Friday, April 19, 2024
Homeরম্য গল্পবুটু ও পটোদিদি - লীলা মজুমদার

বুটু ও পটোদিদি – লীলা মজুমদার

বুটু ও পটোদিদি - লীলা মজুমদার

আমার পটোদিদির গল্প আগেও করেছি। পটোদিদির মেয়ে বুটু, বুটুর মেয়ে মালবিকা। আমার নাতনি মালবিকা কাননের গানের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তাকে সবাই চেনে। যেমন মিষ্টি গলা, তেমনি মিষ্টি চেহারা আর স্বভাব। তার ওপর গল্প যা বলে সে শুনতে হয়। এগল্প তার কাছে থেকেই পাওয়া, প্রায় তারই ভাষায় বলা।

হয়তো পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগের কথা। পটোদিদি বুটুকে নিয়ে রাতের গাড়িতে কোথায় যেন চলেছেন ছুটি কাটাতে। সেকালের সেকেন্ডক্লাস গাড়ি; মেয়েদের কামরা; তাতে পটোদিদি আর বুটু ছাড়া কেউ নেই। সেকালে এখনকার মতো করিডর ট্রেন ছিল না। দরজা খুললেই প্ল্যাটফর্ম। আবার প্ল্যাটফর্ম থেকে এক পদক্ষেপে গাড়ির মধ্যিখানে।

জিনিসপত্র খাবারদাবার নিয়ে দুজনে দিব্যি চলেছেন। মাঝখানে একটা স্টেশনে গাড়ি থামল; একটু বাদেই আবার ছাড়ল। ছাড়ার পর যেই একটু বেগ বেড়েছে, অমনি দরজায় দুমদাম ধাক্কা। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, মায়ে-ঝিয়ে বই পড়ছেন। ধাক্কার শব্দ শুনে বই রেখে দুজনে জানলা দিয়ে দেখেন একটা ঝাঁকড়া চুল, লাল চোখ, ষন্ডামার্কা লোক পাদানিতে দাঁড়িয়ে ‘দরজা খুলুন! দরজা খুলুন!’ বলে চ্যাঁচাচ্ছে।

পটোদিদির বড় দুঃখ হল। বুটুকে বললেন, ‘খুলে দিই, কী বলিস?’ বুটু বলল, ‘মোটেই না। পুরুষমানুষদের এত গাড়ি থাকতে ও মেয়েদের গাড়িতে উঠতে চাইবেই বা কেন? চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা চোর।’

পটোদিদি বিরক্ত হলেন, ‘বাইরের চেহারা দিয়ে কাউকে বিচার করতে হয় না, বুটু। হয়তো ভুল করে এই গাড়িতে উঠেছে। কী কাতরভাবে ডাকছে, শোন্ একবার।’

বুটু নির্দয়ভাবে বলল, ‘সব ভাঁওতা। পাকা চোর। দরজা খুললেই গলা টিপে ধরবে।’

‘কিন্তু যদি পড়ে যায়?’

‘মোটেই পড়বে না। ঝুলে ঝুলে অভ্যাস হয়ে গেছে। হাতের মাস্‌ল্‌ দেখছ না?’

বলাবাহুল্য, এসব কথাবার্তাই লোকটার কর্ণগোচর হচ্ছিল। সেও মওকা পেয়ে পটোদিদির উদ্দেশে নাঁকি সুর ধরল—‘ও মাগো! আর তো পারিনে। এক্ষুনি পড়ব!’

আর থাকতে না পেরে পটোদিদি বললেন, ‘দিচ্ছি খুলে!’

বুটু বলল, ‘চেন্‌ টানব বলে রাখলাম। আমার মন গলানো অত সহজ নয়।’

কী আর করেন পটোদিদি। আবার বসে পড়ে লোকটাকে বলতে লাগলেন, ‘সেকথা সত্যি, বাছা। এদের বংশ যেমনি কঠিনহৃদয়, তেমনি বদরাগী। দয়া-মায়া বলে এদের কিচ্ছু নেই। কিছু মনে কোরো না, বাছা, সাবধানে ঝুলে থাকো। দেখো পড়েটড়ে যেয়ো না।’ এই বলে পটোদিদি আবার বই খুললেন।

একটু পরেই লোকটা আবার চ্যাঁচাতে লাগল, ‘ও মা! বড্ড জলতেষ্টা পেয়েছে! একটু জল দিন, মা!’ পটোদিদি বললেন, ‘সেটা দিতে বোধহয় বাধা নেই।’ তারপর রাগতভাবে মেয়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সঙ্গে ভীম নাগের সন্দেশ আছে, তার দুটো-একটা দেওয়া যেতে পারে কি?’

বুটু বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, ‘যেতে পারে, যদি দরজা না খুলে দেওয়া যায়।’ পটোদিদি জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে জল আর সন্দেশ দিলেন। লোকটা সেগুলো খেয়ে, সন্দেশের খুব প্রশংসাও করল। তারপর ওই অবস্থায় ঝুলে ঝুলে পটোদিদির সঙ্গে গল্প করতে করতে, যেই দেখল দূরে স্টেশনের আলো, অমনি টুপ্‌ করে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পটোদিদি রাগতভাবে মেয়েকে বললেন, ‘চোর যদি হত, তা হলে জল নেবার সময় আমার সোনার বালাটা ছিনিয়ে নিল না কেন?’ বুটু বলল, ‘চোর না হলে চলন্ত গাড়ি থেকে টুপ্‌ করে নেমে পড়ল কেন?’

মালবিকার কাছে শোনা আরেকটা পারিবারিক গল্প বলি। বিখ্যাত গায়ক হেমেন্দ্রলাল রায় হলেন মালবিকার জ্যাঠামশাই। বিয়ে-থা করেননি। ভাগলপুরের গঙ্গার ধারে বুড়ি মায়ের সঙ্গে, তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন।

একতলার ঘর, পুরনো বাড়ি, জানলা সব লটখটে, শিকটিক নেই। শীতের রাত। এমন সময় কোনও উপায়ে জানলা খুলে ঘরে চোর ঢুকল।

খুট্‌খাট্‌ শুনে হেমেন্দ্রলাল জেগে উঠে মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়েই চোরকে দেখে মহা রেগে, মারবার জন্য তেড়ে গেলেন। কিন্তু তার নাগাল পাবার আগেই চোর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হেমেন্দ্রলালের চক্ষুস্থির! ব্যাটা মরে-টরে গেল না তো?

এই কথা মনে হবামাত্র তিনি এমনি চেল্লাচেল্লি করতে লাগলেন যে পাশের ঘর থেকে বুড়ি মা তো বটেই, পাড়াসুদ্ধ লোক এসে হাজির হল। কেউ বলল, ‘আহা! অমন ব্যবহার করতে আছে! ভয়ের চোটে ভিরমি গেছে!’

কেউ বলল, ‘রাগ তো হবারই কথা! তাই বলে এত পেটাবেন যে অজ্ঞান হয়ে যাবে? হয়তো মরেই গেছে!’

বুড়ি মা বললেন, ‘কতবার তোকে রাগতে মানা করেছি না? এখন হাতে হাতকড়া পড়ুক!’

হেমেন্দ্রলাল যতই বলেন চোরকে তিনি ছোঁননি, তা সেকথা কে শোনে! শেষটা ওই কনকনে শীতের রাতে, বেশি করে টাকাকড়ি দিয়ে একটা ছ্যাকড়া-গাড়ি এনে, তাতে করে অচেতন চোরকে নিয়ে হেমেন্দ্রলাল হাসপাতালে গেলেন।

অত রাতে রুগি নিয়ে গিয়ে বেশ কিছু খরচ করে তবে চিকিৎসা মিলল। ওষুধপত্র পেটে পড়তেই চোরের জ্ঞান ফিরল। তখন হেমেন্দ্রলাল তাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছুঁইনি পর্যন্ত। তা হলে মুচ্ছা গেলে কেন?’

লোকটা বলল, ‘আজ্ঞে, ক-দিন খেতে পাইনি, তাই। সেই জন্যেই চুরি করতেও গেছিলাম। পেটের দায়ে চোর হয়েছি।’ বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। হেমেন্দ্রলাল ভয়েই মরেন, এই না আবার মুচ্ছো যায়।

শেষটা হাসপাতাল থেকেই তাকে দুধ, রুটি, ফল ইত্যাদি কিনে খাইয়ে সুস্থ করে, আবার সেই ঠিকে গাড়িতে তুলে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। চলে আসার আগে তার হাতে কুড়িটা টাকা দিয়ে বললেন, ‘দেখো বাপু, অন্য জায়গার কথা বলছি না, কিন্তু আমার ওখানে না খেয়ে কখনও, চুরি করতে যাবে না। যদি মরেই যেতে, কী ফ্যাসাদে পড়তাম বলো তো!’

চোর জিব কেটে বলল, ‘না, না, বাবু তাই কখনও পারি! আর গেলে পেট ভরে খেয়ে দেয়েই যাব!’

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments