঝলসে যাওয়া দেহের উপরে সেই ভায়ানক ঠাণ্ডা জল প্রথমে ধরালো জ্বালা — তারপরে অবশ হয়ে যেতে লাগলো দেহ । কিন্তু সে একটি শব্দও করলো না । যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে তার কষ্টবোধ চলে গিয়েছিল । বাকি অর্ধেক দিন ধরে ঘোড়া পেরোলো তুষারের নদী । অবশেষে বিকেলবেলা ঘোড়া পোঁছলো সূর্যপাহাড়ে । অপরূপ স্নিগ্ধ সে পাহাড়, আশ্চর্য কোমল আলোর ছটা বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে । সেখানে পৌঁছে ঘোড়া থামলো ।

ছেলেটি তখন প্রায় অচেতন । সে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ালো সেখানে । দেখতে দেখতে সূর্যপাহাড়ের স্নিগ্ধ সর্বরোগহর কোমল কিরণ তার সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দিল । তার দেহের সমস্ত যন্ত্রণা উধাও হয়ে গেল ।

প্রসন্নচিত্তে সে পাহাড়ের উপরের মন্দিরের দিকে চললো । বহুকালের চেষ্টা সফল হলে মনে যেমন আনন্দ হয়, তেমনি হচ্ছিল তার ।

পাহাড়ের গা বেয়ে সে পোঁছলো মন্দিরে । সেখানে মন্দিরের দুয়ারে দুটি অদ্ভুত প্রাণী পাহারা দিচ্ছে । চেনাজানা কোনো প্রাণীর সঙ্গেই তাদের মিল নেই । তারা যেন এই দুনিয়ার প্রণী নয় । তারা কথা বলে না, নড়ে না ; চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ।

ছেলেটি তাদের কাছে অনুমতি চাইলো ভিতরে ঢোকার । তারা কিছুই বললো না । ছেলেটি তখন তাদের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকলো ।

বিশাল বড়ো সুন্দর একটি হলঘরে এসে সে পৌঁছলো । ঘরটির ঠিক মধ্যিখানে তার মায়ের করা নক্সাকাপড়খানা টাঙানো । ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক পরী । সকলেই নিজের সামনে বিছানো কাপড়ে সেই নক্সাখানির নকল তুলতে ব্যস্ত । ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে পরীদের রানীকে জানালো যে সে তার মায়ের করা এই নক্সাওলা কাপড়খানি ফেরৎ চায় । রানী যেন দয়া করে ফিরিয়ে দেন । নাহলে তার অসহায়া বুড়ি মা মনোদু:খে মরে যাবে ।

পরীরানী খুবই অবাক হয়েছিল একজন মানুষকে সূর্যপাহাড়ে আসতে দেখে । সেখানে যে কোনো মানুষ পোঁছতে পারে, এ তার ধারণায় ছিল না । যাইহোক পরীরানী বললো যে পরদিন ভোরে সে ওটা ফিরিয়ে দেবে । পরীরা ওটা নকল করা প্রায় সেরে ফেলেছে, শুধু একটি রাত কাজ করলেই হয়ে যাবে । রাতটা যেন সে পরীদের আতিথ্য স্বীকার করে ।

পরীরানী তার জন্য ভালো সান্ধ্যভোজের ও সুখদ শয্যার আয়োজন করলো । কিন্তু ছেলেটির ঘুম হয় না উদ্বেগে, সে ভাবে পরদিন ভোরে ওরা দেবে তো ?

সে এসে দেখে ওই হলঘরে খুব ব্যস্ত হয়ে সব পরীরা কাজ করছে । সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন প্রায় আর নজর চলে না তখন এক পরী এসে সুন্দর একটা দ্যুতিময় মণি টাঙিয়ে দিল ছাদের হুক থেকে । সেই আলোতে ঘর আলো হয়ে গেল । পরীরা নক্সা তুলতে ব্যস্ত ।

সবচেয়ে প্রথমে কাজ শেষ হলো সবচেয়ে দক্ষ এক সুন্দরী পরীর । রাঙা শাড়ি পরা সেই পরী । সে নিজের নক্সাখানি মেলে দিল ছেলেটির মায়ের নক্সাকরা কাপড়ের পাশে ।

কিন্তু মায়ের নক্সার পাশে পরীর নক্সাটি নিতান্ত সাদামাঠা ঠেকলো । পরী নিজেও খুশি হয়নি । সে অনেকক্ষণ নানা দিক থেকে দেখলো ওটিকে, তারপরে সে নিরাশ হয়ে স্বীকার করলো আসল নক্সার শতাংশের একাংশ সৌন্দর্যও তারটাতে ফোটেনি ।

বুদ্ধিমতী পরী তখন এক দারুণ উপায় ঠাওরালো মনের শান্তির জন্য । সে ভাবলো “আমি বরং ওই নক্সার মধ্যে ঢুকে যাই ।”

এই ভেবে সে সুচ সুতো দিয়ে নিজের ছবিখানি বুনে দিল বুড়ির নক্সায় । উদ্যানে, একটি সরোবরের পাশে রাঙা শাড়ি পরা তার ছোট্টো ছবিখানি ।

কাজ শেষ করে সে ঘুমিয়ে পড়লো শান্ত হয়ে, খুবই পরিশ্রম হয়েছিল ওভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বুনে চলতে ।

শেষ রাতে সব পরীরা যখন ঘুমোচ্ছে, বুড়ির ছেলে পা টিপে টিপে গিয়ে নিজের মায়ের নক্সাখানা চুরি করে এক দৌড়ে বাইরে চলে এলো । পরদিন ভোরে ওরা দেয় কি না দেয়, ঠিক কি ?

বাইরে এসেই এক লাফে জাদুঘোড়ার পিঠে । ঘোড়া তাকে নিয়ে উড়ে চলে বাতাস চিরে । এবার আর পথে বরফের নদী নেই, আগুনের নদী নেই । মুহূর্তের মধ্যে সে এসে পোঁছয় সেই জাদুকরীর গুহার সামনে ।

জাদুকরী বুড়ি তাকে দেখে খুব খুশি । বলে, “সাবাস বেটা, সাবাস । এই তো চাই । সার্থক তোর মা যে তোকে পৃথিবীতে এনেছিল বাছা ।”

বুড়ি ঘোড়াকে আবার মন্ত্রবলে পাথর করে রাখেন । আর ঘোড়ার মুখ থেকে ছেলেটির দাঁত দুটো খুলে নিয়ে ছেলেটির মুখে পুরে মন্ত্র বলো । যেখানকার দাঁত আবার সেখানে বসে যায়, যেন কোনোদিন ওখানে থেকে ওরা নড়েনি ।

জাদুকরীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয় সে । ভেবেছিল অনেক পথ যেতে হবে, কিন্তু জাদুকরীর জাদুবলে মুহূর্তের মধ্যে সে এসে পোঁছয় তার কুটিরে ।

মাকে যখন সে নক্সাকরা কাপড়টি ফিরিয়ে দিচ্ছে তখনকার কথা বর্ণনা করতে পারি এমন ভাষা আমার নেই । মা যে তাকে কিভাবে আশীর্বাদ করলো, কাপড়খানি বুকে নিয়ে কিভাবে কাঁদতে লাগলো, সে আর কি করে বলি ?

চোখের জলে অন্ধত্ব ধুয়ে গেল তার, সে আবার দেখতে পেলো । দুর্বলতাও দূর হয়ে গেল ।

সে কাপড়টি নিয়ে বাইরে এলো । সকালের শান্ত বাতাস সেটিকে উর্দ্ধে তুললো, সেটি ছড়িয়ে যেতে লাগলো, বড়ো থেকে আরো বড়ো হতে লাগলো । কোথায় মিলিয়ে গেল তাদের জীর্ণ কুটির, কুয়াশাভরা উপত্যকা ! সেখানে দেখা দিল সেই অপরূপ প্রাসাদ, উদ্যান ও সরোবর সমুহ । উজ্বল সোনালি সূর্যালোকে ঝকঝক করছে সব । উজ্জ্বল ঢেউয়ে ঢেউয়ে লক্ষ হীরার ফুল ফুটিয়ে চঞ্চল নদী বয়ে যাচ্ছে । আর উদ্যানে সরোবরের পাশে শান্ত হয়ে বসে আছে রাঙা শাড়ি পরা সেই সূর্যপাহাড়ের পরী ।

সেই প্রাসাদে এত জায়গা ছিল যে পাড়া-প্রতিবেশিরও জায়গা হয়ে গেল ।

এখন বুড়ি তার স্বপ্নের প্রাসাদে ছেলে আর বউমাকে নিয়ে থাকেন । সেই লাল পরীর বিয়ে হয়েছিল বুড়ির ছোটোছেলের সঙ্গে ।

তারপরে ? গল্পটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো ।

লেখা: মল্লিকা ধর

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments