Wednesday, August 20, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পবেনেটির জঙ্গলে - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

বেনেটির জঙ্গলে – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

অনেক বছর আগের কথা। তখন আমি সরকারের কৃষিবিভাগের সঙ্গে যুক্ত। আমার কাজ ছিল গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে চাষ-আবাদের তদারক করা। চাষের ব্যাপারে চাষিদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখা। কোনো অঞ্চল থেকে হয়তো খবর এল, ধান গাছ সেরকম বাড়ছে না, কিংবা পাতাগুলো হলদে হয়ে যাচ্ছে। নয়তো নারকেল গাছে ফল ধরবার আগেই ঝরে পড়েছে, বেগুনে কালো দাগ হচ্ছে, পোকায় পাট গাছ খতম করে দিচ্ছে, অমনি আমাকে ওষুধবিসুধ নিয়ে ছুটতে সে অঞ্চলে। নিজের চোখে সব দেখে ব্যবস্থা করতে হত।

কাজটা আমার খুব ভালো লাগত। যাওয়া-আসা দৌড়ঝাঁপে কষ্ট হয়তো একটু হত, কিন্তু বয়স কম থাকার জন্য সেসব কষ্ট আমার গায়েই লাগত না। সত্যি কথা বলতে কী, দিল্লি, আগ্রা, পুরী, হরিদ্বারের চেয়ে এইসব গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে আমার ভালোই লাগত। এইসব জায়গায় গেলে আমার দেশ আর দেশের মানুষকে ভালোভাবে চিনতে পারা যায়।

তা ছাড়া আমি গেলে চাষিমহলে একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত। কে আমাকে কী খাওয়াবে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা। কেউ মুড়ি আনত, কেউ গুড়, কেউ-বা আবার খেতের শাকসবজি, ফলপাকুড়। চলে আসবার সময় সবাই দল বেঁধে আমাকে জিপে তুলে দিত, কিংবা আসত বাসের রাস্তা পর্যন্ত।

এ চাকরিও একদিন ছেড়ে দিলাম। কেন দিলাম সেই কথাটাই তোমাদের বলি।

হঠাৎ আতাপুর থেকে খবর এল, সেখানকার চাষিরা মাথায় হাত দিয়ে পড়েছে। লাউ গাছে ফুল হয়েই শুকিয়ে যাচ্ছে। ফল ধরছে না।

আতাপুর লাউয়ের জন্য বিখ্যাত। যেমন আকার, তেমনই স্বাদ। এই লাউ শহরে প্রচুর চালান আসে— তানপুরা তৈরির জন্য।

শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ক-দিন আগে জ্বর থেকে উঠেছি, এখনও বেশ দুর্বল। কিন্তু উপায় নেই। আতাপুরের চাষিদের বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে।

আরও এক অসুবিধা হল। আমাদের তাঁবে তিনটে জিপ। দুটো গেছে নবদ্বীপ আর বীরভূমের দিকে। বাকি যেটা আছে, সেটা অচল। ইঞ্জিন মেরামতের কাজ চলছে।

অগত্যা বাসে যাওয়াই ঠিক করলাম। তার আগে কৃষি বিষয়ের বইগুলো পড়ে নিলাম। কেন অকালে লাউয়ের ফুল ঝরে যাচ্ছে। কিছু ওষুধপত্রও ব্যাগে ভরলাম।

অশুভক্ষণেই বোধ হয় যাত্রা শুরু করেছিলাম। মাইল পঁচিশ-ছাব্বিশ গিয়েই বাস থেমে গেল। আর এগোবার উপায় নেই।

সামনে কয়াল নদী। অন্য সময়ে এই নদী রুপোলি সুতোর মতন পাশে পড়ে থাকে। ছোটো একটা কাঠের পুল। এখন কাঠের পুলের চিহ্ন নেই।

নেমে দাঁড়ালাম। এখন উপায়। পাশে একটা টিনের চালা ছিল। চায়ের দোকান। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, গত তিনদিন ধরে এ এলাকায় একটানা বৃষ্টি হয়েছে। মাত্র আজ সকালে থেমেছে। ফলে আশপাশের নদীনালা কূল ছাপিয়ে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে গেছে। চাষবাস সব নষ্ট। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।

সর্বনাশ, এখন কী উপায় হবে! এতটা পথ এসে ফিরেই বা যাই কী করে! চায়ের দোকানের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম।

লোকটা মাথা চুলকে বলল, ‘আতাপুরের খবর ঠিক জানি না। তবে গাঁটা একটু উঁচু জমির ওপর। বোধ হয় বন্যার জল ঢোকেনি।’

‘আতাপুরে যাব কী করে?’

‘কেন, নৌকা করে বল্লভডাঙা চলে যান। সেখানে থেকে পায়ে হাঁটা রাস্তা আছে। রাইচণ্ডী হয়ে আতাপুর। তবে পথে জল পড়বে কিনা জানি না।’

ঠিক করলাম বরাত ঠুকে রওনাই হব। আকাশের অবস্থা খুব ভালো নয়। বৃষ্টি থেমেছে বটে, তবে আকাশ জুড়ে কালো মেঘ ঘোরাফেরা করছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে।

তার ওপর ফিরে যাবার রাস্তাও বন্ধ। বাস ফেলে রেখে ড্রাইভার আর কনডাক্টর সরে পড়েছে।

সামনে দেখলাম কয়াল নদীতে গোটা তিনেক নৌকা পারাপার করছে। ব্যাগ কাঁধে ফেলে একটা নৌকায় চেপে বসলাম।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই ওপারে বল্লভডাঙা পৌঁছে গেলাম। রাইচণ্ডী পর্যন্ত অনেকেই সঙ্গী হল। তারপর আতাপুরের রাস্তায় আমি একলা। মনে হল এদিকে বন্যার প্রকোপ বেশি নেই, কিন্তু আতাপুরের কাছাকাছি গিয়েই দেখলাম, দু-পাশে জলের স্রোত। খেতখামার সব জলের তলায়। দু-পাশের বাড়ি খালি। লোকজন সব সরে গেছে।

গাঁয়ের মাঝখানে কৃষি বিভাগের বাড়ি। একতলায় অফিস, দু-তলায় থাকার ব্যবস্থা। আমি এলে দু-তলাতেই থাকি।

অফিসের সামনে গিয়ে যখন পৌঁছোলাম, তখন অন্ধকার নেমেছে। চারিদিকে ব্যাঙ আর তক্ষকের ডাক।

ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে দরজার ওপর আলো ফেললাম। দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে।

সর্বনাশ! এখানে রাতটা কাটাব কোথায়? ব্যাগের মধ্যে পাঁউরুটি আর কলা এনেছিলাম, তাও শেষ হয়ে গেছে। আশপাশের বাড়ি বন্ধ। লোকেরা আশ্রয়ের জন্য যে যেখানে পেরেছে, পালিয়েছে। যদিও আতাপুর গ্রামটা উঁচু জায়গায়, তবুও জোর করে কিছু বলা যায় না। বন্যার জল বাড়লেই গ্রামে ঢুকে পড়বে।

নিরুপায় হয়ে এদিক-ওদিক দেখলাম। কোথাও কেউ নেই। রাতটা হয়তো অভুক্ত অবস্থায় কৃষি অফিসের বারান্দাতেই কাটাতে হবে। সেটা মোটেও নিরাপদ নয়।

কিছুটা এগোতেই নজরে পড়ল পাশের একটা কুঁড়েঘর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। তার মানে লোক আছে ভেতরে।

এগিয়ে গিয়ে। বললাম, ‘কে আছ, বাইরে এসো।’

দীর্ঘ একটা ছায়া। কাছে আসতে লণ্ঠনের আলোয় চিনতে পারলাম। তিলক। কৃষি অফিসের বেয়ারা। সকলের ফাইফরমাস খাটে।

ধড়ে প্রাণ এল। তিলকের কাছে নিশ্চয় অফিসের চাবি আছে। বাইরে রাত কাটাতে হবে না।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমার চিঠি তোমরা পাওনি?’

তিলক খনখনে গলায় উত্তর দিল, ‘আর চিঠি? চারদিকে যা ব্যাপার, পিয়নই আসছে না কদিন ধরে। চিঠি বিলি করবে কে?’

‘দাও, অফিসঘরের চাবিটা দাও।’

‘চাবি তো সুনন্দবাবুর কাছে। তিনি চাবি দিয়ে চলে গেছেন।’

‘চলে গেছেন? কোথায়?’

‘তাঁর বাড়ি নন্দীপুর।’

নন্দীপুরে সুনন্দবাবুর বাড়ি তা জানতাম। আতাপুর আর নন্দীপুর পাশাপাশি গ্রাম। মাঝখানে আড়াই মাইল। আড়াই মাইল পথ হয়তো বেশি নয়, কিন্তু দু-গ্রামের মধ্যে ঘন জঙ্গল। একপাশে শ্মশান।

দিনের বেলা খুব প্রয়োজন না হলে জঙ্গলে কেউ ঢোকে না। বছর খানেক আগে সুনন্দবাবুর সঙ্গে একবার তার বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু সে দিনের বেলা। তাও দেখেছি ঝুপসি অন্ধকার।

তিলকের কুঁড়ের যা অবস্থা তাতে রাত কাটানোর প্রশ্নই ওঠে না।

একমাত্র উপায় নন্দীপুর চলে যাওয়া। আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো রয়েছে। পথ চলতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

তিলককে তাই বললাম, ‘তাহলে আমি নন্দীপুরে চলে যাই।’

‘এই রাতে?’

‘এ ছাড়া আর উপায় কী? এখানে থাকব কোথায়? খাব কী?’

‘তা অবশ্য ঠিক। চলে যান রাম নাম করতে করতে।’

‘রাম নাম করতে হবে কেন?’

‘মাঝখানে শ্মশান পড়বে তো। অপদেবতাদের উপদ্রব। তাই বলছি।’

ভূতের ভয় আমার কোনোকালেই ছিল না। কাজেই সেদিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই। একমাত্র ভয় ছিল দুর্ব,ত্তদের।

কিন্তু দুর্বৃত্তরা আমার কীই-বা নেবে। হাতঘড়ি, টর্চ আর সামান্য কিছু টাকা।

এসব ভেবে কোনো লাভ নেই। নন্দীপুর যাওয়া ছাড়া আমার আর অন্য পথ ছিল না। আড়াই মাইল পথ যেতে বড়োজোর আড়াই ঘণ্টা লাগবে। একবার সুনন্দবাবুর বাড়ি গিয়ে পৌঁছোতে পারলে আহার-আশ্রয় দুই মিলবে।

ব্যাগটা কাঁধে ফেলে চলতে শুরু করলাম।

পথ যতটা সহজ হবে ভেবেছিলাম ততটা হল না। একেবারে অন্ধকার বন। বট, পাকুড় আর অশ্বত্থের জটলা। গাছ থেকে বিরাট সব ঝুরি নেমে জায়গাটা অন্ধকার করে রেখেছে। চাঁদের আলো গাছের পাতায় ঢাকা পড়ে গেল।

টর্চ জ্বাললাম। পায়ে চলা সুরু পথ। ভূতপ্রেতের ভয় হয়তো করি না, কিন্তু সাপখোপের উপদ্রব তো আর উপেক্ষা করতে পারি না। সাবধানে এদিক-ওদিক দেখে এগোতে লাগলাম।

একমাত্র ভরসার কথা, হাঁটু পর্যন্ত গামবুট ঢাকা। ছোবলে বিশেষ ক্ষতি হবে না।

এ জঙ্গলটির নাম বেনেটির জঙ্গল। কেন এ নাম জানি না। জানবার কোনো আগ্রহ ছিল না। কোনোরকমে এটা পার হতে পারলে বাঁচি।

অনেকক্ষণ ঘোরার পর খেয়াল হল। টর্চের আলোয় হাতঘড়িতে দেখলাম তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যেভাবে হাঁটছি এতক্ষণে নন্দীপুরে পৌঁছে যাবার কথা। তাহলে নিশ্চয় পথ হারিয়েছি।

চলার গতি আরও দ্রুত করলাম। খিদেয় পেট জ্বলছে। শরীরও দুর্বল লাগছে। কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে অন্ধকারে জমাট-বাঁধা জোনাকির মতন কী সব জ্বলছে!

টর্চের আলো ফেলতেই সেগুলো সরে গেল। বুঝতে পারলাম শেয়ালের পাল। টর্চটা এদিক-ওদিক ঘোরাতেই দেখলাম চারদিকে মড়ার খুলি আর হাড় ছড়ানো। তার মানে শ্মশান। নন্দীপুর যেতে ডানদিকে শ্মশান পড়ে। শ্মশানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। তাহলে নির্ঘাৎ ভুল করেছি।

শ্মশান ডানদিকে রেখে হিসাব করে পথ বদলালাম। কয়েক পা যেতেই ঠক করে কপালে একটা গাছের ডাল লাগল।

উঃ করে কপাল চেপে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর টর্চের আলো ওপর দিকে ফেলতেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।

একটা পা! গাছের ডাল থেকে ঝুলছে!

কেউ বোধ হয় কাউকে মেরে গাছের ডালে টাঙিয়ে রেখেছে। কিন্তু টর্চের আলো যতদূর গেল, কেবল পা-ই দেখতে পেলাম। শরীরটা কোথায় গেল?

কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়েই বিপত্তি। আবার মাথায় লাগল।

ওপরে চেয়ে দেখি, সেই পা।

কী আশ্চর্য, পা-টা এদিকে এল কী করে? যেদিক যাচ্ছি পা-টাও সেদিকেই ঘুরছে। শরীর ছাড়া পা-ই বা গাছের ডালে কে ঝুলিয়ে রাখল!

মাথা নীচু করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই নাঁকি সুর কানে এল।

‘অঁ চাটুঁজ্যে মশাঁই শোঁন, শোঁন, কঁথা আঁছে।’

এই এতক্ষণ পরে বুকটা কেঁপে উঠল। কাটা পা দেখে ভেবেছিলাম, কোনো বদমায়েশ লোক হয়তো কাউকে কেটে তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে গাছের ডালে টাঙিয়ে রেখেছে। কিন্তু এধরনের গলার স্বর গাছের ওপর থেকে আসছে কী করে?

কেউ কি গাছের ডালে বসে ভয় দেখাচ্ছে?

ওপরের দিকে চেয়েই চমকে উঠলাম। টর্চের আলোয় যা দেখলাম, তাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

বিরাট একটা কঙ্কাল! মাথাটা গাছের মগডাল ছাড়িয়ে। কঙ্কালের চোখ সচরাচর যেমন হয়, গর্ত নেই, তার বদলে লাল দুটি সার্চলাইট। আলো দুটো অনবরত ঘুরছে। কাঁধের ওপর ধবধবে একটা পৈতা।

অস্বীকার করব না, লোকে আমাকে খুবই সাহসী বলে জানত। আমি নিজেও ভূতপ্রেতের কাহিনিকে একদম পাত্তা দিতাম না। হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু সে রাতে বেনেটির জঙ্গলে চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তা জীবনে ভুলতে পারব না। সে কথা মনে হলে এখনও মাঝরাতে শিউরে উঠি।

ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে আমি বিদ্যুৎবেগে ছুটতে আরম্ভ করেছিলাম।

‘কিঁ হঁলরে, ছুঁটছিস কেঁন, কঁথাটা শুঁনে যাঁ।’

মনে হয়েছিল গলাটা যেন ক্রমেই কাছে আসছে। প্রত্যেক গাছের ডালে বিরাট আকারের সেই কঙ্কাল-পা।

নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেরে আমি পাগলের মতন ছুটতে শুরু করেছিলাম। কাঁটাগাছ লেগে হাত-পা ক্ষত-বিক্ষত, কতবার যে গাছের শিকড়ে পা আটকে পড়েছিলাম, তার ঠিক নেই।

তবু সেই নাঁকি সুর থেকে রেহাই নেই।

‘ওঁরে তুঁইও বাঁমুন, আঁমিও বাঁমুন। তোঁকে কিঁছু কঁরব না। একটু দাঁড়া।’

বেনেটির জঙ্গল ছাড়িয়ে যখন সুনন্দবাবুর দরজায় পৌঁছেছিলাম, তখন রাতের অন্ধকার কেটে ভোর হচ্ছে। শরীরে আর একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। কোনোরকমে একবার দরজার কড়া নেড়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।

যখন জ্ঞান হয়েছিল, দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে সুনন্দবাবু। একটা চেয়ারে ডাক্তার।

চোখ খুলতেই ডাক্তার বলল, ‘আর ভয়ের কিছু নেই। একটু গরম দুধ খাইয়ে দিন। আমার সঙ্গে কাউকে পাঠান, ওষুধ নিয়ে আসবে।’

বিকালের দিকে শরীর ঠিক হয়ে গেল। বিছানার ওপরে উঠে বসলাম।

সুনন্দবাবু বলল, ‘কী হয়েছে বুঝতে পেরেছি স্যার। বেনেটির জঙ্গলে দুর্লভ চক্রবর্তীর পাল্লায় পড়েছিলেন।’

‘দুর্লভ চক্রবর্তী?’

‘হ্যাঁ, আমাদের গাঁয়ের পুরোহিত। অপঘাত মরে বেচারি ব্রহ্মদৈত্য হয়ে রয়েছে। বামুন দেখতে পেলেই অনুরোধ করে, গয়ায় পিণ্ড দেবার জন্য।’

‘অপঘাতে মারা গেছে?’

‘হ্যাঁ স্যার। শুনুন বলি কাহিনিটা।’

সুনন্দবাবু বলতে শুরু করল—

‘দুর্লভ চক্রবর্তী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। আশপাশের গাঁয়ে পুজো, বিয়ে, পইতে, অন্নপ্রাশনের কাজ করে যা উপায় করতেন তাতেই তাঁর বেশ চলে যেত। বাড়িতে শুধু বউ আর একটা ছেলে। কিন্তু ভগবান মানুষকে সব সুখ দেন না। ছেলেটা বিশ্ববখাটে। লেখাপড়া করলই না। বদমায়েশির জন্য স্কুল থেকে নাম কেটে দিয়েছিল। বাপ বুঝিয়েছিলেন, আমার সঙ্গে চল বাড়ি বাড়ি, পুজোর কাজ শিখবি। ছেলে সেসব কথা কানেও তুলত না।

একদিন অবস্থা চরমে উঠেছিল। দুর্লভ চক্রবর্তীর জ্বর। অথচ গাঁয়ের জমিদার বাড়িতে নারায়ণ পূজা। জমিদারি আর নেই, কিন্তু জমিদার বাড়ি নামটা আছে। মাসকাবারি বন্দোবস্ত। ভালোই দক্ষিণা।

দুর্লভ চক্রবর্তী ছেলের খোঁজ করলেন। ছেলে নেই, ভোরে আড্ডা দিতে বেরিয়েছে। জমিদার বাড়ির লোক এসে চেঁচামেচি করে গেল।

ছেলে ফিরল দুপুর বেলা। দুর্লভ চক্রবর্তী কাঁথা জড়িয়ে দাওয়ায় বসেছিলেন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে। ছেলেকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করলেন। খড়ম ছুড়লেন। খড়ম ছেলের গায়ে লাগল না।

ছেলেটিও অকালকুষ্মাণ্ড। উঠানের ওপর একটা বাঁশ পড়েছিল, তাই তুলে নিয়ে সোজা বাপের মাথায়।

দুর্লভ চক্রবর্তী ছিটকে পড়েছিলেন। চারদিকে রক্তস্রোত। ছেলে নিখোঁজ।

কবিরাজ আসার আগেই সব শেষ। সেই থেকে দুর্লভ চক্রবর্তী বেনেটির জঙ্গলে বট গাছের ডালে বাসা বেঁধেছেন। কারও ক্ষতি করেন না। কেবল বামুন দেখলেই অনুরোধ করে গয়ায় পিণ্ড দেবার জন্য।’

অন্য সময় হলে আমি সুনন্দবাবুর কথাগুলো বিশ্বাসই করতাম না, কিন্তু কানে তখনই সেই নাঁকি সুর ভেসে আসছে। অঁ চাঁটুজ্যে মঁশাই, শোঁন, শোঁন। চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেলাম বীভৎস কঙ্কালমূর্তি! কাঁধে পৈতা, দুটি চোখে আগুনের গোলা।

শহরে ফিরে এসেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments