Friday, April 19, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পআজমগড়ের অশরীরী - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আজমগড়ের অশরীরী – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আজমগড়ের অশরীরী - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

তখন আমি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করছিলুম। সেই কাজে আমাকে আজমগড়ে যেতে হয়েছিল।

আজমগড় উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে একটা ছোট্ট শহর। সেখানে একটা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ আছে। তবে ওটা দেখবার জন্য পর্যটকদের বিশেষ উৎসাহ নেই। ওখানে বিশাল গঙ্গার বুকে একটা চরে পক্ষীনিবাস আছে। পাখি দেখবার জন্যই শীতকালে পর্যটকদের ভিড় হয়। ধ্বংসস্তূপ দেখে কে-ই বা আনন্দ পায়?

আমি গিয়েছিলুম মার্চের গোড়ার দিকে। তখন আর তত শীত ছিল না। পর্যটকদের ভিড়ও ছিল না। ভাঙাচোরা নবাবি প্রাসাদের পাশে গঙ্গার তীরে প্যালেস হোটেলে উঠেছিলুম। পর্যটন মরশুমের শেষে এই দোতলা থ্রি-স্টারমার্কা হোটেলে তখন ঘরভাড়াও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

হোটেলের ম্যানেজার সুখলাল ঠাকুর খুব অমায়িক মানুষ। আমি সিপাহিবিদ্রোহ সম্পর্কে গবেষণা করছি জেনে খুব খাতির করেছিলেন। সিপাহিবিদ্রোহের অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। এসব গল্প নিছক গল্পই। আমার গবেষণায় তা কাজে লাগবে না। তবে ওঁর এ কথাটি অবশ্যই খাঁটি। এই আজমগড়ে সিপাহিদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে অনেক হিন্দু-মুসলিম সাধারণ মানুষও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

মিঃ ঠাকুর শুধু একটা ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সূর্যাস্তের পর আমি যেন কেল্লাবাড়ি এলাকায় না থাকি। তাঁকে প্রশ্ন করে কোনও যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাইনি। তিনি মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে শুধু বলেছিলেন, সূর্যাস্তের পর ওই এলাকায় থাকলে বিপদ হতে পারে।

–কী বিপদ?

প্যালেস হোটেলের ম্যানেজার কিছু বলতে যাচ্ছেন, এমনসময় কজন সায়েব-মেম দলবেঁধে হোটেলের লাউঞ্জে ঢুকলেন। তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি ক্যামেরায় কেল্লাবাড়ি আর গঙ্গার ছবি তুলে বেড়ালুম। কোথাও-কোথাও ধ্বংসাবশেষে ঝোঁপজঙ্গল আছে। গঙ্গার তীরে একস্থানে খাড়া পাথরের পাঁচিল নেমে গেছে জলের তলায়। কোথাও ভাঙাচোরা পাথরের ঘাট শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম সেই ফাঁসির মঞ্চটিকে, যেখানে ইংরেজ সেনাধ্যক্ষ জন হকটন বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিলেন। সেই বিদ্রোহীদের দলে ছিলেন নবাব আজম খানের কন্যা রেশমা বেগম। দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানার কাগজপত্রে এই পিতা-পুত্রীর নাম খুঁজে পেয়েছিলুম। আর পেয়েছিলাম একটা স্কেচম্যাপ। সেটা এঁকেছিলেন এক আইরিশ শিল্পী–টমাস পিট। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সেই শিল্পী এ অঞ্চলে বেড়াতে এসেছিলেন। স্কেচম্যাপে কেল্লাবাড়ির সীমানা ছাড়াও খুঁটিনাটি অনেকগুলি স্থান চিহ্নিত করা ছিল। সির মঞ্চ, বিদ্রোহীদের কবরখানা, রেশমা বেগমের গোপন অস্ত্রাগার–এরকম অনেককিছুই ছিল ওতে। আমি জীর্ণ ম্যাপ থেকে কপি করে এনেছিলুম।

সেই কপি থেকে স্থানগুলি খুঁজে বের করা দেখলুম অসম্ভব ব্যাপার। তবে একটা দৃশ্য আমার কাছে অদ্ভুতই মনে হচ্ছিল। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ধ্বংসস্তূপগুলিতে শুধু লাল রঙের ফুলের সমারোহ চোখে পড়ে। আমি প্রকৃতিপ্রেমিক নই। ইতিহাসের একজন গবেষক মাত্র। জীবনে কত ঐতিহাসিক স্থানে আমাকে যেতে হয়েছে। কিন্তু কোথাও এমন উজ্জ্বল লালরঙের ফুল চোখে পড়েনি। নানা আকৃতির এইসব ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, ওগুলি কি ফুল, না চাপ-চাপ রক্ত? এখানে কি অন্যরঙের ফুল ফোটে না?

অবশ্য এখন বসন্তকাল। ফুল ফোটে। পাখিরা গান করে। কিন্তু এখানে পাখিরা কেন চুপ করে আছে?

পাখির কথা ভাবতেই গঙ্গার ধারে পক্ষীনিবাসের কথা মনে পড়ল। তখন ধরে নিলুম, এলাকার সব পাখি সেখানে গিয়েই জুটেছে। কোথায় সেই চর তা জেনে আসিনি। গঙ্গা এখানে প্রশস্ত। উত্তাল বাতাসে বড় বড় ঢেউ উঠে কেল্লার পাথুরে পাঁচিলে অদ্ভুত শব্দ করছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে হাজার-হাজার মানুষের কোলাহল। ওপারে দূরে ঘন নীল পাহাড়গুলি দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি জেলেনৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে।

অন্যমনস্কভাবে গঙ্গার ধারে জীর্ণ শ্যাওলাধরা ঘাটের মাথায় একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। এই সময় আমার ডানদিকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একজন ফকির বেরিয়ে এলেন।

ফকিরের মাথায় জটা, মুখে লম্বা দাড়ি। পরনে পা পর্যন্ত লম্বা কালো আলখাল্লা। গলায় মোটা-মোটা রঙবেরঙের পাথরের মালা। তার এক হাতে প্রকাণ্ড চিমটে। চিমটেটার গোড়া রুপো আর তামার তারে বাঁধানো। ফকির ঘাটের কাছে এসে আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,–কৌন হ্যায় তুম?

আমি যথাসাধ্য হিন্দিতে নিজের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলুম। তারপর বললুম, রেশমা বেগমের ফাঁসির জায়গা আর তার কবর কোথায় তা কি আপনি জানেন? দেখিয়ে দিলে আপনাকে কিছু বখশিস দেব।

ফকির কিন্তু চটে গেলেন। তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন,–কে চায় তোমার বখশিস? শিগগির এখান থেকে চলে যাও। না গেলে তোমার বিপদ হবে।

তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলুম, আমি সিপাহিবিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে চাই। কিন্তু ফকির আমাকে পাত্তা দিলেন না। মস্ত বড় চিমটেটা তুলে তেড়ে এলেন। চিমটের ডগা সূক্ষ্ম এবং ধারালো। বেগতিক দেখে আমি সরে এলুম।

একটু পরে দূর থেকে দেখলুম, ফকির আলখাল্লা খুলে রেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ওখানে জল খুব গভীর। ফকির সেই জলে সাঁতার কাটছেন দেখে অবাক লাগল। একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছিলুম। কিছুক্ষণ পরে ফকির জল থেকে উঠে ভিজে গায়েই কালো আলখাল্লা পরে নিয়ে চিমটেসহ এগিয়ে গেলেন। তারপর ধ্বংসস্তূপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।

ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। ওঁকে অনুসরণের সাহস হল না। শুধু জায়গাটা চিনে রাখলুম। তারপর প্যালেস হোটেলে ফিরে গেলুম।

স্নান করার পর নিচের ডাইনিং হলে খেতে গেলুম। ডাইনিং হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিলেন জনাচারেক বোর্ডার। ম্যানেজারের কাছে শুনেছিলুম, তাঁরা নানা জায়গা থেকে এসেছেন এবং বিত্তবান ব্যবসায়ী। সায়েব-মেমদের দলটি তখনও বাইরে থেকে ফেরেননি। পরিচারক আসলাম খান আমাকে সেলাম দিয়ে খাদ্য পরিবেশন করল। সেই সুযোগে তাকে কেল্লাবাড়ির সেই ফকিরের কথা বললুম। আসলাম খান একটু হেসে বলল,–ও তো পাগলাবাবা স্যার। ওখানে পিরের দরগা। আছে। সেখানে থাকে। একেবারে পাগল। খিদে পেলে তখন কিন্তু বেরিয়ে আসে। শহরের রাস্তায় বসে শাপ দেয়, তাকে কেউ খেতে না দিলে তার বিপদ হবে। আবার খেতে দিলেও শাপশাপান্ত করে। ওকে কখনও ভয় করবেন না। শুধু বলবেন, সঙ্গে পিস্তল আছে। গুলি করে মারব। দেখবেন, তখন কীভাবে দৌড়ে পালায়। একেবারে শেয়ালের মতো কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে যাবে…

আসলামের কাছে এ কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। তাই খাওয়ার পর ঘণ্টাটাক বিশ্রাম করে আবার কেল্লাবাড়িতে গেলুম। ফকির যেখানে ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে উধাও হয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে সংকীর্ণ একফালি পায়ে-চলা পথ খুঁজে পেলুম। দুধারে ঝোঁপঝাড় আর পাথর। আঁকাবাঁকা গোলকধাঁধার মতো পথে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় থমকে দাঁড়ালুম। সামনে একটা কাঠের বেড়া। বেড়াতে একটা ফলক আঁটা আছে। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, নিষিদ্ধ এলাকা। তার নিচে একটা মড়ার খুলি এবং খুলির তলায় আড়াআড়িভাবে দুটো হাড় আঁকা। এই চিহ্নের অর্থ সাংঘাতিক।

নিষেধাজ্ঞার তলায় ছোট অক্ষরে লেখা আছে, কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। ভারত সরকার।

বুঝতে পারছিলুম না কেন সরকারি পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই বিপদজ্ঞাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছেন।

বেড়ার ফাঁকে পা দিয়ে উঠে উঁকি মেরে ওদিকটা দেখতে পেলুম। খানিকটা ফাঁকা জমির পর নিচে গঙ্গার বুকে বালির চড়া। চড়াটা বহুদূর অবধি বিস্তৃত। বিকেলের রোদে চড়ার শেষপ্রান্তে কাঁটাতারের বেড়া চোখে পড়ল। এবার বুঝতে পারলুম, ওই চড়ায় চোরাবালি আছে। তাই এই সতর্কতা।

কাঠের বেড়া থেকে নেমে যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে চললুম। একটু পরে দেখি, ডানদিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তা চড়াইয়ে উঠে গেছে। রাস্তাটা লাল ধুলোয় ভরা। এটা কেন চোখে পড়েনি তখন?

আসলে লাল রাস্তাটা ঝোঁপের আড়ালে থাকায় লক্ষ করিনি। তা ছাড়া একটা প্রকাণ্ড চৌকো কালো পাথর রাস্তাটাকে আড়াল করেছিল। পাথরটাতে নকশার মতো আঁকা লিপি দেখে বুঝলুম আরবি হরফে কিছু লেখা আছে। তখনই ক্যামেরায় কালো পাথরটার কয়েকটা ছবি তুললুম।

তারপর পাথরের একপাশ দিয়ে এগিয়ে লাল রাস্তায় পৌঁছলুম। কিন্তু সংকীর্ণ রাস্তাটার লাল ধুলোয় জুতো প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। প্যান্ট একটু গুটিয়ে নিতে হল। সাবধানে পা ফেলে একটুখানি এগিয়েছি, হঠাৎ চমকে উঠলুম। আমার প্রায় ফুটছয়েক দূরে চোখের সামনে এইমাত্র কার জুতোর ছাপ ফুটে উঠেছে। প্রথমে ভাবলুম চোখের ভুল। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, আমি আবার পা ফেলে এগোতেই আমার সামনে একই দূরত্বে বারবার আগে-পিছে জুতোর ছাপ ফুটে উঠছে। বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হিম হয়ে গেল।

কোনও এক অশরীরী আমার সামনে হেঁটে চলেছে, এতে কোনও ভুল নেই। তার জুতোর ছাপগুলি আমার জুতোর ছাপের তুলনায় ছোট। কিন্তু কে সে?

চোখের ভুল কি না জানার জন্য দুঃসাহসী হয়ে আবার কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। আবার আমার সামনে একই দূরত্বে সেই অশরীরীর জুতোর স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল।

এবার আমার সব সাহস উবে গেল। শেষবেলার রোদে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে আমার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গেল। আমি দ্রুত পিছু ফিরে লাল ধুলোয় টলতে টলতে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলুম। তারপর বিভ্রান্তভাবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে দৌডুতে থাকলুম। একটু পরে গঙ্গার ধারে খোলা জায়গায় পৌঁছে পিছু ফিরে দেখে নিলুম কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কি না।

এরপর কী করে যে হোটেলে ফিরেছিলুম, মনে পড়ে না।…

জীবনে বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ এবং দুর্গম স্থানে গেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা কোথাও ঘটতে দেখিনি। হোটেলের লাউঞ্জে বসে ইশারায় একজন ওয়েটারকে ডেকে কফি আনতে বললুম।

সে কফি এনে দিল। কফি খেতে-খেতে ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় বোঝবার চেষ্টা করছিলুম। এমন সময় দেখি, লাউঞ্জের অন্যপ্রান্তে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জিনস এবং টি-শার্ট। মুখে গোঁফ। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হয়েও নয়, ভদ্রলোকের মুখে যেন একটা একটা বিরক্তির ছাপ এবং চোখদুটোও কুতকুতে। এরকম চেহারার মানুষ দেখলে অস্বস্তি জাগে।

ভদ্রলোক সম্ভবত প্যালেস হোটেলের লাউঞ্জে এসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাকে না পেয়ে হয়তো বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।

আমার চোখে চোখ পড়লে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর বাংলায় বলে উঠলেন, আপনি কি বাঙালি?

বললুম, হ্যাঁ।

ভদ্রলোক অমায়িক হেসে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন। বললেন,–মশাই! বাঙালির চেহারা দেখলেই চেনা যায়। আমার ঠাকুরদা ওকালতি করতে আজমগড়ে এসেছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি। বাবাও ওকালতি করতেন। আমি কিন্তু ব্যবসা করি। আমার নাম অশোক রায়। আপনার পরিচয় পেলে খুশি হব।

অশোকবাবুকে প্রথমে দেখে যা ভেবেছিলুম, তাঁর অমায়িক হাবভাব এবং কথাবার্তা শুনে সেই ধারণা কেটে গেল। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন,–কেল্লাবাড়ির ধ্বংস্কৃপের মধ্যে কোথায় কী ছিল, তা আমার নখদর্পণে। আমার ছেলেবেলায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি।

ওয়েটারকে আবার ডেকে ওঁর জন্য কফি আনতে বললুম। তারপর অশোকবাবু আজ গড়ের পুরনো ঐতিহাসিক কাহিনি বলতে শুরু করলেন। ম্যানেজারের কাছে এসব গল্প শুনেছি। ওয়েটার কফি দিয়ে গিয়েছিল। কফি খেতে-খেতে অশোকবাবু বললেন, আজ বিকেলে কলকাতা থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর আসার কথা। তার জন্য অপেক্ষা করে অস্থির। ছটা বেজে এল। সে এল না। কাজেই ধরে নিচ্ছি, আর সে আসবে না। না আসুক। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী যে আনন্দ পেলুম, বোঝাতে পারব না। তা আপনি হোটেলে থাকবেন কে? খামোকা একগাদা টাকা খরচ! বরং আমার অতিথি হোন। আপনাকে দেখলে আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও খুব খুশি হবে।

এত অন্তরঙ্গতার পর বিকেলে কেল্লাবাড়ির ভেতরে সংকীর্ণ লাল রাস্তায় যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি, তা অশোকবাবুকে না বলে থাকতে পারলুম না।

অশোকবাবু ঘটনাটা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, আপনি ঐতিহাসিক পণ্ডিত। ইতিহাসের ভেতর ডুবে থাকেন। বাস্তব জগতে ভুলভাল দেখা আপনার পক্ষে স্বাভাবিক। দেখুন মশাই! আমি কত রাতদুপুরে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও কিচ্ছু দেখিনি। হ্যাঁ–ওখানে এক পাগলা ফকির থাকে। আমাকে দেখলেই সে লেজ তুলে পালিয়ে যায়। তাকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন?

বললুম,–হ্যাঁ। দুপুরে ফকিরকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখেছি। আমাকে সে ভয় দেখাচ্ছিল।

অশোকবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,–পরশু দোলপূর্ণিমা গেছে। আজ কিছুক্ষণ পরে সঁদ উঠবে। কোনও ভয়ের কারণ নেই। আমার সঙ্গে কেল্লাবাড়িতে চলুন। দেখবেন, কোনও অলৌকিক ব্যাপার ঘটছে না। আর পাগলা ফকিরের ডেরাতেও আপনাকে নিয়ে যাব। দেখবেন, আমাকে দেখে ব্যাটাচ্ছেলে কী করে।

এতক্ষণে সায়েব-মেমদের দলটি এসে পড়ল। অন্যান্য বোর্ডাররাও ততক্ষণে এসে গেছে। কেউ লাউঞ্জে, কেউ ডাইনিং হলে ঢুকে চা-কফি খাচ্ছে। অশোকবাবু বললেন, চলুন! জ্যোৎস্নারাতে আজমগড়ের গঙ্গার ধারে বসে গল্প করা যাবে। তারপর সেই লাল রাস্তায় যাব। আমার কাছে টর্চ আছে। আপনাকে আমি রেশমা বেগমের কবরও দেখিয়ে দেব। উঠে পড়ুন।

একটু অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে অশোকবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেলুম। তারপর মনে হল, ইনি বাঙালি এবং এখানেই বড় হয়েছেন। তা ছাড়া, তাঁর বলিষ্ঠ গড়ন দেখেও শেষপর্যন্ত ভয়টুকু ঘুচে গেল…

কেল্লাবাড়ি এলাকায় ঢুকে গঙ্গার ধারে একটা পাথরের ওপর পাশাপাশি দুজনে বসলুম। অশোকবাবু কলকাতার সাম্প্রতিক খবরাখবর জেনে নিচ্ছিলেন। বহুবছর তার কলকাতা যাওয়া হয়নি।

কিছুক্ষণ পরেই চাঁদ উঠল। জ্যোত্সায় গাছপালা, ঝোঁপঝাড় আর ধ্বংসস্তূপ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অশোকবাবু বললেন, আপনি যে লাল রাস্তাটা দেখেছিলেন, ওর পাশেই নাকি ইংরেজরা বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়েছিল। তবে আপনি যে অশরীরী জুতোর ছাপ দেখার কথা বললেন, ওটা চোখের ভুল। ওই রাস্তা দিয়ে পাগলা ফকির যাতায়াত করে। আপনাকে আড়াল থেকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যাটা নিশ্চয় কোনও কারচুপি করেছিল। এও হতে পারে পুরু ধুলোর তলায় লম্বা কোনও জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। তার ওপর আপনি পা ফেললেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে ধুলো ঠেলে তুলবে। স্রেফ ম্যাজিক! চলুন। পরীক্ষা করা যাক।

অশোকবাবু আমার হাত ধরে ওঠালেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললুম, কিন্তু আমি সত্যি জুতোর ছাপ দেখেছিলুম।

আরে মশাই! আমি তো সঙ্গে আছি আসুন না। বলে অশোকবাবু হাঁটতে শুরু করলেন। আমার কাঁধে তার হাত চেপে বসল।

জ্যোৎস্নার জন্য ধ্বংসস্তূপের চকরাবকরা ছায়ার ভেতর দিয়ে আমাকে তিনি নিয়ে চললেন। একটু পরে দেখলুম, সেই আরবি লিপি খোদাই করা কালো পাথরটার কাছে এসে গেছি! অশোকবাবু টর্চের আলো ফেলে বললেন,–চলে আসুন। দেখা যাক কী হয়।

সংকীর্ণ চড়াই রাস্তায় কিছুটা উঠে টর্চের আলো ফেলে অশোকবাবু বললেন, কই? কোনও ভুতুড়ে জুতোর ছাপ দেখতে পাচ্ছেন?

বললুম,–এখন পাচ্ছি না। কিন্তু–আমার কথা থেমে গেল। এরপর যা ঘটল তা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে অশোকবাবু আমার কানের নিচে শক্ত এবং ঠান্ডা কী একটা জিনিস ঠেকিয়ে চাপা গর্জন করে বললেন,–টুঁ শব্দটি নয়। ট্রিগারে আঙুল আছে। একটু চাপ দিলেই তোমার মুন্ডু উড়ে যাবে। আগে ক্যামেরাটা দাও। হ্যাঁ–তারপর রিস্টওয়াচ। আর মানিব্যাগটা বের করো।

মুহূর্তে আমি টের পেয়ে গেছি, এক ভদ্রবেশী গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছি। হোটেলের ম্যানজার মিঃ ঠাকুর আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন কেন, এতক্ষণে তার মর্ম বুঝতে পারলুম। সেই ফকিরও হয়তো আমাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই। ক্যামেরাটা গলা থেকে ঝুলছিল। সেটা হাতে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললুম, দয়া করে এটা নেবেন না। মানিব্যাগে হাজারখানেক টাকা আছে। তা নিন। ঘড়িটাও নিন। কিন্তু ক্যামেরায় লোড করা ফিল্মে অনেক ছবি আছে। দয়া করে অন্তত ফিল্মের রোলটা বের করে নিতে দিন আগে।

অশোকবাবুরূপী দুবৃত্ত আগ্নেয়াস্ত্রের নল আমার কানের নিচে আরও চেপে হিসহিস করে বলে উঠল, চুপ! শিগগির! আর একটা কথা বললে তোমার লাশ পড়বে। আর সেই লাশের কথা কেউ জানতেও পারবে না। কারণ তোমার লাশ আমি চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আসব। চোরাবালিতে তোমার মতো কত লাশ আমি ফেলে দিয়ে এসেছি। সব তলিয়ে গেছে।

বলেই সে ধমক দিল,–আবে জলদি কর!

এতক্ষণে মনে হল, লোকটার মাতৃভাষা বাংলা নয়। তার বাংলা কথাবার্তায় কেমন যেন একটু হিন্দির টান ছিল। কিন্তু এবার ডান কানের নিচে ব্যথা পেয়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিলুম। তারপরই আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা শপাং করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপর দেখলুম, দুবৃত্তটার হাতের অস্ত্র ছিটকে পড়ল এবং সে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।

তারপর আবার শপাং করে প্রচণ্ড শব্দ হল। গুণ্ডাটা লাল ধুলোয় গড়াতে শুরু করল। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। কোনও অশরীরী অদৃশ্য চাবুক মেরে চলেছে তাকে। সে একবার কাত হচ্ছে। একবার উপুড় হচ্ছে। হাঁটু মুড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারপরই সেই প্রচণ্ড শব্দ এবং তার মুহুর্মুহু আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখছি, লোকটার গায়ের টি শার্ট ফালাফালা হয়ে কালো কালো ক্ষতরেখা ফুটে উঠছে।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। লাল ধুলোভরা রাস্তায় নোকটা ক্রমাগত গড়াচ্ছে এবং তার গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে শুধু। অশরীরীর চাবুকের শব্দ ক্রমশ প্রচণ্ডতর হয়ে উঠছে।

লাল ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবার। তার আড়ালে চাবুকের ক্রমাগত শব্দ আর গোঙানি শুনতে-শুনতে একসময় আমার চেতনা ফিরে এল। তখনই দৌড়ে নেমে এসে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরোলাম। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ভোলা জায়গায় ছুটে চললুম।

কেল্লাবাড়ির ভাঙা ফটকের কাছে গিয়ে প্যান্ট-শার্ট থেকে ধুলো ঝেড়ে হোটেলে ফিরে চললুম। না, কাউকে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলা উচিত হবে না…

রাতে ডিনার খাইনি। ম্যানেজার খবর নিতে এসেছিলেন আমার রুমে। বলেছিলুম,–ঘুরে-ঘুরে খুব ক্লান্ত। খিদে নেই।

সারারাত যতবার ঘুম এসেছে, চমকে উঠেছি। আবার বুঝি কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। ভোর ছটায় আসলাম খান বেড-টি আনল। তারপর গম্ভীরমুখে বলল, খবর আছে স্যার! সুখবর। তাই বলা উচিত মনে হল।

বললুম, কী সুখবর আসলাম?

সে বলল,–আজমগড়ে একজন সাংঘাতিক গুণ্ডা ছিল। তার নাম কাল্প। সে আমাদের হোটেলে এসেও ম্যানেজারসায়েবের কাছে টাকা দাবি করত। কাল সন্ধ্যার আগে সে নাকি আপনার সঙ্গে কথা বলছিল। ওয়েটার রমেশ দেখেছে। কিন্তু আপনাকে সাবধান করার সুযোগ পায়নি।

–কিন্তু সুখরবটা কী?

কাক্কু গুণ্ডাকে কে বা কারা রাত্রে মেরে কেল্লাবাড়ির ভেতরে লাশ ফেলে এসেছে। পাগলা ফকির খুব ভোরে সেই লাশ দেখে থানায় খবর দিয়েছিল। আশ্চর্য ঘটনা স্যার, তার পিস্তল আর টর্চটা সেখানেই পড়ে ছিল।

–আচ্ছা আসলাম! কাল্লু কি বাঙালি ছিল?

–না স্যার। তবে সে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা সব ভাষাতেই কথা বলতে পারত। কলকাতাতে নাকি তার ছোটবেলা কেটেছিল। স্কুলেও পড়েছিল। তাই বাংলাও বলতে পারত। আজমগড়ে বাঙালি আছে। তারা তো কাল্লুকে বাঙালি বলেই মনে করত। কাম্পু কখন কোন রূপ ধরত, চেনা কঠিন হতো।

–কাল্লুর লাশ কি পুলিশ নিয়ে গেছে?

–শুনলুম একটু আগে মর্গে নিয়ে গেছে। কাল্পর সারা শরীর নাকি রক্তে লাল।

ব্রেকফাস্টের পর সাড়ে নটায় আমি এবার সাহস করে কেল্লাবাড়িতে গেলুম। আমার মনে হচ্ছিল, কাল বিকেলে যে অশরীরীর জুতোর ছাপ আমার সামনে রাঙা ধুলোয় ফুটতে উঠতে দেখেছি, সেই ছদ্মবেশী অশোক রায় নামধারী দুবৃত্ত কাল্পর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে। মনে-মনে তার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানালুম।

এবার নির্ভয়ে সেই কালো পাথরের পাশ দিয়ে সংকীর্ণ লাল ধুলোভরা রাস্তায় পৌঁছলুম। চড়াই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আর সেই জুতোর ছাপ সামনে ফুটে উঠল না। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। নিচে নেমেই ঘন গাছপালার ভেতর সারসার কয়েকটা কবর দেখলুম। তারপর লাল পাথরের একটা কবর দেখে এগিয়ে গেলুম। সেই কবরের শিয়রে একটা রক্তকরবীর গাছ। কবরে লাল ফুল ঝরে পড়েছে। আমি বহুকাল আরবি লিপির ফলক দেখে-দেখে লিপি বিষয়ে সামান্য জ্ঞান অর্জন করেছিলুম। আরবিতে তিনটি হরফ চেনামাত্র বুঝতে পারলুম এটাই সেই সিপাহিবিদ্রাহীদের নেত্রী শাহজাদি রেশমা বেগমের কবর, যাঁর ডাকে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।

হঠাৎ আমার মাথায় কথাটা এসে গেল। তা হলে কি রেশমা বেগমের অতৃপ্ত আত্মাই আমাকে কাল বিকেলে পথ দেখিয়ে তার কবরের কাছে আনতে চেষ্টা করেছিল? সেই রেশমা বেগমের আত্মাই কি দুবৃত কাল্লুকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করেছিল?

শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে পড়ল। পাশের একটা লাল ফুলের গুচ্ছ ডাল থেকে ভেঙে বিদ্রোহিনীর কবরে রেখে মাথা ঠেকালুম। সেই মুহূর্তে স্নিগ্ধ একটা হাওয়া ভেসে এল। সেই হাওয়ায় যেন পুরোনো ইতিহাসের সুঘ্রাণ টের পেলুম। মনে-মনে বললুম, প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়িকা বীরাঙ্গনা তুমি! তোমার জীবনকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।

এই সময় পাগলা ফকির এসে গেল। অট্টহাসি হেসে সে বলল,–বাবুজি! আপকা উপ্লর রেশমা বেটি বহত খুশ যায়। তো আব আপ তুরন্ত হিয়াসে চলা যাইয়ে। রেশমা বেটিকো একেলা রহনে দিজিয়ে। বেটি জিন্দেগিমে বহত দুখ পায়ি। বহত দুখসে মর গেয়ি বেটিয়া!

তখনই নিঝুম কবরখানা থেকে চলে এলুম। ইতিহাসে এইসব আশ্চর্য ঘটনা লেখা যাবে না। সেগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনেই থেকে যাক।

হ্যাঁ–সেই অদ্ভুত ঘটনা এতদিন কাকেও বলিনি। এখন আমি বৃদ্ধ। মৃত্যুর আগে ঘটনাগুলি লিখে যাওয়া উচিত মনে করেই লিখে ফেললুম। এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমি নিরুত্তর থাকব।…

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments