Thursday, March 28, 2024
Homeবাণী-কথাবটবৃক্ষ - হুমায়ূন আহমেদ

বটবৃক্ষ – হুমায়ূন আহমেদ

বটবৃক্ষ - হুমায়ূন আহমেদ

রাত এগারোটায় গাড়িতে উঠলাম। যাব ময়মনসিংহ। ঢাকা থেকে ১২৭ কিলোমিটার পথ। তিন ঘণ্টার বেশি লাগার কথা না, কিন্তু ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। বুদ্ধিমানের কাজ হবে বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা।

সেই অপেক্ষাটুকু। করতে পারছি না। খবর এসেছে–আমার নানীজানের স্ট্রোক হয়েছে। শরীরের এক অংশ অবশ। মুখের কথা জড়িয়ে গেছে। তিনি আমাকে শেষবারের মত একবার দেখতে চাচ্ছেন। অন্য ভুবনের দিকে যাত্রার আগে আগে সবাই প্রিয়জনদের দেখতে চায়। আমি নানীজানের অতি প্রিয়দের একজন, কারণ তিনি এক অর্থে আমার দুধ-মা। আমার জন্মের পর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাকে লালন করার দায়িত্ব চলে যায়। নানীজানের কাছে। সেই সময় তাঁর নিজের একটি মেয়ে হয়েছে। তিনি তাঁর ডান বুকের দুধ আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বাঁ দিকেরটা তাঁর কন্যার জন্যে। বুকের দুধের কোন আকর্ষণী ক্ষমতা কি আছে? হয়ত আছে। আমি নানীজানের পাশে উপস্থিত হবার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা অনুভব করছি।

নানীজান আমার শৈশবের একটি বড় অংশ দখল করে আছেন। চোখ বন্ধ করলেই নানার বাড়ির সব জায়গায় তাঁকে একসঙ্গে দেখতে পাই। এই দেখছি রান্নাঘরে। পিঠা তৈরি হচ্ছে, তিনি বসেছেন সরঞ্জাম নিয়ে, এই দেখছি উঠোনে, ধান শুকানো হচ্ছে, তিনি এক ফাঁকে এসে কাক তাড়িয়ে গেলেন। এই দেখছি পুকুর ঘাটে। বাচ্চারা সবাই পানিতে নামবে–তিনি তাদের একা ছেড়ে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না, সঙ্গে আছেন।

রাতগুলি তো অপূর্ব! তিনিই তখন সম্রাজ্ঞী। গল্পের আসর বসেছে। তিনি একের পর এক ভূতের গল্প বলে যাচ্ছেন। রক্ত জমাট করা ভয়ংকর কিছু গল্প আমি নানীজানের কাছে শুনেছি। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি খুব সাধারণ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভূতের গল্পগুলি এমনভাবে বলেন যে এসব কিছুই না, সব সময় ঘটছে। পান খেতে খেতে একটু নিচু গলায় গল্প শুরু করবেন। ঘটনাটা কোথায় ঘটল সেই বিষয়ে আগে অনেকক্ষণ ধরে বলেন। তারপর হঠাৎ মূল গল্পে চলে যান–

“কি হল শোন। শীতের রাত, মশারি খাঁটিয়ে শুয়েছি, সঙ্গে আনোয়ারার ছোট মেয়ে। ঘরে একটা হারিকেন জ্বলছে। হঠাৎ দেখি মশারির চারদিকে ছায়ার মত একটা কি যেন ঘুরছে। চরকির মত ঘুরছে। মানুষের ছায়ার মত ছায়া, নাক-মুখ কিছু বুঝা যায় না, তবে চোখ দুটা দেখা যায়–শাদা ছোট ছোট চোখ। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল ছায়াটার দিকে বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলাম–এইটা কি? এইটা কি? ওমি ছায়াটা আমার আঙ্গুলে কামড়ে ধরল। এই দেখ এখনো দাগ আছে।

আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আঙ্গুলের দাগ দেখার জন্যে। তারপর ভয়ে ভয়ে বললাম, জিনিসটা কি ছিল?

নানীজান হাই তুলতে তুলতে বললেন, কি আবার? জ্বীন।

যেন জ্বীন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। সব সময়ই চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে–সুযোগ। পেলেই মানুষের হাত কামড়ে ধরছে।

.

আমার ঝিমুনীর মত এসে গেছে।

গাড়ি চলছে ঘণ্টায় কুড়ি কিলোমিটার বেগে। বৃষ্টি কমার লক্ষণ নেই। বরং বাড়ছে। দমকা হাওয়া দিচ্ছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে গান ছেড়ে দিয়েছি। অলিভিয়া নিউটন জনের লালাবাই–

“Precious baby, sweetly sleep,
Sleep in peace.
Sleep in comfort, slumber deep.
I will rock you, rock you, rock you,
I will rock you, rock you, rock you …”

ঘুমপাড়ানি গান। স্নায়ুকে কেমন অবশ করে দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। গাড়ির ঝাঁকুনি, বৃষ্টির শব্দ, অলিভিয়া নিউটন জনের লালাবাই সব মিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমি ভাবতে চেষ্টা করছি–পঁচাশি বছর বয়েসী আমার বৃদ্ধা নানীজান ঠিক এই মুহূর্তে কি ভাবছেন। অন্য ভুবনের দিকে যাত্রা শুরুর আগে মানুষ কী ভাবে, একজন অল্পবয়সী মানুষ এরকম অবস্থায় তীব্র হতাশায় ভুগবে। সুন্দর পৃথিবীর কিছুই না দেখে তাকে চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু একজন পরিণত বয়সের মানুষ? সে কি ভাববে? তার ভেতরেও কি হতাশা কাজ করবে? না-কি সে ভাববে -”অনেক তো দেখলাম। আর কত! এবার তোমরা আমাকে বিদায় দাও।”

আমার নানীজান আর দশজন বৃদ্ধার মতই সুখ-দুঃখের জীবন কাটিয়েছেন। সুখ দুঃখ দাড়িপাল্লায় মাপা যায় না। মাপা গেলে হয়তবা তাঁর দুঃখের পাল্লাই ভারি হবে। নিজের জীবনে বেশ ক’জন সন্তানের মৃত্যুশোক সইতে হয়েছে। স্বামী হারানোর ব্যথায় জর্জরিত হয়েছেন। আবার এগারোটি সন্তানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছেন। প্রথম জীবনে অভাব দেখেছেন। শেষ জীবনে দেখলেন প্রাচুর্য। পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনি, এবং নাতি-নাতনিদের ছেলেমেয়েতে বটবৃক্ষের মত নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কোন উৎসব উপলক্ষে সবাই যখন জড় হয় তখন মনে হয় হাট বসে গেছে। নানীজান বসে থাকেন জলচৌকিতে, লাইন বেঁধে তাঁকে সালাম করা হয়। বিশাল ডেকচিতে রান্না বসে। পুত্রবধূরা সেই ডেগ তাঁর সামনে এনে বলে, ‘মা, আপনি হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দেন। আমরা রান্না বসাব।’ তিনি এক ধরনের গর্ব এবং অহংকারে পাতিল ছুঁয়ে দেন। শুরু হয় উৎসবের বাড়ির রান্না।

ন’ বছর বয়সে বৌ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। পার করলেন আশি বছর। কত দীর্ঘ সময়! দীর্ঘ সময়ের কত না আনন্দ-বেদনার স্মৃতি! সব স্মৃতি পেছনে ফেলে কি করে তিনি যাত্রা করবেন অচেনা ঠিকানায়? পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কেউ কি থাকবে তাঁর পাশে? তাঁর মৃত স্বামী, তাঁর মৃত পুত্র কন্যারা কি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে থাকবে তাঁর পাশে? না-কি যেমন একা পৃথিবীতে এসেছিলেন, তেমনি ফিরেও যাবেন একা? আমি জানি না। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।

.

রাত তিনটায় ময়মনসিংহ পৌঁছলাম। বাড়ি অন্ধকার। সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। কলিংবেলের শব্দে বাড়ির মানুষ জেগে উঠল। সবার মুখ হাসি-হাসি। রোগী সামলে উঠেছে। ডাক্তাররা বলেছেন, এযাত্রা টিকে গেছেন। যে হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল সেই হাতে সাড় ফিরে এসেছে। কথা বললে খানিকটা বোঝা যায়।

হৈচৈয়ে নানীজান জেগে উঠলেন। মুখ ভর্তি পান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কি কাণ্ড! তিনি আরো সুন্দর হয়েছেন। দুধে-আলতায় গায়ের রঙ এখন কেমন ঝিকমিক করছে। লাল টুকটুকে ঠোঁট, পান খাওয়ায় আরো লাল দেখাচ্ছে। আমি পাশে বসে বললাম, রাত তিনটায় ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আমাকে টেনে এনে এখন দিব্যি আরাম করে সুপারি খাচ্ছেন। কাজটা কি ভাল হল?

নানীজান হাসতে হাসতে বললেন, এই পাগলা বলে কি?

আমি বললাম, আমি যেমন ভিজতে ভিজতে এসেছি–আপনাকেও এখন ভিজতে হবে। আপনাকে এখন কোলে করে ছাদে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজাব। ছাড়াছাড়ি নেই।

নানীজানের হাসি আর থামে না। মনে হচ্ছে আসলেই তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে চান। ডাক্তার তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। চুপচাপ সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। তিনি তাতে রাজি নন। বাড়ির সবাই জেগেছে, তিনি তাদের সঙ্গে নিশি যাপন করবেন। সবাই চা খাচ্ছে, তিনিও চা খাবেন, গল্প করবেন। যদিও কোন গল্প ঠিকমত করতে পারছেন না। খেই হারিয়ে ফেলছেন। এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যাচ্ছেন। একবার আমাকে বললেন, ‘তোর পরীক্ষা কবে রে? পড়াশোনা ঠিকমত করছিস তো?” তাঁর মনেও নেই পরীক্ষার যন্ত্রণা আমি অনেক অনেক আগে শেষ করেছি।

ভোরবেলা ঢাকা রওনা হব। নানীজানকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা নানীজান, আমাকে আপনি একটা কথা বলুন তো। আপনার কাছ থেকে ঠিক জবাবটা চাই।

‘কি জানতে চাস?’

‘মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাই। মৃত্যুভয় সম্পর্কে জানতে চাই। একজন মানুষ যখন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকে তখন তার কেমন লাগে তা জানতে চাই। মৃত্যুর কথা ভাবতে কি আপনার ভয় লাগে?’

নানীজান কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, না, ভয় লাগে না। মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাল লাগে।

‘ঠিক বলছেন তো নানীজান?’

‘ঠিকই বলছি।‘

‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না?’

নানীজান এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হাসলেন। সেই হাসির কি অর্থ কে জানে।

.

ঢাকায় ফিরে চলেছি। সুন্দর সকাল। ঝকঝকে রোদ। গাড়ি ছুটে চলেছে ঝড়ের গতিতে। অলিভিয়া নিউটন জনের গান আবারো হচ্ছে,

“Precious baby, sweetly sleep, sleep in peace.
Sleep in comfort, slumber deep.
I will rock you, rock you, rock you,
I will rock you, rock you, rock you …”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments