Saturday, July 27, 2024
Homeবাণী-কথাবল্টুদার উৎসাহলাভ - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বল্টুদার উৎসাহলাভ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

আমি বরাবর দেখেছি, আমাদের বল্টুদার যখন তেজ এসে যায়, তখন তাকে ঠেকানো ভারি মুস্কিল।

রবিবার সকালে দিব্যি চাটুজ্যেদের রকে বসে আছি আর একটা কাকের পালক কুড়িয়ে নিয়ে আরামে কান চুলকোচ্ছি, হঠাৎ কোত্থেকে বল্টুদা এসে হাজির। বললে, চল প্যালা–একটু বেরনো যাক।

–কোথায় যেতে হবে?

-মানে, বন্ধুবান্ধবদের একটু উৎসাহ দেওয়া দরকার। দেখছিস নে, সব কেমন মিইয়ে যাচ্ছে?

শুনে কানের ভেতর আচমকা একটা পালকের খোঁচা লেগে গেল।

–সে আবার কী? কাকে তুমি উৎসাহ দেবে?

–যাকে পাই। বুঝলি, চারদিকে সবাই যেন কী রকম দমে যাচ্ছে। এই তো সেদিন তোর বন্ধু হাবুল সেনকে বললুম, চল হাবলা, একটা অ্যাডভেঞ্চারের ফিলিম হচ্ছে-দুজনে মিলে দেখে আসি। তোর পকেটে যদি পাঁচ সিকে পয়সা থাকে, তা হলেই হয়ে যাবে এখন। বললে বিশ্বেস করবি না প্যালা, হাবুল একেবারে খ্যাঁক করে উঠল। আমার নাকের সামনে হাত নেড়ে বললে, থাউক, অত আহ্লাদ করতে হইব না। যাইতে হইলে একাই যামু-তোমারে নিমু ক্যান? শুনলি একবার কথাটা? দেশের এ কী অবস্থা হল বল দিকি?

আমি বললুম, দেশের অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু তাই বলে যদি আমাকে উৎসাহ দিতে এসে থাকো, তবে সুবিধে হবে না বলে দিচ্ছি। আমার পকেটে ঠিক তিনটে নয়া পয়সা আছে। চাও তো তা থেকে একটা তোমায় দিতে পারি।

বল্টুদা নাকটাক কুঁচকে মুখটাকে মোগলাই পরোটার মত করে বললে, থাক থাক, তোকে আর দয়া করতে হবে না। তুই যে এক নম্বরের ট্যাঁক-খালি জমিদার সে কি আর আমি জানিনে? চল–আমাদের অভিলাষকে একটু উৎসাহ দিয়ে আসি।

অভিলাষের নাম শুনে আমার কান খাড়া হয়ে উঠল।

-কোন্ অভিলাষ? ওই যে সিনেমার সামনে নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে?

বল্টুদা বললে, আবার কে? উৎসাহ দিতে হলে ভালো-ভালো লোককেই দেওয়া উচিত আজেবাজে লোককে দেওয়া আমি পছন্দ করি না। নে–উঠে পড়

তক্ষুনি উঠে পড়লুম।

কী রকম উৎসাহ দেবে বল্টুদা?

–চল না, দেখতেই পাবি।

পরমানন্দে উঠে পড়লুম। আমার আর ভাবনা কী। পকেটে তো মোট তিনটে নয়া পয়সা। তা ছাড়া, বল্টুদার মনে যখন একবার উৎসাহ দেবার তেজ এসে গেছে তখন আর ওকে ঠেকাবে কে।

ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস– বলতে বলতে বলুদার পেছু নিলুম।

.

অভিলাষ আমাদের পাড়ার ছেলে। ওর বাবার মস্ত বড় পটোলের ব্যবসা। তাই অভিলাষকে বেশি লেখাপড়া না শিখিয়ে পটলের ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। দুবছর ধরে অভিলাষ এমন ব্যবসা করলে যে পটোলের দোকান পটল তোলে আর কি! তখন ওর বাবা রেগেমেগে ওকে কষে দুটো থাপ্পড় দিলেন। অভিলাষ তাই শেষ পর্যন্ত ওই রেস্তোরাঁ খুলেছে আর মনের দুঃখে পটোল ভাজা পর্যন্ত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।

আমরা যখন গেলুম, তখন ওর দোকানে বিশেষ লোকজন নেই। একজন ঝাঁটাগুঁফো ভদ্রলোক তারিয়ে-তারিয়ে ডিমের পোচ খাচ্ছেন আর এক বুড়ো নাকের ডগায় খবরের কাগজটা ধরে বসে আছেন।

আমাদের দেখেই অভিলাষের হাসি কান ছাপিয়ে, নাকের ডগা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

-এই যে এসো বল্টুদা-আয় প্যালা বল্টুদা

আর আমি ততক্ষণে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছি। বল্টুদা বললে, আরে আসব বই কি! তুই বললে আসব, না বললে আসব, তাড়িয়ে দিলেও ফিরে আসব।

শুনে অভিলাষ হেঁ হেঁ করল।–আরে তাড়াব কেন? তোমরা হলে খদ্দের–দোকানের লক্ষ্মী। কী খাবে বলল এখন।

বল্টুদা বললে, কী খাব না, তাই বল। তোকে উৎসাহ দেবার জন্যেই তো প্যালাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলুম। তোর কেক খাব, বিস্কুট খাব, টোস্ট খাব, ওমলেট খাব, চপ, কাটলেট, মাংস–ও, সেগুলো বুঝি এ-বেলা হয় না? আচ্ছা বেশ, চপ কাটলেটগুলো সন্ধেবেলায় এসেই খাওয়া যাবে তা হলে। এখন চা খাব, কফি খাব

আমি বললুম, যদি আরও বেশি উৎসাহ পেতে চাস, তা হলে তোর কাপ-ডিশ চামচে-কাঁটাগুলোও খেতে পারি।

অভিলাষ দারুণ খুশি হতে যাচ্ছিল, কিন্তু এবারে যেন একটু নার্ভাস হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বললে, নানা, কাপ-ডিশগুলো বরং

–তুই আপত্তি করছিস?–বল্টুদা বললে, আচ্ছা, ওগুলো তবে থাক। আর যদ্দুর মনে হচ্ছে কাপ-ডিশ খেতে খুব ভালো লাগবে না, কাঁটা-চামচ খাওয়াও বেশ শক্ত হবে। তবে প্যালার যদি খুবই ইচ্ছে হয়ে থাকে, একটা ভাঙা পেয়ালা বরং ওকে দেব–সে বসে চিবোক। আর আমার জন্যে দুখানা প্লাম কেক, চারটে টোস্ট, দুটো ডবল ডিমের ওমলেট–

আমি ভীষণ প্রতিবাদ করে বললুম, না, আমি কক্ষনো ভাঙা কাপ খাব না। আমিও কেক, টোস্ট, ওমলেট এইসবই খেতে চাই।

অভিলাষ বললে, হ্যাঁ-হাঁ, তুইও খাবি। একটু বোস–আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

প্রায় নাচতে নাচতে চলে গেল অভিলাষ। বোধ হয় ভাবছিল সকালে কার মুখ দেখেই উঠেছে আজকে। কমসে কম তিন টাকা করে ছটাকার খদ্দের। কিন্তু আমি যদি বল্টুদাকে চিনে থাকি তা হলে

এদিক বুড়ো ভদ্দরলোক উঠে যেতেই ছোঁ মেরে খবরের কাগজটা তুলে এনেছে বল্টুদা। একমনে খেলার খবর পড়ছে।

বললুম, বল্টুদা—

উঁ!

পকেটে টাকা ফাঁকা আছে তো? না তোমার পাল্লায় পড়ে ঠ্যাঙানি খাব শেষ পর্যন্ত?

বল্টুদার নাকের ডগায় একটা মাছি অনেকক্ষণ ধরে পজিশন নেবার চেষ্টা করছিল। খবরের কাগজের ঘা খেয়ে সেটা পালালে। বল্টুটুদা আমার কথা শুনে উঁচুদরের একটা হাসি হাসল বাংলায় যাকে বলে হাই ক্লাস।

-কে ঠ্যাঙাবে? অভিলাষ? না ও তেমন ছেলে নয়।

-তাই নাকি?–আমার খটকা তবুও যেতে চায় না। জিজ্ঞেস করলুম, কী করে জানলে?

–ও যখন পটোলের দোকানে বসত জানিস তো? সেই যখন দোকানের পটল তোলার জো হয়েছিল। সেই সময় একদিন ও একা দোকানে বসে রয়েছে, দুজন লোক এসে হাজির। একজন বললে, খোকন, আমায় পটলডাঙার টেনিদার বাড়িটা চিনিয়ে দিতে পারো? ও বললে, ওই তো বাটার দোকানের পাশ দিয়ে চলে যান। শুনে লোকটা বললে, আমি কলকাতায় নতুন এসেছি ভাই পথ-ঘাট কিছু চিনিনে। একটু আসবে সঙ্গে?

অভিলাষ বললে, আমি যে দোকানে একা আছি? লোকটা বললে, তাতে কী–আমার সঙ্গের বন্ধুটি তোমার দোকান পাহারা দেবে। শুনে অভিলাষ তো তাকে এগিয়ে দিতে গেল।

পটলডাঙার গলিতে ঢুকেই লোকটা একদম ভ্যানিশ। ও মশাই, কোথায় গেলেন বলে অভিলাষ একঘণ্টা ধরে চেঁচিয়ে মিথ্যে গোরু-খোঁজা করে ফিরে, ফিসে এসে দেখে, লোকটার সঙ্গীও নেই। আর নেই–

বললুম, কী নেই?

বল্টুদা বললে, এক ঝুড়ি পটোল। ভীষণ মন-খারাপ করে হিসেবের খাতায় লিখে রাখলে : সাত সের তেরো ছটাক পটোল বাকিতে লইয়া গেল। তাহার নাম-ঠিকানা কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না। আর সেই হিসেব দেখে ওর বাবা

–ওর বাবা কী করলে?

বল্টুদা চোখ মিটমিট করে বললে, পরে বলব। ওই যে অভিলাষ আসছে।

সত্যই অভিলাষ আসছে। নিজের হাতে করে আনছে দুটো প্লেট। তাতে ডবল ডিমের ওমলেট, দুটো করে প্লাম কেক আর চারটে করে টোস্ট।

বল্টদা বললে, বাঃ, তোফা!–তারপর প্রায় অভিলাষের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিয়েই খাওয়া শুরু করে দিল। আর আহ্লাদী-আহ্লাদী মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইল অভিলাষ। কী খুশি!

–ওমলেট কেমন হয়েছে বল্টুদা?

খাসা! তোকে তো উৎসাহ দিতেই এলুম অভিলাষ। তোর ওমলেট খেয়েই বুঝতে পারছি–তোর ভবিষ্যৎ কী নিদারুণ উজ্জ্বল।

অভিলাষের চোখ-মুখ চকচক করে উঠল।–তাই নাকি?

–তবে আর বলছি কী? তোর রেস্তোরাঁ দিনের পর দিন ফেঁপে উঠবে, দেলখোসকে মেরে বেরিয়ে যাবে।

-সত্যি?–আনন্দে অভিলাষ বার-দুই খাবি খেল।

তা ছাড়া কী? তারপর তোর রেস্তোরাঁ আরও বড় হবে–গ্র্যান্ড হোটেলকেও ছাপিয়ে উঠবে। গ্রেট ইস্টার্ন বা ফিরপোতে না গিয়ে দলে-দলে লোক ছুটে আসবে তোর দোকানে। চাং-ওয়ার চাউ চাউ হাউহাউ করে কাঁদতে থাকবে আর তুই গদি-আঁটা চেয়ারে বসে খালি টাকা গুনতে থাকবি।

বক্তৃতা আর খাওয়া সমানে চলছে বল্টুদার। আমিও যতটা পারি চটপট প্লেট সাফ করছি। কখন যে কী হয়ে যায়, কিছুই তো বলা যায় না।

.

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ নেচে নিলে অভিলাষ; তারপর দৌড়ে যেতে-যেতে বলে গেল, বোসো, তোমাদের জন্যে ভালো করে ডবল কাপ চা নিয়ে আসি দুটো।

বল্টুদা শেষ প্লাম কেকটা গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বললে, কেমন বুঝছিস?

বললুম, ভালো নয়। পকেটে যদি টাকা না থাকে

টাকা? টাকা কী হবে? উৎসাহ দেবার শক্তি থাকলেই যথেষ্ট। দেখছিস না-এর মধ্যেই কেমন নাচতে শুরু করেছে অভিলাষ? আর তাও ভেবে দ্যাখ প্যালা– ঝট করে কী রকম ওর রেস্তোরাঁটাকে গ্র্যান্ড হোটেলের চাইতেও বড় করে দিলুম। আর কী চাই? হু-হু।

-মুখে বললেই তো হয় না।

–মুখে বলব না তো কান দিয়ে বলব নাকি? কিন্তু তুই তো আমায় ভাবিয়ে তুললি, সত্যিই তো–কান দিয়ে কি বলা যায়? অবিশ্যি নাক দিয়ে কেউ কেউ ঘুমের সময় বলে বটে, কিন্তু কী যে বলে তা বোঝাই যায় না। বোধ হয় হিব্রু বলে। না কি জার্মান ভাষা? ঘু-ঘুরু–খুঁরুর–আচ্ছা, চীনে ভাষা না তো? তোর কী মনে হয় প্যালা?

নাকের ডাকের ভাষাটা যে কী-বোঝবার আগেই অভিলাষ চা আনল। কী মনে হয়, তা আর বলতে পারলুম না।

বল্টুদা আর আমি বেশ মন দিয়ে চা-টা শেষ করলুম। তারপর ধীরে সুস্থে গোটা দুই ঢেকুর তুলে বল্টুদা উঠে দাঁড়াল। আমিও তক্ষুনি একেবারে দোরগোড়ায়–এইবারে যা হওয়ার হবে–এসপার ওসপার।

বল্টুদা বললে, জোর খাইয়েছিস! দ্যাখ না বছর ঘুরতে না ঘুরতে তুই দেলখোসকে মেরে দিবি। তারপর ফিরপো-গ্রেট ইস্টার্ন–গ্র্যান্ড হোটেলে

আনন্দে অভিলাষ হাঁসের মতো হাঁসফাঁস করতে লাগল।

–তা হলে চলি-

—এই যে বিলটা-অভিলাষ একখানা কাগজ এগিয়ে ধরল : পাঁচ টাকা বারো আনা—

কিসের বিল? কিসের টাকা?–বল্টুদা যেন আকাশ থেকে পড়ল।

আর অভিলাষ পড়লনা, আকাশ থেকে নয়, সোজা স্পুটনিক থেকে।

-বা-রে, পাঁচ টাকা বারো আনার খেলে দুজনে মিলে?

বল্টুদা বললে, মোটে পাঁচ টাকা বারো আনার? তা হলে তোর কাছে আরও চুয়াল্লিশ টাকা চার আনা পাওনা রইল।

অভিলাষ এবার শুটনিক থেকে—না–না, সোজা চাঁদ থেকে পড়ল। পাঁচ বার খাবি খেয়ে বললে, চুয়াল্লিশ টাকা চার আনা মানে? আমি আবার কবে তোমার কাছে থেকে টাকা নিয়েছি? কক্ষনো না। তুমি এক পয়সাও পাও না আমার কাছ থেকে।

বটে? বসে-বসে পঞ্চাশ টাকার উৎসাহ দিইনি এতক্ষণ? বলিনি–লেগে থাক অভিলাষ–শেষে গদি-আঁটা চেয়ারে বসে টাকা গুনবি? সেই থেকে তো মোটে পাঁচ টাকা বারো আনা শোধ হল।

অভিলাষ বললে, আঁ—আঁ–আঁ–

–আ-আ-আ নয়, বল্ হাঁ হাঁ হাঁ। আর তোর হিসেবের খাতায় লিখে রাখ :কেহ পঞ্চাশ টাকা জমা দিয়া পাঁচ টাকা বারো আনার খাইয়া গেল। পরে ক্রমশ বাকিটা খাইবে। আচ্ছা চলি, টা-টা

অভিলাষ হাঁ-হাঁ বলতে পারলে না–একেবারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে আমার মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। বেচারা অভিলাষ! বল্টুদার পাল্লায় পড়ে ওকে অমনভাবে ঠকানোটা একদম ঠিক হল না–না খেলেই ভালো হত বল্টুদার সঙ্গে। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমার পকেটে তো মোটে তিনটে নয়া পয়সা ছাড়া কিছু নেই। যদি কোনও দিন যোগাড় করতে পারি, ওর টাকা নিশ্চয় শোধ করে দেব; এসব জোচ্চুরিতে আমি নেই!

ভীষণ রাগ হল বল্টুদার ওপর। ট্রামে উঠতে যাচ্ছি বল্টুদা ঠ্যাং ধরে আমায় টেনে নামাল।

-কোথায় যাচ্ছিস?

যাব একবার বলাই ঢ্যাং লেনে।

–ও, আমাদের পাঁচুগোপালের বাড়িতে? তা চলচল। ওর ক্ষেমঙ্করী-পিসিমা বেশ ভালো খাওয়ায়।

কী রাক্ষস দেখেছ? এইমাত্র অভিলাষের মাথায় কাঁটাল ভেঙে এতগুলো খেয়ে এসেছে। আবার এক্ষুনি খাই-খাই করছে।

বললুম, আজ গিয়ে সুবিধে হবে না। পাঁচুগোপাল ফুটবল খেলতে গিয়ে পা মচকে পড়ে আছে।

–পা মচকে পড়ে আছে? আহা, চুক চুক। তা হলে তো ওকে উৎসাহ দেবার জন্যে আরও বেশি করে যাওয়া দরকার। চল-চল

একটা হ্যাঁচকা টানে বল্টুদা আমায় ট্রামে তুলে ফেলল।

.

পাঁচুগোপালের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তে ওর ক্ষেমঙ্করী-পিসিমা দরজাটা খুলে দিলে। বল্টুদা সঙ্গে সঙ্গে একমুখ দাঁত বের করে ফেলল। গলেই গেল বলতে গেলে।

–পাঁচু কেমন আছে দেখতে এলুম পিসিমা।

ক্ষেমঙ্করী-পিসিমা ভারি খুশি হলেন : আহা বাবা, আয় আয়। বাছা আমার আজ দুদিন থেকে মনমরা হয়ে শুয়ে আছে।

-সেই জন্যেই তো এলুম। শরীর খারাপ বলেই তো ওকে ভালো করে উৎসাহ দেওয়া দরকার।

-তাই দে বাবা। আমি তোদের জন্যে কটা তালের বড়া ভেজে আনি।

সত্যিই তালের বড়ার গন্ধে বাড়ি ম-ম করছিল। বলুটদাঁ মুখটাকে ছুঁচোর মতো ছুঁচলো করে আমায় চুপিচুপি বললে, দেখলি তো প্যালা–হুঁ-হুঁ। কেমন প্রেমসে গরম-গরম তালের বড়া খাওয়া যাবে। কপাল ভালো থাকলে এমনিই হয়। এখন চল দেখি–পেঁচোটা কী করছে।

পায়ে চুন-চলুদ মাখিয়ে পাঁচুগোপাল প্যাঁচার মতো পড়ে আছে। বল্টুদা গিয়ে ধপাত করে তার পাশে বসে পড়ল।

কীরে পেঁচো, কেমন আছিস?

পাঁচু চিঁ-চিঁ করে বললে, ভীষণ ব্যথা।

–ভীষণ ব্যথা?–বল্টুদা উৎসাহ দিতে লাগল : অমন হয়। ব্যথা হতে হতে শেষে সেপটিক হয়ে যায়।

পাঁচুগোপাল ভীষণ ঘাবড়ে গেল : মচকানি থেকে সেপটিক হয়?

হয় বই কি। অনেক সময় পা কেটে ফেলতে হয় কত লোকে মরেও যায়।

পাঁচগোপালের চোখে কপালে চড়ে গেল : অ্যা–আমি তবে মারা যাব নাকি?

উৎসাহ দিয়ে বল্টুদা বলতে লাগল, যেতে পারিস–কিছু অসম্ভব নয়। তবে মারা না-ও যেতে পারিস–মানে, মনে জোর থাকলে বেঁচে গেলেও বেঁচে যেতে পারিস। তবে একটা পা কাটা গেলেও ঘাবড়াসনি। না হয় লাঠি ভর করেই হাঁটবি। আর যদি মারাই যাস–মনে কর মারাই গেলি–তা হলেও ঘাবড়ে যাসনি। দেখিস পেঁচো–বল্টুদা আরও বেশি উৎসাহ দিতে লাগল : তোর মৃত্যুর পর আমরা কীরকম একখানা শোকসভা

বল্টুদা আর বলতে পারল না–শব্দ হল ঝপাং। বাপ বাপ বলে বল্টুদা লাফিয়ে উঠল।

ক্ষেমঙ্করী-পিসিমার ঝাঁটা আবার নামল বল্টুদার পিঠে। পিসিমা যে কখন ঘরে ঢুকেছে আমরা দেখতে পাইনি।

বিকটরকম দাঁত খিঁচিয়ে ক্ষেমঙ্করী-পিসিমা আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল : তবে রে অলপ্পেয়ে–নচ্ছার, ড্যাকরা, হাড়হাবাতে। আমার পাঁচুর ঠ্যাং কাটা যাবে? আমার পাঁচু মারা যাবে? তার আগে তোরই মরণ ঘনিয়েছে–দেখে নে।

আবার ঝাঁটা নামল : ঝপাং ঝপাং

বাবারে গেছি–গেছি বলে বল্টুদা ছুটল। পেছনে ছুটল ঝাঁটা হাতে ক্ষেমঙ্করী-পিসিমা। কী আর করা–আমাকেও ছুটতে হল সঙ্গে সঙ্গে।

সন্ধেবেলা গেছি বল্টুদার বাড়িতে। গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে পড়ে আছে বল্টুদা। ঝাঁটার ঘায়ে বল্টুদাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে, ক্ষেমঙ্করী-পিসিমা। উৎসাহ দেবার পালা আমার এবার।

বললুম, কিছু ভেব না বল্টুদা। ঝাঁটার ঘায়ে যদি সারা গা সেপটিক হয়ে যায়–যদি তুমি মারাই যাও তা হলেও কিছু চিন্তা কোরো না। অভিলাষের দোকানে তোমার যে চুয়াল্লিশ টাকা চার আনা পাওনা আছে–সেটা আমিই খেয়ে আসব এখন।

কিন্তু বল্টুদা একদম উৎসাহ পেল না। চেঁচিয়ে আমায় গাল দিতে লাগল : বেরো–বেরো এখান থেকে। উল্লুক-ভাল্লুক-শল্লকী–পক্কবিল্ব–অম্লজান কোথাকার কী ছোটলোক–দেখেছ?

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments