Monday, August 25, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পভয়ভুতুড়ে - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভয়ভুতুড়ে – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। বড় অদ্ভুত বিজ্ঞাপন।

সস্তায় ভূত কিনুন!
বাচ্চা ভূত মাত্র পঞ্চাশ পয়সা
ধেড়ে ভূত মাত্র এক টাকা
জাল ভূত নয়। একেবারে আসল ভূত!!
ভূতনাথ অ্যান্ড কোং
১/১ কালোবাজার স্ট্রিট
(লালবাজারের উল্টোদিকে)
কলকাতা

ভাগ্নে নেপাল তার মামা নকুলেশ্বরকে বলল,–ও মামা, ভূত কিনবেন? এই দেখুন, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

নকুলেশ্বর বললেন, তাই নাকি? দেখি, দেখি!

বিজ্ঞাপন পড়ে নকুলেশ্বর নেচে উঠলেন। তার নানারকম জন্তুজানোয়ার এবং পাখি পোষার শখ আছে বরাবর। বাড়ির ছাদে আস্ত একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছেন। সেখানে এখন বাঘ-ভালুক না থাকলেও ছোট-ছোট জন্তু অনেক আছে। বাঘ-ভালুক একসময় ছিল। তাদের খোরাক জোগাতে না পেরে সার্কাস কোম্পানিকে বেচে দিয়েছিলেন। এখন আছে গোটা দুই খরগোশ, একটি হরিণের বাচ্চা, একটা খেকশিয়াল, একটা ভোদড়, দুটো বেজি আর পাঁচটা গিনিপিগ। পাখিও আছে কয়েকরকম। মামা-ভাগ্নে তাদের নিয়েই থাকেন।

নকুলেশ্বরের বরাবর সাধ ছিল, একটা ভূত রাখবেন চিড়িয়াখানায়। কিন্তু ভূত পাবেন কোথায়? ভাগ্নেকে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরেছেন শ্মশানে, পোড়ো-বাড়িতে, চিলেকোঠায়। ভূত পাননি। এখন কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লেন দুজনে।

অনেক খুঁজে ভূতনাথ অ্যান্ড কোং বের করলেন। একটা বিরাট পুরোননা বাড়ির ভেতর অনেক ঘোরালো সিঁড়ি বেয়ে অনেক করিডর পেরিয়ে তিনতলায় কোনার দিকে একটা ছোট্ট ঘরের দরজায় কোম্পানির নাম দেখতে পেলেন।

টুলে বেয়ারা বসেছিল। বলল, চলিয়ে যান অন্দরমে।

বেয়ারার কালো কুচকুচে চেহারা, রোগা-পটকা গড়ন। গোঁফটা প্রকাণ্ড। নেপাল ও নকুলেশ্বর চোখাচোখি করলেন। তার মানে, বেয়ারাটা মানুষ বটে তো? বলা যায় না।

ঘরের ভেতর আলো নেই। আবছা আঁধার। ঢুকে কিছু দেখতে পেলেন না নকুলেশ্বর। আর কেমন একটা চিমসে গন্ধ। নেপাল ফিসফিস করে বলল, ভূতের গায়ে কেমন গন্ধ মামা। বড় বিচ্ছিরি।

নকুলেশ্বর বললেন,-তা তো হবেই। কিন্তু ঘরে যে কাকেও দেখতে পাচ্ছিনে।

দেশলাই জ্বালুন মামা। নেপাল পরামর্শ দিল।

অমনি কে হেঁড়ে গলায় বলে উঠল,–উঁহু হুঁ। আলো জ্বালাবেন না। আলোয় ওদের কষ্ট হয়। এই যে, এখানে চলে আসুন।

নকুলেশ্বর বললেন, কিছু দেখতে পাচ্ছি না যে।

–দেখার দরকারটা কী? পয়সা দিন, জিনিস নিয়ে যান। বাড়ি গিয়ে কিন্তু অন্ধকারে দেখবেন।

–সে কি! না দেখে কিনব কেন মশাই!

–আপনি বোকার মতো কথা বলছেন। ভূত হল গিয়ে অন্ধকারের প্রাণী। আলোয় তারা বাঁচে না। যেমন ধরুন, আপনি ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে গেছেন। ফিল্মের রোল থাকে কৌটোর ভেতর। কেন থাকে জানেন নিশ্চয়। ফিল্মের রোল আলোয় খুললেই নষ্ট হয়ে যায়। একেবারে সাদা হয়ে যায়। তাই না?

নকুলেশ্বর বুঝতে পেরে বললেন, হ্যাঁ, তা যায় বটে।

–এও তেমনি। কাজেই এই ডার্করুমে ভূত বিক্রি করতে হয়। পয়সা দিন, আমি একটা কৌটো দিচ্ছি–তার মধ্যে ভূত আছে। কিন্তু আবার সাবধান করে দিচ্ছি। আলোয় খুলবেন না, ডার্করুমে রাখবেন।

–বুঝলুম। কিন্তু ওদের খেতে দিতে হবে তো?

–আলবাত দিতে হবে। অন্ধকারে কৌটো খুলে খাইয়ে দেবেন।

কী খায় ওরা জিগ্যেস করে নিন, মামা!–নেপাল পরামর্শ দিল।

অন্ধকারে লোকটা বলল, ভূতের খাদ্যও খুব সস্তা। সকালে ও বিকেলে একগ্রাম শুকনো গোবর। খাটালে পেয়ে যাবেন। দুপুরে ও রাতে কুচোচিংড়ির মাথা। ব্যস। আর সপ্তায় একদিন এক চামচ দুধ দেবেন। অবিশ্যি একটা কাগজে ভূতের লালন-পালন সম্পর্কে সব কথা লিখে ছাপিয়ে রেখেছি। একটা দেব। ভাববেন না।

নকুলেশ্বর বুদ্ধি খাঁটিয়ে বললেন, ঠিক আছে। আপাতত একটা দিন। বাচ্চা ভূতই দিন। আগে ব্যাপার-স্যাপার দেখে নেব। তারপর বরং গোটাকতক কিনব।

নেপাল বলল, বাচ্চা-ধেড়ে সবরকমই কিনব।

–কই, পঞ্চাশ পয়সা দিন তাহলে।

নকুলেশ্বর একটা আধুলি বের করে বাড়িয়ে বললেন,–নিন। অন্ধকারে একটা হাত এসে তাঁর পয়সাটা তুলে নিল এবং তক্ষুনি তাঁর হাতে একটা ছোট্ট কৌটো দিল। নকুলেশর বললেন,–এতটুকু কৌটো!

–এতটুকুই তো হবে। বাচ্চা ভূত কিনা। তা ছাড়া, আপনি নিশ্চয় জানেন, ভূতেরা ইচ্ছেমতো রূপ ধরতে পারে। প্রকাণ্ড বড় হতে পারে, আবার এতটুকুটি হতেও পারে। ওরা অদৃশ্য হতেও পারে। তাই সাবধান, কৌটোর মুখ খোলার সময় দেখবেন যেন সুড়ুৎ করে না পালায়।

নকুলেশ্বর বললেন–হ্যাঁ। তা আর বলতে। আচ্ছা, চলি। নমস্কার।

ভূতের কৌটো পকেটে পুরে মামা-ভাগ্নে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বেয়ারা সেলাম দিয়ে একগাল হেসে বলল, বহুৎ বড়িয়া চিজ বাবু। এইসা চিজ কঁহি নেহি মিলেগা।

মহা আনন্দে মামা-ভাগ্নে বাড়ি ফিরলেন ভূত কিনে।

কৌটোটা টেবিলের ড্রয়ারে রইল এবং ঘরে সে রাতে আলো জ্বাললেন না নকুলেশ্বর। পরদিন ছাদের চিড়িয়াখানায় একটা ডার্করুম বানাবেন। সেখানে বাচ্চা ভূতটা থাকবে। সকালের অপেক্ষা শুধু। মিস্ত্রিকে খবর দেওয়া হয়েছে। ঘর বানিয়ে দেবে।

রাতদুপুরে হঠাৎ শোনেন, ড্রয়ারের ভেতর কৌটোটা খুব লাফালাফি জুড়ে দিয়েছে যেন। পাশের ঘর থেকে ভাগ্নে নেপালকে ডাকলেন। বলা যায় না, ভূত সাংঘাতিক প্রাণী–বাচ্চা হলেও তো ভূত বটে। দুজনে সাহস করে ড্রয়ার খুলতেই কৌটোটা সত্যি নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছে টের পাওয়া গেল। নেপাল বলল,–ও মামা, আসলে ওর খিদে পেয়েছে।

নকুলেশ্বর বললেন,–শোবার আগে তো কুচোচিংড়ির মাথা খাইয়ে দিলুম। আবার খিদে?

–বাচ্চাদের বারবার খিদে পায় না বুঝি? আমার তো পায়।

–এখন আর কী দেব বলতো? আর তো কুচোচিংড়ির মাথা নেই। অনেক খুঁজে ছাইগাদা থেকে কিছু পেয়েছিলুম। বাজারে আজকাল চিংড়ি পাওয়া কঠিন। সব বিদেশে পাঠাচ্ছে কিনা।

–মামা, সকালের চায়ের দুধ রাখা আছে। এক চামচ এনে দিই বরং।

–তাই আন।

নেপাল দুধ আনলে নকুলেশ্বর কৌটোর মুখ খুললেন সাবধানে। দুধটুকু ঢেলে দিয়ে আদর করে বললেন লক্ষ্মীসোনা। মানিক! ঠো করে খেয়ে ফেলো তো বাবা।

তারপর বাপরে বলে লাফ দিলেন। উঁহু হু হু করে উঠলেন নকুলেশ্বর। নেপাল বলল, কী হল, মামা? কী হল?

–উঁহু হু কামড়ে দিয়েছে আঙুলে। নে, নে, কৌটো ধর নেপাল। জ্বালা করছে। বড্ড।

নেপাল কৌটো ধরে যেই কৌটোর মধ্যে হাত ঢুকিয়েছে অমনি হতচ্ছাড়াটা আবার আঙুলে কামড়ে দিল।

নেপাল কৌটো ফেলে দিয়ে বাপরে-মারে করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল।

সে এক হুলুস্থুল অবস্থা। ঠাকুর-চাকর দৌড়ে এল। বাতি জ্বালল সুইচ টিপে। দেখল মামা-ভাগ্নে আঙুল চেপে ধরে লাফালাফি করছে।

নকুলেশ্বর সেই অবস্থায় চেঁচালেন,–আলো নেভাও, আলো নেভাও।

কে নেভাবে? ঠাকুর-চাকর সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সময় ঘরে আওয়াজ শোনা গেল বো ওঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ। নিশ্চয় বাচ্চা ভূতের আওয়াজ।

ঠাকুর চেঁচিয়ে উঠল, সর্বনাশ। বোলতা, বোলতা। মস্তবড় একটা বোলতা।

নকুলেশ্বর বিকৃতমুখে বললেন, ধর-ধ। কৌটোয় পুরে দে। বোলতা নয়– বোলতা নয়। বোলতার রূপ ধরেছে।

বোলতা ধরে সাধ্য কার। বোলতাটা কিছুক্ষণ ওড়াওড়ি করে ঘুলঘুলিতে গিয়ে ঢুকল। তারপর তার আর সাড়া পাওয়া গেল না।

.

আঙুল ফুলে ঢোল মামা-ভাগ্নের। গোবিন্দ ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছিলেন। জ্বরও হয়েছিল! ঘুলঘুলিতে খোঁজা হয়েছে। বোলতা-টোলতা ছিল না।

নকুলেশ্বর মনমরা হয়ে গিয়েছিল। আহা যদি বাসা বানিয়েও থাকত ভূতের বাচ্চাটা।

জ্বর সারলে এবং আঙুলের ফোলা কমলে ফের সেই ভূতনাথ অ্যান্ড কোং এর আপিসে গেলেন। কিন্তু কোথায় কোম্পানি। ঘরের দরজায় একটা কাঠের ফলকে লেখা আছে : ভজহরি ট্রেডিং কোং লিঃ। তারা অনেক কিছু বেচেতবে ভূতটুত নয়।

খোঁজ নিয়ে জানলেন, ভূতনাথ কোম্পানি উঠে গেছে আগের দিন। পুলিশ ঝামেলা বাধিয়েছিল।

আজকাল মামা ভাগ্নে-মিলে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে পড়েন। এবার ভূত বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখলে সেখানে গিয়ে ধেড়ে ভূতই কিনবেন। বাচ্চা ভূতগুলো বড় বাজে। হিংসুটে স্বভাব। খামোকা কামড়ে আঙুল ঢোল করে দেয়।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments