Friday, May 3, 2024
Homeরম্য গল্পমজার গল্পহর্ষবর্ধনের সূর্য-দর্শন - শিবরাম চক্রবর্তী

হর্ষবর্ধনের সূর্য-দর্শন – শিবরাম চক্রবর্তী

হর্ষবর্ধনের সূর্য-দর্শন - শিবরাম চক্রবর্তী

সূর্যদর্শন না বলে সূর্যগ্ৰাস বললেই ঠিক হয় বোধ হয়।

রাহুর পরে এক মহাবীরই যা সূর্যদেবকে বগলদাবাই করেছিলে, কিন্তু যতো বড় বীরবাহুই হন না, হর্ষবর্ধনকে হনুমানের পর্যায়ে কখনো ভাবাই যায় না।

তাই তিনি যখন এসে পড়লেন, সূয্যি মামাকে দেখে নেবো এইবার, তখন বলতে কি, আমি হা হয়ে গেছলাম।

আমার হা কারের কোনো জবাব না দিয়েই তিনি হেঁয়ালি পাড়লেন, সুন্দরবনের বাঘ শিকার তো হয়েছে, চলুন এবার পাহাড়ে বাঘটাকে দেখে আসা যাক।

যদ্দুর আমার জানা, না বলে আমি পারলাম না, বাঘরা পাহাড়ে বড়ো একটা থাকে না। বনে জঙ্গলেই তাদের দেখা মেলে। হাতিরাই থাকে পাহাড়ে। পাহাড়দের হাতিমার্কা চেহারা দেখেছেন তো?

কে বলছে আপনাকে? তিনি প্রতিবাদ করলেন আমার কথার, টাইগার হিল তাহলে বলেছে কেন? নাম শোনেনি টাইগার হিলের?

শুনবো না কেন? তবে সে হিলে, যদ্দুর জানি, কোনো টাইগার থাকে না। বাবুরা বেড়াতে যান।

সূর্যিঠাকুর সেই পাহাড়ে ওঠেন রোজ সকালে সে নাকি অপূর্ব্ব দৃশ্য!

তাই দেখতেই তো যায় মানুষ।

আমরা যাবো। আমি, আপনি আর গোবরা। এই তিনজন।

বিকেলের দিকে পৌঁছালাম দার্জিলিঙে। টাইগার পাহাড়ের কাছাকাছি এক হোটেলে ওঠা গেল।

খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত করে হোটেলের মালিককে অনুরোধ করলাম দয়া করে আমাদের কাল খুব ভোরের আগে জাগিয়ে দেবেন….

কেন বলুন তো?

আমরা এক-একটি ঘুমের ওস্তাদ কিনা, তাই বলছিলাম।

ঘুম পাহাড়ও বলতে পারেন আমাদের। বললেন হর্ষবর্ধন যে ঘুম পাহাড় খানিক আগেই পেরিয়ে এসেছি আমরা! তাই আমাদের এই পাহাড়ে ঘুম সহজে ভাঙবার নয় মশাই।

নিজগুণে আমরা ঘুম থেকে উঠতে পারবো না, গোবরাও যোগ দিলো আমাদের কথায় তাই আপনাকে এই অনুরোধ করছি…।

কারণটা জানতে পারি?

কারণ? আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, অদূরে এসেছি কেবল দূর্যোদয় দেখবার জন্য।

সূর্যোদয় দেখবার জন্য? কেন, কলকাতায় কি তা দেখা যায় না? সেখানে কি সূর্য ওঠে না নাকি?

উঠবে না কেন, কিন্তু দর্শন মেলে না। চারধারেই এমন উঁচু.উঁচু সব বাড়িঘর যে, সূয্যি ঠাকুরের ওটা নামার খবর টের পাবার জো নেই।

তাছাড়া তালগাছও তো নেইকো কলকাতায়, থাকলে না-হয় তার মাথায় উঠে দেখা যেতো.. গোবরা এই তালে একটা কথা বললো বটে তালেবরের মতন!

তাল গাছ না থাক, তেতলা বাড়ি আছে তো? তার ছাদে উঠে কি দেখা যেতো না? বলতে চান ম্যানেজার।

থাকবে না কেন তেতলা বাড়ি। তেতাল, চৌতাল, ঝাঁপতাল সবরকমের বাড়িই আছে। বলে হর্ষবর্ধন তার উল্লিখিত শেষের বাড়ির বিশদ বর্ণনা দেন, ঝাঁপতাল বাড়ি নামে যে-সব সাত-দশ তল বাড়ির থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরবার তালে ওঠে মানুষ, তেমন বাড়িও আছে বইকি! কিন্তু থাকলে কি হবে, তাদের ছাদে উঠেও বোধ হয় দেখা যাবে না সূর্যোদয়! দূরের উঁচু উঁচু বাড়ির আড়ালেই ঢাকা থাকবে পূর্ব্ব আকাশ।

এক হয়, যদি মনুমেন্টের মাথায় উঠে দেখা যায়…আমি জানাই।

তা সেই মনুমেন্টের মাথায় উঠতে হলে পুরো দিন লাগবে মশাই আমার এই দেহ নিয়ে…দেহটা দেখেছেন?

হর্ষবর্ধনের সকাতর আবেদনে হোটেলের মালিক তার দেহটি অবলোকন করেন। তারপরে সায় দেন–তা বটে।

তবে দেখুন এ জন্মে আমার সূর্যোদয়ই দেখা হচ্ছে না তাহলে এই মানবদেহ ধারণ বৃথাই হলো…।

তাই আমাদের একান্ত অনুরোধ….

এখানে নাকি অবাধে সূর্যোদয় দেখা যায়, আর তা নাকি একটা দেখাবার জিনিস সত্যিই…

সেই কারণেই আপনাকে বলছিলাম…

আমাদের যুগপৎ প্রতিবেদন-দয়া করে আমাদের ভোর হবার আগেই ঘুম থেকে তুলে দেবেন। এমনকি, দরকার হলে জোর করেও।

কোনো দরকার হবে না। তিনি জানান, রোজ ভোর হবার আগে এমন সোরগোল বাধে এখানে যে তার চোটে আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে যাবে আপনাদের।

সোরগোলটা বাধে কেন?

কেন আবার? ঐ সূর্যোদয় দেখবার জন্যেই। যে কারণে যেই আসুক না, হাওয়া খেতে কি বেড়াতে কি কোনো ব্যবসার খাতিরে, ঐ সূর্যোদয়টি সবারই দেখা চাই। হাজার বার দেখেও আশ মেটে না কারো। একটা বাতিকের মতই বলতে পারেন।

আমরাও. এখানে চেঞ্জে আসিনি, বেড়াতে কি হাওয়া খেতেও নয়– এসেছি ঠিক কি কারণেই…।

তাই রোজ রোজ হবার আগেই হোটেলের বোর্ডাররা সব গোল পাকায়, এমন হাঁকডাক ছাড়ে যে, আমরা, মাসে এই হোটেলের কর্মচারীরা, যারা অনেক রাতে কাজকর্ম সেরে ঘুমতে যায় আর অত ভোরে উঠতে চায় না, সূর্য ভাঙিয়ে আমাদের ব্যবসা হলেও সূর্য দেখার একটুও গরজ নেই, যাদের, একদম সেজন্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদেরও বাধ্য হয়ে উঠতে হয় ঐ হাঁকডাকের দাপটে। কাজেই আপনাদের কোনো ভাবনা নেই কিছু করতে হবে না আমাদের। কোন বোর্ডারকে আমরা ডিস্টার্ব করতে চাইনে কারও বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো আমাদের নিয়ম নয়…তার দরকার হবে না, সাত সকালেই সেই গোলমালে আপনাদের ঘুম যতই নিটোল হোক না কেন, না ভাঙলেই আনু অবাক হবো।

অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে হোটেলের ঘরে আমাদের মালপত্র রেখে বিকেলের জলযোগ পর্ব চা-টা সেরে বেড়াতে বেরুলাম আমরা।

তখন অবশ্য সূর্যোদয় দেখার সময় ছিল না, কিন্তু তা ছাড়াও দেখবার মতো আরো নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মজুদ ছিল তো। সেই সব অপূর্ব্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতেই আমরা বেরুলাম।

সন্ধে হয় হয়। এ-ধারের পাহাড়ের পথঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকাই এখন। একটা ভুটিয়ার ছেলে একপাল ভেড়া চরিয়ে বাড়ি ফিরছে গান গাইতে গাইতে।

শুনে হর্ষবর্ধন আহা-উঁহু করতে লাগলেন।

আহা আহা! কী মিষ্টি! কী মধুর…

কেমন মূছনা! যোগ দিল গোবরা। শুনে প্রায় মূছনা হয় আর কী!

একেই বলে ভাটিয়ালি গান, বুঝেছিস গোবরা? কান ভরে শুনে নে, প্রাণ ভরে শোন।

ভাটিয়ালি গান বোধ হয় এ নয়, মৃদু প্রতিবাদ আমার–সে গান গায় পূর্ব্ব-বাংলার মাঝিরা, নদীর বুকে নৌকার ওপর বৈঠা নিয়ে বসে। ভাটির টানে গাওয়া হয় বলেই বলা হয় ভাটিয়ালি।

তাহলে এটা কাওয়ালি হবে। সমঝদারের মতন কন হর্ষবর্ধন।

তাই-বা কি করে হয়? গোরু-চরাতে চরাতে গাইলে তাই হতো বটে, কিন্তু cow তো নয়, ও তো চারাচ্ছে ভেড়া।

কাওয়ালিও নয়? হর্ষবর্ধন যেন ক্ষুণ্ণ হন।

রাখালী গান বলতে পারো দাদা। ভাই বাতলায়, ভেড়া চরালেও রাখালই তো বলা যায় ছোঁড়াটাকে।

লোকসঙ্গীতের বাচ্চা বলতে পারেন। আমিও সঙ্গীতের গবেষণায় কারো চাইতে কম যাই না, এই বেড়ালই যেমন বনে গেড়ে বনবেড়াল হয়। তেমনি এই বানকই বড়ো হয়ে একদিন কে বিষ্ণু লোক হবে। অন্তত যখন ওর গোঁফ বেরুবে গানকে অক্লেশে লোকসঙ্গীত বলা যাবে। এখন নেহাৎ বালকসঙ্গীত।

ভেড়ার পাল নিয়ে ছেলেটা কাছিয়ে এলে হর্ষবর্ধন নিজের পকেট হাতড়াতে লাগলেন–ওকে কিছু বকশিস দেওয়া যাক। ওমা! আমার মানিব্যাগটা তো হোটেলের ঘরে ফেলে এসেছি দেখছি। আপনার কাছে কিছু আছে? নাকি, আপনিও ফেলে এসেছেন হোটেলে?

পাগল! আমি প্রাণ হাত ছাড়া করতে পারি, কিন্তু পয়সা নয়। আমার যৎসামান্য যা কিছু আমার সঙ্গে থাকে আমার পকেটে আমার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে কিনা।

বলতে গিয়েও বাধে আমার। চক্রবর্তীরা যে কঞ্জুস হয়, সে-কথা মুখ ফুটে বলি কি করে? নিজ গুণ কি গণনা করবার?

তাহলে ওকে কিছু দিন মশাই! একটা টাকা অন্তত।

দিলাম।

টাকাই পেয়ে তো ছেলেটা দস্তুরমত হতবাক। পয়সার জন্য নয়, প্রাণের তাগাদার অকারণ পুলকেই গাইছিল সে। তাহলেও খুশি হয়ে, আমাদের সেলাম বাজিয়ে নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে সে চলে গেলো।

খানিকবাদে সেই পথে আবার এক রাখাল বালকের আবির্ভাব! সেই ভেড়ার পাল নিয়ে সেইরকম সুর ভাজতে ভাজতে….তাকেও এক টাকা দিতে হয়।

আবার খানিকবাদে আবার আরেক! পঞ্চম গলা চড়িয়ে ফিরছে ঐ–পথেই।

তার স্বরাঘাতের হাত থেকেই রেহাই পেতে, অর্ধচন্দ্র দেওয়ার মতো একটা আধুলি দিয়ে তাকে বিদায় করা হলো।

তারপর আরো আরো মেষপালকের গাইয়ে বালকের দল আসতে লাগল পরম্পরায়…ঐ পথে, আর আমিও তাদের বিদায় দিতে লেগেছি। তিনটাকে আধুলি, চারটেকে পঁচিশ পয়সা করে, বাকীগুলোকে পুঁজি হালকা হওয়ার হেতু বাধ্য হয়েই দশ পয়সা, পচ পয়সা করে দিয়ে তাদের গন্তব্য পথে পাচার করে দিতে হলো।

সেই একটা ছেলেই ঘুরে ঘুরে আসছে নাতো দাদা, গোবরা সন্দেহ করে শেষটার পয়সা নেবার ফিকিরে?

সেই একটা ছেলেই নাকি মশাই? দাদা শুধান আমায়।

কি করে বলব? একটা ভুটিয়ার থেকে আরেকটা ভুটিয়াকে আলাদা করে চেনা যার পক্ষে শক্ত। এক ভেড়ার পালকে আরেক পালের থেকে পৃথক করা কঠিন। আমার কাছে, সব ভেড়াই একরকম। এক চেহারা।

বলেন কি? হর্ষবর্ধন তাজ্জব হন।

হ্যাঁ সব এক ভ্যারাইটি। যেমন এক চেহারা তেমনি এক রকমের স্বরলরী–কি ভেড়ার আর কি ভুটিয়ার!

আসুন তো, পাশের টিলাটার ওপরে উঠে দেখা যাক ছেলেটা যায় কোথায়! ছেলেটা

যেতেই আমরা টিলাটার ওপরে উঠলাম,

ঠিক তাই; ছেলেটা এই টিলাটার বেড় মেরেই ফের আসছে বটে ঘুরে.. গলা ছেড়ে দিয়ে সুরের সপ্তমে।

কিন্তু এবার আর সে আমাদের দেখা পেল না।

পেয়ে, টিলাটাকে আর চক্কর না মেরে তার নিজের পথ ধরল সে। আর চক্ৰত্তের থেকে মুক্তি পেলাম আমরাও।

কিন্তু ছেলেটা আমাকে কপর্দকশূন্য করে দিয়ে গেলো। আরেকটু হলে তার গানের দাপটে আমার কানের সবকটা পর্দাই সে ফাটিয়ে দিয়ে যেত। তাহলেও কানের পাতলা পর্দার বেশ কয়েকটাই সে ঘায়েল করে গেছে, শেষ পর্দাটাই বেঁচে, গেছে কোন রকমে। আমার মত আমার কানকেও কপর্দকশূন্য করে গেছে।

তাহলেও কোনো গতিকে কানে কানে বেঁচে গেলাম এ-যাত্রায়।

প্রাকৃতিক মাধুরীর প্রচুর ভুরিভোজের পর বহুৎ হন্টন করে হোটেলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো।

তখন ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলুঢুলু, পা টলছে। কোনো রকমে কিছু নাকে মুখে গুঁজেই আমাদের ঘরের ঢালাও বিছানায় গিয়ে আমরা গড়িয়ে পড়লাম।

গোবরাভায়া, দরজা জানলা খড়খড়ি ভালো করে এঁটে দাও সব। নইলে কোনো ফাঁক পেলে কখন এসে বৃষ্টি নামবে, তার কোনো ঠিক নেই। বললাম আমি গোর্বধনকে।

এটা তো বর্ষাকাল নয় মশাই।

দার্জিলিঙের মেজাজ তুমি জানো না ভাই। এখানে আর কোনো ঋতু নেই, গ্রীষ্ম নেই, বসন্ত নেই, শরৎ নেই, খালি দুটো ঋতুই আছে কেবল। শীতটা লাগাতার আর বর্ষণ যখন তখন।

তার মানে?

চার ধারেই হালকা মেঘ ঘুরছে নজরে না ঠাওর হলেও। মেঘলোকের উচ্চতাতেই দার্জিলিং তো। জানলা খড়খড়ির ফাঁক পেলেই ঘরের ভেতরে সেই মেঘ এসে বৃষ্টি নামিয়ে সব ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবে।

বলেন কি?

তাই বলছি। আমি বললাম কিন্তু আর বলতে পারছি না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম…

ঘুমোচ্ছন তো! কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে ঘুমোবেন। হাঁকলেন হর্ষবর্ধন।

তেমন করে কি ঘুমানো যায় নাকি? আমি না বলে পারি না চোখ তো বুজতে হবে অন্তত।

কিন্তু কান খাড়া রাখুন। কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে ঘুমোন। একটু সোরগোল কানে এলেই বুঝবেন ভোর হয়েছে। জাগিয়ে দেবেন আমাদের।

দেখা যাবে। বলে আমি পাশ ফিরে শুই। কান দিয়ে কদুর কতটা দেখতে পারবো তেমন কোনো ভরসা না করেই।

এক ঘুমের পর কেমন একটা আওয়াজ আমার কান খাড়া হয়। আমি উঠে বসি বিছানায়। পাশে ঠেলা দিই গোবরাকে–গোবরা ভায়া, একটা আওয়াজ পাচ্ছো না?

কিসের আওয়াজ?

পাখখায়াজ বাজছে যেন। কেউ যেন ভৈরো রাগিণী সাধছে মনে হচ্ছে। ভৈরো হললাগে ভোরবেলার রাগিণী। ভোরবেলায় গায়।

পাথোয়াজ বাজছে? গোবরাও কান তুলে শোনবার চেষ্টা করে।

হর্ষবর্ধনও সাড়া দেন ঘুম থেকে উঠে কি হয়েছে? ভোর হয়েছে নাকি?

খানিক আগে কি রকম যেন একটা সোরগোল শুনছিলাম–আমি বললাম।

ভোর হয়েছে বুছি?

ভাবছিলুম তাই। কিন্তু আর সেই হাঁকডাকটা শোনা যাচ্ছে না।

শুনবেন কি করে? বলল গোবরা–দাদা জেগে উঠলেন যে! দাদাই তো নাক ডাকাচ্ছিলেন এতক্ষণ।

কখনো না। বললেই হলো! কখনো আমার নাক ডাকে না, ডাকলে আমি শুনতে পেতুম না নাকি? ঘুম ভেঙে যেতো না আমার?

তুমি যে বদ্ধকালা। শুনবে কি করে? নইলে কানের অত কাছাকাছি নাক! আর ওই ডাকাত পড়া হাঁক তোমার কানে যেতে না?

তুমি একটা বদ্ধ পাগল! তোর সঙ্গে কথা কয়ে আমি বাজে সময় নষ্ট করতে চাই নে।বলে দাদা পাশ ফিরলেন আবার তাঁর হাঁকডাক শুরু হলো।

এরপর, অনেকক্ষণ পরেই বোধহয়, হর্ষবর্ধনই জাগালেন আমাদের কোনো সোরগোল শুনছেন?

কই না তো। আমি বলি–বিলকুল চুপচাপ।

এতক্ষণেও ভোর হয়নি? বলেন কি! জানলা খুলে দেখা যাক তো…তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে জানলাটা খুললেন–ওমা! এই যে বেশ ফর্সা হয়ে এসেছে, উঠুন! উঠুন! উঠে পড়ন। চটপট।

আমরা ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।

জামা কাপড় পরে না! সাজগোজ করার সময় নেই তাছাড়া দেখতেই যাচ্ছেন, কাউকে দেখাতে যাচ্ছেন না। নিন, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। দেরি করলে সূর্যোদয়টা ফসকে যাবে।

তিনজনেই শশব্যস্ত হয়ে আপাদমস্তক কম্বল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টাইগার হিলের উঁচু টিলার কাছেই। হন্তদন্ত হয়ে তিনজনায় গিয়ে খাড়া হলাম তার ওপর। বিস্তর লোক গিজগিজ করছে সেখানে। নিঃসন্দেহে, সূর্যোদয় দেখতে এসেছে সবাই।

মশাই। সূর্য্যি উঠতে দেরি কতো? হর্ষবর্ধন একজনকে শুধালেন।

সূর্য্যি উঠতে? ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে ওঁর কথায় জবাব দিলেন।

বেশি দেরি নেই আর। আমি বললাম–আকাশ বেশ পরিষ্কার। দিগ্বিদিক উদ্ভাসিত….উঠলো বলে মনে হয়।

কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। হর্ষবর্ধন বাধ্য হয়ে আরেকজনকে শুধান সূয্যি উঠচে না কোন মশাই?

এখন সূর্য উঠবে কি? সোকে অবাক হয়ে তাকান তার দিকে।

মানে, বলছিলাম কি সূর্য তো ওঠা উচিত ছিলো এতক্ষণ। পূবের আকাশ বেশ পরিষ্কার। সূর্যের আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে অথচ সূর্যের পাত্তা নেই।

সূর্য কি উঠবে না নাকি আজ? আমার অনুযোগ।

ঐ মেঘটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য, তাই দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি জানালেন মেঘটা নরে গেলেই

বলতে বলতে মেঘ সরে গেলো প্রকাশ পেলেন সূর্যদেব!

ও বাবা! অনেকখানি উঠে পড়েছেন দেখছি! বেলা হয়ে গেছে বেশ। আপসোস করলেন হর্ষবর্ধন সূর্যোদয়টা হাতছাড়া হয়ে গেলো দেখছি আজ।

ওমা! একি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি নেমে যাচ্ছে যেন! নামছে কেন সূয্যিটা? নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে যে! এ-কি ব্যাপার?

এরকমটা তো কখনো হয় না! আমিও বিস্মিত হইয়া সূর্যের এমন বেচাল ব্যাপার তো দেখা যায় না কখনো।

হ্যাঁ মশাই, এরকমটা হয় নাকি এখানে মাঝে মাঝে? একটু না উঠেই নামতে থাকেন আবার পথ ভুল হয় সূর্যদেবের?

তার মানে?

তার মানে, আমরা সূর্যোদয় দেখতে এসেছি কিনা। উদীয়মান সূর্য দেখতে না পাই, উদিত সূর্য দেখেও তেমন বিশেষ দুঃখিত হইনি-কিন্তু একি! উঠতে না উঠতে নামতে লাগলো যে!

আপনার জন্যে কি পশ্চিম দিকে উঠবে নাকি সূর্য অস্ত যাবার সময় সূর্যোদয় দেখতে এসেছেন! আঁঝালো গলা শোনা যায় ভদ্রলোকের–

কোথাকার পাগল সব! আরেক জন উতোর গেয়ে ওঠেন তাঁর কথার।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments