ছায়া – আফজাল হোসেন

গুহামানবী - আফজাল হোসেন

ঘোর সন্ধ্যা। ধীরে-ধীরে তরল অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। রাস্তার ল্যাম্প-পোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠছে। নিপা কোচিং সেন্টার থেকে পড়া শেষে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। মফস্বল শহরের শহরতলী এলাকা। মাগরিবের আজানের পরপর এই সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য রাস্তা-ঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে যায়। রাস্তায় নিপার আশপাশে আর কেউ নেই। এই মুহূর্তে নিপা একটা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ওর কেমন গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে কেউ ওকে অনুসরণ করছে। ও বার-বার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাচ্ছে, কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ নিপা লক্ষ করল, পিছন থেকে আসা ল্যাম্প-পোস্টের আলোতে ওর সামনে দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে। একটা ওর নিজের, অন্যটা খুনখুনে বৃদ্ধ কুঁজো ধরনের কোনও লোকের, যার মুখ ভর্তি উষ্কখুষ্ক জঙ্গুলে দাড়ি। হাতে লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে লোকটা যেন একেবারে নিপার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলে এগোচ্ছে।

থমকে নিপা আবার পিছনে তাকাল। নাহ, কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

নিপার বুকটা ধক ধক করতে শুরু করল। এ কী হচ্ছে সঙ্গে?! রাস্তায় ও একা, অথচ দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে-এর কারণ হতে পারে?

নিপা একটা গন্ধও পাচ্ছে। যেন যে তাকে অনুসরণ করছে তার গা থেকেই গন্ধটা আসছে। অত্যন্ত কড়া আতরের গন্ধ। সেই গন্ধে নিপার কেমন মাথা ঝিমঝিম করছে।

ও চলার গতি বাড়িয়ে দিল। দ্রুত লম্বা-লম্বা পা ফেলতে লাগল।

চলতে-চলতে নিপা কাশির শব্দ শুনতে পেল। বুকে শ্লেষ্মা জমা কোনও বৃদ্ধের কাশি। বৃদ্ধ যেন একেবারে ওর ঘাড়ের পিছন থেকে কেশে উঠল।

নিপা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার পিছনে তাকাল। আগের মতই কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ও চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল।

.

হাঁপাতে-হাঁপাতে শেষ পর্যন্ত নিপা বাড়ি এসে পৌঁছল। ভয়ার্ত কাঁদো-কাঁদো গলায় সবকিছু ওর মাকে জানাল। সব শোনার পর ওর মা বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিলেন

তিনি নিপাকে বোঝালেন, যেহেতু ও রাস্তায় একা ছিল, তার উপর কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে আসছিল-এজন্যই ভয় পেয়েছে। কবরস্থানকে ঘিরে সবার মনেই এক ধরনের ভয় কাজ করে। ভর সন্ধ্যায়, একা-একা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে আসায় সেই ভয়টাই তীব্র হয়ে ধরা দিয়েছে। কেউ ওকে অনুসরণ করেছে, আতরের গন্ধ, কাশির শব্দ—এ সবই মনের ভুল। আর দুটো ছায়া দেখেছে রাস্তার দু’ধারের ল্যাম্প-পোস্টের কারণে। দু’ধারের ল্যাম্প-পোস্ট থেকে আসা ভিন্ন-ভিন্ন আলোতে নিজেরই দুটো ছায়া পড়েছে। একটা ছায়াকে কুঁজো ধরনের কোনও বৃদ্ধের মনে হয়েছে কাধের স্কুল ব্যাগটার জন্য। ছায়ায় স্কুল ব্যাগটাকে পিঠের কুঁজ মনে হয়েছে। ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখায় গালের দু’পাশ বেয়ে নামা ওড়নার ছায়াকে মনে হয়েছে কাল্পনিক বৃদ্ধের জঙ্গুলে দাড়ি। ছায়ার হাতে লাঠি দেখতে পাওয়া, আতরের গন্ধ, কাশির শব্দ-ওসবই বিভ্রম। ভীত-সন্ত্রস্ত মনের অতি কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এত-এতভাবে মা বোঝানোয় নিপা অনেকটাই সুস্থির হলো। ও পোশাক পাল্টে, মুখ-হাত ধুয়ে, হালকা নাস্তা সেরে পড়তে বসল। সামনে ওর এস.এস.সি. পরীক্ষা। পড়ার ভীষণ চাপ। অনেক রাত পর্যন্ত ওকে পড়াশোনা করতে হয়।

.

রাত পৌনে একটা।

নিপা এখনও পড়ার টেবিলে। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। বার-বার হাই উঠছে। এর পরও অতি কষ্টে পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। রাত একটা বাজার পর বিছানায় যাবে। ও নিয়ম করে নিয়েছে রাত ঠিক একটা পর্যন্ত পড়ার টেবিলে থাকবে।

রাত একটা বাজার পর নিপা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। শোবার আগে একবার ওকে বাথরুমে যেতে হবে। টয়লেট সেরে, ফেসওয়াশ দিয়ে মুখটা ভালভাবে ধুয়ে শুয়ে পড়বে। শোবার আগে মুখ ধুয়ে নিলে মুখে ব্রণ কম ওঠে।

নিপা বাথরুমের বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফেসওয়াশ মাখছে। ফেসওয়াশের ফেনার কারণে ওর চোখ বন্ধ। মুখে পানির ঝাপটা মেরে ফেসওয়াশের ফেনা পুরোপুরি পরিষ্কারের পর ও চোখ খুলল। অমনি ওর বুকটা ধক করে উঠল। ‘ও, মা,’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল।

চোখ খুলে ও আয়নায় দেখতে পেয়েছে ওর পিছনে কুঁজো ধরনের এক বৃদ্ধ দাঁড়ানো। বৃদ্ধ ফোকলা দাঁত বের করে কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসছে।

নিপার চিৎকার শুনে ওর বাবা-মা তাঁদের শোবার ঘর থেকে ছুটে এলেন। নিপা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে-কাঁপতে ভাঙা-ভাঙাভাবে বলল, ‘মা, সেই বুড়োটা! বুড়োটাকে এইমাত্র আমি আয়নায় দেখেছি! আমার পিছনে দাঁড়ানো ছিল!’

বলা শেষে নিপা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর মা মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘এসব কী বলছিস, মা, কোন্ বুড়োটা?!’

নিপা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘সন্ধ্যায় কবরস্থানের সামনে থেকে যে বুড়োটা আমার পিছু নিয়েছিল।’

নিপার বাবা অবাক হওয়া গলায় বলে উঠলেন, ‘কোন্ বুড়ো আবার আমার মেয়ের পিছু নিয়েছিল?! কোনও পাগল-টাগল নাকি?’

নিপার মা বললেন, ‘পাগল-টাগল কিছু নয়, তোমার মেয়ে শুধু-শুধুই ভয় পেয়েছিল। ওর নাকি মনে হয়েছিল বুড়ো কেউ ওকে অনুসরণ করছে। কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না।’ নিপাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মা, তুই এখনও ওসব মাথায় নিয়ে ঘুরছিস? আমি না তোকে কতভাবে বোঝালাম! সবই তোর মনের ভুল!

নিপা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘না, মা, মনের ভুল নয়। আমি এইমাত্র আয়নায় স্পষ্ট বুড়োকে দেখেছি। বুড়োর একপাশের গাল শ্বেতিতে সাদা হয়ে গেছে। একটা চোখ নষ্ট। সেই চোখটা ঘোলাটে। ঠোঁটের দু’কোনায় থুথু জমা। ফোকলা দাঁত।’

নিপার মা মেয়ের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘সবই তোর চোখের ভুল। আয়, তোকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিই।’

নিপাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। একসময় নিপা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। নিপা ঘুমিয়ে যাবার পর মা ওর পাশ ছেড়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। যাবার আগে নিপার রুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন।

.

শেষ রাতের দিকে কড়া আতরের গন্ধে নিপার ঘুম ভেঙে গেল। ও টের পেল ওর মা এখনও ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। ও ভেবে পেল না মায়ের গা থেকে এমন কড়া আতরের গন্ধ আসছে কেন?!

নিপা পাশ ফিরে মায়ের দিকে ঘুরল। ঘরে ডিম বাতি জ্বলছে। ডিম বাতির আলোতে ও যা দেখল, তা ও কোনও দিন কল্পনাও করেনি। যে ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছে সে ওর মা নয়! সেই ভয়ঙ্কর চেহারার বুড়োটা! বুড়োটার একটা মাত্র চোখ লালসায় জ্বলজ্বল করছে। কুৎসিত ভঙ্গিতে বার-বার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে।

নিপা চিৎকার দিয়ে উঠতে চাইল। তার আগেই বুড়োটা নিপার মুখ চেপে ধরল। ও জ্ঞান হারাল।

.

নিপার মা সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেয়ের খোঁজ নিতে এলেন। বিছানায় নিপা নেই। ভাবলেন বোধহয় বাথরুমে।

নাহ, বাথরুমেও নেই! বাথরুমেও নেই!

কাতা হলে গেল কোথায়?!

নিপার খোঁজ আর পাওয়া গেল না। পুলিশে জানানো হলো, সারা শহরে মাইকিং করে ঘোষণা দেয়া হলো, খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলো-কিছুতেই আর নিপার খোঁজ মিলল না।

.

কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে।

না মাঝরাত। মিদুল রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে এসেছে। সে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। অনেক রাত বলে রাস্তায় কোনও যানবাহন নেই। অগত্যা তাকে স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতে হয়েছে। পথে একটা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। তার কেমন গা ছমছম করছে। চারদিক একেবারে সুনসান। উৎকট একটা আতরের গন্ধ পাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে কারা যেন তাকে অনুসরণ করছে। যারা অনুসরণ করছে তাদের গা থেকেই আতরের গন্ধটা আসছে। অথচ আশপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ মিদুল লক্ষ করল, ল্যাম্প-পোস্টের আলোতে তার সামনে তিনটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। একটা তার নিজের ছায়া, অন্য দুটো কুঁজো ধরনের এক বৃদ্ধের আর এক কিশোরীর।

মিদুলের নিজের ছায়াটার দু’পাশে পড়েছে সেই দু’জনের ছায়া। অথচ তার দু’পাশে কেউই নেই।

ভয়ে ছায়াসঙ্গীদের গলার স্বরও শুনতে পেল মিদুল। বুড়োটার বুকে কফ জমা খল-খল কাশির শব্দ আর কিশোরীর রিনঝিনে গলার খিল-খিল হাসি।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.