Wednesday, August 20, 2025
Homeবাণী ও কথাবুড়োর দোকান - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বুড়োর দোকান – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বুড়োর দোকান – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দিনেরবেলা কেউ কোনওদিন এ-দোকান খোলা দেখেনি। অন্য দোকান যখন বন্ধ হয় তখন এই দোকান খোলে। কোনও অচেনা খদ্দের এ-দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালে ধমক খায়।

দশ-বারোটা সোডার বোতল আর অনেকগুলো সিগারেটের প্যাকেট সাজানো রয়েছে, তার মধ্যে অবশ্য বেশির ভাগই খালি। ইলেকট্রিক কানেকশান নেই, একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বলে শাঁ-শাঁ শব্দ করে। দোকানের মালিকের নাম বুড়ো হলেও সে কিন্তু যথেষ্ট বুড়োনয়। তার মাথার চুল এখনও। অনেক কাঁচা আছে। তার মুখের চামড়ায় কুঞ্চন শুরু হয়নি, চোখ দুটোই বেশ পরিষ্কার। বয়েস হবে পঞ্চান্ন-ছাপান্ন, বেশ মজবুত চেহারা, কালো কুচকুচে রং বেশ লম্বা বলেই একটু ঝুঁকে পড়া। একটা ধুতি পাট করে লুঙ্গির মতন পরা, গায়ে হাফ হাতা গেঞ্জি। এই তার প্রতিদিনের পোশাক, শীতকালে এর ওপর নস্যিরঙা আলোয়ান জড়িয়ে নেয়। ডান বাহুতে একটা বড় রুপোর তাবিজ।

লোকটির ডাক নাম বুড়ো, ছেলেবেলা থেকেই সবাই তাকে বুড়ো বলত, এখন অনেকে বলে বুড়োদা।

সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ এসে বুড়োদা রোজ তার দোকানের ঝাঁপ খোলে। তারপর ধূপ ধুনো। দেয়। বহুদিন আগেকার একটা ক্যালেন্ডারের লক্ষ্মীর ছবি বাঁধানো আছে, সে ছবি এখন চেনাই বেশ শক্ত। পেট্রোম্যাক্স জ্বালার সময়েই দু-চারজন পুরোনো খদ্দের কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে। থাকে। বুড়োদা তাদের পাত্তাই দেয় না। ওপরের পাটাতনে বসবার আগে তার আরও কাজ বাকি থাকে। দোকানের নীচের খুপরিতে দুটো বালতি রাখা থাকে, কাছেই টিউবওয়েল, সেই বালতি দুটোতে জল ভরতে হবে। তারপর কাচের গেলাস ধুতে হবে গোটাদশেক।

ওপরে ওঠবার সময় একটা গামছায় পায়ের তলা ভালো করে মুছে নেয় বুড়োদা। তারপর লক্ষ্মীর ছবির দিকে চোখ বুজে, হাত জোড় করে প্রণাম শেষ করে মুখ ঘুরিয়ে জিগ্যেস করে, কত?

আগে থেকে অপেক্ষমান দুই খদ্দের কাছে এসে বলে, পাঁচ আউন্স করে লাগাও, বুড়োদা। এত দেরি করলে, যে হাই উঠে গেল মাইরি।

দোকানের ভেতরের দিকে দেওয়ালের গায়েই একটা খুব ছোট জানলা আছে। সেটা ঢাকা থাকে সোডার বোতলে। তার মধ্য দিয়ে হাত গলিয়ে একটা বোতল বের করে আনে বুড়োদা। বোতলটার গায়ে কোনও লেবেল নেই, মুখে একটা শোলার ছিপি আঁটা।

একজন খদ্দের জিগ্যেস করলে, মালটা ভালো তো?

বুড়োদা বলল, কাল তো এই মালই খেলি, খারাপ ছেল? নাকি কালকের কথা সব ভুলে মেরে দিয়েছিস?

প্রথমে একটি গেলাসে সামান্য কয়েক ফোঁটা ঢেলে এক চুমুক মেরে দিল বুড়োদা নিজেই। তারপর গরম স্রোতটি যখন তার বুকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেই অবস্থায় অনুভব করে সে হৃষ্ট স্বরে বলল, মাল ঠিক আছে!

এবারে খদ্দেরদের দুটি গেলাসে বোতলের বাংলা ঢেলে দিয়ে বুড়োদা জিগ্যেস করলে, সোডা?

সোডা নিলে বুড়োদা নিজেই সোডার বোতল খুলে দেবে। আর কোনও খদ্দের যদি শুধু জল মেশাতে চায় তাহলে তাকেই বালতি থেকে জল নিয়ে নিতে হবে। দু-চারজন স্পেশাল খদ্দেরের জন্য অবশ্য আলাদা খাতির আছে।

—এক প্যাকেট সিগারেট দাও, বুড়োদা। তুমি ঠিক ধরেছ, কাল রাত্তিরের অনেক কথা ভুলে মেরে দিয়েছি। কিছু ঝনঝাট হয়েছিল?

সিগারেট প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বুড়োদা বলল, নটাকা পঁচিশ দে। তুই আজকাল বড় ঝনঝোটিয়া হচ্ছিস নিতাই। কাল তুই ভদ্দরলোকের পেছনে লেগেছিলি কেন র‍্যা?

—কোন ভদ্দরলোক, বুড়োদা?

নিতাই এর সঙ্গী বলল, ওই যে রে, প্যান্ট-কোট পরে আসে!

নিতাই বললে, দাঁড়া বাবা, আর-একটু খাই। নেশাটা জমুক, তারপর যদি মনে পড়ে।

সামনেই মস্ত বড় রাস্তা, সেখান দিয়ে অনবরত দোতলা বাস, একতলা বাস, মিনি বাস, ট্যাক্সিতে হাজার-হাজার লোক যাচ্ছে, এ ছাড়া আছে রিকশা। এইসব যাত্রীরা অনেকেই এখান দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার একটা দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায়। কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। এখানে যে রোমাঞ্চকর পল্লিটি আছে তার প্রায় সব বাড়ির জানলাই সন্ধের পর থেকে বন্ধ থাকে। অথচ ভেতরে আলো জ্বলে।

পরশু এ-পাড়ায় একটা মার্ডার হয়েছে। হ্যাঁ, মার্ডারই, কেন না এ-পাড়ায় কেউ খুন বলে না। সচরাচর। সন্ধ্যারানির ফ্ল্যাট, যে বাড়িতে সন্ধ্যারানি নামে কেউ থাকে না, কেন যে বাড়িটির ওই নাম তা এখন অনেকেই জানে না—সেই বাড়িতে ছবিরানির ঘরে দুই ফ্রেন্ড এসেছিল। এদের মধ্যে একজন বাঁধা, আর-একজন নতুন, দুজনেই আগে থেকে টেনে এসেছিল অনেকটা, আবার সঙ্গে রামের বোতলও এনেছিল। ওরা দুজনেই হোল নাইট থাকতে চায়, ছবিরানি কিছুতেই রাজি নয়, এ-বাড়িতে সেরকম রেওয়াজ নেই। হোলনাইটের বাবু শুধু একজনই হতে পারে। দুজনের। মধ্যে কে থাকবে তা ওরা বুঝে নিক। তাই নিয়ে গোলমাল, ঝগড়া, হঠাৎ একসময় নতুন বাবুটি বাঁধা বাবুর পেটে ছুরি বসিয়ে দিল, তারপর সেই সেই রক্তাক্ত ছুরি নাচাতে-নাচাতেই ছুটে গেল বাড়ির বাইরে।

তাই নিয়ে বেশ সরগরম হয়েছিল পরশু রাতে। চার-পাঁচজন দালাল আর নোকর অনেকখানি। তাড়া করে গিয়েছিল সেই ছুরিওয়ালাকে। সে নাকি তার ফ্রেন্ডকে শুধু মার্ডার করেনি, তার পকেটের টাকাপয়সাও সব হাতিয়ে নিয়ে গেছে। ছুরিওয়ালা শেষপর্যন্ত ধরা পড়েনি অবশ্য, কিন্তু একটু বাদে পুলিশের গাড়ি এসে ছবিরানি আর সেই দালাল-নোকর কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। ভোরের আগেই তারা ফিরে এসেছে।

আজ সন্ধেবেলা সেই ঘটনার সামান্য রেশও নেই এখানে। স্বাভাবিকভাবে লোকজন যাচ্ছে, আসছে, ট্যাক্সি এসে থামছে ঘনঘন। এখানে কেউ পুরোনো কথা মনে রাখে না। মাসে একটা দুটো খুন তো হবেই। কলকাতার কোন পাড়াতে সেরকম খুন না হয়?

নিতাইয়ের মতন আর দু-চারজন যারা সন্ধে হতে-না-হতেই বুড়োদার দোকানের সামনে এসে ভিড় জমায় ওরা এ-পাড়ার বাবুও নয়, দালালও নয়, এমনিই এখানে ঘুরঘুর করে। একটা কিছু জীবিকা আছে নিশ্চয়ই, নইলে প্রত্যেক সন্ধেবেলা মাল খাওয়ার পয়সা পায় কোথায়? বুড়োর কাছে ধারে কারবার নেই।

নিতাই-এর সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন জুটেছিল, এর মধ্যে চারবার পাঁচ আউন্স করে খাওয়া হয়ে গেছে। এই সময় কথাবার্তাগুলো জোরে-জোরে হয়, হাসি শুরু হলে আর থামতেই চায় না। বালু আর তার দলটা এসে দাঁড়াতেই ওরা চুপ করে গেল।

বাল্লু ছফুটের বেশি লম্বা, কিন্তু তার সঙ্গী দুজন বেঁটে। ওরা সব সময় বাল্লুর দুপাশে দাঁড়ায় বলেই বাল্লুকে আরও ঢ্যাঙা দেখায়। বাল্লু পরে পায়ের সঙ্গে সাঁটা কালো রঙের প্যান্ট আর একটা কালো টি-শার্ট। তার কপাল অনেকখানি চওড়া, অর্থাৎ সামনের দিকে টাক। বাল্লুর মুখখানা অবিকল বুল ডগের মতন। অনেকেই জানে বাল্লু এ-পর্যন্ত তিনটে মার্ডার করেছে, অথচ জেল খেটেছে মাত্র দুবছর। বাল্লুকে সবাই সমীহ করে এখানে।

বাল্লুর কায়দাই আলাদা। দোকানের কাউন্টারে দু-হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ইচ্ছাকৃত কর্কশ স্বরে বলে, একটা বোতল লাগাও বুড়োদা।

তিনটে গেলাস নিয়ে সে তার সঙ্গীদের জন্যে অল্প-অল্প ঢালে, নিজের গেলাসটা একেবারে ভরতি করে নেয়। সে জল বা সোডা মেশাবার ধার ধারে না। নিজের গেলাসটা তুলে সে প্রথমে কপালে ঠেকায়, তারপর বলে, লে!

এক চুমুকে সে তার গেলাস সাবাড় করে দেয়।

বুড়োদা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসে। বাল্লু গেলাস নামাবার পর জিগ্যেস করে, কীরকম টেস পেলি, মালটার জোর আছে না?

গলা খাকারি দিয়ে বাল্লু বলল, চলবে। আর-একটা লাগাও!

দশ মিনিটে দুবোতল শেষ করে বাল্লু তার দুই সঙ্গীর কাঁধে চাপড় মেরে বলে, চল।

পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, বাকিটা জমা রেখে দিও!

তারপর সদলবলে সে চলে যায় ভেতরের দিকে।

শুধু যে নিতাই বা বাল্লুর মতন খদ্দেররাই আসে এখানে তা নয়। ছুটকো ছাটকা নেশাডুরা আসে। যেসব বাবুরা এ-পাড়ায় বসতে আসে, তারা সাধারণত মেয়েদের ঘরে বসে বিলিতি খায়। বাইরে বেরুবার সময় তারা এদিক-ওদিক চেয়ে সুট করে কেটে পড়ে, বুড়োর দোকানের সামনে দাঁড়ায় না।

বাবু শ্রেণির লোকও দু-চারজন আসে। যারা ধরমতলা অঞ্চলের বারগুলোতে মাল খায়, তারা কেউ-কেউ বাড়ি ফেরার পথে এখানে একবার থামে। তারা আধা মাতাল হয়েই আসে, তবু আর একটু না খেলে চলে না। কারুর-কারুর আবার বিলিতি খাবার পরও খানিকটা বাংলা না প্যাঁদালে মনে ফুর্তি আসে না ঠিক।

নিতাইয়ের সঙ্গী নিতাইয়ের পাঁজরে একটা কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলল, ওই দ্যাখ, আজ আবার এয়েছে।

ট্যাক্সি থেকে নামল তিনটি বাবু শ্রেণির ছোকরা। একজনের শরীরে পুরোপুরি স্যুট-টাই, অন্য দুজনেরও ফিটফাট পোশাক। তিনজনেই অল্প-অল্প টলছে।

স্যুট-টাই কাউন্টারের ওপর তার পোর্ট ফোলিওটা রেখে বলল, কেমন আছ, বুড়োদা? একটু বিষ দেবে?

বুড়োদা হেসে বলল, আবনাদের জন্যে তো রেডি করে রেখিছি। স্যাম্পেলের মাল আছে।

সব বোতলগুলোতেই চোলাই, তবু কেন যেন স্যাম্পেলের বোতল শুনলেই সবাই মনে করে সে জিনিসটা উৎকৃষ্ট।

স্যুট-টাই-এর দুই সঙ্গীর মধ্যে একজনের ঝাঁকড়া চুল, অন্যজনের সরু দাড়ি। তিনজনেরই বয়েস তিরিশের এদিক-ওদিক। বেশ ফুর্তিবাজ ধরনের। টাইবাবুটি কোনও অফিসে বড় কাজ করে, অন্য দুজনও এলেবেলে নয়। সার্থকতার পথ তাদের চরিত্রে এক ধরনের ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে। তবু সার্থকতার প্রতি খানিকটা বিদ্রোহ দেখাতেই বোধহয় এরা এই বে-আইনি, অতি সস্তার মদের দোকানটাতে আসে।

টাইবাবু কাউন্টারের ওপরে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে। একটা বোতল কিনে তিন বন্ধু ভাগ করে নেওয়ার পর ঝাঁকড়া চুল বলে, বুড়োদা, তুমি একটু খাও। কই, তোমার গেলাস কোথায়?

প্রত্যেকটি নতুন বোতল ভাঙবার সময় বুড়োদা নিজে আগে কয়েক ফোঁটা চেখে দেখে জিনিসটা ঠিক আছে কি না। এই করতে-করতেই শেষের দিকে তার নেশা হয়ে যায়। নেশাটি টইটুম্বুর হলেই বুড়োদা তখন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়।

বুড়োদা বলল, নিচ্ছি, নিচ্ছি, আবনারা আগে খান।

টাইবাবু বলল, না, ও-কথা শুনছি না, তুমি গেলাসে না ঢাললে আমরা চিয়ার্স করতে পারছি না! সরু-দাড়ি অবশ্য আগেই নিজের গেলাসটা এক চুমুকে শেষ করে ফেলেছে। তার ধৈর্য কম! গেলাসটা ঠক করে নামিয়ে রেখে সরু দাড়ি বলল, এসে গেছে!

একটা ব্ল্যাক মারিয়া এসে থেমেছে রাস্তার ওপাশে। পুলিশ এলে একটু সম্ভ্রমের ভান দেখাতেই হয়। সবাই গেলাস নামিয়ে রাখে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে যারা খাচ্ছিল, তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায়। পাশেই একটা শাল রিপেয়ারিং শপ, সেটা এসময় বন্ধ থাকে অবশ্য। তার সামনের রকটা

অন্ধকার, সেখানে কেউ-কেউ উঠে দাঁড়ায়।

পুলিশের গাড়িটা চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছে, তার থেকে নামছে না কেউ। বুড়োদা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকে।

টাইবাবু বলল, কী ব্যাপার, বুড়োদা, ব্যাটারা ঘাপটি মেরে রইল কেন? তুমি কি এ-মাসের পার্বনী দাওনি নাকি?

বুড়োদা বলল, হ্যাঁ, দিইচি। মাস পালাতেই পাওনাদারের মতন এসে-এসে হাত পাতে যে!

—তবু ওদের মাঝে-মাঝে কোটা ফুলফিল করতে হয়। কয়েক জনকে এ-পাড়া থেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়ে রেকর্ড ঠিক রাখে। আজ বোধহয় কয়েকটাকে ধরবে।

—আপনারা চুম মেরে বসে থাকুন তো! পয়সা দিইচি, অমনি যখন-তখন এসে ধরলেই হল! বাপের জম্মো থেকে দেখচি শালাদের!

—তুমি চিন্তা কোরো না, বুড়োদা, আমার এই যে দুই বন্ধুকে দেখছ, এরা খুব ভালো পুলিশ ট্যাকল করতে পারে!

বুড়োদা কী বুঝল কে জানে, বলল, সে আমি জানি! এক শালা নতুন ইনসপেকটর এয়েছে, ভারি টেটিয়া। নতুন তো, এখনও বিষ দাঁত ভাঙেনি!

পুলিশের গাড়িটা ইউ-টার্ন নিয়ে চলে এল এদিকের ফুটপাথে। নিতাই আর অন্য যারা ছিল সবাই পোঁ-পোঁ দৌড় দিল তাই দেখে। শুধু এই তিন বন্ধু জায়গা ছেড়ে নড়ল না।

গাড়ি থেকে নেমে এল একজন তরুণ ইনসপেকটর। বুড়োদার দোকানের থেকে হাতপাঁচেক দূরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।

সরু দাড়ি গান শুরু করল গুণগুণ করে। ঝাঁকড়া-চুল বেপরোয়া ভঙ্গিতে আর অর্ধসমাপ্ত গেলাসটা চুমুক দিল পুলিশটির সামনেই। টাইবাবু হাঁটু দোলাতে লাগল।

ইনসপেকটরটি অত্যন্ত মিহি সুরে অ-পুলিশ গলায় ঝাঁকড়া চুলকে জিগ্যেস করল, আপনি তো অমুক বাবু, না?

ঝাঁকড়া চুল গম্ভীর গলায় বলল, নাঃ। আপনার ভুল হয়েছে, অনেকেই ভুল করে। বোধহয় চেহারাটা একরকম!

সরু-দাড়ির দিকে তাকিয়ে ইনসপেকটরটি বলল, উনি তো পোয়েট্রি লেখেন, ওঁকে আমি দেখেছি আগে।

সরু-দাড়ি বলল, আমি বাপের জন্মে এক লাইন পোয়েট্রি লিখিনি! পোয়েট্রি, হেঃ।

টাইবাবু আপন মনে বলল, আমরা নিরিবিলিতে বসে একটু মাল খাচ্ছি, কারুর তো কোনও ক্ষতি করিনি। কেন যে লোকে তবু এখানে ঝুট-ঝামেলা করতে আসে।

ইনসপেকটরটি এবারে আর-একটু এগিয়ে এসে বলল, দেখি এক প্যাকেট ক্যাপস্টেন।

বুড়োদা বলল, ক্যাপোস্টান নেই!

—নেই। রেড অ্যান্ড হোয়াইট দিন তাহলে?

—তাও নেই।

—তাও নেই? ওই যে সব প্যাকেট রয়েছে দেখছি?

—ওগুলো সব খালি। শুধু চার্মিনার আছে।

ইনসপেকটর এবারে ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।

টাইবাবু বলল, আহারে, বেচারার বোধহয় গল্প করার ইচ্ছে করছিল একটুখানি! সারা সন্ধে। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

সরু-দাড়ি বলল, বোধহয় মাল খেতে চাইছিল।

টাইবাবু চেঁচিয়ে ডাকল, ও দাদা, শুনুন, শুনুন!

পুলিশের গাড়িটা ততক্ষণে আবার চলতে শুরু করেছে, টাই-বাবু খুব মজা পেয়ে বলতে লাগল, পুলিশের গাড়ি থামিয়ে এখান থেকে সিগারেট কিনতে এসেছিল, হে—হে–হে।

অন্য দুই বন্ধুও হাসতে লাগল খুব।

বুড়োদা বলল, না। পরশুদিন একটা মার্ডার হয়ে গ্যাচে তো, সেইজন্য একটু লোক-দ্যাখানো ঘনঘন আসছে।

ঝাঁকড়া চুল অতিরিক্ত কৌতূহলের সঙ্গে বলল, খুন! কে কাকে করল?

বুড়োদা এমন একটা ভঙ্গিতে কে জানে! বলল, যেন এসব পোকামাকড় আরশোলার ব্যাপার!

টাইবাবু বুড়োদার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, বুড়োদা, তোমার কাছ থেকে কোনও গল্প আদায় করার উপায় নেই। তুমি সব এককথায় উড়িয়ে দাও!

বুড়োদা বলল, আমি ওসব কী জানি। রুজি-রোজগারের ধাক্কাতেই সারাটা জীবন কেটে গেল!

—মাসে তোমার কত হয় বুড়োদা?

—তিনশো, সাড়ে তিনশো বড়জোর। শীতকালে একটু কমে যায়।

—মোটে?

—আর কত হবে? পুলিশ শালাদেরই তো দিতে হয় অনেক।

—এত রকম ঝকমারি। পুলিশকে সামলানো, তারপর দু-একজন পয়সা না দিয়ে পালায়, কালকেই তো দেখলুম একজনকে তাড়া করে গেলে…এত করেও মোটে তিনশো সাড়ে তিনশো?

—কী করব দাদা! আর তো কোনও কারবার শিখিনি! আমার বাপেরও এই কারবার ছেল, আমিও সেটাই চালাচ্ছি।

–তোমরা তাহলে এ পাড়ায় অনেক দিনের—দু-পুরুষ।

—কোনওদিন পাড়ার ভেতরে যাইনি, মাগিগুলোর একটাকেও চিনি না। এই যে ডান দিকের রাস্তাটা দেখছেন, এটা হল এ-পাড়ায় ঢোকবার গেট। আমি বসে থাকি গেটের বাইরে!

ঝাঁকড়া-চুল জিগ্যেস করল, বুড়োদা, তুমি মল্লিকাকেও চিনতে না! বুড়োদা বলল, নাম শুনিচি। নাম তো অনেকেরই শুনি, লোকে এখানে ডাঁড়িয়ে কত রকম কথাই বলে, সব শুনি। মল্লিকা নামের মাগিটা তো হাওয়া হয়ে গ্যাচে।

এ আলোচনা আর বেশিদূর এগোতে পারল না, খদ্দেররা আবার ফিরে এসেছে। এখন রাত সাড়ে নটা। এই সময়টাতেই খদ্দেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়। এরকম চলতে থাকে এগারোটা পর্যন্ত। বালতির জল ফুরিয়ে গেছে, এখন খদ্দেররা নিজেরাই টিউবওয়েল থেকে জল নিতে শুরু করেছে।

দুজন বেঁটে সঙ্গীকে নিয়ে বাল্লু ফিরে এসেছে আবার। এটাই বাল্লুর স্বভাব। সে এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না, ঘুরে-ঘুরে আসে। পাড়ার মধ্যে টহল দিয়ে সে কোনও-কোনও মেয়ের ঘর থেকে ভোলা তুলে আনে। বাল্লু কারুর কারুর কাছে খুনি বলে পরিচিত হলেও সে আসলে এ-পাড়ার শান্তি রক্ষক। পুলিশের চেয়ে সে এই কাজে অনেক বেশি দক্ষ। এ-পাড়ায় ছিনতাই কিংবা গুণ্ডামি হলে পাড়ার বদনাম হয়ে যাবে, খদ্দের কম আসবে, সকলেরই রোজগার কমে যাবে, সেইজন্য এ পাড়ায় নিরাপত্তার সুনাম রক্ষা করায় সকলেরই স্বার্থ আছে।

বাল্লু এসে বলল, শুনলুম মামার গাড়ি এসেছিল, বুড়োদা? কিছু চায়?

বুড়োদা বলল, কী আবার চাইবে, সিগ্রেট চাইল। আমিও তেমনি বলে দিলুম, নেই! হ্যারে বাল্লু, কেষ্ট যে কাল আমার একটা পাইটের দাম না দিয়ে পালাল, সেজন্য তুই কিছু করবিনি। আমার। পয়সাটা মারা যাবে?

বাল্লু বলল, যাবে কোথায়? এই ঠেকে তাকে আসতেই হবে। আমি তখন ওকে নাকখদ দেওয়াব!

টাইবাবু বাক্কুকে আগে কখনও দেখেনি। সে তারিফ করা চোখে বলল, বাঃ, দাদার চেহারাখানা।

তো দারুণ! দাদা সিনেমায় নামেন নাকি?

এসব অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না বাল্লু। সে গেলাসে মাল ঢালে।

এরপর নিছক মজার ঝোঁকেই টাই-বাবু একটা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড করে ফেলল। সে দু-হাতে বাল্লুর ডান হাতের মাসল পরীক্ষা করাবার জন্য চেপে ধরে বলল, বাপরে! দাদার ডানাখানা দেখছি আমার পায়ের দাবনার চেয়েও মোটা!

বাল্লু সঙ্গে-সঙ্গে এমন জোরে ধাককা দিল সে টাইবাবু অনেকগুলে গেলাস, সোডার বোতলের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঝাঁকড়া-চুল আর সুরু-দাড়ির দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে তার সঙ্গী দুজন, একজনের হাতে ছুরি।

এসব লাইনে কারুর গায়ে কেউ অযথা হাত ছোঁয়ায় না। কার কী মতলব তা তো বলা যায় না। ওই টাইবাবু বাল্লুর এক হাত চেপে ধরেছিল, সেই সুযোগে যদি অন্য কেউ পেছন থেকে তার ওপর চাকু চালিয়ে দিত?

বুড়োদা বলে উঠল, আরে কি করছিস, বাল্লু! আমার গেলাস-টেলাস সব ভাঙবি? এনারা

ভদ্দরলোক, একটু ইয়ার্কি মারতে গেছে তাও বুঝিস না?

বাল্লুর বেঁটে সঙ্গীর মাথায় এক চাপড় মেরে বুড়োদা আবার বলল, এই গুলু, ওসব ছোরা-ছুরির কারবার আমার এখানে চালাবি না। ইচ্ছে হয়তো গলির ভেতরে যা!

টাইবাবু আবার উঠে বসে হতভম্ব হয়ে বলল, কী ব্যাপার, দাদা হঠাৎ এত খেপচুরিয়াস হয়ে গেলেন কেন, অ্যাঁ? বাল্লু এর মধ্যে অন্য দুই বন্ধুকে ভালো করে দেখে নিয়েছে। সে মানুষ চেনে। এরা নিরীহ, উড়তে শেখা ভদ্দরলোকের ছেলে। সে টাইবাবুকে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ঝাঁকড়া-চুল আর সরু-দাড়ি ছাড়বে না। তারা ঘন হয়ে এসে বলল, আপনি ওকে ঠেলা মারলেন কেন?

বাল্লু বলল, বলছি তো ঠিক আছে। যখুন-তখুন কারও গায়ে হাত দিতে নেই। মাল খেতে এসেছেন, মাল খান, বাড়ি যান।

টাইবাবু বলল, মাল তো খাবই, তা বলে মারও খেতে হবে নাকি? আপনার হাতে মার খেলে যে ছাতু হয়ে যাব! ছিঃ, অত জোরে ধাককা দেয়? যদি মাথা ফেটে রক্ত বেরুত, তাহলে বাড়িতে মা

কী বলত?

টাইবাবুর কথা শুনে সবাই না হেসে পারে না। মা কথাটা এখানে সবার কানে নতুন লাগে। টাই বাবু রাগ করে না কক্ষনো, এমনকি বাল্লুর হাতে ধাক্কা খেয়েও রাগেনি।

অনতি বিলম্বে বাল্লুর দলটার সঙ্গে তাদের ভাব হয়ে যায়।

বুড়োদা টাইবাবুকে বলল, ওই যে আবনি মল্লিকার কথা জিগ্যেস কচ্ছিলেন, এই বাল্লুকে বলুন, ও জানে!

বাল্লু একটি ভুরু তুলে বলল, কোন মল্লিকা?

—ওই যে রে, পাঁজ নম্বর বাড়ির। কে যেন বলছেলো, সে নাকি হাওয়া হয়ে গ্যাচে।

টাই-বাবু বলল, মল্লিকা মেয়েটি বেশ ভালো ছিল। বেঁটে খাটো, ফরসা রং, অল্প একটু গোঁফ। আছে। আমরা ওর ঘরে মাঝে-মাঝে মাল খেতে যেতুম, বুঝলেন! গত হপ্তায় একদিন গিয়ে দেখি, ওর ঘরের দরজা খোলা, বিছানা পত্তর, আলমারি-টারি যেখানে যেমনটি ছিল, সবই আছে কিন্তু

মল্লিকা নেই। ওর পাশের ঘরের মেয়েটি বলল, কী যেন তার নাম?

ঝাঁকড়া-চুল বলল, উষা!

—হ্যাঁ, ঊষা। সেই ঊষা বলল, মল্লিকা নাকি তিনদিন ধরে ফেরেনি। কোথায় গেছে, কেউ জানে। পরের দিন আবার গিয়ে দেখলুম, সেই একই কেস, মল্লিকার পাত্তা নেই! কী ব্যাপার, কোথায় গেল মেয়েটা?

বাল্লু বলল, হ্যাঁ, মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

ঝাঁকড়া-চুল বলল, এ-পাড়ার কোনও-কোনও মেয়ে তো ইচ্ছে করলে লাইন ছেড়ে চলে যেতেও পারে, নাকি পারে না?

বাল্লুর এক বেঁটে সঙ্গী বলল, চলে যায় কেউ-কেউ! কোনও বাঁধা বাবুর সঙ্গে অন্য পাড়ায় ঘর নেয়। সিঁদুর পরে।

–যাওয়ার সময় নিজের জিনিসপত্তর নিয়ে যাবে না?

—তা যায়। তবে খাট-আলমারি ওসব ওদের নিজেদের তো নয়, সব ভাড়া!

—মল্লিকার ঘরে যে রেডিও, ঘড়ি রয়েছে? সে সবও ওর নিজের নয়?

বাল্লু বলল, ও-মেয়েটা সেরকম ভাবে যায়নি। একজন নাকি ওকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকেই হাপিস!

টাইবাবু অভিযোগের সুরে বলল, অমন একটা চমৎকার মেয়ে এমনি-এমনি হাওয়া হয়ে গেল? তোমরা কেউ কিছু করতে পারলে না? তুমি দাদা তাহলে কীসের মাস্তান? সিনেমার হিরোর মতো চেহারা করে রেখেছ!

বাল্লু বলল, লাশটা কোথায় গায়েব করল, তাই ভাবছি। লাশটা পাওয়া গেলে কাদের কাজ তা বুঝতে পারা যেত!

টাইবাবু বলল, খবরদার, লাশের কথা বলবে না! মল্লিকা বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। এমন হাসিখুশি মেয়ে, সে কখনও মরতে পারে? কে তাকে শুধু-শুধু মারবে? দুনিয়াটা কি এত খারাপ হয়ে গেছে?

টাইবাবু কাউন্টার থেকে নামল। তার হিসি পেয়েছে। সে কাজটা সারতে হয় পাশের সরু গলিতে। তিন বন্ধুই গেল সেখানে, কিন্তু টাই-বাবু সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পেরে অতি কষ্টে দেওয়াল ধরে সামলাল নিজেকে।

ঝাঁকড়া-চুল বলল, এবারে বাড়ি যেতে হবে!

সরু-দাড়ি বলল, আর একটু খাব না?

টাইবাবু একবার এলিয়ে গেলে আর দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকে না, ঝাঁকড়া-চুল তার কাঁধ ধরে থেকে ট্যাক্সির দিকে হাতছানি দিতে লাগল। সরু-দাড়ি এরই মধ্যে টুক করে খেয়ে এল আরও পাঁচ আউন্স।

বুড়োর দোকানের খদ্দেরের ভিড় রইল আরও ঘন্টাখানেক। এর মধ্যে একটা ছোট মারামারিও হয়ে গেল কিছু নতুন ও পুরোনো খদ্দেরদের মধ্যে। নতুনদের এই জায়গাটায় খাপ খাওয়াতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে। একেবারে নতুন কেউ একলা এলে বুড়োদা তাকে মাল দেয় না। সঙ্গে পুরোনো কেউ থাকা চাই। কারণ বুড়োদা জানে, নতুন কোনও কাঁচা মাথা পেলে নিতাইয়ের মতন পুরোনো ঝানু কেউ-কেউ তাকে ইচ্ছে করে বেশি খাইয়ে আউট করে দেবে, তারপর তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে সাফ করে দেবে পকেটের সবকিছু। ঘড়ি আংটি তো যাবেই। বুড়ো এসব পছন্দ করে না।

এখানে ঝগড়া হলে বুড়োই থামায়। বুড়ো কাউন্টার থেকে নামে না, ওখানে বসেই চেঁচিয়ে বলে, এই, এক থাবড়া মারব! আমি নাবলে ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি! আমি ঝোনঝাট পছন্দ করি না। শান্তিতে মাল খাবি তো খা, নইলে ভাগ।

বারোটার সময় ভিড় একেবারে পাতলা। বাল্লু আবার এসেছে শেষবারের মতো। এবার সে একা, তার বেঁটে সঙ্গীরা নেই। নিতাইও ঘুরে এসেছে। নিতাইয়েরই চোখে পড়ল জিনিসটা!

—বুড়োদা, ওই চামড়ার মোটা ব্যাগটা! আরিঃ শাবাশ!

কাউন্টারের ঠিক নীচে, ফুটপাথে পড়ে আছে সেই চৌকো ব্যাগটা, বড়-বড় অফিসাররা যেরকম ব্যাগ নিয়ে অফিসে যায়। এটা টাই-বাবুর, ভুল করে ফেলে গেছে।

বুড়োদা বলল, এইরে। দে, দে!

নিতাই সেটা তুলল, বাল্লু তার হাত থেকে নিয়ে সেটা বুড়োদার হাতে দিল।

চাবি দেওয়া নেই, বোতাম টিপতেই খুলে গেল ব্যাগটা। তার মধ্যে অনেক কাগজপত্তর, এক তাড়া টাকা আর এক গোছা চাবি!

বেশ জোরে শিস দিয়ে উঠল বাল্লু। লোভে চোখ চকচক করছে নিতাইয়ের। বুড়োদা বলল, এ যে দেখছি অনেক টাকা।

বুড়োদা গুনল। সবই একশো টাকার নোট, চার হাজার সাতশো!

বাল্লু গম্ভীরভাবে বলল, তিন ভাগ হবে!

ঘৃণার দৃষ্টিতে বাল্লুর দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাগটা কিন্তু আমি আগে দেখিচি!

বুড়োদা ব্যাগটা নিজের কোলের কাছে তুলে নিয়ে বলল, শালা, শেয়ালের মতন অমনি ভাগাভাগি শুরু করে দিইচিস! এ তো টাই-বাবুর ব্যাগ, তাকে ফেরত দিতে হবে।

নিতাই যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখ কপালে তুলে বলল, ফেরত দিতে হবে? তুমি কী বলচ বুড়োদা?

—বাঃ, ফেরত দিতে হবে না? ভদ্দরলোক ভুল করে ফেলে গ্যাচে। অফিসের চাবি-টাবি রয়েছে, অফিসের টাকা। একদিন এখেনে বসে বলছেল, ওকে রোজ আগে গিয়ে অফিস খুলতে হয়!

বাল্লু বলল, তোমার কাছে ব্যাগটা জমা রেখেছেল?

—না, তা রাখেনি। আমি তো দেখিইনি অ্যাতক্ষণ!

—তবে? তোমার আর কোনও দায়িত্ব নেই। মনে করো, যদি লোকটা ট্যাক্সিতে ব্যাগটা ফেলে যেত, তাহলে আর কোনওদিন পেত?

—তুই কি বলছিস রে বাল্লু? মনে কর, তোর পকেট থেকে একটা একশো টাকার পাত্তি এমনি পড়ে গেল, তুই টের পেলিনি, অমনি আমি সেটা মেরে দোব? অ্যাঁ? আমরা কি শ্যাল-কুকুর?

বাল্লু আর নিতাই দুজনেই চেয়ে রইল বুড়োর মুখের দিকে। ওরা বুড়োর এই ভালোমানুষি রোগের কথা জানে। কেউ খুচরো পয়সা ফেরত নিতে ভুলে গেলে বুড়ো পরের দিন সে পয়সা ঠিক দিয়ে দেয়!

নিতাই তবু তেড়িয়ার মতন বলল, আমি ফাস্টে দেখিছি, ও ব্যাগ আমার। তুমি কেন চোপা

চালাচ্ছ, বুড়োদা?

বাল্লু কটকট করে তাকাতেই নিতাই আবার বলল, আমি তো বলিচি তিন ভাগ হবে, সমান-সমান!

বাল্লু বলল, দাও, বুড়োদা আমি ভাগ করে দিচ্ছি।

বুড়োদা হেসে বলল, কী বলছিস পাগলের মতো কতা। পরের জিনিস এভাবে নেওয়া যায়? এ কি লটারির মাল? ভদ্রলোকের কত বিপদ হবে, অফিসের চাবি-টাবি রয়েছে।

—সে চাবি তুমি ফেরত দাও গে, টাকাটা আমাদের চাই।

–তোরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবি? নে দিখিনি?

বাল্লু ইচ্ছে হলে শুধু বাঁ-হাত দিয়েই বুড়োর গলাটা মুচড়ে দিতে পারে। কিন্তু বুড়োর সততার কাছে সে অসহায়। হাত বাড়াতে সাহস করছে না।

নিতাই কাকুতিমিনতি করে বলল, বড্ড টানাটানি যাচ্ছে, বুড়োদা! ওরা বড়লোক, ওই টাকা গেলে ওদের কিছু যাবে আসবে না। ওদের ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে!

বুড়োদা বলল, হাত খালি থাকে তো মাগির দালালি করগে যা! নেয্য ভাবে রোজগার কর। অন্যের টাকা চুরি করবি কেন হারামজাদা!

—চুরি কোথায়? একজন ভুল করে রাস্তায় ফেলে গেছে। তার গুনাগার দিতে হবে না?

—চোপ!

বাল্লু বলল, কাজটা তুমি ঠিক করে না, বুড়োদা। বুড়ো বলল, তোের মুরোদ থাকে তুই কেড়ে নে না আমার ঠেঙে! দেখব, তারপর তুই কী করে এ পাড়ায় টিকি!

ধ্যাৎ তেরিকা, বলে বিরক্ত হয়ে বাল্লু হনহন করে হেঁটে চলে গেল। তার মুখে একটা অসহায় ভাব। চোখের সামনে অতগুলো ফালতু টাকা, তবু সে কিছুই করতে পারবে না। কীসের যে বাধা, সেটাই সে বুঝতে পারে না।

বুড়ো কাউন্টার থেকে নেমে ঝাঁপ বন্ধ করতে লাগল। নিতাই তার পা জড়িয়ে ধরে বলল, বুড়োদা, তোমার পায়ে ধরছি, তুমি অত সাধুপুরুষ হয়ো না। একটুনীচে নামো। এ টাকাটা নিলে কোনও দোষ নেই! সবটা না নিয়ে, অন্তত কিছুটা দাও।

—দ্যাখ নেতাই, এবার মারব তোর মুখে লাথ। যা ভাগ? ব্যাগটা আজ রাত্তিরেই ফেরত দেওয়ার দরকার। কাল সকালে ঘুম ভেঙে যখন মনে পড়বে ব্যাগ নেই, তখন লোকটার মনটা কীরকম। হবে? এতসব দরকারি কাগজ পত্তর, চাবি…আমার দোকান তো সকালে খোলা থাকে না, খোঁজ করতে এলেও পাবে না।

—ভদ্দরলোক কোথায় থাকে তুমি জানবে কী করে।

—সে আমি বার করব! ওদের কথাবার্তা সব শুনি তো! শ্যামবাজার মোড় থেকে রোজ রিকশা নেয়। তারপর দেশবন্ধু পার্কের দিকে যায়। শ্যামবাজার মোড়ে রিকশাওয়ালাদের জিগ্যেস করলই বলে দেবে। ওরা বেশি রাতের খদ্দেরদের চেনে!

—এত রাতে গিয়ে তুমি তাকে ডাকবে? তুমি তো তার নামও জানো না!

—জানি! ওর বন্ধুরা ওকে ধুজ্জোটি বলে ডাকে।

নিতাই অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে রইল। এক-একবার তাই ইচ্ছে করছিল, বুড়োদার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে ছুট দিতে। কিন্তু সে মনে-মনে জানে, তাহলে আর জীবনে কখনও এ-পাড়ায় ফিরে আসতে পারবে না। বাল্লু কিংবা তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা অন্য কোথাও তাকে দেখতে পেলেই ঠ্যাঙাবে। বুড়োদা ভালোমানুষ বলেই তার গায়ে এ-পাড়ায় কেউ হাত তোলে না। এটাই এখানকার অলিখিত নিয়ম। বুড়োদা যদি একদিনও কোনও লোককে একটুঠকাত, অমনি হয়তো তার পরের দিনই তার দোকান লুঠ হয়ে যেত!

হঠাৎ বুড়োদার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বলে উঠল, তুমি এরকম কেন গো, বুড়োদা! তুমি আমাদের মতন হও না গো, তাহলে কত সুবিধে হত আমাদের!

বুড়ো বলল, তুই আমার হাত থেকে এটা কেড়ে নিতে পারবি? নে দিকি!

নিতাই অমনি কুঁকড়ে সরে গেল।

বুড়োদা প্রথমে একটা রিকশা নিয়ে এল শ্যামবাজার। সে ঠিকই ধারণা করেছিল, সেখানকার রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে খোঁজ পাওয়া গেল, এক সুট-টাই পরা মাতালবাবু বেশি রাত্রে আর দুজন বন্ধুকে নিয়ে আসে। অনেকেই সে বাবুর বাড়ি চেনে।

রিকশা বদলে দেশবন্ধু পার্কের দিকে চলল বুড়োদা। পার্কের ঠিক গায়েই একটা বাড়ির সামনে এসে থামল রিকশাটা। দরজা বন্ধ, সারা বাড়ি অন্ধকার। নেমে এসে সে বাড়ির বেল বাজাতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল। একবার ওপর দিকে তাকাল, একবার ব্যাগটার দিকে। সমস্ত পাড়াটা সুনসান। বুড়ো দ্বিধা করল দু-এক মুহূর্ত। তারপর ফিরে এসে রিকশায় উঠে বলল, চলরে, দর্জিপাড়ায় যাব!

দোকানের সামনে রাস্তায় তখনও ঝিম মেরে বসে আছে নিতাই। ব্যাগ শুঙ্কু বুড়োদাকে ফিরতে দেখে সে লাফিয়ে উঠল। আনন্দে চকচক করে উঠল চোখ। কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, বাড়ি খুঁজে পাওনি তো! কেল্লা মার দিস। আমি বাল্লুকে কিছু বলব না বুড়োদা। দুজনে ভাগ করেনি।

বুড়োদা রাগে গনগনে গলায় বলল, তোর চোখ গেলে দেব। শালা শকুনি। যা, বাড়ি যা।

পরদিন সকালে, টাই-পরা বাবু তখন টাই-পরা নয়। সে তখন পাজামা ও গেঞ্জি পরা ধূর্জটিবাবু! দরজা খুলে বাইরে থেকে খবরের কাগজ নিতে এসেছে, তখন দেখল, তার অফিস ব্যাগটা বুকে করে বুড়োদা দাঁড়িয়ে আছে।

ধূর্জটিবাবুর চোখে এখনও ঘোর, ব্যাগের কথা তখনও মনে পড়েনি। বুড়োদাকে দেখে যেন ভূত দেখেছে। দিনের আলোয় এইসব লোকদের দেখলে বুক শিরশির করে।বুড়োদা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, বুঝলেন দাদা, কাল রাত্তিরেই এসছিলুম। কিন্তু অত রাতে বাড়ির সব্বাইকে ঘুম থেকে তোলা, কে কী ভাববে, সেইজন্য তখন আর ডাকিনি, কিছু মনে করবেন না…।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments