Sunday, August 24, 2025
Homeরম্য গল্পব্যাঙের রাজা - সুকুমার রায়

ব্যাঙের রাজা – সুকুমার রায়

রাজবাড়িতে যাবার যে পথ, সেই পথের ধারে প্রকাণ্ড দেয়াল, সেই দেয়ালের একপাশে ব্যাঙেদের পুকুর। সোনাব্যাং, কোলাব্যাং, গেছোব্যাং, মেঠোব্যাং— সকলেরই বাড়ি সেই পুকুরের ধারে। ব্যাঙেদের সর্দার যে বুড়ো ব্যাং, সে থাকে দেয়ালের ধারে, একটা মরা গাছের ফাটলের মধ্যে, আর ভোর হলে সবাইকে ডাক দিয়ে জাগায়— “আয় আয় আয়— গ্যাঁক্‌ গ্যাঁক্‌ গ্যাঁক্‌— দেখ্‌ দেখ্‌ দেখ্‌— ব্যাং ব্যাং ব্যাং— ব্যাঙ্গাচি।” এই ব’লে সে অহংকারে গাল ফুলিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, আর ব্যাংগুলো সব “যাই যাই যাই— থাক্‌ থাক্‌ থাক্‌” ব’লে, ঘুম ভেঙে, মুখ ধুয়ে দাঁত মেজে, পুকুর-পারের সভায় বসে।

একদিন হয়েছে কি, সর্দার ব্যাং ফুর্তির চোটে লাফ দিয়েছে উলটোমুখে ডিগবাজি খেয়ে— আর পড়বি তো পড়, এক্কেবারে দেয়াল টপকে রাজপথের মধ্যিখানে! রাজা তখন সভায় চলেছেন, সিপাইশান্ত্রী লোকলস্কর দলবল সব সঙ্গে চলেছে। মোটা মোটা সব নাগ্‌রাই জুতো, খট্‌মট্‌ ঘ্যাঁচ্‌ম্যাঁচ্‌ ক’রে ব্যাং বুড়োর মাথার উপর দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে এমনি রোখ ক’রে চলতে লেগেছে, যে ভয়ে ব্যাঙের প্রাণ তো যায় যায়! হঠাৎ কোত্থেকে কার একটা লাঠি না ছাতা না কিসের গুঁতো এসে এমনি ধাঁই করে ব্যাঙের গায়ে লেগেছে যে সে বেচারা ঠিক্‌রে গিয়ে পথের ধারে ঘাসের উপর চিৎপাত হয়ে পড়েছে। ব্যাং বুড়োর খুব লেগেছিল, কিন্তু হাতও ভাঙেনি, পাও ভাঙেনি, সে আস্তে আস্তে উঠে বসল— আর চারিদিকে তাকিয়ে, দেয়ালের গায়ে একটা ফাটল দেখে, তাড়াতাড়ি তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে খুব সাবধানে মুখ বার ক’রে সে চেয়ে দেখল, মাথায়-মুকুট রঙ্গিন-পোশাক রাজা, আলো-ঝল্‌মল্‌ চতুর্দোলায় চড়ে সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা সব “রাজা, রাজা” ব’লে নমস্কার করছে, নাচছে, গাইছে আর ছুটোছুটি করছে। আর রাজামশাই চতুর্দোলায় ব’সে খুশি হয়ে, এর দিকে তাকাচ্ছেন, ওর দিকে তাকাচ্ছেন, আর কেবলই হাসছেন। তাই দেখে ব্যাঙের বড় ভালো লাগল, সেও দু’হাত তুলে নমস্কার করতে লাগল আরে বলতে লাগল, “রাজা রাজা রাজা— রাজা রাজা রাজা—” তার মনে হল রাজামশাই ঠিক যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিক্‌ ক’রে হেসে ফেললেন! ব্যাং তখন কাঁদ কাঁদ হয়ে নিশ্বাস ফেলে ভাবল, “আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!”

তারপর ঘুরে ঘুরে পথ খুঁজে খুঁজে ব্যাং যখন বাসায় ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সবাই বলল, “সর্দার বুড়ো, সর্দার বুড়ো, সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা যে কত ডাকলাম, কত খুঁজলাম, তুমি তো কই সাড়াও দিলে না।” সর্দার বলল— “চোপ্‌ চোপ্‌ চোপ্‌ রাও! রাজা দেখতে গিয়েছিলাম।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সব এক সঙ্গে “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” ব’লে চেঁচিয়ে উঠল। বুড়ো তখন গাল ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে, দ’চোখ বুজে, দু’হাত তুলে লাফিয়ে বলল, “রাজা হচ্ছে এই এত্তো বড়ো উঁচু, আর ধব্‌ধবে সাদা আর ঝক্‌ঝকে আলোর মতো— আর তাকে দেখলেই সবাই মিলে ডাকতে থাকে— ‘রাজা রাজা রাজা রাজা’।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সবাই বলতে লাগল, “আহা! আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!” তাদের যে রাজা নেই, এই কথা ভাবতে ভাবতে তাদের চোখ দিয়ে ঝরঝর ক’রে জল পড়তে লাগল। বুড়ো ব্যাং বলল, “ভাই সকল, এস আমরা রাজার জন্য দরখাস্ত করি।” তখন সবাই মিলে গোল হয়ে ব’সে, আকাশের দিকে চোখ তুলে, নানান্‌ সুরে ডাকতে লাগল— “রাজা রাজা রাজা রাজা— রাজা রাজা রাজা রাজা— রাজা চাই রাজা চাই— রাজা চাই রাজা চাই।”
ব্যাংপুকুরের ব্যাং দেবতা— যিনি বাদ্‌লা দিনে বর্ষা মেঘের ঝাঁঝরি দিয়ে পুকুর ভরে জল ঢালেন— তিনি তখন আকাশতলায় চাদর মেলে ঘুমচ্ছিলেন। হঠাৎ ব্যাঙেদের চীৎকারে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, “বৃষ্টিও নেই, বাদ্‌লাও নেই, মেঘের কোনো চিহ্নও নেই, বাছারা সব চেঁচাও কেন?” ব্যাঙেরা বলল, “আমাদের রাজা নেই, রাজা চাই।” দেবতা বললেন, “এই নে রাজা।” ব’লে মরা গাছের একখানা ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিলেন।

ভাঙা ডাল পুকুরপাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল— তার মাথার উপর মস্ত মস্ত ব্যাঙের ছাতা জোছনায় চক্‌চক্‌ করতে লাগল। তাই দেখে ব্যাঙের ফুর্তি আর ধরে না। তারা গোল হয়ে ঘিরে ব’সে মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গাইতে লাগল— “রাজা রাজা রাজা রাজা— রাজা রাজা রাজা রাজা —”

এমনি ক’রে দু’দিন যায়, দশদিন যায়, শেষটায় একদিন সর্দার গিন্নী বললেন, “ছাই রাজা! কর্তা যে সেদিন রাজা দেখলেন, এর চেয়ে সে অনেক ভালো। এ রাজা নড়েও না চড়েও না, এদিকেও চায় না ওদিকেও চায় না— ছাই রাজা!” তাই শুনে সবাই বলল, “ছাই রাজা! ছাই রাজা!— নড়েও না চড়েও না, দেখেও না শোনেও না— ছাই রাজা!” তখন আবার বুড়ো ব্যাং গাছের উপর চড়ে বলল, “ভাই সকল, এস আমরা দরখাস্ত করি— আমাদের ভালো রাজা চাই।” আবার সবাই গোল হয়ে ব’সে আকাশপানে চোখ তাকিয়ে নানান্‌ সুরে ডাকতে লাগল— “রাজা চাই! রাজা চাই! ভালো রাজা— নতুন রাজা।” তাই শুনে ব্যাং দেবতা জেগে বললেন, “ব্যাপারখানা কী? এই তো সেদিন তোদের রাজা দিলাম, এর মধ্যে আবার নতুন কী হল?” ব্যাঙেরা বলল, “ও রাজা ছাই রাজা! ও রাজা বিশ্রী রাজা— ও রাজা নড়েও না চড়েও না— ও রাজা চাই না চাই না চাই না চাই না চাই না চাই না—” ব্যাং দেবতা বললেন, “থাম তোরা থাম্‌— নতুন রাজা দিচ্ছি।” এই ব’লে একটা বককে সেই পুকুরের ধারে নামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “এই নে তোদের নতুন রাজা।”

তাই না দেখে ব্যাঙেরা সব আবাক হয়ে বলতে লাগল, “বাপ্‌রে বাপ্‌! কি প্রকাণ্ড রাজা!” চক্‌চকে ঝক্‌ঝকে ধব্‌ধবে সাদা! ভালো রাজা! সুন্দর রাজা! রাজা রাজা রাজা রাজা।” বকের তখন খিদে ছিল না, মাছ খেয়ে পেট ভরা ছিল, তাই সে কিছু বলল না; খালি চোক মিট্‌মিট্‌ ক’রে একবার এদিকে তাকাল, একবার ওদিকে তাকাল, তারপর এক পা তুলে চুপচাপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইল। তাই দেখে ব্যাঙেদের উৎসাহ আর ধরে না, তারা প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল। সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল হল, সন্ধ্যা হল— তারপর ঘুট্‌ঘুটে অন্ধকার রাত্রি এল— তখন ব্যাঙেদের গান গাওয়া বন্ধ হল।

তার পরের দিন সকালবেলায় উঠে যেমনি তারা গান ধরেছে, অমনি বকরাজা এসে একটা গোব্‌দামতন মোটা ব্যাংকে টপাস্‌ ক’রে মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে! তাই দেখে ব্যাঙেরা সব হঠাৎ কেমন মুষড়ে গেল— তাদের “রাজা রাজা”র গান একেবারে পাঁচ সুর নেমে গেল। বকরাজা ব্যাংটিকে দিয়ে জলযোগ ক’রে একটি ঠ্যাং মুড়ে ধ্যান ক রতে লাগলেন। এমনি ক’রে এক-এক বেলায় এক-একটি ক’রে ব্যাং বকরাজার পেটের মধ্যে যায়। ব্যাং-মহলে হৈ চৈ লেগে গেল। সবাই মিলে সভায় ব’সে যুক্তি ক’রে বলল, “এটা বড় অন্যায় হচ্ছে। রাজাকে বুঝিয়ে বলা দরকার, সে হল আমাদের রাজা, সে এমন করলে আমরা পালাই কোথা?” কিন্তু বুঝিয়ে বলবে কে? সর্দার গিন্নী বললেন, “তার জন্য ভাবছিস্‌ কেন? এতে আরে মুশকিল কিসের? এই দেখ্‌ না, আমিই গিয়ে ব’লে আসছি।”

সর্দার গিন্নী বকরাজার পায়ের সামনে গ্যাঁট হয়ে ব’সে, হাতমুখ নেড়ে কড়্‌কড়ে গলায় বলতে লাগলেন, “ও রাজা, তোর ভাগ্যি ভালো, তুই আমাদের রাজা হলি। তোর চোখ ভালো, মুখ ভালো, ঝক্‌ঝকে রঙ ভালো, তোর এক পা-ও ভালো, দুই পা-ও ভালো, কেবল ঐটি তোর ভালো নয়, তুই আমাদের খাস কেন? শামুক আছে, শামুক খা’ না, পোকা মাকড় প্রজাপতি তাও তো তুই খেতে পারিস। রাজা হয়ে আমাদের খেতে চাস? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা — রাম রাম রাম রাম— অমন আর কক্ষনো করিসনে।” বক দেখলে তার পায়ের কাছে দিব্যি একটা নাদুসনুদুস ব্যাং, তার নরম নরম গোলগাল চেহারা! টপ্‌ ক’রে বকরাজার জিভ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল আর খপ্‌ ক’রে সর্দার গিন্নী তার মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

ব্যাঙেদের মুখে আর কথাটি নেই। সবাই তাড়াতাড়ি চট্‌পট্‌ সরে ব’সে বড় বড় হাঁ ক’রে তাকিয়ে রইল। পরে সর্দার ব্যাং রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, “পাজি রাজা! লক্ষীছারা দুষ্টু রাজা!” তাই শুনে সবাই একসঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, “পাজি রাজা! দুষ্টু রাজা!— চাই না চাই না চাই না চাই না— রাজা চাই না, রাজা চাই না।”

ব্যাং দেবতা জেগে বললেন, “দূর ছাই! আবার কী হল?” ব্যাঙেরা বলল, “বাপ্‌রে বাপ্‌! বাপ্‌রে বাপ্‌! কী দুষ্টু রাজা! নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও!”

তখন ব্যাং দেবতা হুশ্‌ ক’রে তাড়া দিতেই বকরাজা পাখা মেলে উড়ে পালাল। আর ব্যাঙেরা সব বাসায় গিয়ে বলতে লাগল, “গ্যাঁক্‌ গ্যাঁক্‌ গ্যাঁক্‌ — বাপ্‌ বাপ্‌ বাপ্‌— ছ্যা ছ্যা ছ্যা— রাজাটাজা আর কক্ষনো চাইব না।”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments

error: Content is protected !!