Tuesday, April 30, 2024
Homeকিশোর গল্পরইস মাস্টার - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

রইস মাস্টার – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

রইস মাস্টার - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বেল শুনে টুনি দরজা খুলে দিল। একজন মানুষ হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাসিটা ভেজাল। কোনো অচেনা মানুষকে দেখলেই টুনি মনে মনে মানুষটাকে যাচাই করে তাকে একটা নম্বর দেয়। আজকেও মানুষটাকে যাচাই করল, ভেজাল হাসির জন্য তার বেশ কিছু নম্বর কাটা গেল। সিরাজউদ্দৌলার মতো সরু একটা গোঁফ আর ঢলঢলে শার্টটার জন্যও অল্প কিছু নম্বর কাটা গেল। নম্বর কেটেকুটে টুনি মনে মনে তাকে দশের মাঝে চার দিল—যার অর্থ টেনেটুনে পাস। কোনো নূতন মানুষকে দেখলে টুনি নম্বর দেওয়ার সাথে সাথে তার নাম কী হতে পারে, সেটাও আন্দাজ করার চেষ্টা করে। এখন পর্যন্ত একটাও মেলাতে পারে নাই, কিন্তু তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছে। টুনির মনে হলো আজকের এই মানুষটার নাম হতে পারে ফরিদ মিয়া। কিংবা কাজেম আলী। দেখা যাক, মেলে কি না!

মানুষটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে দাদির সাথে দেখা করতে এসেছে। এই বাসায় এই টাইপের মানুষেরা সাধারণত তাঁর সাথেই দেখা করতে আসে। তবে মানুষটার হাতে কোনো স্যুটকেস কিংবা ব্যাগ নাই। তার মানে শুধু দেখা করতে এসেছে, থাকতে আসে নাই। কপাল ভালো। হাতে পলিথিনের ব্যাগে কয়েকটা আপেল উঁকি দিচ্ছে, সেইটা অবশ্য একটু বিপজ্জনক।

মানুষটা কোনো কথা না বলে তার মুখটা ভেজাল হাসি হাসি ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই টুনি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘জি, আপনি কার কাছে এসেছেন?’

মানুষটা বলল, ‘এইটা খালাম্মার বাসা না?’

মানুষটার কথা শুনে টুনি তার আরও এক নম্বর কেটে এবারে তাকে দশে তিন করে দিল—তিন হচ্ছে ফেল মার্ক। খালাম্মা কারও নাম হয় না। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘কোন খালাম্মা?’

‘ওই তো, জোবেদা খালাম্মা।’

‘জি, আপনি বসেন, আমি দাদিকে বলি। আপনার নাম কী বলব?’

মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হলো যে তার নাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে আশা করে আছে টুনি তাকে দেখেই চিনে ফেলবে। টুনি মনে মনে আরও এক নম্বর কেটে ফেলবে কি না চিন্তা করল। শেষ পর্যন্ত কাটল না।

মানুষটা এবারে তার নকল হাসিটা বন্ধ করে মুখ শক্ত করে বলল, ‘বলো, কান্দিরপাড়ের রইস উদ্দিন এসেছে। খালাম্মা রইস মাস্টার বললেই চিনবে।’

কাজেই টুনি রইস মাস্টারকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরে দাদিকে খবর দিতে গেল। দাদি অবশ্য কান্দিরপাড়ের রইস মাস্টারকে চিনলেন না। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘রইস মাস্টার? সেইটা আবার কে?’

টুনি বলল, ‘সেইটা তুমি জানো দাদি! আমি তো জানি না।’

দাদি তাঁর আরামের চেয়ারে পা তুলে বসে এই মোটা একটা উপন্যাস পড়ছিলেন, উঠে বাইরের ঘরে যাওয়ার ইচ্ছা নাই, তাই বললেন, ‘যা, ডেকে নিয়ে আয়।’

টুনি তাই রইস মাস্টারকে ভেতরে ডেকে আনল। তাকে দেখেও দাদি প্রথমে চিনতে পারলেন না, তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রইস মাস্টার তখন বলল, ‘খালাম্মা, আমি বদু।’

‘ও বদু! সেইটা বলো। চেহারাও অন্য রকম লাগে।’

‘জে খালাম্মা। এখন মনে করেন মাস্টারি করি, তাই একটু ভদ্র থাকা লাগে।’

এই মানুষটির চেহারা ভদ্র করার আগে কেমন ছিল টুনি কল্পনা করার চেষ্টা করল। মুখে দাড়ি-গোঁফ? মাথায় জংলি ছাঁট? চোখে কালো চশমা? গলায় সোনার চেন? হাতে ব্রেসলেট? টুনি খুব বেশি দূর এগোতে পারল না।

দাদি বললেন, ‘বসো।’

রইস মাস্টার অথবা বদু নামের মানুষটা কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল। টুনির কাজ শেষ, সে এখন যেতে পারে। কিন্তু মানুষটার কথাবার্তা একটু অন্য রকম, তাই সে আরেকটু শোনার চেষ্টা করল।

দাদি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করো আজকাল? তুমি না মিডল ইস্ট গিয়েছিলে?’

‘জি খালাম্মা, বেশি দিন থাকি নাই। চলে আসছি।’

‘এখন কী করো? মাস্টারি?’

‘জি খালাম্মা। স্কুলে পড়াই।’

‘পড়াও?’ দাদির কথা শুনে মনে হলো বদু কিংবা রইস মাস্টার স্কুলে পড়ায় শুনে বেশ অবাক হয়েছেন। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পড়াও?’

‘বিজ্ঞান আর গণিত।’

‘বিজ্ঞান?’ দাদি আরও অবাক হলেন। কিছুক্ষণ রইস মাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘পড়াতে কেমন লাগে? মাস্টারিতে বেতন কী রকম?’

টুনি মনে মনে একটু হাসল। তাদেরকে শেখানো হয়েছে, কাউকে কখনো বেতন জিজ্ঞেস করতে হয় না—দাদি অবশ্য এই সব নিয়মের ধার ধারেন না। প্রথমেই জিজ্ঞেস করে ফেলেন বেতন কত।

রইস মাস্টার বলল, ‘স্কুলের বেতন আর কত! সেইটা দিয়ে কী আর চলে? প্রাইভেট পড়াই, কোচিং করাই, সেইটা দিয়ে মনে করেন কিছু ইনকাম হয়।’

দাদি বলেলন, ‘ও।’

রইস মাস্টার বলল, ‘সেইটাই কী আর শান্তিমতো করতে পারি? দুই দিন পরে পরে ট্রেনিং। তখন আমার প্রাইভেট বন্ধ, কোচিং বন্ধ। ছাত্রছাত্রী ধরে রাখাই মুশকিল, ভয় ডর দেখিয়ে কোনোমতে ধরে রাখি।’

‘ট্রেনিং? কিসের ট্রেনিং?’

‘কত রকম ঢংয়ের ট্রেনিং। ছেলেমেয়েদের কেমন করে পড়াতে হয়, তাদের কেমন করে উৎসাহ দিতে হয়, এই রকম হ্যানোতেনো হাবিজাবি।’

টুনি একটু অবাক হয়ে রইস মাস্টারের মুখের দিকে তাকাল। ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দেওয়ার ট্রেনিং হাবিজাবি কেন হবে?

দাদি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কয়দিনের ট্রেনিং?’

‘সেইটার ঠিক নাই। কোনোবার তিন দিন, কোনোবার এক সপ্তাহ।’

‘থাকো কোথায়? খাও কী?’

টুনি বুঝতে পারল, এইটা ভুল প্রশ্ন! মানুষটা এই প্রশ্নের উত্তরে থাকা-খাওয়ার কী রকম কষ্ট, সেইটা নিয়ে লম্বা একটা কাহিনি শুরু করে দেবে। হলোও তা–ই। রইস মাস্টার লম্বা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘থাকা-খাওয়ার কথা আর বলবেন না খালাম্মা। একটা হোস্টেলে উঠি। চিপা একটা ঘরে দুইজন থাকতে হয়। খাওয়ার কথা বলে লাভ নাই। গতকাল শিং মাছ দিয়েছে, সেই শিং মাছের মাথায় বড়শির কাঁটা, আপনি বিশ্বাস করবেন না—’

টুনি যেটা ভয় করছিল দাদি তখন ঠিক সেই কাজটা করলেন। বললেন, ‘তোমার থাকা-খাওয়ার এত কষ্ট, এইখানে চলে এসো। যত দিন তোমার ট্রেনিং, তত দিন এইখানে থেকে যাও।’

রইস মাস্টারের মুখ এক শ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল। বলল, ‘আপনাদের কষ্ট হবে না তো?’

‘না না, কষ্ট কিসের!’

টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাসায় যদি কোচিংয়ের মাস্টার ঢুকে যায়, তাহলে মহা বিপদ! যেই মানুষ ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দেওয়াকে হাবিজাবি মনে করে, সেই মানুষ নিশ্চয়ই খুবই বিপজ্জনক মানুষ!

টুনি তখন দাদির ঘর থেকে বের হয়ে অন্য সবাইকে দুঃসংবাদটা দিতে গেল।

টুনি তখনো জানত না, রইস মাস্টারকে সে যতটুকু বিপজ্জনক ভেবেছিল, সে তার থেকেও বেশি বিপজ্জনক!

রইস মাস্টার স্কুলের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান পড়ায়। দেখা গেল, মানুষটি ছেলেমেয়ে এবং বিজ্ঞান—এই দুইটা জিনিসের কোনোটাই দুই চোখে দেখতে পারে না!

দাদি যখন রইস মাস্টারকে এই বাসায় চলে আসতে বলেছেন রইস মাস্টার তখন আর দেরি করে নাই, তখন তখনই বের হয়ে একটু পরেই তার ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছে। সন্ধ্যার পর গোসল করে, পরিষ্কার কাপড় পরে, তৃপ্তি করে খেয়ে দেয়ে দাদির ঘরে এসে বসেছে। বাচ্চারা যখন দাদির ঘরে হুটোপুটি করছে, তখন রইস মাস্টার কেমন যেন চোখ কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে দেখে মনে হলো, সে যেন বাচ্চাকাচ্চা দেখছে না, কোনো ধরনের বিষাক্ত পোকার দিকে তাকিয়ে আছে।

রইস মাস্টার বাচ্চাদের হুটোপুটি দেখতে দেখতে এবং তাদের চেঁচামেচি শুনতে শুনতে একসময় কেমন যেন হতাশভাবে মাথা নেড়ে দাদিকে বলল, ‘বুঝলেন খালাম্মা, আমাদের দেশের উন্নতি হয় না কেন?’

দাদি বললেন, ‘কে বলেছে উন্নতি হয় না? দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে।’

রইস মাস্টার বলল, ‘না, মানে দেশের মানুষ সবাই চোর-ডাকাত-বদমাইশ—’

দাদি চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘এইটা কী বলো বদু? আমি তো কোনো চোর-ডাকাত দেখি না! আমি তো যাকেই দেখি, সবাই ভালো মানুষ। পরিশ্রম করে সংসার চালায়।’

রইস মাস্টার কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা চুলকে বলল, ‘অ্যাঁ?’

দাদি মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় তুমি ঠিক মানুষের সাথে মিশো না। তুমি যাদের সাথে মিশো, তারা নিশ্চয়ই চোর-ছেঁচড়। এ জন্য তোমার ধারণা, সবাই চোর-ডাকাত-বদমাইশ।’ দাদি খুবই বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন।

বাচ্চারা সবাই হুটোপুটি করছে, দাদি আর রইস মাস্টারের কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল না। তবে টুনির অভ্যাস হচ্ছে, চারপাশে কী হচ্ছে সব সময়ে সেটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করা। কাজেই সে হুটোপুটির মাঝখানে থেকেও দাদির সাথে রইস মাস্টারের কী কথা হচ্ছে, সেটা শোনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

দাদির ধমক খেয়ে রইস মাস্টার এবার তার সুর পাল্টাল। বলল, ‘খালাম্মা, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই দেশের মানুষ আসলে ভালো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। পাঠ্যবইগুলো সব ভুলভাল!’

দাদি বললেন, ‘তাই নাকি?’

‘জি খালাম্মা। আমি তো বিজ্ঞান পড়াই, আমি জানি। সবচেয়ে বেশি ভুল বিজ্ঞান বইয়ে।’

দাদি এবারে আসলেই অবাক হলেন, বললেন, ‘কী আশ্চর্য!’

রইস মাস্টার এবারে উৎসাহ পেল। দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যেমন মনে করেন বিজ্ঞান বইয়ে লেখা, পৃথিবী নাকি সূর্যের চারিদিকে ঘুরে! আমরা স্পষ্ট দেখি, পূর্ব দিকে সূর্য উঠে পৃথিবীটাকে ঘিরে ঘুরে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। এখন আপনিই বলেন, যেটা চোখের সামনে ঘটতে দেখি, সেইটা বিশ্বাস করব, নাকি বইয়ের উল্টাপাল্টা কথা বিশ্বাস করব?’

দাদি কেমন যেন অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি এসব কী বলছ বদু? আমি বিজ্ঞান-টিজ্ঞান জানি না। কিন্তু এইটা তো সবাই জানে যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে! আমিও জন্ম থেকে শুনে আসছি।’

রইস মাস্টার সবকিছু জানে এ রকম ভাব করে বলল, ‘খালাম্মা, এইগুলা নাস্তিকদের কথা! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিকের নাম হচ্ছে আইনস্টাইন, সে বলেছে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বলা যেই কথা, সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে বলা একই কথা! এইটাকে বলে রিলেটিভিটি।’ কথা শেষ করে রইস মাস্টার দুলে দুলে হাসল।

দাদি কী বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, ‘আমি জানি না বদু, এইগুলা বড় মানুষজনের বড় বড় কথা। কে কী বলে, কেন বলে আমি সেগুলো বুঝি না।’

টুনির কাছে রইস মাস্টারের কথাগুলো যথেষ্ট আজব মনে হলো—একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে সেইটা বিশ্বাস করে না? টুনি তখন গলা নামিয়ে অন্যদের রইস মাস্টারের কথা শুনতে বলল। এবারে অনেকেই শুনল রইস মাস্টার বলছে, ‘আপনিই বলেন খালাম্মা, জেনেশুনে ছেলেমেয়েদের মিছা কথা বলতে কী ভালো লাগে? পড়াতে হয় সে জন্য পড়াই। তারপর বলে দিই তোমরা পরীক্ষায় নম্বার পাওয়ার জন্য এইগুলা লিখতে হলে লিখবে, কিন্তু আসলে কখনো বিশ্বাস করবে না।’

এইবারে প্রমি জিজ্ঞেস করল, ‘কী বিশ্বাস করবে না?’

রইস মাস্টার চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আমরা বড় মানুষেরা কথা বলছি। তার মাঝে তোমরা পোলাপান আসছ কেন?’

টুনি প্রমিকে বলল, ‘উনি বলছেন, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘিরে ঘুরে এইটা ভুল! এইটা নাস্তিকদের কথা। ছাত্রছাত্রীরা যেন এইটা বিশ্বাস না করে। এইটা মিছা কথা।’

প্রমি অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে সত্যি কথা কোনটা?’

‘সত্যি কথা হচ্ছে, সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘিরে ঘোরে।’

প্রমি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘সত্যি?’

রইস মাস্টার মুখ শক্ত করে বলল, ‘হ্যাঁ সত্যি। এইটা বিজ্ঞানমতে প্রমাণ করা যায়।’

‘প্রমাণ করা যায়? বিজ্ঞানমতে?’

‘হ্যাঁ।’ রইস মাস্টার গম্ভীর মুখে বলল, ‘বিজ্ঞান কী বলে? যেইটার ওজন বেশি সেইটাকে ঘিরে যেইটা হালকা সেইটা ঘুরবে। ঠিক কি না?’

কয়েকজন ইতস্ততভাবে মাথা নাড়ল। রইস উদ্দিন বলল, ‘তাহলে ওজন বেশি কার? পৃথিবীর নাকি সূর্যের?’

কয়েকজন বলল, ‘সূর্যের।’

রইস মাস্টার কাঠ কাঠ গলায় হাসল। বলল, ‘সূর্যটা কী দিয়ে তৈরি? আগুন দিয়ে। আগুনের কোনো ওজন আছে? নাই! তাহলে কার ওজন বেশি?’

বাচ্চারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, তারপর একজন বলল, ‘কিন্তু আমাদের বইয়ে লেখা আছে সূর্যের ওজন অনেক বেশি।’

রইস মাস্টার আঙুল তুলে বলল, ‘ভুয়া কথা। মিছা কথা। বইয়ের মাঝে সব কথা ভুয়া!’

শান্ত বলল, ‘আমার মনে হয়, আপনার সব কথা ভুয়া। মনে হয় আপনিও ভুয়া।’

দাদি ধমক দিয়ে বললেন, ‘ছিঃ শান্ত। এইভাবে কথা বলে না।’

‘সত্যি কথা বললে দোষ?’

রইস মাস্টার মুখ কালো করে দাদির (কিংবা নানির) দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখেছেন খালাম্মা? ছোট ছেলেমেয়েরা বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলে?’

দাদি শান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শান্ত। তুই এক্ষুনি বল, তুই সরি। বল।’

‘মিছা কথা বলতে পারব না দাদি। আমি মোটেও সরি না। অন্য কিছু বলি?’

রইস মাস্টার বলল, ‘এই দেশের সর্বনাশটা হয়েছে কখন জানেন?’

‘কখন?’

‘যেদিন এই দেশে ছেলেমেয়েদের বেত মারা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, সেই দিন।’

দাদি অবাক হয়ে রইস মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইটা তুমি কি বলছ রইস?’ রইস মাস্টার বলল, ‘সত্যি কথা বলছি খালাম্মা। ছেলেমেয়েদের রেগুলার পিটাতে হয়। তাহলে তারা সিধা থাকে। টনটনা থাকে।’

‘টনটনা?’

‘জি খালাম্মা। পিটা খাইলে পোলাপান টনটনা থাকে। আমরা কী ছেলেবেলায় পিটা খাই নাই? কোনো কি ক্ষতি হয়েছে?’

শান্ত বলতে চাইল, ‘হয়েছে, অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে!’ কিন্তু অন্যরা তাকে কথা বলতে দিল না। সে উল্টাপাল্টা কথা বলে সব সময় একটা না হয় আরেকটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে। তাকে যত কম কথা বলতে দেওয়া হয়, তত ভালো।

পরদিন সন্ধেবেলা বাচ্চারা সবাই পড়তে বসেছে। কেউ কেউ আসলেই লেখাপড়া করছে, কেউ কেউ ভান করছে, কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে পেনসিলের গোড়া চিবিয়ে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ করে রইস মাস্টার এসে হাজির হলো। একটা খালি চেয়ারে বসে সবার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘কার কয়টা বই মুখস্থ হয়েছে?’

বাচ্চারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। এই বাসায় মুখস্থ শব্দটাকে রীতিমতো খারাপ গালির মতো ধরা হয়! একজন বলল, ‘আমরা মুখস্থ করি না।’

রইস উদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘মুখস্থ করো না? তাহলে?’

টুনি বলল, ‘আপনি বলেছেন বইয়ে সব কথা ভুয়া। ভুয়া কথা মুখস্থ করে কী লাভ?’

‘কিন্তু পরীক্ষায় পাস করতে হবে না? কোন কোচিং সেন্টারে পড়ো?’

‘কোনো কোচিং সেন্টারে পড়ি না।’

‘অ্যাঁ? প্রাইভেট? প্রাইভেট মাস্টার আসে?’

‘নাহ্‌!’

রইস উদ্দিন কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ‘খালি গাইড বই?’

‘আমরা গাইড বইও পড়ি না।’

‘খালি পত্রিকার শিক্ষা পাতায় গাইড বইয়ের যে পৃষ্ঠা ছাপা হয় সেইগুলো মুখস্থ করো?’

‘ছিঃ! আমরা সেইগুলাও পড়ি না।’

‘সর্বনাশ! তোমাদের বাবা-মায়ের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই?’

শান্ত বলল, ‘নাহ্‌! নাই।’

আগের দিন রইস মাস্টার যখন দাদিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে পৃথিবী আসলে সূর্যকে ঘিরে ঘোরে না, এইটা মতলববাজ নাস্তিকদের প্রচার, আসলে সূর্য আগুন দিয়ে তৈরি ওজনহীন একটা জিনিস, তাই সেটা পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে, তখন শাহানা সেখানে ছিল না। পরে অন্যরা তাকে বিষয়টা রিপোর্ট করেছে, তাই শাহানার এই মানুষটাকে দেখার খুব শখ ছিল। কাজেই সে খুবই আগ্রহ নিয়ে রইস মাস্টারের কথাবার্তা শুনছিল। যখন সে কথা বলার সুযোগ পেল, তখন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আসলেই বিশ্বাস করেন না যে পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘোরে?’

রইস উদ্দিন মুখ শক্ত করে বলল, ‘এইটা বিজ্ঞানের বিষয়। বিজ্ঞানের বিষয় যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে তার কোনো প্রমাণ নাই।’

শাহানা বিষয়টা নিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করল না। সূর্য যে আগুন না, সূর্যে যে ফিউসান হয়ে তাপ তৈরি হয় সে এগুলো কিছুই বলার চেষ্টা করল না। সে এত দিনে জেনে গেছে এই রকম মানুষের কোনো অভাব নাই, তাদের অনেকে আজব আজব বই লিখে, সেই বই আবার বেস্টসেলার হয়। সেই বই পড়ে অন্যরাও আজব হয়ে যায়, তাদের সাথে তর্ক করা হচ্ছে সময় নষ্ট! তাই সে কোনো সময় নষ্ট না করে বলল, ‘তার মানে আপনি মোটামুটি পাঁচ শ বছর আগে ফিরে যেতে চান?’

রইস মাস্টার কথাটা না বুঝে শাহানার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। শাহানা তখন আরেকটু বুঝিয়ে দিল, বলল, ‘পাঁচ শ বছর আগে মানুষ বিশ্বাস করত সূর্য পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে। আপনি পাঁচ শ বছর আগের মানুষ হতে চান?’

শাহানা তাকে কোন প্যাঁচে ফেলবে রইস মাস্টার বুঝতে পারছিল না। তাই একটু অ্যাঁ উঁ শব্দ করল—তার মানে যা কিছু হতে পারে। শাহানা আরেকটা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, তার আগেই শান্ত গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তার মানে আপনি পাঁচ শ বছর আগের অন্য কাজকর্মগুলোও করবেন?’

রইস মাস্টার শান্তর ওপর খুবই বিরক্ত, তাই তার কথা না শোনার ভান করল। কিন্তু শান্ত চিনে জোঁকের মতো তার পেছনে লেগে রইল, বলল, ‘নিশ্চয়ই করবেন! পাঁচ শ বছর আগে কত মজার মজার কাজ করা যেত, এখন সেগুলো আর করা যায় না! আপনি সেইগুলো করতে পারবেন! কী মজা!’

রইস মাস্টার জিজ্ঞেস করল, ‘কী মজার কাজ?’

‘যেমন মনে করেন, বাজার থেকে মানুষ কিনে আনা!’

‘মানুষ কিনে আনা? কী বলছ তুমি?’

শান্ত চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আমি পড়েছি, তখন মানুষ বেচাকেনা করা যেত! আপনি নিশ্চয়ই করবেন। করবেন না?’

রইস মাস্টার বলল, ‘এই ছেলে, উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।’

তখন অন্যরা শান্তর সাথে যোগ দিল! একজন বলল, ‘আপনি তো পাঁচ শ বছর আগের মানুষের মতো চিন্তা করেন। তাহলে সমস্যা কী?’

আরেকজন বলল, ‘কোনো সমস্যা নাই। চিন্তা করেন, কত মজা হবে। বাজারে যাবেন, সব মানুষ দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকবে। একজনকে কিনে দড়িতে বেঁধে নিয়ে আসবেন!’

‘পছন্দ না হলে আবার বিক্রি করে দেবেন।’

আরেকজন বলল, ‘তার চেয়ে ভালো হয়, আপনি নিজেই মানুষ বেচাকেনার একটা বিজনেস শুরু করে দেন!’

রইস উদ্দিন চোখমুখ কালো করে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, তখন শান্তও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনি কি বিজনেসের জন্য একটা মানুষ চান? আমার কাছে আছে একজন!’

সবাই অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কে আছে তোর কাছে?’

শান্ত কারও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রইস মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে ফ্রি দিয়ে দিব! আপনি বিক্রি করতে পারবেন।’

রইস মাস্টার এবারে তার ঘরের দিকে রওনা দিল। শান্ত পেছনে পেছনে যেতে যেতে বলল, ‘আমাকে টেন পার্সেন্ট কমিশন দিলেই হবে। মাত্র টেন পার্সেন্ট।’

রইস মাস্টার শান্তর দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এই ছেলে। ভালো হবে না কিন্তু।’ তারপর দড়াম করে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।

শান্ত আনন্দে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তার পড়ার টেবিলে ফিরে এল। প্রমি জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কাকে বিক্রি করে দিতে চাইছিলি?’

‘কেন? আমাকে!’

টুম্পা হি হি করে হেসে বলল, ‘তোমাকে কেউ কিনবে না শান্ত ভাইয়া! ফ্রি দিলেও কেউ কিনবে না।’

পরদিন খুব ভোরে কেউ ওঠার আগে রইস মাস্টার তার স্যুটকেস নিয়ে কাউকে কিছু না বলে বাসা ছেড়ে চলে গেল। তার চোখ লাল, মনে হচ্ছে রাতে ভালো ঘুম হয়নি।

কেমন করে হবে? প্রায় পুরো রাত বিভিন্ন মানুষ ফোন করে তার কাছে জানতে চেয়েছে সে কি সত্যিই মানুষ বিক্রির ব্যবসা করে? এত ব্যবসা থাকতে এই ব্যবসা কেন শুরু করেছে? ব্যবসায় লাভ কী রকম? অনলাইনে কী কেনা সম্ভব? কত দামে বিক্রি হচ্ছে? পাইকারি রেট কত আর খুচরা রেট কত? আরও কত রকম প্রশ্ন!

রইস মাস্টার ওরফে বদু শুধু তার মাথার চুল শুধু ছিঁড়তে বাকি রেখেছে। না জানি কী কুক্ষণে সে এই বাসায় পা দিয়েছিল!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments