Wednesday, August 20, 2025
Homeবাণী ও কথাএকটি জানালা - হারুকি মুরাকামি

একটি জানালা – হারুকি মুরাকামি

প্রিয়ে…

শীতের সকাল তার শক্ত মুঠি একটুখানি শিথিল করলে সূর্যের তাপের উষ্ণতার ভেতর বসন্ত অনুভব করি। গতকালের চমৎকার চিঠির জন্য আবারও ধন্যবাদ।

হামবার্গার স্টেক এর সঙ্গে মশলা হিসেবে জায়ফল মেশানো নিয়ে তোমার লেখার অংশ উপভোগ করেছি। খুব বাস্তব সম্মত মনে হয়েছে। ছুরি দিয়ে যখন তুমি সবজি কাটছিলে তার সেই চপ-চপ’ শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। তোমার রান্নাঘরের উষ্ণতা আর গন্ধও অনুভব করতে পেরেছি।

তোমার চিঠি পড়ার পর একটা হামবার্গার স্টেক খেতে খুব ইচ্ছে করেছিল। ফলে দ্রুত একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়েছিলাম। বিশ্বাস করো আর না করো ওই রেস্তোরাঁয় আট রকমের হামবার্গার স্টেক পাওয়া যায়! একটা আছে ট্রেক্সাস রীতির। আর একটা ক্যালিফোর্নিয়ার। আর একটা আছে হাওয়াইয়ের ঘ্রাণঅলা। তারপর আছে জাপানি রীতির। ট্রেক্সাস রীতির হামবার্গারটা সাইজে বড় এই যা। হাওয়াইয়ের বার্গারটা আবার আনারসের টুকরো দিয়ে সাজানো হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার রীতিটা কেমন ছিল মনে করতে পারছি না। জাপানি স্টেক পরিবেশিত হয় মূলোর কুচো দিয়ে। রেস্তোরাঁটি আমার কাছে বেশ হাল ফ্যাশনের মনে হয়েছে। ওয়েট্রেসদের সবাই খুব সুন্দরী। তারা খাটো স্কার্ট পরে।

যদিও রেস্তোরাঁটির ভেতরকর সাজসজ্জা আর ওয়েট্রেসদের দেখতে যাইনি। ওখানে যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য আমার ছিল তা হচ্ছে ওখানকার প্রধান হামবার্গারগুলো চেখে দেখা। ওয়েট্রেসদেরকে সে কথাই বলেছিলাম। কিন্তু ওদের একজন ক্ষমা প্রকাশ করে জানাল যে, তাদের কাছে শুধু সাধারণ স্টেক আছে। ওদের দায়ি করা যায় না এ জন্য। কারণ মেনু নির্ধারণের দায়িত্ব ওদের নয়। তবে তার পরনের স্কার্টটা আবার এত খাটো নয় যে, কেউ কোনো জিনিস ফেলে দিয়ে নিচ থেকে তার প্যান্টি দেখার সুযোগ নিতে পারে। শেষতক হাওয়াই রীতির একটা হামবার্গারের অর্ডার পেশ করলাম। ওটা খাওয়ার সময় একজন ওয়েট্রেস আনারসের টুকরোগুলো ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দিল। দুনিয়া একটা আজব জায়গা বটে। সত্যিকথা বলতে কী সাধারণ একটা হামবার্গার স্টেকই চেয়েছিলাম আমি। সে থাকগে, তুমি কেমন করে হামবার্গার স্টেক বানাও তাই বল আমাকে। তোমার চিঠি পড়ে ভেবেছি, তোমার বানানো স্টেক খেতে হবে একবার।

স্বয়ংক্রিয় টিকেট মেশিন সম্পর্কে যা লিখেছ তা ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে কিছু উন্নতি ঘটেছে ওটার। দৃষ্টিভঙ্গিটা চমৎকার ছিল। তবে দৃশ্য আর অবস্থা দেখা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। হতে পারে তুমি জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছ। যা-ই বল না কেন একটা বাক্য দিয়ে তুমি গোটা পৃথিবী বদলে ফেলতে পারবে না।

লেখাটার সব দিক বিবেচনা করে তোমাকে ৭০ নম্বর দিয়েছি। আমার মনে হয় উন্নতি হচ্ছে লেখার। তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই কোনো। ধৈর্যধারণ কর। ভাল থেকো। তোমার পরের চিঠির প্রতীক্ষায় আছি। সে যা-ই হোক, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তাই না? পাঁচমিশালী কুকি পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। ওগুলো সত্যিই খুব ভাল। পত্রের বাইরে সৌহার্দ্য যেহেতু নিষিদ্ধ কাজেই ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবে প্লিজ। বিস্কিট বা কুকির প্যাকেট ট্যাকেট পাঠিও না আর। ধন্যবাদ তোমাকে।

চিঠি শেষ করবার আগে তোমার স্বামীর নার্ভাসনেসের সমস্যার ব্যাখ্যা চমৎকারভাবে দিয়েছ বলে আমার ধারণা।

আমার ২২ বছর বয়সের সময় প্রায় এক বছর ওটাই ছিল আমার কাজ। পেন। সোসাইটি’ নামে ছোট্ট একটা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম। প্রতিটি চিঠি লেখার জন্য ২০০০ ইয়েন পেতাম। শিগগিরই মাসে গোটা ৩০টি চিঠি লেখা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের কোম্পানির আদর্শবাণী ছিল- আপনিও এমন একখানা চিঠি লিখুন যা আপনার বন্ধু বা বান্ধবীর হৃদয়ের গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়। মাসিক ফি দিয়ে ক্লায়েন্টরা প্রতি মাসে অন্তত চারখানা চিঠি লিখত। আমাদেরকে ‘পেন মাস্টার’ ডাকা হতো।

মহিলা পেন মাস্টাররা পুরুষদের কাছে আর পুরুষ পেন মাস্টাররা মেয়েদের কাছে লিখত। আমার সব ক্লায়েন্টই বয়সে আমার চেয়ে বড় ছিল। প্রায় ১৫ জনের বয়স ৪০ থেকে ৫৩’র মধ্যে, তবে অধিকাংশের বয়সই ছিল ২৫ থেকে ৩৫। লেখার প্রথম মাসটা খুব খারাপ গেছে। আমার সব ক্লায়েন্ট আমার চেয়ে ভাল লিখত? কারণ তারা লেখালেখিতে অভ্যস্ত ছিল। জীবনের ওই সময়টা পর্যন্ত চিঠি লেখাকে খুব একটা সিরিয়াসভাবে নেইনি।

তারপরও আমার সুনাম বাড়তে থাকে। ক্লায়েন্টরাই বলেছে এ কথা। তবে মাস তিনেক পর আমার লিখবার ক্ষমতা নেতৃত্বদানের’ পর্যায়ে চলে যায়। এইসব মহিলাদের সাহায্য করে যে আস্থা অর্জন করি তাতে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভবের সঞ্চার হয় আমার ভেতর। তারা বিশ্বাস করে আমাকে আর আমার নির্দেশনায় আস্থা রাখে। সেই সময় ব্যাপারটা বুঝতাম না। পরে বুঝেছিলাম ওই মহিলারা ছিল নিঃসঙ্গ। তাদের কাছে কারা চিঠি লিখত এটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। আর কী তারা লিখত তাতেও কিছু আসত যেত না। হতে পারে আমাদের সবারই ওই প্রয়োজনটুকু ছিল। প্রয়োজন ছিল ক্ষমার কিংবা কারও সঙ্গে সুখ-দুঃখের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার।

ওভাবেই শীত আর বসন্ত অতিক্রান্ত হয়, একুশ পেরিয়ে বাইশে পড়ি আমি। চারদিকে তখন চিঠি আর চিঠি।

নানা ধরনের চিঠির উত্তর লিখতে হয়েছে। বিরক্তিকর সব চিঠি, খুশি আর দুঃখে ভরা চিঠির উত্তরও লিখেছি। ওখানে মাত্র এক বছর কাজ করলেও মনে হয়েছে তিন বছর কাজ করেছি। চাকুরি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিলে আমার ক্লায়েন্টরা দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে কথা কী, ওখানে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। তবে চাকুরিটা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার নিজেরই নানান উদ্বেগ- আশংকা ছিল। বুঝেছিলাম এতগুলো সৎ ও ভাল মানুষের সঙ্গে মেশার দ্বিতীয় সুযোগ আর পাব না।

হামবার্গার স্টেক এর কথা বলতে বলতে, শেষ পর্যন্ত ওই মহিলার বানানো (প্রথম চিঠি থেকে) একটা স্টেক খেয়েছিলাম। তার বয়স ৩২। কোনো ছেলেপুলে নেই। স্বামী বিশ্বের ৫ম বিখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। মাসের শেষের দিকে চাকুরি ছাড়ার কথা জানালে ওই মহিলা তার বাড়িতে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করে আমাকে। সে কথা দেয় একটা আসল হামবার্গার স্টেক বানাবে। কোম্পানির নীতির বাইরে হলেও তৎক্ষণাত তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম। ব্যাপারটা হলো কী কৌতূহল দমন করতে পারছিলাম না। ওটাচু ট্রেন লাইনের কাছে ছিল তার অ্যাপার্টমেন্টটা। ওটা ছিল বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর ছিমছাম। বাচ্চাকাচ্চা নেই এমন দম্পতিদের জন্য উপযুক্ত। ঘরের আসবাবপত্র আর ভেতরকার সাজসজ্জা সুন্দর। তার গায়ের স্যুয়েটারটা দামি না হলেও দেখতে ছিল চমৎকার। আমার প্রত্যাশার চেয়েও বয়স কম ছিল তার। আমার তারুণ্য মুগ্ধ করেছিল তাকে। আমাদের কোম্পানির পলিসিতে বয়স প্রকাশ না করবার বিধান ছিল।

অচিরেই আমরা আয়েশ করে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। মনে হলো একই ট্রেন মিস করবার পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছে আর আমরা পরবর্তী ট্রেনের প্রতীক্ষায় আছি। আমরা স্টেক আর কফি খেলাম। আবহাওয়াটাও ছিল চমৎকার। তার চারতলা অ্যাপার্টমেন্টের জানালা থেকে ট্রেন দেখা যায়। হামবার্গার স্টেকটা খেতে খুব মজা ছিল। পরিমাণ মতো মশলা দেওয়া হয়েছিল আর রসালও ছিল। মাংসের ঝোলও ঠিক মতো মেশানো হয়েছিল। কফি শেষ করে জীবনের গল্প বলেছিলাম। বলার মতো তেমন কিছুই ছিল না আমার, ফলে সে-ই বেশি কথা বলেছিল। সে আমাকে জানাল, ছাত্রী থাকাকালে সে লেখক হতে চেয়েছিল। ফ্রাসোয়া সাগার ভক্ত ছিল সে। তার লেখা ‘ডু ইউ লাইক ব্রাহ্ম’ ছিল ওর প্রিয় বই। তবে এমন নয় যে, আমি সাগার লেখা পছন্দ করি না। ভালই লেখেন। লোকেরা অবশ্য বলে তার লেখা বিরক্তিকর। তাদের সঙ্গে একমত নই আমি।

“কিন্তু কিছুই লিখতে পারি না,” বলল সে।

আমি বললাম, “সময় তো যায়নি।”

“কিন্তু তুমি-ই বলেছিলে ভাল লিখতে পারি না আমি।” হেসে বলল।

আমিও হাসি। ২২ বছর বয়সের সময় খুব হাসতাম।

“আমার মনে হয় তোমার লেখায় যথেষ্ট বাস্তবতা আছে।” সে কিছু না বললেও এক ঝলক মৃদু হাসি তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। “তোমার চিঠি পড়ে আমার মনে হয়েছে তোমার বানানো একটা হামবার্গার স্টেক খাওয়া উচিত।”

সে হেসে বলল, “সম্ভবত ক্ষুধার্ত ছিলে তুমি।”

আমারও তাই মনে হয়েছে।

তখন ঘটাং ঘটাং শব্দ করে একটা ট্রেন চলে যেতে দেখলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো ৫ টা বাজে। চলে যেতে হবে আমাকে। তার কাছে ক্ষমা চেয়ে উঠতে উদ্যত হলাম। বললাম, “তোমার স্বামী শিগগিরই এসে পড়বে, ধারণা করি ডিনার তৈরিতে বসতে হবে তোমাকে।”

“সে বরাবরই দেরিতে আসে,” বলল সে, “মধ্যরাতের আগে সে ঘরে ফেরে না।”

“খুব ব্যস্ত মানুষ নিশ্চয়ই।”

“আমারও তাই মনে হয়, একটুখানি দ্বিধা নিয়ে সে বলল,

“চিঠিতে তো লিখেছিলাম আমাদের ভেতর বনিবনার অভাব।” এ কথার কোনো জবাব আমার কাছে ছিল না।

“তাতে অসুবিধা নেই,” কোমল স্বরে সে বলল। আমারও তাই মনে হয়েছে।

“এত সব সুন্দর চিঠি লেখার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ওগুলো বেশ উপভোগ করেছি।”

বললাম, “আমিও। হামবার্গার স্টেকের জন্য ধন্যবাদ।”

.

দশ বছর পরে ওটাচু লাইন দিয়ে ট্রেনে যাওয়ার সময় তার ওই হামবার্গার স্টেকের কথা আমার মনে পড়ে যায়। তার অ্যাপার্টমেন্টের জানালাটি খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তবে বিস্ময়ের সঙ্গে ভেবেছিলাম সে কি এখনও একা, বসে বসে বার্ট বাখারাচের সঙ্গীত শুনছে?

আপনার কি মনে হয় ওই মহিলার সঙ্গে বিছানায় যাওয়া উচিত ছিল আমার?

এটাই হচ্ছে এই গল্পের আসল ব্যাপার। আমারও জানা নেই ব্যাপারটা। যতই দিন যাচ্ছে, অনেক বেশি বেশি জিনিস আমার বোঝার বাইরে চলে যাচ্ছে…।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments