Thursday, August 21, 2025
Homeকিশোর গল্পসাদা ঘুড়ি - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

সাদা ঘুড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ওই যে কালো ঘুড়িটা লাট খেয়ে বেড়ে আসছে, তার মানে হচ্ছে ওটা লড়বে। কালো রঙের মাঝখানে একটা লালচে ছোপ–তাতে ঘুড়িটাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। আমার ছাদে রেলিঙ নেই। বাড়িটা এখনও শেষ হয়নি–এটার নানা জায়গায় বহু কাজ বাকি রয়ে গেছে। অফিস থেকে ধার তুলে একটু-একটু করে করছি। যতই করছি ততই কেবল মনে হয়, একটা বাড়ি আসলে কখনওই শেষ হয় না-যতই করা যায় ততই বাকি থেকে যায়। অনন্তকাল লেগে যায়। ওই রেলিঙহীন ছাদে আমার একগুঁয়ে ছোট ছেলেটা–হাবু–তার সাদা ঘুড়ি বহু দূরে বাড়িয়ে লাটাই ঘোরাচ্ছে। লড়বে। হাবুর ঘুড়ির দিকে ছোঁ মেরে-মেরে সরে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর কালো ফাইটার ঘুড়িটা। রেলিঙহীন ছাদে দাঁড়িয়ে হাবু পিছু হাঁটছে।

বেশিক্ষণ দেখার সময় নেই। ছাদে রেলিঙ নেই–ভগবান হাবুকে দেখবেন বোধহয়। আমি গরিব মানুষ, ছাদে রেলিঙ দিতে পারিনি এখনও। ভগবান গরিবকে দেখবেন। এখন আমার সময়। নেই, সারারাত শীতে কষ্ট পেয়েছে আমার দুটো গরু। মশা রক্ত খেয়েছে কত! বাছুরটার পায়ে বাত, পেছনের ঠ্যাং দুটো একটার সঙ্গে আর-একটা লেগে থাকে। আমার দুটো গরুই হারামি। সাদাটার বিয়োনোর বালাই নেই, সারাবছর খড় খোলের শ্রাদ্ধ করছে। এবছর ভাবছি আমার। শ্বশুরবাড়ির দেশ অভয়গ্রামে পাঠিয়ে দেব। আমার কালোটা প্রায় বছর-বিয়ানি। তার বাঁকা শিং বাঁকা মেজাজ। মাসখানেক আগে আমাকে মাটিতে ফেলে হিঁচড়ে দশ গজ রাস্তা নিয়ে গিয়েছিল। তার ফলে আমাকে টিটেনাসের ইঞ্জেকশন নিতে হয়। কোমরে সেই থেকে একটা ব্যথা বোধহয় পাকাঁপাকি বাসা নিয়েছে। বুড়ো বয়সের চোট তো! আমার কালোটা প্রায়ই খোঁটা উপড়ে পালাতে চায়। কোথায় পালাতে চায় কে জানে!

সাঁই করে কালো ঘুড়িটা নেমে এল ওই। হাবু সিঁড়িঘরের দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে। খুব জোরে সুতো গোটাচ্ছে, ওর ঘুড়িটা সূর্যের আলোর মধ্যে, তাই ঠিক দেখতে পেলাম না। কালোটা অনেক বেড়ে এসেছে, হাবুর ঘুড়ি পালাচ্ছে। ছাদে রেলিং নেই। ভগবান হাবুকে দেখবেন।

বীণাপাণি ক্লাবের পশ্চিম কোণে একটা ভাঙা টিউবওয়েল। এই কলটার সঙ্গে আমি রোজ সাদাটাকে বেঁধে রাখি। একটু মাঠ মতন আছে, কিন্তু রাতে ব্যাডমিন্টন খেলা হয় বলে ঘাস মরে মাটি বেরিয়ে গেছে। দু-চারখানা ঘাসের মরা ডগা দাঁতের আগায় সারাদিন খোঁটে গরুটা। কালোটাকে বাঁধি দত্তদের জমিতে। জমিটা ছাড়া পড়ে আছে বহুকাল। বাড়ির ভিত গাঁথা হয়েছিল বহুদিন আগে। চারটে ঘর, একটা বারান্দা, পিছন দিকে একটা কুয়ো–এই হচ্ছে বাড়িটার ছক। ভিত সেইভাবেই গাঁথা আছে, তার ওপর বাড়িটা আর হয়ে ওঠেনি। কুয়োটা মজে এল রাজ্যের কুটোকাটা শ্যাওলা আর ব্যাঙের আস্তানা। বাড়ির ভিতর জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। বছরে একবার দত্তবাবু এসে দূরে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত চোখে দৃশ্যটা দেখে চলে যান দূর এক স্টিমারঘাটায় তাঁর কেরানিগিরিতে। আমার কালো গরুটা এইখানে চরে। এখানে গাছগাছালির ছায়ায় কিছু ঘাস জন্মায়। গরুটা সারাদিন খায় আর খায় আর খায়। গরুদের কখনও পেট ভরে না।

এবার শীতটা পড়েছে খুব। আলুখেতের মাটি উসকে দিয়ে বেগুন চারাগুলোর কাছে এসে বসি। বেগুনের বাড় নেই এ বছর। পোকা লেগেছে। ফুলকপির ফুলগুলোও কেন জানি ছড়িয়ে গেছে, দুধের মতো সাদা হয়ে জমাট বাঁধেনি। কলার ঝাড়ে কেঁচো লেগেছে। বাগান থেকে আকাশ স্পষ্ট দেখা যায় না, তবু গাছপাতার ফাঁকে একঝলক একটা সাদা ঘুড়ি দেখতে পাই। যাক বাবা এখনও কাটেনি হাবুরটা। কালো ঘুড়িটা কি এখনও ছোঁ মারছে? কে জানে!

কতকাল ধরে পৃথিবীর রস শুষছে গাছপালা। শুষতে–শুষতে মাটি ছিবড়ে হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় যেমন স্বাদ পেতাম তরিতরকারিতে, এখন আর তেমন স্বাদ পাই না। আমার নাকের দোষ কিনা কে জানে, আজকাল শাকপাতায় কেমিক্যাল সারের গন্ধ পাই। পায় আমার গিন্নিও। কেবল ছেলেপুলেরা কিছু টের পায় না।

সামনে ছায়া পড়তেই চোখ তুলে দেখি, দুজন মানুষ বেড়ার ওধারে দাঁড়িয়ে।

–কাকে চাইছেন?

–শ্যামাপদ ঘোষালের বাড়ি কি এটা?

–আজ্ঞে, আমিই।

তারা বিনীতভাবে নমস্কার করে। তাদের মধ্যে লম্বা জন বলে–আমরা কলকাতা থেকে আসছি, এ বাড়িতে একটা ঘর খালি আছে শুনলাম।

–আছে। দেখবেন?

–দেখি একটু।

চাবি আনতে যেতে-যেতে একবার মুখ তুলি। হাবু একেবারে রেলিঙহীন ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে। যদি বে–খেয়ালে এক পা পিছু হটে। হাবু-উ, সরে যা, সরে যা, মরে যাবি…পড়ে যাবি! কিন্তু আমি কিছুই বলি না। বললেও হাবু কখনও শোনে না। থাক, যা করবার করুক। ভগবান ওকে দেখবেন।

–ঘরটা তো ছোটই দেখছি। দক্ষিণটা একেবারে বন্ধ। ভিতরের বারান্দা তো কমন, না?

–হ্যাঁ, বাথরুমও তাই।

–ইস। রান্নাঘর উঠোনের ওপাশে। জল বলতে পাতকো–না? উঠোনে তো রোদ আসে না, মনে হয়–জামাকাপড় শুকোবে কোথায়? আর পায়খানা…?

–দুটো। একটা আপনাদের ছেড়ে দেব।

–ভাড়া বলেছেন পঞ্চাশ টাকা! কলকাতা থেকে দশ কিলোমিটার দূর, রেল স্টেশন থেকে সাত আট মিনিটের হাঁটাপথ–তবু পঞ্চাশ টাকা! ওর মধ্যে কি ইলেকট্রিক চার্জ ধরা আছে?

–না ইলেকট্রিক আলাদা। মাসে দশ টাকা ফিকসড।

–দশ টাকা। মাত্র চারটে পয়েন্টের জন্য দশটাকা।

–গরমকালে পাখা চলবে তো!

–আমাদের পাখাটাখা নেই।

–তা হলেও কলকাতার চেয়ে এখানকার ইউনিটের দর দ্বিগুণ।

লোক দুজন বিতৃষ্ণ চোখে ঘরটা দেখে। পছন্দ হয় না বোধ হয়। গত এক বছর ধরে এরকম বহু লোক এসে ফিরে গেছে। আমি নিস্পৃহভাবে তাকিয়ে থাকি।

লম্বা লোকটা বলে–আমি এখন যে বাড়িতে আছি সন্তোষপুরে–সেটার ভাড়া পঁয়তাল্লিশ, দুখানা ঘর সামনে পিছনে বারান্দা, দক্ষিণের হাওয়া আসে হুড়হুড় করে। তার ওপর সেটা কলকাতা-এরকম গ্রামগঞ্জ নয়–

–ছেড়ে দিচ্ছেন কেন?

–আমার সামনের বারান্দায় বসে পাড়ার ছোঁকরারা বোম বাঁধে মশাই।

অপেক্ষাকৃত বেঁটে লোকটি লম্বা লোকটির শালা। খুব বিনীত হাসি তার মুখে। সসঙ্কোচে বলে –এ ঘরটায় কে থাকে? চৌকিতে বিছানা দেখছি। আঠার শিশি, পোস্টারের কাগজ তুলি রাজনীতির বই–এসব কী ব্যাপার!

–আমার মেজো ছেলে পটল।

–পলিটিকস করে?

–না, পলিটিকসের বোঝে কী? এ সি ই পাস করে বেকার বসে আছে। ওইসব করে সময় কাটায়। ওটা একটা শখ।

লম্বা লোকটাকে চিন্তিত দেখায়!–এসব এলাকা কেমন? ঝঞ্ঝাট–টঞ্ঝাট আছে কিছু?

–আজ্ঞে না, খুব নিরিবিলি।

–কিন্তু খবরের কাগজে যেন দেখেছি এই এলাকাতেও—

–ও, সে ওই অভয়নগর–বেলাবাগান রিফিউজি এলাকায়। এদিকটায় কিছু নেই।

লোক দুজনকে তবু চিন্তিত দেখায়।

আমি তাদের কিছুদূরে এগিয়ে দিই। বুঝতে পারি, তারা আর আসবে না।

গত এক বছর ঘরটা ভাড়া হচ্ছে না। আগের ভাড়াটেরা তিরিশ টাকা দিত, ইলেকট্রিক চার্জ দিত তিন টাকা। তারা ছাড়ার পর আমি ভাড়া বাড়িয়েছি। টাকাটা জমিয়ে বাড়িটাতেই লাগাব। ভাড়া হচ্ছে না বটে, কিন্তু হবে। কলকাতার গণ্ডগোলটা যদি জোর লেগে যায়। লম্বা লোকটার সামনের বারান্দায় যদি ছোঁকরাদের বাঁধা বোমা একটাও একদিন ফাটে–

হাবু এখন ছাদের মাঝখানে আবার সুতো ছেড়েছে। কালো ঘুড়িটা কোথায়? কেটে গেছে নাকি! না সুতো গুটিয়ে একটু সরেছে পুবদিকে। কিন্তু লড়বে! এগোচ্ছে। হাবু ছাদের মাঝখানে দাঁতে ঠোঁট টিপে হাসছে।

বাছুরটা রোদে গা এলিয়ে শুয়ে। পায়ে বাত, ল্যাজের দিকটায় পাতলা গোবরে মাখামাখি। মাথার কাছে একটা কাক বসে মন দিয়ে ওর মুখ দেখছে।

কুয়োর পাড়ে হাত পা ধুচ্ছি, রান্নাঘর থেকে হাবুর মা চেঁচিয়ে বলে–ওরা কী বলে গেল?

–নেবে না বোধ হয়। ভাড়া বেশি।

–না নিক। তুমি কমিও না। কলকাতা থেকে তোক চলে আসছে এখন। ধরদের বাড়ি কুষ্ঠরোগীর বাড়ি বলে ভাড়া হচ্ছিল না, গত শুক্রবারে সেটাও আশি টাকায় ভাড়া হয়েছে। তুমি চেপে বসে থেকো।

রোদে দেওয়া তোষক বালিশের ওপর তপুর বেড়ালটা ডন মারছে। বেড়ালটাকে তাড়িয়ে রোদে একটু বসি। একটা সিগারেট টানি। আকাশে সাদা কালো দুটো ঘুড়িই সমান–সমান বেড়েছে। এইবার লাগবে, ছাদে হাবুর পা দাপানোর শব্দ হচ্ছে। ঘুড়ির লড়াইটা কি দেখে যাব? থাকগে। এখন আর সে বয়স নেই। সপ্তাহে এই একটাই তো মাত্র ছুটির দিন! সময় নষ্ট করা ঠিক না।

উঠোনটায় গতবারে বর্ষা থেকে জল জমছে। আগে জমত না। পশ্চিমে একটা মজা পুকুর ছিল, সেখানে নাবালে গড়িয়ে নেমে যেত। গত বছর থেকে এক বড়লোক পুকুরটা কিনে উঁচু করে মাটি ফেলেছে। উঁচু ভিতের বাড়ি গাঁথছে, জলটা এখন উলটোবেগে গড়িয়ে আসে। গরিবের উঠোন ভেসে যায়। কী করব ভেবে পাই না। চিন্তিতভাবে ঘরে আসি। পরশুদিন সন্ধেবেলা কারেন্ট ছিল না, অসাবধানে মোমবাতি জ্বেলে দিল তপু। দেওয়ালে কালো দাগ। সাবান জলে সেই দাগ তুলি। ক্যালেন্ডারের পেরেক পুঁততে গিয়ে দেওয়ালের চালটা উঠিয়েছে পটল। ভ্রূ কুঁচকে দৃশ্যটি একটু দেখি। দোতলা উঠবে, সেই আশায় সিঁড়িঘরটা পোক্ত করে করা হয়নি, বর্ষার জল সেইখান দিয়ে চুঁইয়ে এসে নষ্ট করেছে ইলেকট্রিকের তার। দাঁড়িয়ে সমস্যাটা একটু ভাবি। ছাদের ওপর জমানো আছে লোহার শিক–তাতে জং পড়েছে, বাইরে এক গাড়ি বালি ক্রমে মাটি হয়ে যাচ্ছে, পাথরকুচিগুলো ছুঁড়ে– ছুঁড়ে নষ্ট করেছে পাড়ার ছেলেরা। সারা বাড়ি ঘুরে

আমি এইসব দেখি। বাড়িটা শেষ হতে অনন্তকাল লেগে যাবে মনে হয়। কুয়োতলায় মাথায়। সাবান দিতে বসেছে তপু আমার কালো মেয়েটা। গত জ্যৈষ্ঠে চব্বিশ পার হয়ে গেল। তপুর বিয়ে হলে আমার তিনটে মেয়েই পার হত। কিন্তু কালো বলে তপুই কেমন আটকে গেছে। গতকাল জি টি রোডে তিনটে মড়া পড়েছিল। পটল চারদিন বাড়ি নেই। আমার বেতো বাছুরটা কি বাঁচবে? ফুলকপিগুলো আঁট বাঁধল না, বেগুনে পোকা। ওই লম্বা লোকটা আর আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এক বছর একটা ফালতু ঘর পড়ে আছে। কোমরের ব্যথাটা আঁট হয়ে বসেছে। আমার দুটো গরুই হারামি। ভগবান কি সত্যিই হাবুকে দেখবেন?

যদি দোতলাটা তুলতে পারতাম তবে পুরো একতলা ভাড়া দিতাম। দেড় দুশো টাকা নিশ্চিন্ত আয়। দক্ষিণ দিকে দোতলায় আমার একটা নিজস্ব ছোট্ট বারান্দা করতাম। রেলিঙ ঘেঁষে বসাতাম মোরগফুলের টব। ঝোলাম অর্কিড। ছেলেবেলায় সাহেববাড়িতে ওরকম বারান্দা দেখে আমার বড় শখ রয়ে গেছে। চাকরির আর মাত্র আট মাস বাকি। তারপর অখণ্ড অবসর, দক্ষিণের বারান্দায় বসতাম ইজিচেয়ারে, হাতে খবরের কাগজ, মাঝে-মাঝে এক পেয়ালা চা পায়ের কাছে পড়ে–থাকা রোদ…এইসব খুব একটা বেশি কিছু নয়। যে কেউ এইসব চাইতে পারে।

একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে খবর দেয়–মেলোমশাই, আপনাদের কেলে গরু খোঁটা উপড়েছে দেখুনগে…

সত্যিই তাই। হারামি গরুটা ছাড়া জমি পার হয়ে রেলরাস্তায় ঢালু বেয়ে উঠছে। চিৎকার করে ডাকি। গলা শুনে একবার পিছনে ফিরে দেখে তারপর জোর কদমে ভারী শরীর টেনে উঠে পড়ে রেলরাস্তায়। পাথরে কাঠের খোঁটার খটখট শব্দ হয়। আপ–ডাউন দুটো লাইন পাশাপাশি। আপ লাইনটা পার হওয়ার চেষ্টা করছে আমার কালো গরু। এইখানে রেল লাইনে একটা গভীর বাঁক। গাড়ি এলে দূর থেকে ড্রাইভার গরুটাকে দেখতেও পাবে না…

–হারামির বাচ্চা। আমি ছুটতে থাকি। গরুটা টের পায়। লাইনটা আর পার হওয়ার চেষ্টা না করে লাইন ধরে ছোটে। আমার কোমর ভেঙে আসে। মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ছুরির ফলা লকলক করে চমকে ওঠে। ঢাল বেয়ে উঠতে আবার দম বেরিয়ে যায়। পাথর, খোয়া,। রেলের স্লিপারে হোঁচট খাই। গোরুটা ‘বাহা’ বলে ডাক দেয়, ছুটতে থাকে। রেল লাইনের গভীর বাঁক এখানে–আমার অবোধ দুধেল গাইটা বুঝতেও পারে না।

চনচনে রোদে, খালি পায়ে কোমরের সেই ব্যথা নিয়ে আমি প্রাণপণে খানিকটা তাড়া করি। তারপর দাঁড়াই, হঠাৎ মনে হল ভগবান ওকে দেখবেন।

অবাধ্য গরুটাকে যেতে দিয়ে রেলরাস্তা থেকে নামবার আগে আমি সংসারের দৃশ্যটা ভালো করে দেখি। পিছনে বহুদুরে ওই জি টি রোড যেখানে কাল তিনটে মৃতদেহ পড়ে ছিল। পটল সারাদিন বাড়িতে নেই। ডানধারে রেল লাইনের গভীর বাঁক ধরে হেঁটে যাচ্ছে আমার দুধেল গাই। কোথায় সে যাবে কে জানে! সামনে কলাঝোঁপের আড়ালে দেখা যাচ্ছে আমার পলেস্তারাহীন অসম্পূর্ণ বাড়িটা। ওটা কোনওদিনই শেষ হবে না। রেলিঙহীন ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তারপর দ্রুত সুতো গুটিয়ে নিচ্ছে হাবু। ওই অনেকটা সুতো নিয়ে তার সাদা ঘুড়ি টাল খেয়ে-খেয়ে ভেসে যাচ্ছে। আনন্দে গোত্তা খেয়ে ওপরে উঠে ঘুরপাক খাচ্ছে কালো ঘুড়িটা।

কয়েক পলক স্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আমি সংসারের অসম্পূর্ণতাকে দেখে নিই, অনুভব করি। ব্যর্থতাগুলি। সাদা কাটা ঘুড়িটা আমার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যায়।

হঠাৎ তড়িৎস্পর্শের মতো আমার হাত ছোঁয় সুতোর হালকা স্পর্শ, মাঞ্জার কড়া ধার। আমি সংসারের দৃশ্য থেকে মুখ ফেরাতেই নীল আকাশে সাদা হাসিটির মতো দোল খাওয়া ঘুড়িটাকে দেখি। সুতোটা আমার হাত ছুঁয়ে আবার সরে যাচ্ছে। আমার পিছনে রাজ্যের ছেলের পায়ের শব্দ আর চিৎকার শুনি। তারা ঘুড়িটার দিকে ছুটে আসছে।

সুতোটা আমার মাথার একটু ওপরে দোল খায়। আমি সংসারের সব ভুলে গিয়ে আনন্দে হাসি। লাফ দিয়ে উঠি। সুতোটা সরে যায়। অল্প দূরেই আবার স্থির হয়ে বাতাসে দোল খায়। আমি এগোই। সুতোটা সরে যায়। আমি এগোই। আমি এগোতে থাকি। ক্রমে সংসারের কোলাহল দূরে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় পৃথিবী। ঘুড়িটা টলতে টলতে এগোয়। সুতোটা আমার হাতের নাগালে–নাগালে থাকে। ধরা দেয় না।

ক্রমে আমরা আশ্চর্য এক অচেনা পৃথিবীতে চলে যেতে থাকি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments