Friday, March 29, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পবোমাইবুরুর জঙ্গলে - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বোমাইবুরুর জঙ্গলে – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বোমাইবুরুর জঙ্গলে - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

জঙ্গলের বিভিন্ন অংশে সার্ভে হইতেছিল। কাছারি হইতে তিন ক্রোশ দূরে বোমাইবুরুর জঙ্গলে আমাদের এক আমিন রামচন্দ্র সিং এই উপলক্ষ্যে কিছুদিন ধরিয়া আছে। সকালে খবর পাওয়া গেল রামচন্দ্র সিং হঠাৎ আজ দিন দুই-তিন হইল পাগল হইয়া গিয়াছে।

শুনিয়া তখনই লোকজন লইয়া সেখানে গিয়া পৌঁছিলাম। বোমাইবুরুর জঙ্গল খুব নিবিড় নয়, খুব ফাঁকা উঁচু-নীচু প্রান্তরের মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গাছ, ডাল হইতে সরু দড়ির মতো লতা ঝুলিতেছে, যেন জাহাজের উঁচু মাস্তুলের সঙ্গে দড়াদড়ি বাঁধা। বোমাইবুরুর জঙ্গল সম্পূর্ণরূপে লোকবসতিশূন্য।

গাছপালার নিবিড়তা হইতে দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে কাশে-ছাওয়া ছোট্ট দু-খানা কুঁড়ে। একখানা একটু বড়ো, এ-খানাতে রামচন্দ্র আমিন থাকে, পাশের ছোটোখানায় তার পেয়াদা আসরফি টিন্ডেল থাকে। রামচন্দ্র নিজের কাঠের মাচার উপর চোখ বুজিয়া শুইয়াছিল। আমাদের দেখিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিলাম— ‘কী হয়েছে রামচন্দ্র? কেমন আছো?’

রামচন্দ্র হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিয়া চুপ করিয়া রহিল।

কিন্তু আসরফি টিন্ডেল সে কথার উত্তর দিল। বলিল— ‘বাবু, একটা বড়ো আশ্চর্য কথা। আপনি শুনলে বিশ্বাস করবেন না। আমি নিজেই কাছারিতে গিয়ে খবর দিতাম, কিন্তু আমিনবাবুকে ফেলে যাই বা কী করে? ব্যাপারটা এই, আজ ক-দিন থেকে আমিনবাবু বলছেন একটা কুকুর এসে রাত্রে তাঁকে বড়ো বিরক্ত করে। আমি শুই এই ছোটো ঘরে, আমিনবাবু শুয়ে থাকেন এখানে। দু-তিনদিন এইরকম গেল। রোজই ইনি বলেন— আরে কোত্থেকে একটা সাদা কুকুর আসে রাত্রে। মাচার ওপর বিছানা পেতে শুই, কুকুরটা এসে মাচার নীচে কেঁউ-কেঁউ করে, গাঁয়ে ঘেঁষ দিতে আসে। শুনি, বড়ো একটা গা করি না। আজ চারদিন আগে উনি অনেক রাত্রে বললেন— আসরফি, শিগগির এসো বেরিয়ে, কুকুরটা এসেছে। আমি তার লেজ চেপে ধরে রেখেছি। লাঠি নিয়ে এসো।

আমি ঘুম ভেঙে উঠে লাঠি-আলো নিয়ে ছুটে যেতে দেখি, বললে বিশ্বাস করবেন না হুজুর; কিন্তু হুজুরের সামনে মিথ্যা বলব এমন সাহস আমার নেই— একটি মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে বার হয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। আমি প্রথমটা থতোমতো খেয়ে গেলাম। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি আমিনবাবু বিছানা হাতড়ে দেশলাই খুঁজছেন। উনি বললেন— কুকুরটা দেখলে?

আমি বললাম— কুকুর কই বাবু, একটা কে মেয়ে তো বার হয়ে গেল।

উনি বললেন— উল্লুক, আমার সঙ্গে বেয়াদবি? মেয়েমানুষ কে আসবে এই জঙ্গলে দুপুররাতে? আমি কুকুরটার লেজ চেপে ধরেছিলাম, এমনকী তার লম্বা কান আমার গায়ে ঠেকেছে। মাচার নীচে ঢুকে কেঁউ-কেঁউ করছিল। নেশা করতে শুরু করেছ বুঝি? রিপোর্ট করে দেবো সদরে।

পরদিন রাত্রে আমি সজাগ হয়ে ছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত। যেই একটু ঘুমিয়েছি অমনি আমীনবাবু ডাকলেন। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে বেরিয়ে আমার ঘরের দোর পর্যন্ত গিয়েছি, এমন সময় দেখি একটি মেয়ে ওঁর ঘরের উত্তর দিকের বেড়ার গা বেয়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। তখনই হুজুর আমি নিজে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম; অতটুকু সময়ের মধ্যে লুকোবে কোথায়, যাবেই বা কত দূর? বিশেষ করে আমরা জঙ্গল জরিপ করি, অন্ধি-সন্ধি সব আমাদের জানা। কত খুঁজলাম বাবু, কোথাও তার চিহ্নটি পাওয়া গেল না। শেষে আমার কেমন সন্দেহ হল, মাটিতে আলো ধরে দেখি কোথাও পায়ের দাগ নেই, আমার নাগড়া জুতোর দাগ ছাড়া।

আমিনবাবুকে আমি একথা বললাম না আর সেদিন। একটি দু-টি প্রাণী থাকি এই ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে হুজুর। ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আর বোমাইবুরুর জঙ্গলের একটু দুর্নামও শোনা ছিল। ঠাকুরদাদার মুখে শুনেছি, বোমাইবুরুর পাহাড়ের উপর ওই যে বটগাছটা দেখছেন দূরে— একবার তিনি পূর্ণিয়া থেকে কলাই বিক্রির টাকা নিয়ে জ্যোৎস্না রাত্রে ঘোড়ায় করে জঙ্গলের পথে ফিরছিলেন; ওই বটতলায় এসে দেখেন একদল অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে হাত-ধরাধরি করে জ্যোৎস্নার মধ্যে নাচছে। এদেশে বলে ওদের ‘ডামাবাণু’— এক ধরনের জিনপরি, নির্জন জঙ্গলের মধ্যে থাকে। মানুষকে বেঘোরে পেলে মেরেও ফেলে।

হুজুর, পরদিন রাত্রে আমি নিজে আমিনবাবুর তাঁবুতে শুয়ে জেগে রইলাম সারারাত। সারারাত জেগে জরিপের থাকবন্দির হিসাব কষতে লাগলাম। বোধ হয় শেষ রাতের দিকে একটু তন্দ্রা এসে থাকবে; হঠাৎ কাছেই একটা কীসের শব্দ শুনে মুখ তুলে চাইলাম; দেখি— আমিনসাহেব ঘুমুচ্ছেন ওর খাটে, আর খাটের নীচে কী একটা ঢুকেছে। মাথা নীচু করে খাটের তলায় দেখতে গিয়েই চমকে উঠলাম। আধা-আলো আধা-অন্ধকারে প্রথমটা মনে হল একটি মেয়ে যেন গুটি সুটি মেরে খাটের তলায় বসে আমার দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে! স্পষ্ট দেখলাম, হুজুর, আপনার পায়ে হাত দিয়ে বলতে পারি। এমনকী তার মাথায় বেশ কালো চুলের গোছা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখেছি। লণ্ঠনটা ছিল যেখানটাতে বসে হিসাব কষছিলাম সেখানে— হাত ছ-সাত দূরে। আরও ভালো করে দেখব বলে লণ্ঠনটা যেমন আনতে গিয়েছি, কী একটা প্রাণী ছুটে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে পালাতে গেল— দোরের কাছে লণ্ঠনের আলোটা বাঁকাভাবে পড়ে ছিল, সেই আলোতে দেখলাম— একটা বড়ো কুকুর, কিন্তু তার আগাগোড়া সাদা হুজুর, কালোর চিহ্ন কোথাও নেই তার গায়ে।

আমিনসাহেব জেগে বললেন— কী, কী? বললাম— ও কিছু নয়, একটা শেয়াল কী কুকুর ঘরে ঢুকেছিল। আমিনসাহেব বললেন— কুকুর? কীরকম কুকুর? বললাম— সাদা কুকুর। আমিনসাহেব যেন একটা নিরাশার সুরে বললেন— সাদা ঠিক দেখেছ? না কালো? বললাম— না, সাদাই হুজুর।

আমি একটু বিস্মিত যে না হয়েছিলাম এমন নয়। সাদা না-হয়ে কালো হলেই বা আমিনবাবুর কী সুবিধা হবে তাতো বুঝলাম না। উনি ঘুমিয়ে পড়লেন; কিন্তু আমার যে কেমন একটা ভয় ও অস্বস্তি বোধ হল, কিছুতেই চোখের পাতা বোজাতে পারলাম না। খুব সকালে উঠে খাটের নীচেটা একবার কী মনে করে ভালো করে খুঁজতে গিয়ে সেখানে একগাছা কালো চুল পেলাম। এই সে চুলও রেখেছি, হুজুর। মেয়েমানুষের মাথার চুল। কোথা থেকে এল এ চুল? দিব্যি কালো কুচকুচে নরম চুল। কুকুর— বিশেষত সাদা কুকুরের গায়ে এত বড়ো, নরম কালো চুল হয় না। এই হল গত রবিবার অর্থাৎ আজ তিনদিনের কথা। এই তিনদিন থেকে আমিনসাহেব তো একরকম উন্মাদ হয়েই উঠেছেন। আমার ভয় করছে হুজুর; এবার আমার পালা কি না তাই ভাবছি।

গল্পটা বেশ আষাঢ়ে গোছের বটে। সে-চুলগাছি হাতে করিয়া দেখিয়াও কিছু বুঝিতে পারিলাম না। মেয়েমানুষের মাথার চুল, সে বিষয়ে আমারও কোনো সন্দেহ রহিল না। আসরফি টিন্ডেল ছোকরা মানুষ, সে যে নেশা ভাঙ করে না, একথা সকলেই একবাক্যে বলিল।

জনমানবশূন্য প্রান্তর ও বনঝোপের মধ্যে একমাত্র তাঁবু এই আমিনের নিকটতম লোকালয় হইতেছে লবটুলিয়া— ছয় মাইল দূরে। মেয়েমানুষই-বা কোথা হইতে আসিতে পারে অত গভীর রাত্রে; বিশেষ যখন এইসব নির্জন বনপ্রান্তরে বাঘ ও বুনোশুয়োরের ভয়ে সন্ধ্যার পরে আর লোকে পথ চলে না?

যদি আসরফি টিন্ডেলের কথা সত্য বলিয়া ধরিয়া লই, তবে ব্যাপারটা খুব রহস্যময় অথবা এই পাণ্ডববর্জিত দেশে, এই জনহীন বনজঙ্গল ও ধু-ধু প্রান্তরের মধ্যে বিংশ শতাব্দী তো প্রবেশের পথ খুঁজিয়া পায়ই নাই; ঊনবিংশ শতাব্দীও পাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। অতীত যুগের রহস্যময় অন্ধকারে এখনও এসব অঞ্চল আসন্ন— এখানে সবই সম্ভব।

সেখানকার তাঁবু উঠাইয়া রামচন্দ্র আমিন ও আসরফি টিন্ডেলকে সদর কাছারিতে লইয়া আসিলাম। রামচন্দ্রের অবস্থা দিন দিন খারাপ হইতে লাগিল, ক্রমশ সে ঘোর উন্মাদ হইয়া উঠিল। সারারাত্রি চিৎকার করে, বকে, গান গায়। ডাক্তার আনাইয়া দেখাইলাম, কিছুতেই কিছু হইল না, অবশেষে তাহার এক দাদা আসিয়া তাহাকে লইয়া গেল।

এই ঘটনার এটা উপসংহার আছে, যদিও তাহা ঘটিয়াছিল বর্তমান ঘটনার সাত-আট মাস পরে, তবুও এখানেই তাহা বলিয়া রাখি।

এই ঘটনার ছ-মাস পরে চৈত্রমাসের দিকে দু-টি লোক কাছারিতে আমার সঙ্গে দেখা করিল। একজন বৃদ্ধ, বয়স ষাট-পঁয়ষট্টির কম নয়; অন্যটি তার ছেলে বয়স কুড়ি-বাইশ। তাদের বাড়ি বালিয়া জেলায়, আমাদের এখানে আসিয়াছে চরি-মহাল ইজারা লইতে অর্থাৎ আমাদের জঙ্গলে খাজানা দিয়া তাহারা গোরু মহিষ চরাইবে।

অন্য সব চরি-মহাল তখন বিলি হইয়া গিয়াছে, বোমাইবুরুর জঙ্গলটা তখনও খালি পড়িয়া ছিল, সেইটাই বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। বৃদ্ধ ছেলেকে সঙ্গে লইয়া একদিন মহাল দেখিয়াও আসিল। খুব খুশি, বলিল— খুব বড়ো বড়ো ঘাস হুজুর, বহুৎ আচ্ছা জঙ্গল। হুজুরের মেহেরবানি না-হলে অমন জঙ্গল মিলত না।

রামচন্দ্র ও আসরফি টিন্ডেলের কথা তখন আমার মনে ছিল না, থাকিলেও বৃদ্ধের নিকট তাহা হয়তো বলিতাম না। কারণ, ভয় পাইয়া সে ভাগিয়া গেলে জমিদারের লোকসান। স্থানীয় লোকেরা কেহই ও-জঙ্গল লইতে ঘেঁষে না, রামচন্দ্র আমিনের সেই ব্যাপারের পরে।

মাস খানেক পরে বৈশাখের গোড়ায় একদিন বৃদ্ধ লোকটি কাছারিতে আসিয়া হাজির, মহা রাগত ভাব, তার পিছনে সেই ছেলেটি কাঁচুমাচুভাবে দাঁড়িয়ে।

বলিলাম— কী ব্যাপার?

বৃদ্ধ রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল— এই বাঁদরটাকে নিয়ে এলাম হুজুরের কাছে দরবার করতে। ওকে আপনি পা থেকে খুলে পঁচিশ জুতো মারুন, ও জব্দ হয়ে যাক।

—কী হয়েছে কী?

—হুজুরের কাছে বলতে লজ্জা করে। এই বাঁদর, এখানে এসে পর্যন্ত বিগড়ে যাচ্ছে। আমি সাত-আট দিন প্রায়ই লক্ষ করছি, লজ্জা করে বলতে হুজুর, প্রায়ই মেয়েমানুষ ঘর থেকে বার হয়ে যায়। একটা মাত্র খুপরি— হাত-আষ্টেক লম্বা, ঘাসে-ছাওয়া, ও আর আমি দু-জনে শুই। আমার চোখে ধুলো দিতে পারাও সোজা কথা নয়। দু-দিন যখন দেখলাম তখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও একেবারে গাছ থেকে পড়ল হুজুর। বলে— কই, আমি তো কিছুই জানি না! আরও দু-দিন যখন দেখলাম, তখন একদিন দিলাম ওকে আচ্ছা করে মার। চোখের সামনে বিগড়ে যাবে ছেলে? কিন্তু তারপরেও যখন দেখলাম, এই পরশু রাত্রেই হুজুর; তখন ওকে আমি হুজুরের দরবারে নিয়ে এসেছি, হুজুর শাসন করে দিন।

হঠাৎ রামচন্দ্র আমিনের ব্যাপারটা মনে পড়িয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিলাম— কত রাত্রে দেখেছ?

—প্রায়ই শেষরাত্রের দিকে হুজুর। এই রাতের দু-এক ঘড়ি বাকি থাকতে।

—ঠিক দেখেছ, মেয়েমানুষ?

—হুজুর, আমার চোখের তেজ এখনও তত কম হয়নি। জরুর মেয়েমানুষ, বয়সেও কম, কোনোদিন পরনে সাদা ধোয়া শাড়ি, কোনোদিন-বা লাল, কোনোদিন কালো। একদিন মেয়েমানুষটা বেরিয়ে যেতেই আমি পেছন পেছন গেলাম। কাশের জঙ্গলের মধ্যে কোথায় পালিয়ে গেল, টের পেলাম না! ফিরে এসে দেখি, ছেলে আমার যেন খুব ঘুমের ভান করে পড়ে রয়েছে, ডাকতেই ধড়মড় করে ঠেলে উঠল, যেন সদ্য ঘুম ভেঙে উঠল। এ রোগের ওষুধ কাছারি ভিন্ন হবে না বুঝলাম, তাই হুজুরের কাছে—

ছেলেটিকে আড়ালে লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম— এ সব কী শুনছি তোমার নামে?

ছেলেটি আমার পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল— আমার কথা বিশ্বাস করুন হুজুর। আমি এর বিন্দুবিসর্গ জানি না। সমস্ত দিন জঙ্গলে মহিষ চরিয়ে বেড়াই; রাতে মড়ার মতো ঘুমোই, ভোর হলে তবে ঘুম ভাঙে। ঘরে আগুন লাগলেও আমার হুঁশ থাকে না।

বলিলাম— তুমি কোনোদিন কিছু ঘরে ঢুকতে দেখনি?

—না, হুজুর। আমরা ঘুমুলে হুঁশ থাকে না।

এ-বিষয়ে আর কোনো কথা হইল না। বৃদ্ধ খুব খুশি হইল, ভাবিল আমি আড়ালে লইয়া গিয়া ছেলেকে খুব শাসন করিয়া দিয়াছি। দিন-পনেরো পরে একদিন ছেলেটি আমার কাছে আসিল। বলিল— হুজুর, একটা কথা আছে। সেবার যখন আমি বাবার সঙ্গে কাছারিতে এসেছিলাম, তখন আপনি ও-কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন, যে আমি কোনো কিছু ঘরে ঢুকতে দেখেছি কি না?

—কেন বলো তো?

—হুজুর, আমার ঘুম আজকাল খুব সজাগ হয়েছে; বাবা ওইরকম করেন বলে আমার মনে কেমন একটা ভয়ের দরুনই হোক, বা যার দরুনই হোক। তাই ক-দিন থেকে দেখছি, রাত্রে একটা সাদা কুকুর কোথা থেকে আসে— অনেক রাত্রে আসে, ঘুম ভেঙে এক-একদিন দেখি সেটা বিছানার কাছেই কোথায় ছিল। আমি জেগে উঠলেই পালায়, সে কেমন বুঝতে পারে যে, এইবার আমি জেগেছি। এরকম তো ক-দিন দেখলাম; কিন্তু কাল রাতে হুজুর একটা ব্যাপার ঘটেছে, বাবুজি জানে না— আপনাকেই চুপি-চুপি বলতে এলাম। কাল অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি, কুকুরটা ঘরে কখন ঢুকেছিল দেখিনি— আস্তে আস্তে ঘর থেকে বার হয়ে যাচ্ছে। সেদিকের কাশের বেড়ায় জানালার মাপে কাটা ফাঁক। কুকুর বেরিয়ে যাওয়ার পরে বোধ হয় পলক ফেলতে যতটা দেরি হয়, তারপরেই আমার সামনের জানালা দিয়ে দেখি— একটা মেয়েমানুষ জানলার পাশ দিয়ে ঘরের পেছনের জঙ্গলের দিকে চলে গেল। আমি তখুনি বাইরে ছুটে গেলাম— কোথাও কিছু না! বাবাকেও জানাইনি, বুড়ো মানুষ ঘুমুচ্ছে। ব্যাপারটা কী হুজুর বুঝতে পারছিনে।

আমি তাহাকে আশ্বাস দিলাম— ও কিছু নয়, চোখের ভুল। বলিলাম, তাহাদের যদি ওখানে থাকিতে ভয় করে, তাহারা কাছারিতে আসিয়া শুইতে পারে। ছেলেটি নিজের সাহসহীনতায় বোধ করি কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু আমার অস্বস্তি দূর হইল না, ভাবিলাম এইবার কিছু শুনিলে কাছারি হইতে দুইজন সিপাহি পাঠাইব রাত্রে ওদের কাছে শুইবার জন্য।

তখনও বুঝিতে পারি নাই জিনিসটা কত সঙ্গিন। দুর্ঘটনা ঘটিয়া গেল অতি অকস্মাৎ এবং অতি অপ্রত্যাশিতভাবে।

দিন তিনেক পরে।

সকালে সবে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়াছি, খবর পাইলাম কাল রাত্রে বোমাইবুরুর জঙ্গলে বৃদ্ধ ইজারাদারের ছেলেটি মারা গিয়াছে। ঘোড়ায় চড়িয়া আমরা তখনই রওনা হইলাম। গিয়া দেখি তাহারা যে-ঘরটাতে থাকিত, তাহার পিছনে কাশ ও বনঝাউ জঙ্গলে ছেলেটির মৃতদেহ তখনও পড়িয়া আছে। মুখে তাহার ভীষণ ভয় ও আতঙ্কের চিহ্ন— কী একটা বিভীষিকা দেখিয়া আঁতকাইয়া যেন মারা গিয়াছে। বৃদ্ধের মুখে শুনিলাম, শেষরাত্রির দিকে উঠিয়া ছেলেকে সে বিছানায় না-দেখিয়া তখনই লণ্ঠন ধরিয়া খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করে; কিন্তু ভোরের পূর্বে তাহার মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া যায় নাই। মনে হয়, সে হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া কোনো কিছুর অনুসরণ করিয়া বনের মধ্যে ঢোকে। কারণ, মৃতদেহের কাছেই একটা মোটা লাঠি ও লণ্ঠন পড়িয়া ছিল। কীসের অনুসরণ করিয়া সে বনের মধ্যে রাত্রে একা আসিয়াছিল, তাহা বলা শক্ত। কারণ, নরম বালিমাটির উপর ছেলেটির পায়ের দাগ ছাড়া অন্য কোনো পায়ের দাগ নেই— না মানুষ, না জানোয়ারের। মৃতদেহেও কোনোরূপ আঘাতের চিহ্ন ছিল না। বোমাইবুরু জঙ্গলের এই রহস্যময় ব্যাপারের কোনো মীমাংসাই হয় নাই। পুলিশ আসিয়া কিছু করিতে না-পারিয়া ফিরিয়া গেল। লোকজনের মনে এমন একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করিল ঘটনাটি যে, সন্ধ্যার বহুপূর্ব হইতে ও-অঞ্চলে আর কেহ যায় না। দিন কতক তো এমন হইল যে, কাছারিতে একলা নিজের ঘরটিতে শুইয়া বাহিরের ধপধপে সাদা, ছায়াহীন, উদাস, নির্জন জ্যোৎস্নারাত্রির দিকে চাহিয়া কেমন একটা অজানা আতঙ্কে প্রাণ কাঁপিয়া উঠিত; মনে হইত কলকাতার পালাই, এ-সব জায়গা ভালো নয়। এর জ্যোৎস্নাভরা নৈশপ্রকৃতি রূপকথার রাক্ষসি রানির মতো, তোমাকে ভুলাইয়া বেঘোরে লইয়া গিয়া মারিয়া ফেলিবে। যেন এ-সব স্থান মানুষের বাসভূমি নয় বটে, কিন্তু ভিন্ন লোকের রহস্যময়, অশরীরী প্রাণীদের রাজ্য— বহুকাল ধরিয়া তাহারাই বসবাস করিয়া আসিতেছিল, আজ হঠাৎ তাহাদের সেই গোপন রাজ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ তাহারা পছন্দ করে নাই, সুযোগ পাইলেই প্রতিহিংসা লইতে ছাড়িবে না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments