Saturday, August 23, 2025
Homeলেখক-রচনারচনা সমগ্রনেকড়ে খামার - হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

নেকড়ে খামার – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

১. খাড়া পাহাড়ি রাস্তা

গাড়িতে বসে খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতেই অনীশ ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ অরগানাইজেশনের দেওয়া ফাইলটাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। হিমালয়ান উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্প বা নেকড়ে খামার-টার সম্বন্ধে নানা তথ্য দেওয়া আছে এই ফাইলটাতে। এমনকী প্রাণীগুলোর ছবি, খামার মালিক ভন ভাইমার ও তার কর্মচারীদের ছবি, সরকারি চিঠিপত্র সবই সংযোজিত আছে তার মধ্যে।

মিস্টার ভাইমার আর সরকারের মধ্যে যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে তা দেখে অনীশ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে সরকার মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে প্রাণীগুলোকে মারার। তাই মিস্টার ভাইমার একটা শেষ চেষ্টা করেছেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফকে একটা চিঠি দিয়ে প্রাণীগুলোকে বাঁচাবার। আর এই চিঠিটার জন্যই কিছুটা হলেও থমকেছে সরকার। তারাও তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে প্রাণীগুলোর সম্বন্ধে বিশ্ব বন্য প্রাণ সংস্থার মতামত জানতে চেয়েছেন। সংস্থা তাই এদেশে তাদের সংস্থার প্রতিনিধি হিসাবে অনীশকে নেকড়ে খামারটাতে পাঠাচ্ছে সরেজমিনে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবার জন্য।

সরকার পক্ষকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না তেমন। হিমালয়ান মাউন্টেন উলফ বা তুষার নেকড়ে যদি মানুষ মারে তবে সে যত দুষ্প্রাপ্য প্রাণী হোক না কেন তার জীবনের দাম গ্রামবাসীদের জীবনের চেয়ে বেশি নয়। তবে সরকারি তরফে নেকড়েগুলোকে মারতে চাওয়ার পিছনে নাকি আসল কারণ অন্য। সেটা অবশ্য এ ফাইলে লেখা নেই, থাকার কথাও নয়। অনীশেরই ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে কাজ করা এক সহকর্মী খবরটা কীভাবে যেন সংগ্রহ করেছে স্থানীয় এক সেনা অফিসারের কাছ থেকে। সেই সহকর্মী অনীশকে জানিয়েছে যে ওই তুষার নেকড়েগুলোকে। নিয়ে নাকি সীমান্তরক্ষীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আসলে সরকার এ ব্যাপারটা নিয়েই বেশি ভাবিত। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছে না ব্যাপারটা। এ অঞ্চল দেশের অন্যতম দুর্গম ও উত্তেজনা প্রবণ সীমান্ত অঞ্চল। তাই সরকার কোনও অবস্থাতেই চায় না যে-কোনও কারণেই। এখানকার সীমান্তরক্ষীদের কাজের সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটুক।

ফাইলটা দেখছিল অনীশ। তার চিন্তাজাল ছিন্ন হল ড্রাইভার পবন বাহাদুরের কথায়– স্যার, আমরা এখন নাথুলা পাসে। প্রায় চোদ্দ হাজার ফিট ওপরে উঠে এসেছি আমরা।

ফাইল থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকাল অনীশ। সত্যিই অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে অনীশ। নীল আকাশের বুকে উঠে গেছে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণি। তাদের বরফমোড়া কিরীটগুলো সূর্যালোকে ঝলমল করছে। নীচের ধাপের পাহাড়গুলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে গিরিবর্ক্স। যে জায়গাতে গাড়িটা এসে পৌঁছেছে সে জায়গা একটু সমতল। অনেক লোকজন, ট্যুরিস্ট গাড়ির ভিড় সেখানে।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে। গাড়িগুলো সব মুখ ঘুরিয়ে নীচে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ড্রাইভার আঙুল তুলে কিছুটা দূরে একটা ছোট পাহাড়ের মাথা দেখিয়ে বলল, ওটাই হল, টিবেট, চায়না। ওখানে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা যে সব লোকজনকে দেখতে পাচ্ছেন তারা হল-পিপিলস লিবারেশন আর্মি অব চায়না অর্থাৎ চীনা সেনাবাহিনী। আর তার উলটোদিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ভারতীয় সেনারা।

অনীশ জানতে চাইল আমরা যে জায়গাটাতে যাব সে জায়গাটা এখান থেকে কতদূর?

পবন বলল, ও জায়গাটা রেশমপথের ভিতর। আরও ওপরে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ভিতরে। স্থানীয় লোক ছাড়া ট্যুরিস্টদের ওখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। রাস্তার এক পাশে চায়না, অন্য পাশে ইন্ডিয়া। ওই নেকড়ে খামারটা আর একটাই ছোট গ্রাম আছে সেখানে।

কথা বলতে বলতে ট্যুরিস্ট গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে অনীশদের গাড়িটা গিয়ে থামল একটা চেকপোস্টের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানরা।

গাড়ি থেকে নামতে হল অনীশদের। তাদের গাড়ির উইন্ড শিল্ডে আটকানো ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ অরগানাইজেশনের লোগো দেখে সেটা চিনতে পেরে এক অফিসার এগিয়ে এলেন। সরকারের পক্ষ থেকে অনীশদের সে জায়গাতে যাবার খবর আগাম তাদের কাছেও ছিল। অনীশের কাগজপত্র আর তাদের কাগজ মিলিয়ে দেখে আশ্বস্ত হবার পর চেকপোস্ট খুলে দিল তারা। অনীশদের গাড়ি প্রবেশ করল ভিতরে।

রেশমপথ! সিল্করুট! নামটা শুনলেই কেমন যেন রোমাঞ্চ হয় মনের ভিতর। কত হাজার বছরের প্রাচীন এই বাণিজ্যপথ। হাজার হাজার বছর ধরে এ পথ বেয়েই দু-দেশের মধ্যে বাণিজ্য আর সংস্কৃতির লেনদেন হয়েছে। কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে এ পথের সঙ্গে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাং-ও একদিন এ পথে হেঁটেছিলেন।

অনীশও বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করল প্রথম এ পথে প্রবেশ করে। সর্পিল গিরিবর্ত এঁকে বেঁকে উঠেছে ওপর দিকে। কখনও রাস্তার দুপাশেই পাহাড় আবার কখনও অতলান্ত খাদ।

পাহাড়ের মাথাগুলোতে কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে দু-দেশের সীমান্তরক্ষীরা। হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, ইস্পাত কঠিন মুখ। ঠিক যেন পাথরের মূর্তি তারা। আর্মির গাড়ি ছাড়া এ পথে অন্য কোনও গাড়ি নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু লোকজন চোখে পড়ছে। ঘোড়া, খচ্চর বা গাধার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। স্থানীয় লোকজন সব। ড্রাইভার জানাল ওই সব বস্তায় আর্মির জন্য রেশন যাচ্ছে।

অনীশ জানতে চাইল, এই রেশম পথে এখনও বাণিজ্য হয়?

পবন বলল, হয়, হয়। উনিশশো বাষট্টির চীন-ভারত যুদ্ধের পর বহুদিনের জন্য এ পথ বন্ধ ছিল। তারপর বছর কুড়ি হল আবার এ পথ খুলেছে। সপ্তাহে এখন দু-দিন এ পথ খোলা থাকে। তবে সীমান্তে উত্তেজনা থাকলে পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অনীশ প্রশ্ন করল, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানকার গ্রামে কারা থাকে? কী করে তারা?

ড্রাইভার বলল, ওটা তিব্বতী শরণার্থীদের গ্রাম। যুদ্ধের সময় ওপার থেকে এসেছিল ওরা। যদিও তারা এখন এ দেশেরই নাগরিক। ওরা পশুপালন করে, উল বোনে। পাইন বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে। এভাবেই দিন চলে ওদের।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল অনীশদের গাড়ি। রাস্তায় লোকজনের চলাচল, আর্মি গাড়ির যাতায়াতও হারিয়ে যেতে লাগল তার সঙ্গে সঙ্গে। আর তার সঙ্গে বাড়তে লাগল কনকনে ঠান্ডা বাতাসের দাপট। তীব্র শিস-এর মতো শব্দ করে বাতাস বইছে কোথাও কোথাও। গিরিবর্তের গা-গুলোর অধিকাংশ জায়গা নেড়া রুক্ষ হলেও মাঝে মাঝে পাইনবন আছে। ছোট হলেও বনগুলোর ভিতর আলো প্রবেশ করতে পারে না। এত ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে সূর্যালোক ভিতরে প্রবেশ করে না। ঝিঁঝি পোকার অবিশ্রান্ত কলতান ভেসে আসছে সেখান থেকে।

ড্রাইভার বলল, আমরা যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথ কিন্তু একেবারে তিব্বতের রাজধানী লাসায় গিয়ে মিশেছে। তবে এই মূল রাস্তা ধরে আরও কয়েকটা পথ বেরিয়েছে। সেগুলোও একটু ঘুরপথে তিব্বতের নানা জায়গাতে পৌঁছেছে।

ঘণ্টাখানেক চলার পর এক জায়গাতে পথের বাঁকে মুহূর্তের জন্য গাড়িটা থামাল ড্রাইভার। দুটো পাহাড়ের ফাঁক গলে আরও উঁচুতে একটা জায়গা দেখাল সে। কুয়াশা ঘেরা আবছা একটা কালো জায়গা।

সেটা দেখিয়ে সে বলল, ওখানেই যাব আমরা। বনটা দেখা যাচ্ছে। ওই বনের গা বেয়েই বরফের পাহাড় উঠে গেছে। তাই ওখানে সবসময় বেশ ঠান্ডা আর কুয়াশা থাকে। এই রাস্তা ছেড়ে বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকতে হয় ওখানে যেতে হলে।–এই বলে সে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করল।

সময় এগিয়ে চলল। বেলা পড়ে আসছে ক্রমশ। জনশূন্য গিরিবর্ত বেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠে চলেছে গাড়ি। মাঝে মাঝে নীচের দিকে তাকালে চোখে পড়ছে পিছনে ফেলে আসা নীচের পাকদণ্ডীগুলো। যাত্রাপথে আরও এক জায়গাতে থামতে হল অনীশদের। এ জায়গাটাই নাকি এদিকের সীমান্তের শেষ চেকপোস্ট। সেখানে কাগজপত্র পরীক্ষা হবার পর আবার চলতে শুরু করল গাড়ি। বেলা চারটে নাগাদ প্রধান রাস্তা ছেড়ে একটা ছোট শুড়ি পথ ধরল গাড়িটা। দু পাশে পাহাড়ের ঢালে গভীর পাইনবন। মাঝে মাঝে পায়ে চলা পথ উঠে গেছে বনের ভিতরে।

ড্রাইভার বলল, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি স্যার। আমাদের ডানপাশের পাহাড়টা ভারতের আর বাঁ-পাশেরটা চীনের। এ রাস্তাটাকে আপনি নো-মেনসল্যান্ড বলতে পারেন। তিব্বতীদের গ্রামটা রয়েছে আর একটু এগিয়ে জঙ্গলের পিছনে। আর নেকড়ে ফার্মটাও সামনেই।

ড্রাইভারের কথা কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যি বলে প্রমাণিত হল। পাকদণ্ডী বেয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে থামল অনীশদের গাড়িটা।

গাড়ি থেকে নামল অনীশ। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে একটা সমতল জায়গা। রাস্তার যে পাশে চীনের সীমানা সে দিকের পাহাড়টা এত খাড়া যে ওপরে ওঠার রাস্তা নেই। আর রাস্তার ডানপাশে বেশ অনেকটা জমি ঘন সন্নিবিষ্ট কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। উচ্চতায় অন্তত দশফুট উঁচু হবে সেই বেড়াটা। আর তার মাঝে মাঝে পাইন গাছের খুঁটি। ফাঁকা জমিটার মাঝখানে রয়েছে ঢালু টিনের ছাদঅলা লম্বাটে একটা কাঠের বাড়ি। সেটা দেখতে অনেকটা সেনা বেরাকের মতো। বাড়িটার পিছন থেকেই উঠে গেছে বরফের চাদর মোড়া পাহাড়। অনীশদের যাত্রাপথের পাশের পাইন বনটাও এসে মিশেছে জমিটার গায়ে।

গাড়ি থেকে নামার পর অনীশ জানতে চাইল, গ্রামটা দেখা যাচ্ছে না তো! সেটা কোথায়?

ড্রাইভার বলল, সেটা এ জায়গার একটু কোনাকুনি। পাইনবনের পিছনের ঢালে। পায়ে হেঁটে সেখানে যেতে হয়। আপনি আগে সেখানে যাবেন নাকি?

অনীশ বলল, না, না, আমি এখন এই বাড়িটাতেই যাব। তবে কাল গ্রামেও যেতে হবে। লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাই খোঁজ নিলাম তোমার কাছে। তুমি কি আমার সঙ্গে এখানে রাত কাটাবে?

ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না স্যার। গ্রামে আমার একজন চেনা লোক আছে। আমি সেখানেই থাকব। ফোন করলে দশ মিনিটের মধ্যেই হাজির হয়ে যাব। গাড়িটা এখানেই থাকবে।

তার কথাটা শুনে অনীশ মনে মনে ভাবল, ব্যাপারটা ভালোই হবে তাহলে। গ্রামবাসীদের মনোভাবের খবর সংগ্রহ করা যাবে লোকটার থেকে। সঙ্গের ব্যাগপত্র নিয়ে অনীশ এরপর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা জমিটার প্রবেশমুখে। দরজাটাও কাঁটা তারে ঘেরা। তার একপাশে খুঁটির গায়ে বিপদচিহ্ন আঁকা সাইনবোর্ডে লেখা আছে হিমালয়ান উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ফার্ম, নাথুলা পাস, সিকিম, ইন্ডিয়া।

প্রবেশ তোরণের পাশেই কাঠের তৈরি একটা ছোট্ট ঘর। অনীশ তোরণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সেই ঘরটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল একজন। তার পরনে একটা লং কোট, মাথায় হ্যাট, পায়ে হাই হিল বুট। তার মুখমণ্ডলের রং লালচে ধরনের। চিবুকে দাড়িও রয়েছে। মাঝবয়েসি সুঠাম চেহারার সেই বিদেশি ভদ্রলোককে অনীশ দেখেই চিনতে পারল। লোকটার ছবি রয়েছে ফাইলে। ইনিই নেকড়ে খামারের মালিক ভন ভাইমার।

ভদ্রলোক অনীশকে দেখতে পেয়ে একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে এসে পকেট থেকে চাবি বার করে দরজাটা খুললেন। তারপর তার দস্তানা পরা হাতটা করমর্দনের জন্য অনীশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আসুন, আসুন। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।

অনীশ করমর্দন করে ভিতরে প্রবেশ করল। দরজার তালাটা বন্ধ করতে করতে ভদ্রলোক বললেন, কীভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। কত দূর থেকে কত কষ্ট করে আপনি এখানে ছুটে এলেন। আপনারা যে আমার ডাকে শেষ পর্যন্ত সাড়া দেবেন তা আমি ভাবতেও পারিনি।

অনীশ বলল, ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। আমরা বন্যপ্রাণকে ভালোবাসি। তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করি। এটা আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে।

দরজাটা বন্ধ করার পর অনীশকে নিয়ে বাড়িটার দিকে এগোলেন ভাইমার। সেদিকে এগোতে এগোতে অনীশ জানতে চাইল, এ বাড়িটা কি আপনি বানিয়েছেন বা কিনেছেন?

ভাইমার বললেন, না। এ বাড়িটা একসময় তিব্বতী শরণার্থী শিবির ছিল। পরে ওরা এ বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। বাড়িটা পরিত্যক্ত ছিল। আমি বাড়িটা মেরামত করে নিই। বাড়িটা নেবার সময় সরকারের সঙ্গে ছোটখাটো একটা চুক্তিও হয়েছিল। তখন সরকার উৎসাহও দিয়েছিল এ কাজে। কিন্তু এখন…। কথাটা শেষ করলেন না ভাইমার।

বাড়িটার সামনে টানা লম্বা বারান্দা। কাঠের মেঝে, কাঠের দেওয়ালঅলা সারবাঁধা ছোট ছোট ঘর। কয়েকটা ঘর তালা বন্ধ, কয়েকটা ভোলা। অনীশকে নিয়ে বারান্দায় উঠে তেমনই একটা ঘরে প্রবেশ করলেন ভাইমার।

ঘরটা মনে হয় তার অফিস ঘর। একটা টেবিল ঘিরে বেশ কটা গদি আঁটা চেয়ার। দেওয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো বেশ কয়েকটা ওয়াইল্ড লাইফের ছবি। তার মধ্যে ভাইমারের চেয়ারের ঠিক পিছনের ছবিটা একটা হিমালয়ান উলফের। একটা কাঁচ ঢাকা আলমারিও আছে ঘরে। সেটাও ওয়াইল্ড লাইফ সংক্রান্ত বইপত্রে ঠাসা।

নিজের চেয়ারে বসলেন ভাইমার। অনীশ তার মুখোমুখি একটা চেয়ারে। সেখানে বসার পর একটা রাইফেলও চোখে পড়ল অনীশের। যে দরজা দিয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করেছে তার গা ঘেঁষেই দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে সেটা।

বেশ কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে বসে রইল তারা দুজন। বাইরে বিকাল নেমে এসেছে। আলো মরে আসছে। আধো অন্ধকার ঘর। মিস্টার ভাইমারই প্রথম মুখ খুললেন। তিনি বললেন, আপনি নিশ্চই সব ব্যাপারটাই মোটামুটি জেনেছেন আমার চিঠি আর কাগজপত্রের মাধ্যমে। এখন হয়তো আপনার রিপোর্টের ওপরই নির্ভর করছে প্রাণীগুলোর ভবিষ্যৎ।

অনীশ বলল, হ্যাঁ, মোটামুটি জানি। গ্রামের লোক সরকারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। আপনার নেকড়েগুলো এ জায়গা থেকে বেরিয়ে মানুষ মারছে বলে। আপনার চিঠি থেকে জেনেছি। তারা নাকি একবার কিছুদিন আগে হামলাও চালিয়েছিল এ জায়গাতে। প্রাণীগুলো কোথায় থাকে?

ভাইমার বললেন, ওরা এখানেই থাকে। বাড়ির পিছনে কয়েকটা লোহার গরাদঅলা পাথরের ঘরে। ওরা এ চত্বর ছেড়ে বা খাঁচার বাইরে কোনওদিন যায়নি। কোনও গ্রামবাসীকে মারেনি।

অনীশ বলল, গ্রামবাসীরা কি তবে মিথ্যা কথা বলছে? গত ছয় মাসে নাকি চারটে দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে তারা? সরকারের কাছে এমনই রিপোর্ট আছে।

ভাইমার বললেন, যে দেহাবশেষগুলো পাওয়া গেছে তাদের কেউ গ্রামবাসী নয়। তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। এমনই ক্ষতবিক্ষত ছিল দেহগুলো। তারা মিথ্যা আতঙ্কিত হচ্ছে। আমার ক্যাম্পের কোনও প্রাণী সে কাণ্ড ঘটায়নি। তারা বাইরে যায় না। খাঁচা ঘরে থাকে।

অনীশ একটু বিস্মিতভাবে বলল, তারা গ্রামবাসী নয় তা আমার জানা ছিল না। তবে মৃত মানুষগুলো কারা? কে মারল সেই লোকগুলোকে?

ভাইমার পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনি যখন ওয়াইল্ড লাইফ অরগানাইজেশনের লোক, তখন নিশ্চই এই হিমালয়ান উলফ বা টিবেটিয়ান উল্‌ফের ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে কিছুটা জানা আছে আপনার?

অনীশ জবাব দিল, যদিও আমি এদের নিয়ে তেমন কাজ করিনি তবে কিছুটা জানি। দুষ্প্রাপ্য প্রাণী। গায়ে বড় বড় লোম আছে। ধূসর এবং সোনালি রঙের। সাদা রঙেরও হয়। যে কারণে নানা নাম আছে এদের। কেউ বলেন টিবেটিয়ান গ্রে উল, কেউ বলেন গোল্ডেন উল আবার কেউ বলেন স্নো-উলফ। সাধারণত খরগোশ ইত্যাদি ছোটখাটো প্রাণী শিকার করে এই নেকড়েরা। কখনও কখনও দলবদ্ধভাবে হরিণ বা পাহাড়ি ছাগল জাতীয় প্রাণী অর্থাৎ ঘুরালও শিকার করে। অন্য প্রাণীদের মতোই মানুষকেও এড়িয়ে চলে ওরা।

অনীশের জবাব শুনে ভাইমার একটু খুশি হয়ে বললেন, ঠিক তাই। মানুষ ওদের সাধারণ খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। আত্মরক্ষার জন্য নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মানুষকে তারা আক্রমণ করে না। এটাই তো গ্রামের মানুষকে বোঝাতে পারছি না।

অনীশ আবার জানতে চাইল, তবে যে মানুষগুলো মরল তারা কারা? কে মারল ওদের? গ্রামের মানুষরাই বা হঠাৎ খেপে গেল কেন?

ভাইমার একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমার ধারণা যে মানুষগুলো মারা গেছে। তারা স্মাগলার। যে-কোনও সীমান্তেই চোরা কারবার হয় জানেন তো? সোনা ইত্যাদি অবৈধ পণ্য নিয়ে আসা যাওয়া করে তারা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বনের মধ্যে দিয়ে। সব কটা দেহই কিন্তু বনের মধ্যে পাওয়া গেছে। আমার ধারণা কাজটা চিতা বাঘের। মাউন্টেন লেপার্ড। বয়স বা কোনও আঘাত পাবার কারণে সে নরখাদক হয়েছে। তার পায়ের ছাপ দেখেছি আমি। প্রাণীটাকে মারার জন্য সন্ধানও চালাচ্ছি।

এ কথা বলার পর আবারও একটু চুপ করে থেকে ভাইমার বললেন, গ্রামবাসীদের খ্যাপার কারণটা আসলে অন্য। ওদের গ্রামের প্রধান হল নরবু বলে একটা বুড়ো। পশুপালনের ব্যবসা করে সে। একসময় আমি তার কাছ থেকে নেকড়েগুলোর খাবারের জন্য পশু কিনতাম। কিন্তু এখন কিনি সীমান্তের ওপার থেকে আসা তিব্বতীদের কাছ থেকে। তিনভাগ কম দাম। আর এতেই খেপে গেছে বুড়োটা। আর গ্রামের লোককেও সেই খ্যাপাচ্ছে। এটাই হল আসল কারণ।

অনীশ বলল, আপনি তো জার্মানির লোক। এখানে এসে ঘাঁটি গাড়লেন কীভাবে?

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, আমি জার্মানির লোক। বারীয় পার্বত্য অঞ্চলে আমার বাড়ি। জার্মানীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জাগস্পিৎজ ওখানেই অবস্থিত। ছোটবেলা থেকেই বন্যপ্রাণীদের প্রতি আমার অসীম মায়া। ওখানকার পার্বত্য অঞ্চলে নেকড়েদের সংরক্ষণের জন্য আমি বেশ কিছু কাজও করেছিলাম আমার নিজস্ব এন.জি.ও-র মাধ্যমে। পাহাড়ি অঞ্চলে আমার ভ্রমণের শখও প্রবল। এখানে এসেছিলাম পায়ে হেঁটে সিল্ক রুট অতিক্রম করার জন্য। কিন্তু যাত্রাপথে একদিন চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া একটা অর্ধমৃত তুষার নেকড়ে। কোনওভাবে গুলি লেগেছিল প্রাণীটার পিছনের পায়ে। এমন প্রায়শই হয় এখানে। দু-দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলি বিনিময়ে প্রাণ যায় নিরীহ প্রাণীদের। কখনও বা মানুষেরও।

এখন বরফ মোড়া পাহাড়গুলোতেও সীমান্ত সুরক্ষার জন্য ঘাঁটি গাড়ছে দু-দেশের সেনারা। বিশেষত চীন সেনারা তাদের দিকের পাহাড়গুলোতে বহু ঘাঁটি গেড়েছে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে সেখানকার প্রাণীরা। তার মধ্যে টিবেটিয়ান উল্য অন্যতম। তারা নীচে নেমে আসছে। তারপর মারা পড়ছে গ্রামবাসী বা এ দেশের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে।

যাই হোক সেই নেকড়েটাকে আমি তুলে এনে সুস্থ করে তুললাম। তখনই আমার মনে হল আচ্ছা এই দুষ্প্রাপ্য প্রাণীগুলোর জন্য কোনও কাজ করা যায় না? এখানে উপযুক্ত জায়গা পেয়ে আমি খুলে বসলাম এই ক্যাম্পটা। একে একে আমি সংগ্রহ করলাম আরও কিছু নেকড়ে। তাদের অধিকাংশকেই আমি সংগ্রহ করি গ্রামবাসীদের খপ্পর থেকে বা বনের মধ্যে থেকে। তাদের কেউ অনাহারে অথবা আহত হয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় ছিল। মোট পাঁচটা নেকড়ে আছে আমার এই ক্যাম্পে। ওদের জন্যই দেশ ছেড়ে এতদূরে পড়ে আছি আমি।

ভাইমারের কথা শুনে অনীশ বলল, আপনার উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। বুঝতে পারছি প্রাণীগুলোর প্রতি আপনার মমতা অপরিসীম। কিন্তু মুশকিল হল সব মানুষ এ ব্যাপারটা অনুভব করতে পারে না। গ্রামবাসীরা এ ক্যাম্পটা উৎখাত করার জন্য আবেদন জানিয়েছে সরকারের কাছে। এ দেশের বড় চিড়িয়াখানাগুলো অধিকাংশই সমতলে। সেখানে গরমে প্রাণীগুলো বাঁচবে না। পাহাড়ি অঞ্চলের চিড়িয়াখানাগুলো খুব ছোট। সেখানে দু-একটা করে তুষার নেকড়ে আছে। পরিকাঠামোর অভাবে তারা নিতে চাচ্ছে না আপনার প্রাণীগুলোকে। কাজেই…।

অনীশ তার কথা শেষ না করলেও তার অনুচ্চারিত বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হল না ভাইমারের। একটু বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ জানি। ওরা এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতে চায়। দেখুন যদি আপনি কিছু করতে পারেন।

অনীশ বলল, হ্যাঁ এ কথা ঠিকই যে দুষ্প্রাপ্য বন্যপ্রাণীদের মারতে হলে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণ সংস্থার কিছু নিয়মনীতি মানতে হয় সব দেশের সরকারকে। নইলে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলের বরাদ্দ অর্থ বন্ধ হয়ে যায়। তবে অনেক দেশ অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে সে নির্দেশ মানে না। যেমন একবার আফ্রিকার একটা দেশে দশ হাজার হাতি মারার ব্যবস্থা করা হল। আমরা ব্যাপারটা আটকাতে পারিনি। দেখা যাক গ্রামবাসীদের অভিযোগপত্রটা প্রত্যাহার করানো যায় কিনা? সরকার তো সেটাকেই সামনে রাখছে।

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, আপনি সে চেষ্টাই করুন। প্রয়োজনে আমি ওদের থেকেই মাংস কিনব। গ্রামের উন্নতির জন্য কিছু অর্থ সাহায্যও করব। এ প্রাণীগুলোকে আমি কিছুতেই মরতে দিতে পারি না।

বাইরে পাহাড়ের আড়ালে মনে হয় সূর্য ডুবতে বসেছে। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে বাইরে। ঘরের ভিতরটাও অন্ধকার হয়ে আসছে। বিষণ্ণ, নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন ভাইমার।

অনীশও বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলল, আপনার প্রাণীগুলোকে একটু দেখা যাবে?

বাইরে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে এখন নয়। ওদের ঘরগুলোতে বা এ বাড়িতে আলো নেই। দিনের আলোতে কাল ভালো করে দেখবেন ওদের। অনেকটা পথ এসেছেন, এবার বিশ্রাম নেবেন চলুন। কাল দিনের বেলায় যা করার করবেন।

কথাটা মিথ্যা বলেননি ভাইমার। গতকাল রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু। করেছিল অনীশ। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ও ঘরে চেয়ারে বসার পর বেশ ক্লান্ত লাগছে। ঠান্ডাও লাগছে বেশ।

টেবিলের ওপর একটা সেজ বাতি রাখা ছিল। সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে অনীশকে সঙ্গে করে এরপর ঘর ছেড়ে বেরোলেন ভাইমার। বাইরে সূর্য ডুবে গেছে। দ্রুত অন্ধকারের চাদরে মুড়ে যাচ্ছে চারপাশের পাহাড়, গিরিপথ। বাইরে বেরিয়ে ভাইমারের পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে অনীশ প্রশ্ন করল, আপনার অন্য সব লোকজন কোথায়?

ভাইমার জবাব দিলেন, তারা নানা কাজে বাইরে গেছে। এখনই ফিরবে।

বারান্দা বেয়ে কিছুটা এগিয়ে অনীশকে নিয়ে একটা ঘরে প্রবেশ করলেন ভাইমার। বেশ ছিমছাম সাজানো ঘর। খাট-বিছানা সবই আছে। ঘর সংলগ্ন টয়লেটও আছে। বাতিটা টেবিলের ওপর নামিয়ে ভাইমার বললেন, আপনি বিশ্রাম নিন। আমি এখন যাই। কাল সকালে আবার দেখা হবে। রাতে খাবার দিয়ে যাবে আমার লোক। তবে একটা কথা খেয়াল রাখবেন। রাতে মানুষের গলার শব্দ না শুনলে দরজা খুলবেন না। রাতে আমরা প্রাণীগুলোকে খাঁচার বাইরে বার করে দিই। ওদের সুস্থতার জন্যই এটা প্রয়োজন। যদিও ওরা আমাদের সঙ্গে প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই আচরণ করে। আপনাকেও কিছু করবে বলে মনে হয় না। তবু সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো।

মিস্টার ভাইমার চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে টয়লেটে যাবার পর পোশাক পালটে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল অনীশ। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিল সে। তারপর একসময় কৌতূহলবশত খাট সংলগ্ন জানলার পাল্লাটা খুলল।

পিছনের বরফ পাহাড়টা ধীরে ধীরে আলোকিত হতে শুরু করেছে। অন্ধকার কেটে গিয়ে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। অনীশ তাকিয়ে রইল সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদ উঁকি দিল পাহাড়ের আড়ালে। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন কেঁপে উঠল বাড়িটা। নেকড়ের ডাক! একযোগে ডেকে উঠল প্রাণীগুলো। চাঁদ ওঠার কারণেই রাত্রিকে আহ্বান জানিয়ে। চাঁদের সঙ্গে একটা আদিমতার সম্পর্ক আছে। নেকড়ে শেয়াল জাতীয় প্রাণীরা চাঁদ উঠলেই সেদিকে তাকিয়ে ডেকে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল সে ডাক।

তারপর একসময় থেমে গেল। বেশ ঠান্ডা বাতাস আসছে জানলা দিয়ে। কাজেই জানলা বন্ধ করে অনীশ আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত আটটা নাগাদ দরজায় টোকা দেবার শব্দ হল। তার সঙ্গে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, স্যার খাবার এনেছি। দরজা খুলল অনীশ। চীনা দেখতে একটা লোক খাবারের পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে। সমতলের লোকদের চোখে অবশ্য চীনা, নেপালি, ভুটিয়া ইত্যাদি পাহাড়ি লোকদের একইরকম দেখতে লাগে। ঘরে ঢুকে টেবিলে খাবারের পাত্রগুলো নামিয়ে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল অনীশ। টেবিলে সে রেখে গেছে রুটি আর ধোঁয়া ওঠা মুরগির মাংস। খাওয়া সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানায় চলে গেল অনীশ। ঘুম নেমে এল তার চোখে। ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই যেন সে শুনতে লাগল বাইরে থেকে ভেসে আসা নেকড়ের ডাক।

২. যখন ঘুম ভাঙল

অনীশের যখন ঘুম ভাঙল তখনও ভোরের কুয়াশা কাটেনি। জানলাটা একটু ফাঁক করে সে দেখল বাইরেটা পুরো কুয়াশায় মোড়া। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে তার কর্মপন্থা ঠিক করে নিল। তিনটে দিন সে এখানে কাটাতে পারবে। তার মধ্যেই তাকে যা করার করতে হবে। এদিনের কর্মপন্থা হিসাবে সে ঠিক করে নিল আজ প্রথমে সে প্রাণীগুলোকে দেখবে। তারপর গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের বক্তব্য শুনবে। এ জায়গার চারপাশটাও সম্ভব হলে ঘুরে দেখবে।

পরিকল্পনা শেষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। মিনিট দশেক সময় লাগল তার তৈরি হতে। তার মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল। চা নিয়ে এসেছে একজন। কালকের লোকটা নয়, অন্য একটা লোক। যদিও তার চেহারাও একই রকম। সেও তিব্বতী বা সিকিমিজ হবে। লোকটা চা দিয়ে চলে যাবার পর দরজাটা খোলাই রেখেছিল অনীশ। বাইরের কুয়াশা এবার ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। অনীশের চা-পানের কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ভাইমার। অনীশকে দেখে তিনি বললেন, সুপ্রভাত। আশা করি রাতে ঘুম ভালো। হয়েছে?

অনীশও সুপ্রভাত জানিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, ঘুম ভালো হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আপনার পোষ্যদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। চলুন এবার তাদের দেখতে যাব। আমি তৈরি হয়েই আছি।

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, চলুন, তাদের দেখাতে নিয়ে যাব বলেই এসেছি আমি।

ঘর ছেড়ে বেরোল অনীশ। কুয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রভাতি সূর্যকিরণে ঝলমল করছে বরফমোড়া পাহাড়ের শিখরগুলো। শুধু পাশের পাইনবনটা তখনও পাতলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। কিন্তু বাড়িটার সামনে ফাঁকা জমিটার দিকে তাকিয়ে অনীশ বেশ অবাক হয়ে গেল। ছিট ছিট সাদা বিন্দুতে ছেয়ে আছে সারা জমিটা। অনীশ কিছু প্রশ্ন করার আগেই ভাইমার বললেন, কাল রাতে তুষারপাত হয়েছে। এ মরশুমের প্রথম তুষারপাত। আর কদিনের মধ্যে তুষারের চাদরে মুড়ে যাবে এ অঞ্চল। রেশম পথও তখন চলে যায় চার-পাঁচ ফুট বরফের নীচে। মাসখানেকের জন্য এ পথে বন্ধ হয়ে যায় মানুষের যাওয়া আসা। যতদিন না আবার আর্মির লোকরা ড্রেজিং করে বরফ সরিয়ে রাস্তা বার করে।

অনীশকে নিয়ে বারান্দা ছেড়ে নীচে নামলেন ভদ্রলোক। তারপর বাড়িটাকে বেড় দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনীশকে নিয়ে চললেন বাড়িটার পিছন অংশে। ভদ্রলোকের হাঁটার ধরন দেখে অনীশ বুঝতে পারল যে ভাইমারের ডান পায়ে কোনও ত্রুটি আছে।

ভাইমারের সঙ্গে বাড়ির পিছনে পৌঁছে গেল অনীশ। বাড়িটার লাগোয়াই পাথরের তৈরি। সার সার বেশ বড় বড় ঘর। তার সামনে লোহার গরাদ বসানো। একটা বোঁটকা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। চিড়িয়াখানার মাংশাসী পশুদের ঘরের সামনে গেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমনই গন্ধ। ভাইমার অনীশকে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন প্রথম খাঁচাটার সামনে।

বাইরে সূর্যালোক কিছুটা ঢুকছে ঘরের ভিতর। ঘরটার এক কোণে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বিরাট একটা রোমশ প্রাণী। অনীশ ভালো করে তাকাল প্রাণীটার দিকে। হ্যাঁ, টিবেটিয়ান উলফ বা তুষার নেকড়েই বটে। সাদাটে সোনালি বর্ণের প্রাণীটা ঘুমোচ্ছে। ঈষৎ ফাঁক করা মুখের ভিতর লাল জিভটা আর শ্বদন্তগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভাইমার বললেন, এদের দেহের লোমের বৈশিষ্ট্য জানেন তো?

অনীশ একবার দার্জিলিং চিড়িয়াখানায় অন্য একটা কাজে গিয়ে এই টিবেটিয়ান নেকড়ে দেখেছিল। এখানে আসার আগে প্রাণীটার সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনাও করে এসেছে। সে বলল, হা, জানি। প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই নেকড়েদের উলের রংও পরিবর্তিত হয়। কখনও কালচে, কখনও ধূসর, কখনও সোনালি আবার কখনও ধবধবে সাদা হয়। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে আত্মগোপন করা, শিকার ধরার কারণে প্রকৃতি এদের এ ক্ষমতা দিয়েছে।

ভাইমার বললেন, ঠিক তাই। দেখুন শীত আসছে বলে ওদের লোমের রং সাদা হতে শুরু করেছে।

অনীশ বলল, আর এও জানি এদের গ্রে উলফও যে বলা হয় তা কিন্তু এদের গাত্রবর্ণের ধূসরতার জন্য নয়। জন এডোয়ার্ড গ্রে নামের এক ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ১৮৬৩ সালে সর্বপ্রথম এই টিবেটিয়ান উল্‌ফের সন্ধান পান। তাঁর নাম অনুসারেই এদের বলা হয় গ্রে উলফ।

ভাইমার তার কথা শুনে বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাঃ, আপনি অনেক কিছু জানেন দেখছি। আর জানবেনই বা কেন! আপনাদেরও তো কারবার বন্যপ্রাণ নিয়ে। হয়তো বা আপনি আমার চেয়েও বেশি জানেন এদের সম্বন্ধে। বেশ বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন মিস্টার ভাইমার।

প্ৰথম খাঁচা ছেড়ে দ্বিতীয় খাঁচার সামনে গেল অনীশরা। সেখানেও কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা নেকড়ে। তৃতীয় খাঁচা, চতুর্থ খাঁচাতেও নেকড়ে আছে। অনীশের হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা প্রাণীগুলো সুস্থ তো? অনেক সময় অসুস্থ শ্বাপদেরা অন্য প্রাণীর পিছু ধাওয়া করতে না পেরে মানুষকে আক্রমণ করে।

অনীশ প্রশ্ন করল, ওরা সব ঘুমাচ্ছে কেন?

ভাইমার বললেন, এমনিতেই প্রকৃতির নিয়মে যারা রাতে জাগে তারা দিনের বেলা ঘুমায়। সারারাত ছোটাছুটি করে ওরা এখন ক্লান্ত।

এ কথা বলে হয়তো বা অনীশের মনের বক্তব্য পাঠ করেই ভাইমার বললেন, আপনি দেখতে চাইছেন তো ওরা সুস্থ কিনা? দাঁড়ান দেখাচ্ছি। এই বলে তিনি একটা খাঁচার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে টক্ শব্দ করলেন। কয়েকবার শব্দ করার পরই চোখ মেলল ঘরের কোণায় শুয়ে থাকা নেকড়েটা। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিশাল একটা হাই তুলল। আধো অন্ধকারে ঝিলিক দিয়ে উঠল তার ধবধবে সাদা শ্বদন্ত বা ক্যানাইনগুলো। ভাইমার এরপর খাঁচার গায়ে শব্দ করে তার উদ্দেশ্যে বললেন–কাম, কাম।

ঠিক যেন পোষা কুকুরের মতো অত বড় নেকড়েটা ভাইমারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল খাঁচার গায়ে। গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে প্রাণীটার মাথায় একবার আদর করলেন ভাইমার। ঘড়ঘড় করে একটা আদুরে শব্দ করল নেকড়েটা। তারপর খাঁচার ভিতর চারপাশে একবার পাক খেয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে থাবায় মুখ ঢেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে দেখে বোঝা গেল প্রাণীটা বেশ সুস্থ সবল।

শেষ খাঁচাটার সামনে গিয়ে এরপর দাঁড়াল অনীশ। কিন্তু তার ভিতর কোনও প্রাণী দেখতে না পেয়ে সে বলল, এই খাঁচার নেকড়েটা কোথায় গেল? বাইরে ছাড়া আছে নাকি?

ভাইমার হেসে বললেন, না, দিনের বেলায় ওদের বাইরে ছাড়া হয় না। ও খাঁচাতেই আছে।

কোথায়, খাঁচার ভিতর?

ভাইমার বললেন, ওই দেখুন খাঁচার এক কোণে একটা বড় গর্ত আছে। প্রতি খাঁচাতেই ওই গর্ত আছে। নেকড়েরা ঠান্ডা পড়লে বরফের নীচে গর্ত করে ঘুমায়। তাতে ঠান্ডা কম লাগে কারণ বাতাস গায়ে লাগে না বলে। এটা ওদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাস। সেজন্য খাঁচার ভিতরও সেই ব্যবস্থা করা আছে। প্রাণীটা গর্তের ভিতরে আছে। দেখি ওকে বাইরে বের করতে পারি কিনা? এই বলে মুখ দিয়ে টক্ শব্দ করতে লাগলেন ভাইমার। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরও প্রাণীটাকে বাইরে আনতে না পেরে তিনি বললেন, ও এখন আরাম ভেঙে বাইরে বেরোবে না। ও বড় শীতকাতুরে। যেই বাইরে বরফ পড়তে দেখল অমনি গতাঁর ভিতর গিয়ে সেঁধিয়েছে। ওকে নয় পরে দেখবেন।

অনীশ বলল, ঠিক আছে ওকে নয় পরেই দেখব।

প্রাণীগুলোকে দেখার পর আবার বাড়ির সামনের দিকে ফেরার পথ ধরল অনীশরা। ভাইমার বললেন, কেমন দেখলেন প্রাণীগুলোকে? খুব সুন্দর তাই না?

অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, খুব সুন্দর প্রাণী।

ভাইমার আক্ষেপের স্বরে বললেন, কেন যে সরকার অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের কথায় এত গুরুত্ব দিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে গুলি করে মারা হবে সেটা ভাবতে পারছেন!

অনীশ চিন্তিত ভাবে বলল, সত্যিই ওরা এই কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে যায় না তো?

ভাইমার বললেন, আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি ওরা এর বাইরে যায় না। যারা মারা গেছে সেগুলো হয় চিতাবাঘ বা অন্য কোনও নেকড়ের কীর্তি। নেকড়ের তো অভাব নেই এখানে। ভাবছি আমি একটা চেষ্টা করব। যে প্রাণীটা লোক মারছে তাকে ধরা বা মারা যায় কিনা দেখব। তার খোঁজে বন্দুক নিয়ে বনে ঘোরাও শুরু করেছিলাম কিন্তু গ্রামবাসীদের ভয়ে দিনের বেলা আর বাইরে বেরোতে ভরসা পাচ্ছি না। রাতেই না হয় বেরোব তবে। যদিও ব্যাপারটা বিপদজনক। তবুও সে চেষ্টাই করতে হবে। এতে যদি গ্রামবাসীরা সত্যিটা বুঝতে পারে।

অনীশ বলল, আমি এখন গ্রামে যাব কথা বলতে। কীভাবে যাব পথটা দেখিয়ে দিন। দেখি তারা কী বলে?

ভাইমার বললেন, আমি কিন্তু যাব না আপনার সঙ্গে। আমাকে বাগে পেলে তারা খুনও করতে পারে। তাছাড়া কিছু লোকের আসার কথা এখানে।

অনীশ বলল, আমি একাই যাব। আমার ড্রাইভার পবন বাহাদুর ও গ্রামেই আছে। অসুবিধা হবে না।

ভাইমার বললেন, ঠিক আছে রাস্তাটা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

ভাইমারের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল ফোনে পবন বাহাদুরকে ধরল অনীশ। সে তাকে বলল গ্রামের লোককে জানিয়ে দাও আমি আসছি। তবে ওয়াইল্ড লাইফের লোক এ ব্যাপারটা তাদের বলার দরকার নেই। হয়তো তারা সেটা বুঝবে না। তাদের বোলো যে সরকারি তরফে আমি খোঁজ নিতে যাচ্ছি তাদের কাছে।

পবন বাহাদুর জানাল, ঠিক আছে স্যার। তবে এরা খুব খেপে আছে সাহেবটার ওপর।

ফোনটা জ্যাকেটের পকেটে রাখার পর অনীশ ভাইমারকে প্রশ্ন করল, কাদের আসার কথা এখানে?

ভাইমার জবাব দিলেন, তিব্বতী চীনাদের একটা দল। সীমান্ত পেরিয়ে ওপার থেকে আসবে ওরা আমাদের জন্য রেশন, পশুগুলোর জন্য মাংস ইত্যাদি নিয়ে। গত তিনমাস ধরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে সব লেনদেন তো বন্ধ। কাজেই ওই চীনারাই ভরসা। তা ছাড়া জিনিসপত্র কম দামেও দেয় ওরা।

তার কথা শুনে অনীশ মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, এভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা যাওয়া করা যায় নাকি?

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, স্থানীয় লোকরা করে। এখানে তো কাটাতারের বেড়া নেই। আপনি বুঝতেই পারবেন না কোনটা চীন আর কোনটা ইন্ডিয়া। দু-দেশের সীমান্তরক্ষীরা এ ব্যাপারে খুব একটা বাঁধা দেয় না। তবে যারা ওদেশ থেকে আসে তারা খুব বেশি নীচে নামে না, আর এ দেশের স্থানীয় মানুষরাও ও দেশের ভিতরে ঢোকে না। সীমান্তে উত্তেজনা না থাকলে স্থানীয়ভাবে এ ব্যাপারটা চলে।

ফাঁকা জমিটার যে দিকটায় বাইরের দিক থেকে পাইনবন কাঁটাতারের বেড়াকে প্রায় ছুঁয়ে আছে সেদিকটাতে ভাইমারের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল অনীশ। সেখানেও বাইরে যাবার একটা দরজা আছে। সে দরজার বাইরে থেকেই একটা অঁড়িপথ প্রবেশ করেছে পাইনবনের ভিতরে। দরজাটা খুলে শুড়িপথটা দেখিয়ে ভাইমার বললেন–এ পথটা যেমনভাবে গেছে তেমন তেমন। চলে যাবেন। একটু কোনাকুনি গেলেই ঢাল বেয়ে গ্রামে পৌঁছে যাবেন।

ঘেরা জায়গাটার বাইরে বেরিয়ে পাইবনে প্রবেশ করল অনীশ। বিরাট বিরাট সব গাছ। দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। তার ঋজু গুঁড়িগুলো সব সোজা উঠে গেছে ওপরদিকে। গাছগুলো কত প্রাচীন কে জানে! শ্যাওলার পুরু আবরণ জমে রয়েছে গায়ে। কোনও গুঁড়ির গায়ে জন্মেছে। থালার মতো বিরাট বিরাট ছত্রাক। একটা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বিরাজ করছে বনের মধ্যে। কেমন। যেন গা-ছমছমে রহস্য ভাবও আছে। ভাইমারের দেখানো শুড়িপথ দিয়ে হাঁটতে লাগল অনীশ। মাঝে মাঝে পাতা থেকে মাটিতে জল খসে পড়ার শব্দ অথবা বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। যে পথ ধরে অনীশ গাড়ি নিয়ে এসেছে তার ডানহাতেই মাইল তিনেক বিস্তৃত এই পাইনবন। তবে শুড়িপথটা পাইন বনের একটু ভিতরে ঢুকেই ভাইমারের নেকড়ে খামারের কোনাকুনি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে। সে পথই ধরল অনীশ।

কিছুক্ষণ চলার পরই বনটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেল। বনের বাইরে বেরিয়ে এল। অনীশ। বনের ঠিক বাইরে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। পাহাড়ি ছোট ছোট গ্রাম যেমন হয় এ গ্রামটাও তেমনই। পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো অনুচ্চ প্রাচীর ঘিরে আছে গ্রামটাকে। সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি ঘর হবে গ্রামে। ঘরগুলোর দেওয়াল পাথরের তৈরি। মাথার ওপর নীচু ছাদ। ঘেরা চৌহদ্দির একপাশে একটা খোঁয়াড়ও আছে। পশুর ডাকও ভেসে আসছে সেখান থেকে।

অনীশের আগমনবার্তা ড্রাইভার পবনের মাধ্যমে আগাম পেয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল গ্রামের লোকজন। তাদের মধ্যে পবনও ছিল। অনীশ ঢাল বেয়ে নীচে নামতেই তাকে বেশ খাতির করে গ্রামের ভিতর নিয়ে গেল কয়েকজন। একটা ফাঁকা জায়গাতে একটা পাথরের ওপর অনীশকে বসানোর পর তাকে ঘিরে দাঁড়াল।

গ্রাম্য গরিব পাহাড়ি মানুষ সব। পরনে শতছিন্ন শীতবস্ত্র। মাথায় টুপি। এই শীতেও অধিকাংশেরই খালি পা। বুড়ো বুড়ি, জোয়ান, বাচ্চা কাচ্চা মিলিয়ে একশজন মতো হবে। অনীশ বসার পর ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বুড়োলোক বেরিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। পবন তাকে দেখিয়ে বলল, স্যার, এ হল নরবু। গ্রামের মাথা। ওই কথা বলবে আপনার সঙ্গে।

নরবু! এ লোকটার নাম ভাইমারের মুখে শুনেছে অনীশ। লোকটার মাথায় একটা চামড়ার টুপি, গায়ে নোংরা জ্যাকেট। সম্ভবত বয়সের ভারেই একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে লোকটা। তার অসংখ্য বলিরেখাময় মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই তিব্বতী লোকটা এ জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে। তবে তার নরুন-চেরা জ্বহীন চোখের দৃষ্টি এখনও বেশ তীক্ষ্ণ। তার হাতে ছিল একটা কাঠগোলাপের স্তবক। সেটা সে অনীশকে দিল।

লোকটাকে একবার ভালো করে দেখে নেবার পর অনীশ বলল, তোমরা তো ওই নেকড়ে খামারটার ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছ। তাই আমি সরকারের তরফ থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আমি জানতে চাই আসল কারণটা কী?

নরবু একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা মানুষ মারতে শুরু করেছে। গত ছমাসে বেশ কজন মানুষের দেহ মিলেছে বনের মধ্যে।

অনীশ বলল, তারা তো গ্রামের লোক নয় বলেই জানি।

নরবু বলল, তারা গ্রামের লোক নয় ঠিকই কিন্তু একবার নেকড়েরা মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষ মারতে শুরু করে। আমাদের দুজন লোককে নেকড়েগুলো তাড়াও করেছিল। পালিয়ে এসেছে তারা। এই জঙ্গলের ওপরই আমাদের জীবন নির্ভর করে। কাঠ সংগ্রহ, পশুপালন সব বন্ধ হতে বসেছে।

অনীশ বলল, সে তো অন্য নেকড়েও করতে পারে। নেকড়ের তো অভাব নেই এখানে?

নরবু বলল, কথাটা ঠিক। কিন্তু মানুষগুলোকে মেরেছে খামারের নেকড়েগুলোই। আমাদের লোক দুজনকে ওরা তাড়া করার পর যখন আমরা নেকড়ে মারার জন্য জঙ্গলে ঢুকি তখন ওই খামারের দুজন লোককে পেয়েছিলাম জঙ্গলের ভিতর।

অনীশ বলল, তাদেরও তো তোমাদেরই মতো জঙ্গলে ঢুকতে বাধা নেই। তোমরা কি নেকড়ে পেয়েছিলে তাদের সঙ্গে?

বৃদ্ধ জবাব দিল, না, পাইনি।

অনীশ বলল, তবে কীভাবে প্রমাণ হল যে খামারের নেকড়েরাই মানুষ মারছে?

প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃদ্ধ বলে উঠল, দুটো নেকড়ে তাড়া করেছিল আমাদের লোকদের। বনের ভিতরও পাওয়া গেছিল খামারের দুজনকে। আসলে ওরাই তাড়া করেছিল আমাদের লোকদের। ওরা আসলে মানুষ নয়, নেকড়ে মানুষ।

নেকড়ে মানুষ! ওয়্যার উল! মৃদু চমকে উঠল অনীশ। এদের আতঙ্কের আসল কারণটা এবার বুঝতে পারল সে। বহু দেশের পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে কু-সংস্কার আছে যে যুদ্ধে যারা মারা যায় তারা নেকড়ে হয়ে যায়। বিশেষত দুর্গম, তুষার ঢাকা পার্বত্য অঞ্চলে মৃত মানুষদের দেহ অনেক সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় না বা সৎকার করা সম্ভব হয় না। জঙ্গলে, খাদের ভিতর বা তুষার চাপা অবস্থায় পড়ে থাকে মৃতদেহ। ওদের প্রেতাত্মারাই নাকি ওয়্যার উফের রূপ ধারণ করে। এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে বহু সময় মারা হয় এই দুষ্প্রাপ্য প্রাণীগুলোকে।

গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অন্ধবিশ্বাস চট করে ভাঙা সম্ভব নয়। সে ধারণা এখন ভাঙতে গেলে বরং বিপদ হতে পারে। অনীশ তাই বলল, হ্যাঁ, ওয়্যার উলফের ব্যাপারটা আমিও শুনেছি। কিন্তু দুটো নেকড়ে তাড়া করেছিল আর ওই লোকগুলো সংখ্যায় দুজন ছিল বলেই কি ধরে নেওয়া যায় ওরা ওয়্যার উলফ?

নরবু বলল, শুধু সে কারণে নয়, যেখানে যেখানে দেহ মিলেছে সেখানেই তার পাশে পাওয়া গেছে মানুষের পায়ের ছাপ। ঘটনার আগে-পরে খামারের লোকগুলোকে জঙ্গলে ঢুকতে বেরোতেও দেখেছে অনেকে। যখন ওরা প্রথমে খামারটা খুলল তখন ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারিনি। সাহেব আর তার লোকজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্কই ছিল আমাদের, তারপর ধীরে ধীরে ওরা কথাবার্তা, কাজ কারবার বন্ধ করে দিল। ওরা মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। নেকড়ের রূপ ধরে। এমনকী যে-কোনও মানুষেরও রূপ ধরতে পারে ওরা। আপনি তো ওখানে আছেন শুনলাম। সাবধানে থাকবেন।

অনীশ বুঝতে পারল, ওয়্যার উফের ব্যাপারটা বেশ জেঁকে বসেছে এদের মাথায়। তাই সে তাদের আশ্বস্ত করার জন্য এবার অন্য কৌশল নিল। সে বলল, তোমাদের কথা আমি অবিশ্বাস করছি না। ইচ্ছা করলে তো আজকেই তুলে দেওয়া যায় খামারটা। কিন্তু তার জন্য আরও মজবুত প্রমাণ দরকার। ভাইমার সাহেব একটু সময় চাইছেন তোমাদের কাছে। তোমরা যদি আবার সরকারকে চিঠি দিয়ে অভিযোগটা তুলে নাও তবে তিনি আবার মাংস কিনবেন তোমাদের কাছ থেকে। গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি অর্থ সাহায্যও করবেন তোমাদের। তার কাছে যদি তোমাদের আরও কোনও দাবি থাকে তবে আমি তা নিয়ে তার সঙ্গে কথাও বলতে পারি। আমি তোমাদের চাপ দিচ্ছি না। শুধু একবার ভেবে দেখতে বলছি। উভয় পক্ষেরই কোথাও কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে।

তার কথা শুনে মাথা নাড়ল নরবু। তারপর বলল, ভুল আমাদের হচ্ছে না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। তবে আপনি সাবধানে থাকবেন। আমার বিশ্বাস ওরা নেকড়েই।

অনীশ আর কথা বাড়াল না। কাঠগোলাপের পুষ্পস্তবকটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, এবার আমি চলি। কাল আবার আসব।

পাহাড়ের ঢালের পাইনবনের মুখ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এল ড্রাইভার ছেলেটা। অনীশ তাকে বলল, গ্রামের তেমন কিছু খবর হলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমাকে জানাবে।

বনের মধ্যে দিয়ে একটু সাবধানে ফিরবেন।

পবন বলল, আচ্ছা সাহেব। কোনও খবর হলেই জানাব।

তাকে বিদায় জানিয়ে বনে প্রবেশ করল অনীশ। চারপাশে আবার সেই অদ্ভুত আলো আঁধারী পরিবেশ। গাছের পাতা থেকে জল খসে পড়ার টুপটাপ শব্দ। হিমেল বাতাস বনের মধ্যে এমনভাবে বয়ে যাচ্ছে যে ঠিক যেন ফিসফাস শব্দে কারা কথা বলছে পাইনগাছের আড়াল থেকে। পবন আর গ্রামবাসীদের কথা মেনে একটু সাবধানেই চলছিল অনীশ। ওয়্যার-উফের ভয়ে নয়। ওসবে সে বিশ্বাস করে না। তবে সত্যিকারের নেকড়ে বনে থাকতেই পারে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

হাঁটছিল অনীশ। হঠাই পাশেই একটা গাছের আড়াল থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে সে দিকে তাকাতেই দেখতে পেল গাছটার আড়ালে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার পোশাকের কিছুটা অংশ গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে।

অনীশ বলে উঠল, কে ওখানে? কে?

প্রশ্ন শুনে গাছের আড়াল থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখে অনীশ বেশ অবাক হয়ে গেল।

সে বলল, ভাইমার আপনি এখানে?

ভাইমারের মুখে কেমন যেন একটা অপ্রস্তুত হাসি। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি। ক্যাম্পে। থাকতে আর ভালো লাগছিল না, তাই বনে ঢুকেছিলাম। গ্রামবাসীরা কী বলল?

অনীশ জবাব দিল, কথা বললাম ওদের সঙ্গে। আপনি যে ওদের থেকে পশু কিনবেন, অর্থ সাহায্য করবেন সেটা ওদের জানিয়েছি। দেখা যাক ওরা মত পরিবর্তন করে কিনা?

অনীশের জবাব শুনে চুপ করে কী যেন ভাবলেন ভাইমার। তারপর প্রশ্ন করলেন, আপনি এখন কোথায় যাবেন? ক্যাম্পে ফিরবেন?

অনীশ বলল, ভাবছি চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নেই। এই বনের মধ্যে দিয়ে গাড়ি রাস্তায় যাবার অন্য কোনও পথ আছে?

ভাইমার একটা গাছের গুঁড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ওর আড়াল থেকে একটা শুড়িপথ নেমেছে ওদিকে। ওটা ধরে চলে যান। রাস্তা পাবেন। ঠিক আছে ক্যাম্পে ফিরে আবার দেখা হবে। এই বলে সেদিকে এগোল অনীশ।

৩. ভাইমারের নির্দেশিত শুঁড়িপথ

ভাইমারের নির্দেশিত শুঁড়িপথ ধরে আধঘণ্টা মতো চলার পর সেই রাস্তা পেয়ে গেল অনীশ। যে রাস্তা দিয়ে ক্যাম্পে এসেছিল সে। নির্জন রাস্তা। একপাশে পাইনবনের ঢাল। অন্যদিকে পাথরের প্রাচীর। ড্রাইভার ছেলেটার কথা অনুযায়ী ওদিকটাই চীন। গত রাতে তুষারপাত হয়েছে। যদিও সূর্যালোকে তা এখন গলতে শুরু করেছে তবুও এখনও রাস্তার খানাখন্দে, পাথরের দেওয়ালের গায়ে তার চিহ্ন লেগে আছে।

বেশ কিছুক্ষণ ক্যাম্পের উলটোপথে হাঁটার পর রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরের ওপর বসল অনীশ। কাছেই বন থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

পাইনবনের দিকে তাকিয়ে অনীশ ভাবতে লাগল গ্রামবাসীরা কি সম্মত হবে তার কথায়। অমন সুন্দর প্রাণীগুলোকে কি শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাবে। একসময় এ তল্লাটের আদি বাসিন্দাদের অন্যতম ছিল এই টিবেটিয়ান নেকড়েগুলোই। প্রচুর সংখ্যায় ছিল ওরা। কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে চামড়ার জন্য নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে ওদের। ওয়্যার উলফ ভেবেও স্থানীয় মানুষরা পুড়িয়ে মেরেছে প্রকৃতির এই সন্তানদের। এখন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের রিপোর্ট অনুযায়ী এই তিব্বতী নেকড়ের সংখ্যা মাত্র তিনশোতে এসে ঠেকেছে।

আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণ সংস্থার দুষ্প্রাপ্য বণ্যপ্রাণীদের যে তালিকা আছে তাতে একদম প্রথম দিকেই আছে এই প্রাণী। দেশের সরকার শেষ পর্যন্ত খামারের প্রাণীগুলো সম্বন্ধে যাই সিদ্ধান্ত নিক না কেন অনীশদের সংস্থার তরফ থেকে তাকে অনুরোধ করা হয়েছে যে সে যেন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে প্রাণীগুলোকে রক্ষা করার। অনীশ সেই চেষ্টাই করবে।

প্রাণীগুলোর সম্বন্ধেই ভাবছিল অনীশ। হঠাৎ একটা জিপের হর্ন শুনতে পেল সে। সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে চলন্ত গাড়িটাতে ড্রাইভারের পাশের আসনে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামরিক বাহিনীর এক জওয়ান। অনীশকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে গাড়িটা এসে থামল অনীশের ঠিক সামনে।

ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়ি। বেশ কয়েকজন লোক আছে তাতে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল ধোপদুরস্থ সামরিক পোশাক পরা ছোটখাটো চেহারার একজন মাঝবয়সি লোক। হাতে একটা ফাইল। সম্ভবত লোকটা পাহাড়ি দেশের মানুষই হবে। অনীশ তার বুকে লাগানো কাপড়ের পটিগুলো দেখেই বুঝতে পারল যে লোকটা সামরিক বিভাগের কোনও উচ্চপদস্থ কর্মচারী হবে। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল অনীশ।

লোকটা এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। তারপর ইংরাজিতে জানতে চাইল, আপনিই তো মিস্টার অনীশ মুখার্জী? ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের প্রতিনিধি হয়ে এখানে এসেছেন?

অনীশ বলল, হ্যাঁ। আপনি? এই বলে সে পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি কার্ড বার করে সেটা দেখাতে যাচ্ছিল ভদ্রলোককে, কিন্তু তিনি বললেন, থাক ওটা দেখাবার প্রয়োজন। নেই। আপনার পরিচিতি সম্পর্কে কাগজ আমাদের কাছে সরকারের তরফ থেকে আছে। সেখানে আপনার ছবিও আছে। দেখেই চিনতে পেরেছি। আমি লেফটানেন্ট ছেত্রী। এই সেক্টর, মানে এই অঞ্চলের সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে আছি। এখানে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স আর আমরা একসঙ্গে কাজ করি। এই বলে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

করমর্দন পর্ব মেটার পর অনীশ বলল, আপনি কি এখানকারই লোক? আমার সঙ্গে কোনও দরকার আছে?

ভদ্রলোক হেসে বললেন, না, না, আমি কার্শিয়াং-এর লোক। তবে বেশ কয়েকবছর ধরে এখানে পোস্টেড।

এরপর একটু থেমে লেফটানেন্ট বললেন, দরকার মানে আপনাকেই খুঁজছিলাম আমি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে আপনার ওপর নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে।

অনীশ বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, নজর রাখতে বলা হয়েছে কেন? আমি অপরাধী, নাকি গুপ্তচর?

ভদ্রলোক হেসে বললেন, না, না, তেমন ব্যাপার নয়। আপনি এ দেশের নাগরিক হলেও একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি। এ জায়গা সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এখানে বিপদ ঘটতে বেশি সময় লাগে না। তাই আপনার নিরাপত্তার স্বার্থেই আপনার ওপর নজর রাখার নির্দেশ এসেছে। তাছাড়া আপনি যে জায়গাতে উঠেছেন সে জায়গাটা ভালো নয় বলেই আমাদের ধারণা।

অনীশ বলে উঠল, ও জায়গা ভালো নয় কেন? গ্রামের মানুষদের মতো আপনিও কি ওয়্যার উফের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন? আপনাদেরও কি আপত্তি আছে এই উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্পটা নিয়ে? তার বন্ধুর মুখে শোনা গোপন খবরটা যাচাই করার চেষ্টা করল অনীশ।

একটু চুপ করে থেকে লেফটানেন্ট ছেত্রী জবাব দিলেন, না, আমি ওসবে বিশ্বাস করি না। আপনি নিশ্চয়ই দেশপ্রেমিক একজন নাগরিক?

অনীশ জবাব দিল, হা, নিশ্চয়ই। এ বিষয়ে আপনি ভরসা রাখতে পারেন।

লেফটানেন্ট আবারও একটু চুপ করে থেকে যেন একটু ইতস্তত করে বললেন, হ্যাঁ, আমরাও চাই যে উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্পটা এখান থেকে উঠে যাক। সেটা ওয়্যার উলফের কারণে নয়। আমাদের ধারণা বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ আছে মিস্টার ভাইমারের। একটা সময় পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ রাখতেন আমাদের সঙ্গে, কিন্তু বেশ কিছুদিন হল তিনি সব যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন।

অনীশ প্রশ্ন করল, যোগাযোগ ছিন্ন করাই কি আপনাদের সন্দেহের কারণ?

লেফটানেন্ট বললেন, না, ওটাই একমাত্র কারণ নয়। আরও কারণ আছে। তবে সামরিক বাহিনীর সব খবর বাইরের লোককে বলা যায় না। ক্ষমা করবেন আমাকে। তা ফার্মটা কেমন দেখলেন? পশুগুলোকে দেখলেন?

অনীশ জবাব দিল, দেখেছি। বেশ সুস্থ সবল সুন্দর প্রাণী সেগুলো।

আর মানুষগুলো? জানতে চাইলেন ছেত্রী।

অনীশ বলল, মিস্টার ভাইমার আর তার দু-জন সহকর্মীর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে আমার। যদিও ভাইমারের সঙ্গীদের সঙ্গে বাক্যালাপ হয়নি। তবুও বলি তাদের কোনও অস্বাভাবিক আচরণ আমি দেখিনি।

লেফটানেন্ট এবার তার হাতের ফাইলটা খুলে তার একটা পাতা মেলে ধরলেন অনীশের সামনে। সেখানে রয়েছে বেশ কয়েকজন লোকের রঙিন ফোটোগ্রাফ। তাদের ছবি দেখে অনীশের মনে হল তারা চীনা সামরিক বাহিনীরই কেউ হবে। কারণ, লাল পট্টিঅলা, তারকা খচিত এই কালচে সবুজ পোশাক পরা লোকদেরই সে আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল চীন ভূখণ্ডে।

ছবিগুলো দেখিয়ে লেফটানেন্ট তাকে প্রশ্ন করলেন, ছবিগুলো ভালো করে দেখে বলুন তো এই ছবিগুলোর মধ্যে কাউকে আপনি ওই উলফ ক্যাম্পে দেখেছেন কিনা?

তাঁর কথা শুনে পাঁচটা ছবিই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল অনীশ। তার সঙ্গে কল্পনা করল তাকে খাবার দিতে আসা লোক দুজনের মুখ।

তারপর সে বলল, আমার কাছে যে ফাইল আছে তাতে বলা আছে ভাইমার সাহেবের চারজন কর্মচারী আছে ওই নেকড়ে ক্যাম্পে। তাদের ছবিও আছে আমার ফাইলে। তাদের মধ্যে আমি দু-জন কর্মচারীকে দেখেছি। আপনার ফাইলের লোকগুলোর মুখের সঙ্গে সে দু-জন লোকের মুখের মিল নেই।

লেফটানেন্ট এবার তার ফাইলটা বন্ধ করে বললেন, যদি বাকি অন্য দু-জনের সঙ্গে এই ছবিগুলোর কারও মিল পান অথবা এদের মধ্যে কাউকে ওখানে দেখতে পান তবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা প্রয়োজন। আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিন, আর আমারটাও রাখুন আপনার কাছে।

দুজনের মধ্যে ফোন নম্বর বিনিময়ের পর লেফটানেন্ট ছেত্রী জানতে চাইলেন, আপনি এখন কোথা থেকে এলেন? কোথায় যাবেন?

অনীশ বলল, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে গেছিলাম। আবার এরপর নেকড়ে খামারে ফিরব।

গ্রামের মানুষরা কী বলল? জানতে চাইলেন ছেত্রী।

অনীশ বলল, ওদের ধারণা ক্যাম্পের নেকড়েগুলো আসলে ওয়্যার উলফ! ভাইমার বলেছেন যে অভিযোগপত্র তুলে নিলে তিনি তাদের অর্থ সাহায্য করবেন। সেটাও তাদের জানালাম। দেখা যাক…।

লেফটানেন্ট বললেন, আমরা এই ওয়্যার উফের ব্যাপারটা বিশ্বাস না করলেও হয়তো বা ভাইমারই এ ব্যাপারটার জন্য কিছুটা দায়ী। এই মাস ছয়েক আগেই একবার একদিন রাতে মিস্টার ভাইমার আমাকে উত্তেজিত ভাবে ফোন করে বলেছিলেন, জানেন আমার ধারণা হচ্ছে। যে আমার নেকড়েগুলো সব ওয়্যার উন। তার কথা শুনে আমি হেসে ফেলায় তিনি ফোন রেখে দিলেন। সেই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। তিনি আমার ফোন আর ধরেন না। ফোনও করেন না। হয়তো তিনি গ্রামবাসীদেরও কাউকে খেয়ালবশে কোনও কারণে একথা বলেছিলেন। সেটাই প্রচারিত হয়েছে। তবে গ্রামবাসীরা একবার ক্যাম্পটা আক্রমণ করার চেষ্টা করে সফল না হলেও কিন্তু নেকড়ে নিধন যজ্ঞে নেমে পড়েছে।

অনীশ বলল, সেটা কেমন?

লেফটানেন্ট বললেন, এ অঞ্চলে একটা বিশেষ ব্যাপারে তল্লাশি চালাচ্ছিলাম আমরা। জিনিসটার খোঁজে কাছেই এক জায়গায় মাটি খুঁড়েছিলাম। সেখান থেকে চারটে টিবেটিয়ান উফের চামড়া কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে। আমার ধারণা গ্রামবাসীরা তাদের মেরে মাটিতে পুঁতে দিয়েছে।

অনীশ চমকে উঠে বলল, এমন দুষ্প্রাপ্য পাঁচটা প্রাণীকে মেরে ফেলল ওরা?

ছেত্রী বললেন, আমার ধারণা তাই। তবে ওদের তেমন দোষ দেওয়া যায় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ওয়্যার উল সম্বন্ধে কুসংস্কার কি এত সহজে দূর করা সম্ভব? যদিও ব্যাপারটা ওরা ভয়ে স্বীকার করতে চাইছে না কেউ। কারণ সরকারি তরফ ছাড়া বন্যপ্রাণী হত্যা আইন বিরুদ্ধ।

অনীশ প্রশ্ন করল, কীসের খোঁজে গিয়ে আপনারা নেকড়েগুলোর মৃতদেহর সন্ধান। পেলেন?

লেফটানেন্ট মৃদু হেসে বললেন, কীসের খোঁজে আমরা গেছিলাম সেটা বলা যাবে না আপনাকে। এটাও সামরিক বাহিনীর গোপন ব্যাপার।

অনীশ বলল, সরি। ব্যাপারটা জিগ্যেস করা আমার উচিত হয়নি।

লেফটানেন্ট এরপর আর বেশি কথা বাড়ালেন না। তিনি বললেন, এবার আমাকে যেতে হবে। কোনও অসুবিধায় পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দেবেন।–এই বলে অনীশের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন তিনি। পথের বাঁকে হারিয়ে গেল তার গাড়ি। অনীশও এরপর ক্যাম্পে ফেরার জন্য এগোল।

ক্যাম্পে পৌঁছে গেল অনীশ। বাড়িটার সামনের জমিটায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গতকাল তালা খুলে দিয়েছিলেন ভাইমার। কিন্তু অনীশ খেয়াল করল আজ দরজায় তালা দেওয়া নেই। হয়তো বা তার জন্যই তালাটা খুলে রাখা হয়েছে। গেটের ফাঁক দিয়ে ওপাশে হাত গলিয়ে ওপাশের ছিটকিনি খুলে ভিতরে প্রবেশ করল অনীশ। ঠিক সেই সময় মাথার ওপরের আকাশটাতে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এল। পাহাড়ি অঞ্চলে সারাদিনই এমন মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা চলে। ফাঁকা জমি পেরিয়ে বারান্দায় উঠল অনীশ। সেখানেও কোনও লোকজন নেই।

নিজের ঘরে ঢুকে কিন্তু অনীশ দেখতে পেল তার টেবিলে খাবার রাখা আছে। ধোঁয়া উঠছে তার থেকে। অর্থাৎ কিছুক্ষণ আগেই খাবার দিয়ে গেছে কেউ। ভাইমার কি ফিরেছেন বাইরে থেকে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। এতটা পথ হাঁটার ফলে বেশ খিদেও পেয়েছিল তার। কাজেই খাওয়া সেরে নিয়ে বিছানায় বসল সে।

জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন আধো-অন্ধকার ভাব। পিছনের বরফ পাহাড় থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে অনীশ লেফটানেন্ট ছেত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথনগুলো ভাবতে লাগল। ছেত্রী কি সন্দেহ করছেন এ বাড়িতে অন্য কেউ ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে? কথাটা মনে হতেই নিজের সঙ্গে আনা ফাইলটা খুলল অনীশ। ভাইমার সহ তার কর্মচারী চারজনের ছবি আর পাঁচটা নেকড়ের ছবি আছে ফাইলটাতে। ভাইমারের যে দুজন। সঙ্গীকে অনীশ ইতিমধ্যে দেখেছে তাদের মধ্যে দুজনের ছবি দেখে চিনতে পারল অনীশ। মনে মনে সে ভেবে নিল ভাইমারের কর্মচারীদের মধ্যে বাকি দুজনের চেহারাও মিলিয়ে নিতে হবে ফাইলের ছবির সঙ্গে।

ফাইলটা ঘাঁটছিল অনীশ। দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎ যেন দরজা বেয়ে আসা আলোটা আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। অনীশ তাকিয়ে দেখল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ভাইমার। তাকে দেখে ফাইল বন্ধ করে অনীশ বলল, আপনি কখন ফিরলেন?

ভাইমার বললেন, মানে?

অনীশ বলল, পাইনবনে যে আপনার সঙ্গে দেখা হল তারপর কখন ক্যাম্পে ফিরলেন?

ভাইমার একটু চুপ করে রইলেন। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট লাগছে তার মুখ। তিনি বললেন, ও, হা, বেশ কিছুক্ষণ হল।

জবাব দিয়ে ভাইমার ঘরের ভিতর ঢুকতে গিয়েও হঠাৎই থমকে গেলেন। বেশ কয়েকবার নাক টেনে ঘরের ভিতর তাকালেন তিনি। তার নজর গিয়ে থামল অনীশের খাটের ওপর পড়ে থাকা কাঠ গোলাপের বোকেটার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ফেলে দিন বোকেটা, এখনই জানলা দিয়ে ফেলে দিন। কারা দিল ওটা?

বিস্মিতভাবে অনীশ বলল, গ্রামবাসীরা। কেন কী হল?

ভাইমার দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বার করে নাক চাপা দিয়ে বলল, ওতে আমার ভয়ানক অ্যালার্জি। এখনই আমার হাত মুখ চুলকাতে শুরু করবে। প্লিজ ফেলে দিন ওটা।

অনীশ ব্যাপারটা এবার বুঝতে পেরে জানলা দিয়ে বোকেটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলল।

ঘরে ঢুকলেন ভাইমার। অনীশও খাট ছেড়ে নামল। মুখ থেকে রুমাল সরালেন ভাইমার। এর মধ্যেই তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। বিশেষ বিশেষ ফুলের গন্ধে অনেকেরই অ্যালার্জি হয়। অনীশের এক পরিচিত বন্ধুর কাঠালি-পা ফুলের গন্ধেও এমন অ্যালার্জি হত।

রুমাল সরিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন ভাইমার। তাই দেখে অনীশ বলল, আপনাকে বেশ চিন্তান্বিত লাগছে! কিছু হয়েছে?

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ। মাথায় চিন্তা ঘুরছে। ওপার থেকে তিব্বতী চীনাদের দলটার রসদ নিয়ে ভোরবেলাই পৌঁছোনোর কথা। তারা এখনও এল না। এদিকে আকাশের যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আজ সন্ধ্যা থেকেই ভারী তুষারপাত শুরু হবে। বরফে পাস আটকে গেলে তারা আর আসতে পারবে না। এদিকে রসদও শেষ। আমাদের কথা বাদ দিন প্রাণীগুলোকে তো খাবার দিতে হবে। আমার কর্মচারীরা তো বটেই প্রাণীগুলোও গত দুদিন ধরে না খেয়ে। আছে বলা চলে।

অনীশের বেশ লজ্জা লাগল ভাইমারের কথা শুনে। তাদের নিজেদের খাদ্য সংকট অথচ তারা দু-বেলা অনীশের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন বলে।

সে বলল, আমার খাবার নিয়ে কিন্তু আপনি ভাববেন না। সঙ্গে শুকনো খাবার আছে। প্রয়োজনে গ্রাম থেকে খাবার সংগ্রহ করে নেব।

ভাইমার মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, আসলে প্রাণীগুলোর ভবিষ্যতের চিন্তা সবসময় মাথায় ঘুরছে, তার ওপর আবার এই সমস্যা! মাথার ভিতর সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা কী বলল আমাকে আর একবার বলুন তো?

অনীশ বলল, ওই তো তখন আপনাকে যা বললাম। আপনার প্রস্তাব ওদের বললাম। ওরা ভাববে বলল, দেখা যাক কী হয়?

ভাইমার মৃদু চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে আপনার কী মনে হল? আমার ক্যাম্পের ওপর ওদের এত রাগ কেন?

অনীশ জবাব দিল, ওদের ধারণা আপনার ক্যাম্পের নেকড়েরা আসলে ওয়্যার উলফ।

আবারও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন ভাইমার। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে যে কত হত্যা করা হয়েছে তার হিসাব নেই। এখন এ সত্ত্বেও যদি সরকার এদেরকে সমর্থন করেন তবে আর কিছু বলার নেই।

ভাইমারের কথায় অনীশের মনে পড়ে গেল লেফটানেন্টের কথা। সে বলল, আপনি কখনও কাউকে মজা করেও বলেননি তো যে আপনার নেকড়েরা ওয়্যার উলফ??

ভাইমার বললেন, না, বলিনি। তবে আমার নাম করে কেউ যদি সে কথা ছড়িয়ে থাকে তবে তা আমি জানি না।

অনীশ এরপর আর এ প্রসঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বলল, আচ্ছা আপনার তো চারজন কর্মচারী। দু-জনকে দেখলাম। অন্য দুজন কোথায়?

ভাইমার হেসে বললেন, আপনার কি মনে হয় তারা দু-জন ওয়্যার উলফ? গ্রামের লোকরা বলেছে নাকি এ কথা?

ভাইমারের এ কথা শুনে অনীশ একটু লজ্জিতভাবে বলল, না, না, সে কথা নয়। আমি এ সবে বিশ্বাস করি না। আসলে তাদের দেখিনি তাই বললাম।

ভাইমার বললেন, নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে সবাই। ঠিক আছে আপনার কৌতূহল নিরসনের জন্য ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার চলি তাহলে। বাইরেটা অন্ধকার হয়ে আসছে।

ভাইমার বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যি দু-জন লোক এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। ভাইমার তাদের পাঠিয়েছেন। তাদের দেখেই অনীশ বুঝতে পারল ভাইমারের আগের দু-জন কর্মচারীর সঙ্গে এ দু-জন লোকেরও ছবি আছে তার ফাইলে। অর্থাৎ চারজন লোককেই দেখা হয়ে গেল তার। সে দুজন লোকের মধ্যে একজন একটু ইতস্তত করে অনীশের উদ্দেশ্যে বলল, স্যার, আমাদের কোনও প্রশ্ন করবেন? সাহেব আমাদের পাঠালেন।

তার তেমন কিছু প্রশ্ন করার নেই লোকগুলোকে। সে শুধু তাদের দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু লোকগুলো অনীশের কাছে জানতে চাওয়ায় সে প্রশ্ন করল, তোমরা এখানে কী কাজ করো?

একজন লোক জবাব দিল, পশুগুলোর যত্ন নিই। তাছাড়া ক্যাম্পের নানা কাজ।

অনীশ বলল, এই ক্যাম্প যদি না থাকে তখন?

তার কথা শুনে অন্য লোকটা ভয়ার্তভাবে বলল, ক্যাম্প না থাকলে আমরা কোথায় যাব স্যার? পেটের ব্যাপার। আমাদের কথা ভাববেন স্যার। ভাইমার সাহেবের দয়ায় এই ক্যাম্পে আমরা খেতে পরতে পারছি।

বাইরেটা আরও অন্ধকার হয়ে আসছে। খোলা দরজা-জানলা দিয়ে তীক্ষ্ণ কনকনে বাতাস ঢুকছে ভিতরে।

অনীশ লোক দুজনের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা এখন যাও। আমি দেখছি কী করা যায়। আর সাহেবকে বোলো রাতে খাবার লাগবে না। সঙ্গে খাবার আছে সেগুলো খাব।

অনীশকে সেলাম ঠুকে চলে গেল লোকদুটো। দরজা-জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল অনীশ।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অনীশ। তার যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল গড়িয়ে অনেকক্ষণ হল সন্ধ্যা নেমেছে। জানলার বাইরে থেকে কীসের যেন অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে।

অনীশ জানলা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাতাসের সঙ্গে জানলার গরাদের ফঁক গলে বিন্দু বিন্দু কী যেন এসে পড়ল তার গায়ে। তুষার! তুষারপাত যেন শুরু হয়েছে কখন। পিছনের পাহাড়ের মাথায় ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে। তার আলোতে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। তুষারে ঢেকে গেছে পিছনের জমিটা। নিশ্চয়ই সামনের জমিটাও একইভাবে বরফে ঢেকে গেছে। অনীশ এর আগে কোনওদিন তুষারপাত দেখেনি। জানলাটা বন্ধ করে খাট থেকে নেমে সে দরজাটা খুলল। হা, সামনের ফাঁকা জমিটা সাদা হয়ে গেছে তুষারে। তারপরই সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।

বারান্দার বাইরে তুষারপাতের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে পাঁচটা নেকড়ে। ফাঁকা জমিটার মধ্যে উল্লাসে ছোটাছুটি করছে তারা। কখনও বা একে অন্যের পিছু ধাওয়া করছে খেলার ছলে। তাদের পায়ের আঘাতে তুষার উড়ছে বাতাসে। এই নেকড়ের দলের মধ্যেই ধবধবে সাদা বিশালাকার একটা নেকড়ে দেখতে পেল অনীশ। আকারে সেটা অন্য চারটে নেকড়ের থেকে অনেক বড়। অনীশ আগে তাকে দেখেনি। সম্ভবত এটাই সেই পঞ্চম নেকড়ে যেটা খাঁচার গতাঁর ভিতর লুকিয়ে ছিল। একমাত্র এই নেকড়েটাই কিন্তু ছোটাছুটিতে অংশ নিচ্ছে না। এক জায়গাতে চুপচাপ বসে অন্যদের ওপর নজর রাখছে।

দূর থেকে একবার যেন ঘাড় ফিরিয়ে অনীশের ঘরের দিকে তাকাল সে। তারপর একবার মুখটা হাঁ করল। এত দূর থেকেও যেন তার টকটকে লাল জিভ আর তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দেখতে পেল অনীশ। শ্বাপদের দাঁত! মুহূর্তের জন্য কেমন যেন শিরশির করে উঠল অনীশের গা। এরপর চাঁদের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল প্রাণীটা। আর সঙ্গে সঙ্গে অন্য চারটে নেকড়ে যে যেখানে ছিল থমকে দাঁড়িয়ে গলা মেলাল তার সঙ্গে। তুষারপাতের মধ্যে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে যেন আদিমতা জেগে উঠল প্রাণীগুলোর মধ্যে।

হাজার বছর ধরে, যুগ যুগ ধরে এমনই রাত্রির আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসেছে তারা। রাত্রির সন্তানদের অপার্থিব সঙ্গীত মূৰ্ছনা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল নির্জন পাহাড়ের বুকে। এ অভিজ্ঞতা অনীশের কোনওদিন হয়নি। মাঝে মাঝে একটু থেমে থেমে একইভাবে ডেকে উঠতে লাগল প্রাণীগুলো। সে ডাক শুনে অনীশের কোনও সময় মনে হল তা যেন প্রকৃতির সন্তানদের উল্লাসধ্বনি আবার কোনও কোনও সময় মনে হতে লাগল সেটা তাদের আত্মবিলাপ, ক্রন্দনধ্বনি। অনীশ দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তাদের।

সময় কাটতে লাগল। কিন্তু একসময় প্রচণ্ড তুষারপাত শুরু হল। বাতাসও বইতে লাগল শনশন করে। তার ঝাপটায় তুষার এসে লাগতে লাগল অনীশের মুখে। তার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও প্রচণ্ড। অনীশ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালাল সে। তারপর সঙ্গে আনা বিস্কুট, শুকনো খাবার খেয়ে বাতি নিভিয়ে রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে হঠাৎ কীসের যেন একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। দরজার কাছ থেকে শব্দটা আসছে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত খসখসে শব্দ! সঙ্গের টর্চটা জ্বালিয়ে দরজার দিকে আলো ফেলল অনীশ। তারপর বলে উঠল, কে? পুরোনো কাঠের প্যানেলঅলা দরজাটা একবার যেন কেঁপে উঠল। তারপর সব শব্দ থেমে গেল। হয়তো বা বাতাসের আঘাতেই শব্দটা হচ্ছে। দরজা কেঁপে উঠছে। টর্চ নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল অনীশ। কিন্তু ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝেই যেন শব্দটা কানে বাজতে লাগল। তার। অদ্ভুত একটা খসখস্ শব্দ!

৪. মোবাইলের রিংটোনের শব্দে

ভোর ছটা নাগাদ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল অনীশের। ওপাশ থেকে ড্রাইভার পবন বলল, গুড মর্নিং স্যার। আপনি কি আজ আসছেন?

অনীশ বলল, হ্যাঁ, যাব। কোনও খবর আছে নাকি?

পবন একটু ইতস্তত করে বলল, এখানে তো গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়ে। তার ওপর কাল সন্ধ্যা থেকেই তুষারপাত শুরু হয়েছিল। চাঁদ ওঠার কিছু পরে তুষারপাত দেখার জন্য আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি গ্রামপ্রধান নরবু একা তুষারপাতের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে বেরোচ্ছে। কৌতূহলবশত আমি এগোলাম তার পিছনে। সে আমাকে দেখেনি। নরবু ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে পাইনবনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক। সে নরবুকে নিয়ে পাইনবনের ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর বেশ কিছু সময় পর বন থেকে বেরিয়ে এক গ্রামে ফিরে এল সে।

অনীশ প্রশ্ন করল, লোকটা কে? কেমন দেখতে।

পবন মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, সম্ভবত ভাইমার সাহেব।

ভাইমার সাহেব! বেশ অবাক হয়ে গেল অনীশ। তবে ভাইমার কি গোপনে সন্ধি করতে গেছিলেন গ্রামের মাথা নরবুর সঙ্গে? অনীশ অবশ্য এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না পবনকে। শুধু বলল, ঠিক আছে। চোখকান খোলা রেখো। তেমন কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।

বিছানা ছেড়ে উঠে অনীশের কিছুক্ষণ সময় লাগল তৈরি হয়ে নিতে। দরজা খুলেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল সে। সামনের চত্বর তো বটেই, এমনকী চারপাশের সবকিছু সাদা হয়ে গেছে তুষারপাতের ফলে। পাইনবনের মাথাটাও পুরো সাদা!

বারান্দাটা পুরো ফাঁকা। ভাইমার বা তার কর্মচারীরা কেউ কোথাও নেই। বারান্দা ছেড়ে নীচে নামল অনীশ। সঙ্গে সঙ্গে তার দু-পা ডুবে গেল তুষারের মধ্যে। জমির ওপর অন্তত এক ফুট তুষার জমেছে। সারা রাত ধরে এতটা তুষারপাত হয়েছে তা ধারণা করতে পারেনি অনীশ। বাড়ির সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে পেঁজা তুলোর মতো তুষার মাড়িয়ে অনীশ এগোল বাড়িটার পিছন দিকে। বাড়িটাকে বেড় দিয়ে বাঁক ফিরতেই অনীশ কিছুটা তফাতেই দেখতে পেল ভাইমার আর তার এক কর্মচারীকে। ভাইমার তার কর্মচারীকে ধমকে বললেন, তুমি ওখানে গেছিলে কেন?

কর্মচারীটা যেন মাথা নীচু করে জবাব দিল, এভাবে আর পারছি না স্যার।

ভাইমার এরপর কিছু একটা যেন বলতে যাচ্ছিলেন তার লোকটাকে। কিন্তু অনীশকে দেখতে পেয়ে থেমে গেলেন। অনীশের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, সুপ্রভাত। ঘুম কেমন হল?

অনীশ জবাব দিল, ভালো।

ভাইমারের সেই লোকটা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইমার তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাও। খাঁচাগুলোর সামনে তেরপলের পরদা টাঙাবার ব্যবস্থা করো যাতে ঠান্ডা বাতাস আটকানো যায়।

তার কথা শুনে লোকটা ধীরে ধীরে চলে গেল খাঁচাগুলোর দিকে।

সে চলে যাবার পর ভাইমার বললেন, এই নেকড়েগুলো বরফের দেশের প্রাণী। বরফ। বা তুষারপাতে ওদের কিছু হয় না। কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে ওরাও কাবু হয়ে যায়। সহ্য করতে পারে না। বাতাসের থেকে বাঁচার জন্য বরফে গর্ত খুঁড়ে থাকে। দেখেছেন কাল কেমন তুষারপাত হয়েছে। এমন আর দু-তিন দিন হলে সিল্ক রুট, নাথুলা পাস বন্ধ হয়ে যাবে।

অনীশ বলল, হ্যাঁ। দেখলাম। কাল রাতে নেকড়েগুলোকে খেলতেও দেখলাম সামনের চত্বরে। তার মধ্যে একটা নেকড়ে কী বিশাল! সুন্দর! ওই নেকড়েটাই তো কাল খাঁচার গর্তে লুকিয়ে ছিল তাই না?

ভাইমার হেসে বললেন, হ্যাঁ। ধবধবে সাদা বিশাল নেকড়ে। যাদের দেখলেন তাদের মধ্যে প্রথম ওই আসে এই ক্যাম্পে। ওকেই অন্য প্রাণীগুলোর দলপতি বলা যেতে পারে। এত সুন্দর প্রাণীগুলো মারার চেষ্টা হচ্ছে আপনি ভাবতে পারছেন। বিষণ্ণতা নেমে এল ভাইমারের মুখে।

অনীশ বলল, আমি এখন গ্রামে যাব কথা বলতে। দেখি ওদের মত পরিবর্তন করা যায় কিনা? তবে সময় তো বেশি নেই। হাতে আজ আর কালকের দিনটা আছে। পরশু ভোরে আমাকে ফিরতে হবে। এ দেশে আমাদের বন্যপ্রাণ সংস্থার প্রধান প্রতিনিধি যিনি, সেই ডক্টর মাধবনও আমাকে বলেছেন যে প্রাণীগুলোকে বাঁচাবার জন্য যেন আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। একটা কথা আপনাকে বলতে পারি যে আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না।

বিষণ্ণ হেসে ভাইমার বললেন, চেষ্টা করে দেখুন ওই নরবু বলে লোকটাকে অভিযোগ ওঠাতে রাজি করাতে পারেন কিনা? ভাইমার কিন্তু একবারও বললেন না যে গতরাতে নরবুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা। অনীশও তাকে প্রশ্ন করা সমীচীন মনে করল না। ভাইমার এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে তুষারের মধ্যে দিয়ে এগোলেন অনীশকে কাঁটাতারের বাইরে বার। করে দেবার জন্য। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছে তার মুখ।

অনীশ বাইরে বেরোবার সময় তিনি একবার শুধু বললেন, তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবেন। দুপুরের পর থেকেই আবার গতকালের মতো প্রকৃতির রূপ বদলাতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে তুষার পড়তে শুরু করবে।

পাইনবনে প্রবেশ করল অনীশ। আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলো আজ ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাতাসে পাইনবনের ডাল-পাতা থেকে টুপটাপ তুষারকণা ঝরে পড়ছে অনীশের গায়ে। বনটাকে যেন আজ আরও বেশি নিঝুম মনে হচ্ছে। অজানা কোনও এক কারণে যেন আজ থমকে আছে সারা বন। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে একসময় ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গ্রামে পৌঁছে গেল অনীশ। গ্রামে নরবু সহ অন্যদের জমায়েত দেখে অনীশের মনে হল লোকগুলো যেন তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ অনীশ আজও গ্রামে ঢুকতেই নরবু তার হাতে গতদিনের মতোই একটা কাঠ-গোলাপের তোড়া দিয়ে তাকে সম্মান জানাল।

অনীশকে বেশ খাতির করে তারা একটা বাঁশের মাচায় বসাল। একজন একটা কাপে ধূমায়িত চা আর একটা পাত্রে চমরি গাইয়ের জমাট বাঁধা দুধ–ছুরপি দিয়ে গেল। একটা ছুরপির টুকরো মুখে ফেলে বার কয়েক চায়ে চুমুক দিল অনীশ। গ্রামের ঘরের চালাগুলো সাদা তুষারের চাদরে ঢেকে আছে। প্রথমে আসল প্রশ্নে না গিয়ে ঘরের চালগুলোর দিকে তাকিয়ে অনীশ বলল, বেশ তুষারপাত হয়েছে দেখছি!

নরবু বলল, হ্যাঁ, এবার শুরু হল। আর দু-তিনদিনের মধ্যে পথঘাট কিছুই চিনতে পারবেন না। সবই বরফের তলায় চলে যাবে। এই কটা মাস আমাদের খুব কষ্টে কাটে। বাইরে বেরোনো যায় না, চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ! খাবার দাবারেরও খুব কষ্ট। আর্মির লোকেরা কিছু খাবার দিয়ে যায় তাতেই চলে যায়। পশুপাখিদের আরও কষ্ট। তাদের তো আর খাবার দেয় না কেউ। জানেন এ সময় খিদের জ্বালায় নেকড়েরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। অনেক সময় ছাগল-ভেড়ার লোভে তারা গ্রামেও হানা দেয়।

চা-পান শেষ হবার পর অনীশ এবার প্রশ্ন করল, কাল যা বললাম সে ব্যাপারে কী ঠিক করলে তোমরা?

তার প্রশ্ন শুনে নরবু একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি সরকারি লোক তাই তুমি অনুরোধ করায় ব্যাপারটা নিয়ে আমরা ভেবেছি। আপাতত আমরা তিনমাস সময় দিতে রাজি তাকে। তবে কিছু শর্ত আছে। আমাদের কাছ থেকেই তাকে মাংস কিনতে হবে। শীতের এই তিনমাস আমাদের গ্রামের রুটির ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। বেশি কিছু নয় চল্লিশ বস্তা আটা। পয়সা দিলে আমরাই সেগুলো সংগ্রহ করে আনব।

আমাদের গ্রামে কোনও স্কুল নেই। স্কুল খুলব। সেই স্কুলের একজন মাস্টারের বেতন দিতে হবে সাহেবকে। আমার নাতি মাস্টার হবে। আমার নাতি গ্যাংটক থেকে মাস্টারি পাশ করে ফিরছে। আজই তার গ্রামে ফেরার কথা। সেই চালাবে স্কুলটা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা নেকড়েগুলোকে সামলাতে হবে সাহেবকে। ওই খামারের বাইরে তাদের বার করা চলবে না। যদি গ্রামের একটা মানুষেরও কোনও ক্ষতি হয় তবে আমরা খামারে আগুন লাগিয়ে দেব।

অনীশ নরবুর কথা শুনে বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা আপাতত মেনে নিতে রাজি হয়ে গেছে নরবু। হয়তো গতরাতে ভাইমারের সঙ্গে আরও কিছু বোঝাপড়া হয়ে গেছে নরবুর। সেটা অর্থনৈতিক লেনদেনও হতে পারে। নরবুর কথাই গ্রামের মানুষের কাছে শেষ কথা।

অনীশ বলল, ভাইমার সাহেব যদি তোমাদের শর্ত মেনে নেন তবে তোমরা সরকারকে জানাবে তো যে নেকড়ে খামারটা আপাতত এখানে থাকুক? চিঠি দিয়ে জানাতে হবে কিন্তু। সেটা আমি নিয়ে যাব। সরকারের ঘরে জমা দেব।

নরবু বলল, আমরা কেউ লিখতে পড়তে জানি না। গতবার আমার নাতিই চিঠিটা লিখে সরকারের ঘরে জমা দিয়েছিল। আমরা শুধু টিপসই দিয়েছিলাম। তুমি কাগজ তৈরি করো। নাতি ফিরলে সেটা দেখব। সব ঠিক থাকলে টিপ সই দিয়ে দেব।

পাহাড়ি লোকরা একবার কথা দিলে সেটা রাখে এটা শুনেছে অনীশ। যদিও নরবুর নাতির ওপর ব্যাপারটা কিছুটা ঝুলে রইল তবে সে শিক্ষিত ছেলে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তাকে অনীশ বোঝাতে সক্ষম হবে। এই ভেবে অনীশ বলল, ঠিক আছে আমি কাগজ তৈরি করছি। নাতি এলে তাকে দেখিয়ে তবে সই কোরো। কিন্তু সে ঠিক আসবে তো? আমার হাতে শুধু। কালকের দিনটাই আছে।

নরবু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে আজ রাতেই বা কাল ভোরে চলে আসবে।

এরপর নরবুর সঙ্গে আরও কিছু টুকটাক কথা বলে অনীশ উঠে পড়ল। ড্রাইভার পবন তাকে ঢাল বেয়ে পাইনবনের মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে পবন বলল, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি স্যার। এই বোকেটা দেখে মনে পড়ল। কাল যখন নরবু গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছিল তখন তার হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু যখন সে বন ছেড়ে বেরোল। তখন তার হাতে এই কাঠগোলাপের বোকেটা ছিল। হয়তো বা এটা ভাইমার সাহেবই তাকে দিয়েছেন?

অনীশ কথাটা শুনে হেসে বলল, না, ভাইমার সাহেবের এ ফুলে অ্যালার্জি আছে। যে কারণে গতকাল ফুলের বোকেটা ফেলে দিতে হল আমাকে। নরবু ওটা অন্য কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে। আমার ধারণা নরবুর সঙ্গে সাহেবের কোনও গোপন চুক্তি বা লেনদেন হয়েছে। যা নরবু অন্যদের বলতে চাইছে না। ও কারণেই নরবু সাহেবের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। যাই হোক, যে ভাবেই হোক ব্যাপারটা ভালো হল। প্রাণীগুলো আপাতত কিছুদিনের জন্য বিপদমুক্ত হল। কথাগুলো বলে পবনের থেকে বিদায় নিয়ে পাইবনে ঢুকল অনীশ।

ক্যাম্পে ফিরে কোনও কাজ নেই। কাজেই গতদিনের মতো জঙ্গল ভেঙে উলটোদিকের ঢাল বেয়ে গাড়ির রাস্তায় নেমে এল অনীশ। আজ রাস্তা তুষারে ঢাকা। মনটা বেশ খুশি লাগছে অনীশের। যে কাজের জন্য সে এসেছিল সে কাজে সম্ভবত সে সফল হতে চলেছে। প্রাণীগুলোকে আপাতত রক্ষা করার পথ পাওয়া গেছে। সরকার এখন আর গ্রামবাসীদের অজুহাত দিতে পারবে না প্রাণীগুলোকে মারার ক্ষেত্রে। তুষার মাড়িয়ে আগের দিনের মতোই হাঁটতে লাগল সে।

আগের দিন অনীশ যেখানে গিয়ে বসেছিল তার কাছাকাছি গিয়ে অনীশ দেখতে পেল গতদিনের সেই সাঁজোয়া আর্মি জিপটা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই পাথরটার ওপর বসে চুরুট খাচ্ছেন লেফটানেন্ট ছেত্রী।

অনীশ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাবলাম হয়তো আপনার সঙ্গে এখানে এলে দেখা পাব। দেখা না হলে ফোন করতাম।–একথা বলে তিনি পকেট থেকে একটা চুরুটের বাক্স বার করে অনীশের হাতে ধরিয়ে বললেন, এটা আমার উপহার। খাঁটি হাভানা চুরুট। আপনি রাখুন।

অনীশ খুব বেশি ধূমপান না করলেও বাক্সটা নিল। তার থেকে একটা চুরুট বার করে মুখে দিয়ে লেফটানেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাক্সটা ওভারকোটের পকেটে রাখল।

লেফটানেন্ট ছেত্রীই তার লাইটার দিয়ে অনীশের চুরুটটা জ্বালিয়ে দিলেন। বেশ কয়েক মুহূর্ত দুজনে নিঃশব্দে ধূম্র উদগিরণের পর ছেত্রী জানতে চাইলেন, গ্রামে গেছিলেন? কী বলল ওরা?

অনীশ সতর্ক হয়ে গেল। ছেত্রীরা চাইছেন না ক্যাম্পটা এখানে থাকুক। হয়তো দু-পক্ষের মিটমাট হতে চলেছে শুনলে ব্যাপারটায় তারা বাগড়া দিতে পারে। তাই সে কৌশলে বলল, তেমন কিছু নয়। ওদের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করছি আর কী।

লেফটানেন্ট এরপর জানতে চাইলেন, ক্যাম্পের সব কর্মচারীকে দেখেছেন আপনি? আমার ফাইলে দেখা ছবির সঙ্গে কারও মিল পেলেন?

অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, সবাইকে দেখেছি। তবে আপনার ফাইলের ছবির সঙ্গে কারো মিল নেই।

অনীশের মনে হল যে উত্তরটা শুনে ঠিক যেন খুশি হলেন না ছেত্রী। কী যেন একটু ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, আর নেকড়েগুলোকে দেখেছেন?

অনীশ বলল, হ্যাঁ, সব কটাকে দেখেছি। কাল চাঁদের আলোতে তুষারপাতের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছিল ওরা। খুব সুন্দর প্রাণী। কিন্তু ওরাতো মানুষ নয়, ওরাও ওয়ান্টেড নাকি?

অনীশ হেসে কথা শেষ করলেও মৃদু খোঁচা ছিল তার শেষ কথায়। কিন্তু লেফটানেন্ট সেটা গায়ে মাখলেন না। তিনি বললেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার! ওপারের সেনারা মানে চীন সেনারাও নেকড়েগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী! সীমান্তে দু-দেশের সেনাদের মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং হয় জানেন নিশ্চয়ই? কাল তেমনই একটা মিটিং ছিল। ওদের সেনাদের কাছে কীভাবে খবর গেছে যে গ্রামবাসী আর সরকার ক্যাম্পটা তুলে দিতে চায়। ওরা বলছে ওরা নেকড়েগুলোকে নিতে চায়। নেকড়েগুলো তো ওদেশ থেকেই এদেশে ঢুকেছিল তাই ওরা প্রাণীগুলোর দাবিদার। কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক পথ ভুলে ওদেশে ঢুকে কিছুদিন হল ওদের সেনাদের হাতে আটকে আছে। নেকড়েগুলোকে পেলে তাদেরও মুক্তি দেবার প্রস্তাব দিচ্ছে ওরা। অথচ যে সব নির্দোষ ভারতীয় নাগরিককে ওরা বন্দি করে রেখেছে তাদের কিছুতেই আগে মুক্তি দিতে রাজি হচ্ছিল না ওরা। খালি বলছিল যে ওই নিরীহ ভারতীয় নাগরিকরা নাকি আসলে গুপ্তচরবৃত্তি করতে ঢুকেছিল ওদেশে। তাই তাদের হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। হঠাৎ চীনা সৈনিকরা এত বন্যপ্রাণপ্রেমী হয়ে উঠল কেন বুঝতে পারছি না।

অনীশ বেশ আশ্চর্য হল তার কথা শুনে। একইসঙ্গে তার ভালোও লাগল কথাটা জেনে। সে বলল, প্রস্তাবটা তো ভালোই। প্রাণীগুলো তাহলে তাদের দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেই তো সবদিক বজায় থাকে। ক্যাম্পও থাকল না আবার প্রাণীগুলোও বাঁচল।

অনীশের কথা শুনে লেফটানেন্ট বললেন, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রাণীগুলো আমরা এভাবে তুলে দিতে পারি না ওদের হাতে। একথা ঠিক যে ক্যাম্পের নেকড়েগুলো ওদেশ থেকেই এদেশে এসেছে। কিন্তু ওরা এখন আমাদের সম্পত্তি। সুন্দরবনের বাঘও তো সীমানা মানে না। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াত করে। যখন যে দেশে বাঘ ধরা পড়ে তখন সেটা তারই সম্পত্তি হয়। এক্ষেত্রেও তেমনই ব্যাপার। ওভাবে নেকড়েগুলোর হস্তান্তর করা যাবে না। নেকড়েগুলোকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব না মারব সেটা এখন একান্তই আমাদের দেশের সরকারের ব্যাপার।

কথাটা শুনে অনীশ চুপ করে গেল। সামান্য কটা নিরিহ প্রাণীর দামের চেয়েও, এমনকী মানুষের জীবনের চেয়েও দু-দেশের সরকারি ফাইলের লাল ফিতের ক্ষমতা অনেক বেশি।

কিন্তু এরপরই চারপাশে হঠাৎ কেমন যেন অন্ধকার নেমে এল। ঘড়িতে সবে মাত্র বেলা দশটা বাজে। আকাশের দিকে তাকিয়ে লেফটানেন্ট বললেন, আজ দুপুরের আগে থেকেই তুষারপাত হবে মনে হয়। চলুন আপনাকে নেকড়ে ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে আসি। গাড়িতে উঠে বসুন।

সত্যি চারপাশের প্রকৃতি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যেন অন্য রূপ ধারণ করেছে। ব্যাপারটা অনুধাবন করে অনীশ লেফটানেন্টের সঙ্গে চড়ে বসল তার গাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামল ক্যাম্পের কাছাকাছি জায়গাতে। গাড়ি থেকে নামার সময় ছেত্রী সাহেব শুধু বললেন, কোনও প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন আমাকে।

গাড়ি থেকে নেমে অনীশ এগোল ক্যাম্পের দিকে। আজও ক্যাম্পের সামনের চত্বরে কোনও লোকজন নেই। অনীশ গেট খুলে ভিতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হল। তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাতাস সোঁ-সোঁ শব্দে ধেয়ে আসতে লাগল পাহাড়ের দিক থেকে। কোনওরকমে মাথার টুপিটাকে সামলে তুষারের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে অনীশ বারান্দায় উঠে প্রবেশ করল তার ঘরে। হঠাৎ তার খেয়াল হল যে হাতের পুষ্পস্তবকটা তার সঙ্গে আনা উচিত হয়নি। সে সেটা জানলা গলিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করলেন ভাইমার। তিনি প্রথমে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে দ্বিপ্রহরে আপনার খাবারের ব্যবস্থা সম্ভব হল না বলে। ভাঁড়ারে একদানাও খাবার নেই। ভাইমারের মুখমণ্ডল বেশ থমথমে, চিন্তান্বিত।

অনীশ বলল, আপনি বিব্রত হবেন না। দুটো দিন চালিয়ে নেবার মতো শুকনো খাবার আমার কাছে আছে।

ভাইমার এরপর বললেন, কী বলল গ্রামবাসীরা?

অনীশ উৎফুল্লভাবে ব্যাপারটা জানাল ভাইমারকে। কিন্তু ভাইমারের মুখমণ্ডলের তেমন। কিছু পরিবর্তন হল না।

তা দেখে অনীশ বলল, আপনি কি ওদের প্রস্তাবে সম্মত নন? আপনি এত চিন্তান্বিত কেন?

ভাইমার বললেন, আমি সম্মত। আপনি চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করুন। আসলে আমি খুব মানসিক চাপে আছি। ওপার থেকে রসদ নিয়ে দলটা আজও, এখনও এল না। আমাদের কথা বাদ দিন। কিন্তু দু-দিন হল পশুগুলোর মুখে একটুকরো খাবার তুলে দিতে পারিনি।

অনীশ বলল, আপনি আজকের রাতটা দেখুন। যদি রসদ না আসে তবে কাল সকালে গ্রামে গিয়ে অন্তত পশুগুলোর জন্য মাংস সংগ্রহ করে আনব। আশা করি তারা আপত্তি করবে না।

ভাইমার শুধু বললেন, দেখা যাক কী হয়? একথা বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ভাইমার চলে যাবার পর দরজা-জানলা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল অনীশ। বাইরে থেকে ভেসে আসতে লাগল বাতাসের শব্দ। বাতাসের ধাক্কায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠতে লাগল দরজা-জানলাগুলো।

শেষ বিকালে বিছানা থেকে উঠল অনীশ। দরজাটা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তুষারপাত হয়েই চলেছে। পেঁজা তুলোর মতো তুষার ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে আকাশ থেকে। এত ঠান্ডা যে বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না অনীশ। পিছু ফিরে সে যখন ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে ঠিক তখন একটা জিনিসের উপর নজর পড়ল তার। কাঠের প্যানেল অলা দরজার পাল্লার নীচের দিকে কেমন যেন লম্বা লম্বা দাগ! কাঠের ছিলকা উঠেছে সেখান থেকে। এই আঁচড়ের দাগগুলো কি আগেই ছিল? কে জানে?

ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে সেজবাতিটা জ্বালাল অনীশ। ঠিক তারপরই বাইরে ঝুপ করে অন্ধকার নামল। অনীশ কাগজকলম বার করে চুক্তিপত্রটা আর গ্রামবাসীরা যে চিঠি সরকারকে দেবে তার খসড়া তৈরি করতে বসল। লিখতে লিখতেই অনীশ বুঝতে পারল বাইরে বাতাসের দাপট আবার শুরু হয়েছে। দরজা-জানলার পাল্লাগুলো মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। আর এরপরই হঠাৎ একসময় বাড়ির পিছন দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল নেকড়েগুলোর ডাক। না, ঠিক গর্জন নয়, যেন করুণ স্বরে আত্মবিলাপ করে চলেছে প্রাণীগুলো।

ভাইমারের কথাটা মনে পড়ল অনীশের। প্রাণীগুলো দু-দিন খায়নি। সম্ভবত অন্ধকার নামার পর ঘুম ভেঙে খিদের জ্বালায় কাঁদছে ওরা। কী করুণ সেই ডাক! লেখা থামিয়ে কিছুক্ষণ সেই ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলোর কান্না শুনল অনীশ। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল। রাত আটটা নাগাদ লেখার কাজ শেষ হল অনীশের। ততক্ষণে অবশ্য নেকড়ের কান্না থেমে গেছে। বিস্কুট আর জল খেয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় চলে গেল অনীশ।

বেশ অনেকক্ষণ ঘুমাবার পর হঠাৎ কীসের একটা শব্দে যেন ঘুম ভেঙে গেল অনীশের। তার রেডিয়াম লাগানো ঘড়িতে রাত আড়াইটে বাজে। শব্দটা বুঝতে পারল সে। দরজাটা মাঝে মাঝে কাঁপছে। তাতেই শব্দ হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটা নাকি? কিন্তু তাতে তো এতটা শব্দ হবার কথা নয়। ঠিক যেন কেউ ঘা দিচ্ছে দরজায়। অনীশকে কেউ ডাকছে নাকি? সে একবার বলল, কে? তার গলার আওয়াজে মুহূর্তের জন্য শব্দটা যেন থামল। তারপর আবার হতে শুরু করল।

অনীশ কম্বল ছেড়ে উঠে বসে টর্চের আলো ফেলল দরজার ওপর। আলোটা ওপর থেকে নামতে নামতে স্থির হয়ে গেল কাঁপতে থাকা দরজার নীচের দিকে। চমকে উঠল অনীশ। দরজার একটা পাল্লার নীচের দিকে একটা ছোট ছিদ্র তৈরি হয়েছে। আর তার মধ্যে দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে তীক্ষ্ণ নখর যুক্ত একটা থাবা! নেকড়ের থাবা। হিংস্র থাবাটা একবার ফুটো দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকছে, আবার বেরোচ্ছে! প্রাণীটা যেন পাল্লার নীচের প্যানেলটা ভেঙে ঘরের ভিতর ঢোকার চেষ্টা করছে! ব্যাপারটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অনীশ খাট ছেড়ে লাফিয়ে নেমে টেবিলের বাতিটা জ্বালিয়ে নিল। হ্যাঁ, সে এবার আরও স্পষ্ট দেখতে পেল সেই থাবাটা। সেটা ঘরে ঢুকে বাইরে বেরোবার সময় প্রচণ্ড আক্রোশে যেন ফালা ফালা করে দিচ্ছে পাল্লা সংলগ্ন কাঠের মেঝেটাকে। ভাইমার আর তার সঙ্গীরা এখন কোথায়? অনীশ একবার চিৎকার করার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রচণ্ড উত্তেজনায় তার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। আর এরপরই আরও ভয়ংকর কাণ্ড ঘটল।

পাল্লার নীচের ফুট দুই চওড়া কাঠের প্যানেলটা হঠাই পাল্লা থেকে খসে ছিটকে পড়ল ঘরের ভিতর। কয়েক মুহূতাঁর নিস্তব্ধতা। আর তারপরই সেই ফোকর দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল একটা বিশাল নেকড়ের মাথা! বাতির আলোতে দেখা যাচ্ছে প্রাণীটার চোয়ালে সার সার হিংস্র দাঁতের পাটি, টকটকে লাল জিভ। লোলুপ দৃষ্টিতে অনীশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রাণীটা। তার চোয়ালের দু-পাশ বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে।

হিম হয়ে গেল অনীশের শরীর। সম্মোহিতের মতো বেশ কিছুক্ষণ তারা চেয়ে রইল পরস্পরের দিকে। প্রাণীটা এবার মাথা দিয়ে চাপ দিতে লাগল পাল্লার ওপরের প্যানেলটাকে ভেঙে ফেলার জন্য। একটা মৃদু মড়মড় শব্দ হতে লাগল সেই কাঠের প্যানেল থেকে। এবার হুঁশ ফিরল অনীশের। ওই কাঠের প্যানেলটা ভেঙে দিতে পারলেই হিংস্র প্রাণীটা তুড়ি মেরে ঘরের ভিতরে ঢুকে যেতে পারবে। অনীশের কাছে কোনও অস্ত্র নেই ক্ষুধার্ত নেকড়েটাকে রোখার মতো। মুহূর্তর মধ্যে কর্তব্য স্থির করে নিল অনীশ। এতে যা হবার তা হবে। অনীশ টেবিল থেকে তুলে নিল তেলভর্তি কাচের বাতিটা। তারপর দু-পা এগিয়ে নেকড়ের মাথাটা লক্ষ্য করে বাতিটা প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে মারল। চৌকাঠের কাছে নেকড়ের মাথার ওপর আছড়ে পড়ে জোর শব্দে চুরমার হয়ে গেল বাতিটা। একটা রক্ত জল করা বীভৎস আর্তনাদ করে মাথাটা দরজার বাইরে বার করে নিল শ্বাপদটা। সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল এরপর।

অন্ধকার ঘর। অনীশের হঠাৎ মনে হল, প্রাণীটা যদি আবার ফিরে আসে তখন? জানলাটা খুলে দিল সে। আবছা আলোতে ভরে উঠল ঘর। বাইরে তখনও তুষারপাত হয়েই চলেছে। বাকি রাতটা সেই আধো অন্ধকার ঘরে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিল অনীশ। তবে নেকড়েটা আর ফিরে এল না। শেষ রাতে তুষারপাত যেন কিছুটা কমে এল। আবছা আলো ফুটে উঠল বরফ পাহাড়ের মাথায়।

৫. ভোর হলেও

ভোর হলেও দরজা খুলে বাইরে বেরোতে ঠিক সাহস পেল না অনীশ। বলা যায় না প্রাণীটা হয়তো এখনও খোলা আছে। দরজার বাইরেই হয়তো বা সে ঘাপটি মেরে বসে আছে অনীশের জন্য। ঘরের ভিতর থেকে অনীশ বার কয়েক ডাকল ভাইমারের নাম ধরে। কিন্তু বাইরে থেকে কোনও সাড়া মিলল না। বন্ধ ঘরে বসে তার কী করা উচিত তা ভাবতে লাগল অনীশ।

সময় এগোতে লাগল। বেলা আটটা নাগাদ তখন বাইরে বেশ একটু রোদ উঠেছে, সে সময় অনীশ বাইরের চত্বর থেকে যেন বেশ কিছু লোকজনের গলার শব্দ, ঘোড়ার ডাক এ সব শুনতে পেল। সাহস করে এবার সে দরজা খুলে ফেলল। সে দেখতে পেল চত্বরের ওপাশে কাঁটাতারের বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একদল লোক। কিছু পশুও আছে তাদের সঙ্গে। ভাইমারকেও দেখতে পেল অনীশ। বাড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিনি এগোচ্ছেন দরজা খোলার জন্য।

দরজা খুলে দিলেন ভাইমার। হুড়মুড় করে পশুদের নিয়ে বরফ ঢাকা চত্বরে প্রবেশ করল লোকগুলো। জনা সাতেক ছোটখাটো চেহারার লোক। তাদের পরনে লম্বা ঝুলের নোংরা পোশাক, পায়ে লোহার বেড়ি লাগানো হাই হিল বুট, মাথায় চামড়ার টুপি। তাদের সঙ্গে পাঁচটা পশু। তবে তারা ঘোড়া নয়, ছোটখাটো চেহারার ভারবাহী খচ্চর। তাদের পিঠে চাপানো পেট ফোলা চটের বস্তা। রসদ এসে গেছে সম্ভবত। চত্বরের ভিতরে ঢুকে এক জায়গাতে জটলা বেঁধে দাঁড়াল তারা। ভাইমার তাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। অনীশ এবার বারান্দা থেকে নেমে বরফের মধ্যে দিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল তাদের সামনে।

লোকগুলোর সঙ্গে অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছিলেন ভাইমার। ভাষাটা হয়তো বা চাইনিজ হবে। কারণ লোকগুলোর গড়নে, মুখমণ্ডলের মধ্যে লিয়ান ছাপ স্পষ্ট। ভাইমারও বলেছিলেন রসদবাহী লোকেরা ওপারের।

অনীশ তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কথা থামিয়ে তার দিকে তাকালেন ভাইমার। তার মুখ গম্ভীর, চোখে-মুখে রাত্রি জাগরণের স্পষ্ট ছাপ। অনেকটা শুষ্কভাবেই তিনি বললেন সুপ্রভাত।

অনীশ গতকালের ব্যাপারটা এ লোকগুলোর সামনে বলা ঠিক হবে কিনা ভেবে একটু চুপ করে রইল। সম্ভবত ভাইমার তার মনের ভাব পাঠ করে বলে উঠলেন, কথা বলতে পারেন। এরা চীনা ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা বোঝে না।

অনীশ বলল, কাল রাতে একটা নেকড়ে আমার ঘরে হানা দিয়েছিল। দরজার কাঠের প্যানেল ভেঙে ঘরের ভিতর মাথাও গলিয়ে ফেলেছিল। আমি বাতিটা ছুঁড়ে কোনওরকমে তাকে আটকাই। আর একটু হলেই..

তার কথা শুনে ভাইমার বললেন, তাই নাকি! তবে সেই বড় ধূসর নেকড়েটা। কাল কীভাবে যেন খিদের জ্বালায় খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে। শেষ রাতে তাকে খাঁচায় ফেরানো হয়। ঠান্ডা ও খিদের জ্বালায় হিংস্র হয়ে উঠে সম্ভবত সে ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এই লোকগুলো যদি গতকাল বিকালে আসতে পারত তবে গত রাতে কোনও দুর্ঘটনাই ঘটত না। এখন অবশ্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

অনীশ এরপর বলল, গ্রামবাসীদের চিঠিটা আর আপনার সঙ্গে তাদের চুক্তিপত্র দুটোই তৈরি করে ফেলেছি। একবার দেখে নেবেন নাকি?

তার কথা শুনে ভাইমার কেন জানি মৃদু চমকে উঠে বললেন, আপনি এখন গ্রামে যাবেন নাকি?

অনীশ বলল, কেন? তেমনই তো কথা ছিল। নরবুর নাতির ফিরে আসার কথা। সেটা সে দেখার পর গ্রামের লোকেরা সেটায় স্বাক্ষর করবে। চুক্তিপত্রটাও আপনাদের উভয়পক্ষকে দিয়ে স্বাক্ষর করাতে হবে।

ভাইমার আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রথমে বললেন, যে-কোনও সময় কিন্তু আবার আকাশের গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে পারে, আবার তুষারপাত শুরু হতে পারে। তাই বলছিলাম আর কী।

একথা বলার পর তিনি কেমন যেন নিস্পৃহভাবে বললেন, আমাকে এখন কাগজগুলো দেখাবার দরকার নেই। আগে গ্রামে যান, দেখুন ওরা কী বলে? ওরা সই করে দিলে আমিও সই করে দেব। আপনি তো এখানে ফিরবেনই।

এরপর আর কথা বাড়ালেন না ভাইমার। তিনি এগোলেন বাড়ির পিছন দিকে যাবার জন্য। পশুদের নিয়ে তাকে অনুসরণ করল সেই চীনাদের দলটা। অনীশ ঘরে ফিরে এল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল তার কাগজপত্র নিয়ে। বাড়ির পিছন দিক থেকে লোকজনের গলার শব্দ ভেসে আসছে। দরজা খুলে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে এসে পাইনবনের ভিতর দিয়ে সে রওনা হল গ্রামের দিকে। হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছিল তার। পাইনবনের ভিতরেও তুষার জমা হয়েছে। কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে বরফে। কিন্তু সেই বরফ ভেঙেই একসময় সে পৌঁছে গেল গ্রামে।

গ্রামটা যেন ধীরে ধীরে বরফের তলাতেই চলে যাচ্ছে। অনেক বাড়ির অর্ধেক দরজা বরফে ঢেকে গেছে। ঘরের বাইরে ভিড়ও তেমন নেই। গ্রাম প্রধান নরবু আর কিছু পুরুষ মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল অনীশের জন্য। তাদের সঙ্গে ড্রাইভার পবনও ছিল। অনীশ গ্রামে ঢুকতেই এদিনও নরবু তার হাতে কাঠগোলাপের স্তবক তুলে দিল। তবে তার চোখে মুখে কেমন যেন একটা চাপা উৎকণ্ঠার ভাব। ফুলটা সে অনীশকে দিল ঠিকই কিন্তু তাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে বসাল না। অনীশ নরবুর উদ্দেশ্যে বলল, কাগজ তৈরি করে এনেছি। তোমার নাতি কোথায়? তাকে ডাকো?

নরবু জবাব দিল, সে এখনও ফেরেনি। তার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা।

ফেরেনি! বিস্মিত ভাবে বলল অনীশ।

নরবু বলল, না, এখনও ফেরেনি। গতকাল সন্ধ্যার আগেই তার ফেরার কথা ছিল। পায়ে হেঁটেই ফেরার কথা তার। গ্যাংটক থেকে গাড়ি তাকে ওপরে পাসের মুখে পৌঁছে দিয়েছিল। সে যে পাসে ঢুকেছিল সে খবরও পেয়েছি। কিন্তু তারপর আর তার কোনও খবর নেই। সে না এলে কিছু হবে না।

এর জবাবে অনীশ বলল, তোমরা চাইলে লেখাটা আমি পড়ে শোনাতে পারি।

নরবু প্রত্যুত্তরে স্পষ্টভাবে বলল, আপনি এখন ফিরে যান। নাতিটার না ফেরা নিয়ে আমরা সকলে খুব চিন্তায় আছি। সে ফিরে এলে আমরা আপনাকে খবর দেব।

সমস্যায় পড়ে গেল অনীশ। পরদিনই তো তাকে ফেরার পথ ধরতে হবে। তার মধ্যে যদি নরবুর নাতি না ফেরে? অনীশ পবনকে বলল, তুমি একটা কাজ করো। আমাদের সঙ্গে তো গাড়ি আছে, সেটা নিয়ে তুমি পাসে গিয়ে, সম্ভব হলে পাসের একটু ভিতরে গিয়ে তার। সন্ধান নিতে পারো। কিন্তু মুশকিল হল তুমি তাকে চিনবে কীভাবে?

পবন বলল, আমি তাকে চিনি স্যার। এর আগে যখন গ্রামে এসেছিলাম তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

অনীশ আর তার ড্রাইভারের কথোপকথন শুনে নরবু ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দেখো তাকে খুঁজে পাও কিনা। এমনও হতে পারে কোথাও সে তুষারপাতে আটকে পড়েছে। তোমরা তাকে খুঁজে না পেলে আমরা গ্রামের লোকরা মিলে আশেপাশের জায়গাগুলোতে তাকে খুঁজতে বেরোব।

অনীশ এরপর আর সেখানে দাঁড়াল না। পবনকে নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পবন বলল, ছেলেটা না ফেরায় এখন ওদের মনে অন্য ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।

অনীশ প্রশ্ন করল, কী ভয়?

পবন বলল, গতকাল সন্ধ্যায় খামার থেকে ক্ষুধার্ত নেকড়ের ডাক ভেসে আসছিল গ্রামে। ওদের মনে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধছে যে…।

পবন তার কথা শেষ না করলেও তার সম্পূর্ণ বক্তব্য বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না অনীশের। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। সেজ বাতির আলোতে দরজার ফোকর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই নেকড়েটা! তার সেই লোলুপ ক্ষুধার্ত দৃষ্টি, লাল জিভ, চোয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁত! সেই নেকড়েটাই কোনওভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটায়নি তো?

অনীশের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মুখে সে শুধু বলল, তেমন কিছু ঘটলে ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর হবে।

পবন বলল, হ্যাঁ, সাহেব, নেকড়ে সমেত খামারে আগুন লাগিয়ে দেবে ওরা।

বাকিটা পথ তারা দু-জন কেউ কোনও কথা বলল না। আশঙ্কা দানা বাঁধছে দুজনের মনেই। বন পেরিয়ে ঢাল বেয়ে বড় রাস্তায় নামল তারা। ক্যাম্পের দিকে কিছুটা এগোতেই পিছন থেকে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আর্মি গাড়িটা তাদের পাশে এসেই দাঁড়াল। চালকের পাশের আসনেই বসে আছেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। পবনকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি অনীশকে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাচ্ছেন এখন?

অনীশ বলল, আমি এখন ক্যাম্পেই ফিরছি। তবে আমার ড্রাইভারকে পাঠাচ্ছি পাসের মুখটাতে। শহর থেকে একটা ছেলের ও পথ ধরেই গতকাল গ্রামে ফেরার কথা ছিল। সে ফেরেনি। তাই আমার ড্রাইভার তার খোঁজে ওদিকে যাচ্ছে।

ছেত্রী এরপর বললেন, শুনলাম আপনি নাকি কিছুদিনের জন্য ওই ক্যাম্পেই থাকছেন? এখন ফিরছেন না?

অনীশ বিস্মিতভাবে বলল, আমার তো কালই ফিরে যাবার কথা। এ খবর আপনাকে কে দিল?

লেফটানেন্ট বললেন, আমাকে নয়, আমার এক সৈনিককে কথাটা বলেছেন ভাইমার। গতকাল সন্ধ্যায় যখন তুষারপাত হচ্ছিল তখন টহল দিয়ে ফিরছিল আমার এক সৈনিক। ক্যাম্পের গেটের মুখে তার সঙ্গে ভাইমারের দেখা হয়। গত কয়েকমাস ধরে আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলতেন না তিনি। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় নিজেই সেই সৈনিককে ডাকেন। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। কথা প্রসঙ্গে তিনিই তাকে ব্যাপারটা বলেন।

অনীশ বলল, না না, আমার তেমন কোনও কথা হয়নি ভাইমারের সঙ্গে।

অনীশের জবাব শুনে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল লেফটানেন্টের মুখ। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, থাকুন বা নাই থাকুন আপনি কিন্তু গতরাতের মতো বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। সীমান্ত অঞ্চল। রাস্তা চিনতে না পেরে ওদেশে ঢুকে পড়লেই পিপিলস আর্মির হাতে গুপ্তচর সন্দেহে বলি হবেন। এভাবে অনেক নিরীহ মানুষ বন্দি হয়েছে ওদের কাছে।

এবার তার কথা শুনে আরও অবাক হয়ে গেল অনীশ। সে বলল, আমি কাল ঘরে ঢোকার পর বাইরে বেরোইনি তো!

লেফটানেন্ট ছেত্রী বলল, কিন্তু আমাদের এক গার্ড নাইট ভিশন ফিল্ড গ্লাসে আপনাকে দেখতে পেয়েছিল বলল। তার তো ভুল দেখার কথা নয়!

অনীশ এবার বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, হ্যাঁ, সে ভুল দেখেছে। আমি বাইরে যাইনি।

দু-পাশে মাথা নাড়লেন ছেত্রী। যেন তিনি বুঝতে পারছেন না সেই গার্ড নাকি অনীশ, কে সত্যি বলছে। এরপর তিনি আর কথা বাড়ালেন না। তার ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করলেন গাড়ি এগোবার জন্য।

লেফট্যানেন্ট চলে যাবার পর ক্যাম্পের দিকে এগোল তারা দু-জন। গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল তারা। পবনকে অনীশ বলল, ছেলেটার খোঁজ জেনে সঙ্গে সঙ্গে জানিও আমাকে।

পবন বলল, আচ্ছা স্যার।

সে গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর কিছুটা হেঁটে তার কাঁটা ঘেরা ক্যাম্পের ভিতর প্রবেশ করল অনীশ। বরফ ঢাকা চত্বরটার ঠিক মাঝখানে তাবু খাটাচ্ছে চীনাগুলো। তাদের ভারবাহী পশুগুলো অবশ্য সেখানে নেই। হয়তো তারা বাড়ির পিছনের দিকেই রয়ে গেছে। ভাইমারকেও দেখতে পেল না অনীশ। ঘরে ঢুকে হঠাৎ তার খেয়াল হল ফুলের বোকেটা বাইরে ফেলা হয়নি। জানলাটা বন্ধ। একটু পরে সেটা ফেলে দিলেও চলবে। সেটা টেবিলের ওপর রেখে জিরিয়ে নেবার জন্য খাটের ওপর বসল অনীশ।

হঠাৎ তার চোখ পড়ল দরজাটার সেই ভাঙা জায়গার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল গত রাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি। খুব জোর বেঁচে গেছে সে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তার খেয়াল হল ঘরে বাতি নেই। নেকড়ে আর আসবে না ঠিকই কিন্তু বাতি ছাড়া চলবে কীভাবে? ভাইমারের কাছ থেকে একটা বাতি জোগাড় করার জন্য খাট ছেড়ে নেমে ঘরের বাইরে বেরোল অনীশ। বাইরে বেরিয়েই সে দেখতে পেল বারান্দার অন্যপ্রান্ত থেকে এগিয়ে আসছেন ভাইমার। অনীশও এগোল তার দিকে।

ভাইমার তাকে মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, কখন ফিরলেন?

অনীশ বলল, এই মাত্র। তবে কাজ এগোয়নি। নরবুর নাতির গ্রামে ফেরার কথা ছিল, সে ফেরেনি। সে না ফিরলে কী হবে বুঝতে পারছি না। কাল তো আমাকে ফিরতে হবে।

অনীশের কথা শুনে এ ব্যাপারে ভাইমার খুব বেশি উদ্বিগ্ন হলেন বলে মনে হল না। প্রথমে তিনি বললেন, চলে যেতে হলে যাবেন। তারপর যেন একটু মজা করার ঢঙেই বললেন, আমি তো ভাবছিলাম আপনি হয়তো এখানেই থেকে যাবেন। এই পাহাড়, এই প্রকৃতি, এই। সুন্দর সুন্দর প্রাণীগুলোকে ছেড়ে আপনি যাবেন না।

অনীশের মনে পড়ে গেল লেফটানেন্ট ছেত্রীর কথা। তাহলে হয়তো সত্যিই ভাইমার মজা করে হলেও এ কথাটা বলেছেন সেই সৈনিককে। অনীশ হেসে ভাইমারকে বলল, এমন সুন্দর জায়গাতে থাকতে পারলে ভালোই হত। কিন্তু তার কি আর উপায় আছে।

ভাইমার নিঃশব্দে হাসলেন তার কথা শুনে।

অনীশ এরপর বলল, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। গতকাল বাতিটা ভেঙে গেছে। একটা বাতি লাগবে।

ভাইমার বললেন, তেলের বাতি নেই। একটা মোমবাতি দিচ্ছি। আর তো মাত্র আজকের রাতের ব্যাপার। খুব অসুবিধা হবে না আশাকরি।

এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মোম নিয়ে ফিরে এলেন ভাইমার। সেটা তিনি অনীশের হাতে দিয়ে বললেন, আমি এই চীনাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকব। সম্ভবত আজ আর আপনার সঙ্গে দেখা হবে না আমার। তাই আগাম শুভরাত্রি জানিয়ে রাখলাম আপনাকে।

আকাশটা আবার কেমন যেন পালটাতে শুরু করেছে। তুষারপাত শুরু হবে আবার। মোমবাতিটা নিয়ে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়ল অনীশ।

বিকাল পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে আবার বাইরে বেরোল সে। তুষারপাত হচ্ছে। চীনাদের তাবু খাটানো হয়ে গেলেও তারা বাইরে তুষারপাতের মধ্যেই বসে আছে। ঝিরিঝিরি তুষারপাত তাদের পোশাককেও সাদা করে দিয়েছে। অনীশ হঠাৎ দেখতে পেল কাঁটাতারের বাইরে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার গাড়িটা। পবন ফিরে এসেছে। বারান্দা থেকে নেমে চীনাদের জটলাটার পাশ কাটিয়ে অনীশ গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পবন বলল, পাসের ভিতরে ঢুকেও অনেকটা খুঁজে এলাম স্যার। তার দেখা মেলেনি। তবে একজন খচ্চরঅলা বলল যে গতকাল অন্ধকার নামার পর ওই বয়সেরই একটা ছেলে নাকি পাস দিয়ে আসছিল।

অনীশ বলল, পেলে না যখন তখন আর কী করা যাবে! তুমি তবে গ্রামে ফিরে যাও। কাল আটটা নাগাদ চলে এস। ফেরার জন্য রওনা হতে হবে।

পবন বলল, হ্যাঁ, সার। আমি ঠিক সময় চলে আসব।

ছেলেটাকে যখন পাওয়া গেল না তখন সম্ভবত আর কিছুই করার নেই অনীশের। ভাইমার। যদি গ্রামবাসীদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে পারেন ভালো, নইলে তার ক্যাম্পের ভাগ্যে যা আছে তা হবে। বিষণ্ণ ভাবে সে পিছু ফিরল ঘরে যাবার জন্য। চীনাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে একবার থমকে দাঁড়াল। বরফের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে আগুন জ্বেলে বসে আছে তারা। অনীশ সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই তাদের একজন তাকে দেখিয়ে কী যেন বলল। কথাটা শুনে অন্য চীনারাও তাকাল অনীশের দিকে। তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলতে বলতে হাসাহাসি শুরু করল নিজেদের মধ্যে। অস্বস্তি বোধ করল অনীশ। সে এগোল ঘরের দিকে।

বাইরে অন্ধকার নামার পর মোমের আলোতে তার টুকিটাকি জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিল অনীশ। সকালবেলা বেরিয়ে অনেকটা পথ ফিরতে হবে তাকে। বাইরে তুষারপাত আর বাতাস ক্রমশ বাড়ছে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। বেশ অবসন্ন বোধ করছে অনীশ। তার আসাটা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হল। পরদিন বেরোতে হবে বলে রাত আটটা নাগাদ খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল সে।

বাইরে অবিশ্রান্ত তুষারপাত আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

কিন্তু এদিনও মাঝরাতে অনীশের ঘুম ভেঙে গেল। খটখট শব্দে কঁপছে দরজাটা। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে লাফিয়ে নামল অনীশ। বাইরে বাতাসের প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। তাতেই কি দরজাটা কাঁপছে, নাকি গতকালের নেকড়েটা ফিরে এসেছে?

পকেট হাতড়ে দেশলাই বার করে মোম জ্বালাবার চেষ্টা করল অনীশ। কিন্তু দরজা জানলার ফাঁক গলে আসা বাতাসে কাঠি নিভে যাচ্ছে। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় দেশলাই দিয়ে মোম জ্বালাতে সমর্থ হল অনীশ। মোমের শিখাটা কাঁপছে, হয়তো বা এখনই সেটা নিভে যাবে। তবু তার আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। সেই আলোতে দরজার নীচের ফাটলের দিকে তাকিয়ে হৃৎস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল অনীশের।

দরজার ফাটল গলে ঘরের ভিতর উঁকি দিচ্ছে একটা নেকড়ের মাথা! এ নেকড়েটা গতকালের নেকড়েটার চেয়ে আরও বড় আরও প্রকাণ্ড! তার ধবধবে সাদা রং দেখে অনীশ বুঝতে পারল এটা সেই দলপতি নেকড়েটা। অদম্য জিঘাংসা জেগে আছে তার চোখদুটোতে। মোমের নরম আলোতেও ঝিলিক দিচ্ছে তার হিংস্র স্বদন্তগুলো।

ভাইমার তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে গতকালের ঘটনাটা নিছকই দুর্ঘটনা বলে। তবে?

প্রাণীটা গতকালের নেকড়েটার মতোই মাথা দিয়ে ঠেলে ভাঙার চেষ্টা করছে দরজার ওপরের প্যানেলটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনীশ তাকিয়ে রইল তার দিকে। থরথর করে কাঁপছে দরজাটা। নেকড়ের মাথার চাপে মচমচ্ করে শব্দ হচ্ছে পুরোনো আমলের কাঠের দরজা থেকে। বাইরে বাতাসের শনশন শব্দ। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠছে। এই বুঝি নিভে গেল সেটা।

এ নেকড়েটা অন্য নেকড়েদের চেয়ে অনেক বড়, অনেক শক্তিধর। তার বিশাল মাথার চাপে সত্যি একসময় খসে গেল আর একটা প্যানেলও। বেশ বড় একটা ছিদ্র তৈরি হল দরজার নীচের অংশে। মুহূর্তের জন্য একবার থমকে অনীশের দিকে তাকাল শ্বাপদটা। তারপর প্রথমে সামনের পা দুটোকে দরজার এ পাশে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে গুঁড়ি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকতে শুরু করল।

প্রাণীটা তখন প্রায় তার দেহের অর্ধেক অংশটা ঢুকিয়ে ফেলেছে ঘরের মধ্যে, ঠিক সেই সময় হুঁশ ফিরল অনীশের। যেভাবেই হোক আটকাতে হবে নেকড়েটাকে। কিন্তু কীভাবে? তার কাছে তো তেমন কিছুই নেই। প্রাণীটা ক্রমশ ঢুকে আসছে ঘরের মধ্যে। মানুষ যখন প্রচণ্ড বিপদে পড়ে তখন খড়কুটো ধরেও বাঁচার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক সময় ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও সেটাই সত্যি।

টেবিলের ওপরই রাখা ফুলের বোকেটা তুলে নিয়ে সেটাই সে ছুঁড়ে মারল নেকড়েটাকে লক্ষ্য করে। প্রাণীটার কাঁধে গিয়ে পড়ল বোকেটা। কিন্তু তাতেই এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। ফুল নয় যেন কেউ কোনও একটা ভারী কিছু জিনিস দিয়ে আঘাত করেছে অথবা যেন তাকে আগুন ছুঁড়ে মেরেছে এমনভাবে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে উঠল নেকড়েটা। তারপর কোনওরকমে তার দেহটা হাচোড়-প্যাচোড় করে দরজার বাইরে বার করে নিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আক্রোশে গর্জন করতে লাগল প্রাণীটা। অনীশও বুঝে উঠতে পারল না যে ব্যাপারটা কী ঘটল? সে চেয়ে রইল দরজার ফাটলটার দিকে। বোকে থেকে ফুলগুলো খসে পড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে। দরজার ওপাশে গর্জন করেই চলেছে প্রাণীটা। কী রক্তজল করা তার ডাক! যেন অনীশকে নাগালের মধ্যে পেলেই সে তার কুঁটি ছিঁড়ে নেবে।

সময়ের পর সময় কেটে যেতে লাগল। দরজার দু-পাশে দাঁড়িয়ে রইল অনীশ আর নেকড়েটা। শেষ রাতের দিকে ধীরে ধীরে কমে এল নেকড়ের ডাকটা। তার ক্রুদ্ধ গর্জন দরজা ছেড়ে দূরে চলে যেতে লাগল। কতক্ষণ এভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল তা নিজেরও খেয়াল ছিল না অনীশের। একসময় সে দেখল দরজার ফোকর দিয়ে যেন আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। ভোর হচ্ছে বাইরে।

৬. দুঃস্বপ্নের রাত

দুঃস্বপ্নের রাত অতিবাহিত হল শেষ পর্যন্ত। বাইরে সূর্যোদয় হয়েছে। অনীশ জানলা খুলতেই একরাশ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। বাইরের দিকে তাকিয়েই অনীশ বুঝতে পারল গতকাল অন্ধকার নামার পর থেকেই আরও অনেক তুষারপাত হয়েছে। অন্তত চার-পাঁচ ফুট বরফের চাদরে ঢেকে গেছে মাটি। বাড়িটার সামনের বা পিছনের কোনও অংশ থেকেই কোনও শব্দ আসছে না।

ঘরে আলো ঢুকতেই মনে অনেকটা বল ফিরে এল অনীশের। সে মনে মনে ভাবল যে যাবার আগে গত রাতের ব্যাপারটা নিয়ে একবার জবাবদিহি চাইবে ভাইমারের কাছে। পরপর দু-রাত ভাইমারের অসতর্কতার জন্য প্রাণ যেতে বসেছিল তার। গ্রামবাসীদের অভিযোগ এবার সত্যি বলে অনীশের মনে হল। ওয়্যার উলফ না হলেও তার নেকড়েগুলোই হয়তো ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে একের পর এক মানুষ মেরেছে। ভাইমার ঘটনাটা যতই অস্বীকার করুন না কেন এ ব্যাপারটাই সম্ভবত সত্যি। কপাল ভালো যে পরপর দু-রাত বেঁচে গেছে অনীশ।

অনীশের ঘড়ির কাটায় সাতটা বাজল একসময়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোবাইলও বেজে উঠল। ড্রাইভার পবনের ফোন। সে বলল, আমি চলে এসেছি স্যার।

অনীশ বলল, ঠিক কোথায় তুমি?

পবন বলল, ঠিক গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে। ভিতরে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে গেট খোলা।

অনীশ বলল, দাঁড়াও আমি ঘরের বাইরে বেরোচ্ছি।

দরজা খুলল অনীশ। বাইরেটা পুরো তুষারে মুড়ে আছে। এমনকী বঁটাতারগুলো থেকেও ঝুলের মতো তুষার ঝুলছে। বারান্দার মেঝেও ঢেকে গেছে বাতাসে ভেসে আসা তুষারে। পবনকে দেখে হাত নেড়ে ভিতরে ঢোকার ইঙ্গিত করল অনীশ। চীনাদের তাঁবুটারও এখন কোনও চিহ্ন নেই। আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও ভাইমার বা তার লোকজনকেও দেখতে পেল না অনীশ।

পবন হাঁটু পর্যন্ত বরফ ভেঙে বারান্দায় উঠে এল। তার চোখে মুখে কেমন যেন উত্তেজনার ছাপ। দরজার সামনে এসে বারান্দার মেঝের দিকে তাকিয়ে সে আঁতকে উঠে বলল, ওটা কী?

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনীশ দেখল দরজার বাইরে তুষারের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে নেকড়ের অসংখ্য পায়ের ছাপ! গতরাতের ঘটনার চিহ্ন। অনীশ জবাব দিল, গত রাতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। একটা নেকড়ে দরজা ভেঙে ঢুকতে যাচ্ছিল। কোনওমতে বেঁচে গেছি!

অনীশের কথা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে গেল পবনের মুখ। অনীশ তাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার পর পবন উত্তেজিতভাবে বলল, ওদিকে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছে। তাই গ্রামে থাকা সুবিধার মনে হল না। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।

অনীশ বলল, কী ঘটনা?

পবন বলল, কাল সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে এসে ছেলেটাকে যে পাওয়া যায়নি সে খবর দেবার পর গ্রামের লোকরা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল দল বেঁধে। পাস থেকে যে রাস্তাটা এদিকে ঢুকেছে সেখানে জঙ্গলের মধ্যে ছেলেটার দেহর কিছু অংশ মিলেছে। নেকড়ে খাওয়া দেহ। সম্ভবত গত পরশু রাতে তাকে ধরেছিল নেকড়েগুলো। গ্রামবাসীরা প্রচণ্ড উত্তেজিত। তারা হয়তো সত্যিই পুড়িয়ে দেবে এই ক্যাম্প। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে ফেরা যায় ততই ভালো।

অনীশ তার কথা শুনে চমকে উঠে বলল, আমি তৈরি হয়েই আছি। এখনই বেরিয়ে পড়ব। যাবার আগে শুধু ভাইমারকে একবার জানিয়ে যাই।

অনীশ বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর মিস্টার ভাইমার, মিস্টার ভাইমার বলে হাঁক দিতে লাগল। কিন্তু কোথা থেকে কোনও সাড়া মিলল না ভাইমারের। বারান্দার সার বাঁধা একটার। পর একটা ঘরগুলোও দেখল তারা দুজন। সব ঘর বাইরে থেকে তালা বন্ধ। এমনকী অনীশ প্রথমদিন যে ঘরে এসে বসেছিল সেটাও তালা দেওয়া। অনীশ বলল, ভাইমার নিশ্চয়ই তবে বাড়ির পিছনের দিকে আছেন। চলো সেখানে।

অনীশ আর পবন বারান্দা থেকে নামতেই তাদের প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল তুষারের মধ্যে। বরফ ভেঙে তারা বাড়ির পিছন দিকে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেইসময় একটা আর্মি জিপ এসে থামল গেটের সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন ছেত্রীসাহেব সহ আরও জনা পাঁচেক অস্ত্রধারী সেনা। সটান গেট খুলে তারা প্রবেশ করলেন ভিতরে। অনীশ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তাদের দেখে।

অনীশদের সামনে এসে দাঁড়ালেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। তিনি প্রশ্ন করলেন, এখানে যে চীনাদের দলটা ছিল তারা কই?

অনীশ জবাব দিল, কাল সন্ধ্যায় তাদের তাবু ছিল। সকালে উঠে দেখতে পাচ্ছি না।

থমথম করছে লেফটানেন্ট ছেত্রীর মুখ। তিনি বললেন, শুনেছেন নিশ্চয়ই কাল রাতে সেই নিখোঁজ ছেলেটার নেকড়ে খাওয়া দেহ মিলেছে। ভাইমার সাহেব কই? তিনি হয়তো ঘটনাটা বলতে পারবেন। আমার ধারণা তার নেকড়েই পরশু এ কাণ্ডটা ঘটিয়েছে।

অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, এখন আমারও তাই ধারণা। কাল আর পরশু দু-দিন রাতেই দুটো নেকড়ে আমার ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে। ফিরে যাবার আগে তাকেই আমরা খুঁজতে যাচ্ছিলাম। হয়তো তিনি বাড়ির পিছনের অংশে আছেন।

লেফটানেন্ট বলল, তবে চলুন ওদিকে।

বাড়ির পিছন দিকে এগোল তারা সবাই মিলে। যেতে যেতে লেফটানেন্ট অনীশকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি গতকাল সন্ধ্যার পর বাইরে বেরিয়েছিলেন?

অনীশ জবাব দিল, না, কেন বলুন তো?

লেফটানেন্ট ছেত্রী যদিও জবাব দিলেন এমনি জিগ্যেস করলাম কিন্তু তার জবাব শুনে লেফটানেন্টের সঙ্গে যেন মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হল তার এক সেনার। ব্যাপারটা অনীশের চোখ এড়াল না।

অনীশরা বাড়ির পিছনে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে ভাইমার বা তার লোকজন কেউ নেই। সেই চীনাদের দল বা তাদের ভারবাহী পশুগুলোও নয়। আর এরপরই তাদের নজর পড়ল খাঁচাগুলোর দরজাতে। দরজাগুলো সব খোলা! কোনও খাঁচাতেই কোনও প্রাণী নেই!

বিস্মিত অনীশ বলে উঠল, নেকড়েগুলো সব কোথায় গেল?

অন্যরাও বিস্মিত! কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই হতবাক হয়ে গেল। লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত বিপদের আঁচ করে পশুগুলোকে নিয়ে পালিয়েছেন ভাইমার। তবু ক্যাম্পটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখতে হবে।

লেফটানেন্টের নির্দেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল সেনারা।

অনীশ বলল, কিন্তু প্রাণীগুলোকে নিয়ে কোথায় যাবেন ভাইমার?

লেফটানেন্ট জবাব দিল, সম্ভবত সীমান্তের ওপারে। চীনা সেনারা তো প্রাণীগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী। হয়তো ওই চীনা রসদ সরবরাহকারী দলের সাহায্যে বা অন্য কোনওভাবে চীনা সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ভাইমার। পশুগুলোকে নিয়ে তিনি ওপাশে চলে গেলে আমাদের কিছু করার থাকবে না। যদিও আপনাকে সব কথা বলা ঠিক না তবু বলি চীনা সৈনিকদের একটা বেতারবার্তা ধরা পড়েছে আমাদের কাছে। সাংকেতিক সেই বেতারবার্তায় তারা নিজেদের মধ্যে খোঁজখবর নিচ্ছিল যে ওই চীনা ব্যবসায়ীদের দলটা এই ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে কিনা? অর্থাৎ ওই লোকগুলোর সঙ্গে চীনা ব্যবসায়ীদের কোনও সম্পর্ক আছে। সেজন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই এখানে এসেছিলাম আমি।

লেফটানেন্ট ছেত্রীর পাশে একজন সেনা দাঁড়িয়ে ছিল। তার পিঠে বাঁধা ওয়ারলেস সেট। ছেত্রী তাকে বললেন, আটশো চব্বিশ আউটপোস্টের স্নো-আউলকে ধরে দাও।

তার নির্দেশ শুনে সেই সৈনিক ওয়ারলেসে ধরে দিল স্নো-আউল ছদ্মনামের কোনও লোককে। মাইক্রোফোন নিয়ে লেফটানেন্ট বললেন, স্নো-লেপার্ড কলিং। এরপর অবশ্য সাংকেতিক কথা-বার্তা শুরু হল দুজনের মধ্যে। মিনিট তিনেক কথা বলার পর লাইনটা কেটে দিয়ে লেফটানেন্ট বললেন, আজ সূর্যোদয়ের সময় নাথুলা পাসে প্রবেশ করেছে চীনাদের ওই দলটা। ওদের সঙ্গে ভাইমার নেই ঠিকই কিন্তু পশুগুলোর পিঠে ভারী ভারী চটের বস্তা আছে। কিন্তু ওভাবে বস্তায় পুরে নেকড়ে নিয়ে যাওয়া কী সম্ভব? তারা ডাক ছাড়বে, ছটফট করবে, অনায়াসে চটের বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।

পশুগুলোকে নিয়ে ভাইমার কোথায় গেলেন ভাবতে লাগলেন ছেত্রী। নেকড়ে তো আর কুকুর নয় যে চেনে বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে? তার ওপর অমন পাঁচ পাঁচটা হিংস্র নেকড়ে।

যে সব সেনারা ক্যাম্পের ভিতর ভাইমারকে খুঁজতে গেছিল তারা এসে জানাল যে ভাইমার কোথাও নেই। তবে?

হঠাৎ অনীশের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। সে বলল, হ্যাঁ, হা, ওভাবেও কিন্তু প্রাণীগুলোকে বস্তাবন্দি করে পাচার করা সম্ভব।

বিস্মিত লেফটানেন্ট জানতে চাইল, কীভাবে?

অনীশ বলল, আফ্রিকার রোডেশিয়াতে একবার একটা চিতা হানা দিচ্ছিল গ্রামে। গ্রামবাসীরা তাকে ফাঁদ পেতে ধরে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে বস্তাবন্দি করে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের রেসকিউ ক্যাম্পে। নেকড়েগুলোকে যদি ঘুমের ওষুধ বা ইনজেকশন দেওয়া হয়ে থাকে? আট-নয় ঘণ্টা অনায়াসে এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় ওদের। ভাইমার অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটাও জানেন।

অনীশের কথা শুনে লেফটানেন্ট চমকে উঠে বললেন, এমনটা হতেই পারে। ওই চীনাদের পিছু ধাওয়া করতে হবে। আপনি লোকগুলোকে চিনতে পারবেন? কেন না ওইরকম খচ্চরের পিঠে বস্তা চাপিয়ে অনেকে যাতায়াত করে রেশমপথে। সবাইয়ের তল্লাসী নেবার সময় হাতে নেই। ও দেশের সীমান্তে প্রবেশের আগেই তাদের ধরা চাই।

অনীশ জবাব দিল, সম্ভবত চিনতে পারব।

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত আজ আর আপনার ফেরা হবে না। সব ঠিক থাকলে কাল আপনি ফিরবেন। আপনার ফেরার যাবতীয় ব্যবস্থা আমি করব। এমনকী যদি তেমন প্রয়োজন হয় তবে আর্মি কপ্টার আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। আমি আপনাকে কথা দিলাম। আর দেরি করা যাবে না। এখনই পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের। চলুন আমার সঙ্গে।

লেফটানেন্ট ছেত্রীর বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন একটা প্রচ্ছন্ন নির্দেশ লুকিয়ে ছিল যে অনীশ কিছু বলতে পারল না। শুধু পবন বলল, আমি কি গাড়ি নিয়ে যাব আপনাদের সঙ্গে?

ছেত্রী পকেট থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা কার্ড বার করে পবনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এতে আমার ফোন নং আছে। প্রয়োজন হলে, ভাইমার ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করবে আমার সঙ্গে। তাছাড়া তোমার স্যারের ফোন নম্বর তো নিশ্চয়ই আছে তোমার কাছে। তুমি এখানেই থাকবে।

অনীশ বলল, তুমি বরং আমার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করো। ওখানে আমার জিনিসপত্র সব রাখা আছে।

লেফটানেন্ট ছেত্রী অনীশকে তাড়া দিলেন–দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলুন চলুন…।

মিনিট খানেকের মধ্যেই ক্যাম্প ছেড়ে নাথুলা পাস বা রেশম পথের উদ্দেশ্যে আর্মি জিপে রওনা হয়ে গেল অনীশরা।

বরফ মোড়া রাস্তা। পথের পাশের পাইন গাছগুলোর মাথাও বরফে ঢেকে আছে। অন্য পাশের পাথুরে দেওয়ালও বরফের চাদরে ঢাকা। আর্মি গাড়িটার চাকার চাপে দু-পাশে ছিটকে যাচ্ছে বরফের কাদা। সকলেই নিশ্চপ, লেফটানেন্ট আর তার সেনারা হিমশীতল মুখে বসে আছে, অনীশ বুঝতে পারল তাদের সবার ভিতরই প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করছে। অনীশ নিজেও ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড দুলে উঠছে গাড়িটা। মনে হয় এই বুঝি উলটে যাবে সেটা। তবু কারও মুখে কোনও ভাবান্তর হচ্ছে না। একসময় পাসের কাছাকাছি চলে এল গাড়িটা। তার আগে পথের পাশে পাইনবন যেখানে শেষ হয়েছে তার কিছুটা আগে বনের ভিতরে আঙুল তুলে দেখিয়ে ছেত্রী বললেন, ওর ভিতরই ছেলেটার দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। মাথা আর কঁধ বাদ দিয়ে দেহের পুরো অংশটাই সাবাড় করে দিয়েছে নেকড়ের দল।

পাসে প্রবেশ করল গাড়িটা। বরফ মোড়া রাস্তা। সংকীর্ণ পথের দু-পাশে কোথাও বরফের দেওয়াল, আবার কোথাও খাদ। নীচে পাকদণ্ডিগুলো দেখা যাচ্ছে। যে পথ বেয়ে অনীশ ওপরে উঠে এসেছিল। গাড়ি চলতে লাগল তার বিপরীতে আরও ওপর দিকে। কখনও গাড়িটা খাড়া উঠছে ওপর দিকে, আবার কখনও চুলের কাটার মতো বাঁক নিচ্ছে। বরফে চাকা পিছলোলেই যে-কোনও মুহূর্তে উলটে যেতে পারে গাড়ি। এ পথে কাউকেই ওপরে উঠতে দেখতে পাচ্ছে না অনীশরা। তবে মাঝে মাঝে দু-পাঁচ জনের ছোট ছোট দল ওপর থেকে নামছে। তাদের সঙ্গে কখনও বা নারী-শিশুও আছে। কখনও বা ভারবাহী খচ্চর বা গাধা। অনীশ জানতে চাইল, এই লোকগুলো কোথায় যাচ্ছে?

লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, পাসের এদিক-ওদিকে দু-চারটে ছোট ছোট গ্রাম আছে। বরফ পড়ছে বলে ওরা নীচে নেমে আসছে। এই তিনমাস ওরা নীচে থাকবে। আর গ্রামগুলো জনশূন্য অবস্থায় বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকবে।

পাস বা রেশমপথ ধরে আরও কিছুটা ওপরে ওঠার পরই ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হল। তার সঙ্গে বইতে লাগল কনকনে ঠান্ডা বাতাস। মাঝে মাঝে পাহাড়ের ঢাল থেকে শুড়িপথ এসে মিশেছে মূল রাস্তায়। সেগুলোও বরফে মোড়া। সে পথগুলো দেখিয়ে লেফটানেন্ট তার এক সৈনিককে বললেন, এ পথগুলো বরফে ঢাকা না থাকলে ওরা নির্ঘাত এ পথগুলোই ধরত সীমান্ত পেরোবার জন্য। আমরা ওদের ধরতে পারতাম না। এখন সোজা পথে ওদের চলতে হচ্ছে এটা বাঁচোয়া।

চলতে লাগল গাড়ি। তুষারপাত আর বাতাস ক্রমশ বাড়ছে। মাঝে মাঝে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। একসময় লেফটানেন্ট বারবার ঘড়ি দেখতে লাগলেন। তারপর আক্ষেপের স্বরে বললেন, এমন চললে আমরা হয়তো আর ওদের নাগাল পাব না। সীমান্ত পেরিয়ে যাবে ওরা। আমরা সীমান্তর অনেকটা কাছে চলে এসেছি। অথচ ওদের দেখা নেই!

অনীশ প্রশ্ন করল, আর কতদূর সীমান্ত?

লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, আমাদের পথের ডানপাশের দেওয়ালটাই তো চীনের ভূখণ্ডে। সীমান্ত বলতে যেখানে ওদের চেকপোস্ট আছে এই রেশম পথের ওপর আমি সে জায়গার কথাই বলছি। ও জায়গা এখান থেকে আর পাঁচ-ছয় কিলোমিটার হবে। হয়তো ওরা সীমান্তের ওপাশে পৌঁছে দাঁত বার করে হাসবে, আর এ-পাশ থেকে আমরা তাকিয়ে দেখব।

এবার স্পষ্ট উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠল লেফটানেন্ট আর তার সৈনিকদের মুখে। দাঁতে দাঁত চিপে শক্ত হাতে হুইল ধরে যথাসম্ভব গাড়িটা দ্রুত চালাবার চেষ্টা করছে ড্রাইভার। কিন্তু। পারছে না। বাতাসের দাপটে মনে হচ্ছে উলটে যাবে গাড়িটা।

একসময় গাড়িটা এভাবেই আরও দু-তিন কিলোমিটার এসে থামল এক জায়গাতে। পথ সেখানে দুটো ভাগে ভাগ হয়েছে। ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্ন করল, কোন পথ ধরব? দুটো পথই তো চীনা আউটপোস্টে পৌঁছেছে।

লেফটানেন্ট মুহূর্তখানেক ভেবে নিয়ে বললেন, বাঁ-দিকের পথটা একটু শর্টকাটে চীনা আউটপোস্টে পৌঁছয় ঠিকই কিন্তু পথের শেষ এক কিলোমিটার খুব খাড়াই। ওদের পশুগুলোর পিঠে মাল আছে। ওদের পক্ষে ও পথে যাওয়া একটু কষ্টকর। ডান দিকের পথটাই বরং ধরো। যা হবার হবে।

ডান দিকের পথটাই ধরল ড্রাইভার। একটু এগোতেই হঠাই একটা ধাতব খটখট শব্দ কানে এল অনীশদের। গাড়ির কিছুটা তফাতে রাস্তার ওপর যেন বরফের ঝড় উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থেমে গেল। লেফটানেন্ট গাড়ি থেকে মুহূতাঁর মধ্যে লাফিয়ে নেমে অনীশকে টেনে নামিয়ে জাপটে ধরে শুয়ে পড়লেন রাস্তার পাশে একটা ফাটলের মধ্যে। চাপা স্বরে তিনি বলে উঠলেন, চীনা আর্মি পাহাড়ের মাথা থেকে মেশিনগান চালাচ্ছে। মাথা তুলবেন না।

গাড়ির অন্য জওয়ানরাও মুহূতাঁর মধ্যে নেমে পড়েছিল গাড়ি থেকে। গাড়ির আড়াল বা বরফের দেওয়ালে পজিশন নিয়ে এবার তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করল। বুলেটের আঘাতে ছিটকে উঠতে লাগল বরফ, এতগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দে খানখান। হয়ে যেতে লাগল রেশম পথের নিস্তব্ধতা। টানা এক মিনিট মতো চলল গুলির লড়াই। তারপর হঠাই থেমে গেল গুলির শব্দ। শুধু অনেক ওপর থেকে ধপ করে কোনও ভারী জিনিস যেন খসে পড়ল রাস্তায়!

সাংকেতিক শিস দিল একজন সৈনিক। গর্ত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লেফটানেন্ট আর অনীশ। কিছু দূরে রাস্তার পাশে পড়ে আছে একজন চীনা সৈনিকের মৃতদেহ। এ লোকটাই ওপর থেকে মেশিনগান চালাচ্ছিল। ভারতীয় সেনাদের গুলি ওপর থেকে পেড়ে ফেলেছে তাকে।

মৃতদেহটাকে দেখে লেফটানেন্ট বললেন, আমরা ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছি। সেজন্য লোকটা আমাদের আটকাবার চেষ্টা করছিল। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না। চীনাদের দলটা এখনও সীমান্ত পেরোতে পারেনি।

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে গাড়িতে উঠল সকলে। আবার চলতে শুরু করল গাড়ি।

তুষারঝড় শুরু হয়েছে এ পথে। শনশন শব্দে বাতাস বইছে প্রবল বেগে। রাস্তা থেকে বাতাসের ধাক্কায় পাক খেয়ে উঠছে তুষারকণা। তারই মধ্যে দিয়ে চলছে গাড়িটা। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। হঠাৎ ড্রাইভারের পাশে যে জওয়ান অস্ত্র উঁচিয়ে বসে ছিল সে চিৎকার করে উঠল, ওই! ওই!

অনীশ তাকাল সেদিকে। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ওদের। একটা বাকের দিকে এগোচ্ছে লোকগুলো। অনীশও বলে উঠল, হা হা ওরাই! ওরাই! একটা বাঁক পেরোচ্ছে লোকগুলো। গতি বাড়িয়ে গাড়িটা তুষারঝড়ের মধ্যে দিয়ে এগোল তাদের দিকে। কিন্তু তাদের কাছাকাছি পৌঁছোবার আগেই লোকগুলো টের পেয়ে গেল তাদের পিছনে ধাবমান গাড়িটার উপস্থিতি। ভারবাহী পশুগুলোকে ফেলে লোকগুলো পালাবার জন্য তুষারঝড়ের মধ্যে এদিক-ওদিকে ছুটল। অনীশদের গাড়িটা যখন সে জায়গাতে পৌঁছল তখন ভারবাহী খচ্চরগুলোই শুধু রাস্তার মাঝে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারটে খচ্চরের পিঠে বিরাট বিরাট চটের বস্তা। তার মধ্যে সম্ভবত বড় বড় কাঠের বাক্সর মতো কিছু আছে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। ঠিক সেই সময় দূরের পাহাড় থেকে মেশিনগানের র‍্যাট র‍্যাট শব্দ শোনা যেতে লাগল। লেফটানেন্ট সৈনিকদের বললেন, তাড়াতাড়ি বস্তাগুলো নামিয়ে গাড়ির মাথায় তোলো। এখানে আর ওর ভিতর কী আছে দেখার সময় নেই। বস্তার ভিতর বাক্সর মধ্যে যদি জীবন্ত নেকড়েগুলো থাকে তবে সেগুলো ওদের কাছে দামী। ছাদে থাকলে গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাবে না ওরা।

লেফটানেন্টের কথা মতোই কাজ হল। ছুরি দিয়ে দড়ি কেটে বস্তাগুলো নামিয়ে সেগুলো গাড়ির ছাদের খাঁচা মতো জায়গাটাতে তুলে ফেলা হল। মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল অনীশদের গাড়ি। এদিকে পাসের মধ্যেও তখন তুষারঝড় শুরু হয়েছে। অনীশরা পাসে উঠে কিছুটা এগোতেই আবারও গুলির শব্দ ভেসে আসতে লাগল দূরের পাহাড় থেকে। লেফটানেন্ট যাতে তাদের জিনিস নিয়ে পালাতে না পারেন সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীনা সেনারা। একটু বিস্মিতভাবে লেফটানেন্ট বলে উঠলেন, সামান্য এই নেকড়েগুলো হঠাৎ ওদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন?

তারপর তিনি ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, একটু এগিয়ে পাস থেকে ডান পাশের নীচে নামার পথটা ধরো। আমাদের ও পথে ফিরতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে ঠিকই। কিন্তু পথটার দু-পাশেই পাথরের দেওয়াল আর ভারতের ভূখণ্ড। চীনা সেনাদের গুলি সেখানে পৌঁছোবে না। লেফটানেন্টের নির্দেশ পালিত হল কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর্মি গাড়িটা সে পথই ধরল। আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল চীনা সেনাদের মেশিনগানের শব্দ।

৭. শেষ বিকালে ক্যাম্পে এসে

শেষ বিকালে ক্যাম্পে এসে পৌঁছোল অনীশরা। ঘুর পথে চীনা সেনাদের গুলি এড়িয়ে ফিরতে বেশ সময় লেগেছে। তাছাড়া সে পথে তুষারপাতও হচ্ছিল খুব। যদিও এদিকে তুষারপাত থেমেছে এখন। ক্যাম্পের পিছনে বরফ পাহাড়ের মাথায় শেষবারের মতো উঁকি দিচ্ছে সূর্য। তার মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে তুষারমোড়া ক্যাম্প চত্বরে। গাড়ি প্রবেশ করল ক্যাম্পের ভিতর। লেফটানেন্ট ড্রাইভারকে বললেন, গাড়িটা বাড়ির পিছন দিকে নিয়ে চলো। বস্তার মধ্যে যদি নেকড়ে থাকে তবে তো আপাতত সেগুলোকে খাঁচার মধ্যে রাখারই ব্যবস্থা করতে হবে।

সেইমতো গাড়িটাকে নিয়ে আসা হল বাড়ির পিছন অংশে খাঁচাগুলোর সামনে।

গাড়ি থেকে প্রথমে নামল সবাই। গাড়ির মাথায় তুষারের আড়ালে চাপা পড়ে আছে বস্তাগুলো। সেগুলো সাবধানে মাটিতে নামানো হল। একজন সেনা প্রথমে আর্মি নাইফ দিয়ে একটা বস্তা কাটতেই তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল পাতলা পাইন কাঠের তৈরি বেশ বড় একটা বাক্স। অনায়াসে তার মধ্যে একটা ঘুমন্ত নেকড়েকে রাখা যায়। সেই সেনা কান পাতল বাক্সর গায়ে। তারপর লেফটানেন্ট ছেত্রীর উদ্দেশ্যে বলল, সম্ভবত প্রাণীটার ঘুম ভাঙেনি। কোনও শব্দ আসছে না। হয়তো বা প্রাণীটা মরে গিয়েও থাকতে পারে।

তবুও সাবধানের মার নেই। অনীশকে কিছুটা তফাতে দাঁড়াতে বলে বাক্সটার দিকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে সেটাকে ঘিরে দাঁড়াল সেনারা। লেফটানেন্ট ছেত্রীও কোমর থেকে তার রিভলবার খুলে হাতে নিলেন। যাতে ঘুম ভেঙে প্রাণীটা কাউকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলেই তাকে এতগুলো আগ্নেয়াস্ত্রর গুলিতে আঁঝরা করে দেওয়া যায়।

একজন সৈনিক গাড়ি থেকে শাবলের মতো একটা স্প্যানার নামিয়ে আনল। তারপর সেটা দিয়ে সন্তর্পণে চাপ দিল বাক্সটার ঢাকনার খাঁজে। নরম পাইন কাঠের ঢাকনাটা খুলে মাটিতে খসে পড়ল। এক পা এগিয়ে সেই সৈনিক উঁকি দিল বাক্সর ভিতর। তারপর বিস্মিতভাবে চিৎকার করে উঠল, নেকড়ে নয়। ডেডবডি স্যার! চীনা সৈনিকের বডি।

তার কথা শুনে অন্য সবাইও ঝুঁকে পড়ল বাক্সটার ওপর। অনীশও এগিয়ে এল বাক্সটার কাছে। হ্যাঁ, বাক্সটার ভিতর দুমড়ে মুচড়ে রাখা আছে একটা মানুষের মৃতদেহ। গায়ে তার সামরিক পোশাক। চীনা সেনাবাহিনীর সামরিক উর্দি!

সবাই নিস্তব্ধ। এরপর একে একে খুলে ফেলা হল চটের চাদর মোড়া অন্য তিনটে বাক্সও। তাদের মধ্যেও তিনটে মানব দেহ!

লেফটানেন্ট ছেত্রীর নির্দেশে এরপর দেহগুলোকে বাক্স থেকে বার করে পরপর পাশাপাশি শোয়ানো হল। অনীশের যেন কেমন চেনা লাগল তাদের হিমশীতল মুখগুলো। তাদের দিকে তাকিয়ে লেফটানেন্ট ছেত্রী বলে উঠলেন, আরে এদেরই তো খুঁজছিলাম আমরা!

বিস্মিত অনীশ বলে উঠল, কারা এরা?

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, মাস ছয় আগে চীনা সেনাদের এই দলটা সীমান্ত পেরিয়ে প্রবেশ করেছিল এদেশে। পাঁচজনের দল ছিল। তার মধ্যে চারজনের দেহ পড়ে আছে এখানে। আমার ফাইলে এদেরই ছবি দেখেছেন আপনি। আমাদের সেনারা গুলি করে এদের মারে। ভালো করে দেখুন এদের শরীরে গুলির ক্ষত আছে। এ জায়গার কাছাকাছি ঘটনাটা ঘটেছিল। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কীভাবে যেন লোপাট হয়ে যায় এদের দেহ। আমাদের একটা সন্দেহ হয়েছিল যে ভাইমার হয়তো তার এই নেকড়ে খামারে এনে লুকিয়ে ফেলেছেন এদের দেহ। গত ছ মাস ধরে হন্যে হয়ে তল্লাশি চালিয়েও এই দেহগুলোর খোঁজ পাইনি আমরা। তিন দিন আগে এদের খোঁজ করতে গিয়েই নেকড়েদের পচাগলা দেহ উদ্ধার হয়েছিল। যদিও একজনের দেহ এখানে নেই। ওদের দলনেতার দেহ। আমাদের অনুমান তবে সত্যি। ভাইমার দেহগুলোকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন, তারপর ওদেশে পাচার করছিলেন। এজন্যই চীনা সেনাদের এত আগ্রহ ছিল বস্তাগুলোর ওপর।

লেফটানেন্ট ছেত্রীর কথা শেষ হলে বিস্মিত অনীশ বলল, দেহগুলো এমন অবিকৃত রইল কীভাবে? মনে হয় লোকগুলো ঘুমিয়ে আছে।

লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, বরফের নীচে থাকলে মানুষের দেহ শুধু ছমাস কেন, বছরের পর বছর অবিকৃত থেকে যায়। নিশ্চয়ই বরফের নীচে চাপা রাখা ছিল দেহগুলো। এ কথা বলে লেফটানেন্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন সেই মৃতদেহগুলো।

হঠাৎ একটা মৃতদেহর ওপর ঝুঁকে পড়লেন তিনি। তার মুখে কী যেন গেঁথে আছে। তার মুখ থেকে জিনিসটা তিনি খুলে নিলেন। ঈষৎ নীলাভ একটা কাচের টুকরো। জিনিসটা দেখেই অনীশের অন্য একটা জিনিসের কথা মনে পড়ে গেল। তার ঘরের বাতির কাঁচটাও এমন। নীলাভ ছিল! যেটা সে ছুঁড়ে মেরেছিল নেকড়ের মুখ লক্ষ্য করে।

ভালো করে মরদেহগুলো খুঁটিয়ে দেখার পর লেফটানেন্ট গম্ভীরভাবে নির্দেশ দিলেন, আপাতত এই মরদেহগুলোকে একটা খাঁচার ভিতর রেখে তালা দাও। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। কাল সকালে যা করার করা যাবে। সত্যিই তখন সূর্যদেব মুখ লুকিয়েছেন বরফ পাহাড়ের আড়ালে। শুধু তার লাল আভাটুকু জেগে আছে পাহাড়ের মাথায়।

লেফটানেন্ট ছেত্রীর নির্দেশমতো তার সেনারা মৃতদেহগুলোকে ধরাধরি করে একটা খাঁচার ভিতর রাখতে লাগল। অনীশ, লেফটানেন্ট ছেত্রীকে প্রশ্ন করলেন, তবে ভাইমার তার নেকড়েগুলোকে নিয়ে গেলেন কোথায়?

লেফটানেন্ট ছেত্রী জবাব দিলেন, জানি না। হয়তো তিনি তাদের নিয়ে আত্মগোপন করেছেন পাইনবনে অথবা এই বরফরাজ্যের কোথাও। লুকিয়ে থাকার জায়গার এখানে অভাব নেই। তবে এতগুলো প্রাণী নিয়ে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবেন না তিনি। রাতে টহল দেবে সেনারা। সীমান্ত সিল করার ব্যবস্থা করছি। কাল সকাল থেকে বড় সেনাদল তল্লাশি অভিযান চালাবে চারপাশে। ভাইমার ঠিক ধরা পড়ে যাবেন।

দেহগুলোকে একটা খাঁচার মধ্যে ঢোকানো হয়ে গেল। হঠাৎ অনীশের মনে পড়ে গেল ড্রাইভার পবনের কথা। সে কই?

অনীশ লেফটানেন্টকে বলল, আমার ড্রাইভার পবনকে দেখতে পাচ্ছি না। সে মনে হয় ঘরেই আছে। ও ঘরে আমার মালপত্রও আছে।

লেফটানেন্ট বললেন, হ্যাঁ, সেগুলো নিয়ে নিন। ড্রাইভারকেও সঙ্গে নিন। আজ রাতে এখানে নয়, আমাদের ক্যাম্পে থাকবেন আপনি। কাল ভোরে ফেরার পথ ধরবেন।

লাশগুলোকে খাঁচায় ঢোকানো হয়ে যাবার পর যে লোকটা বাক্সগুলো খুলেছিল সে লোকটা আর একজনকে খাঁচার সামনে পাহারায় রেখে অনীশ আর অন্য সেনাদের নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। গাড়িটা বাড়ির পিছন থেকে এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনের বারান্দার কাছে। গাড়ি থেকে নেমে অনীশের সঙ্গে বারান্দায় উঠে এলেন ছেত্রী আর তার সেনারা।

অনীশের ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। অনীশ বার কয়েক হাঁক দিল পবনের নাম ধরে। কিন্তু ভিতর থেকে কোনও সাড়া এল না। আশঙ্কার মেঘ তৈরি হল অনীশের মনে। ছেত্রী সাহেবের দিকে তাকালেন তিনি। লেফটানেন্ট ছেত্রী একজন সেনাকে বললেন, দরজা ভেঙে ফেলো।

সে অনীশকে জিগ্যেস করল, দরজার ছিটকিনিটা কোথায়? ওপরে, মাঝে, না নীচে?

অনীশ জবাব দিল, ওপরে।

আন্দাজ মতো সে জায়গা লক্ষ্য করে হাতের অস্ত্র থেকে গুলি চালাল লোকটা। অন্য একজন লোক এরপর দরজাটা ধাক্কা দিতেই ছিটকিনি ভেঙে দরজাটা খুলে গেল। আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ঘরে ঢুকল সবাই। কিন্তু ঘরে কেউ নেই!

কোথায় গেল পবন?

একজন সেনা তার অস্ত্র উঁচিয়ে ঘর সংলগ্ন বাথরুমটাও দেখে এল। না সেখানেও কেউ নেই!

লেফটানেন্ট বিস্মিতভাবে বললেন, ঘর বন্ধ, অথচ কোথায় গেল লোকটা?

হঠাৎ একটা খচমচ শব্দ শোনা গেল। শব্দটা আসছে খাটের নীচ থেকে।

সঙ্গে সঙ্গে খাটের নীচের দিকে সবার অস্ত্রের নল ঘুরে গেল। কয়েক মুহূতাঁর মধ্যে খাটের নীচ থেকে উঁকি দিল একটা মাথা। না নেকড়ে নয়, পবন! অনীশ বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ওখানে কী করছিলে তুমি?

কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল পবন। তারপর আতঙ্কিতভাবে বলল, নেকড়ে! নেকড়ে!

অনীশ বলল, কোথায় নেকড়ে?

কয়েক মুহূর্ত ধাতস্থ হতে লাগল পবনের। তারপর সে বলল, আপনারা চলে যাবার পর এই ফাঁকা ক্যাম্পে কেমন যেন গা-ছমছমে ভাব লাগছিল আমার। তাই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তুষারপাতও শুরু হয়েছিল বাইরে। খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ বিকালের দিকে ঘুম ভেঙে গেল একটা শব্দে। উঠে দেখি একটা বিশাল নেকড়ে দরজার নীচের ওই ফোকর দিয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে!

আমি চিৎকার করলাম। তারপর আপনার ব্যাগটা ছুঁড়ে মারলাম ওর দিকে। দেখুন ওই যে ব্যাগটা দরজার কোণে পড়ে আছে। কিন্তু প্রাণীটা তারপরও ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাইরে কীসের যেন শব্দ পেয়ে সম্ভবত চলে গেল এ জায়গা ছেড়ে। কিন্তু প্রাণীটা যদি আবার ফিরে আসে সে ভয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলাম আমি।

অনীশ বলল, প্রাণীটা যদি ঘরে ঢুকত তবে তো খাটের তলা থেকেই টেনে বার করত তোমাকে। তুমি বাঁচতে না। নেকড়েগুলো পরপর দু-রাত এভাবে আমাকেও ধরার চেষ্টা করেছিল এ ঘরে। হয়তো আমাদের ফিরে আসার শব্দ শুনেই সে পালিয়েছে। বেঁচে গেছো তুমি।

পবন বলল, তাই হবে স্যার। আমিও বাইরে আপনাদের কথাবার্তা তারপর ডাকাডাকি টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু ভয়ে আমার গলা দিয়ে শব্দ হচ্ছিল না। হাত-পা অসাড় হয়ে গেছিল। খাটের নীচ থেকে বেরোতেও পারছিলাম না।

লেফটানেন্ট বলল, অর্থাৎ নেকড়েগুলো খুব কাছাকাছিই আছে। অন্তত একটা নেকড়ে তো আছেই। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। দেখুন বাইরে অন্ধকার নামা শুরু হয়েছে। আশা করছি কাল পাইনবনে তল্লাশি চালালে ওদের সবার হদিশ মিলবে। চলুন এবার ফেরা যাক।

অনীশের মালপত্র উঠিয়ে নিয়ে পবন সহ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল সকলে। ঠিক সেই সময় যেন ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল চারপাশে। বারান্দা থেকে নেমে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে সকলে, ঠিক সে সময় সবাইকে চমকে দিয়ে বাড়ির পিছন থেকে ভেসে এল নেকড়ের ডাক! সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। লেফটানেন্ট বলে উঠলেন, তবে নেকড়েটা এখনও এ চৌহদ্দি ছেড়ে যায়নি।

কথাগুলো বলেই রিভলবার খুলে তিনি এগোলেন বাড়ির পিছন দিকে যাবার জন্য। আবার শোনা গেল নেকড়ের ডাক। এক নয়, একাধিক নেকড়ের সম্মিলিত হিংস্র গর্জন! তবে কি সবকটা নেকড়েই এখানেই আছে!

বিস্মিত অনীশরা সবাই এগোচ্ছিল বাড়ির পিছন দিকে। কিন্তু সেদিক থেকে ঊধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসতে দেখা গেল খাঁচার কাছে প্রহরারত দুই জওয়ানকে। অস্ত্র হাতে থাকলেও ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তাদের মুখ। অনীশদের সামনে তারা উপস্থিত হয়ে আতঙ্কিত স্বরে একসঙ্গে বলে উঠল, নেকড়ে! নেকড়ে!

লেফটানেন্ট বলে উঠলেন, কোথায়?

আতঙ্কিত স্বরে একজন বলে উঠল, খাঁচার মধ্যে আটকে আছে স্যার।

অন্যজন বলল, ওদিকে যাবেন না স্যার।

খাঁচার মধ্যে! লোক দুজনকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ছেত্রী ছুটলেন বাড়ির পিছন দিকে। অনীশ সহ অন্য সেনারাও অনুসরণ করল তাঁকে। এমনকী সেই আতঙ্কিত সেনা দুজনও নিরুপায় হয়ে পিছনে এল। নেকড়েদের ক্রুদ্ধ গর্জন ভেসে আসছে। বাড়ির পিছনে খাঁচাগুলোর সামনে উপস্থিত হল সবাই। যে খাঁচাটার ভিতর চীনা সৈনিকদের শবদেহগুলো রাখা ছিল সেখানে একসঙ্গে অনেকগুলো টর্চের আলো ফেলা হল। খাঁচার ভিতর দাঁড়িয়ে আছে চার চারটে নেকড়ে! টর্চের আলোতে ভঁটার মতো জ্বলছে তাদের চোখ, টকটকে লাল জিভ আর হিংস্র দাঁতের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা!

কে যেন বলে উঠল, মৃতদেহগুলো কোথায় গেল?

খাঁচার সামনে প্রহরারত সেই আতঙ্কিত সেনাদের একজন বলে উঠল, অন্ধকার নামতেই মৃতদেহগুলো যেন ঘুম ভেঙে প্রথমে নড়ে উঠল। তারপর ওরা ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনেই নেকড়ে হয়ে গেল!

লোকটার কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই চারটে নেকড়ে খাঁচার গরাদের ওপর এসে কঁপাতে শুরু করল। আর তার সঙ্গে কী বীভৎস চিৎকার তাদের। যেন খাঁচার বাইরে একবার আসতে পারলেই তারা ছিঁড়ে খাবে সবাইকে। আদিম হিংসার প্রতিমূর্তি যেন প্রাণীগুলো। নাকি প্রেতমুর্তি?

হতভম্ব অনীশের পাশে দাঁড়ানো লেফটানেন্ট ছেত্রী বিস্মিতভাবে প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, সত্যিই তবে এরা ওয়্যার উলফ! সত্যিই এরা আছে!

অনীশ যেন নিজের চোখ কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু সে ব্যাপারটা অবিশ্বাসও করে কীভাবে। চীনাদের শবগুলো তো এ খাঁচাতেই রাখা হয়েছিল। তাছাড়া লোকদুটোও তো নিজের চোখে…।

হতভম্ব হয়ে খাঁচার দিকে চেয়ে রইল সবাই। নেকড়েগুলো খাঁচার গরাদগুলোর ওপর ঝাঁপাচ্ছে, সীমাহীন আক্রোশে কখনও কামড় বসাচ্ছে লোহার গরাদগুলো ভেঙে ফেলার জন্য। রক্তাক্ত হয়ে উঠছে প্রাণীগুলোর মুখ। বীভৎস এক দৃশ্য!

সম্বিত ফিরে পেয়ে এক জওয়ান হঠাৎ বলল, গুলি চালাব স্যার?

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত এদের ওপর গুলি চালিয়ে কোনও লাভ হবে না। চীনা আর্মির লোকরা তো গুলি খেয়েই মরে ছিল…।

অন্য একজন বলল, তাহলে স্যার?

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, এদের ব্যবস্থা সম্ভবত কিছু সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে। ওই দেখো…।–এই বলে তিনি আঙুল নির্দেশ করলেন পাইনবনের দিকে। সার সার মশালের আলো সেদিক থেকে এগিয়ে আসছে কাঁটাতারের দিকে। অন্ধকার নামতেই গ্রামবাসীরা ক্যাম্প জ্বালিয়ে দিতে আসছে হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য।

লেফটানেন্ট এরপর বললেন, এখন আর আমাদের এখানে থাকার দরকার নেই। বলা যায় না ভুল বোঝাবুঝি হয়ে তাদের আক্রমণ আমাদের ওপরও বর্ষিত হতে পারে। তখন আমাদেরও বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হবে। অযথা কিছু মানুষের প্রাণহানি হবে।

এ কথা বলে তিনি এগোলেন জায়গাটা ছেড়ে যাবার জন্য। বাড়ির সামনের অংশে এসে গাড়িতে উঠে বসল সবাই। কাঁটাতারের বাইরে এসে পবন আর্মি গাড়ি থেকে নেমে উঠে বসল নিজের গাড়িতে। গ্রামবাসীরা তখন পৌঁছে গেছে কাঁটাতারের গায়ে। খুঁটি উপড়ে ফেলল তারা। তারপর চিৎকার করতে করতে ছুটল বাড়িটার দিকে। গাড়ি দুটোও সে সময় একইসঙ্গে রওনা হল সেনা ছাউনির দিকে। শেষবারের মতো নেকড়ে খামারটার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস যেন চোখে পড়ল অনীশের। মশাল হাতে বাড়িটার দিকে ধাবমান জনতার প্রথম লোকটাকে যেন ভাইমারের মতো লাগল! কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

গাড়ি দুটো সেনা ছাউনির দিকে যেতে যেতেই নেকড়ে খামারের দিকে আকাশটা লাল হতে লাগল। সেদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল জনতার আক্রোশধ্বনি আর নেকড়েগুলোর আর্তনাদ। বাড়িটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনা ছাউনিতে পৌঁছে গেল অনীশরা। এটাও কাঁটাতার ঘেরা। অনেক লোকজন সেখানে। অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে সামরিক বাহিনীর লোকজন। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া জায়গাটা। দুটো গাড়ি প্রবেশ করল সেখানে। অনীশ আর পবনের জন্য দুটো আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হল। লেফটানেন্ট ছেত্রীর তত্ত্বাবধানে রাতের খাওয়া সাঙ্গ হবার পর অনীশকে তার ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন লেফটানেন্ট। বিদায় নেবার আগে তিনি বললেন, আমরা আজ যা দেখলাম, যা শুনলাম তা শুধু আমাদের অভিজ্ঞতা থাকাই বাঞ্ছনীয়। বাইরের কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না। আমাদের পাগল ভাববে। আমার চাকরি যাবে আর আপনার ওয়াইল্ড লাইফের পদও।

অনীশ হেসে বলল, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমি ওয়াইল্ড লাইফকে রিপোর্ট করব যে ক্যাম্পের নেকড়েগুলো বাইরে বেরিয়ে গ্রামবাসীকে মেরেছিল। তাই তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে ক্যাম্পটা। নেকড়েগুলোও মারা পরেছে তাতে। কিন্তু ভাইমার এবং আর একটা নেকড়ে?

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত তাদের খুঁজে বার করব আমি। নেকড়েটাকে পুড়িয়ে মারব আর ভাইমারকে গ্রেপ্তার করব। আমিও আপনার মতো একই রিপোর্ট দেব সরকারের ঘরে।

অনীশ এবার শেষ প্রশ্নটা করল, আমি তাহলে কাল রওনা হতে পারি তো?

লেফটানেন্ট ছেত্রী বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনাকে আর আটকে রাখব না। যা তুষারপাত শুরু হয়েছে তাতে হয়তো পরশুই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি আর ফিরতে পারবেন না। কাল ভোরের আলো ফুটলেই রওনা হয়ে যাবেন আপনি।

এ কথা বলার পর ছেত্রী সাহেব একটু যেন ইতস্তত করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা শেষ প্রশ্ন করি–গত দু-দিন কি অন্ধকার নামার পর সত্যিই ক্যাম্পের বাইরে বেরোননি আপনি?

অনীশ জবাব দিল, না, বেরোইনি।

ছেত্রী বললেন, তাহলে হয়তো ভুল দেখেছিল আমার লোকরা। রাতের ব্যাপার তো, এমন ভুল হয়। যান এবার নিশ্চিন্তে ঘুম দিন। আশা করি ভাইমার সাহেবের নেকড়েরা এখানে আপনাকে আর বিরক্ত করবে না। শুভরাত্রি। এই বলে অনীশের থেকে বিদায় নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানাতে শুতেই ক্লান্ত-অবসন্ন অনীশের চোখে ঘুম নেমে এল।

৮. সূর্যদেব সবে উদয় হচ্ছেন

ভোর। অনীশ যখন তার ঘরের দরজা খুলল তখন সূর্যদেব সবে উদয় হচ্ছেন বরফ পাহাড়ের মাথায়। তবে ঝিরিঝিরি তুষারপাত হচ্ছে। হয়তো বা সারা রাত ধরেই এমন তুষারপাত হয়েছে। সেনা ছাউনির ঢালু ছাদগুলো ঢাকা পড়ে আছে সাদা তুষারের তলায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল অনীশ। পবন হাজির হয়ে গেছে তার দরজার বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন লেফটানেন্ট ছেত্রীও।

দুজনে সুপ্রভাত বিনিময়ের পর লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, আপনি বেরোবার পর আমিও বেরোব ভাইমার আর তার নেকড়েটার খোঁজে। সেনারা তৈরি হচ্ছে। সমস্ত রাস্তা ইতিমধ্যে সিল করে দেওয়া হয়েছে। আপনি ছাড়া কেউ এখান থেকে বেরোতে পারবে না। যেভাবেই হোক শেষ ওয়্যার উলফটার হদিশ পেতে হবে ভাইমারের কাছ থেকে।

অনীশ বলল, ক্যাম্পটার শেষ অবস্থা কী?

লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। সারা রাত সেখানে তাণ্ডব চালিয়ে নিজেদের আক্রোশ মিটিয়ে ভোরবেলা গ্রামে ফিরে গেছে লোকগুলো। চারটে নেকড়েকেই পুড়িয়ে মারা হয়েছে। শুনলাম নাকি গায়ে আগুন লাগার পর নেকড়েগুলো আবার চীনা সৈনিকদের রূপ ধারণ করেছিল। ভকে ভকে রক্তবমি করছিল তারা। একজনের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। একটা কাটা আঙুল। সে আঙুলে একটা আংটি ছিল। যা দেখে গ্রামের লোকরা সেটা সেই নিহত ছেলের আঙুল বলে সনাক্ত করেছে। এই সুন্দর ভোরে, এসব কথা আর বেশি শুনতে ইচ্ছা করল না। অনীশ তার স্মৃতি থেকে যথাসম্ভব দ্রুত মুছে ফেলতে চায় এই অবিশ্বাস্য ভয়ংকর ঘটনাগুলোকে।

সে বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। হয়তো আপনার জন্যই ফেরা হচ্ছে আমার। তবে ভাইমার আর তার ওয়্যার উলফের সন্ধান পেলে আমাকে জানাবেন। সেই নেকড়েটা আমি দেখেছিলাম। ধবধবে সাদা রং, আকারে অন্য নেকড়েগুলোর প্রায় দ্বিগুণ। এবার তাহলে আমি চলি।

লেফটানেন্ট ছেত্রী তার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, হ্যাঁ, আসুন। আমাকেও বেরোতে হবে।

কিছুটা এগিয়ে অনীশ পবনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। সেনা ছাউনি ছেড়ে ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল অনীশ। সেই নেকড়ে ক্যাম্পের পাশ দিয়ে ফেরার পথে ক্যাম্পের সামনে গাড়ির গতি মৃদু কমিয়ে সেদিকে তাকাল পবন। অনীশও শেষ বারের মতো সেদিকে তাকাল। চারপাশের কাঁটাতারের বেড়াগুলোকে সব উপড়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িটার বদলে বিশাল জায়গা জুড়ে ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে শুধু দু-একটা অগ্নিদগ্ধ খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। তখনও কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে।

অনীশ স্বগতোক্তির স্বরে বলল, সবই ঠিক হল। একটাই শুধু ভয়, এখানে তো আরও নেকড়ে আছে, ভবিষ্যতে তাদের সবাইকেই না ওয়্যার উলঙ্ক ভেবে পুড়িয়ে মারে গ্রামবাসীরা।

তার কথা কানে যেতে বিষণ্ণ হেসে আবার গাড়ি গতি বাড়াল পবন।

পিছনে পড়ে রইল নেকড়ে খামার। একসময় রাস্তার পাশের সেই পাইনবনও হারিয়ে গেল। সে রাস্তা ছেড়ে পাসে প্রবেশ করল অনীশের গাড়ি। পাসের ভিতর অনেক বেশি তুষারপাত হচ্ছে। পথ, দু-পাশের প্রাচীর সবই তুষারে আচ্ছাদিত। শনশন শব্দে বাতাসও বইছে। শক্ত হাতে হুইল ধরে তুষার ভেঙে পাকদণ্ডী বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল পবন। অনীশ আর পবন দু জনেই নিশ্চুপ। হয়তো তারা দুজনেই ভাবছিল তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে একটার পর একটা বাঁক অতিক্রম করে নীচের দিকে নামতে লাগল গাড়ি। এ রাস্তাতেও আর আগের দিনের মতো দু-একজন লোকও চোখে পড়ছে না। নাগাড়ে কদিন ধরে তুষারপাতের ফলে লোকজনের চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই দেখে অনীশ একসময় মন্তব্য করল, রাস্তার যা অবস্থা তাতে ওপরে আর একদিন থাকলে আর ফেরা হত না।

তার কথা শুনে ঘাড় নাড়ল পবন।

সামনেই একটা বাঁক। তার একপাশে বরফ মোড়া পাহাড়, অন্য পাশে খাদের ভিতর থেকে উঠে এসেছে গভীর পাইনবন। তাদের মাথাগুলো সব তুষারের চাদরে মোড়া। সেই বাঁকের মুখে পৌঁছে হঠাৎই যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল গাড়িটা। পবন চাবি ঘুরিয়ে বার কয়েক গাড়িটাকে চালাবার চেষ্টা করল ঠিকই কিন্তু তাতে গোঁ গোঁ শব্দ হল কিন্তু গাড়ি স্টার্ট হল না। গাড়ি থেকে নেমে পবন প্রথমে গাড়ির সামনের বনেটটা খুলল। ইঞ্জিনটা দেখতে লাগল সে।

গাড়ির ভিতরে বসে অনীশ জানতে চাইল, কী হয়েছে? পবন জবাব দিল, ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার। একবার গাড়ির নীচে ঢুকে দেখি। নইলে মেকানিক ডাকতে হবে ফোন করে। এই বলে পবন গাড়ির বনেট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে গাড়ির তলায় ঢুকে গেল। গাড়ির তলায় খুটখাট শব্দ শুরু হল। অনীশ তাকিয়ে রইল রাস্তার পাশের পাইনবনের দিকে। খাদের ভিতর যে জায়গা থেকে গাছগুলো ওপরে উঠে এসেছে সে জায়গাটাতে কী অন্ধকার। সূর্যের আলো প্রবেশ করে না সেখানে। হয়তো বা ওরকম জায়গাই নেকড়েদেরও প্রিয়। সেদিকে তাকিয়ে এ সব নানা কথা ভাবতে লাগল অনীশ। সময় এগিয়ে চলল।

একটা সময় সে জায়গায় বেশ তুষারপাত শুরু হল। ঠিক সে সময় অনীশের খেয়াল হল গাড়ির তলা থেকে আর যেন কোনও শব্দ কানে আসছে না। ইতিমধ্যে মিনিট পনেরো সময় কেটে গেছে। অনীশ হাঁক দিল–পবন? পবন? কিন্তু পবনের কোনও সাড়া মিলল না। পবন কি তবে অনীশকে গাড়িতে একলা রেখে মেকানিকের খোঁজে গেল? কিন্তু এ রাস্তায় সে। মেকানিক পাবে কোথায়?

ব্যাপারটা বোঝার জন্য গাড়ি থেকে অনীশ লাফিয়ে নীচে নামল। গাড়ির বাইরে ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবল তুষারপাত শুরু হল। তার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র কনকনে বাতাস। কিছুটা তফাতেই সব কিছু যেন তুষার ঝড়ে অদৃশ্য লাগছে। পিছনের পথটাতে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল অনীশ। তারপর শেষ একবার গাড়ির নীচের দিকে তাকিয়ে বলল, পবন তুমি কি গাড়ির তলাতেই আছ?

অনীশের কথার প্রত্যুত্তরে প্রথমে একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ হল গাড়ির তলা থেকে। তারপর পবনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, হ্যাঁ, আমি এখানে। বেরোচ্ছি…।

গাড়ির সামনে থেকে অনীশ কয়েক হাত তফাতে সরে এল পবনকে বাইরে আসার সুবিধা করে দেবার জন্য। কিন্তু গাড়ির তলা থেকে তুষার ঝড়ের মধ্যে গুঁড়ি মেরে যে ধীরে ধীরে বাইরে বেরোতে শুরু করল তাকে দেখে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল অনীশের হৃৎপিণ্ড।

বিশাল একটা ধবধবে সাদা নেকড়ে বেরিয়ে আসছে গাড়ির তলা থেকে। জ্বলন্ত চোখ, চোয়ালে সার সার হিংস্র দাঁতের পাটির আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল জিভ, সাদা ফেনা ঝরছে তার থেকে। মুহূতাঁর মধ্যে তাকে চিনে ফেলল অনীশ। ভাইমারের সেই পালের গোদা ওয়্যার উলটা। যে হানা দিয়েছিল অনীশের ঘরে।

গাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে একবার হাঁ করল প্রাণীটা। ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো দেখিয়ে সে যেন হেসে অনীশকে বলল, এবার কোথায় পালাবে তুমি? সত্যিই অনীশের পালাবার পথ বন্ধ। রাস্তার একপাশে খাড়া পাথুরে দেওয়াল, অন্যপাশে পাইনবনের অন্ধকার খাদ। তার পিছনের রাস্তাটা তুষারঝড়ে অদৃশ্য আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেকড়েটা!

অনীশ তবুও কিছুটা ছুটে পাথরের দেওয়ালের একটা খাঁজে আত্মরক্ষার জন্য পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কীভাবে আত্মরক্ষা করবে অনীশ? তার কাছে একটা লাঠিও নেই। নেকড়েটা এবার এগোতে লাগল তার দিকে। ধীরে সুস্থে একটু যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে সে। শিকার ধরার কোনও তাড়া নেই তার। কারণ সে বুঝতে পেরেছে শিকারের পালাবার সব পথ বন্ধ। তার ধবধবে সাদা দেহ তুষারের সঙ্গে মাঝে মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তুষার ঝড়ের মধ্যে শুধু দেখা যাচ্ছে তার জ্বলন্ত চোখ দুটো আর টকটকে লাল জিভটা। জিভ চাটছে বীভৎস প্রাণীটা। জ্বলন্ত চোখ দুটো ক্রমশ এগিয়ে আসছে অনীশের দিকে।

হঠাৎ অনীশ তার পায়ের সামনেই বরফের মধ্যে পড়ে থাকা একটা পাথরখণ্ড দেখতে পেল। বাঁচার জন্য একটা শেষ চেষ্টা করল অনীশ। সে পাথরটা তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। পাথরটা আছড়ে পড়ল নেকড়েটার পিঠের ওপর। একটা রক্ত জল করা গর্জন করে প্রাণীটা প্রথমে লাফিয়ে উঠল। তার নখের আঘাতে ছিটকে উঠল বরফের ধুলো। আর এরপরই সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্রুত এগোতে লাগল অনীশের দিকে।

অনীশের হাত দশেক দূরে এসে থামল প্রাণীটা। কী হিংস্র তার চোখের দৃষ্টি। আদিম জিঘাংসার প্রতিমূর্তি যেন এই প্রাণীটা। পৃথিবীর সব বীভৎসতা, সব অশুভ শক্তি যেন সঞ্চারিত হয়েছে তার মধ্যে।

ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে উঠতে লাগল সেই ভয়ংকর, অশুভ জীবটার ঘাড় ও পিঠের রোমগুলো। থাবার থেকে উঁকি দিল ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ নখর। সে এবার ঝাঁপ দেবে শিকারকে লক্ষ্য করে। অসহায় অনীশ হাত দিয়ে তার গলাটা আড়াল করল যাতে সে প্রথমেই গলায় কামড় বসাতে না পারে। ধনুকের ছিলার মতো ওপর দিকে বেঁকে গেল জন্তুটার পিঠ। লাফ দেবার ঠিক আগের মুহূর্ত! ঠিক এই সময় প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। লাফ দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে কীসের যেন প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়ল হিংস্র প্রাণীটা। রক্তজল করা একটা বীভৎস আর্তনাদ ছিন্নভিন্ন করে দিল চারপাশের নিস্তব্ধতাকে। আর এর পরক্ষণেই অনীশের মাথার ওপর পাথরের দেওয়ালের ওপর থেকে ঝুপঝুপ করে লাফিয়ে নীচে নামল বেশ কয়েকজন সামরিক পোশাক পরা লোক। তার মধ্যে লেফটানেন্ট ছেত্রীও আছেন। এরপর একযোগে বেশ কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি একনাগাড়ে বর্ষিত হতে লাগল নেকড়েটার ওপর। গুলির আঘাতে উড়তে লাগল তার লোম, ছিটকে উঠতে লাগল তার রক্ত। বেশ কিছুক্ষণ গুলি বর্ষণের পর থামল সেনারা। ক্ষতবিক্ষত নেকড়ের দেহটার দিকে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে তাকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল সেনারা।

অনীশ এবার দেওয়াল ছেড়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল লেফটানেন্টের পাশে। তিনি অনীশের কাঁধে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করে বললেন, আর এখন ভয় নেই আপনার। আপনি সত্যি বেঁচে গেলেন এ যাত্রায়।

প্রত্যুত্তরে অনীশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় হঠাই নড়ে উঠল নেকড়ের মৃতদেহটা। একজন সেনা আবার গুলি চালাতে যাচ্ছিল কিন্তু ছেত্রীসাহেব ইশারায় থামতে বললেন। তাকে। এরপর দেহটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত-অবিশ্বাস্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল উপস্থিত সবাই। মাথার ওপর থেকে তুষার ঝরে পড়ছে দেহটার ওপর। নেকড়ের দেহটা প্রথমে দুমড়াতে-মুচড়াতে আরম্ভ করল, গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল মৃত নেকড়েটার মুখ থেকে। তারপর সবার চোখের সামনেই নেকড়ের দেহটা বদলে গেল একটা মানুষের মৃতদেহে। দীর্ঘকায় এক চীনার মৃতদেহ!

তার মুখটা যেন কেমন চেনা চেনা মনে হল অনীশের। লেফটানেন্টের কথায় তার ভাবনার উত্তর পেয়ে গেল অনীশ। তিনি বললেন, এ লোকটার ছবি আমি আপনাকে আমার ফাইল থেকে দেখিয়েছিলাম। পাঁচটা লোকের ছবি ছিল ফাইলে যাদের গুলি করে মারে আমাদের বাহিনী। এদের দলপতি ছিল এ লোকটাই। চীনা সৈন্যদের মধ্যে সাধারণত এমন লম্বা চওড়া লোক দেখা যায় না। আমাদের সেনা ছাউনিতে নাশকতা চালাবার জন্য এরই নেতৃত্বে আরও চারজন এদেশে ঢুকেছিল সীমান্ত পেরিয়ে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ওদের দলের শেষ লোকটাকে, শেষ নেকড়েটাকে খুঁজে পেলাম আমরা। তবে এ দেহটাকেও এখন পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হবে। নইলে অন্ধকার নামলেই বেঁচে উঠবে দেহটা।

অনীশ বলল, কিন্তু ভাইমার? আসল যে লোকটা এই ওয়ার উলফগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল তার কী খবর। ধরতে পেরেছেন ভাইমারকে?

লেফটানেন্ট প্রথমে হাসলেন। তারপর ফিরে তাকালেন পিছন দিকে। কখন যেন সেখানে নিঃশব্দে হাজির হয়েছে একটা সামরিক জিপ। তার থেকে নেমে তুষারঝড়ের মধ্যে এগিয়ে আসছে। একজন। লোকটা কাছাকাছি আসতেই তাকে দেখে আবারও অনীশের হৃৎপিণ্ড যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। এগিয়ে আসছেন স্বয়ং ভাইমার। তার হাতে ধরা একটা কাঠগোলাপের বোকে!

খুঁড়িয়ে নয়, বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটা এসে দাঁড়াল অনীশের সামনে। তারপর মৃদু হেসে অনীশের উদ্দেশ্যে বলল, হ্যাঁ, আমিই ভাইমার। যে নেকড়ে খামারটা ছিল সেটা আমারই ছিল।

অনীশের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। তাই দেখে লোকটা বলল, আমি খোঁড়াও নই আর এই কাঠগোলাপের গন্ধ আমার বেশ ভালোই লাগে। ওয়্যার উরা ভয় পায় এই বুনো কাঠগোলাপকে। আপনি ওয়্যার উলফ কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যই প্রতি সকালে গ্রামবাসীরা এই কাঠগোলাপের স্তবক দিত আপনার হাতে। আমিই বনের ভিতর থেকে ফুল সংগ্রহ করে দিতাম নরবুকে। আপনার সঙ্গে আমার একদিন সত্যিই সাক্ষাৎ হয়েছিল পাইনবনের ভিতর। এটা আমার উপহার।–এই বলে তিনি ফুলটা ধরিয়ে দিলেন অনীশের হাতে।

অনীশের মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে অস্পষ্টভাবে বলল, আপনার সঙ্গে যদি আমার মাত্র একবার দেখা হয়ে থাকে তবে কোন ভাইমারের সঙ্গে তিনটে রাত নেকড়ে খামারে কাটালাম?

ভাইমার মাটিতে পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই লোকটার সঙ্গে। ওয়্যার উলরা আমার আপনার সবার দেহ ধারণ করতে পারে। ও করেও ছিল তা।

অনীশ বলল, আমার মাথার ভিতর সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! আপনারা কীভাবে এখানে উপস্থিত হলেন?

লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, চলুন আপনাকে পৌঁছে দেবার পথে সব কথা বুঝিয়ে দেব। ভয় নেই, আমরা কেউ ওয়্যার উলফ নই। আপনার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি সত্যি ভাইমার।

অনীশ এবার চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু আমার ড্রাইভার পবন কোথায় গেল?

লেফটানেন্ট সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, সে আর কোনওদিন ফিরবে না।

তারপর তিনি বললেন, মালপত্র নিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠুন। যা তুষারপাত শুরু হয়েছে তাতে দেরি হলে আপনাকে গ্যাংটক শহরে পৌঁছে দিয়ে আমরা আর ওপরে ফিরতে পারব না।

সৈনিকদের কয়েকজন চীনা সৈনিকের সেই দেহটাকে পোড়াবার প্রস্তুতি শুরু করল। তাদের সেখানে ছেড়ে রেখে লেফটানেন্ট অনীশ, ভাইমার আর দু-জন সেনাকে নিয়ে আর্মি গাড়িটাতে উঠে বসলেন। পাকদণ্ডী বেয়ে নামতে শুরু করল গাড়ি।

৯. রেশমপথ বেয়ে

রেশমপথ বেয়ে নীচে নামতে লাগল গাড়িটা। প্রথমে লেফটানেন্ট ছেত্রী আর ভাইমার চুপচাপ রইলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিহ্বল, উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অনীশ। হয়তো বা তাকে ধাতস্থ হবার জন্য কিছুটা সময় দিলেন তারা। তারপর প্রথমে অনীশের উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন ভাইমার। তিনি বললেন, ঘটনাটা তবে খুলেই বলি আপনাকে। আমার কথার কোনও অংশ। বুঝতে না পারলে প্রশ্ন করবেন।

অনীশ বলল, আচ্ছা।

একটু চুপ করে থেকে ভাইমার বলতে শুরু করলেন, আপনি যেমন বন্যপ্রাণ প্রেমী মানুষ আমিও ঠিক তেমনই মানুষ। আমার বাড়ি জার্মানীর বারীয় পর্বতাঞ্চলের যে অংশে সেখানে প্রচুর তুষার নেকড়ে পাওয়া যায়। তাই ছোটবেলা থেকেই ওদের সঙ্গে আমি পরিচিত, ভালোবাসি এই প্রাণীগুলোকে। খোঁজ নিলে দেখবেন ওদেশের নেকড়ে সংরক্ষণ আন্দোলনের সঙ্গেও আমি যুক্ত ছিলাম। সব দেশেই অত্যাচার চালানো হয় ওদের ওপর। কখনও বা তা চামড়ার জন্য, কখনও বা ওয়্যার উলফ ভেবে মারা হয় ওদের। যাই হোক এদেশে আমি প্রথম টিবেটিয়ান উলফের খোঁজে আসিনি। এসেছিলাম পায়ে হেঁটে সিল্করুট অতিক্রম করার জন্য। ট্রেকিং আমার অন্যতম নেশা। যাই হোক ট্রেকিং করতে করতে একদিন পাসের মধ্যে পেয়ে গেলাম একটা নেকড়েকে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল ওটা। জানলাম দু-দেশের সীমান্তে সৈনিকদের গুলিতে প্রায়শই এই ঘটনা ঘটে। রাতের অন্ধকারে নেকড়েগুলোকে ঠিক চিনতে না পেরে অপর পক্ষের সেনা আত্মগোপন করে আছে ভেবে গুলি চালায় সেনারা। তখন আমি আশ্রয় নিয়েছি যেখানে উলফ রিহ্যাবিলেটেশন ক্যাম্প করেছিলাম সেখানেই। বাড়িটা তখন পরিত্যক্ত ছিল। ট্রেকার্সরা মাঝে মাঝে রাত কাটাত সেখানে। যাই হোক সে বাড়িটাতে আমি তুলে আনলাম আহত নেকড়েটাকে। তার শুশ্রূষা করে তাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলতে লাগলাম।

নেকড়েদের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই আমার মমত্ব। তাই আমি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম পাস ধরে তিব্বত না গিয়ে আমি কাজ করব এই অসহায় প্রাণীগুলোর জন্য। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানালাম এ ব্যাপারে। তারাও স্বাগত জানাল ব্যাপারটাকে। আর্মিও ছাড়পত্র দিল ক্যাম্প খোলার জন্য। বাড়িটা মেরামত করে টিবেটিয়ান উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্প খুলে বসলাম আমি। স্থানীয় গ্রামবাসীরা তার নাম দিল নেকড়ে খামার। তাদের সঙ্গেও বেশ সুসম্পর্ক ছিল আমার। তারা আমার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছিল ঠিকই, কিন্তু নেকড়ে সম্পর্কে প্রচলিত ভয়ার্ত ধারণার জন্য তারা কেউ খামারে কাজ করতে চাইল না। তার ফলে সীমান্তর ওপার থেকে চারজন তিব্বতী শরণার্থীকে আমি খামারের কাজে নিয়োগ করলাম। তাদের সবাই সৎ, নিরীহ প্রকৃতির লোক ছিল। তবে গ্রামপ্রধান নরবুর থেকে খামার বা ক্যাম্পের রসদ সংগ্রহ করা হত। ভালোই চলছিল সবকিছু, একে একে আরও তিনটে, অর্থাৎ মোট চারটে নেকড়ে সংগ্রহ করলাম আমি…

এতক্ষণ ভাইমার সাহেব যা বললেন তার অনেকখানিই ফাইলে পড়েছে অনীশ। তবুও সে শুনে গেল তার কথাগুলো।

একটু থেমে ভাইমার সাহেব এরপর বললেন, কিন্তু এ সব ঘটনার সূত্রপাত মাস ছয় সাত আগে। ঠিক সেদিনের আগের রাতে আমি গুলির লড়াইয়ের শব্দ শুনেছিলাম আমার ক্যাম্পে বসে।

ভাইমারের কথার মাঝেই লেফটানেন্ট ছেত্রী এবার বললেন, হ্যাঁ, ওই রাতেই আমরা গুলি চালাই চীনা সেনাদের ওই পাঁচজন অনুপ্রবেশকারীকে লক্ষ্য করে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম সবাই নিহত হয়েছে। কিন্তু পরদিন অনেক অনুসন্ধান করেও তাদের কারো মৃতদেহ আমরা খুঁজে পাইনি।

ভাইমার সাহেব এরপর বললেন, যাই হোক সেদিন সারারাত গুলি যুদ্ধর পর, পরদিন সকালে পাইনবনের মধ্যে খুঁজে পেলাম একটা অর্ধমৃত নেকড়েকে। মর্টারের শেলের আঘাতে একটা পা ভেঙে গেছে তার। তবে অতবড় নেকড়ে আমি আগে কোনওদিন দেখিনি।

দানবাকৃতির নেকড়ে! ধবধবে সাদা গায়ের রং। ঠিক যেমন নেকড়েটাকে দেখেছিলেন আপনি। নেকড়েটাকে তুলে আমি ক্যাম্পে নিয়ে এসে কিছুদিনের মধ্যেই তাকে সুস্থ করে তুললাম। তবে তার পা-টা সম্পূর্ণ ঠিক হল না। সুস্থ হলেও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটত সে। তখন আমি বুঝতে পারিনি সে আসলে কে? তাকে ক্যাম্পে আনাই আমার কাল হয়েছিল। এর কয়েকদিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে ক্যাম্পে অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটতে লাগল। ধরুন আমার চারজন কর্মচারীদের কেউ বাইরে কাজে বেরিয়েছিল কিন্তু তারা সে রাতে আর কেউ ফিরল না।

পরদিন তারা যখন ফিরল তখন তারা কেমন যেন অচেনা মানুষ। হাজার জিগ্যেস করলেও তারা বলত না যে সারা রাত তারা কোথায় কাটিয়েছে। আর যেদিন তারা রাতে উধাও হত তার পরদিন ভোরেই জঙ্গলের মধ্যে খোঁজ মিলত এক একটা মৃতদেহর। সাধারণত নেকড়েরা কোনও কারণে মানুষ মারলেও তার মাথা খায় না। কিন্তু এই বিবস্ত্র দেহগুলোর মাথা থাকত না। তাই তাদের সনাক্তও করা যেত না। পরে বুঝেছিলাম যে সেগুলো আসলে ছিল আমার কর্মীদেরই দেহ। তাদের খেয়ে ফেলে পরদিন তাদের অবয়ব ধারণ করে ফিরে আসত এক একজন মৃত চীনা সেনা বা ওয়্যার উলফ। একে একে আমার চারজন কর্মীকেই মেরে তাদের জায়গা দখল করল তারা। তারপর একদিন আমার চারটে নেকড়েকেও কীভাবে যেন মেরে খাঁচার ভিতর ঢুকে তাদের জায়গায় নেকড়ে রূপ ধারণ করল তারা চারজন। আর তাদের দলপতি তো নেকড়েরূপে আগেই ছিল খাঁচার মধ্যে।

একদিন সকালে উঠে আমি আর আমার কোনও লোককেই খুঁজে পেলাম না। লোকগুলো গেল কোথায়? সেদিন সন্ধ্যায় আমি খাঁচার কাছাকাছি গিয়ে শুনলাম এক অদ্ভুত কথোপকথন। খাঁচার ভিতর থেকে একজন যেন বলছে সাহেবটাকে শেষ করে দিতে পারলেই আমরা দখল নিতে পারব বাড়িটার।

তার কথা শুনে আর একজন লোক যেন বলল, হ্যাঁ, দু-এক দিনের মধ্যেই কাজটা শেষ করব।

কথাবার্তাটা কানে যেতেই আমি চমকে উঠে খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোনও খাঁচায় কোনও লোক নেই। খাঁচার ভিতর থেকে নেকড়েগুলো যেন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে এ দৃষ্টি আমি কোনওদিন দেখিনি। সেদিনই আমার প্রথম সন্দেহ হয় ওয়্যার উফের ব্যাপারে। আমি ঘটনাটা বলার জন্য টেলিফোন করেছিলাম ছেত্রী সাহেবকে। কিন্তু উনি আমার কথা শুনে হাসলেন, আমিও ফোন রেখে দিলাম…।

লেফটানেন্ট ছেত্রী এ কথা শুনে বললেন, তখন এ কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না। আর আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আপনার নেকড়ের মৃতদেহ আমরা দু-দিন আগে বরফের তলা থেকে সংগ্রহ করেছি চীনা সৈনিকদের মৃতদেহ খুঁজতে গিয়ে।

ভাইমার আবার শুরু করলেন তার কথা–পরদিন রাতেই কীভাবে যেন বেরিয়ে পড়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করল আমার ওপর। বরাতজোরে আমি ক্যাম্প থেকে কোনওরকমে আত্মগোপন করলাম পাইনবনে। সেখানে বনের ভিতর এক জায়গাতে কাঠগোলাপের অনেক গাছ আছে সেখানেই। কারণ বনের ওই একটা অংশকেই এড়িয়ে চলে ওয়্যার উলফরা। কোথায় যাব আমি? কাকে বলব আমার কথা? কেউ বিশ্বাস করত না আমার কথা। তবে একজন বিশ্বাস করল আমার কথা। সে হল নরবু। তার দয়াতেই বাঁচলাম আমি। দুজনে মিলে আলোচনা করে ঠিক করলাম সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। তবে সে সুযোগ যে নরবুর নাতির প্রাণের বিনিময়ে আসবে তা জানা ছিল না আমাদের। অবশ্য একইভাবে এটাও সত্যি যে সেদিন রাতে খিদের জ্বালাতে নেকড়েগুলো যদি ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে ছেলেটাকে না মারত তবে হয়তো ঘটনাটার শেষ হত না। কতদিন আমি পাইনবনের ভিতর থেকে দেখেছি ক্যাম্পের ভিতর আমারই ভেক ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই বিশাল ওয়্যার উলটা। কিন্তু তাকে সে সময় চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না আমার।

লেফটানেন্ট ছেত্রী এরপর বললেন, পালের গোদা শয়তান নেকড়েটা দু-রাত আপনার রূপ ধরেও বেরিয়েছিল। ইচ্ছা করেই সে আমার সেনাদের বলেছিল যে আপনি নাকি এ জায়গায়। থেকে যেতে চান। কারণ, সে ভেবেছিল যে আসল ভাইমারকে সে যদি শেষ করতে না পারে, ভাইমার যদি আত্মপ্রকাশ করেন তবে আপনার রূপ ধরেই জায়গাটাতে থেকে যাবে সে। আমরা ঠিক সময় উপস্থিত না হলে তার ইচ্ছা হয়তো বাস্তব হত।

অনীশ এবার প্রশ্ন করল, কিন্তু আমার খোঁজ আপনারা পেলেন কীভাবে?

ভাইমার বললেন, গতকাল রাতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে ক্যাম্পটা জ্বালাতে গেছিলাম আমিও…।

অনীশ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি মুহূতাঁর জন্য একবার গ্রামবাসীদের মধ্যে আপনাকে দেখেছিলাম। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। আমার দৃষ্টি বিভ্রম ভেবে আমি কথাটা বলিনি ছেত্রী সাহেবকে।

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা আপনার কাছে অবশ্যই অবিশ্বাস্য ছিল। ক্যাম্পে ঢুকে প্রথমে চারটে ওয়্যার উলকে পুড়িয়ে মারলাম আমরা। তারপর পুরো বাড়িটাতে আগুন লাগাবার আগে আমরা তল্লাশি শুরু করলাম পালের গোদা নেকড়েটার খোঁজে। একটা ঘরে তার দরজার একটা পাল্লার নীচের অংশ ভাঙা ছিল। নেকড়ের নখের অজস্র চিহ্ন ছিল দরজার গায়ে। সে ঘরের খাটের নীচে উঁকি দিতে দেখেই একটা লাশ। সেই দেহটা বার করতেই আমি চিনতে পারলাম তাকে। আপনার ড্রাইভার পবন। নরবুও চিনতে পারল তাকে। পবন নামের ওই লোকটাকে আমি আপনাকে গ্রাম থেকে পাইনবন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দেখেছি। তার গলার নলি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিল নেকড়ের দাঁতে।

অনীশ বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ওটাই আমার ঘর ছিল। তবে পবনকে খুন করে তার রূপ ধারণ করে খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ওয়্যার উলফটা? লেফটানেন্ট ছেত্রী মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলেন অনীশের কথায়।

ভাইমার এবার বললেন, ক্যাম্পটাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে প্রায় রাত হয়ে গেল। গ্রামে ফিরে এসে নরবুর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ব্যাপারটা খুলে বলা প্রয়োজন লেফটানেন্টের কাছে। নইলে হয়তো আমাকেই ওয়্যার উলফ ভেবে বা তাদের আশ্রয়দাতা ভেবে গুলি চালিয়ে মারবে সেনারা। একটা কাঠগোলাপের বোকে আর নরবুকে সঙ্গে নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সেনা ছাউনিতে। লেফটানেন্ট তখন আমারই সন্ধানে অর্থাৎ সেই ওয়্যার উলফ ভাইমারের সন্ধানে বেরোতে যাচ্ছিলেন। আমি আর নরবু তাকে খুলে বললাম সব কথা। ওর মুখেই শুনলাম আপনার ড্রাইভার পবন নাকি রওনা হয়েছে আপনাকে নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল সবকিছু। আপনার ড্রাইভার আসলে পবন নয়, সে আসলে পবনের রূপধারী ওয়্যার উলফ! সঙ্গে সঙ্গে আপনার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। ভাগ্যিস আমরা ঠিক সময় পৌঁছেছিলাম। আর একটু হলেই..। কথা শেষ করলেন ভাইমার।

অনীশের আর কিছু জানা বা বোঝার নেই। তাই আর কোনও প্রশ্ন করল না সে।

গাড়ি প্রথমে পৌঁছোল নাথুলা পাসের সেই ট্যুরিস্ট স্পটে। তারপর এগোল গ্যাংটক শহরের দিকে। দুপুরবেলা গ্যাংটক শহরে এক হোটেলে অনীশের আশ্রয় ঠিক করে বিদায় নিলেন। লেফটানেন্ট ছেত্রী আর ভাইমার। যাবার আগে লেফটানেন্ট আর একবার স্মরণ করিয়ে দিলেন তার কথা–আপনি যা দেখলেন, যা শুনলেন কাউকে তা বলতে যাবেন না। লোকে আপনাকে পাগল ভাববে।

অনীশ বলল, আচ্ছা। তবে চেষ্টা করবেন যাতে গ্রামবাসীরা নেকড়ে দেখলেই তাকে ওয়্যার উলফ ভেবে পুড়িয়ে না মারে।

ভাইমার আর লেফটানেন্ট ছেত্রী একসঙ্গে বলে উঠলেন, আমরা সে চেষ্টাই করব।

ভাইমার আর লেফটানেন্ট ছেত্রী চলে যাবার পর হোটেলের দোতলায় উঠে নিজের কামরাতে প্রবেশ করল অনীশ। খোলা জানলা দিয়ে দূরের পাহাড়শ্রেণি দেখা যাচ্ছে। ওদিকেই তো নাথুলা পাস। ওদিক থেকেই নেমে এসেছে সে। গ্যাংটক শহরে তুষারপাত না হলেও আকাশটা কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন। হয়তো বা বৃষ্টি হবে। ঘরের ভিতর বিরাজ করছে আধো অন্ধকার।

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলতেই একটা লোক ঘরে ঢুকল। সে জানতে চাইল অনীশের কিছু প্রয়োজন আছে কিনা? হোটেলেরই কর্মচারী সে। তার চেহারা দেখে অনীশের মনে হল সে চীনা বা তিব্বতী হতে পারে। অনীশ তাকে বলল, কিছু খাবার দিয়ে যাও।

লোকটা অর্ডার নিয়ে চলে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় অনীশের হঠাৎ মনে হল, ঠিক এমনই একটা লোককে সে যেন দেখেছিল সেই নেকড়ে খামারে! এ লোকটাও ওয়্যার উলফ নয়তো?

অনীশ তাকে বলল, এক মিনিট দাঁড়াও।

দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা।

অনীশ ব্যাগ থেকে ভাইমারের উপহার দেওয়া সেই বুনো কাঠগোলাপের বোকেটা বার করে লোকটার হাতে ধরিয়ে বলল, এটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম।

লোকটা স্বাভাবিকভাবেই বোকেটা নিল। তারপর বলল, ধন্যবাদ স্যার। ওই যে নাথুলা পাসের ওদিকে পাহাড় দেখলেন ওখানেই ফোটে এই কাঠগোলাপ। এটা আমি বাড়িতে রেখে দেব। আপনি শহুরে মানুষ। হয়তো ওয়্যার উফে বিশ্বাস করেন না। সীমান্তে যারা যুদ্ধে মারা যায় তারা ওয়্যার উলফ–অপদেবতা হয়। নেকড়ে মানুষ! আমরা বিশ্বাস করি ব্যাপারটা। এই বুনো গোলাপের শুকনো ফুলও যদি বাড়িতে থাকে তবে ওই ওয়্যার উফরা বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না। অনেকদিন ধরে এ ফুল খুঁজছিলাম স্যার। এই বলে লোকটা ফুলের বোকেটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অনীশ চেয়ে রইল জানলার বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ কেটে গেল। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল বরফ ঢাকা পাহাড়ের মাথায়। অনীশের ঘরটাও ভরে উঠল আলোতে। অন্ধকার কেটে গেল। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের সূর্যালোকে উদ্ভাসিত পাহাড়শ্রেণির অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে অনীশ মনে মনে বলল, হয়তো বা পুরো ঘটনাটাই নিছকই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল!

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments

error: Content is protected !!