Thursday, April 18, 2024
Homeরম্য গল্পমজার গল্পবিবাহঘটিত - তারাপদ রায়

বিবাহঘটিত – তারাপদ রায়

বিবাহঘটিত - তারাপদ রায়

প্রথম তরঙ্গ: পঙ্কজবাবুর বিপদ

কোট-প্যান্ট পরে অফিসে বেরোচ্ছিলেন পঙ্কজবাবু। অফিসে যাঁর পরিচয় মিস্টার পি. চক্রবর্তী।

যা হোক এটা পারিবারিক কাহিনি। এ গল্পে আমরা তাকে পঙ্কজবাবুই বলব।

পঙ্কজবাবুর স্ত্রীর নাম সুহাসিনী। মহিলার নামটি যে উপযুক্ত নয়, এ গল্প পড়েই পাঠক-পাঠিকারা বুঝতে পারবেন।

কোট পরে টাইয়ের নট বাঁধছেন, রাস্তায় অফিসের গাড়ি হর্ন দিচ্ছে, এমন সময় সুহাসিনী বললেন, ওগো তোমার কোটের পকেটে একটা ফুটো ছিল।

পঙ্কজবাবু নির্বিকার ভাবে বললেন, জানি।

সেই ফুটোটা আমি সেলাই করে ঠিক করে দিয়েছি। সুহাসিনী বললেন।

পঙ্কজবাবু বললেন, সেটাও আমি লক্ষ করেছি।

তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিলে না যে! সুহাসিনী অনুযোগ করলেন।

শুষ্ক কণ্ঠে পঙ্কজ বললেন, তার আগে তুমি আমাকে বলো কী ভাবে তুমি জানতে পারলে যে আমার কোটের পকেটে ফুটো আছে?

.

অবশ্য এই প্রথম নয়।

অন্যান্য অনেক গৃহিণীর মতো স্বামীর পকেট হাতড়ানো সুহাসিনীর হবি। শুধু হবি নয়, পকেট থেকে অর্থাগম যথেষ্ট হয়। স্বামী তার হাতখরচার জন্যে সামান্য দুদশ টাকা যেটুকু আলাদা করে রাখেন, সবটা তার ভোগে লাগে না। স্ত্রীর তার অধিকাংশই গায়েব করেন।

মাত্র দুবছর বিয়ে হয়েছে পঙ্কজ-সুহাসিনীর। প্রায় প্রথম থেকেই সুহাসিনীর হাতসাফাইয়ের দক্ষতা দেখে পঙ্কজ তাজ্জব হয়ে আছেন।

বিয়ের পরে পরেই একদিন সুহাসিনী পঙ্কজকে বললেন, ওগো আমার বিয়ের আংটিটা আঙুল থেকে খসে কোথায় পড়ে গেছে। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও তো পাচ্ছি না।

 পঙ্কজ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তোমার আংটিটা আমার কোটের পকেটে পেয়েছি। এই বলে টেবিলের ড্রয়ার খুলে আংটিটা বার করে পরমযত্নে সুহাসিনীর অনামিকায় পরিয়ে দিলেন।

দুজনায় এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করলেন, অজ্ঞতার ভান করে সুহাসিনী পঙ্কজকে বললেন, আচ্ছা আমার আংটিটা তোমার পকেটে গেল কী করে?

পঙ্কজ ভালই জানেন কী ভাবে সুহাসিনীর আংটিটা তার পকেটে গিয়েছিল। পকেট হাতড়াবার সময় নিশ্চয় খসে পড়েছিল। কিন্তু তার এই অনুমান তিনি নববধূর কাছে ফাঁস করলেন না। তখনও তিনি নববিবাহের অনুরাগে বিহ্বল। তিনি সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সিনেমার খলচরিত্রের মতো বললেন, ম্যাজিক।

পঙ্কজ বললেন বটে ম্যাজিক, কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠল। রীতিমতো আর্থিক দুরবস্থা দেখা দিল পঙ্কজবাবুর জীবনে। ট্যাক্সি থেকে নেমে ট্যাক্সির ভাড়া দিতে যাবেন, দেখেন পকেটে টাকা নেই। বাজারে বা দোকানে জিনিস কিনে দাম দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগে টাকা নেই। অথবা যত টাকা থাকার কথা তা নেই।

বেশ কয়েকবার অপদস্থ হওয়ার পর অবশেষে পঙ্কজ একটা বুদ্ধি বার করলেন। বুদ্ধিটা অবশ্য তার নিজস্ব নয়, এই কৌশলটা তিনি একটা হাসির গল্পে পড়েছিলেন।

সেই গল্প অনুযায়ী তিনি সুহাসিনীকে তাস খেলা শেখাতে লাগলেন। ঠিক তাস খেলা নয়, তাসের জুয়া।

কৌশলটা এই যে বউ টাকাপয়সা যা কিছু সরাবে, জুয়া খেলায় হারিয়ে বউয়ের কাছ থেকে সেটা উদ্ধার করা হবে।

ভালই হচ্ছিল ব্যাপারটা। সুহাসিনী পঙ্কজের পকেট থেকে টাকাকড়ি যা কিছু সরান, কয়েকদিনের মধ্যে সে টাকা জুয়ায় হারিয়ে সুহাসিনীর কাছ থেকে বার করে নেন পঙ্কজবাবু। সন্ধ্যাটা বউয়ের সঙ্গে তাস খেলেই কেটে যায়। সন্ধ্যাবেলায় আগে নিয়মিত ক্লাবে যেতেন পঙ্কজবাবু। কিন্তু বিয়ের পরে দুটো কারণে ক্লাবে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

প্রথম কারণটি হল, নববিবাহের পর বউয়ের প্রতি অনুরাগবশত সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে আর বাড়ি থেকে বেরোতে ইচ্ছে করত না।

অবশ্য দ্বিতীয় কারণটিই হল মুখ্য। পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয় সে কারণটি অনুমান করতে পারছেন। কারণটি হল অর্থাভাব। ক্লাবে গিয়ে খরচ করার মতো কোনও অর্থই পঙ্কজবাবুর পকেটে থাকত না। কোথাও লুকিয়ে রাখার জো-ও ছিল না। সুহাসিনীর অতি শ্যেনদৃষ্টি যেখানেই টাকাপয়সা থাক তাঁর হস্তগত হবেই।

এদিকে সংসার-খরচের, দৈনিক বাজার, মাসকাবারি খরচ এসবের জন্যে যে টাকা প্রয়োজন হয় সে টাকা, সেই সঙ্গে দুশো টাকা হাতখরচ পঙ্কজবাবু মাসের প্রথমে মাইনে পেয়েই সুহাসিনীকে দিয়ে দেন। এই টাকাগুলো কিন্তু সুহাসিনী রীতিমতো হিসেব করে গোছগাছ করে খরচ করেন। বড় জোর, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দিনে মাসের শেষে আরও দুএকশো টাকা তিনি স্বামীর কাছে দাবি করেন।

 পঙ্কজবাবু সেটা দিয়েও দেন। কিন্তু সুহাসিনী পঙ্কজবাবুর ব্যক্তিগত হাতখরচের টাকা সুযোগ পেলেই সরিয়ে ফেলেন। পঙ্কজবাবুর নিজের সাধ-আহ্লাদের জন্যে কোনও পয়সাই প্রায় থাকে না।

সুহাসিনীকে তাসের জুয়া খেলা শেখানোর পর সুহাসিনী বেশ হারতেন। চুরি-যাওয়া প্রায় সমস্ত টাকাই উসুল হয়ে যেত।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুদ্ধিমতী সুহাসিনী জুয়াখেলাতেও বেশ রপ্ত হয়ে গেলেন। তখন কোথায় সুহাসিনীকে পঙ্কজবাবু হারিয়ে হৃত-অর্থ পুনরুদ্ধার করবেন, তা তো নয়ই, বরং পঙ্কজবাবুই হারতে লাগলেন।

ফলে সুহাসিনীর আয় আরও বাড়তে লাগল। একদিকে পকেট-সাফাইয়ের টাকা, অন্যদিকে জুয়োয় জেতা টাকা।

এখন প্রশ্ন হল, এত টাকা দিয়ে সুহাসিনী কী করেন?

এমন হতে পারে যে সুহাসিনীর কোনও অতীত জীবন আছে, প্রাক্তন প্রেমিক আছে। হয়তো কোনও বাউণ্ডুলে কবি, কিংবা ছন্নছাড়া গায়ক বা চিত্রশিল্পী। তাকে মাসে মাসে কিছু সাহায্য করতে হয় সুহাসিনীকে। এমনও হতে পারে কোনও দুষ্টু লোক কোনও অজ্ঞাত গোপন কারণে সুহাসিনীকে ব্ল্যাকমেইলিং করে।

কিন্তু পঙ্কজবাবু জানেন, এসব কিছুই বিশ্বাসযোগ্য নয়। পারিবারিকসূত্রে সুহাসিনীকে তিনি সুদূর বাল্যকাল থেকে জানেন, বিয়ের পরও অনেকটা দেখলেন।

পঙ্কজবাবু স্থিরনিশ্চিত যে তার স্ত্রী সুহাসিনীর কুমারী জীবন সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক, যাকে বলে একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা।

.

তাহলে এসব টাকা নিয়ে সুহাসিনী দেবী কী করেন?

শাড়ি-গয়না কেনেন?

কিন্তু তা তো নয়। তা হলে তো চোখে পড়ত।

বাপের বাড়িতে সাহায্য করেন?

কিন্তু তাও তো নয়। পঙ্কজবাবু ভালই জানেন, সুহাসিনীর পিত্রালয়ের অবস্থা বেশ ভাল। পঙ্কজবাবুর শ্বশুর নামী ব্যাঙ্কে উচ্চপদস্থ অফিসার, শাশুড়ি ঠাকরুণ কলেজে অধ্যাপিকা। দুজনে মিলে অন্তত পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা মাসে আয় করেন। দায়দায়িত্বও বিশেষ কিছু নেই। সুহাসিনীর এক দিদি আছেন, তিনি জামশেদপুরে থাকেন। তারও স্বামীর এঞ্জিনিয়ারিং জিনিসপত্তরের ব্যবসা, বেশ বড়লোক তারা।

তবে?

সুহাসিনী কেন স্বামীর টাকা চুরি করেন? তার এত কী দরকার টাকার?

প্রথম দিকে এ নিয়ে অনেক রকম চিন্তাভাবনা করেছেন পঙ্কজবাবু। ভেবেচিন্তে কোনও লাভ হয়নি, কোনও কূলকিনারা পাননি।

উলটোপালটা টাকা, বেশি বেশি টাকা কাঁদের দরকার পড়ে? যারা রেসের মাঠে যায়, যারা মদ খায় বা অন্য কোনও দামি নেশা করে তাদের খুব টাকার দরকার। কিন্তু সুহাসিনীর এসব দোষ নেই, থাকা সম্ভব নয়। একটু তাসের জুয়াখেলা শিখেছে, সেও পঙ্কজই শিখিয়েছেন।

তাহলে আর কী হতে পারে?

শাড়ি-গয়না, বিলাসসামগ্রী? কিন্তু নতুন বিয়ের পর মেয়েদের এত বেশি গয়নাগাঁটি, দামি শাড়ি, পারফিউম হঠাৎ হয়ে যায় যে বেশ কিছুদিন এ ব্যাপারে নবোঢ়ার মনে অনীহা ভাব থাকে। তা ছাড়া এজাতীয় বিলাসিতার প্রতি সুহাসিনীর যে খুব আকর্ষণ আছে সেটা পঙ্কজবাবুর কখনওই মনে হয়নি।

তা হলে?

অল্প কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপারটা পঙ্কজবাবু টের পেলেন।

একদিন লক্ষ করলেন বাড়িতে প্লাস্টিকের বালতি বড় বেশি হয়ে গেছে। লাল, নীল, হলুদ কতরকমের যে বালতি-বাথরুমেই পাঁচটা, বাথরুমের বাইরে দরজার সামনে দুটো, রান্নাঘরে আট-দশটা, অধিকাংশ জলের জন্যে, যদিও ট্যাপ রয়েছে, দুয়েকটায় অবশ্য চাল-গম রাখা আছে। এ ছাড়া খাটের নীচে সারি সারি নতুন বালতি।

এত বালতি দিয়ে কী হবে? এত বালতি সুহাসিনী পেলেন কোথায়? নিশ্চয় কিনেছেন! কিন্তু কিনলেন কেন?

সুহাসিনীকে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, একটা বালতিও কিনিনি। সব বিনে পয়সায় পেয়েছি।

বিনে পয়সায়? বালতি? পঙ্কজবাবু অবাক। দাঁতব্য ঔষধালয় হয়, দাঁতব্য লঙ্গরখানা হয়, কিন্তু দাঁতব্য বালতি-বিলি হয় একথা ভাবা কঠিন।

ব্যাপারটা সুহাসিনীই খোলসা করলেন। প্রতি পাঁচ কেজি প্যাকেটের গুঁড়ো সাবানের একটা নতুন ব্র্যান্ডের সঙ্গে একটা করে বালতি ফ্রি দিচ্ছে।

আঁতকে উঠলেন পঙ্কজবাবু, এত গুঁড়ো সাবান দিয়ে কী করব আমরা?

সুহাসিনীর পরিষ্কার জবাব, সাবান তো পচবে না। ইস্টুরে-পিঁপড়েতে খেয়ে নেবে না। সব চিলেকোঠা ঘরে জমিয়ে রেখেছি।

এইভাবে শতাধিক জাম্বো সাইজের টুথপেস্ট কিনে সমসংখ্যক ফ্রি টুথব্রাশ সংগ্রহ করেছেন সুহাসিনী। এ জীবনে আর বোধহয় টুথব্রাশ কেনার দরকার হবে না।

এই তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। শুধু আর একটার কথা বলছি। নুনের না মশলার কীসের যেন প্যাকেটের সঙ্গে এক পাতা বিন্দি অর্থাৎ মেয়েদের কপালের টিপ উপহার দিচ্ছে। বাড়িতে পাহাড়প্রমাণ, বারান্দায় চিলেকোঠায় ছাদ পর্যন্ত উঁচু নুন-মশলার প্যাকেট জমে গেছে আর যে পরিমাণ বিন্দি সংগৃহীত হয়েছে তা দিয়ে কলকাতা শহরের সব বয়েসের সব মেয়ের কপালে একটা করে টিপ পরানো যায়।

এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে দূরদর্শনের আপকা বাজার। এই দেখাচ্ছে রুটি বানানোর মেশিন, দাম মাত্র আড়াই হাজার টাকা। ঘর মোছার কল দেড় হাজার টাকা। কাগজ কুচি করার যন্ত্র তিন হাজার টাকা।

 মাসে মাসে বাড়িতে নতুন নতুন যন্ত্র আসছে। হাঁটাচলা অসম্ভব হয়ে গেছে। টাকার ব্যাপারটা আর সামাল দিতে পারছেন না পঙ্কজবাবু। এদিকে সুহাসিনীর কেনাকাটা বেড়েই চলেছে।

দ্বিতীয় তরঙ্গ: পঙ্কজবাবুর প্রতিক্রিয়া

বিয়ের পরে বছর দুয়েক চলে গেছে, এর মধ্যে একটা সন্তান, মেয়ে হয়েছে পঙ্কজ-সুহাসিনীর।

কিন্তু সুহাসিনীর আর্থিক আচরণের মোটেই উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে।

স্টেইনলেস স্টিলের থালাবাসনে বাড়ি ভরতি। এগুলো সুহাসিনী কিস্তিতে কেনেন। ভাগ্যিস আগের নুনের প্যাকেটগুলো গত বর্ষায় গলে জল হয়ে গিয়েছিল! ফলে সেখানে জায়গা বেরিয়েছে, সেই জায়গায় কিস্তিতে কেনা থালা-বাসন, ঘটি-বাটি রাখা হচ্ছে।

.

বাচ্চা হওয়ার পরে সংসারের খরচ অনেকটাই বেড়েছে। এদিকে জিনিসপত্রের দামও হু-হুঁ করে বেড়ে যাচ্ছে। সুহাসিনীর হাতটানও বেড়েছে। পঙ্কজবাবু আর সামাল দিতে পারছেন না।

সুহাসিনী অবশেষে বাজার খরচের টাকাও উলটোপালটা খরচ করা আরম্ভ করেছেন।

ফলে বাড়ির রান্না বান্নার হাল দাঁড়িয়েছে খুবই দুঃখজনক। দুপুরে ভাত-ডাল আর অর্ধেক ডিমের ঝোল। রাতে রুটি আর কুমড়োছক্কা কিংবা বেগুনভর্তা, বড়জোর সস্তার সময়ে আলু-পটল কিংবা আলু-ফুলকপির তরকারি। তবে অধিকাংশ রাতেই আলুচচ্চড়ি।

ঘরের পাপোশগুলো ছিঁড়ে গেছে। জানলা-দরজার পর্দাগুলোও ছিঁড়ে গেছে। তা ছাড়া সেগুলো ময়লা, এত ময়লা যে হাত দিলে আঠা আঠা লাগে। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, স্নানের তোয়ালে ইত্যাদির ভয়াবহ অবস্থা। একদিন পঙ্কজবাবু সুহাসিনীকে ছেঁড়া তোশক আর ছেঁড়া বালিশ দেখিয়ে বলেছিলেন, ঠিক শ্মশানের বিছানার মতো দেখাচ্ছে।

সুহাসিনী ভ্রুক্ষেপ করেননি। প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্যে তার মাথাব্যথা কম।

কিন্তু কিছু মাথাব্যথা পঙ্কজবাবুকে করতেই হয়।

আজকাল বাইরে বেরোনো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কিন্তু অফিসে তো যেতে হয়। জামাকাপড়, জুতোর সঙ্গীন অবস্থা। বছরে দুবার শ্বশুরবাড়ি থেকে পুজোয় এবং জামাইষষ্ঠীতে শার্টপিস, প্যান্টপিস দেয়। কিন্তু সেগুলো তৈরি করতে পয়সা লাগে। তা ছাড়া জুতো, কোট প্যান্ট।

বিয়ের আগের আর্থিক সচ্ছলতার দিনগুলি স্মরণ করে আজকাল প্রায়ই উদাসীন হয়ে যান রিক্ত, নিঃস্ব পঙ্কজবাবু।

তখন পঙ্কজবাবু দামি সিগারেট দৈনিক প্রায় বিশ-পঁচিশটা খেতেন। সপ্তাহে অন্তত দুদিন ক্লাবে বসে বন্ধুদের সঙ্গে দুয়েক পেগ হুইসকি। রবিবারে দুপুরবেলায় এক বোতল বিয়ার। বৎসরান্তে একপ্রস্থ নতুন স্যুট, একজোড়া ভাল জুতো। মাসের প্রথম দিকে চিনে হোটেলে ডিনার কিংবা পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় তন্দুরি। একটু-আধটু ছুটি পেলে পুরী-দিঘা অথবা দার্জিলিং।

পঙ্কজবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবেন, সেই যে বিয়ের পরে মধুচন্দ্রিমায় কালিম্পং গিয়েছিলেন, তারপরে আর কলকাতার বাইরে বেরোনো হয়নি। শুধু অফিস আর বাড়ি, বাড়ি আর অফিস। ক্লাবে-রেস্তোরাঁয় পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।

সাধারণত বউয়েরাই বাইরে যাওয়ার জন্যে, বাইরে খাওয়ার জন্যে জোরাজুরি করে কিন্তু এসব বিষয়ে শ্রীমতী সুহাসিনী নির্বিকার। তার শুধু অবান্তর জিনিস কেনার অফুরন্ত বাসনা।

সেই বাসনাই পঙ্কজবাবুকে ডুবিয়েছে। তিনি কখনও ভাবতে পারেননি কারফাটা শার্ট, ছেঁড়া মোজা, তাপ্লিমারা জুতো, ময়লা ইস্ত্রিহীন পুরনো কোট পরে অফিস যেতে হবে।

 আজকাল সব রকম আর্থিক দুর্গতির জন্যে নিজেকে দুষছেন পঙ্কজবাবু। বারবার মনে মনে। বলছেন, না, বিয়ে করাটা মোটেই ঠিক হয়নি আমার।

এই রকম ভাবতে ভাবতে যেমন হয়, ক্রমশ বিবাহ-বিদ্বেষী হয়ে পড়েছেন তিনি। কোথাও কেউ বিয়ে করছে জানলেই তিনি ভাবী বরকে বিয়ে করা থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন।

এতে যে খুব কাজ হয় তা মোটেই নয়। কেউ বিয়ে করতে চাইলে, তারপর পাত্রী পেয়ে গেলে, তার বিয়ে ঠেকানো মুশকিল। তবু কেউ যাতে নতুন করে বিয়ে করে না পস্তায় সেই জন্যে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পঙ্কজবাবু।

নানাভাবে বিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেন তিনি। দুঃখের বিষয়, কখনও কখনও ভাংচিও দেন। খুব সূক্ষ্ম ভাংচি। অপরিচিতা পাত্রীর নামে কাল্পনিক নিন্দামন্দ নয়, পুরো বিয়ের ব্যাপারটাকেই তিনি ভাংচি দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিবাহিত জীবন যে মোটেই সুখের জীবন নয়, এ কথা তিনি আকারে-প্রকারে হবু বরদের হৃদয়ঙ্গম করানোর চেষ্টা করবেন।

সেই বন্দোবস্তের ব্যাপারটা বলার জন্যই এই বিবাহঘটিত কাহিনি।

অবান্তর প্রসঙ্গ বহু হল। এবার মুল ঘটনা।

সেদিন অফিসে তার এক কনিষ্ঠ সহকর্মী জয়ন্ত, বয়েস বড়জোর পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, এসে পঙ্কজবাবুকে বলল, মি. চক্রবর্তী, সামনের মাসে আমি দুসপ্তাহ ছুটি নিচ্ছি। বড়সাহেব কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, কোনও অসুবিধে হবে না।

সে আমি চালিয়ে নেব, পঙ্কজবাবু বললেন, কিন্তু ছুটি নিচ্ছ কেন?

একটু লজ্জিতভাবে জয়ন্ত বলল, আমি বিয়ে করছি।

বিয়ে! ইলেকট্রিক শক লাগার মতো চমকে উঠলেন পঙ্কজ। মনে মনে ভাবলেন আরেকটা মানুষের দুঃখের দিন ঘনিয়ে আসছে। মনোভাব প্রকাশিত না করে জিজ্ঞাসা করলেন, পাত্রী কেমন?

জয়ন্ত বলল, আমাদের অফিসেরই ডেসপ্যাচ দপ্তরের রমা পাল।

পঙ্কজ জিজ্ঞাসা করলেন, ভাব-ভালবাসা হয়েছে তার সঙ্গে?

জয়ন্ত বলল, ঠিক আমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা এখনও হয়নি। তবে আমার বন্ধু নবীন রমার সঙ্গে দুবছর প্রেম করেছে। নবীন বলেছে, রমা ভাল মেয়ে। ওর কথাতেই বিয়ে করছি।

জয়ন্তর কথা শুনে পঙ্কজ তাজ্জব হয়ে গেলেন। বিয়ের পরে জীবনের স্বাদ কেমন হয় একে টের পাওয়াতে হবে, এই রকম ভেবে নিয়ে তিনি জয়ন্তকে বললেন, কনগ্রাচুলেশন, এর পরে তো সময় পাব না, তুমিও ছুটিতে চলে যাবে, আজকেই সন্ধ্যায় তোমাকে আমি আইবুড়ো-ভাত খাওয়াব।

জয়ন্ত রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল, অফিস ছুটির পর দুজনে একসঙ্গে পঙ্কজবাবুর বাড়িতে যাওয়া হবে।

পঙ্কজবাবু বাড়িতে ফোন করে সুহাসিনীকে জানালেন যে সন্ধ্যাবেলা একজন অতিথি আমাদের সঙ্গে খাবে।

এ কথা শুনে সুহাসিনী আকাশ থেকে পড়লেন, আমাদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যাবেলায় অসম্ভব।

পঙ্কজ বললেন, কেন?

সুহাসিনী বললেন, ভাড়ার শূন্য। ফ্রিজেও কিছু নেই। আলুচচ্চড়ি আর রুটি ছাড়া কিছুই হবে না। তা ছাড়া সামনের দরজার পর্দা থেকে বিছানার বেডকভার সব ঘেঁড়া, ময়লা। ঘরভরতি গাদাগাদা জিনিস, খাওয়ার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছতে গেলে সে-সব টপকাতে হবে। এদিকে মেয়েটার গা। গরম।…

পঙ্কজবাবু আর কথা বাড়াতে দিলেন না। বললেন, এতেই যথেষ্ট হবে।

এসব কাহিনি শেষ হয় না।

শুধু এটুকু না বললে দোষ হবে যে পঙ্কজবাবু যে আশা করেছিলেন যে এতেই যথেষ্ট হবে, তা হয়নি।

সেদিন জয়ন্ত পঙ্কজবাবুর বাড়িতে নৈশাহার করেছিল। বালতির এবং স্টিলের বাসনের পাহাড় ডিঙিয়ে, ময়লা টেবিলে পৌঁছে সে আলুর চচ্চড়ি দিয়ে রুটি রীতিমতো তারিফ করে খেয়েছিল। নোংরা ঘরদোর, ছেঁড়া পর্দা, ময়লা বিছানা কিছুই জয়ন্ত লক্ষ করে দেখেনি। যদিও রুটি দিয়ে আইবুড়ো-ভাত, তবুও আসন্ন বিয়ের মৌতাতে সে এতই মশগুল যে পঙ্কজবাবু কিছুতেই বিবাহিত জীবনের দুর্ভোগ বোঝাতে পারলেন না।

গত শ্রাবণ মাসে যথানির্দিষ্ট দিনে এক বাদল ঝরঝর গোধূলি লগ্নে জয়ন্তের সঙ্গে রমার বিয়ে হয়ে গেছে।

পঙ্কজবাবু অবশ্য জয়ন্তের বিয়েতে যাননি। উপহার কেনার পয়সা তার নেই।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments